বিয়ের সাজে

আম্মু যখন মৌণতার সামনে আমাকে বলল “দেখ নিলয়, তোর বাদরামো ছোট থেকেই সহ্য করছি, তাই বলে ঘরে বউ নিয়ে আসবি আর সেটা মেনে নেবো তা কখনই হবে না। ধুর হয়ে যা সামনে থেকে।” কথাটা শুনে আমি মৌণতার দিকে তাকায়। সে আমার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে আছে। মৌণতার হা হয়ে থাকাটা এটাই বলে যে সে অবাক হয়ে গেছে। অবশ্য অবাক হওয়ারই কথা। কারন, মৌণতার গায়ে বিয়ের নতুন দামী শাড়ি, গায়ে গহনা। সব মিলিয়ে মৌণতা বিয়ের সাজে সেজে আছে। আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম…

– আসলে আম্মু, আমি জানি যে….
– চুপ, বেয়াদপ। কাল যে বেরিয়েছিলি আর আজ এসেছিস। সাথে বউ। তোর কথা আমার একদমই শোনার ইচ্ছে নেই। আমার সামনে থেকে যা।
.
আমি আম্মুর কথা শুনে আবারো মৌণতার দিকে তাকালাম। সে মাথা নিচু করে আছে। আমি মৌণতার হাত ধরলাম। সে মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল। মৌণতার চোখে কান্নার হালকা আবরণ আমি ঠিক টের পাচ্ছি। তবে সেটা মুছে দেওয়ার কোনো অধিকার বা সাহস আমার আপাতত নেই। চোখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য আমার কাছে দুটো জিনিস খুব দরকার। সেটা হল অধিকার আর সম্পর্ক। যা মৌণতার প্রতি আমার কোনোটাই নেই। তাই কোনো এক অজানা কারনেই হাতটা শক্ত করে ধরেছি।

– আরে নিলয়, দেখি দেখি আমাদের নিলয়ের বউ টা দেখি? ওহ বাবা রে, কি সুন্দর বউটা। এই নিহি.. দেখ দেখ তোর ছোট ভাবিকে দেখে যা।

ভাবির কথা শুনে মৌণতা মুখ তুলে তাকায়। আমি আড়চোখে বাম হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত দুইটা ছুই ছুই। মৌণতাকে নিয়ে যখন বাড়ির কলিংবেল চাপিয়ে অপেক্ষা করছি, ভাবি কিংবা বোন এসে দরজা খুলবে। আর ওদের ম্যানেজ করে মৌণতাকে নিজের বাড়িতে রেখে দেবো। কিন্তু সব প্ল্যান মাটিতে দুমড়ে পড়েছে আম্মুর দরজা খোলাতে। এখন আমার উপর দিয়ে কি কি ঝড় বয়ে যাবে তা আপাতত গ্রহন করা ছাড়া আমার কোনো কাজ দেখছি না।

– নিলয়ন্না রে… তুই কি মাল রে ভাই। সারাটা জীবন দেখেছি আমার ক্ষ্যাত মার্কা বান্ধবিরাও তোকে পাত্তা দেয়না আর শেষমেশ তুই এত কিউট একটা বউ ম্যানেজ করলি? ওরে বাটপার, ওরে চি….(বোন)
– এক চড়ে না, তোর যত দাঁত পড়বে, সবগুলো দিয়ে ফুটবল খেলবো বুঝলি? আমার সামনে থেকে যা তুই।
– নিলয়, তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? (আম্মু)

আম্মুর কথা শুনে আবারো চুপ হয়ে গেলাম। আম্মুকে কেনো যেন আজ খুব ভয় করছে। অবশ্য ভয় হওয়ারই কথা। কারন কোনো ছেলে যদি কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে যায় আবার হুট করে বউ নিয়ে বাড়িতে আসে তাহলে প্রতিটা মা বাবার রাগ হওয়ারই তো কথা। তবে মৌণতা আমার বউ না। আবার সে আমার প্রেমিকাও নয়। মৌণতা হল সাকিব ভাইয়ের আদরের প্রেমিকা, বউ ও হতে পারতো। তবে আমি মৌণতাকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসাটা হুট করেই আসেনি। মৌণতাকে তো আমি চিনতামও না।
.
আমি মৌণতার হাত ধরে চলে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই শুনলাম…

