-আপনি কখনো প্রেম করেছেন?
নতুন বউয়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা ইতস্তত বোধ হচ্ছে।
আমার স্ত্রী নিধি। আজই আমাদের বিয়ে হলো। পড়াশোনা শেষ করে প্রতিদিন শুধু পত্রিকার পাতা উল্টাতাম। কিন্তু কোনোভাবেই সোনার হরিণকে বন্দী করতে পারছিলাম না। আমি চাকরির কথা বলছি। সকালে এক গ্লাস পানি খেয়ে স্যুট-কোট পরে শিক্ষা জীবনের সকল ডকুমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে যেতাম একটা মাত্র চাকরির উদ্দেশ্যে। সারাদিন ঘুরেফিরে একরাশ হতাশা নিয়ে যখন বাসার কলিং বেল চাপ দিতাম বাবা দরজাটা খুলে জিজ্ঞেস করতো “কিছু হলো বাবা?”
সারাদিনের ঘুরেফিরে কষ্ট লাগার চেয়ে বাবার এই প্রশ্নটাই আমাকে আরো বেশি কষ্ট দিতো। যাইহোক, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম সৃষ্টিকর্তা কখনো কাউকে নিরাশ করেন না। নিশ্চয়ই তিনি একদিন আমাকে সুখবর দিবেন। দীর্ঘ দেড় বছর এভাবেই কেটে গেছে। আশার আলো ফুটলো কোকিল ডাকা বসন্তের এক ভোরে। একটি ফোন কল বাজছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় কল রিসিভ করলাম,
-আসসালামু আলাইকুম, আমি কি মিস্টার মেহরাব সাহেবের সাথে কথা বলছি?
-ওয়ালাইকুম সালাম, জি আমি মেহরাব।
-কনগ্রেচুলেশন’স মিস্টার মেহরাব! টেকনো বাংলাদেশ মোবাইল কোম্পানিতে জেনারেল ম্যানেজার পোস্টে আপনার জব হয়েছে। আপনি চাইলে আগামীকাল থেকে সরাসরি জয়েন করতে পারেন। থ্যাংক ইয়্যু।
-অহ রিয়েলি! থ্যাংক ইয়্যু সো মাচ।
কিছুক্ষণ আমি বাকরুদ্ধ ছিলাম। কিছু অর্জন করার আনন্দ কতটুকু তা আরেকবার অনুভব করার সুযোগ পেলাম আলহামদুলিল্লাহ। খুশির খবরটা বাবা-মা’কে প্রথম শোনালাম। সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করলাম।
সেদিনের সারাদিনটাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কীভাবে স্মার্ট, পারফেক্ট দেখাবে সে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলাম। চাকরির প্রথম দিন পরিচয় পর্বে সবার সাথে পরিচিত হলাম। বেশ আনন্দদায়ক ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ক্যারিয়ার নিয়ে। এভাবে কাটিয়ে দিলাম দু’টো বছর। অবশ্য চাকরি হওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই বাবা-মা বিয়ের কথা বলছিল। আমি করবো করবো করে এ দু’বছরে আর করা হয়নি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। তাদের বয়স হয়েছে। সারাদিন একা একা থাকে বাসায়। কারো সঙ্গ পেলে আমার বা বাবা-মায়ের মন্দ হবে না ভেবে নিজেই গিয়ে মায়ের কাছে বললাম,
-মা, মনে হচ্ছে বিয়ে করাটা জরুরি, তোমাদের জন্য আর কি!
