লক ডাউনে বসে বসে বোর হচ্ছি। কিচ্ছু ভালো লাগে না। ঘুমাতে ঘুমাতে টায়ার্ড হয়ে আবার ঘুমাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠলেই টিটকারি স্বরূপ আব্বু বলে,”অনেক তো ঘুমাইলা। এখন একটু রেস্ট নাও।” আম্মু ফুয়াদ ডেকে আমার কথা বলে,”দেখে আয় তো, মরছে কি-না!” তো এই হচ্ছে অবস্থা।
আজকে সকাল থেকে আরও সবকিছু অসহ্য মনে হচ্ছে। নিজেকে পাগল মনে হয়। মেন্টাল হসপিটালগুলোতে যেমন পাগলদের বন্দী রাখা হয়, আমারও হয়েছে সেই অবস্থা। আব্বুকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণ বই নাড়াচাড়া করলাম। ভেতর থেকে হাহাকার করে উঠলো আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়। কিছুই যে পারি না! সব ভুলে গেছি! রাগও হচ্ছে নিজের উপর। রাগটা কারোর উপর ঝাড়তে ইচ্ছা হলো। ঠিক এই সময় দেখলাম আমার সেভেনে পড়া ছোট ভাইটা আরামসে কার্টুন দেখছে। মনে মনে ভাবলাম এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। ওর কাছে গিয়ে রিমোট কেড়ে নিয়েই দিলাম কষে এক চড়। বললাম,”কি দেখস এগুলা? শিক্ষণীয় কিছু দেখতে পারস না?যত্তসব। এত্ত বড় হইছোস তাও কার্টুন দেখস।”
কথা শেষ করতে না করতেই আমার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে চুল ধরে ঘুরানী দিলো একটা। তারপর ইচ্ছামত কিল, ঘুষি।
আলহামদুলিল্লাহ! এখন প্রচুউউর ভাল্লাগতাসে। রাগ সব মাটি হয়ে গেছে। আর শরীরে মোটামুটি একটা ভাবও চলে আসছে। করুন স্বরে শুধু বললাম,”আজকে মারছস,,,কিছু বললাম না। আরেক দিন শুধু মারতে আসিস ওইদিন দেখায় দিবো মাইর কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি!”
যাই হোক,এটা হচ্ছে আমার ডায়লগ। প্রতিবার মাইর খাওয়ার পরে এই ডায়লগ ছাড়ি। তাই সে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে আবার কার্টুন দেখায় মনোনিবেশ করলো।
এদিকে আব্বু আর আম্মুর তুমুল ঝগড়া গানের কলি খেলা নিয়ে। ব্যাপারটা এই, আব্বু নিজের মতো করে বানিয়ে বানিয়ে গান বলছে। লিরিক্সের কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। আম্মুর রাগ উঠে গেলো। আব্বু ভুলভাল লিরিক্স নিয়ে নিজের বেসুরো গলাকে সুরেলা কন্ঠ প্রমাণ করতে চাইছেন। বিশিষ্ট সংগীত সাধক মাহফুজুর রহমান ফেল আব্বুর কাছে। আস্তে আস্তে তর্ক, তর্ক থেকে ঝগড়া। এক পর্যায়ে আব্বু আব্বুর শ্বশুরবাড়ির দুর্নাম শুরু করে দিয়েছেন আর আম্মু আম্মুর শ্বশুরবাড়ির দুর্নাম। কবে কে কোন কালে কি করছিলো একেক জন বর্ননা করে যাচ্ছেন।
এদিকে আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কার পক্ষ নিলে সুবিধা পাওয়া যাবে। ফুয়াদকে দেখছি আব্বুর সাথে তাল মিলাচ্ছে। আমিও আব্বুর সাপোর্টই নিতাম। কারণ, এই পক্ষে লাভ বেশি। কিন্তু বেচারি আম্মু একা ঝগড়া করতে পারবে না বলে আমি আম্মুর সাপোর্ট নিলাম। কিন্তু ঝগড়ার মোড় ঘুরে গেলো। একসময় দেখা গেলো এরা দুইজনই আমাকে দোষারোপ করা শুরু করে দিয়েছে। দুইজনই তাল মিলিয়ে বলতে শুরু করলো,”এহ্ মাতাব্বর আসছে। তুই কি বুঝস?” এর সাথে যোগ দিলো ফুয়াদ। একটু আগের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলো। বলা বাহুল্য, ও নিজেকে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করে আমাকে ঠিক যেন ডাস্টবিনে দৃশ্যমান সাতদিনের পচা কাঁঠাল হিসেবে তুলে ধরলো। আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু এখন আমি। তিনজন মিলে আমার উপর দিয়ে কথার ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন। আমি অবশ্য মোড়টা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেও বেশি সুবিধা করতে পারলাম না।
এভাবে ২ ঘন্টা ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। আম্মু এখন বলছে,”সব দোষ বড়টার। এইটার দেখাদেখি ছোটটাও পাজি হইতেছে। ” আব্বু বলছে,”মায়ের শিক্ষাই আসল শিক্ষা। মা যা শেখাবে, সন্তান তো তাই শিখবে।” ব্যস! এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। ঝগড়ার মোড়টা এখন বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ঘুরে আবার আব্বু আম্মুতে পৌঁছে যাচ্ছে। আম্মু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,”ও তার মানে আমি খারাপ! দেখলি? কত বড় কথাটা আমাকে বললো।” এবার আর আমি কোনো রিস্ক নিলাম না। আম্মুর সাপোর্টার হয়ে তখন বিরাট ভুল করছিলাম। এখন আব্বুর দলে চলে গেলাম। আম্মু এখন একা।
সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী জানানো যাচ্ছে যে, আমরা এখনও অনাহারে আছি। রান্নাঘরে লক ডাউন চলছে। আম্মু ঘোষণা করেছেন তিনি আর রান্না করবেন না। আলহামদুলিল্লাহ! লক ডাউন এখন খুব ট্যাশ লাগছে আমাদের কাছে।