– আরে, নিলয়ের আম্মু, আমার বউ। এতরাতে চেঁচামেচি না করে একটা বিষয় ভেবে দেখো তো, ছেলে কিন্তু সোজা না পালিয়ে বউয়ের হাত ধরে বুক উঁচিয়ে সোজা বাড়িতে চলে এসেছে। জানি আমাদের মান সম্মান কিন্তু নষ্ট হবে। সবাই বলবে, আদনান সাহেবের ছেলে নিলয় কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করো বউ নিয়ে এসেছে। সবাই কিন্তু এটা বলবে না, নিলয় পালিয়ে গিয়েছে। আবার কোনো মেয়ের সাথে নোংরামো করেছে। তাই বলি কি, অন্তত রাতটুকু ওদের থাকতে দাও। আর তুমিও মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখো যে আমি ঠিক বলেছি কি না?
.
আমি ঘুরে সোজা হলাম। টাকলু মানে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আমি হা হয়ে গেলাম। কারন লোকটা এতদিন আমার সবসময় বাঁশ দিয়ে এসেছে। আর আজ সাইড নায়ক হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। ভাবতেই নিজেই গর্বে যেন আট সন্তানের বাপ হতে চাইছে মন। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আম্মু যা বললো তাতে শুনে মৌণতা ও আমি দুজনেই ঢোক গিললাম..

– ঠিক আছে, তবে কাল সকালেই মেয়েটার বাবা মাকে কল করে এখানে আসতে বলবে, তোমরা দুজনে যে এমনটা করবে তা ভাবিনি। দুই পরিবারের সম্মানের খাতিরে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আসো।

মৌণতার দিকে তাকিয়ে আম্মু গম্ভীর গলায় যা বললো তাতে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কারন মৌণতার বাবা আর যাইহোক যদি জানেন আমিই ওনার মেয়েকে নিয়ে বউ করে বাড়িতে উঠেছি এতে আর রক্ষা নেই। কারন মৌণতার বাবা একজন মেওর। ওনার মেয়ের সাথে সাকিব ভাইয়ের প্রেম এটা জানার পর থেকেই সাকিব ভাইকে যে কতবার পিটিয়েছে তার কোনো শেষ নেই। শুধু সাকিব ভাই না, এলাকা, এলাকার বাইরেও কোনো ছেলে যদি মৌণতার সাথে মিশেছে তবে সেই ছেলের যে অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে তা নিজের চোখে দেখে দেখে ভয়ে চুপসে গিয়েছি কতবার তার কোনো ঠিক নেই।

এ কারনেই মৌণতার সাথে দেখা করতে গেলে সাকিব ভাই আমাকে সাথে নিবেই। এলাকার বাইরে সাকিব ভাইয়ের সাথে মৌণতাকে নিয়ে ঘুরতে হয়েছে। অবশ্য সাকিব আমাকে কেনো ওনার সাথে নেবে তার কারন পরে বলছি। এখন আপতত ঘরে যায়।
.
মৌণতাকে নিয়ে নিজের রুমে এসে দাঁড়ালাম। মৌণতা ধপ করে বিছানায় বসে আমার দিকে তাকাল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিহি, ভাবি আর ভাইয়া এসে হাজির। আমি মৌণতার পাশে এসে বসলাম। ওনারা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাইয়া প্রশ্ন করল…

– তা ছোট বউয়ের নাম পরিচয় তো আমাদেরকে দে।
– ওহ, হা, এর নাম মৌণতা, মৌণতা তাহসিন মিহি। আর মৌণতা এই পিচ্চিটা হল আমার বোন কম শত্রু বেশি। পাশেরটা আমার ভাবি আর এটা ভাইয়া।

মৌণতা সবাইকে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে যাবে ঠিক তখনি ভাবি আর নিহি চিল্লিয়ে বলল “কিহহ, এই সেই মৌণতা?” আমি দৌড়ে যেয়ে ওনাদের থামালাম। তারপর বিছানার কাছে এসে বসতেই মৌণতা বলল…

– এই সেই মৌণতা মানে? কি ব্যাপার নিলয়?
– ইয়ে না মানে আসলে….