মা একরাশ মুগ্ধতার হাসি হাসলো। সে হাসিতে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। উপায়ন্তর না পেয়ে স্থান ত্যাগ করলাম।
এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের আয়োজন করা হলো।বিয়ের পীড়িতে বসলাম এক রূপবতী রাজকন্যার সাথে। বাবা-মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে মেয়েটাকে।সত্যিকার অর্থে আমিও প্রথম দেখায় মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাই। মনে প্রানে চাচ্ছিলাম সে যেন আমারই হয়। আলহামদুলিল্লাহ তার সাথেই আমার বিবাহ সম্পন্ন হলো এবং আজই আমাদের বিয়ের প্রথম রজনী অতিবাহিত করছি।
স্ত্রীর এমন প্রশ্নে আমি আমতা আমতা করছি। আমার ভয়াবহ অবস্থা দেখে সে আবার বললো,
-আপনি বলতে পারেন সমস্যা নেই। আমি শুনতে রাজি আছি। পূর্বে প্রেম-ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকলেও বর্তমান জীবনে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। আপনি নির্ভয়ে আমাকে শেয়ার করতে পারেন।
বন্ধুরা বলতো, “ব্যাচেলর থাকা অবস্থায় জীবনে যা কিছু করেছিস সব বউকে বলতে পারিস কিন্তু প্রেমের বিষয়ে কখনো বউকে বলিস না। যদি বলছিস তো তোর জীবনের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে সে!”
কথাটা মনে পড়তেই আরো আড়মোড়া শুরু হলো আমার। নিধির মুখের দিকে তাকাতেই মনে হলো সে সৎ ইচ্ছায় জানতে চাচ্ছে। তাই অতশত না ভেবে বলতে শুরু করলাম,
রিয়া ছিল মায়াবতী একটি মেয়ের নাম। তার মায়ায় আমি আটকেছিলাম যখন ক্লাস টেনে পড়ি।ছোটবেলা থেকেই আমি চুপচাপ স্বভাবের। কারো সাথে কখনোই ঝামেলাই যাইনি। প্রেম-ভালোবাসাটাকে আমি সবসময় ঝামেলা মনে করতাম। কারণ প্রায় সময় দেখতাম কত বড় ভাই-আপুদের প্রেমে বিচ্ছেদ, কাটাকাটি, মারামারি, হানাহানি, গলায় ফাঁস ইত্যাদি যত ঝামেলা পূর্ণ কাজ আছে সেগুলো প্রেম-ভালোবাসায় অন্তর্ভুক্ত। জেনেশুনে এসব ঝামেলায় আমি যেতে পারবো না। দশম শ্রেণিতে পড়া আগ অব্দি ভাবতাম প্রেম আবার কী? এটা নিয়ে মানুষ এতো সিরিয়াস কেন? এসব না করলে কী হয়?
কিন্তু যখন দশম শ্রেণিতে উঠেছি তখন সব ছেলে-মেয়ের একটা বিশেষ সময় অতিবাহিত হয়। যেটা বয়ঃসন্ধিকাল। অবশ্য এটা অনেকের এর আগে থেকেও শুরু হতে পারে। আমি ব্যাপারটি ফিল করি দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। বন্ধুদের আড্ডাবাজির ফাঁকে দু’একটা বাজে কথা চলে আসতো। বাজে কথাটা সবাই খুব ভালোভাবেই উপভোগ করতো। ক্লাসের মেয়ে বন্ধুদের সাথে মিশতেও খারাপ লাগতো না। যত যাই হোক, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। নিজের ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে দিতাম না।
টিভি বা মোবাইলে দেখা কিছু রোম্যান্টিক সিন আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলতে শুরু করে। নায়ক যেভাবে নায়িকার হাত ধরে বসে থাকে, জড়িয়ে ধরে, একসাথে বসে গল্প করে এসব আমারো ইচ্ছে করতো। মাঝেমাঝে তো এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন রাত পার হয়ে সকাল হয়ে যেত তা টেরই পেতাম না। আমাদের ক্লাসেই পড়তো রিয়া। পড়াশোনা, আচার-ব্যবহারে যথেষ্ট ভালো ছিল। আমি শুনেছি কোনো একটা টপিক সম্পর্কে তার আইডিয়া থাকা সত্ত্বেও আমার কাছ থেকে জানতে আসতো। রিয়া নাকি আমার সান্নিধ্য পেতে ভালোবাসতো এই বলে আমায় ক্ষেপাত ক্লাসের বন্ধুরা। লক্ষ্য করলাম পড়াশোনার বাহিরেও রিয়া আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করতো। স্কুলে আগে আগে চলে আসলে আমার পাশে বসে দুনিয়ার যতসব কথা শুরু করে দিত। তার চোখ, মুখের অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনটা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হতে শুরু করলো। এভাবে বছরের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেল।
