স্কুল লাইফে এক ইংরেজি টিচারের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম আমরা দুই সহপাঠী। ঊর্মি আর আমি। বেশ হ্যান্ডসাম স্যার প্রতিদিন একটা করে নতুন শার্ট পড়ে স্কুলে আসতেন। তখন আমরা নাইনে পড়ি। ঊর্মি ফার্স্ট আর আমি থার্ড গার্ল।
স্যার যখন এ স্কুলে জয়েন করেন তখন আমরা সেভেনে পড়তাম। তখন আমাদের কোনো ক্লাস নিতেন না। স্যারের উপর ক্রাশ খেয়েছিলো স্কুলের বড় আপুদের অনেকেই। স্কুলে মোটামুটি চাউর হয়েছিলো সেকথা যে কারণে আমাদের কান অব্দিও এসেছিলো।
স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন সেটা জানতাম। যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে হিসেবে স্কুলে আমার পরিচিতি ছিলো। বাবা স্কুল কমিটিতে ছিলেন এবং মোটামুটি সব টিচাররাই বাবাকে পছন্দ করতেন। একবার এইটে সেকেন্ড টার্মিনাল পরীক্ষায় গণিত পরীক্ষা দেই নি। বাবার কাছে টাকা চেয়েছিলাম দেয়নি এজন্য সেদিন রাগ করে পরীক্ষা দিতে যাইনি। তো পরের দিন যখন পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছি তখন রিয়াজুল স্যার হলের ডিউটিতে। প্রশ্নপত্র সাপ্লাইয়ের পরপরই আমার সিটের কাছে এলেন।
— গণিত পরীক্ষা দিলে না কেনো?
— স্যার, অসুস্থ ছিলাম।
— অসুস্থ মানে? একদিনে অসুখ ভালো হয়ে গেলো? আমিতো শুনলাম অন্য কথা।
এবার আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। স্যার কে নিশ্চয়ই আব্বা বলেছেন বিকেলে বাজারে এসে।
— তাহলে তো শুনেছেনই।
— এখন তুমি বলো কি কারণে পরীক্ষা দাও নি।
স্যার এবার আসল জায়গায় খোঁচা দিলেন। কারণ আমার সব সাবজেক্টে নাম্বার ভালো আসতো শুধুমাত্র গণিত ছাড়া। এই ভয়ংকর সাবজেক্টে শুধু পাশ করার জন্যই লড়াই করতাম। ওইবার আমার প্রিপারেশান খুবই খারাপ একারণে আগেই চিন্তা করে রেখেছি যেভাবেই হোক পরীক্ষাটা দেবো না। এর জন্য এই রিয়াজুল স্যারেরও ভুমিকা আছে। সে আমাকে আর ঊর্মিকে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়েছেন।
আমাদের হলে ডিউটি পড়লেই বলতেন–এবার দেখা যাবে ঊর্মি আর লাইজুর মধ্যে কে ফার্স্ট হতে পারে। তিনি সহ সব স্যারেরাই জানতেন আমি অন্যান্য সাবজেক্টে বেশি নাম্বার পেলেও গণিতে টেনেটুনে পাশ করি। তো স্যারের এই প্রতিযোগিতার কথা আমার গণিত ভীতিকে ভয়াবহ রকমের বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তাই ফার্স্ট না হওয়ার লজ্জা ঢাকতেই এডভান্স নিজেকে প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিতেই পরীক্ষায় এটেন্ড না করার প্লান। অলিখিত প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার চেয়ে এটাই ছিলো আমার উত্তম সিদ্ধান্ত। স্যার সেটাই অনুমান করেছেন। তবে একদিকে স্বস্তি পাচ্ছি আবার আব্বা টাকা দেয়নি বলে পরীক্ষা দেইনি সেটা যখন আব্বার কাছ থেকেই শুনেছেন তাহলে আমার ইজ্জত বাঁচলো অনুমান যা করে করুক।
সবসময়ই স্যার আমার একাধিক বিষয়ে স্নেহশীল ছিলেন। স্কুলে একদিন না গেলে খোঁজ খবর নিতেন, গণিত বিষয়ের উন্নতির জন্য কেমন চেষ্টা করছি সে খোঁজ নিতেন, ক্লাসের টুকটাক দুষ্টুমিতেও আমাকে একটু ছাড় দিতেন, এছাড়াও আমাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করতেন। এসব কারণে আমার কিছু সহপাঠী মনে করতো স্যারের সাথে সম্ভবত আমার প্রেমের সম্পর্ক আছে। ওরা রীতিমতো কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। যদিও সম্পর্ক বলতে এতোখানি ই। সেই সহপাঠীদের নেতৃত্বে আবার ঊর্মি যে আমার অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বী। কোনো ভাবেই মানতে পারছে না এই সম্পর্ক। কেননা ও তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
হঠাৎ একদিন ঊর্মি আমাকে খুব আদর যত্ন করছে। আমি সবসময়ই সেকেন্ড বেঞ্চের প্রথম সাইডে বসতাম। ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম সাইডে ঊর্মি বসতো কারণ ও প্রাইভেট পড়ার জন্য আগে আসতো। ওই দিন কোনো ভাবে আমাকে সেকেন্ড বেঞ্চে বসতে দেবে না। ওর পাশে বসতে হবে। জোড়াজুড়িতে বসলাম। পাশে বসিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো কমন রুমে। বাসা থেকে আচার ভর্তি বাটি এনেছে আমাকে খাওয়ানোর জন্য। দোকান থেকে সিঙ্গারা আনিয়েছে দপ্তরি কে দিয়ে আমাকে খাওয়ানোর জন্য। এতো আপ্যায়নের মানে খুঁজছিলাম। হঠাৎ এতো পরিবর্তন কেনো? অবশেষে কারণ প্রকাশ করলো।
— লাইজু, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো সত্যি বলবি। বল, আল্লাহর কিরা!