আমি চোখ তুলে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। জানিনা ভাবি কি বুঝলো। তবে ভাইয়াকে রুম থেকে বের করে দিয়ে ভিতর থেকে আটকে দিয়ে নিহি আর ভাবি আমাদের সামনে এসে বসল। আমি এক ঝটকায় মৌণতার থেকে এক হাত দুরে যেয়ে বসলাম। ইশারায় সবাইকে থামাতেই মৌণতা ঠিকই তা দেখে ফেলেছে। মৌণতা বলে…

– কি ব্যাপার নিলয়, ওনারা আমার ব্যাপারে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তুমি থামিয়ে কেনো দিচ্ছো? কি সমস্যা হুম? ভাবি আপনি বলেন, নিহি তুমিও বলো কি হয়েছে, আমিই সেই মৌণতা মানে?
– আসলে আপনার কথা শুনতে শুনতে আমার আর ভাবির কান যেন জ্বলে গিয়েছে। তাই আপনাকে এইভাবে দেখবো আশা করিনি। (নিহি)
– মানে? ঠিক বুঝলাম না। (মৌণতা)
– আর বলো না, ভাবি জানো মৌণতার চোখের কাজলে তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছিল। ওর চুলগুলো সবসময় কেনো এত আকর্ষন করে আমার বলো তো? মৌণতার হাসি দেখলে যেন মনে হয় আমার পৃথিবী অচল হয়ে গিয়েছে। হা হয়ে তাকিয়ে দেখি। এসব শুনতে শুনতে আমরা শেষ। সবসময় তো তোমার গল্প করে।
– হুমম, ভাইয়া তো সবসময় তোমাকে নিয়েই কথা বলে। আচ্ছা ছোট ভাবি, তোমাকে যে ভাইয়া খুব ভালোবাসে এটা তোমাকে কিভাবে জানিয়েছে মানে কিভাবে প্রপোজ করেছে একটু বলো না। খালি বলে তোমার সামনে গেলে নাকি ওর হাঁটু কাপে। তোমাকে নিয়ে লেখা ওর পাঁচটা ডায়েরি আমাদের চুরি করে পড়া শেষ। তুমিও পড়বা, সেখানেই লেখা দেখে বুঝতে পারা আমার বান্দর ভাইটা তোমাকে কতখানি ভালোবাসে। (নিহি)
.
ভাবি আর বোনের কথা শুনে মৌণতা আমার দিকে তাকাল। ওর চাহনি আমাকে বলে দিয়েছে আমি বেশ বড় রকমের অন্যায় করে ফেলেছি। আমি বসা থেকে উঠে বেলকনির দিকে আসলাম। মৌণতা তখনো বসে বসে ওদের কথা শুনতে থাকে। আমি মৌণতার দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে মৌণতা মুচকি হেসে আমার দিকে তাকাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে রাগি চোখে তাকাচ্ছে। এই চাহনির প্রেমে আমি অনেক আগে বহুবার করে পড়ে গিয়েছি।
.
সাকিব ভাই ছিলেন ভার্সিটির সিনিওর ভাই। কোনো এক অজানা কারনে আমি আর উনি বেশ ঘনিষ্ট হয়ে যায়। ভার্সিটিতে থাকাকালীন ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয় মৌণতার। অবশ্য তাদের মাঝে প্রেমটা আমিই করিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর ভাগ্য ক্রমে আমি যে অফিসে চাকরি পেয়েছিলাম সাকিব সেই অফিসের ম্যানেজার পদে নিয়োজিত। ব্যস, সব কথা তিনি আমাকে বলবে। কখন কি করবে সেই সবও আমাকে বলবে। তবে ওনার কথার মাঝে মৌণতার প্রসঙ্গটাই বেশি ছিল। উনি মৌণতার সাথে দেখা করতে গেলে আমাকে সবসময় সাথে নিতেন। আমি দুরে বসে ওনাদের পাহারা দিতাম। মৌণতাকে প্রথম আমি সাকিব ভাইয়ের সাথে দেখি, ওনাদের নাকি ফেসবুক থেকে পরিচয়। পরে সাকিব আমার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন।
.
পাহারা দিতে দিতে আমি কখন যে মৌণতার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম তা একদমই বুঝতে পারিনি। যখন বুঝেছিলাম তখন দেরি করে ফেলেছিলাম। তাই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম মৌণতা অন্যের প্রেমিকা, অন্যের বউ হতে যাচ্ছে। সেখানে আমি কি করে তাকে পাওয়ার আশা করতে পারি? সবসময় মৌণতাকে নিয়ে চিন্তাতে বিভোর থাকতে থাকতে গত কালই অফিসের কাজে বাড়ি থেকে বের হয়ে অফিসে আসতেই সাকিব ভাই বলে “নিলয়, তুই তো জানিস মৌণতাকে আমি ভালোবাসি। ওর বাবা আমাকে কখনো মেনে নেবে না।” আমি ওনার কথা শুনে শুকনো হাসি দিয়ে বলি “তা তুমি ওনার বাবার সাথে কথা বলো।” সাকিব ভাই ওনার বাবার সাথে কথা বলেনি। কেবল আমার দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে বলেছিল “ওত সাহস কি আমার আছে রে।” আমি কেবল হেসেছিলাম। উনি আমার হাসির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল আমি কেনো হাসছি। কিন্তু আমি উত্তর দেয়নি।
.
সেদিন রাতে মৌণতার বিয়ে হচ্ছিল অন্য একটি ছেলের সাথে। প্ল্যান করে ওদের পালানোর কথা ছিল। আর মৌণতার বাড়ি থেকে সাকিব ভাইয়ের ঠিকানা অনুযায়ী পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। তবে কান্নাগুলো অপ্রকাশিতই ছিল। মৌণতাকে পালিয়ে নিয়ে যখন সাকিব ভাইয়ের ঠিকানায় গেলাম তখন সেখানে সাকিব ভাইয়ের কোনো অস্থিত্ব ছিল না। মৌণতা কেঁদেই বলেছিল “আমি আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই না।” তাই বাধ্য হয়ে আমার বাড়িতেই তাকে নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম আম্মুকে সব বুঝিয়ে বলবো কি কি হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে আম্মু যে কি ভাবল, আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিল না। অবশ্য এক দিক দিয়ে আমার লাভই হয়েছে।
.
“তো মি. নিলয় সাহেব, আমাকে কবে থেকে ভালোবাসেন শুনি?”