একদিন আমাদেরই সহপাঠী সুরভী এসে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে যায়,
-নে এটা পড়ে উত্তর দিস।
খাম দেখে বুঝতে বাকি রইল না এটা একটা চিঠি। ভাবতে শুরু করলাম, কী ব্যাপার সুরভী কি আমাকে আবার প্রপোজ করতে চাচ্ছে নাকি! আবার ভাবছি যদি প্রপোজই করতে চাইতো তাহলে চিঠি দেওয়ার সময় তুই করে কেন বলে গেল! তুমি করে বলতো। কারণ এ বয়সে সহপাঠীর সাথে প্রেম হলে তা অটোমেটিক তুই থেকে তুমি হয়ে যায়। তুমি শব্দটাতে তখন একরাশ আনন্দ মিশ্রিত থাকে। আরে দূর এসব কী ভাবছি আবোলতাবোল। অন্যকিছুও তো হতে পারে। মনের ছটফটানি শুরু হলো কখন পড়বো চিঠিটা। এসব গোপন কাগজ কেউ দিলে ওপেন প্লেসে পড়া উচিত না। একাকী নির্জন পরিবেশে পড়তে হয়। এর জন্য উপযুক্ত সময় রাতে দরজা লক করে পড়া। রাত ঘনিয়ে এলো। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লো আমি ধীরে ধীরে খামের মুখটা আলগা করি। খামের ভেতরে তাকাতেই ভাঁজ করা একটা কাগজের সাথে স্টিকার দেখতে পাই। স্টিকারটির উপরে লেখা ছিল I Love You. আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা প্রেমপত্র। আমার গলা শুকিয়ে আসতে শুরু করেছে। তড়িঘড়ি করে চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করলাম,
প্রিয় মেহরাব,
পত্রের প্রথমে এক আকাশ ভালোবাসা গ্রহণ করো। আশা করি ভালো আছো। তোমাকে লেখা এটাই আমার প্রথম পত্র। প্রথম বললে ভুল হবে, অনেকগুলোই লিখেছি কিন্তু তোমাকে দিতে পারিনি। এটা যদি তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছায় তাহলেই তা হবে প্রথম। যাইহোক, আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। তাই সহজেই বলি “আমি তোমাকে ভালোবাসি”। দীর্ঘদিন ধরেই বলতে চেয়েছি কিন্তু মেয়ে হয়ে তোমার সামনে গিয়ে বলার সাহস হারিয়ে ফেলি। তাই এই মাধ্যম। ছেলে হয়ে তুমি বুঝতেই পারোনি একটা মেয়ে তোমায় ভালোবাসে। নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেছো তা তুমিই ভালো বলতে পারো। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে আমি তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছি তা বলতে পারবো না। আমার মন বারবারই বলছিল “তোমাকে হারাতে চাই না”। মেহরাব আমরা একসাথে বাঁচতে চাই। প্লিজ আমার প্রপোজাল তুমি রিজেক্ট করে দিও না। আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি
তোমার রিয়া