—- আচ্ছা, বল।
—- রিয়াজুল স্যারের সাথে কি তুই প্রেম করিস?
—- নাহ্।
—- মিথ্যে বলছিস?
—- আরে না, সত্যি বলছি। কিসের প্রেম, স্যারের সাথে প্রেম করা যায়?
—- তাহলে তুই একটা কাজ করে দিবি আমাকে।
—– কী কাজ?
—– স্যার কে আমি ভালোবাসি। তার সাথে আমি প্রেম করবো, তুই হেল্প করবি।
—– কিভাবে?
—- স্যারের কাছে বলবি আমার কথা। আমি চিঠি দেবো তুই তার কাছে পৌঁছে দিবি।
—- আচ্ছা।
তারপর আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললো–
— বাসায় গিয়ে পড়বি। এটা তোকে লিখেছি।
—-ওকে।
বহুত চিন্তায় পড়ে গেলাম। ছুটি শেষে বাসায় গিয়ে ঊর্মির ষোলো ভাঁজ করা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম।
প্রিয় লাইজু,
শুভেচ্ছা নিস। আজ থেকে তোর আর আমার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। জানি, স্যারের সাথে তোর ভালো সম্পর্ক আছে। স্যারকে আমিও ভালোবাসি। তুই কি জানিস, ইমা, পুতুলও স্যারকে ভালোবাসে? ওদের কিন্তু কিছুতেই হেল্প করবি না। স্যার হয় তোর নাহয় আমার। ভালো থাকিস। আজ আর নয়।
ইতি
স্যারের ওয়াইফ,
রিয়াজুল স্যার + ঊর্মি,
রিয়াজুল স্যার + লাইজু।
সারা পৃষ্ঠা ভরা R+U, R+L. এসব দেখে এখন আমিও ঊর্মির মতো ভালোবাসতে শুরু করেছি। সবচেয়ে মজার আর লক্ষনীয় বিষয় ছিলো ওর আর আমার মধ্যে কোনো হিংসা কিংবা রেষারেষির লেশমাত্র ছিলো না। অন্যদের সাথে আমরা খুব একটা মিশি না কারণ আমাদের এ গল্প কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। এজন্য দুজনেই এটা নিয়ে পড়ে থাকতাম কিন্তু স্যারের কাছে প্রকাশ করার সাহস আর হয়ে ওঠে না। কতবার দুজন মিলে চেষ্টা করেছি তার শেষ নেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
স্যারও দেখলেন আমাদের মধ্যে বেশ দহরম মহরম ভাব। সারাক্ষণ একসঙ্গে গল্প করি। একদিন স্যার আবার বললেন – “তোমরা কি ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিচ্ছো? কার ছেলের সাথে কার মেয়ের বিয়ে দেবে এই নিয়ে এখন পড়ে থাকতে হবে না, লেখাপড়ায় মন দাও।”
এভাবেই চলছে সাহস করে আর বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু খোঁজ রাখতাম কারো সাথে স্যারের আবার সম্পর্ক হয়ে যায় কিনা। আমি আর ঊর্মি খুব খুব ভালো বান্ধবী হয়ে গেলাম। সারাক্ষণ আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতাম আর স্যারের অদৃশ্য উপস্থিতি সেখানে।
হঠাৎ করে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি ঊর্মি মন খারাপ করে বসে আছে। কাঁদো কাঁদো ভাব। আমি যাওয়ার পরই আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো কমন রুমে। কান্না করতে করতে কোনো রকমে বললো।
— স্যার বিয়ে করেছে গতকাল। এজন্য ছুটি নিয়েছে।
— বলিস কি? এখন আমাদের কি হবে?
দুই জন দুঃখে কান্না করতে করতে চোখ, মুখ লাল করে ফেললাম। এতো বড় শোক কিভাবে সইবো? শেষে শোকে কাতর দুজন নিজেদের সান্ত্বনা দিলাম। থাক, পুতুল, ইমাকে তো বিয়ে করে নি! আস্তে আস্তে আমরা দুজন মেনে নিলাম স্যারের বিয়ে কে। ঊর্মি বলে — আমার পরিবার কোনোদিনই মেনে নিতো না, পালিয়ে যেতে হতো। স্যার কি পালিয়ে যেতো কখনো?
— আমারও তো একই অবস্থা হতো। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। স্কুলের কাউকে তো বিয়ে করেনি?
হঠাৎ ডায়রির ভাঁজে ঊর্মির সেই চিঠি দেখে মনে পড়ে গেলো হারিয়ে ফেলা সেই সব মজার দিন গুলি। গুনগুনিয়ে উঠলাম।
দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না রইলো না
সে যে আমার নানান রঙের দিন গুলি —-