আমি চমকে উঠি। পাশে তাকিয়ে দেখি মৌণতা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। কেমন যেন অস্বস্থি লাগছে ওর পাশে আমাকে। কেমন একটা লজ্জার ভয় আমাকে পরাজিত করে দিচ্ছে বারবার। অন্যের প্রেমিকাকে ভালোবাসা এটা কি কোনো লজ্জার কাজ নয়? আমি কিছু বলতে যাবো তখনি ফোনটা বেজে ওঠে.. স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি সাকিব ভাইয়ের কল। মৌণতা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে স্পিকার অন করে।

– হ্যালো নিলয়, ভাই সরি রে। আমি না আমার কথাগুলো রাখতে পারলাম না। যখন পালাতে চেয়েছিলাম তখনি গ্রামের বাড়ি থেকে কল আসে। মায়ের অসুখ। তখনি মনে পড়ে আমাকে নিয়ে মা বাবার কতখানি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নটাকে মৌণতাকে হুট করে পালিয়ে বিয়ে করে নষ্ট করে দিতে চাইনা। তাই তোকে না বলেই গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। তুই একটু ম্যানেজ করে দিস সব। আর বড় কথা আমি কোনোদিন ওর বাবার সামনে যেয়ে কথা বলতে পারবো না। ওকে নিয়ে দাঁড়াতেও পারবো না। তাই যদি আমার কিছু হয় আমার মা বাবাকে কে দেখবে?
– সাকিব ভাই, আপনি কি তবে ভয় পেয়ে চলে গেলেন? (আমি)
– বলতে পারিস সেটাই।
– হিহিহি… ভাই ভালোবাসতে ভয় করেনি আপনার, ভালোবাসাটাকে সাকসেস করতে ভয় পেলে? তোমাকে একটা কথা বলি, ভালো তো যে কাউকেই বাসা যায়। আপন করে নিতে কিন্তু সবাই পারে না। যদি গভীর ভালোবাসা থাকত তবে আপনি নয় আপনার ভালোবাসায় আপনাকে মৌণতার বাবার সামনে নিয়ে যেত। আপনার ভালোবাসার মাঝে হারানোর ভয় নেয় আছে নিজের মধ্যে ভালোবাসার নাম দিয়ে ছেঁচড়ামো ভয়।
.
সাকিব ভাই ফোন কেঁটে দিলেন। মৌণতা গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত থেকে আমার ফোনটা জোরে আঁছাড় মারে ও। আমি কেবল হা হয়েই সাধের ফোনের টুকরো গুলোকে চেয়ে চেয়ে দেখছি। মৌণতাকে কিছু বলতে যাবো তখনি সে বলে…