অজানা কারণে বুকটা ধুকপুক করছে। লিখতে বসলাম চিঠি। খাতার পাতা অনেকগুলো নষ্ট হলো। কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ একটা চিঠি লিখতে পারলাম না। হয়ত লেখা সুন্দর হয় না নয়ত সাজিয়ে লিখতে পারছি না। সবকিছু বাদ দিয়ে অবশেষে তার দেওয়া চিরকুটেই Approved লিখে নিচে আমার সাইন করে দিলাম! পরদিন স্কুলে গিয়ে সুরভীর কাছে পৌঁছে দিলাম চিঠিখানা। আমি সুরভী আর রিয়ার গতিবিধি সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখছিলাম। দেখলাম টিফিনে সুরভী রিয়াকে খামটা হাতে দিলো। সবাই যখন সবার কাজে ব্যস্ত তখন রিয়া তড়িঘড়ি করে চিরকুটটা বের করে তার বইয়ের ভেতর লেপ্টে দিলো। যেন সবাই বুঝতে পারে রিয়া বই পড়ছে। রিয়া মিনিট তিনেক চিঠির দিকে তাকিয়ে রইল, সে নিজের লেখাই পড়ছিল। নতুন কিছু চোখে পড়ছে না। কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা দেখতে পেলাম। আমি তাকিয়ে দেখলাম সে আশেপাশে কাউকে খুঁজছিল। হয়তো আমাকেই খুঁজছিল তার আনন্দের হাসি ভাগাভাগি করে নিতে। এই দিনটা যে কতটা আনন্দের ছিল তা বলে বুঝানো সম্ভব না। জীবনটা হয়তো অনেক সুন্দর সেটা সেদিন অনুধাবন করতে পেরেছিলাম।
ক্লাসের ফাঁকে একটু প্রেম, একটু হাত ধরা, শত বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে ফোনে একটু কথা বলার চেষ্টা করা, ক্লাসের নোট একে অপরকে হস্তান্তর করা এসব করেই কাটিয়ে দিলাম দশম শ্রেণি। বোর্ড রেজাল্টে হাতে পেলাম। বাবা বলছে গ্রামে আর পড়াবে না। পড়াশোনা বাকিটা শহরে করাবে। আমি রিয়ার সাথে যোগাযোগ করলাম। রিয়াকে ওর বাবা গ্রামেই পড়াবে। আগামীকাল বাবা-মা সহ আমি শহরে চলে যাবো। খুব ইচ্ছে করছে রিয়ার সাথে দেখা করার। অনেক কষ্ট করে সবকিছু ঠিকঠাক করে আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করলাম। সেদিন মেয়েটা সারাক্ষণ আমার হাত ঝাপটে ধরে ছিল। একে অপরকে কথা দিলাম যত দূরত্বই থাকুক না কেন, একে অপরকে কখনো ভুলবো না। বিশ মিনিটের বেশি থাকতে পারলাম না। যখন চলে আসবো আমি তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার মলিন মুখের পানে। অঝরে অশ্রু জড়াচ্ছে সে। কখন যে আমারও চোখের পাতা ভিজে গেছে টের পাইনি। বিদায় দিয়ে চলে আসি সেদিনের মতো।
শহরের একটি স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলো আমার। বেশ কয়েকমাস আমাদের কথা হচ্ছিল নিয়মিত। আমাকে দেখতে না পেয়ে শুধু কান্না করতো রিয়া। এক রাতে কান্নার শব্দ তার মা শুনতে পায়। এসে দেখে রিয়া মোবাইলে কথা বলছে আর কাঁদছে। হয়তো তার মোবাইলটা কেড়ে নেয় তখনই। তারপর তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। এভাবে একমাস কেটে গেল রিয়ার সাথে আমার কোনো প্রকার যোগাযোগ হয়নি। বাধ্য হয়ে একদিন কলেজ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন ধরে গ্রামে চলে আসি। গ্রামে এসে কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা। তারা আমাকে জানালো রিয়ার বিয়ে হয়েছে আজ পনেরো দিন। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আর আগাতে পারলাম না। ফিরে এলাম শহরে। মাত্র কয়েক মাসের একটা প্রেম, একটা মায়া ভেঙে দিলো আমার কোমল হৃদয়কে। আমার চারদিক বিষন্নতায় ঢেকে গেল। নিজে থেকে আর চাইনি রিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে। রিয়াকে আমি ভুল বুঝতে শুরু করলাম।
চলে গেল আরো কয়েকমাস। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন রিসিভ করলাম,
-হ্যালো, আমি রিয়া বলছি। মেহরাব কেমন আছো তুমি?
রিয়ার কন্ঠ শুনে আমার গলা ধরে আসছে। অজান্তে অশ্রু বিন্দু টপ টপ করে পড়ছিল।
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি?
-আমি আছি, বেশ ভালো আছি। তোমাকে আজ খুব মনে পড়ছিল তাই কল দিলাম।
-কেন এতদিন পড়েনি, আজই কেন পড়তে হলো?
-আমি পারতাম এতদিন তোমায় কল দিতে কিন্তু দেইনি নিজের সংসারের কথা ভেবে, তোমার কথা ভেবে। মেনে নিয়েছি জীবনে যা হওয়ার হয়েই তো গিয়েছে। নতুন করে কথা বলে মায়া বাড়ালে শুধু কষ্টই বাড়বে। ভালো কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না। অহ, তোমাকে আজ কল না দিয়ে পারলাম না। মনে আছে তোমার আজকের দিনের কথা? আজকের দিনে আমরা দুটি মন একই শিকলে বেঁধেছিলাম।
আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। কাঁদো কন্ঠে বলছি,
-না মনে নেই। মনে করার চেষ্টাও করতে চাই না। তুমিও করো না। শিকল তো সেই কবেই ছিঁড়ে গেছে।
-তুমি খুব রাগ করেছো তাই না? জানো মা আমার মোবাইলটা নিয়ে নিয়েছিল সেদিন। তারপর আমাকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে। কারো সাথে যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম ছিল না। যখন আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই তারা পরিকল্পনা করে আমায় বিয়ে দিয়েছে। আমি কত বলেছি তোমার কথা। কিন্তু কোনো কাজই হচ্ছিল না। তাদের একটাই কথা “এইটুকুন একটা ছেলে, বিয়ে করে খাওয়াবে কী? ছেলের প্রতিষ্ঠিত হতে আরো অনেক সময় বাকি”। আমি বললাম “তাহলে আমাকে পড়তে দাও, আমাকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দাও, তাকে সুযোগ দাও”। আমার কোনো কথাই তারা কানে নিচ্ছিল না। তারা জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
ওপাশ থেকে ফোনটা টুট টুট করে কেটে গেল। আর কল আসলো না। রিয়ার প্রতি ভুল ধারণা আমার ভেঙে গেল। মেনে নিয়েছিলাম এটাই বাস্তবতা। এরপরে মাঝেমাঝে রিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো কিন্তু এতে কোনো লাভই হতো না শুধুই কষ্ট বাড়তো। তাই রিয়াকে এক পর্যায়ে নিষেধ করে দিয়েছিলাম যোগাযোগ করতে। আমি চাইনি আমার কারণে একটা মেয়ের সংসার ভেঙে যাক। ধীরে ধীরে মোহ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। আসলেই হয়েছি কিনা জানি না! এভাবে ইন্টার, অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছি। এর মাঝে প্রেম-ভালোবাসায় নিজেকে জড়াইনি। জড়াইনি বললে ভুল হবে। সর্বশেষ একটা মেয়েকে দেখে ইচ্ছে হলো তার প্রেমে পড়ি। যে প্রেমটা তাকে আমি প্রকাশ করবো না। যদি তার সাথে বিয়ে হয় তাহলেই প্রকাশ করবো।
পেছন ফেরে তাকিয়ে দেখি নিধি ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত নিধিকে কত সুন্দর লাগছে। এভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা হয়নি কোনো মেয়েকে। চোখের পাপড়িগুলো মাঝেমাঝে দোল খেলে যা দেখেই সারারাত পার করে দেওয়ার মতো। চাদরটা টেনে দিয়ে নিধির পাশে বসে থাকি আমি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবো না। ভোরে আজানের ধ্বনিতে নিধির ঘুম ভাঙে। আমাকে ডেকে তোলে সে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-বললেন না তো সর্বশেষ কোন মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলেন যাকে আপনার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবেন বিয়ের পর যদি তার সাথে বিয়ে হয়।
কী ব্যাপার নিধি তো ঘুমিয়ে পড়েছিল তাহলে সে শেষটুকু শুনলো কীভাবে? তারমানে সে ঘুমের ভান করেছিল। ঘুম ঘুম একচোখে নিধির দিকে তাকিয়ে বলি,
– সর্বশেষ প্রেমে পড়েছি আপনার। আপনাকেই বলবো “ভালোবাসি”।
মুচকি হেসে নতুন বউ বললো,
-উঠুন, নামাজ পড়বেন। আর শুনুন আমিও আপনাকে ভালোবাসি।
উড়ে গেল সকালবেলার একঝাঁক পাখির দল। ক্রমশ আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী, আলোকিত হচ্ছে আমার জীবন। জীবনের পূর্ণতা যেন আজ খুঁজে পেলাম।