– তুমি পারবে, আমার বাবার সামনে আমাকে ভালোবাসি বলতে?
– ***.
– তুমি পারবে, আমার বাবার সামনে আমাকে চাইতে? বলতে পারবে সবার সামনে তুমি আমাকেই ভালোবাসো, আমাকেই চাও?
– ***** (চুপ করে রইলাম)
– হেহেহে… জানি পারবে না। তুমিও আমার বাবাকে ভয় পাও। টেনশন করো না, আমি বাবাকে কাল সব বুঝিয়ে বলবো। ওনারা তোমাকে কিচ্ছু বলবে না।
.
মৌণতা চলে গেল বিছানাতে। ওর চোখের কোণে পানি স্পষ্ট। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বেলকনির চেয়ার গিয়ে বসলাম। রাতটা কোনো রকমে পার করলাম।
.
“নিলয়, চলো, সবাই আমাদের ডাকছে।”

আমি চোখ তুলে তাকালাম। দেখি মৌণতা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাইরে থেকে শুনতে পেলাম অনেক লোক জনের আওয়াজ। মৌণতার বাবার চিৎকারই বেশি কানে এলো “কই সেই ছেলে, আমার মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে এসেছে। অফিসার পুরো বাড়ি সার্চ করো। বেটার গুষ্টি শুদ্ধ জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়াবো।” আমি উঠে মৌণতার হাত ধরলাম। কেমন যেন হাত পা কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। মৌণতা আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলল..

– ভয় নেই, আমি থাকতে বাবা তোমাকে কিছু করতে পারবে না। আর আমি সবটা বুঝিয়েই বলবো। তোমার কোনো দোষ নেই।

আমি কিছু বললাম না। মৌণতার হাত ধরে দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে আসলাম। সবাই আমাদের দেখে চিৎকার চেঁচামেচি কমিয়ে দিয়েছে। মৌণতার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলাম। মৌণতার বাবা হাত ধরার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে হনহন করে এসে সোজা আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আমার আম্মু কিছু বলতে যাবে আমি ইশারায় থামিয়ে দিলাম। মৌণতার হাত আরো শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলাম। মৌণতা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

– তোমার এত সাহস কি করে হয়, আমার মেয়েকে বিয়ের রাতে পালিয়ে নিয়ে আসার? (মৌণতার বাবা)
– বাবা, তুমি প্লীজ ওকে কিছু বলো না। আসলে… (মৌণতা)
– চুপ… তোর লজ্জা করে না এভাবে আমার সম্মান হানী করে অন্য একটা ছেলের সাথে পালিয়ে আসতে? জানিস তোর জন্য আমার কতটা সম্মানহানী হয়েছে?

মৌণতা আরো কিছু বলতে যাবে। কিন্তু তাকে আবারো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির ভিতরে পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে আছে। মৌণতার হাত তখনো ধরে আছি আমি। মৌণতার বাবার ইশারায় একজন পুলিশ এসে আমার এক হাতে হ্যান্ডকাপ পরালো। মা বাবা বাধা দিয়েও কোনো কাজ হলো না। অফিসার যখন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখনো মৌণতার হাত ছাড়িনি। দরজার কাছে এসেই আমি বললাম..

– স্যার আমার কিছু বলার আছে।
– কি বলবে তুমি? (মৌণতার বাবা)
– আমাকে তো আপনার মেয়েকে পালিয়ে নিয়ে আসার অপরাধে ধরেই নিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে আমার কিছু কথাগুলো শুনুন।
– হুম…

সবাই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মৌণাতাকে নিজের খুব কাছে টেনে নিলাম। মৌণতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল…

– আসলে বাবা, ও বলতে চাচ্ছে তোমরা যা মনে করছো…….
– স্যার, মৌণতাকে আমি খুব ভালোবাসি। যদি বলেন তাকে কেনো ভালোবাসি, তাহলে স্যার আমার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আপনি না বললেন মৌণতার জন্য আপনার অনেক সম্মান নষ্ট হল? আচ্ছা স্যার, আপনি তো আমার গুরুজন, আপনি আমার থেকে অনেক বেশিই জানেন। তবে এটা বলতে পারি, এখানে কেবল আপনি আপনার সম্মান, আপনার অভিজাত্যটাই দেখলেন। একবারো কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনার মেয়ের এই বিয়েতে কোনো মত আছে কি না? আপনি হয়ত চাইলে তাকে জোর করে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু মৌণতা যে সেখানে ভালো থাকবে এটার প্রায়োরিটি আপনি দিতে পারবেন? ভালো থাকা মানে বংশ,টাকা, অর্থ এসব কি বোঝায়। যদি ভালোবাসাটাই না থাকে সেখানে?
.
স্যার, আমি চাইলেই আপনার মেয়েকে নিয়ে অনেক দুরে চলে যেতে পারতাম। এতটাই দুরে যেতাম যেখানে আপনি আমাদের হয়ত খুজেই পেতেন না। আমি কিন্তু আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি স্যার। আমি আপনার মেয়েকে নিয়ে সোজা আমার বাড়িতে এসেছি। কারন আমি আমার বাড়ির সম্মান ও ভালোবাসা কোনোটাই হারাতে চাইনা। আরেকটা কথা আমরা একে অপরকে ভালোবাসি স্যার, আপনি চাইলে ওকে নিয়ে যেতে পারেন। তবে হা, আমি ছাড়া মৌণতাকে কেউ খুশি রাখতে পারবে না। কারন সে আমাকে ভালোবাসে। এখন আপনি আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিতে পারেন।
.
আমার কথা শুনে সবাই যেন চুপ হয়ে রইল। আমি মৌণতার হাত ছেড়ে দিলাম। মৌণতা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ওর চোখে আমি ভয় দেখেছি। আমি ছেড়ে যাবো কি না সেটার ভয় ওর চোখে স্পষ্ট। গম্ভীর গলাতে মৌণতার বাবা বলল…

– এখন যা করি না কেনো সবকিছু তো আর আগের মত হবে না। এখন যা হয়েছে সব মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুও করার নেই। যদি মৌণতাকে নিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে দিই তবে এই সমাজের লোকেরাই বলবে “দেখ দেখ পালিয়ে গিয়েছিল একজনের সাথে আবার অন্য জনের সাথে বিয়ে হচ্ছে।” তাই সব দিক ভেবে আমার মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। আপনারা কি ওদেরকে মেনে নিয়েছেন?

মৌণতার বাবা আমার আম্মু আব্বুর দিকে তাকিয়ে শেষের কথাটা বলল। আম্মু কিছুই বলছে না। মৌণতা এসে আমার হাত ধরলো। আমিও ওর হাতটা আঁকড়ে নিলাম। এরপর মাথাটা নিচু করে দুজনেই বললাম…

– আমরা আসলে সরি, জানি পরিস্থিতি এমন যে যেখানে আমাদের যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেবো।
– হুমম… তবে আজকেই তোদের দুজনের এই মুহুর্তে বিয়ে করতে হবে। আপনি কি বলেন ভাই সাহেব?
– ঠিক আছে..পরে না হয় অনুষ্ঠান করা যাবে।

মৌণতার বাবার দিকে তাকিয়ে আম্মু কথাটা বলল। উনিও সম্মতি দিলেন। মৌণতা মাথাটা নিচু করে নিল। আমি মনে মনে হাসছি। কারন কি থেকে যে কি হয়ে গেল। আমি মৌণতার কানে কানে বললাম..

– এখন কি বলবো, যে আমাদের মাঝে কিছুই নেই? তুমি অন্যের জিএফ ছিলে ভাগিয়ে নিয়ে তাহার হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছিলাম আমি?
– জ্বি না মশাই, এখন আর এসব কাউকেই বলতে হবে না।
– তার মানে? তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেললে নাকি?
– তাছাড়া উপায়ও নেই। (মৌণতা)
– হায়রে… ছিলে অন্যের জিএফ, চাপে পড়ে আমাকে বানিয়ে দিলে তোমার বিএফ। মেয়েরা না সব পারে।
– ঐ কি বললে…
– কিছু বলি নাই.. কেবল শুনবো…
– কি? (মৌণতা)
– তোমার থেকে ভালোবাসি শব্দটা। (আমি)
– তার জন্য তো বাসর ঘর অবদি যেতে হবে মশাই।
– হুর, বাসর ঘরে কি ভালোবাসি শুনবো নাকি?
– তাহলে…
– আরে বাসর ঘরে একটা হাজবেন্ড এর অনেক কাজ।
– কি কাজ…
– সেটা না হয় পরেই বুঝবা, যাও বিয়ের জন্য রেডি হও।
– জ্বি মশাই, আপনিও যান।
.
মৌণতার সাথে ফিস ফিস করে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দেখে দৌড়ে চলে আসি ভাইয়ার রুমে। আর মৌণতা যায় ভাবির সাথে নিহির রুমে। দুজনেই বিয়ের সাজে সাজতে। যাক অবশেষে অন্যের জিএফ আমার হচ্ছে। কি বান্দর রে আমি….
—-‘(সমাপ্ত)’—-

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত