প্রেমাতাল !!

প্রেমাতাল !!

ঘড়িতে রাত ১২:৫৬ । অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনটা বেজেই চলেছে, তিতিরের হাত পা কাঁপছে। ফোন ধরার সাহস হচ্ছেনা। অবশেষে থাকতে না পেরে ধরেই ফেলল,
– হ্যালো
– যাক, অবশেষে দয়া হলো ফোনটা ধরার।
– আসলে আমি ফোনের কাছে ছিলাম না। তাই ধরতে পারিনি।
– আর সেদিন যে সারারাত কল দিলাম, সেদিন ধরোনি কেন?
– ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
– মিথ্যে বলোনা, অন্তত আমার কাছে।
– আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তা নাহলে তো পরদিন সকালের ফোনটাও ধরতাম না।
– সকালে ধরে তো লাভ নেই, অফিসে থাকলে কি কথা বলা সম্ভব?
– হুম বুঝেছি, বলো কি বলবে?
– কাল কি তুমি আমাদের এদিকে এসেছিলে?
চমকে উঠল তিতির, হ্যাঁ তিতির গিয়েছিল শুধু দূর থেকে মুগ্ধকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু মুগ্ধ তো ওকে দেখেনি। তাহলে?
– কই না তো। কেন জিজ্ঞেস করছো?
– না মানে কাল সকালে যখন বেড়িয়েছি, কেন যেন মনে হচ্ছিল তুমি ওখানে ছিলে!
– নাহ আমি বাসাতেই ছিলাম।
– ও, আমি অবশ্য চারপাশ দেখেছি, কোথাও তোমাকে দেখতে পাইনি। তবু মানুষের মন তো, অনেকসময় অনেক কিছু ভেবে ফেলে। তাছাড়া ইদানীং তোমাকে বড্ড বেশি মিস করি!
তিতির মনে মনে ভাবতে লাগলো, মুগ্ধ কিভাবে বুঝলো। এটা কি ওর ভালবাসার জোড়? নাকি টেলিপ্যাথি? তবু বলল,
– এটা তোমার আমাকে কল দেয়ার একটা ছুতো মাত্র।
– তোমাকে কল করতে আমার কোন ছুতো লাগেনা, মন চাইলেও কল করিনা কারন আমি জানি ফোন রাখার পরই প্রতিবার কেঁদে সমুদ্র বানিয়ে ফেল তুমি।
– হুহ, আজাইরা কারনে কাঁদিনা আমি, ওকে?? চোখের জল এত সস্তা না আমার।
– চোখের জল বাজারে বেচা-কেনা হয়না যে তা সস্তা আর দামি বলে বিচার করবে! সে যাই হোক তুমি কি কি কারনে কি কি সিচুয়েশনে কত কত কাঁদতে পারো তা অন্তত আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানেনা।
বলেই হাসলো মুগ্ধ। রাগে তিতিরের শরীর জ্বলে গেল। বলল,
– পুরোনো কথা তুলছো কেন?
– পুরোনো কথা কোথায় তুললাম? পুরোনো কথা তুললে তো তোমাকে মনে করিয়ে দিতাম তুমি আমাকে কিভাবে কিভাবে আদর করতে। আদর করতে করতেও কতবার কেঁদেছো।
– তুমি টপিক চেঞ্জ না করলে আমি ফোনটা রাখতে বাধ্য হবো।
– তুমি চাইলেও এখন ফোন রাখতে পারবে না। কারন তোমার ভেতরে যে আরেক তিতির বাস করে সে চাইবে না।
রাগে অভিমানে কান্না পেল তিতিরের। কেন যে মুগ্ধ এমন করে। তিতির কান্না চাপানোর চেষ্টা করলো। মুগ্ধ বলল,
– তুমি কি কাঁদতে বসলা নাকি? এখন কাঁদলে কিন্তু চলে যাবো তোমার বাসায়, দুই গালে দুইটা চর মেরে আসবো।
– আমার অত ঠেকা পড়ে নাই যে আমি তোমার জন্য বসে বসে কাঁদবো। নিজেকে কি মনে করো তুমি?
– নিজেকে রাজপুত্র মনে করি, তুমি আরেক রাজ্যের রাজকন্য। কথা ছিল যুদ্ধে জয়ী হতে পারলে রাজকন্যা কে পাবো। যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিদের হারিয়ে জয়লাভ করার পরও পূর্ব শত্রুতার রেশ ধরে রাজকন্যার ভ্রাতা রাজামশাইয়ের মন বিষিয়ে দিয়েছেন। এখন এই রাজপুত্রের হাতে আর কিছুই নেই।
– এত বেহায়াপনা করতে কি তোমার একটুও লজ্জা লাগেনা?
– আমার লজ্জাশরম আগেও ছিল না, এখনো নেই, বিন্দুমাত্র নেই। তুমি তো জানোই।
– মিনিমাম এতটুকু লজ্জা থাকা উচিত যতটুকু থাকলে মানুষ বেহায়া বলবেনা।
– একটু বেহায়া হয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায় তো সেটুকু বেহায়া আমি হাজার বার হতে পারবো তিতির।
চোখের জল মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করল তিতির, মুগ্ধকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না। মুগ্ধ ডাকল,
– তিতির
– হ্যা বলো।
– তুমি আমার কাছে চলে আসো প্লিজ। আমার ফ্যামিলিতে তো কোন প্রবলেম নেই, সবাই তোমাকে পছন্দ করে। তুমি তো জানোই। একবার আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ভাইয়া ঠিকই মেনে নেবে।
– আবার সেই পুরোনো কথা! তুমি কেন বোঝোনা সেটা সম্ভব হলে তো আরো অনেক আগেই করতাম।
– তুমি সম্ভব করলেই হবে।
– আচ্ছা একই কথা বলতে বলতে তুমি কি ক্লান্ত হওনা?
মনটা খারাপ হয়ে গেল মুগ্ধর। বলল,
– কেন তুমি অ্যাকটিং করছো? তুমিও তো আমাকে ছাড়া ভাল নেই।
– আমি মোটেই অ্যাকটিং করছিনা। অনেক ভাল আছি আমি।
– প্লিজ তিতির,এরকম করোনা। একা থাকতে থাকতে আমি বড্ড ক্লান্ত। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।
– আমার কিছু করার নেই। আমার ফ্যামিলির কথা আমাকে ভাবতেই হবে। তোমাকে আগেও বলেছি। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি যেতে পারবো না।
– আর কত ট্রাই করবো? তাদের রাজী করানোর সব চেষ্টাই তো করেছি। তারা যা বলেছে তাই করেছি। আর কি করতে হবে জিজ্ঞেস করো।
– তবু যখন মানছে না, তখন এত চেষ্টাই বা তুমি করছো কেন?
– কারন এখনো আমি তোমাকে ভালবাসি।
তিতিরের বুকের ভেতর ধ্ধক করে উঠল। মুখে বলল,
– এসব কথায় আজকাল আর আমার ভিতরে কিছু হয়না।
– কিছু হওয়ানোর জন্য বলিনি তিতির। একটু বোঝো আমাকে। তুমি না আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে!
– দিন বদলেছে তো। আজকাল অত কাউকেই বুঝিনা। বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।
– এত কঠিন হওয়ার ভান করছো কেন?
– আমি ভান টান করিনা তুমি সেটা জানো। আমি কঠিনই হয়ে গিয়েছি।
– আমাদের একসাথে কাটানো সব সুইট সময়গুলো, সব স্মৃতিগুলো ভুলে গিয়েছো?
– ভুলিনি কিছুই তবে ভোলা উচিৎ, এসব মনে রেখে কোন লাভ তো নেই। তাই ভোলার চেষ্টা করছি।
– পারবে ভুলতে?
– না পারার কি হলো? মানুষ পারেনা এমন কোন কিছুই নেই পৃথিবীতে।
– তাই? তাহলে বিয়ে করছো না কেন?
– আমার এখনো বিয়ে করার বয়স হয়নি তাই, আগে তো পড়াশুনা শেষ হোক।
– ঠিকাছে, দেখা যাবে।
– শোন তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, এজন্যই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিয়ে করো, বউ আসলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুগ্ধ হেসে বলল,
– আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি সহ্য করতে পারবে? তাছাড়া আমার শরীরে তোমার যত খামচি আর কামড়ের দাগ আছে তা নিয়ে কি অন্য মেয়েকে বিয়ে করা যায়? করলেও এসব দাগ দেখলে আমাকে জুতোপেটা করে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
তিতিরের বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– সেটা তোমার ব্যাপার তুমি কি করবে না করবে তুমি ভাল জানো। তোমার লাইফ, তোমার ডিসিশান।
– সেজন্যই এখনো অপেক্ষা করছি।
– অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। আমি কখনো পালাবো না।
– তাহলে তোমার ভাইয়াকে আরেকবার ধোলাই দেই কি বলো? এবার আর ৩ দিন না ৩০ দিন থাকার ব্যাবস্থা করে দেই হসপিটালে।
– হোয়াট?
চেঁচিয়ে বলল তিতির। মুগ্ধ বলল,
– হ্যাঁ, সেই অনেক বছর আগে ওর সাথে আমার কি একটা প্রবলেম হয়েছিল। সেটা ধরে এখনো বসে থাকবে কেন?
– তুমি হিরোগিরি দেখিয়ে ওকে মেরেছিলে কেন?
– ও আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিল কেন?
– কারন ও জানতো না তোমার গার্লফ্রেন্ড ওর বোন।
– মারার সময় আমিও জানতাম না যে ও তোমার বড় ভাই। যাই হোক ও নিজের বোন সম্পর্কে বলছে সেটা জানুক আর না জানুক, যে কোন মেয়েই কারো না কারো বোন। তাই যে কোন মেয়েকেই বোনের চোখে দেখলে কারো মুখ দিয়ে ওই বাজে কথাগুলো বের হয় না। বুঝলে?
তিতর বুঝল মুগ্ধ রেগে গেছে, তাই আরো রাগানোর জন্য বলল,
– আচ্ছা সেটা নাহয় বুঝলাম, আমার ভাই দোষ করেছিল। কিন্তু তোমরা ব্যাচেলর বাসায় মেয়ে নিয়ে এসেছিলে কেন?
অবাক হলো মুগ্ধ,
– মেয়ে!! ও তমালের গার্লফ্রেন্ড ছিল তিতির। যে কিনা এখন তমালের বউ। আর গার্লফ্রেন্ড কি বয়ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে পারে না? এই ব্যাপারটা তোমরা দুই ভাইবোন সহজ ভাবে নিতে পারো না কেন বলো তো। এমনভাবে “মেয়ে নিয়ে এসেছিলে” কথাটা বলছো যেন আমরা সবাই মিলে একটা মেয়েকে ভাড়া করে এনেছিলাম।
– মুখে লাগাম দাও।
– তোমাদের ভাবনা লাগামছাড়া হলে কোন দোষ নেই, আর আমার মুখটা লাগামছাড়া হলেই দোষ! একেই বলে কৃষ্ণ করলে লীলা…
– শোন ফালতু কথা কম বলো।
হেসে ফেলল মুগ্ধ। বলল,
– আচ্ছা দোষ যারই হোক, আমি অনেক মেরেছিলাম তাই তোমার বড় ভাইয়া আমার চেয়ে ছোট হওয়া স্বত্তেও তো আমি ওর পায়ে ধরে মাফ চেয়েছি। আর কি করলে ওর রাগ ভাঙবে বলো।
– ওর রাগ আর জীবনেও ভাঙবে না। ওর ইগোতে লেগেছিল।
– আচ্ছা ওর কথা বাদ দাও, ওর ইগো নিয়ে ও থাক। আমাকে এটা বলো যে তুমিও তো কত আমার বাসায় এসেছো। তাহলে তো সেটাও দোষের তাইনা? সেই দোষ মোচন করার জন্য আমাকে বিয়েটা করে ফেল।
– আমি তোমার ব্যাচেলর বাসায় কখনো যাইনি। গিয়েছিলাম তোমার ফ্যামিলি বাসায়। এবং তখন বাসায় সবাই ছিল, গোপনে লুকিয়ে চুরিয়ে যাইনি। বুঝেছো?
– হুম বুঝেছি।
– এখন রাখছি, প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।
হাসল মুগ্ধ। তিতির বলল,
– হাসছো কেন?
– এমনি।
– আচ্ছা, রাখছি গুড নাইট।
– গুড নাইট।

তারপরও কেউই ফোনটা কাটলনা। দুজনেই কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে ফোনটা ধরে রইল। অনেক সময় শুধু নিরবতাই পারে নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের অব্যক্ত কথাগুলো আরেকজনের কাছে পৌঁছে দিতে। অতঃপর মুগ্ধ বলল,
– রাখো।
ফোনটা রেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিতির। নিজের চুল ছিঁড়ল, হাত কামড়ালো, নিজের ওড়নাটাও ছিঁড়ে কুটিকুটি করলো। হঠাৎ একটা মেসেজ এল। হ্যাঁ মুগ্ধই পাঠিয়েছে,
” শান্ত হও, আমি এখনো মরে যাইনি যে তোমাকে এভাবে কাঁদতে হবে। আর তোমার হোয়াটস এ্যাপে একটা অডিও পাঠিয়েছিলাম, জানিনা কি কারনে সেটা এখনো ওপেন করোনি। আজ কি শুনবে একবার?”

তিতিরের দরকার হয়না বলে হোয়াটস এ্যাপ টা অনেক আগেই আনইন্সটল করে দিয়েছিল। তরিঘরি করে প্লে স্টোরে গিয়ে এ্যাপ টা ডাউনলোড করলো। আজ ডাউনলোড হতে যে কেন এত লেট হচ্ছে! উফফ!!!

অডিওটা প্লে করতেই প্রানটা জুড়িয়ে গেল তিতিরের। মুগ্ধ গাইছে,
“আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..
ভাল আছি ভাল থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
হোওওওও..
দিও তোমার মালাখানি
বাউলেরই মানটারে..
আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
হোওওওও..”।

মুগ্ধ দেখলো তিতির অডিওটা সিন করেছে। যাক তাহলে নিশ্চই শুনছে এখন। শুনে হয়তো কাঁদছে, কিন্তু শান্তি তো পাচ্ছে! এটাই অনেক। ও কি একটা টেক্সট করবে? তিতির নিশ্চই রিপ্লে দিবেনা। তখন খারাপ লাগবে। এসব ভেবেও টেক্সট একটা করেই ফেলল,
“তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।”
প্রায় সাথে সাথে মেসেজটা সিন করলো তিতির, কিন্তু রিপ্লে দিলনা। মুগ্ধ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো শুধু একটা রিপ্লে আসার জন্য। কিন্তু এলনা।

সারারাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে গানটা শুনলো তিতির। শুনতে শুনতে ভাবছিল ওদের প্রথম পরিচয়ের কথা। আহা! কি মিষ্টিই না ছিল মুহূর্তগুলো!!!

তিতিরের সাথে মুগ্ধর পরিচয়টা খুব অন্যরকমভাবে হয়। আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগে “ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ” এর একটা ইভেন্টে এটেন্ড করেছিল ওরা দুজনেই। ইভেন্টটা ছিল বান্দরবানে “নাফাখুম ট্যুর।”

তিতির এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফ্রি বসে ছিল। আর মুগ্ধ মাস্টার্স লাস্ট সেমিস্টারে উঠেছিল কেবল! ওটা ছিল তিতিরের সেকেন্ড ট্যুর উইদাউট ফ্যামিলি। প্রথমবার ফ্রেন্ডদের সাথে সিলেট গিয়েছিল এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে। তিতির অবশ্যই খুব ভাগ্যবতী যে ওর ফ্যামিলি ওকে সব ধরনের স্বাধীনতা দিত যা অন্য অনেক মেয়েরা আজও পায়না।

“বাংলালিংক বাংলার পথে” নামক একটা টিভি প্রোগ্রামে ট্রাভেলর টিংকু চৌধুরী বান্দরবানের এক অপার সৌন্দর্যময় জলপ্রপাত নাফাখুমকে দেখিয়েছিল। তা দেখেই তিতিরের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওখানে যাওয়ার জন্য। তার কিছুদিন পরই ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে নাফাখুম ট্যুরের একটা ইভেন্ট দেখতে পেল। সাথে সাথে বাবা কে দেখালো, বাবা একটু দোনোমনা করছিল কিন্তু ভাইয়া বলল,
-“ওকে যেতে দাও বাবা। ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ অনেক সেফ একটা গ্রুপ! আমার তখন ফাইনাল পরীক্ষা চলবে নাহলে আমিও যেতাম। তুমি চিন্তা করোনা তো, আমি জানি আমার বোন যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, তাছাড়া যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সে সেভ করতে জানে, এন্ড দ্যাটসওয়াই আম প্রাউ অফ হার!”

সময়টা ছিল নভেম্বর মাস, শীতের শুরু। রাত ১০ টায় বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে। ভাইয়া আর বাবা এসে ওকে বাসে তুলে দিল। ওকে দিতে এসে বাবা আরও চিন্তায় পড়ে গেল কারন, ইভেন্টে সবার সাথেই তাদের ফ্রেন্ডস, কাজিনস আছে কিংবা রিলেটিভস আছে, শুধু তিতিরের সাথেই কেউ নেই। তিতিরের অবশ্য এতে নিজেকে আরো ফ্রি ফ্রি লাগছিল। বাবা আর ভাইয়া ইভেন্ট ডিরেক্টর সাফি ভাইয়া আর দোলা আপুকে বলে গেল যাতে তারা ওর খেয়াল রাখে।
দোলা আপু তিতিরকে ওর সিট দেখিয়ে দিল। তিতির বলল,
-“আপু, রেজিস্ট্রেশনের সময় আমি বলেছিলাম যে আমি জানালার পাশে সিট চাই এট এনি কস্ট!”
দোলা আপু চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
-“সেকি! তোমার রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী এই সিটটাই তো তোমার! আচ্ছা, এই সিটটা যার সে আসুক আমি তার সাথে কথা বলে দেখি!”
তিতির হেসে বলল,
-“ওকে আপু, থ্যাংকস!”

দোলা আপু চলে গেল। শীতের মৃদুমন্দ বাতাসে তিতিরের হালকা শীত করছিল, কিন্তু জানালাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে হলোনা। তাই ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে নিল। সিটটা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। ওড়নায় ওর মুখটা ঢাকা। ওর যে কি ভাল লাগছিল তা বলে বোঝানোর মত না। খুব ফ্রি লাগছিল নিজেকে! আগামী ১০ দিন ও একটা অন্য জগতে থাকবে। ওর স্বপ্নের জগৎ! যেখানে থাকবে শুধু প্রকৃতি, শুধু সৌন্দর্য। যেখানে থাকবে না কোন নাগরিক কোলাহল! হঠাৎ একটা ডাক ওর ভাবনার রাশ টেনে ধরল,
-“স্কিউজমি!”
ও তাকাতেই দেখতে পেল একটা ছেলে ব্যগপ্যাক হাতে দাঁড়িয়ে! ও তাকাতেই স্বাভাবিকভাবে বলল,
-“আপনার পাশের সিটটা আমার, আমি কি বসতে পারি?”
তিতির ছেলেটার ম্যানার্স দেখে মুগ্ধ হলো। কিন্তু তারপর হঠাৎই খেয়াল হলো ওর পানির ফ্লাস্কটা পড়ে ছিল পাশের সিটে, ম্যানার্সের কিছু না ছেলেটা ভদ্রভাবে ওর পানির ফ্লাস্কটা সরাতে বলছে। ও ফ্লাস্কটা সরিয়ে বলল,
-“সিওর, বসুন।”
-“থ্যাংকস।”

ছেলেটা নিজের ব্যাগপ্যাক উপড়ে উঠিয়ে দিয়ে বসল। তিতির মনে মনে ভাবলো এই ছেলেটা যদি গায়ে পড়া হয় আর সারা রাস্তা প্যাঁচাল পেড়ে ওর মাথা খারাপ করে দেয়! সিনেমা দেখে দেখে তো ছেলেরা ইন্সপায়ার হয় লম্বা জার্নিতে মেয়েদের সাথে লাইন মারার ব্যাপারে! তারপর ভাবলো গান শুনুক আর না শুনুক হেডফোন কানে দিয়ে রাখুক তাতে ছেলেটা কথা বলতে চান্স পাবেনা। এসব ভাবনা শেষ না হতেই দেখলো ছেলেটা নিজের গলায় ঝুলানো হেডফোনটা কানে দিয়ে সিটটা এলিয়ে শুয়ে পড়লো! যাক বাবা বাঁচা গেল! তার মানে ছেলেটা ওর সাথে আজাইরা প্যাঁচাল পাড়বে না।
বাস ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক সবার রেজিস্ট্রেশন কার্ড চেক করতে লাগলো। ছেলেটা হেডফোন খুলতেই তিতির ওকে বলল,
-“স্কিউজমি!”
-“হ্যা, বলুন!”
-“একচুয়েলি, এই সিটটা আমার আর আপনি যেটাতে বসেছেন ওটা আমার।”
-“ও আপনি কি আপনার সিটে আসতে চাচ্ছেন?”
-“না মানে, আমি বলতে চাচ্ছি আমি কি আপনার সিটটা ধার পেতে পারি? একচুয়েলি আমি জানালার কাছে ছাড়া বসতে পারিনা, অস্বস্তি লাগে। তাই আমি রেজিস্ট্রেশনের সময় বলেছিলাম জানালার পাশে সিট লাগবে আমার। ওনারা কেন দিলনা বুঝলাম না।”
-“ও, ইটস ওকে! নো প্রব্লেম!”
এরপর চেকার এসে ওদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড চেক করে গেল।
তারপর সাফি ভাইয়া আর দোলা আপু একটা স্পিচ দিল। দোলা আপু শুরু করেছিল,
-“হ্যালো,
ডিয়ার ট্রাভেলার ব্রাদার্স এন্ড সিস্টার্স.. হোপ এভরিথিং ইজ ওকে স্টিল নাও।”
একথা বলেই আপু মিষ্টি একটা হাসি দিল। সেই হাসিতে মোটামুটি সবাই তাল মেলালো। তারপর সাফি ভাইয়া হেসে বলতে শুরু করলো,
-“ট্যুর প্ল্যান আপনারা সবাই কমবেশি জানেন, তবুও আরেকবার রিপিট করছি আমরা কোনো তাড়াহুড়োর ট্রিপ চাইনি। দৌড়ের উপর সব দেখা হয় ঠিকই কিন্তু উপভোগ করা যায়না, তখন ট্যুর হয় নট ট্রাভেলিং! তার উপর আমরা যাচ্ছি জঙ্গলে। তাই যেখানে ৬/৭ দিনে যাওয়া আসা হয় সেখানে আমাদের ১০ দিনের প্ল্যান! আজ রাত ১ টার দিকে কুমিল্লা পৌঁছে যাব, ওখানে আমরা আমাদের ডিনার করে নেব। তারপর আরেকটা টি-ব্রেক পাব ৩/৪ টার দিকে। সকাল ৬/৭ টার মধ্যে আমরা বান্দরবান শহরে পৌঁছে যাব। তারপর লাঞ্চ করে ওখা থেকে জিপে করে সোজা থানচি। পথে নিলগিরি, চিম্বুক পড়বে জাস্ট ১০ মিনিটের জন্য একটা ঢুঁ মারবো। তারপর আবার যাত্রা! থানচি পৌঁছাতে আমাদের দুপুর হয়ে যাবে। লাঞ্চ করবো ওখানেই। তারপর একটু রেস্ট নেব। যেহেতু থানচির পর আর কোন বাজারঘাট পাবো না তাই থানচি থেকেই পুরো ১০ দিনের বাজার করে নেব। বিকালটা আমরা বাজার করে আর পাশের একটা ছোট জলপ্রপাত ঘুরে কাটাবো। সন্ধ্যায় বার-বি-কিউ হবে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাব যাতে সকাল সকাল উঠতে পারি। আর থানচিতে আমরা তাঁবুতে থাকবো। পরদিন সকালে আমরা আবার রওনা দিব। কিন্তু নৌকায় করে, বাইরোড থানচি পর্যন্তই। রওনা দেয়ার আগে সবাই বাড়িতে কথা বলে নেবেন। কারন, থানচির পর থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। প্রায় দুইদিন নৌকা ভ্রমনের পর আমরা যেখানে পৌঁছাব সেই যায়গার নাম রেমাক্রি। রেমাক্রি থেকে তিন ঘন্টা হাটার পর আমরা পৌঁছাব আমাদের স্বপ্নের নাফাখুম জলপ্রপাতে। তারপর আমরা ওই রাতটা পাশের পাহাড়ি গ্রামে কাটাব। তারপর কাছের আরো দুটো জল্প্রপাত দেখব পরেরদিন। তারপর যেভাবে গিয়েছি ওভাবেই ব্যাক করবো। আশা করি এই যাত্রার জন্য আপনারা সকলেই মানসিকভাবে প্রস্তুত। সকলের কাছে পরস্পরের প্রতি সহযোগীতার মনোভাব আশা করছি। এখন আমরা আর অপরিচিত নই, আমরা এখন একটা ফ্যামিলি। গ্রুপের কোন মেম্বার অন্য মেম্বারকে কোন বিষয়ে হ্যারাস করবেন না, ছোট করবেন না। যদি কারো নেগেটিভ আচরণ দেখা যায় তাহলে তাকে ওই মুহূর্তে ওই যায়গায় ফেলে চলে যাওয়া হবে। রান্নাবান্না সাধারণত মাঝিরাই করে। কিন্তু মাঝিদের আমরা সবাই সাহায্য করবো, মনে রাখবেন দশের লাঠি একের বোঝা। রেমাক্রির পর থেকে রাস্তায় আপনাকে প্রচুর জোঁক ধরবে তাই নিজের প্রতি ও সকলের প্রতি এক্সট্রা খেয়াল রাখবেন। যখনই দেখবেন আপনাকে জোঁকে ধরেছে আশেপাশে যারা থাকবে তাদের কাছে সাহায্য চাইবেন। আর যদি আপনি দেখেন আপনার পাশের মানুষটিকে জোঁকে ধরেছে তাহলে তাকে নিজ দায়িত্বে সাহায্য করবেন। আর সব শেষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলছি, পাহাড়িদের ড্রেসআপ বাঙালিদের মত হয়না, দয়া করে তখন নিজের চোখকে ও মুখকে সংযত রাখবেন। তাদের জীবন্যাত্রার প্রতি সম্মান রাখবেন। মনে রাখবেন ওখানে আমরা বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য পাহাড়িদের কাছেই যেতে হবে। কারন আবার মনে করিয়ে দেই থানচির পর মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এতক্ষণ ধরে আমার বকবক শোনার জন্য ধন্যবাদ, হ্যাপি ট্রাভেলিং!”
তারপর আবার সেই একই ঘটনা। ছেলেটা হেডফোন কাজে গুঁজে দিল। আর তিতির জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ একটা ডাক কানে এল,
-“স্কিউজমি। স্কিউজমি! এই যে শুনছেন?”
তিতির চোখ মেলে দেখলো পাশের ছেলেটা ওকে ডাকছে, হায়রে! কখন ও ঘুমিয়ে পড়লো টেরই পায়নি! তিতির তাকাতেই ছেলেটা বলল,
-“সবাই ডিনার করতে নেমেছে। আমিও যাচ্ছি। আপনি বাসে একা ঘুমাবেন তাই ডাকলাম। কিছু মনে করবেন না।”
তিতির দেখলো পুরো বাসে কেউ নেই। বলল,
-“থ্যাংকস! কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি।”
-“হ্যা ভালই ঘুম আপনার, একটু আগে তো সাফি সবাইকে মিনি মাইকে বলল ২০-৩০ মিনিট ব্রেক টাইম। এর মধ্যে ডিনার সেড়ে নিতে হবে।”

তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। আসলেই যখন তখন যেকোনো যায়গায় ঘুমিয়ে পড়ার প্রতিভাটা ওর ভালই আছে। বাস থেকে নামতে নামতে ছেলেটা বলল,
-“বাই দ্যা ওয়ে, আমি মুগ্ধ। আপনি?”
তিতির বলল,
-“কি ব্যাপারে?”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“মানে?”
-“আপনি যে জিজ্ঞেস করলেন আমি মুগ্ধ কিনা ওটাই জানতে চাচ্ছি, কি ব্যাপারে মুগ্ধ হওয়ার কথা বলছেন? ট্যুর? বাট এটা তো মাত্র শুরু!”
ছেলেটা হেসে ফেলল,
-“আমার নাম মুগ্ধ। আমি আপনার নামটা জানতে চাচ্ছিলাম। বারবার স্কিউজমি স্কিউজমি করতে কার ভাল লাগে বলুন। আফটারল আগামী ১০ দিন একই যায়গায় থাকছি। নামটা তো জানা প্রয়োজন।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হেসে বলল,
-“ওহ, আমার নাম তিতির।”
-“বাহ, নামটা খুব সুন্দর! তিতির নামের মানে জানেন?”
-“হুম, একটা পাখির নাম।”
মুগ্ধ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-“তিতিরপাখি দেখেছেন কখনো?”
-“নাহ!”
-“তিতির খুব সুন্দর দেখতে।”
-“ঢাকায় আছে নাকি?”
-“নাহ, আমি ঝারখান্ডে দেখেছিলাম। রাঁচীর এক জঙ্গলে।”
-“বাপরে! আপনি খুব ঘোরাফেরা করেন নাকি?”
-“তা বলতে পারেন তবে আমি জঙ্গল প্রেমিক! পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরতে বেশি পছন্দ করি।”
-“ওহ! নাফাখুম গিয়েছেন আগে?”
-“হ্যা, দুইবছর আগে গিয়েছিলাম। এটা সেকেন্ড টাইম।”
-“আমার এই প্রথম।”
-“ওহ! আপনার সাথে কেউ নেই?”
-“নাহ! আমি একাই এসেছি। আচ্ছা আপনারা ছেলেরা মেয়েদের কোথাও একলা যেতে দেখলেই একথা জিজ্ঞেস করেন কেন?”
-“কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আসলে এই টাইপের ট্রিপে কখনো কোন মেয়েকে একা যেতে দেখিনি তো তাই। হয় ফ্রেন্ড, নয় বিএফ, নয় হাসবেন্ড, নয় কাজিন, নয়তো ভাই। কেউ কেউ সাথে থাকেই।”
-“আমার সাথে কাউকে লাগেনা। আই ক্যান টেককেয়ার অফ মাইসেল্ফ।”
-“আপনি বোধহয় রেগে যাচ্ছেন।”
-“নাহ, রেগে যাচ্ছিনা। সত্যি কথা বলতে কি আজকাল অনেক মেয়েরই যাওয়ার সাহসটা থাকে কিন্তু ফ্যামিলি যেতে দেয়না একা। সেক্ষেত্রে আমি বাঁধিয়ে রাখার মত একটা ফ্যামিলিতে জন্মেছি। আমি স্বাধীন, কখনো কেউ কোন কিছুতে বাধা দেয়না।”
-“বাধা দেয়না বলেই বোধহয় আপনি আপনার ফ্যামিলিকে রেসপেক্ট করেন। আর তাদের সম্মান বজায় রাখেন।”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা। ওরা আমার ইচ্ছে অনিচ্ছার এত মূল্য দেয় বলেই আমিও ওদের কথা রাখার ট্রাই করি অলওয়েজ।”
সাফি ভাই দূর থেকে হাত নাড়ছে। মুগ্ধও হাত নেড়ে তার রিপ্লে দিল। বলল,
-“চলুন, খেতে বসা যাক।”
মুগ্ধ সাফিদের টেবিলেই বসলো। সাফি কার সাথে যেন কথা বলছিল। চোখাচোখি হতেই হাসি বিনিময় হলো শুধু। দোলা জিজ্ঞেস করল,
-“কি অবস্থা আপু? ভাল লাগছে?”
-“হ্যা, খুব।”
-“কোন প্রব্লেম হলে আমাকে বলবে, আসলে বুঝতেই তো পারছো এতগুলো মানুষ! আলাদা ভাবে খেয়াল রাখা ডিফিকাল্ট।”
-“ইটস ওকে আপু, আমি আপনাকে বলবো।”
দোলা হেসে বলল,
-“বাই দ্যা ওয়ে, মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে আলাপ হয়েছে?”
মুগ্ধ বলল,
-“আরে উনি তো আমার পাশের সিটেই। আলাপ হবে না কেন?”
দোলা বলল,
-“ওয়াও, দেন গ্রেট! মুগ্ধ ভাইয়া তুমিও একা, ওনাকে একটু দেখে রেখো। উনি একা এই ট্রিপে।”
মুগ্ধ বলল,
-“তুই বলার আগে থেকেই দেখছি।”
তিতির চমকে তাকালো মুগ্ধর দিকে। দোলা বলল,
-“মানে?”
-“মানে সবাই বাস থেকে নেমে গিয়েছিল, তখনও উনি বাসে ঘুমাচ্ছিলেন। আমিই তো ডেকে নিয়ে এলাম। এটা দেখে রাখা হলোনা?”
দোলা হেসে বলল,
-“আচ্ছা বুঝলাম।”
খাওয়া শেষে উঠে যেতেই তিতির বলল,
-“বিল পে করতে হবে না?”
মুগ্ধ বলল,
-“না না, এটা ট্যুরের মধ্যেই। ওরাই দেবে। বাস ছাড়তে আরো ৪/৫ মিনিট বাকী। চলুন বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো যাক।”
তিতির ওর সাথে যেতে যেতে বলল,
-“আপনার সাথে কেউ নেই?”
-“নাহ, আমি একাই ঘুরি অলওয়েজ। তাছাড়া আমার সাথে ঘোরার মত কেউ নেইও।”
-“ওহ! আচ্ছা, দোলা আপু আপনার পরিচিত? তখন দেখলাম তুই করে বলছেন।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ও সাফির গার্লফ্রেন্ড, আর সাফি আমার আপন চাচাতো ভাই। সেই সূত্রেই দোলার সাথে পরিচয়।”
-“ওহ! কে বড়?”
-“আমি সাফির ১ বছরের বড়।”
-“ওহ!”
কিছুক্ষণ ওরা হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথমে কেউ কোন কথা বলছিল না। মুগ্ধই শুরু করলো,
-“আপনি কিসে পড়ছেন?”
-“এবার এইচএসসি দিলাম।”
মুগ্ধ অবাক হলো,
-“মানে এখনো ইউনিভার্সিটিতে যাননি?”
-“নাহ, পাবলিকে পরীক্ষা দিব তাই কোথাও এডমিশন নেইনি। এইতো ফিরে আসার পরই এক্সাম।”
-“তুমি তো পুরাই বাচ্চা। সরি তুমি করে বলে ফেললাম।”
-“ইটস ওকে। সাফি ভাইয়া, দোলা আপু তো প্রথম থেকেই তুমি বলে, আপনিই তো আপনি আপনি করছিলেন।”
-“ওহ! তাই না? ওই আর কি! আমি ওদের মত প্রথমেই কাউকে ওভাবে বলতে পারিনা।”
-“ও, আপনি কিসে পড়েন?”
-“ইস! আর চার মাস পরে কথাটা জিজ্ঞেস করতে যদি।”
-“তাহলে কি হবে?”
-“বলতে পারতাম আমার স্টাডি কম্পলিট।”
তিতির হেসে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“আমি ইংলিশে মাস্টার্স করছি। লাস্ট সেমিস্টারে পড়ছি। এই এই বাস ছেড়ে দিচ্ছে, চলো চলো।”
বাসে উঠে বসতেই মুগ্ধ বলল,
-“এখন কি আবার ঘুমাবে?”
তিতির হেসে বলল,
-“আপনি কি আবার হেডফোন কানে গুঁজবেন?”
এবার মুগ্ধও হেসে দিল।

পর্ব ২

সারাপথ ভালই টুকটাক গল্প হয়েছিল ওদের। কিন্তু গল্প করতে করতে তিতির কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো। মুগ্ধ অবাক হয়ে ভাবলো একটা মানুষ কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে! তিতির কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিল তার উত্তর দিয়ে খেয়াল করলো তিতির ঘুমাচ্ছে! খুব হাসি পাচ্ছিল মুগ্ধর। কিন্তু মেয়েটা বেশ! সহজ সরল, কিন্তু ভীষণ সাহসী। মুখটাও খুব মিষ্টি। অন্ধকার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ভোরের হালকা আলো এসে পড়েছিল তিতিরের মুখে। সত্যি অনেকদিন পর কোন মেয়েকে দেখে এতটা ভাল লাগছে। কাল রাতে যখন প্রথম দেখেছিল তখন কিন্তু কিছুই ফিল হয়নি। অন্যসব মেয়েদের মতই মনে হয়েছে কিন্তু এখন অন্যরকম লাগছে কেন জানি! হঠাৎ দোলার ফিসফিসানো গলা পাওয়া গেল,
-“হুম! ভাইয়া প্রেম কিন্তু এভাবেই হয়।”
মুগ্ধ আস্তে আস্তে বলল,
-“উফ তোরা না, এমনসব কথাবার্তা বলিস। যা ভাগ এখান থেকে।”
-“তাই? তাহলে ওর দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন? অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছো দেখলাম। ভাল লেগে গেল বুঝি!”
-“হুম! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে ট্রাভেলারদের ভাল লাগে।”
-“প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানে?”
-“তাকিয়ে দেখ ওর দিকে। তোদের মত এত রংচঙ মাখেনি, একদম ন্যাচারাল। আর তার উপর ভোরের আলো কিভাবে ভরিয়ে দিয়েছে ওকে দেখ।”
-“ওহ বাবা! আমি একটু সাজি বলে এভাবে বলতে পারলে ভাইয়া?”
-“তো এত আটা ময়দা মাখলে কি বলবো?”
-“হুহ!”
দোলা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আচমকা তিতিরের মাথাটা মুগ্ধর কাধে পড়লো। মুগ্ধ অবাক হয়ে দেখলো তিতিরের মাথাটা ওর কাধে একটু বাকা হয়ে আছে। একটু নিচু হয়ে বসলো যাতে তিতিরের কষ্ট না হয়। তাতে তিতিরও আরাম করে মাথাটা রাখতে পারলো। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এল ওর চুলের ভেতর থেকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো মুগ্ধর। মনে হলো মেয়েটা যদি সারাজীবন এভাবে ওর কাধে শোয়, ব্যাপারটা মন্দ হয়না। কিন্তু মেয়েটা তো বড্ড বাচ্চা।

এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা পার হয়ে গেল। মুগ্ধ কখনো বাসে ঘুমাতে পারে না। তাই পুরো বাস যখন ঘুমে বিভোর তখনও ও একা একা জেগে। হঠাৎ বাসটা নড়ে উঠলো। বোধহয় স্পিয়াদ ব্রেকার পার করলো। আর তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখে ও মুগ্ধর কাধে শুয়ে আছে! লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল। বলল,
-“সরি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ইটস ওকে।”
তারপর থেকে কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করছিল। কিছুই বলতে পারেনি আর। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,
-“প্লিজ বি নরমাল, আমি কিছু মনে করিনি।”
তিতির তাকালো। ছেলেটার চোখের মধ্যে যেন কিছু আছে। কিন্তু কি সেটা!”
যখন বাস বান্দরবান পৌঁছল, ঘিড়িতে তখন ভোর ৬ টা। বান্দরবান ঢোকার মুখেই তিতির অবাক হয়ে দেখতে লাগলো আসেপাশের সব গাছপালা অনেক নিচে নিচে। যে রাস্তায় ওদের বাস চলছে রা অনেক উঁচুতে। আর ওদের বাস ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বোধ করলো তিতির।
পাহাড়ী রাস্তায় ও এই প্রথম। হঠাৎ বাসটা বায়ে মোড় নিল। রাস্তার বাম পাশে একটা সার্কেল শেপের খাদ! আর তা পেরোতেই বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড! বাসস্ট্যান্ডের উল্টোপাশে বড় একটা পাহাড়কে দেখতে দেয়ালের মত লাগছিল। সব মিলিয়ে বান্দরবানের ওকে এভাবে বরণ করে নেয়াটা ভালই লাগলো তিতিরের। বরণই তো, ও তো টিভিতে দেখেছিল বান্দরবান কে। এই বাসস্ট্যান্ড টাও দেখেছিল। সাধারণ মফস্বলের বাসস্ট্যান্ডের মতই মনে হয়েছিল। কিন্তু এটা আদৌ সাধারণ না।

গ্রুপের ২৮ জন মেম্বারের ফ্রেশ হওয়া আর চেঞ্জ করার জন্য সাধারণ একটা হোটেলে ৪ টা রুম বুক করা ছিল। সব মিলিয়ে ৬ জন মেয়ে আর ২২ জন ছেলে। একটা রুম মেয়েদেরকে দেয়া হলো আর বাকি ৩ টা ছেলেরা ভাগাভাগি করে ইউজ করলো। সবাইকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সময় দেয়া হলো মাত্র ২ ঘন্টা। তিতির সেদিন মাত্র ৫ মিনিটে গোসল করেছিল। বাসায় থাকলে এই সময়ের মধ্যে জীবনেও গোসল করতে পারতো না।

ব্লু জিন্সের উপর ফুল স্লিভ হোয়াইট লেডিস শার্ট পড়লো তিতির। তার উপর ব্ল্যাক হুডি। চুলগুলোকে উপরে উঠিয়ে একটা ঝুটি করলো। তারপর ব্যাগ থেকে ওর প্রিয় ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কেডস টা বের করে পড়ে ব্যাগপ্যাকটা গুছিয়ে নিল। তারপর সেটাকে কাধে নিতে নিতে রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল মুগ্ধকে। হোটেলের লম্বা প্যাসেজটা শেষ হয়েছে যেখানে সেখানটার দেয়াল বারান্দার মত খোলা। ওখানেই মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। কথা বলা শেষ হতেই ডাকলো মুগ্ধ,
-“এই তিতির?”
তিতির মুগ্ধর কাছে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“বাহ, একদম ট্রেকার লুক!”
তিতিরে হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি রেডি হতে পারে বলে আমার জানা ছিলনা।”
-“রেডি হতে অবশ্যই টাইম লাগতে পারে। মেয়েদের দোষ দেয়া যায়না। কিন্তু এখানে তো আর আমি বিয়ে খেতে যাচ্ছিনা যে সাজুগুজু করবো আর লেট হবে। আমি জাস্ট শাওয়ার নিয়েছি। ঘুরতে এসে আর কিছুর প্রয়োজন দেখছিনা।”
-“তোমাকে যতটা ছোট ভেবেছিলাম ততটা ছোট কিন্তু তুমি নও।”
-“ছোট ভেবেছিলেন? কেন?”
-“তুমি আমার থেকে তো অনেক ছোটই, আর দেখতেও তুমি ছোট, তাই আর কি! বাট তুমি ম্যাচিওর।”
তিতির হেসে বলল,
-“আজকাল মেয়েরা ১৪,১৫ বছর বয়সে ম্যাচিওর হয়ে যায়।”
-“তাই নাকি? তা হতে পারে অবশ্য।”
মুগ্ধই আবার বলল,
-“বাই দ্যা ওয়ে, শুনেছিলে তো বলা হয়েছিল ফ্রেশ হয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে নিতে?”
-“হ্যা”
-“চলো নাস্তা করে আসি। আমি আবার একা খেতে পারিনা, তাই সঙ্গী খুঁজছিলাম আই মিন সাফির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, অন্যদের কাউকে তো চিনিনা। কিন্তু ওর কোন খবর নেই, তুমি যখন চলে এসেছো ভালই হলো তুমিও একা।”
-“কিন্তু সবার তো হয়নি। সবাই একসাথে খেতে যাবেনা?”
-“আরে নাহ! যার আগে হবে সে আগে খেয়ে নেবে তাতে চাপ কম থাকবে, এজন্যই তো রেস্টুরেন্ট ঠিক করে রেখেছে আগে থেকে।”
-“ওহ, ঠিকাছে তাহলে চলুন”
দুজনেই চুপচাপ খাচ্ছিল। হঠাৎ মুগ্ধ খেতে খেতেই বলল,
-“বাঁশ কুরুইল খেয়েছো কখনো?”
-“সেটা আবার কি?”
-“বাঁশ।”
বলেই মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল,
-“বাঁশ আবার কিভাবে খায়?”
-“বাঁশ যখন খুব কচি থাকে তখন ওটাকে মাটির হাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখে। তারপর ওই কচি বাঁশ কুচি করে কেটে চিংড়িমাছ অথবা মুরগী দিয়ে রান্না করে। পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবার। গ্রামঞ্চলে মানুষ খায় তবে কম। কিন্তু পাহাড়িদের এটা নিত্যখাবার।”
-“ওহ! বাট বাঁশ কিভাবে ভাল লাগতে পারে আমি বুঝতে পারছি না।”
-“এখানে কয়েকটা রেস্টুরেন্টে রান্না করে তবে এখন পাওয়া যাবে না। দুপুরে হয়। থানচি বাজার থেকে বাঁশ কুরুইল কিনে নিবনে। তারপর রান্না করে খাওয়াব। তখন দেখো কেমন লাগে!”
-“আপনি রান্না করতে পারেন?”
-“না পারার কি হলো? ব্যাচেলর তো।”
-“ওহ!”
মুগ্ধর খাওয়া শেষ। উঠে হাত ধুতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে তিতিরেরও খাওয়া শেষ হয়ে গেল। ওরা হোটেলের বাইরে গেল। হাঁটতে হাঁটতে তিতির বলল,
-“ব্যাচেলর তো বুঝলাম কিন্তু ফ্যামিলি? আই মিন বাবা মা?”
-“ওহ, ওনারা চিটাগাং থাকে।”
-“আপনাদের বাড়ি চিটাগাং এ?”
-“না না। বাবার পোস্টিং ওখানে।”
-“ওহ। আপনার ভাইবোন নেই?”
-“একটা ছোট বোন আর একটা ছোটভাই। বাবা মায়ের সাথে থাকে। ভাই স্কুলে আর বোন কলেজে পড়ে। তোমার?”
-“বড় ভাই একটা।”
-“ওহ!”
-“আর আপনি ঢাকায় কোথায় থাকমুগ্ধ বলল,
-“মেঘের আরো কাছে নিয়ে যাব তোমাকে। হাত বাড়ালেই মেঘগুলো লুটিয়ে পড়বে তোমার গায়ে।”
তিতির একথা শুনে বলল,
-“কোথায়? ওহ শুনেছিলাম নিলগিরি তে নাকি মেঘ ছোঁয়া যায়। সত্যি কি?”
-“হুম তবে সেটা খুব সকালে। ৮/৯ টা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা নিলগিরি পৌঁছাতে ১২/১ টা বেজে যাবে।”
-“ওহ!”
-“আমি অবশ্য বলছিলাম রুইলুই পাড়ার কথা।”
-“সেটা কোথায়? নামও তো শুনিনি।”
-“ওটা একটা মেঘের দেশ! সাজেকের একটা গ্রাম।”
-“সাজেক খাগড়াছড়ি তে না?”
-“না না খাগড়াছড়ি দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সাজেক রাঙামাটিতে।”
-“ও। রাঙামাটিতে হলে খাগড়াছড়ি দিয়ে কেন যেতে হবে?”
-“রাঙামাটি দিয়ে কোন রাস্তা এখনো তৈরী হয়নি।”
-“ওহ! কিন্তু ওখানে আপনি আমাকে কি করে নিয়ে যাবেন?”
প্রশ্নটা শুনে মুগ্ধ কোন উত্তর খুঁজে পেলনা। সত্যি তো, কেন বললো ও একথা! তিতিরও প্রশ্নটা করে বোকা হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্নটাতো এখন আর ফিরিয়ে নেয়া যাবেনা। মুগ্ধ বলল,
-“না মানে তুমি একবার যখন ট্রাভেলিং শুরু করে দিয়েছো, ট্রাভেলিং ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না তাই টিওবি থেকে সাজেকে কোন ট্রিপে হয়তো তুমি যাবে আর আমি তো ওদের প্রায় সব ট্রিপেই থাকি। তখন আমি তোমাকে আলো ফুটতে না ফুটতেই ডেকে নিয়ে যাব সেই স্বর্গীয় যায়গায়।”
-“গুড আইডিয়া। টিওবি মানে অরিজিনাল টিওবি আই মিন সাফি ভাইদের টা না। অথরিটির কোন সাজেক ট্যুর হলে আমাকে জানাবেন প্লিজ! আমি যাব।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হা হা হা, অরিজিনাল টিওবি!”
-“অবশ্য জিপ মিস করে খারাপ হয়নি। শাপে বর হয়েছে।”
-“কিরকম?”
তিতির কিছু বলার আগেই হাসু ডাক দিল,
-“মামা কহন যাইবেন?”
মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-“এই খেয়ালই ছিল না। চলো চলো.. দেরী হয়ে যাবে আমাদের।”
তিতির সিওএনজিতে উঠতে উঠতে বলল,
-“অনেস্টলি স্পিকিং মিলনছড়ি অনেক সুন্দর। যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সিএনজি আবার চলতে শুরু করলো। মুগ্ধ বলল,
-“সামনে এরকম শত শত সুন্দর যায়গা পড়বে, যাকে বলে একেবারে ভিউ পয়েন্ট। সব যায়গায় নেমে ২ মিনিট করে থাকলেও ২ দিনের আগে থানচি যেতে পারবো না।”
-“তাহলে কি আমরা ওই শত শত যায়গার মধ্যে ৪/৫ টা যায়গায়ও নামব না?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা তা নামব।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ তিতিরকে ইশারা করে দেখালো,
-“ওইযে দেখতে পাচ্ছো রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছো ওদিকে গিয়ে পাহাড় কেটে কেটে সিড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিড়ি দিয়ে উঠলেই ‘মিলনছড়ি হিলসাইড রিসোর্ট’ বেশ কয়েকটা কটেজ আছে ওদের। আমি থেকেছিলাম যে কটেজে সেটার নাম ছিল মুনিয়া। কটেজের বারান্দায় গিয়ে আমি তো স্পিচলেস হয়ে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর! শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সব গুলো কটেজ এর নাম পাখির নামে বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, চড়ুই, মুনিয়া। তিতির নেই অবশ্য।”
তিতির হেসে ফেলল। মুগ্ধ এবার বলল,
-“নাও এবার বলো জিপ মিস করে কিভাবে শাপে বর হলো?”
-“ও, হ্যা! দেখুন, একেকটা জিপে আমাদের ১৪ জন করে বসতে হত। ৭ জন ডানপাশে, ৭ জন বামপাশে। এতগুলো অচেনা মানুষ মুখোমুখি বসে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এদের বেশিরভাগ মানুষই অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলবে তবে সেটা নিজেদের মধ্যে। অন্যদের সাথে পরিচিত হবার কোন দরকার নেই যেন। বাসে আর রেস্টুরেন্ট গুলোতে যেমন হয়েছে। আর আমরা যারা একা একা এসেছি তারা বলদের মত বসে থাকবো। তার চেয়ে এটাই ভাল হয়েছে না? অন্তত ওদের হা হা হি হি থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল।”
-“হা হা হা, ওয়েল সেইড.. ওয়েল সেইড।”
-“হুম!”
-“আসলে এসব ট্যুরে কেউ একা একা আসেনা। ফ্রেন্ডস, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, ফ্যামিলি এভাবেই আসে। তাই তারা অন্যদের সাথে পরিচিত হবার তাগিদ ফিল করেনা।”
-“কই আপনি তো একা এসেছেন। যদিও আপনার কাজিন আছে কিন্তু সে তো তার ফ্রেন্ড সার্কেলদের সাথেই ছিল পুরোটা সময়। সেই হিসেবে আপনিও একাই এসেছেন।”
-“আসলে আমি যেখানেই যাই একাই যাই। অন্যদের সাথে আমার মেলেনা। খুব হতাশ হই গ্রুপের মানুষদের কিছু কাজকারবার দেখে। এগুলো টিওবির ট্যুরেও থাকে। গ্রুপে গেলে এগুলো থেকে রেহাই নেই।”
-“যেমন? একটু ডিটেইলে বলুন না। আমার তো কোন অভিজ্ঞতা নেই।”
-“যেমন ধরো, এরা অনর্গল হইচই করতে থাকবে। কথা বলুক, কথা বলাতে তো আর কোন প্রব্লেম নেই। এই যেমন আমরাও তো কখন থেকে কথা বলছি। কিন্তু হইচই তো করছি না। হইচই করলে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পাহাড় হলো নিরব, নিস্তব্ধ। এখানে এসে নিস্তব্ধতা বজায় রাখা আবশ্যক। হইচই করে পাহাড়েরও যে একটা নিরব ভাষা আছে সেটা ওরা শুনতেই পারে না। বিরাট এক মিস করে ফেলে।”
তিতির দেখলো মুগ্ধ খুব সিরিয়াসলি কথা বলছে তাই ও সিরিয়াসলি বুঝতে চায় ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করলো,
-“সত্যি কি পাহাড়ের কোন ভাষা আছে? আপনি বুঝতে পারেন সে ভাষা?”
-“শুধু আমি কেন তুমিও বুঝতে পারবে। কোন এক পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনে দেখো তারা কি বলতে চায়। আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারবে।”
তিতির ট্রাই করবে, যদি সত্যি পাহড়ের কোন ভাষা থেকে থাকে তবে রা বুঝতে চায় তিতির। তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তারপর হতাশার বাকি কারনগুলো বলুন।”
-“সেকেন্ড কারন হলো ছবি। যেকোন যায়গায় গেলে তার স্মৃতি রাখার জন্য ছবি তোলে মানুষ। খুব ভাল কথা। কিন্তু আজকাল দেখি যাওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় ফটোসেশন পর্ব। যতক্ষণ সময় থাকবে ততক্ষণই ছবি তুলতে থাকে, এই পোজে সেই পোজে। আমি অবাক হয়ে যাই। এন্ড তাদের জন্য আমি ডিস্টার্ব ফিল করি। আমার পাহাড়ের সাথে প্রেমে ওরা বিঘ্ন ঘটায়। আমার মোবাইলে দেখো.. আমি যত যায়গায় গিয়েছি তার সব যায়গার দুএকটা ছবি পাবে কিন্তু আমার নিজের কোন ছবি পাবেনা। আরে ভাই ছবি তো ঢাকায় বসেও তোলা যায়।”
তিতিরের হঠাৎ খেয়াল হতেই বলল,
-“আরে.. আমিও তো সারাদিন ছবি তুলতে থাকি কিন্তু বান্দরবান আসার পর থেকে একটা ছবিও তুলিনি। এত সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে গেছি। মনেই পড়েনি ছবি তোলার কথা।”
-“কারন তুমি প্রকৃত ট্রাভেলার। আর ওরা ট্যুরিস্ট!”
-“আমি না ট্রাভেলার আর ট্যুরিস্টের ডিফারেন্সটা বুঝিনা।”
-“আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি। ট্যুরিস্টরা কোথাও যাওয়ার আগের ২/৩ মাস ধরে প্ল্যান করে, টাকা জমায়। রুম বুক করে। বিলাশবহুল হোটেলে থাকতে চায়। ভাল খেতে চায়। যেখানে যাওয়ার রাস্তা ভাল, সুযোগ সুবিধা ভাল সেখানে যায়। যেখানে যাবে সেটাকে ব্যাগরাউন্ডে রেখে ছবি তুলে তুলে পুরো সময়টা ব্যায় করবে। ছবির সংখ্যা হবে অগনিত। আর স্পেশালি চিপসের প্যাকেট, কলার খোসা, পানির বোতল ইত্যাদি ভ্রমন স্থানে ফেলে আসবে।”
তিতির হেসে বলল,
-“ওহ! আর ট্রাভেলার রা?”
-“ট্রাভেলার রা হলো, মন চাইলো কোথাও যেতে.. ইন্সট্যান্ট পকেট হাতড়ে দেখবে তার কাছে কত টাকা আছে? যদি ভাল টাকা পয়সা থাকে তাহলে যেখানে মন চায় চলে যেতে পারবে। কিন্তু যদি কম টাকা পয়সা পায় যেমন ধর, ৪ হাজার টাকা পায় তাহলে চলে যাবে সেন্ট মার্টিনস। যদি ৩০০০ টাকা পায় তাহলে ছোটখাটো পাহাড়ে চলে যাবে। ২০০০ পেলে যাবে কক্সবাজার। আর যদি ১০০০ পায় তাহলে সিলেট তো আছেই।”
-“মানে? সিলেট কিভাবে ১০০০ এ যাওয়া যাবে?”
-“আসলে সিলেটের জন্য ১০০০ অনেক বেশি। ট্রেনে করে চলে যাবে। ইকনমি ক্লাসে চড়ে বা স্ট্যান্ডিং টিকেটে। ৩০ টাকার রুমে থাকবে। ১০ টকার ভাত। ১০ টাকার সবজি ১০ টাকার ডাল। মোট ৩০ টাকায় খাওয়া কম্পলিট। তাছাড়া সিলেটে মাংস ভাতও খাওয়া যায় ৭০/৮০ টাকায়।”
-“সিরিয়াসলি? আপনি মজা করছেন না তো?”
-“মজা কেন করবো? ইটস ট্রু!”
-“খাওয়াটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ৩০ টাকায় থাকা যায় কিভাবে? ফ্লোরিং করে নাকি ডরমিটরি সিস্টেমে?”
-“পুরো একটা রুম ভাড়া ৩০ টাকা। রুমে টিভিও আছে। প্রব্লেম একটাই, একটু রিস্কি! মেয়েদের জন্য।”
-“ওহ! হুম আমাদের দেশের সব সুবিধা তো ছেলেদের জন্যই।”
-“মেয়েরা তোমার মত সাহসী হলে মেয়েদের আর কোন প্রব্লেম থাকবে না।”
-“মেয়েদের প্রব্লেমের শেষ নেই কোনো। শুধু সাহস দিয়ে কি হবে?”
-“তুমি কি মিন করছো ঠিক ধরতে পারছি না।”
-“মিন করছি যে মেয়েরা তো বন্দী। ভাইয়া রিকোয়েস্ট না করলে বাবা-মা কখনো আসতে দিতনা। আমি নাহয় ভাইয়ার কারনে যেতে পারছি। কিন্তু আমার মত অনেক মেয়েরা আছে যারা ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও বনে জঙ্গলে যেতে পারেনা। কারন, ফ্যামিলি থেকে এসব যায়গায় কেউ যায়না। বয়স্করা এত কষ্ট করতে পারবে না তাই। আর মেয়েগুলোর ঘুরাঘুরিও কক্সবাজার, সেইন্ট মার্টিনস, সিলেট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।

-“ঠিক, কিন্তু আজকাল আস্তে আস্তে মেয়েরাও সুযোগ পাচ্ছে। আমি তো আমার বোনকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাই গ্রুপে গেলে, ও যদি ফ্রি থাকে। ওর ফ্রেন্ডদের সাথেও যেতে দেয় ফ্যামিলি থেকে।”
-“হুম এখন দেয়। আমাকেও দেয়। কিন্তু যখন আমাদের বিয়েসাদি হবে তখন আর পারবো না।”
-“বাপরে! কোন যুগে পড়ে আছো? তোমাকে দেখলে কিন্তু মনে হয়না তোমার চিন্তাধারা এমন।”
-“যা সত্যি তাই বললাম। যাই হোক, বাদ দিন। আপনি বলুন, একা একা ঘুরেই যদি আপনার এত আনন্দ তাহলে গ্রুপে কেন যান?”

-“একা একা ঘুরে আনন্দ ঠিক আছে তবে মনের মত সঙ্গী হলে দোকলাও প্রব্লেম নেই। বরং ভাল, নিজের ফিলিং শেয়ার করা যায়। আর গ্রুপের কথা যদি বলো সেখানে এত মানুষ সবাই তো আর আমার মনের মত হবে না। আবার একধরনের দূরের আর এক্সপেনসিভ ট্যুর গুলোতে তো গ্রুপ ছাড়া উপায়ও নেই। একেক যায়গার ভাড়া কিরকম তা তো দেখলেই। এসব যায়গায় থাকা খাওয়ার খরচ খুবই কম কিন্তু ভাড়াতেই সব চলে যায়। থানচি থেকে যে নৌকায় যাব তার ভাড়াও প্রায় ৭/৮ হাজার টাকা। তাহলে বোঝো একা তো পোষায় না। আর খরচের ব্যাপারটা আমাকে চিন্তা করতেই হয় কারন, প্রতি মাসেই আমি কোথাও না কোথাও যাই। বৃহস্পতিবার অফিস করে রওনা হই, শুক্র,শনি ঘুরে শনিবার রাতে ব্যাক করে রবিবার থেকে আবার অফিস করি। এরকম প্রতি মাসে অন্তত একবার হয়। আর বড় রকমের ট্যুর বছরে ২/৩ বার।”

তিতিরের চোখগুলো বড় হয়ে গেল।
-“এত ঘুরাঘুরি করেন?”
-“ওই আর কি!”
-“আপনার না স্টাডি কম্পলিট হয়নি তাহলে জব করেন কিভাবে?”
-“ইভেনিং এ মাস্টার্স করছি, প্রাইভেটে।”
-“ওহ!”
হঠাৎ গাড়িটা ডানে মোড় নিতেই টাল সামলাতে না পেরে তিতির মুগ্ধর গায়ের উপড়ে গিয়ে পড়ল। তারপর হয়তো সিএনজি থেকেই পড়ে যেত কিন্তু মুগ্ধ তার আগেই তিতিরকে ধরে ফেলল। তারপর বলল,
-“শক্ত হয়ে বোসো। আমি সময়মত না ধরলে তো পড়ে যেতে।”
ওয়াইজংশন যেতেই মুগ্ধ গাড়ি থামাতে বলল। মুগ্ধ সিএনজি থেকে নেমে বলল,
-“তিতির নামো।”
তিতির নামল। তারপর বলল,
-“রাস্তার ব্যাপারটা দেখেছো?”

তিতির দেখলো এতক্ষণ ওরা একটা রাস্তায় এসেছে। সেই রাস্তাটাই এখানে এসে একটা বাম দিকে নিচে চলে গেছে, পাশে অনেকটা জমির মত কিছুটা সমতল। আরেকটা রাস্তা ডান দিকের বড় পাহাড় ঘেঁষে উপরে চলে গেছে। মোড়টাতে বেশ কয়েকটা দোকানপাট আছে। সব দোকানদার মহিলা। শুধু একটা কাঠের টেবিলে পেঁপে নিয়ে বসে আছে এক বুড়ো-বুড়ী। তিতির বলল,
-“বাহ, যায়গাটা তো বেশ সুন্দর। আচ্ছা, রাস্তাটা এরকম দোতলা টাইপ কেন?
-“দোতলা! ওয়াও.. কিন্তু তোমার এই মোড়টাকে ওয়াইশেপ বলে মনে হচ্ছে না?”
তিতিরের এবার খেয়াল হলো। বলল,
-“আসলেই ওয়াই শেপই তো।”
-“এজন্যই এই যায়গার নাম ওয়াইজংশন।”
-“ওহ!”
-“চা খাও তো?”
-“খুব! বা খেলেই বরং খারাপ লাগে।”
-“তাহলে এতক্ষণ বলোনি কেন?”
-“আমি ভাবিনি এখানে চা পাওয়া যাবে।”
-“আচ্ছা, চলো। চায়ের সাথে আর কি খাবে?”
-“আর কিছুনা। আচ্ছা আমরা কোন রাস্তাটা দিয়ে যাব?”
-“উপরে যেটা গেছে ওটা দিয়ে।”
-“ও। আর নিচের ওই রাস্তাটা দিয়ে কোথায় যায়?”
-“ঠিক নিচের না। এখানে নিচে তবে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। ওটা দিয়ে বগালেক, কেওক্রাডং এসব যায়গায় যায়।”
-“ওহ!”
মুগ্ধ দোকানে বসে বলল,
-“আপু, তিনটা চা দিয়েন।”

তিতির দোকানদার মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা স্কার্ট পড়া। চাকমা টাইপ চেহারা হলেও খুব সুন্দর। তিতিরের স্কিন খুব ভাল। নিজের স্কিন নিয়ে ওর কোনই আক্ষেপ নেই। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে নিজের প্রতি আক্ষেপই হচ্ছে। ও ফিসফিস করে মুগ্ধকে বলল,
-“মেয়েটা তো ব্যাপক স্মার্ট! আর মারাত্মক সুন্দর।”

-“এই কুনজর দিও না। স্মার্ট হবে না কেন? পাহাড়ে থাকে বলে কি ওরা স্ট্যাইল জানেনা ভেবেছো? আর ওরা এত সুন্দর যায়গায় থাকে, ফ্রেশ ওয়েদার। ওরা তো সুন্দর হবেই। আর তুমি এভাবে বলছো কেন? তুমি কি ওর চেয়ে কম নাকি?”

তিতির লজ্জা পেল। মুগ্ধও অকওয়ারড ফিল করলো। কি বলে ফেলল! প্রসঙ্গ পালটাতে মুগ্ধ তারপর হাসুকে ডাক দিল,
-“এই মামা, এদিক আসো।”
হাসু আসতেই বলল,
-“তুমি ওই কোনার মধ্যে বইসা আছো ক্যান? নেও চা-বিস্কুট খাও।”
হাসু চা নিল। বিস্কুটও নিল।
মুগ্ধ চা খাওয়া শেষ করে তিতিরকে বলল,
-“মজা দেখবে এসো।”
তারপর পেঁপের দোকানের সামনে গেল। তিতিরও সাথে গেল। বুড়ো-বুড়ী ওদের দেখেই হেসে দিল। মুগ্ধ একটা পেঁপে হাতে নিয়ে বলল,
-“দাদা, এটা কত?”
বুড়ো বলল,
-“তিইত তাকা।”
মুগ্ধ আরেকটা পেঁপে নিয়ে বলল,
-“আর এটা?”
বুড়ো একটু ভেবে বলল,
-“এতা পঁয়তিত তাকার মোতন।”
-“মিষ্টি হবে?”
বুড়ো হেসে বলল,
-“মিত্তি হবে।”
-“কেটে দেয়া যাবে?”
-“হি, কেতে দেয়া দাবে।”
মুগ্ধ একটা পেঁপে এগিয়ে দিল,
-“এটা কেটে দেন। আর ওইটা এমনই দিয়ে দেন।”

বুড়ো খুব সুন্দর করে পেঁপেটা কাটলো তারপর ধুয়ে পলিথিনে ভরে দিল। মুগ্ধ সেটা হাতে নিয়ে টাকা দিয়ে তিতিরকে নিয়ে সিএনজিতে উঠলো। সিএনজি ছেড়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“যে মজাটা দিতে চেয়েছিলাম সেটা কি পেয়েছো?”
-“হ্যা, ওরা কি সুন্দর করে কথা বলে!”
-“খুব মিষ্টি না? আমার তো পাহাড়ীদের কথা শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।”
তিতির বলল,
-“আপনার কি পেঁপে অনেক পছন্দ?”
মুগ্ধ বলল,
-“পেঁপে বান্দরবানের জাতীয় ফল। ঢাকায় সারাবছরে একটা পেঁপেও খাইনা। কিন্তু বান্দরবান এলে ডেইলি ২/৩ টা পেঁপে খাই। এত মিষ্টি পেঁপে আমি পৃথিবীর আর কোথাও খাইনি। একবার খেয়ে দেখো। ঢাকা গিয়ে আর পেঁপে খেতে ইচ্ছে করবে না।”
-“আচ্ছা পরে খাবো।”
-“আরে খাওনা। খুব মিষ্টি। তোমরা মেয়েরা এত ডায়েট করো কেন বলোতো?”
-“আমি ডায়েট করিনা। অনেক খাই, খেলেও আমি মোটা হইনা।”
-“তাহলে খাও।”
তিতির পেঁপে নিল। মুখে দিয়ে ওর মনে হলো চিনি মাখিয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ পেঁপে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি মিষ্টি না?”
-“হুম, মিষ্টির জন্য মাথা ধরে যাচ্ছে। বাপরে! মনে হচ্ছে ১ কেজি চিনি মাখানো হয়েছে পেঁপেটাতে।”
মুগ্ধ হাসলো।

কোন মানুষ যে যেকোনো সিচুয়েশনে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে তা মুগ্ধ আগে জানতো না। আর ঘুমানোর পর যে কারো মুখটা এতটা মায়াবী লাগে তাও ও জানতো না। তিতির ঘুমাচ্ছে, হ্যা সিএনজিতেই ঘুমাচ্ছে। যাতে পড়ে না যায় তাই ওর সামনে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সিএনজি ধরে রেখেছে মুগ্ধ। ওর খুব ভাল লাগছে। ওর চোখ দুটো তিতিরের বন্ধ চোক, নাক, ঠোঁট, গাল, নিঃশ্বাস আর কপালের উপর এসে পড়া চুলের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো সত্যি ঘুমকুমারী!
তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো মুগ্ধ গুনগুন করে গান গাইছে। ও বলল,
-“আপনি গান গাইতে পারেন?”
মুগ্ধ বেড়ী দিয়ে তিতিরকে আগলে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল। তিতির আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। তিতিরের ঘুমে জড়ানো কন্ঠস্বরটা মুগ্ধর বুকে গিয়ে লাগলো। মুগ্ধ সত্যি এবার চিন্তায় পড়ে গেল। ও তিতিরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? সর্বনাশ! তিতিরকে ভাল লেগেছে এটা ঠিক, কাল যখন বাসে ওর কাধে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন থেকেই। ভাল লাগাতে তো দোষ নেই। কিন্তু প্রেমের মত ভুল ও আর করবে না, খুব শিক্ষা হয়েছে। আর না। ও জানে ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে।

মুগ্ধ চুপ করে আছে দেখে তিতির আবার জিজ্ঞেস করল,
-“কি হলো বলুন না, আমি তো আপনাকে গুনগুন করতে শুনলাম।
-“গান কে না গাইতে পারে?”
-“আমি পারিনা। আচ্ছা, আপনি যখন গান গাইতে পারেন আমাকে একটা গান শোনান। গান আমি খুব পছন্দ করি।”
-“এখন?”
-“হুম, এখনই তো গাইছিলেন।”
-“আমি যদি গাইও সিএনজির শব্দে কিছু শুনতে পাবে না। তারচেয়ে থানচি পৌঁছে রাতে শোনাবো।”
-“আমাদের থানচি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে?”
-“অলমোস্ট।”
-“ও।”
তারপর মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তিতির, তুমি এই গুণটা কিভাবে রপ্ত করেছো একটু বলবে? আমি না রাতে ছাড়া ঘুমাতেই পারিনা। আমাকে টিউটোরিয়াল দাও। খুব দরকার।”
-“ওটা আমার জন্মগত গুণ, আর প্লিজ আমার ঘুম নিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা সরি।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সিএনজি চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে দেখা গেল বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তারা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“তুমি বলেছিলে সিলেট গিয়েছো, সিলেটের কোথায় গিয়েছো?”

-“মাধবকুন্ড, জাফলং, রাতারগুল আর সিটিতেই একটা চা বাগানে। আর মাজারে তো গিয়েছিই।”
-“সবাই এসব যায়গায়তেই যায়। আমিও প্রথম এসব যায়গাতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু নেক্সট বার সিলেট গেলে বিছনাকান্দি মাস্ট যাবে।”
-“বিছনাকান্দি কোথায়? আর ওখানে কি আছে?”
-“বিছনাকান্দি সিলেটেই। তবে যাওয়ায় একটু প্রব্লেম আছে। প্রথমে লেগুনা কিংবা সিএনজিতে করে যেতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে। তারপর নৌকায়। কিন্তু এত কষ্ট করে যাওয়ার পর যায়গাটা দেখে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ওখানে আকাশ নীল, পাহাড় নীল। নদীর পানিও নীল। ইন্ডিয়ার একদম সীমান্তে। ইন্ডিয়ার একটা ঝড়নার পানি এসে ওই নদীটায় পড়ে। অনেকটা জাফলং এর মতই, পানির নিচে পাথর। তবে ডিফারেন্স হলো ওগুলো অনেক বড় বড় পাথর আর জাফলং এর পানি যেমন সবুজ, বিছনাকান্দির পানি নীল। শুধু যে নীল তাই নয় স্বচ্ছও। এত স্বচ্ছ পানি যে তুমি গলা সমান পানিতে নেমে গেলেও নিচে তাকিয়ে পায়ের পাতাটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবে। তা বলে একা একা নেমো না, স্রোত তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির স্রোত এত বেশি যে অনবরত কলকল ধ্ধনি হতে থাকে। জাস্ট স্পিচলেস!!!”

-“ধুর, আপনি খুব খারাপ! খালি লোভ দেখান।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বাইরে তাকালো।
আরেকটু সামনে যেতেই তিতির বিমোহিত হয়ে গেল রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে। দুপাশের পাহাড়গুলোই রাস্তা থেকে অনেক নিচে। বাম পাশের পাহাড়গুলো দেখতে একরকম, ডান পাশের গুলো আবার আরেকরকম। রাস্তার ধারে ফুটে রয়েছে রঙ বেরঙের বুনোফুল আর অচেনা ছোট ছোট বুনোলতা। তিতিরকে সেদিকে তাকিয়ে তাকতে মুগ্ধ বলল,
-“সুন্দর না বুনোলতা গুলো?”
-“হুম।”
-“বলোতো কেমন লাগতো এগুলো না থাকলে?”
-“মানে?”
-“আসলে এগুলো তো আগাছা! এগুলো যদি নিয়মিত কেটে ক্লিন করে রাখা হতো তাহলে কেমন লাগতো?”
-“কি জানি! সেরকম তো আর দেখিনি কখনো। এইতো প্রথম দেখছি।”
-“ভাল লাগতো না। মেঘালয়ে এসব আগাছা নিয়মিত কেটে রাখা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ ফিট উপরে কিন্তু সব পাকা রাস্তা। সব কিছু হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। এই ২৮০০ ফিট উপরের সাধারণ বুনো সৌন্দর্যই আমার কাছে বেশি ভাল লাগে।”
-“ও।”
মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“যা ন্যাচারাল তা সব আমার ভাল লাগে।”
তিতিরের কেমন যেন লাগলো বুকের ভেতর। তিতির বুঝলো না!
দরজায় টোকা পড়ল। তারপর ভাবীর গলা পাওয়া গেল।,
-“তিতির, এই তিতির.. ওঠো, আজ না তোমার ৮:৩০ এ ক্লাস। এখনো যে উঠছো না? দেরী হয়ে যাবে তো বাবা।”
তিতির চোখ মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
-“ভাবী আমি উঠেছি, তুমি যাও.. আমি আসছি।”

মুগ্ধর পাঠানো অডিওটা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের প্রথম পরিচয়ের সেই বান্দরবান ট্রিপের কথা। আজ ৫ বছর পরেও চোখে ভাসে সব। ওসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পার হয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে ও টেরই পায়নি। ফ্রেশ হয়ে এসে চেঞ্জ করলো। ক্লাসে যেতে হবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চোখ পড়লো বাঁশের পেনহোল্ডার টার দিকে। এই পেনহোল্ডার টা ও নিলগিরিতে উল্টেপাল্টে দেখেছিল কিন্তু কেনেনি। ওর পছন্দ হয়েছিল বুঝে মুগ্ধ কখন যেন কিনে নিয়েছিল। অনেক পরে ঢাকায় আসার পর ওকে দিয়েছিল। জিনিসটাকে আজও খুব যত্নে রেখেছে ও। মুগ্ধর দেয়া প্রতিটা জিনিস, মুগ্ধর সাথে কাটানো প্রতিটা ছোট ছোট স্মৃতিগুলাওকে খুব যত্নে রেখেছে ও। শুধু মুগ্ধকেই রাখতে পারেনি!

সেদিন দুপুরের দিকে ওরা নিলগিরি পৌঁছেছিল। সিএনজি পার্কিং এ রেখে ওরা টিকেট কেটে ঢুকলো। তিতির মুগ্ধর ঠিক পাশে পাশে হাঁটছে না। একটু পিছন পিছন হাঁটছে। ছেলেদের পাশাপাশি হাঁটতে ওর অস্বস্তি হয়। তিতিরের যায়গাটা ভাল লাগলো না। সবার মুখে শুনেছে নিলগিরি সুন্দর নিলগিরি সুন্দর। কিন্তু এখানে এসে ওর কাছে মনে হচ্ছে কোনো ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে এসেছে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াগুলো যেমন সুন্দর সাজানো গোছানো থাকে সেরকমই। ও জানে নিলগিরি আর্মিদের যায়গা তবু পাহাড়েও ক্যান্টনমেন্টের মত হবে ভাবেনি। এখানে ভালই ভীর। ওদের মতই অসংখ্য লোকজন এসেছে নিলগিরি দেখতে। প্রায় প্রত্যেকটা দলই মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। একজনের ছবি তোলা হচ্ছে তারপর পালাক্রমে সেটা দলের সবাইকে দেখানো হচ্ছে। সবাই আবার সেই ছবি এনালাইজ করছে। অথচ কোথায় এসেছে সেটা দেখছেই না! অল্প কয়েকজনকেই দেখা গেল ঘুরে ঘুরে দেখতে। মুগ্ধ ঠিকই বলেছিল।

ওরা পাথরের বানানো সিড়ি দিয়ে একটা কিনার ধরে উপরে উঠছিল। বাম পাশে একটু নিচুতেই খাবার আর পাহাড়ীদের হস্তশিল্পের দোকান। উঁচু পাহাড়টা ছিল ডান পাশে। উঠেই দেখতে পেল পাহাড়ের কিনারে কিনারে পাথর দিয়ে বেশ কয়েকটা চেয়ার টেবিলের মত বানানো। তার পাশে রেলিং দেয়া। পাহাড়ের উপরে চার পাঁচটা কটেজ দেখা যাচ্ছে। কটেজগুলো পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু যায়গার কিনারে কিনারে বানানো। মাঝখানে চারকোণা একটা যায়গায় টাইলস বসিয়ে ড্রইংরুমের মেঝের মত করা হয়েছে। বামপাশে দেখলো বান্দরবানের একটা ম্যাপ যেখানে সব ইম্পরট্যান্ট যায়গাগুলো চিহ্নিত করা আছে। এই একটা জিনিসই শুধু ওর ভাল লাগলো।

তিতির মুখে কিছু না বললেও মুগ্ধ বোধহয় ওর ভেতরকার রিয়াকশনটা বুঝতে পেরেছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ভাল লাগছে না না? সব প্লাস্টিক সৌন্দর্য বলে মনে হচ্ছে?”
-“আসলে আমার আফসোস হচ্ছে, এত সুন্দর পাহাড়টাকে কেটে কেটে এরকম ইট পাথরের কটেজ বানানোর কি দরকার ছিল? আবার দেখুন না, ওই যায়গাটাকে পুরো ড্রইংরুম বানিয়ে ফেলেছে।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“আপনি বলছিলেন না বুনোলতাগুলো কেটে ফেলায় মেঘালয়ের পাহাড়ী রাস্তাকে আপনার ভাল লাগেনি। আমারও তেমন। যদিও আমি আগে এখানে আসিনি তবু মনে হচ্ছে এগুলো না থেকে স্বাভাবিক একটা পাহাড় হলেই বেশি ভাল লাগতো। এই যায়গার জন্য মানুষের এত লাফালাফি! আমি তো হতাশ হলাম।”
-“তিতির চোখ বন্ধ করো।”
-“কেন?”
-“অপরিচিত হওয়া স্বত্তেও আমাকে এতটা বিশ্বাস করে আমার সাথে এতদূর আসতে পেরেছো, আর এখন একটু চোখ বন্ধ করতে পারবে না?”
তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিজের চোখ বন্ধ করল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরলো। তিতির চোখ খুলে ফেলল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এতক্ষণে ভয় পেয়ে হোক আর যাই হোক, তুমি অলরেডি আমার হাত ধরে ফেলেছো। আরেকবার ধরলে আশা করি কোন ক্ষতি হবে না। আর অনেস্টলি স্পিকিং আমার মনে কোন দোষ নেই।”
তিতির ওর ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসিটা বজায় রেখে নিজেই মুগ্ধর হাত ধরলো। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির অজান্তেই হাঁটছিল যেদিকে মুগ্ধ ওকে হাঁটাচ্ছিল। তারপর এক যায়গায় থামলো। তিতিরের পেছনে দাঁড়ালো মুগ্ধ। তিতিরের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলল,
-“এবার চোখ খোলো।”
তিতির চোখ খুলতেই দেখতে পেল, ওর সামনেই অনেক অনেক নিচে অনেক অনেক পাহাড়। কাছের গুলো বড়, দূরের গুলো ছোট। দূরে যেতে যেতে পাহাড়গুলো যেন একেকটা পিঁপড়ার সমান হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছে এতক্ষণ যে রাস্তা থেকে পাহাড় দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল তা নিতান্তই কাছে ছিল। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ অনেকগুলো ট্রায়াঙ্গল একটার ওপর একটা এঁকেছে। তারপর সবুজ রং করে দিয়েছে। কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা সবুজ। এ এক অদ্ভুত সবুজের খেলা। বান্দরবানের একমাত্র নদী সাঙ্গু সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে সেই পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে। শেষ প্রান্তটা কোথায় যে শেষ হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। তিতিরের চোখের সামনে যা ছিল তার এক-চতুর্থাংশে ছিল এই পাহাড়! বাকি তিন- চতুর্থাংশ ছিল আকাশ। ছোটবেলায় ছবি আঁকার সময় হালকা আকাশী কালারের আকাশের উপর যে গোল গোল সাদা সাদা বাবলসের মত মেঘ আঁকত ঠিক তেমন মেঘ ছিল সে আকাশে। এমন আকাশ আর এমন মেঘ ও কোনদিনও দেখেনি। এত এত বিশালতা আর এত এত স্বচ্ছতা যেন তিতিরের চোখ, মুখ, নাক, কান এমনকি ওর শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকে ওর ভেতরের সব ক্লান্তি, গ্লানি, দুক্ষ, কষ্ট, আক্ষেপ, অভিমান আর না পাওয়াগুলোকে ছেঁকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ও কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, কিভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুই তখন ওর খেয়াল ছিলনা। একটা কথাও বলতে পারলো না কখন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তা ও নিজেও টের পেলনা। ঠোঁটে ছিল বিস্ময়ের হাসি। থরথর করে কাঁপছিল। মুগ্ধ দেখলো এ দৃশ্য, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। মুগ্ধ বেশ লম্বা তাই তিতিরের পেছনে দাঁড়িয়েও নিচে তাকিয়ে ওর মুখ দেখতে কোন সমস্যা হলোনা। তিতির ভারসাম্য হারিয়ে ওর বুকের উপর ঢলে পড়েছে। মুগ্ধ দুই হাত দিয়ে তিতিরের দুই হাত ধরে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঢেকিয়ে ধরে রেখেছে ওকে।

কতক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে পাহাড়ের কিনার থেকে সরিয়ে আনলো। ওরা ছিল আকাশনীলা কটেজের পেছন দিকটায়। কটেজের পিছন দিকেও একটা বারান্দা ছিল। সেই বারান্দার সামনে ঘাসের উপর তিতির বসে পড়লো। মুগ্ধও বসলো তিতিরের পাশে। অনেকটা সময় কেটে গেল, একটা কথাও বলেনি তিতির। ও এখনো তাকিয়ে আছে সামনের পাহাড় আর আকাশের দিকে। মুগ্ধ বলল,
-“শোনো তিতির, আমাদের দেরি হয়ে যাবে। আমরা মাত্র ৪৮ কিলোমিটার এসেছি। আরো ৪২ কিলোমিটার যেতে হবে অন্ধকার হবার আগেই।”
তিতির উঠে দাঁড়ালো। পাহাড় থেকে নামতে নামতে তিতির কোনো কথা বলল না। ওরা নিলগিরিতেই লাঞ্চ সেড়ে নিয়েছিল। খেতে খেতেও কোন কথা বলেনি তিতির। সিএনজি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর তিতির বলেছিল,
-“থ্যাংকস! আপনি ওভাবে না দেখালে আমি অনেককিছু মিস করে যেতাম। পাহাড়ের উপর ইটের কটেজ দেখে খারাপ লাগা নিয়েই ফিরে যেতাম।”
মুগ্ধ বাম হাতটা নিজের বুকের উপর রেখে বলল,
-“মাই প্লেজার তিতিরপাখি!”
-“বিশ্বাস করেন, আমি আমার জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তিতির, তোমাকে আমার নিলগিরির আরো অনেক কিছু দেখাতে ইচ্ছে করছে। হয়তোবা তুমি আমার মতই প্রকৃতি প্রেমিক বলেই কিন্তু সবটা আমার সামর্থ্যের মধ্যে নেই।”
-“সবই তো দেখলাম। আরো কি ছিল?”
-“সকালের ম্যাজিক্যাল নিলগিরির মেঘের সমুদ্র দেখাতে খুব ইচ্ছে করছে, সূর্যাস্তের নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে। পূর্ণিমা রাতের চাঁদ তারা ভরা নিলগিরিকে দেখাতে ইচ্ছে করছে।”
-“আপনি এই সবগুলো দেখেছেন?”
-“হুম! তবে এর বাইরে একটা জিনিস দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-“কি?”
-“উপরের কটেজগুলো বাদে নিচে একটা কাঠের কটেজ দেখেছো না?”
-“হুম!”
-“ওই কটেজে অসংখ্য তক্ষক রাত হলেই হুমরি খেয়ে পড়ে।”
-“তক্ষক দেখতে চাচ্ছেন?”
-“নাহ, তক্ষক তোমার গায়ে এসে পড়লে তুমি কি করবে তা দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-“আপনাকে যতটা ভালমানুষ মনে করেছিলাম আপনি আদৌ তা নন।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। বলল,
-“সবাই কেন জানি এই ভুলটা করে ফেলে।”
তিতির মৃদু হেসে বলল,
-“আমরা যদি আজ এখানে থেকে যাই তাহলে কি এগুলো দেখতে পারবো?”
-“কাল ভরা পূর্নিমা। আজই আকাশে এতবড় একটা চাঁদ উঠবে তাই হয়তো সেটা দেখাতে পারবো। সূর্যাস্ত তো ডেইলি হয় তাই সেটাও দেখাতে পারবো। সকালে মেঘের সমুদ্রও পাবো এই সময়ে, কিন্তু আজ আমরা এখানে থাকতে পারবো না। কারন, সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের থানচি পৌঁছতে হবে, তাছাড়া ৩ মাস আগে বুকিং দিতে হয় নিলগিরিতে থাকতে চাইলে।”
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-“ওহ!”
-“মন খারাপ করোনা। আরো অনেক সৌন্দর্য তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। যা তুমি কল্পনাও করতে পারছো না। আর এসব নাহয় পরে কোন একসময় এসে দেখে যাবে।”
তিতির এবার পুরো মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-“আপনি না যেকোন সাধারণ একটা যায়গা থেকেও সৌন্দর্য খুঁটিয়ে বের করতে পারেন।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“কোন যায়গাই সাধারণ না। সব যায়গার মধ্যেই কোনো না কোনো সৌন্দর্য আছে, কম আর বেশি।”
-“হুম! আচ্ছা, সেন্ট মার্টিনসের সৌন্দর্যের কথা বলুন তো একটু। ওখাকার কি কি আপনার কাছে মনে হয়েছে এক্সট্রা অর্ডিনারি।”
-“তুমি গিয়েছো নাকি যাওনি?”
-“সেটা পরে বলছি, আগে আপনি বলুন না?”
-“সেন্ট মার্টিনসের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ওখানে দুদিন থাকতে হবে। ম্যক্সিমাম মানুষ যে ১২ টায় গিয়ে ৩ টায় ফিরে আসে সেটা করলে হবে না।”
-“আচ্ছা। তারপর?”
-“ওখানকার সমুদ্রের পানিটা তো খুব স্বচ্ছ, সি গ্রিন কালারের। একদম মালদ্বীপের মত তাই রাতে বিচে গেলে দেখা যায় পানির নিচে লাইট জ্বলছে, মুক্তোর মতো। দ্যাটস দ্যা প্রাইসলেস মোমেন্ট হেয়ার! পূর্নিমা থাকলে তো কথাই নেই। আরেকটা সৌন্দর্য হচ্ছে রঙিন মাছ। ছেঁড়া দ্বীপে উপর থেকে দেখা যায় বটে তবে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় পানির নিচ থেকে। ইদানিং ওখানে সি ডাইভিং এর মত একটা সিস্টেম চালু করেছে। তবে অতটা না জাস্ট সমুদ্রের নিচে একটু ঘুরিয়ে রঙিন মাছ, রঙিন প্রবাল দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তবু এটা মাস্ট করা উচিৎ সবার। বিদেশে গিয়ে সি ডাইভিং এর আনন্দের চেয়ে নিজের দেশে এটা কম আনন্দের না। আর কাঁকড়া খাওয়া উচিৎ কারন, বেস্ট কাঁকড়া যে তিন যায়গায় পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন্ট মার্টিনস একটা।”
-“কাঁকড়া আমার অনেক পছন্দ। অন্য দুটো যায়গা কোথায়?”
-“কুয়াকাটা সি বীচের লেবু বন, আর চিটাগাং এর নাভাল রোড।”
-“আপনি তো পুরো একটা এনসাইক্লোপিডিয়া!”
-“হা হা হা হা.. ঘুরাঘুরি ছাড়া অন্য কোন নলেজ আমার নেই।”
-“যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। যেজন্য আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেন্ট মার্টিনসের কথা। আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা সন্ধ্যার পর বীচে নিয়ে যায়নি। তাই ওই সৌন্দর্যটা আমি মিস করেছি। কেউ কখনো বলেওনি এ ব্যাপারে। আর সি ডাইভিং টাইপের কিছু বাংলাদেশে আছে তা তো জানতামই না।”
-“ওহ!”
-“এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের যে প্রান্তেই যাইনা কেন আপনার সাথে না গেলে সব সৌন্দর্য মিস করবো।”
মুগ্ধ মনে মনে ভাবল, ‘আমারও যে তোমাকে আমার দেখা সব সৌন্দর্য আমার মত করে দেখাতে ইচ্ছে করছে তিতিরপাখি। তুমি হয়তো সরল মনে বলেছো কথাটা কিন্তু আমি বলতে পারছিনা তোমার মত করে।’
তিতর উত্তরের জন্য উৎসুক হয়ে চেয়ে ছিল। তাই মুগ্ধ বলল,
-“টিওবির নেক্সট ট্রিপগুলোতে যেয়ো। সব দেখাবো।”
-“ওকে।”
দরজায় আবার টোকা পড়লো.. ভাবীর গলা,
-“তিতির, এই তিতির? আবার ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
-“আসছি ভাবী।”
তিতির তাড়াতাড়ি চুলটা আঁচড়ে রুম থেকে বের হলো। ওর মা বলল,
-“কিরে, এত দেরী করলি কেন উঠতে? নে তাড়াতাড়ি খেতে বোস।”
-“সময় নেই, ফার্স্ট ক্লাসের পর বাইরে খেয়ে নেব।”
-“না, ক্লাসে লেট হলে হবে। খেয়ে যা।”
-“এখন কি আমার খাওয়া-দাওয়াটাও তোমরাই ঠিক করে দেবে মা?”
তিতিরের মার চোখদুটো বড় হয়ে গেল। মেয়ে কি মিন করতে চাচ্ছে! তিতির কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন আর। সারারাত না ঘুমানো এবং কান্নার জন্য চোখ দুটো বড্ড জলছে। সবকিছুর জন্য মুগ্ধ দায়ী। কেন ফোন করতে গেল এতদিন পর! কেনই বা গান রেকর্ড করে পাঠালো! মুগ্ধকে ও ভুলতে পারেনা কখনোই এটা ঠিক কিন্তু সবকিছুকে চাপা দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোলে তো রাখতে পারে। অথচ সব যখন কন্ট্রোলে তখনই মুগ্ধ ফোন করে বা ভার্সিটির সামনে এসে হাজির হয় আর সব আবার ওলট পালট হয়ে যায় তিতিরের। কোন কাজ ঠিকভাবে করতে পারে না। কোন ব্যাপারে স্থির থাকতে পারে না। একদম অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন শুধু একটাই কাজ, মুগ্ধর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে পার্ট বাই পার্ট রিভিশন করা। রাস্তার ধার ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে হাঁটতে তিতির ভাবনায় ফিরে গেল আবার।
থানচির উদ্দেশ্যে সিএনজি চলছিল। নিলগিরির পর থেকে যত আপহিলস আর ডাউনহিলস আসুক না কেন তিতরের আর ভয় করছিলনা বরং মজা পাচ্ছিল। দুজনে গল্প করতে করতে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। সিএনজি হঠাৎ থেমে গেল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করল,
-“ও মামা, কি হইলো?”
হাসু কতক্ষণ ঘাটাঘাটি করে বলল,
-“মামা, গাড়ি নষ্ট হইসে। আর যাওন যাবো না।”
-“হায় হায় কও কি মামা! এই মাঝপথ থেকে কিভাবে যাব আমরা?
তিতির বলল,
-“এখন কি হবে?”
হাসু বলল,
-“গাড়িতে ঝামেলা হইলে আমি কি করমু কন? এইডা ঠিক করোন তো আমার কাম না।”
-“তাইলে এখন তুমি কি করবা?”
-“কি আর করমু? গাড়িতে শুইয়া রাইত পার করমু। সকাল হইলে থানচি থিকা কত চান্দের গাড়ী বান্দরবান যাইবো না? কোন একটার সাহায্য নিমু।
মুগ্ধ চিন্তায় পড়ে গেল। আরো ১৭ কিলোমিটার বাকী! তিতিরকে নিয়ে কিভাবে যাবে এতটা পথ! আর এক ঘন্টাও বাকি নেই সন্ধ্যা হওয়ার! সিএনজিতে গেলে হয়তো পৌঁছে যেত সন্ধ্যার আগে। কিন্তু হেঁটে তো অসম্ভব। আর তিতির কতটা হাঁটতে পারবে এই উঁচু নিচু রাস্তায় সেটাও তো চিন্তার বিষয়। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে তিতিরকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো মুগ্ধ। তিতির বেশ হেলেদুলে হাঁটছে। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সিএনজি নষ্ট হবে সেজন্য তুমি প্রস্তুতই ছিলে।”
তিতির হেসে বলল,
-“কি করা যাবে বলুন। যেটা হয়েছে সেটাকে মেনে নেওয়াই ভাল না?”
-“হুম!”
এরপর আর কেউ কোন কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটছিল রাস্তার কিনার দিয়ে। একসময় মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কষ্ট হচ্ছে উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে?”
-“না তো।”
-“ব্যাগপ্যাক টার অনেক ওজন না? ওটা আমাকে দাও।”
-“নো নো.. আমার বোঝা আমি টানতে পারি। আমি ছেলেদের ওপর ডিপেন্ডেন্ট না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বাহ! তাহলে তো ভালই। কিন্তু তিতির আমি চিন্তা করছি অন্য কথা।”
-“কি?”
-“থানচি তো দূরের কথা, আগামী ১ ঘন্টায় নেক্সট যে আর্মি চেকপোস্ট আমরা সে পর্যন্তও যেতে পারবো না হেটে।”
-“এতদূর?”
-“হুম!”
-“তাহলে? অন্ধকার হয়ে গেলেও হাঁটবো?”
-“পাগল হয়েছো? এটা পাহাড়ী রাস্তা। রাত হলে কতরকম বন্যপ্রানী চলে আসে এখানে। তাছাড়া পাশেই কত বড় খাদ দেখেছো? সবচেয়ে বড় কথা হলো রাতে এই রাস্তায় চলার পারমিশন নেই। আর্মিদের নজরে এলে খবর আছে।”
-“তাহলে?”
-“সেটাই ভাবছি।”
-“চলুন আশেপাশের কোনো গ্রামে গিয়ে রাতটা থাকতে দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করি।”
-“এটা সিনেমা না তিতির।”
-“মানে?”
-“মানে তোমার কি মনে হয় পাহাড়ে অন্য যায়গার মত একটু পর পর গ্রাম থাকে? কক্ষনো না। এরপর যে গ্রামটা সেটা আর্মি চেক পোস্টেরও পরে।”
-“তাহলে তো আমরা ভুল করলাম। সিএনজিতেই থাকতে পারতাম রাতটা।”
-“সেরকম হলে কি তড়িঘড়ি করে ভাড়া মিটিয়ে চলে আসতাম?”
-“কেন? সিএনজিতে থাকতে কি প্রব্লেম ছিল?”
-“ওই সিএনজি ড্রাইভার যদি ডাকাত দলের কেউ হয়ে থাকে? ডাকাতদের সাহায্য করার জন্য ইচ্ছে করে সিএনজি নষ্টের ভান করে থাকে? কিংবা নিজেই যদি ছুরি ধরে ব্ল্যাকমেইল করে? কি করতে পারবে তুমি?”
বিস্ময়ে তিতিরের চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। বলল,
-“মানে, কি বলছেন এসব?”
-“অসম্ভব কিছু না। এরকমটা এদিকে হয়। তুমি সাথে আছো বলেই ভয়টা বেশি লাগছে।”
-“এখন কি হবে?”
-“ডোন্ট ওরি। তাড়াতাড়ি হাটো। সামনে একটা দ্বিমুখী রাস্তা আছে বোধহয়। থানচির রাস্তায় না গিয়ে আমরা অপজিটে যাব।”
-“কেন আমরা থানচি যাব না?”
-“যদি ওই হাসুটার মধ্যে কোনো ঘাপলা থেকে থাকে তাহলে ওরা ওই থানচির রাস্তায় যাবে আমাদের খুঁজতে। কারন ওরা ভাববে আমরা ওদিকে ।
থানচির রাস্তাকে পাশ কাটিয়ে ওরা বেশ কিছুদূর এসে পড়েছে। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। একপাশে বিশাল পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ। পাহাড়টা যেখানে ছোট হয়ে এসেছে সেখানে সেখান থেকেই জঙ্গল শুরু। ওদিকটায় গিয়েই হঠাৎ মুগ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। তিতির বলল,
-“কি হলো?”
মুগ্ধ তিতিরকে দেখালো যায়গাটা। তিতির বলল,
-“জঙ্গল দেখে কি করবো?”
-“ভেতরে ঢুকে দেখবো। থাকার মত হলে এখানেই থাকবো রাতটা।”
-“এই জঙ্গলে সারারাত কাটাবো?”
-“তো তুমি কি ভেবেছিলে?”
-“আমি ভেবেছিলাম আপনি কোন একটা ব্যবস্থা করবেন।”
-“এই জনমানবশূন্য যায়গায় এর চেয়ে ভাল ব্যাবস্থা আমি কি করবো? কোন গ্রাম কিংবা আর্মি চেকপোস্টে যেতে চাইলে ৩/৪ ঘন্টা হেটে পৌঁছানো যাবে। অথচ আলো আর ম্যাক্সিমাম ৪০ মিনিট থাকবে। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমানরা যা করবে আমিও তাই করছি।”
-“মানে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করবেন?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আজ্ঞে।”
তিতিরের সত্যি ভয় করছিল। মুগ্ধর সাথে এই জঙ্গলে একা রাত কাটাবে! এতক্ষণ যতটুকু দেখেছে তাতে ভালই মনে হয়েছে ছেলেটাকে, কিন্তু ওটা যদি ওর অভিনয় হয়ে থাকে? রাত হলেই ওকে একা পেয়ে যদি আসল রূপটা বের করে? কুকুরকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু ছেলেদের না। বলল,
-“টর্চ নেই আপনার কাছে?”
-“থাকলে?”
-“টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে চলে যাব থানচি। চলুন না। এই জঙ্গলে আমি থাকতে পারবো না। এখনো সন্ধ্যা হয়নি তার আগেই কি অন্ধকার! পুরো গা ছমছমে অবস্থা।”
-“তিতির তোমার বয়স কত?”
-“আপনি জানেন না মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে হয়না।”
-“জানি, তবে এখন তো আমরা কোন স্বাভাবিক সিচুয়েশনে নেই তাই এখন সবই যায়েজ।”
-“সব যায়েজ মানে?”
তিতিরের চোখ ছানাবড়া! মুগ্ধ বলল,
-“কত ১৬/১৭/১৮/১৯?”
-“১৭+।”
-“স্টাডির দিক থেকে হিসাব করলে তুমি আমার ৬ বছরের ছোট। আর বয়সের হিসাব করলে ৮ বছরের ছোট। ঠিকই আছে তাহলে তুমি এটা বলতেই পারো।”
-“কোনটা? ওই টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে যাওয়ার কথাটা?”
-“হুম!”
-“আপনি বলেছিলেন আর্মিদের পারমিশন নেই। কিন্তু বিপদে পড়লে কি আর করা, বুঝিয়ে বলতে হবে।”
-“হায়রে! বুঝতে চাওনা কেন? বাচ্চাদের নিয়ে এই একটা প্রব্লেম।”
-“প্রব্লেম না মনে করে বুঝিয়ে বলুন, ঠিকই সব বুঝবো।”
-“বুঝিয়ে বলবো কি করে? তুমি তো এখনো এডাল্ট হওনি। এডাল্ট কথা তোমাকে কি করে বলি।”
-“ওসব এডাল্ট চ্যাপ্টার স্কুলে থাকতে পার করে এসেছি। বলুন তো।”
-“মানে কি করেছো স্কুলে থাকতে?”
-“উফফ! আপনি বলুন, আমি সব এডাল্ট কথাই বুঝি।”
-“আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক ফাস্ট হয়!”
-“সময় নষ্ট করছেন। বোঝাতে না পারলে চলুন হাঁটা শুরু করি। আমি রাতেরবেলা এই জঙ্গলে থাকতে পারবো না।”
-“আচ্ছা দাঁড়াও, দাঁড়াও।”
তিতির দাঁড়ালো। মুগ্ধ বলল,
-“আমি একা থাকলে এই রাতেও হেটে চলে যেতাম। টর্চ লাগতো না। চাঁদের আলোর কাছে টর্চ ম্লান। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। চেকপোস্টে আর্মিরা আমাদের বিপদের সুযোগ নিতে পারে।”
-“আর্মিরা তো আমাদের হেল্প করবে, বিপদের সুযোগ কেন নেবে?”
-“আর্মিরা হেল্প করতো যদি দিন হতো। কারন, দিনে হেল্প ছাড়াও আমরা যেতে পারবো। আর এখন যখনই বুঝবে আমরা বিপদে আছি তখনই হেল্প করার বিনিময়ে খুব ভদ্রভাবে তোমাকে চাইবে। তখন আমি কি করবো? দিয়ে দেব? আর না দিলেও ওদের প্রব্লেম নাই ওদের নিয়ে নেওয়ার মত জোড় আছে। তার উপর তোমার নাই ন্যাশনাল আইডি কার্ড।”
-“আপনি সবাইকে এত সন্দেহ করেন কেন? তখন সিএনজি ড্রাইভারকে সন্দেহ করলেন, এখন আবার আর্মিদের।”
-“জানতাম দোষ এখন আমারই হবে। শোনো আমি কাউকে অকারনে সন্দেহ করিনা। পাহাড়ের এমন বহুত কাহিনী আমি জানি। যা হয় তাই বললাম।”
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা চলো যাই। তোমার কিছু হলে আমার কি! আমি ছেলে মানুষ আমার তো কোন প্রব্লেম নাই। এজন্যই কারো ভাল করতে নেই।”
মুগ্ধ হাঁটা শুরু করলো। তিতির দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে মুগ্ধর জ্যাকেট টেনে ধরল। বলল,
-“না যাবনা। প্লিজ রাগ করবেন না। আমি তো পাহাড়ের ব্যাপারে কিছুই জানিনা তাই ভুলে বলে ফেলেছি, সরি।”
-“আমার বান্দরবান থেকে আপনাকে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।”
-“হঠাৎ আমাকে ‘আপনি’ করে বলছেন কেন?”
-“ঠিকই আছে, ছোটমানুষ ভেবে তুমি করে বলেছিলাম। কিন্তু আদৌ আপনি ছোট না। বহুত পাক্না।”
তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
-“শালার… মেয়েরা সাথে থাকলে ঝামেলা হবেই। যতই তুমি তাদের জন্য করো। শেষ পর্যন্ত তোমকেই চরিত্রহীন ভাববে!”
তিতির দেখলো রাগে মুগ্ধর কপালের রগ দুটো কাঁপছে। লাল হয়ে গেছে মুখটা। তাড়াতাড়ি বলল,
-“আমি কখন আপনাকে চরিত্রহীন ভাবলাম?”
-“ভেবেছেন, ভেবেছেন বলেই এই রাতের বেলা হেঁটে থানচি চলে যেতে চেয়েছেন। ভয়টা তো জঙ্গল নিয়ে না। ভয়টা আমাকে নিয়ে। ভাবছেন রাত হলেই আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো। এসব বলা লাগেনা বোঝা যায়।”
তিতির মনে মনে ভাবলো ‘এই ছেলে তো দেখছি মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।’ কিন্তু মুখে বলল,
-“না না বিশ্বাস করুন, আমি এসব ভাবিনি। আপনাকে বিশ্বাস না করলে কি আমি একা এতদূর আপনার সাথে আসতাম?”
মুগ্ধ চুপ করে রইলো। তিতির আবার বলল,
-“প্লিজ আমাকে আগের মত তুমি করে বলুন। নাহলে কেমন যেন লাগছে আমার।”
মুগ্ধ খানিকটা স্বাভাবিক হলো। বলল,
-“আচ্ছা, আচ্ছা। দিন থাকতে কিছু কাজ সেড়ে ফেলতে হবে, এসো।”
মুগ্ধ এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। পিছনে পিছনে তিতির। গাছপালার কারনে এদিকটায় অতটা আলো নেই। তবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলে কয়েকটা কমলা গাছ দেখতে পেল মুগ্ধ। বেশ কয়েকটা কমলা ছিঁড়ে নিল। তারপর ভেঙে যাওয়া গাছের ডাল কুঁড়োলো রাত নেমে এলে আগুন ধরাতে হবে তো। তিতিরও সাহায্য করছে। এমন সময় একটা সিএনজি আসার আওয়াজ পেল। মুগ্ধর চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তিতিরকে বলল,
-“তুমি এই বড় গাছটার আড়ালে দাড়াও। আমি দেখি, লিফট পেলে তোমকে ডাকবো। তখন বের হবে। তার আগে না।”
-“ওকে!”
মুগ্ধ হাত বাড়িয়ে থামালো সিএনজিটাকে। সিএনজি থামলো। মুগ্ধর আশা ম্লান হয়ে গেল। সিএনজিতে অলরেডি পিছনে ৩ জন আর ড্রাইভারের দুপাশে দুজন বসা। সবাইকেই খুব ভীত লাগছিল। ড্রাইভার বলল,
-“কি অইসে ভাই? গাড়ি থামাইলেন ক্যান?”
-“আসলে আমরা একটা বিপদে পড়েছি তাই ভেবেছিলাম যদি কোন সাহায্য পাওয়া যায়। পেছন থেকে একটা ছেলে বলল,
-“ভাই কি বলবো? আমরা নিজেরাই বিশাল বিপদ পার করে আসলাম। আপনাকে কি সাহায্য করবো?”
-“কি বিপদ?”
ড্রাইভার বলল,
-“ডাকাইত ধরসিল। তাও ভাল ওনগো লগে মাইয়া মানুষ নাই। মাইরা দইরা ট্যাকা পয়সা সব রাইক্ষা দিসে।”
ড্রাইভারের কথা শেষ না হতেই আরেকটা ছেলে বলল,
-“আমাদের সবার মোবাইল, ল্যাপটপ সব নিয়ে নিয়েছে।”
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাই আপ্নের লগে কি মাইয়া মানুষ আছে?”
মুগ্ধর যেন উত্তর রেডিই ছিল। বলল,
-“না আমর সাথে আমার ছেলে ফ্রেন্ডরা আছে। কেন বলুন তো?”
-“আইজকা একটা পোলা আর একটা মাইয়া সিএনজিতে কইরা থানচি যাইতাসিল। মাইয়াডা পরীর মত সুন্দর। ওই মাইয়াডারে নিলগিরিতে দ্যাখসে ডাকাইত দলের এক পোলা। দেইক্ষা তো ওগো সরদাররে খবর দিসে, পোলা মাইয়া যখন খাইতে গ্যাছে তখন হেয় যাইয়া সিএনজি ড্রাইভারের লগে সেটিং করসে। তারপর কতদূর যাইয়া ড্রাইভার কইসে সিএনজি নষ্ট হইয়া গ্যাছে। এমন যায়গায় অরা যাইবোই বা কই, রাইতে ধরবো ভাবছিল। কিন্তু ডাকাইত আওনের আগেই পোলা মাইয়ারে লইয়া পগারপার। ডাকাইতরা মাইয়া না পাইয়া ড্রাইভার ডারে মাইরা কি অবস্থা যে করসে কি কমু ভাই! হালার তোর যদি এইসব কামে অভিজ্ঞতা না থাহে তয় তুই আজাইরা ঝামেলায় জড়াইতে গেলি ক্যা?”
তিতির গাছের আড়াল থেকে সব শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ড্রাইভারের পাশের ছেলেটা বলল,
-“আমার মনে হয় ড্রাইভারটা ইচ্ছে করে করেনি এমন। ডাকাতদের ভয়ে করেছে।”
পিছন থেকে আরেকজন বলল,
-“টাকার লোভেও করতে পারে।”
মুগ্ধ বলল,
-“আবার দুটোই হতে পারে।”
আরেকটা ছেলে বলল,
-“কিন্তু আমি বুঝলাম না ডাকাতরা ওদের রেখে আমাদের ধরলো কেন?”
মুগ্ধ বলল,
-“ওইতো, ওদের না পেয়ে খালি হাতে চলে যাবে! তাই আপনাদের কাছ থেকে যা পারে হাতিয়ে নিয়েছে। এই রাস্তায় আজ যারা যাবে হয়তো সবারই আপনাদের মত অবস্থা হবে।”
ড্রাইভার বলল,
-“না না, অরা মাইয়ারে ধরনের লাইজ্ঞা থানচির দিক গ্যাছেগা। অগো দলের একজন কইতাসিল, ‘অই মাইয়ারে আমার চাই ই চাই। লাগলে পুরা রাস্তা খুইজ্জা তাপা তাপা কইরালামু। যাইবো আর কই?’
বুজলেন ভাই… ডাকাইতগো কাছে মাইয়া মানুষ পাইলে টাকা কিছুনা।”
মুগ্ধ বলল,
-“আমাদের মেয়ে ফ্রেন্ডরা আসতে চেয়েছিল ভাগ্যিস আনিনি।”
ড্রাইভারটা বলল,
-“আরে ভাই সকাল সকাল গেলেগা তো আর কোনো ঝামেলা হইতো না। কত মাইয়ারাই তো আসে।”
মুগ্ধ বলল,
-“তাও ঠিক!”
-“আচ্ছা ভাই আমরা যাই।”
-“আচ্ছা আচ্ছা।”
সিএনজি চলে যেতেই মুগ্ধ জঙ্গলের ভেতর তিতিরকে যেখানে রেখে এসেছিল সেখানে চলে গেল। তিতির এখনো ভয়ে কাঁপছে। ওকে দেখেই বলল,
-“সরি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আরেএএএ.. ইটস ওক্কে তিতিরপাখি! তুমি যখন আমার সাথে আছো, তোমাকে সেফ রাখার দায়িত্বটাও আমার!”
-“আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো আপনি কি কিছু টের পেয়েছিলেন?”
-“নাহ, কিন্তু যখন হাসু বলেছিল সিএনজি নষ্ট হয়ে গেছে তখন ওর চেহারাটা চোরের মত ছিল। সেটা দেখে আন্দাজ করেছিলাম। এরকম ঘটনা আমি অনেক আগে শুনেছিলাম। এজন্যই তো ম্যাক্সিমাম লোক চান্দের গাড়িতে থানচি যায়, আর ভোরে রওনা দেয় যাতে দুপুরের মধ্যে থানচি পৌঁছে যেতে পারে।”
-“ওহ!”
-“তাছাড়া আমরা তাজিংডং থেকে ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। টর্চে চার্জ ছিলনা, তার উপর অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল, খাবার ছিল না। কি যে অবস্থায় পড়েছিলাম বলে বোঝাবার মত না। সকাল হলে দেখি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম ওখানেই ফিরে এসেছি সারারাত হেটে।”
-“আহারে!”
-“হুম, তারপর থেকে যেকোনো ট্রিপে গেলে সবরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রিপারেশন থাকে আমার।”
-“ভাগ্যিস ছিল, তা না হলে আমার যে কি হতো।”
মুগ্ধ কিছু বলল না। তিতির এবার বলল,
-“আচ্ছা ডাকাতরা যদি এদিকে আসে?”
-“আসুক, প্রব্লেম কি?”
-“আপনি কি ঢিসুম ঢিসুমও জানেন নাকি?”
-“জানলে কি হবে?”
-“ঢিসুম ঢিসুম করে ডাকাতদের খাদে ফেলে দেবেন।”
-“এহহহ! এখনো বিয়ে করিনি। মরার ইচ্ছে নেই।”
-“তাহলে যে বললেন, আসুক আসলে প্রব্লেম নেই।”
-“না মানে আসবে তো তোমাকে নিতে। তো দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।”
তিতির ভয় ভয় চোখে চেয়ে রইল। হঠাৎ মুগ্ধ একটা বুনোহাঁসকে দেখতে পেল। অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও ধরতে পারলো না। তিতির বলল,
-“ধুর থামেন তো, কি হবে ওটা ধরে?”
-“পুড়িয়ে খেতাম। রাতে কি খাওয়া লাগবে না?”
-“এম্মা, হাঁস পুড়িয়ে খাবেন? ছিঃ।”
-“আরে মশলাপাতি আছে তো। সুন্দর করে বার-বি-কিউ করতাম। হাত চেটে খেতে। খালি ধরতে পারলাম না বলে।”
-“আপনি ব্যাগে মশলা নিয়ে ঘোরেন?”
-“হুম, ট্যুরে গেলে।”
তারপর হঠাৎ মুগ্ধর মনে পড়লো হাঁস ধরার ধান্দায় সূর্যাস্তটা মিস হয়ে যাচ্ছে। তিতিরকে বলল,
-“চলো চলো.. সূর্যাস্ত মিস হয়ে যাচ্ছে।”
ভয়ডর সব ভুলে তিতির-মুগ্ধ জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“ব্যাগপ্যাক রেখে এসেছো কেন? নিয়ে এসো। আমরা যেখানেই যাব আমাদের ব্যগপ্যাক আমাদের সাথেই থাকবে। কখন কি লাগে বলা যায়না।”
তিতির আবার জঙ্গলে ঢুকে ওর ব্যগপ্যাকটা এনে কাধে নিল। তারপর মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ধরে রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গেল। যায়গাটা রিস্কি ছিল তবু মুগ্ধ আছে সেই ভরসায় তিতির নামলো। তারপর মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে একটা পাথরের উপর বসলো। তারপর সামনে তাকিয়ে মুগ্ধ বলল,
-“এখান থেকে সূর্যাস্তটা দেখে যে ফিল পাবে সেটা রাস্তা বা জঙ্গল থেকে দেখে পেতে না। আর রাস্তা থেকে আমাদের দেখাও যাবে না। তাই তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম।”
তিতির সূর্যাস্ত দেখবে কি! ও দেখছিল মুগ্ধকে। এমন একটা মানুষ আর উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। ওর কেন জানি ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে বসে সূর্যাস্তটা দেখতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না।
সূর্যটা আস্তে আস্তে একটা উঁচু পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে পড়ছে। পুরো আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কোথাও কমলা রং কোথাও আগুন লাল, কোথাও সিঁদুর লাল। তার ফাঁকেফাঁকে আকাশের নীল রংটাও উকি দিচ্ছিল। পাহাড়চূড়া থেকে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য যে এইরকম ভয়াবহ তা তিতির ভাবতেও পারেনি।
হঠাৎ একটা জীপের শব্দ পেল ওরা। মুগ্ধ চোখের পলকে তিতিরকে টেনে নিয়ে পাথরটার উপর থেকে সরে পাহাড়ের আরো নিচের দিকটায় সরে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তিতির ভয়ের চোটে আচমকা কখন যেন মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরেছে। একটু পা ফসকে গেলেই নিচে বিশাল খাদ। মুগ্ধ জানে তিতিরের সেদিকে চোখ পড়লে ভয় পাবে। তাই ওর একটা হাত দিয়ে তিতিরের চোখ ঢেকে মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে রাখলো। তিতির শুনতে পেল মুগ্ধর বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে… ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ!
জীপগাড়িটা জঙ্গলের সামনে এসে থামলো। একটা লোক বলল,
-“ওস্তাদ, অরা এই জঙ্গলে ঢুকে নাই তো রাতটা পার করার জন্য?”
আরেকটা কন্ঠস্বর শোনা গেল,
-“থানচির রাস্তায় যহন যায় নাই, এই রাস্তায় গ্যাছে। ভাল কইরা খুইজা দেখ, পুরা জঙ্গল তন্নতন্ন কইরা খুঁজবি। লাগলে আগুন জ্বালাইয়া দে। ওই ****পোলার গলাটা নামাই দিয়া মাইয়াডারে লইয়া আয়, যাহ।”
তিতির মুগ্ধর বুকে মুখ লুকিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে, পুরো শরীর কাঁপছে ওর। মুগ্ধ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কান পেতে রইল উপরে কি হচ্ছে সেটা বোঝার জন্যমুগ্ধর মনে হলো রাস্তার দিকটায় কেউ নেই, কারন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু জঙ্গলের ভেতর থেকে শুকনো পাতায় পা ফেলার ঝুপঝাপ শব্দ আসছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজটা কাছে চলে এল। আবার কথোপকথন শোনা গেল। তার মানে ওদের দলের সর্দারটা জঙ্গলে ঢোকেনি, এখানেই ছিল। একজন বলল,
-“ওস্তাদ, জঙ্গলে কেউ নাই।”
সর্দার চেঁচিয়ে বলল,
-“কেউ নাই মানে? গেল কই তাইলে?”
অন্য একটা গলা পাওয়া গেল,
-“ওস্তাদ, আমার মনে লয় অরা এই রাস্তায় আহে নাই, যেমনেই হউক থানচি গ্যাছেগা। উল্টা রাস্তায় ক্যান আইবো কন? অরা তো আর জানতো না আমরা পিছন লাগছি।”
সর্দার বলল,
-“জানতো জানতো। ওই কুত্তার ছাও যেমনেই হউক ট্যার পাইসিলো। নাইলে এত জলদি পলাইতো না।”
এবার ৪র্ধ কোন ব্যক্তির গলা পাওয়া গেল,
-“কিন্তু ওস্তাদ, গাড়ি ছাড়া এত জলদি অরা থানচি গেল ক্যামনে?”
-“গাড়ি ছাড়া যায় নাই। গাড়ি দিয়াই গ্যাছে।”
-“গাড়ি পাইলো কই?”
-“***পো.. আমারে জিগাস গাড়ি কই পাইলো? কত বড় কইলজা!”
-“ওস্তাদ, মাফ কইরা দেন।”
সর্দার বলল,
-“যা সর, তরে লইয়া টাইম নষ্ট করার টাইম নাই আমার। ওই রবিন্যা এদিক আয়।”
কিছুক্ষণ পর সর্দার জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই ওই মাইয়ার ছবি দেহাইয়া আমার গায়ে জ্বালা ধরাইছস!”
তিতির চমকে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। মুগ্ধ তিতিরের মুখ চেপে ধরল।
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
-“ওস্তাদ আপনের পায়ে ধরি.. আমারে এইবারের মত মাফ কইরা দ্যান। আমি কোনদিন আর এমুন কাঁচা কাজ করুম না।”
-“করবি ক্যামনে? সুযোগ পাইলে না করবি! আমার দলে ভুল করার সাজা কি অয় জানোস না?”
-“ওস্তাদ, আমারে মাফ কইরা দ্যান ওস্তাদ, আপনে যা কইবেন করুম। আর জীবনেও এই ভুল করুম না। জান ভিক্ষা দেন।”
-“তাইলে তর বউরে আইজ রাইতে আমার ঘরে পাডাই দিস। তর বউ যদি আমারে খুশি করবার পারে তাইলে তুইও মাফ পাবি।”
লোকটা এবার কেঁদে ফেলল। তারপর বলল,
-“ওস্তাদ, বউডা পোয়াতি। ৫ মাস চলতাছে। অরে আমি ক্যামনে পাডামু?”
তারপর একটা ছুরির আঘাতের আওয়াজ হলো আর সাথে সাথে লোকটার মাথাটা আর মাথাকাটা দেহটা খাদে পড়ে গেল। লোকটাকে ওইভাবে পড়তে দেখে তিতির অজ্ঞান হয়ে গেল। সর্দার বলল,
-“বজলু, আমি বাইত্তে যাইতাসি। এক ঘন্টার মইধ্যে তুই রবিনের বউরে উঠাইয়া নিয়া আয়।”
-“জ্বী ওস্তাদ!”
-“মনে রাখিস যদি কোন ভুল হয় তাইলে তর অবস্থাও রবিনের মত অইব।”
-“কোন ভুল অইবো না ওস্তাদ। আমি অখনই যাইতাসি।”
এরপর সবাই জীপে উঠে চলে গেল। জীপের শব্দ যতক্ষণ শোনা গিয়েছে মুগ্ধ ওর যায়গা থেকে নড়েনি। তারপর যখন শব্দটা পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেল তখন মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে ওখান থেকে সরে সেই পাথরটার উপর এল যেখানে ওরা বসেছিল। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারপাশটা। শুধু চাঁদের আলো ছাড়া অন্য কোন আলো নেই।
একহাতে তিতিরকে ধরে অন্য হাত দিয়ে ব্যগ থেকে পানি বের করে তিতিরের চোখে মুখে ছিটালো। তিতির চোখ খুলল। মুগ্ধ ওর মুখটা তুলে ধরে পানি খাওয়ালো। পানি খাওয়া শেষ হতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“আরে, বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? ওরা চলে গেছে তো। আর আসবে না।”
তিতির তখনও মুগ্ধর এক হাতের উপর পড়ে ছিল, ওঠার মত শক্তি ওর নেই। কোনরকমে বলল,
-“আপনি না থাকলে আমি আজকেই শেষ হয়ে যেতাম।”
-“সেজন্যই তো আল্লাহ আজকে আমাকে এখানে তোমার সাথে রেখেছে। যাই হোক, চলো জঙ্গলে যাই।”
-“নাহ, আমি যাবনা। যদি ওরা আবার আসে?”
-“জঙ্গলে ওরা খুঁজেছে। যেহেতু পায়নি ওরা আর আজকে আসবে না। ওরাতো ভেবেই নিয়েছে আমরা থানচি চলে গিয়েছি, শুনলেই তো। তাছাড়া ওদের আজকের কাজ এখান থেকে ফিক্সড করেই গিয়েছে। ওটা শুনতে পারোনি কারন তখন তুমি অজ্ঞান হয়ে ছিলে।”
-“কি কাজ বলুন না!”
-“ওসব শুনে তোমার কাজ নেই।”
-“না না প্লিজ বলুন না।”
-“ওরা অন্য কাউকে তুলে আনার প্ল্যান করেছে।”
-“সেকি!”
-“হুম! বাদ দাও তো। চলো চলো.. খাদের পাশে সারারাত থাকবো নাকি?”
তিতির উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ওর সাড়া শরীর অসাড় হয়ে পড়েছে। এত ভয় ও জীবনেও কোনদিন পায়নি। মুগ্ধ তিতিরের কাধ থেকে ব্যগপ্যাক টা নামিয়ে কাধে নিজের ব্যাগপ্যাকের উপরে নিল। তারপর তিতিরকে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তায় উঠলো। জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বেশ ভেতরে ঢুকে গেল, একদম রাস্তার পাশের পাহাড়টার পিছন দিকটায়। যাতে ওরা আগুন জ্বালালে রাস্তা থেকে কেউ দেখতে না পায়।
মুগ্ধ দুটো ব্যাগ কাধে নিয়ে আর তিতিরকে কোলে নিয়ে অবলীলায় হাটছিল। তখন তিতির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধর দিকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর গলাটা ধরে রাখতে। কিন্তু হাত উঠানোর মত শক্তি পেলনা।
মুগ্ধ তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসালো। তারপর ব্যাগপ্যাক দুটো নামালো। শেষ বিকেলে যে কাঠগুলো কুড়িয়েছিল সেগুলো এখন অনেক দূরে। তিতিরকে বলল,
-“তিতির আমি সেই কাঠগুলো নিয়ে আসি, তুমি একটু বসো হ্যা?”
তিতির মুগ্ধর জ্যাকেট খামচে ধরে বলল,
-“প্লিজ! আমাকে একা রেখে কোথাও যাবেন না। দরকার নেই আলো জ্বালানোর। চাঁদের আলোতেই সব দেখা যাচ্ছে।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হুম চাঁদের আলোতে তো দেখা যাচ্ছেই, কিন্তু দেখার জন্য তো আর আলো জ্বালাতে হবে না। বন্যপ্রাণী আর শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আগুন জ্বালাতে হবে। আলো দেখলে ওরা আর আসবে না।”
-“আমি এতকিছু জানিনা। আমাকে একা রেখে আপনি যেতে পারবেন না।”
মুগ্ধ গেলনা। ওখান থেকেই কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বালালো। তারপর ব্যাগপ্যাক থেকে কাপড়ের কি একটা বের করে সেটা নিয়ে কিছু একটা করতে লগলো মুগ্ধ। কিচ্ছুক্ষণ পর তিতির বুঝতে পারলো ওটা একটা তাঁবু! তিতির বলল,
-“আপনার কাছে তাঁবু ছিল?”
-“হ্যা, না থাকলে কি নিশ্চিন্তে জঙ্গলে থাকার চিন্তা করতাম? কেন তুমি বুঝতে পারোনি আমার কাছে তাঁবু আছে।”
-“না।”
-“ও।”
-“কিন্তু তাঁবু নিয়ে এসেছিলেন কেন? তাঁবু কি নিজের আনতে হয়? সাফি ভাইরা প্রোভাইড করেনা?”
-“হ্যা, তা তো করেই। আমার নিজের তাঁবু আছে তাই নিয়ে এসেছিলাম যাতে শেয়ার করতে না হয়।”
-“ওহ!”
তাঁবু পুরোপুরি টাঙানো হতেই মুগ্ধ তিতিরকে সেখানে নিয়ে গেল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা স্টিলের মগ আরেকটা কাপড়ে মোড়ানো কাচের মগ আর কিছু ছোট ছোট কৌটা বের করলো। তিতির বলল,
-“আপনার ব্যাগটা পুরো একটা ছোটখাটো বাসা।”
মুগ্ধ হেসে স্টিলের মগে পানি নিয়ে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে গেল। পানিটা আগুনে গরম করে নিয়ে আবার তাঁবুতে ঢুকলো। ঝটপট দুই কাপ কফি বানিয়ে ফেলল মুগ্ধ। তারপর এক কাপ কফি, বিস্কুট আর গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা কমলা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই হলো আজকের ডিনার।”
তিতির হেসে বলল,
-“আপনি এগুলো খেয়ে সারারাত কাটিয়ে দিতে পারবেন?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হুম! তাজিংডং এ হারিয়ে যাওয়া সেই রাতে এক ফোটা পানিও ছিলনা। সেই তুলনায় এটা আল্লাহর রহমতে অনেক ভাল ডিনার। বাই দ্যা ওয়ে তোমার হবে তো এতে?”
তিতির হেসে বলল,
-“আমি ডায়েট কন্ট্রোল করি। রাতে শুধু সবজি সেদ্ধ খাই অথবা যেকোনো একটা ফল। সেই তুলনায় এটা অনেক।”
-“বাপরে! তুমি কেন ডায়েট করো? তুমি তো স্লিমই আছো!”
-“হুম, ডায়েট কন্ট্রোল করি বলেই স্লিম আছি, নাহলে গোল হয়ে যেতাম। অনেক খেতে পারি তো আমি!”
-“ওহ। যাই হোক, কফিটা ঠান্ডা হবার আগে খেয়ে নাও। দূর্বলতাটা কমে যাবে।”
খাওয়া শেষ করে মুগ্ধ বলল,
-“তুমি শুয়ে পড়ো। আমি বাইরে আছি, কিছু লাগলে ডেকো।”
মুগ্ধ বেড়িয়ে গিয়ে আগুনের পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর হঠাৎ তাঁবুর দিকে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকাতেই দেখতে পেল তিতির ওর ড্রেস খুলছে। তাঁবুটা কাপড়ের তাই ছায়াটা দেখা গেল। সাথে সাথে মুগ্ধ চোখ ফিরিয়ে নিল। এই দৃশ্যটা দেখামাত্রই কেমন যেন লাগলো ওর। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠলো। আবার তাকাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তাহলে ওর আর ওই জানোয়ার গুলোর মধ্যে কোন তফাৎ থাকবে না। তাই তাকালো না।
কফি খাওয়ার পর তিতিরের উইকনেস কিছুটা কেটেছে। ড্রেস চেঞ্জ করে কিচ্ছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মনে হলো এই শীতের রাতে মুগ্ধ এভাবে বাইরে বসে আছে! ও কেন এটা মেনে নিল! ছেলেটা ওর জন্য কতকিছু করলো। সাথে সাথে উঠে তাঁবুর দরজার উপড়ের ছোট্ট নেটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। দেখলো আগুনের পাশে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে মুগ্ধ। তিতির ডাকলো,
-“এই যে শুনছেন?”
মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা বলো। কিছু লাগবে?”
-“হ্যা, আপনাকে লাগবে।”
-“মানে?”
-“বাইরে থাকার মানে কি হলো?”
-“কেন কি হয়েছে?”
-“আপনি ভেতরে আসুন।”
-“কেন?”
-“এই শীতের মধ্যে সারারাত বাইরে বসে কাটাবেন?”
-“আরে এখানে আগুন আছে, শীত লাগছে না।”
-“না প্লিজ আপনি ভেতরে এসে শুয়ে পড়ুন। ভেতরে যথেষ্ট যায়গা আছে দুজনের জন্য।”
মুগ্ধ বলল,
-“আরে, আমিও যদি ভেতরে থাকি তো আমাদের পাহাড়া দেবে কে?”
-“আপনি বলেছেন ডাকাতরা আর আসবেনা।”
-“হুম, কিন্তু বন্যপ্রাণীরা আসতে পারে।”
-“আপনিই বলেছিলেন আগুন জ্বালালে ওরা আসবে না। প্লিজ আসুন না। আপনি সারারাত এভাবে বাইরে বসে থাকলে আমার ঘুম আসবে না।”
মুগ্ধ অগত্যা তাঁবুর ভেতরে ঢুকলো। তারপর ব্যাগ খুলে একটা টি-শার্ট আর একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করল। তারপর হুট করে নিজের জ্যাকেট, শার্ট খুলে টি-শার্ট টা পড়লো। এই এতটুকু সময়ের মধ্যেই মুগ্ধর লোমশ বুকটা দেখতে মিস করেনি তিতির। বেহায়ার মত তাকিয়ে ছিল, মুগ্ধ খেয়াল করেছে কিনা কে জানে! সে যাই হোক, ছেলেদেরকে খালি গায়ে কতই তো দেখেছে ও। কিন্তু এরকম তো লাগেনি কখনো। এখন যে আবারও দেখতে ইচ্ছে করছে!
তিতির এসব ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ বলল,
-“বাইরে থাকবো বলে চেঞ্জ করিনি। ভ ভিতরেই যদি থাকি তাহলে চেঞ্জ করা উচিৎ। তুমি থাকো, আমি বাইরে থেকে চেঞ্জ করে আসি।”
মুগ্ধ চেঞ্জ করে আসলো এবং দুজনে দুইপ্রান্তে শুয়েও পড়লো। হঠাৎ তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। মুগ্ধকে ডাকলো,
-“এইযে, এই..
মুগ্ধ চোখ মেলে তাকাতেই তিতির বলল,
-“আপনি জেগে ছিলেন?”
-“না, কেন?”
-“একবার ডাকতেই উঠে গেলেন!”
-“ওহ, আমার ঘুম খুব পাতলা। বল কি বলবে।”
-“ইয়ে মানে একটু প্রব্লেমে পড়েছি।”
-“কি?”
-“আসলে আমি..
তিতিরের আমতা আমতা করা দেখে মুগ্ধ বুঝে নিল। বলল,
-“বাথরুম পেয়েছে?”
তিতির লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এটা ন্যাচারাল একটা ব্যাপার।”
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“খোলা যায়গায় করতে হবে, এছাড়া কোন উপায় নেই। এখানে ঘরবাড়িই নেই, টয়লেট কোত্থেকে আসবে বলো?”
-“কিন্তু খোলা যায়গায়…!”
-“একটু প্রব্লেম হবে বাট একটা রাতই তো ম্যানেজ করে নাও। তাছাড়া তুমি আমি ছাড়া এখানে কেউ নেই।”
মুগ্ধ তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তিতির যেতে যেতে ভাবছিল, এমন পরিস্তিতিতে আল্লাহ কেন যে ফেলে। এত লজ্জা লাগছিল যে তিতিরের মনে হচ্ছিল এখনি মরে যাক, আবার চেপেও রাখতে পারছিল না।
তিতির সাহস করে অনেকটা দূরে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় কেন জানি অনেক ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল পেছন থেকে কেউ টেনে ধরবে, তাই এক দৌড় দিল। দৌড় দিয়ে এসে মুগ্ধর সাথে ধাক্কা খেল। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো?”
-“কিছুনা।”
-“তুমি না কাউকে ভয় পাওনা? তুমি না ছেলেদের উপর ডিপেন্ডেন্ট না?”
-“ছেলেরা এমনই হয় না? সুযোগ বুঝে খোটা দেয়!”
-“এই না, সরি সরি। আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের উপর ডিপেন্ডেন্ট আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের উপর ডিপেন্ডেন্ট। এটাই সত্যি। যাকগে.. চলো ঘুমাই।”
-“না।”
-“না মানে?”
-“মানে আপনি বলেছিলেন রাতে গান শোনাবেন, এখন গান শোনাতে হবে।”
-“এখন? এই অবস্থায়?”
-“হুম! আর কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছি না।”
-“আচ্ছা আচ্ছা দাড়াও আমি জ্যাকেট টা নিয়ে আসি, শীত করছে।”
-“আপনি দাঁড়ান, আমি এনে দিচ্ছি।”
-“কেন? আমি পারবো তো।”
-“আমিও পারবো তো!”
তিতির দৌড়ে গিয়ে জ্যাকেট টা নিয়ে এল। সেটা গায়ে দিয়ে মুগ্ধ গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তিতির আগুনের পাশে ওর মুখোমুখি বসলো। তারপর মুগ্ধ একবার চাঁদের দিকে তাকালো, তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো..
“ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে..
সামলে রাখো জোছনাকে!
কারো নজর লাগতে পারে..
মেঘেদের উড়োচিঠি উড়েও তো আসতে পারে।
জোছনা বড়ই লাজুক মাখা,
লুকিয়ে থাকে ধরা দেয়না।
সেকি তোমার গড়া
নাকি শুধুই মায়া বোঝা যায়না
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।”
তিতিরের মনে হলো গানটা মুগ্ধ ওকে নিয়েই গাইছে। অজানা একটা লজ্জায় পেয়ে গেল ওকে!
-“ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে…”
গান শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ! তারপর তিতির বলল,
-“এই গানটা আমি কখনো শুনিনি। কিন্তু গানটা খুব সুন্দর।”
-“এটা অনেক আগের গান। মান্না দে এর গাওয়া। জানি আজকালকার ছেলে মেয়েরা মান্না দে এর গান শোনে না। কিন্তু আমি আবার ওনার অনেক বড় ফ্যান। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকে ওনার গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।”
-“আসলে আমিও আগের গান শুনিনা, আগের গানগুলো খুব বোরিং হয়। কিন্তু এই গানটা দারুন।”
-“আগের গানগুলো বোরিং না, ইন্সট্রুমেন্ট গুলো বোরিং। এখনকার মত এত আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট তো আর তখন ছিলনা। তুমি যদি এই গানটারই আগের ভার্শন শোনো তোমার ভাল লাগবে না। কিন্তু আগের গানগুলোর মত এত রোমান্টিক গান এখন খুব কমই হয়।”
-“তা যাই হোক, আপনি যে এত সুন্দর গাইতে পারেন আমি কিন্তু ভাবিওনি!”
-“ধুর! কি যে গাই নিজেই বুঝি!”
-“কেন কেউ কখনো বলেনি আপনাকে আপনি কেমন গান?”
-“আমি কাউকে গান শোনাই না, নিজের জন্য গাই।”
-“কেন? আপনার উচিৎ এই প্রতিভাটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।”
-“আমার গান গাওয়াটা কোন প্রতিভা না। আর আমি গান দিয়ে কিছু করতেও চাইনা। নিজের মনের শান্তির জন্য গাই। আর মাঝে মাঝে স্পেশাল দু’একজনকে শোনাই তাও যদি ইচ্ছে করে। বাবাকে বেশি শোনানো হয়, উনি খুব পছন্দ করেন। আর…”
-“আর কি?”
-“আর বউকে শোনাবো প্রতিরাতে, সেই হতভাগিনী শুনতে না চাইলেও শোনাবো। বিরক্ত হলেও মানবো না।”
তিতির হেসে ফেলল। বলল,
-“গার্লফ্রেন্ড কে শোনান না?”
মুগ্ধ হো হো করে হেসে ফেলল। তিতির যে কায়দা করে জানতে চাইছে ওর গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা বুঝতে বাকী রইল না মুগ্ধর। তিতির বলল,
-“হাসির কি হলো?”
-“কিছুনা। চলো ঘুমাই। আমি কাল রাতেও একটু ঘুমাইনি, বাসে ঘুম আসেনা আমার।”
-“আচ্ছা”
তিতিরের গা জ্বালা করতে লাগলো। কি ভাব! গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেই কথা ঘুরিয়ে নিল। বদ একটা।”
তাঁবুর দুই প্রান্তে দুজন শুয়ে পরলো। শুয়েই মুগ্ধ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। জানে নেটওয়ার্ক থাকার কোনই সম্ভাবনা নেই তবু একবার চেক করা জাস্ট। নাহ নেটওয়ার্ক নেই। বলল,
-“এখান্র নেটওয়ার্ক থাকলে আমাদের এরকম বিপদে পড়তে হতো না।”
-“হুম! সকালে বাসায় কথা বলেছিলাম যে বান্দরবান পৌঁছেছি। তারপর তো আর নেটওয়ার্কই পেলাম না। বাবা বোধহয় চিন্তা করছে।”
-“কেন? তুমি বলোনি পাহাড়ে নেটওয়ার্ক থাকেনা?”
-“বলেছি, ভাইয়াও নিশ্চই বলবে কিন্তু বাবা আমাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করে।”
-“স্বাভাবিক! একমাত্র মেয়ে কিনা!”
-“একমাত্র হোক আর যতগুলোই হোক মেয়েদের প্রতি বাবারা বোধহয় এমনই হয়।”
-“হ্যা, সেটাই।”
সিঙ্গেল তাঁবু, পাশাপাশি তিতির মুগ্ধ। মাঝখানে মাত্র এক হাতের দুরত্ব। তিতির মুগ্ধর উল্টোদিকে ফিরে শুয়েছিল। হঠাৎ বাইরে চোখ পড়লো তিতিরের। কাপড়ের ভেতর দিয়েও বাইরে ছায়া দেখা যায়। বাতাসের তোড়ে আগুনের উথাল পাথাল জ্বলা দেখে ওর কেমন যেন ভয় করলো। ও মুগ্ধর দিকে ফিরলো। মুগ্ধর চোখ বন্ধ.. যাক ও যখন ঘুমিয়েই পড়েছে, অস্বস্তি লাগবে না আর।
হঠাৎ তিতিরের খেয়াল হলো, ভেতর থেকে বাইরে দেখা গেলে তো বাইরে থেকেও ভেতরে দেখা যাওয়ার কথা, হোক সে ছায়া! ও যখন ড্রেস চেঞ্জ করছিল তখন তো ভেতরে কেউ নেই ভেবে সব খুলে ফেলেছিল। মুগ্ধ দেখেনিতো আবার? মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। পরমুহূর্তেই ভাবলো, ধুর! কিসব ভাবছে ও। যে মানুষটা নিজে লাইফ রিস্ক নিয়ে ওকে বাঁচালো তাকেই কিনা ও খারাপ ভাবছে! মুগ্ধ নিশ্চই দেখেনি। মুগ্ধ যদি খারাপ হতো তাহলে এই পরিবেশে ওর পাশে হাত গুটিয়ে শুয়ে না থেকে ওকে গিলে খেত! এসব ভাবতে ভাবতেই তাকালো মুগ্ধর দিকে।
তিতির কম্বল নিয়ে শুয়েছিল, মুগ্ধর নাকি শীত করছিল না তাই মুগ্ধ কম্বল গায়ে না দিয়ে মাথার নিচে দিয়ে বালিশ বানিয়ে শুয়েছিল। এখনো কম্বলে মাথা দিয়ে মুগ্ধর টি-শার্ট সরে গিয়ে গলা থেকে বুকের কিছু অংশ বেড়িয়ে ছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই তিতিরের সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তিতির চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর উঠে বসলো। উঠে বসতেই মুগ্ধর পায়ের দিকে চোখ পড়লো। ও এক পায়ের উপর এক পা ভাজ করে রেখেছে। বড় বড় লোমগুলো ওর ফরসা পায়ের উপর শুয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে ওর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ছেলেদেরও উচিৎ মেয়েদের সামনে ভালমতো ড্রেসআপ করা। মেয়েদের সামনে থ্রি কোয়ার্টার পড়ে পা দেখিয়ে বেড়ানো কোন বিরত্ব নয়। তিতির এবার মুগ্ধর মুখের দিকে তাকালো। মুগ্ধর ঠোঁটের নিচে বামপাশে ছোট্ট একটা তিল আছে, আগে খেয়াল করেনি। এটা তো আরো ভয়ঙ্কর জিনিস! তিতির নিজের শরীরের তিল নিজে চেয়ে চেয়ে দেখে! তিল জিনিসটা এত ভাল লাগে ওর! তিতির চোখ সরাতে পারছিল না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ মুগ্ধ চোখ মেলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে গেছিল ভয়ে। কারন, মুগ্ধ একটা পলকও ফেলছিল না। তিতিরের ভয়ে জমে যাওয়া দেখে মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বুকে হাত দিয়ে বলল,
-“উফফ! আপনি সত্যিই খুব খারাপ! ভয় দেখালেন কেন?”
-“তুমি আমাকে স্ক্যান করছিলে কেন?”
-“মানে?”
-“এর চেয়ে ডিটেইলে বললে লজ্জা পেয়ে যাবে তো! তবু বলবো?”
তিতির ভাবলো, মুগ্ধ কি বুঝে ফেলল তিতির ওকে কিভাবে দেখছিল আর কি কি ফিল হচ্ছিল? তাড়াতাড়ি বলল,
-“না না, থাক!”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ঘুমাচ্ছো না কেন?”
-“ঘুম আসছে না।”
-“দিনের বেলায় সিএনজিতে ওভাবে ঘুমালে রাতে ঘুম আসবে কিভাবে?”
-“ছেলেদের কাজই মেয়েদের দূর্বলতা নিয়ে খোঁটা দেয়া।”
-“আচ্ছা আচ্ছা সরি। রাগ করোনা, শুয়ে পড়ো। ঘুম আসবে একসময়।”
তিতির শুতে পড়লো। মনে মনে ভাবল, “যতটা ভাল ছেলে বলে মনে হয় ততটাও না, ফাজিলের হাড্ডি একটা। এর থেকে সাবধান থাকতে হবে।”
কিচ্ছুক্ষণ একটু পর তিতির বলল,
-“আমার খুব শীত লাগছে, সেজন্যই বোধহয় ঘুম আসছে না।”
মুগ্ধ নিজের কম্বলটাও দিল তিতিরকে। বলল,
-“এটা নাও। আমার শীত একটু কম, কম্বল গায়ে দেয়া লাগবে না।”
-“কিন্তু আপনি তো এটা দিয়ে বালিশ বানিয়েছিলেন।”
-“বালিশ লাগবে না। লাগলে বাসা থেকে নিয়ে আসতাম। তুমি এটা নাও তো।”
তিতির দুটো কম্বল একসাথে করে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো তা টেরই পেলনা। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলো মুগ্ধ শীতে কাঁপছে। কি করবে! তাড়াতাড়ি মুগ্ধর কম্বলটা মুগ্ধর গায়ে দিয়ে দিল। তবু মুগ্ধর কাঁপুনি কমলো না। তারপর নিজেরটাও দিল। তাতেও কাজ হলোনা। নিজের ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে তা দিয়ে ওকে চেপে ধরলো। আস্তে আস্তে ওর কাঁপুনি থামলো। তিতির ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। না জ্বর নেই। শীতেই কাঁপছিল! এহ, খুব বীরপুরুষ সেজে ওকে কম্বল দিয়ে ঘুমানো হয়েছিল। তিতির বসে থাকলো কি করবে এছাড়া। কিন্তু ঘুমের জ্বালায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না, শুয়ে পড়লো। তারপর শীত লাগায় কখন যে মুগ্ধর সাথে একই কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লো তা ও টেরই পেলনা।
ভোরে মুগ্ধর ঘুম ভাঙতেই একটা উষ্ণ কোমলতা অনুভব করলো। তারপর চোখ মেলে তাকাতেই সেকেন্ডের মধ্যেই ওর হার্টটা যেন লাফিয়ে উঠলো। তিতির ওর বুকের সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে! মুগ্ধ তাড়াতাড়ি সরে গেল। ছিঃ ছিঃ তিতির জেগে এরকম দেখলে কি ভাবতো!
মুগ্ধ উঠে তাঁবু থেকে বের হলো। বাইরে একটু একটু আলো ফুটেছে। এখনই বেড়িয়ে পড়তে হবে। তা নাহলে আবার কোন বিপদ চলেও আসতে পারে। মুগ্ধ তিতিরকে তাঁবুর বাইরে থেকেই ডাকলো। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলোনা। ভেতরে গিয়ে ডাকতেও কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর মাথায় হাত দিয়ে ডাকলো। তিতির চোখ মেলে বলল,
-“উফফ, আপনি কেন সবসময় ঘুমাতে দেন না?”
-“ডাকাত আসছে।”
তিতির এক লাফে উঠে বসে বলল,
-“কই কই?”
মুগ্ধ হেসে দিয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে বলল,
-“বাহ! খুব ভাল ওষুধ তো!”
তিতির যখন বুঝলো ওকে বোকা বানানো হয়েছে তখন ও রাগ করে বলল,
-“আপনার মত খারাপ মানুষ আমি আগে দেখিনি।”
মুগ্ধ হাসি বজায় রেখে বলল,
-“এখন রওনা না দিলে আরো বড় বিপদ আসবে, তখন কি করবে?”
-“কি বিপদ?”
-“উঠে রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”
উফফ, এই ছেলের ভাব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মুগ্ধর চোখ পড়ল আগের দিনের কেনা পেঁপেটার দিকে। পাকা টা খেয়েছিল আর আধপাকা টা রেখে দিয়েছিল। এখন সেটা পেকে গেছে। বলল,
-“ওয়াও, পেঁপেটার কথা তো মনেই ছিলনা। আমি বাইরে বসে এটা কাটি। তুমি তোমার জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে রেডি হয়ে নাও।”
তিতির রেডি হয়ে বের হতেই দেখলো মুগ্ধ পেঁপে কাটা শেষ। ওকে দেখেই বলল,
-“অল্প পানি দিয়ে মুখ ধুতে হবে, পানি শেষের দিকে।”
-“ও, আচ্ছা প্রব্লেম নেই।”
তিতির মুখ ধুতে ধুতে মুগ্ধ তাঁবু খুলে ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকালো। তারপর কাটা পেঁপেগুলো একটা পলিথিনে নিয়ে বলল,
-“চলো।”
-“খেয়ে যাবনা? আমার তো খিদে পেয়েছে।”
-“যেতে যেতে খাব। এখনে বসে খাওয়া মানে সময় নষ্ট করা।”
-“আচ্ছা।”
ওরা হাটছে আর পেঁপে খাচ্ছে। পেপে খাওয়া একসময় শেষ হয়ে গেল কিন্তু রাস্তা আর শেষ হয়না। রাস্তার পাশে একটা গাছ দেখিয়ে মুগ্ধ বলল,
-“এটা কি গাছ জানো?
তিতির বলল,
-“না তো। কি গাছ?”
-“এটা আলু গাছ। কিন্তু আমরা নরমালি সবসময় যে গোল আলু খাই এটা সেটা না। এটা হলো পাহাড়ী আলু। এতবড় হয়। একটা আলুতেই ১/২ কেজি হয়ে যায়। আলুগুলো খেতে যে কি মজা! নাফাখুম থেকে নাইক্ষ্যাং আর সাতভাইখুম যাওয়ার সময় জিনাপাড়া থাকতে হবে, পাহাড়ী গ্রাম। ওখনে আমাদের এই আলুর ঝোল খেতে দিবে তুমি দেখো।”
-“ওহ!”
-“তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলি আমি?”
-“না না। বলুন না। আমার তো এসব জানতে ভালই লাগে।”
-“হুম, একটা যায়গায় যাব, অথচ সে যায়গার মানুষ কি খায়, কিভাবে জীবন কাটায়, কেমন তাদের ধ্যান ধারণা এসব না জানলে তো আর ঘোরার কোন মানে হয়নান। খালি গেলাম আর দেখে চলে আসলাম সেটা তো আর ট্রাভেলিং না।”
-“হুম!”
-“তোমার কি ঘুম পেয়ে গেল নাকি আবার?”
-“না।”
-“তাহলে কোন কথা বলছো না, শুধু হু হা করছো যে? হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
-“হুম, আসলে আমি এত হাঁটিনি কোনদিন?”
-“আচ্ছা তাহলে একটু বসে যাই চলো।”
ওরা বসলো। তিতর বসেই পানি খেল। মুগ্ধ বলল,
-“অল্প অল্প করে পানি খাবে নাহলে বেশি তৃষ্ণা লাগবে।”
-“আচ্ছা।”
ওরা রাস্তার একপাশে বসে আছে। সামননে খাদ! অন্যপাশে পাহাড়ী জুম ক্ষেত। এরকম দৃশ্য দেখে কাল পর্যন্ত তিতির লাফিয়েছে। এখন সৌন্দর্যে চোখ সয়ে গেছে। মুগ্ধ হঠাৎ একটা গান ধরলো,
” চলোনা যাই বসে নিরিবিলি,
দুটি কথা বলি নিচু গলায়..
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি
আমার মিষ্টি কথামালায়।
তোমাকে বলবো হ্যালো সুইটহার্ট..
খবর শুনেছ নাকি?
তোমার আমার প্রনয়
নিয়ে দেশজুড়ে মাতামাতি।
ঢাকা শহরের অলিগলিতে
তোমার আমার পোস্টার!
সব পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে ছবি
তোমার এবং আমার।
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি
আমার মিষ্টি কথামালায়।
আমাদের কথা সংসদে গেছে
দুই নেত্রী রাজি।
তারা বলেছেন আর দেরী কেন?
এখনি ডাকুন কাজি।
আজ তোমাকে ভোলাবো আমি আমার মিষ্টি কথামালায়….”
গান শেষ হতেই তিতির বলল,
-“নয় নম্বর বিপদ সংকেত!”
-“হুম।”
-“আচ্ছা গানটার মধ্যে তোমাকে বলবো হ্যালো” এর পরে মিস্টার ছিলো না? আপনি যে সুইটহার্ট বললেন?”
-“এটা তো মেয়েদের গান, তাই মিস্টার ছিল। আমি ছেলে হয়েও কি ওটা বলবো? আবার গানটাও খুব পছন্দ। তাই একটু চেঞ্জ করে নিয়েছি।”
তিতির হেসে বলল,
-“ওহ! বাই দ্যা ওয়ে.. কই ঢাকা শহরের কোন গলিতে তো আপনার কোনো পোস্টার দেখিনি কখনো।”
মুগ্ধ তাকালো তিতিরের দিকে। তিতিরের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। মুগ্ধ বলল,
-“কি করবো বলো পোস্টার বের হবার আগেই তো সব মেয়েরা আমাকে ছেড়ে চলে যায়।”
-“সব মেয়েরা ছেড়ে চলে যায়! মানে কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল আপনার?”
-“হবে ৭/৮ টা। কখনো গুনে দেখিনি।”
তিতিরের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তবু মুখটা স্বাভাবিক রেখে বলল,
-“এতগুলো গার্লফ্রেন্ড কে সামলান কিভাবে? ধরা খেয়ে যান না?”
-“আরে তুমি ভুল বুঝছো! এতগুলো তো আর একসাথে ছিল না। একজন গেছে আরেকজন এসেছে এরকম।”
-“এতগুলো মেয়ে সবাই আপনাকে ছেড়ে গেছে, না কাউকে কাউকে আপনিও ছেড়ে দিয়েছেন?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমি একজনকেও ছাড়িনি।”
-“খুব অবলীলায় যে এসব বলছেন? আবার হাসছেনও। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মাধ্যেই কোনো ঘাপলা আছে।”
মুগ্ধ অন্যদিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো!
-“এত হাসছেন কেন, শুনি?”
-“এমনি।”
-“এমনি না, আপনি খুব খারাপ। খালি মনে মনে কি যেন ভাবেন আর হাসেন।”
মুগ্ধ একথার পর আবার হাসলো। তিতির এবার রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আপনি আসলেই খুব খারাপ!”
তারপর হাটা শুরু করলো। মুগ্ধ দৌড়ে ওকে ধরলো। পাশাপাশি হাটতে হাটতে বলল,
-“সরি সরি, আর হাসবো না। বলো কি জানতে চাও।”
-“দরকার নেই।”
-“বাপরে! তোমার দেখি অনেক রাগ! তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমাকে সামলায় কিভাবে?”
-“আমার বয়ফ্রেন্ড নেই।”
-“সেকি! এত সুন্দরী মেয়ের কিনা বয়ফ্রেন্ড নেই।”
তিতির চোখ বড় করে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ ঢঙ করে দূরে সরে গেল। তারপর এক লাইন গাইলো,
“ওই চোখে তাকিয়ো না, আমি লুটপাট হয়ে যাব। আমি বরবাদ হয়ে যাব!”
তিতিরের কি হলো কে জানে রাগ ধরে রাখতে পারলো না গানটা শুনে। হেসে ফেলল। তারপর মুগ্ধ আবার তিতিরের পাশাপাশি হাটতে শুরু করলো। তিতির কিছু বলছিল না। মুগ্ধ বলল,
-“আসলে আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড হয় ভার্সিটি তে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়। ৫ মাস পর ব্রেকাপ। তারপর আবার সেই বছরই আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হয়, ৩ মাস ছিল। তারপর আবার থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হয়। ১০/১২ দিনেই চলে যায়। ব্যস শেষ আমার কাহিনী।”
-“আপনি যে বলেছিলেন ৭/৮ টা?”
-“আরে ওটা তো মজা করে বলেছি।”
-“ও।”
-“থার্ড ইয়ার মানে তো অনেক আগের কথা, না?”
-“হ্যা, তিন বছর প্রায়।”
-“এতদিন ধরে একাই আছেন?”
-“হ্যা, তারপর থেকে আর রিলেশনশিপে যাইনি। একবারে বিয়ে করবো। শুধু শুধু এক্সদের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ কি? তারপর হয়তো বিয়ে করতে গিয়ে দেখবো আমার বউ এক্স এর ছোট বোন। কি ভয়ঙ্কর হবে বুঝতে পারছো?”
একথা বলেই মুগ্ধ হো হো করে হেসে দিল। তিতির হেসে বলল,
-“আপনার খারাপ লাগে না কোনো এক্স এর জন্য?”
-“খারাপ লাগবে কেন? ওরা ভাল আছে, এটাই তো বড় কথা। আমি বয়ফ্রেন্ড হিসেবে খুব খারাপ। যখন বুঝেছে আমার সাথে রিলেশন করে ভুল করেছে তখন চলে গেছে। দুজনের জন্যই ভাল হয়েছে।”
-“ব্রেকাপ গুলো কি কি কারনে হয়েছে জানতে পারি?”
-“সবগুলো ব্রেকাপ সেইম কারনে হয়েছে।”
-“কি কারন?”
-“আমি কেয়ারলেস, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, আমি অগোছালো, আমি ভাব মারি, আমি বোরিং,ব্যাগডেটেড। আমার সাথে থাকা আর গাছের সাথে থাকা সমান।”
-“কি বলছেন? আপনি কেয়ারলেস, দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে আমি এতক্ষণে ডাকাতদের হাতে খুন হয়ে যেতাম।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির আবার বলল,
-“আপনি অগোছালো এটা নিয়ে আর কি বলবো? আপনি সবকিছু আমার আগে গুছিয়েছেন! পেঁপে কাটতে পারেন, রান্না করতে পারেন। এগুলো অগোছালো ছেলেরা পারে?”
-“ওরা তো আর কেউ আমার সাথে কোথাও ট্রিপে যায়নি আর বিয়ে করে এক বাড়িতেও থাকিনি তাই এসব দেখার বা জানার সুযোগ পায়নি। যা জেনেছে যা দেখেছে তা হলো, আমি কেয়ারলেস কারন, আমি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দেইনা। প্রতিবেলায় ফোন করে খবর নেই না খেয়েছে কিনা। শুধুমাত্র রাতে একবার ফোন দেই। কি হেয়ার কাট দিল, কি লিপস্টিক লাগালো, কি ড্রেস পড়লো কিছুই খেয়াল করিনা বলিও না কেমন লাগছে! একচুয়েলি আমার এত সাজগোজ পছন্দ না। বাট আনফরচুনেটলি সবগুলোই সাজুনী ছিল। তিতির হেসে বলল,
-“তারপর?”
-“আমি ব্যাগডেটেড কারন, আমি ফেসবুকের ছবিতে কমেন্ট করিনা এটা একজনের অভিযোগ ছিল। আমি নাকি ভাব মারি কারন রেস্টুরেন্টে গেলে অন্য কাপলদের দেখিয়ে বলতো, ‘দেখো ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর তুমি জীবনেও আমাকে খাইয়ে দিলে না।’ আমি হেসে বলতাম ‘ও’ কিন্তু খাইয়ে দিতাম না।”
-“আচ্ছা, আসলেই আপনি তাহলে একটু অন্যরকম। সব মেয়েরাই এসব কম বেশি চায়। যেমন ধরুন একটা মেয়ে তো অবশ্যই চাইবে যে তার বয়ফ্রেন্ডটা তাকে একটু খেয়াল করে দেখুক। একটু প্রশংসা করুক। কিন্তু আপনি তা করতেন না।”
-“মুখে এক ইঞ্চি মেকাপ থাকলে বুঝবো কি করে কঙ্কাবতী না কৃষ্ণকলি? ফরসা কালো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে আসল ব্যাপারটা জানলে হয়তো সেটা নিয়ে গান শুনিয়ে প্রশংসা করতাম। তারপর ধরো একটা ছেলের মন পর্যন্ত পৌঁছতে যেমন পেটের দিকে আই মিন খাওয়ার দিকে নজর দিতে হয়, তেমনি একটা মেয়ের মন পর্যন্ত যেতেও তার চোখের দিকে নজর দিতে হয়। সুন্দর চোখের প্রতি আমার দূর্বলতা আছে। আমি অবশ্যই সেটা নিয়ে তাকে কিছু বলতাম কিন্তু চোখের উপর এক্সট্রা আইল্যাশ লাগলে আর কি কি সব দিয়ে চোখটাকে ভুতের মত রঙিন করে রাখলে বুঝবো কি করে যে কোন উপমাটা খাটবে? তাই কিছুই বলিনি।”
-“তো আপনি তাদেরকে বলতে পারতেন যে আপনি ওসব পছন্দ করেন না। আপনি না বললে তারা বুঝবে কি করে?”
-“বলবো কেন? যে যেরকম তার সেরকমই থাকা উচিৎ। আমার তো কোন রাইট নাই নিজের পছন্দ অপছন্দ অন্য কারো উপর চাপিয়ে দেয়া। আমি তো আর এসবের জন্য কাউকে ছাড়িনি। আর এসব অভিযোগ থাকলেও এসবের জন্য আমাকেও কেউ ছাড়েনি। ছেড়েছে আমার ট্রাভেলিং এর জন্য।”
-“সেকি! কেন?”
-“এইযে এরকম পাহাড়ে, জঙ্গলে আসলেই নেটওয়ার্ক থাকে না। কথা হয়না, তার জন্য নাকি অস্থির লাগে। গার্লফ্রেন্ডের চাইতে আমি ট্রাভেলিং কে বেশি ভালবাসি, আমি নাকি গার্লফ্রেন্ড ছাড়তে পারবো কিন্তু ট্রাভেলিং ছাড়তে পারবো না তাই ব্রেকাপ!”
-“আচ্ছা আপনি যখন ৪/৫ দিনের ট্রিপে যেতেন তখন আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়েনি? খারাপ লাগেনি?”
-“নাহ! প্রকৃতি আমার সবচেয়ে বড় আর ইম্পরট্যান্ট প্রেমিকা। প্রকৃতির কাছে গেলে আর কিছু লাগেনা।”
-“আমার তো মনে হচ্ছে আপনার কারো সাথেই সম্পর্কটা তেমন গভীর ছিলনা। কাউকেই আপনি সত্যিকার অর্থে ভালবাসেননি।”
-“সেটাও হতে পারে। তবে আমি লয়াল ছিলাম।”
-“ওহ!”
-“অনার্সের পর থেকেই মা আমার জন্য মেয়ে দেখছে। আমার মা ভীষন সৌখিন, সে বড় ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি অনেক চুজি বুঝলে? মায়ের দেখা একটা মেয়েও পছন্দ হয়নি। মা তো পুরো বিরক্ত আমার উপর।”
-“তাই? আচ্ছা, কিরকম মেয়ে আপনার পছন্দ আমাকে বলুন তো। আমি আপনার জন্য মেয়ে দেখে দেব।”
-“বলছি তার আগে শোনো কেন আমার মায়ের দেখা মেয়ে পছন্দ হয়নি।”
-“ওহ, অবশ্যই… বলুন।”
-“দলবেঁধে মেয়ে দেখতে যাওয়া, সালামি দেয়া, এই ব্যাপারটা আমার কেমন যেন লাগে। যেকোনো মেয়ের জন্য খুবই অসম্মানজনক। তাই আমি মেয়ের ছবি দেখে ফোনে কথা বলেছি কিংবা বাইরে দেখা করেছি।”
-“তারপর?”
-“আমার সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট প্রশ্ন ছিল ট্রাভেলিং কেমন লাগে?”
-“ওয়াও, এন্সার কি ছিল?”
-“অনেক ধরনের এন্সার ছিল। একটা শুধু বলি। একজন বলেছিল, ‘ওয়েস্ট অফ মানি। তার চেয়ে সেই টাকায় ঘরের একটা জিনিস বানানো যায়, ড্রেস কেনা যায়’।”
তিতির হাসতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আমি ট্রাভেলিং ছাড়া থাকতে পারবো না। তাই এটাকে সহজভাবে নেবে এমন কোনো মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই। সবচেয়ে ভাল হয় তারও যদি ট্রাভেলিং এ ইন্টারেস্ট থাকে। দুজন মিলে সারা দুনিয়া ঘুরব। খুব বেশি সুন্দরী না হলেও চলবে। শুধু চোখ দুটো সুন্দর হলেই হবে, ডুব দেব সেই চোখে।”
তারপর পাশাপাশি হাটতে হাটতেই তিতিরের চোখের দিকে তাকালো। তিতির সে দৃষ্টির অর্থ বুঝলো না। খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে বলল,
-“তারপর আর কি কোয়ালিটি চাই?”
-“বেশি সাজগোজ করেনা এমন কোনো মেয়ে হলেই ভাল হয়। মেকাপ দেখলেই আমার একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশন ক্রিয়েট হয়।”
-“আর?”
-“রান্নাবান্না না জানলেও চলবে। আমি মোটামুটি সবই রাঁধতে পারি, আর রাঁধতে ভালও লাগে। ফ্রি টাইমে আমার কাছ থেকে হেল্প পাবে। আর বোকা, ইমোশনাল মেয়ে চাই। ওরা অনেক ভালবাসতে জানে।”
-“আর?”
-“বেশি লম্বা না হলেও চলবে। ফরসা, কালো কোনোটাতেই প্রব্লেম নেই।”
-“কিন্তু আপনি তো লম্বা। লম্বা মেয়েদেরই আপনার পাশে ভাল লাগবে।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“হাসছেন যে?”
-“এমনি।”
-“ও ভাল কথা, সবই বললেন কেন এক্স রা আপনাকে কেয়ারলেস, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভাব মারা আর ব্যাগডেটেড বলত। কিন্তু বললেন না তো কেন আপনাকে বোরিং বলতো। আপনি তো মোটেই বোরিং না। দুদিন ধরে তো দেখছি।”
-“ওহ ওটা তো ইচ্ছে করেই স্কিপ করেছি।”
-“কেন?”
-“বললে তুমি লজ্জা পেয়ে যাবে। আর আমি এটা তোমাকে বলেছি বলেও অনেক কিছু ভাবতে পারো।”
-“আরে ধুর! কিছুই ভাববো না। আপনার এক্স আপনাকে বোরিং বলার কারনে আমি কেন লজ্জা পাব?”
-“আমরা তো অতটাও ফ্রি হইনি।”
তিতির কিছু না বুঝেই বাচ্চাদের মত বায়না করতে লাগলো। আরে বলুন না। আমি মোটেই লজ্জা পাব না। আপনার মত মানুষকে কেন বোরিং বলবে আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনা।”
-“সবাই না শুধু সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ডটা বোরিং বলেছিল যার সাথে ৩ মাস রিলেশনশিপ ছিল।”
তিতিরের মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বলল,
-“ইন্ট্রোডাকশন টা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে।”
-“বলার পর আবার রাগ করোনা কিন্তু।”
-“আরে না না বলুন।”
-“আই নেভার কিসড হার… বিকজ অফ হার লিপস্টিক!”
তিতির পুরো হা হয়ে গেল। ও ভাবতেই পারেনি এমন কিছু। ওরা হাটছিল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ অন্যদিকে ফিরে কথাটা বলল। তিতির সাথে সাথে সোজা হয়ে অন্যদিকে তাকালো। লজ্জা পেয়ে পুরো চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। মুগ্ধর একবার ইচ্ছে হলো বলুক, ‘জানতাম এমনটাই হবে।’ কিন্তু কেন জানি আর বলল না।
৩ ঘন্টা হেটে ওরা মাত্র ৪ কিলোমিটার এসেছে। হঠাৎ দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ আসছিল। পিছনে ফিরতেই দেখলো একটা বাস আসছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“তিতির, বাসে যেতে পারবে?”
তিতিরের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বলল,
-“হ্যা পারবো।”
-“লোকাল বাস কিন্তু! দাঁড়িয়েও যেতে হতে পারে।”
-“নো প্রব্লেম। হাটতে তো আর হবে না।”
মুগ্ধ বাসটা থামালো। বাসের হেল্পার জানালো যায়গা নেই। অলরেডি অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। তখন মুগ্ধ ওদের বিপদের কথা বলতেই বাস ওদের তুলে নিল। বাসে উঠে মুগ্ধ বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো। আর তিতির তা নাগাল পেলনা। তাই মুগ্ধর হাত ধরে দাঁড়ালো। মুগ্ধও তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। কিন্তু একটা ডাউনহিল পার করতেই বাস নিচের দিকে যেতে শুরু করলো আর তিতির পড়ে যাওয়ার ভয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও অবশ্য তিতিরকে ধরে ফেলেছিল। এরকম শত শত আপহিল, ডাউনহিল ছিল রাস্তায়। পুরো রাস্তাই মুগ্ধ একহাতে হ্যান্ডেল ধরে আরেক হাতে তিতিরকে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তিতিরের তখন মনে হচ্ছিলো, ও বোধহয় মুগ্ধকে ভালবেসে ফেলেছে! আবার ভাবলো দুদিনের পরিচয়ে কি ভালবাসা সম্ভব? নাকি এটা শুধুই ভালোলাগা! কিন্তু ভালবাসা যদি নাই হয় তাহলে ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতেও কেন অস্বস্তি হচ্ছে না?”
থানচির সরকারি গেস্ট হাউজের মাঠে ওদের তাঁবু গেড়ে থাকার কথা ছিল। মুগ্ধ বাস থেকে নেমেই ফোন বের করলো। এখানে তো নেটওয়ার্ক থাকার কথা। হ্যা নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল, কিন্তু সাফির ফোন বন্ধ। তাড়াতাড়ি একটা অটো নিয়ে গেস্ট হাউজে গেল মুগ্ধ-তিতির। তখনও ওরা জানতো না কি বিপদ ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল থানচিতে!
মুগ্ধ-তিতির আলো ফুটতেই মানে ৫ টার দিকে রওনা দিয়েছিল। ৩ ঘন্টা হাটা আর প্রায় ১ ঘন্টা বাস জার্নির পর ওরা থানচি পৌঁছেছিল। থানচি গেস্ট হাউজে ঢুকেই মুগ্ধ রিসিপশনের দিকে গেল। পিছন পিছন গেল তিতির। ঘড়ির কাটা ছিল তখন ৯ টার আশেপাশে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা ২৬ জনের একটা দল এসেছে না কাল?”
-“ওনারা তো আজ ভোরেই রেমাক্রি রওনা দিয়ে দিয়েছে। তা প্রায় ৩/৪ ঘন্টা হবে। আপনারা ওনাদের খুঁজছেন কেন?”
-“আমরাও ওই দলেই নাফাখুম ট্রিপে এসেছি। পথে আমরা ওদের হারিয়ে ফেলি।”
-“ওহ হ্যা। ওনারা তো ২৮ জনেরই বুকিং দিয়েছিল।”
-“হ্যা। এত আগে রওনা দিয়েছে। এখন তো ধরতেও পারবোনা ওদের।”
-“ওনারা যদি টানা নৌকায় যেত তাহলে আপনারা ইঞ্জিন নৌকায় গিয়ে ধরতে পারতেন। কিন্তু ওনারা তো ইঞ্জিন নৌকা নিয়েছে সবগুলোই।”
-“ওরা কোনো মেসেজ দিয়ে গেছে আমাদের জন্য?”
-“না কিছু বলেনি।”
তিতির বলল,
-“এখন কি হবে?”
-“দাড়াও দেখছি।”
তারপর মুগ্ধ আবার ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,
-“একটা ঘর হবে?”
-“দুজনের জন্য?”
-“হ্যা।”
-“আপনাদের সম্পর্ক?”
-“আমরা স্বামী-স্ত্রী।”
তিতির অবাক হয়ে চাইলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ম্যানেজার বলল,
-“সব রুম বুকিং দেয়া আছে। দিব কিভাবে বলুন।”
-“আমরা রাতে থাকব না। জাস্ট গোসল করে ফ্রেশ হবো, খাবো এটুকু সময়।”
-“ওহ তাহলে একটা রুম দেয়া যাবে। যদিও বুকিং আছে কিন্তু ওনাদের আসতে বিকাল হবে।”
-“ওহ, থ্যাংকস।”
রুমে খুলে দিতে দিতে ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো,
-“নতুন বিয়ে করেছেন বুঝি?”
-“হ্যা। গত সপ্তাহে।”
-“হানিমুনে এলেন এই জঙ্গলে?”
-“আসলে আমাদের দুজনেরই পাহাড়, জঙ্গল পছন্দ!”
ম্যানেজার সবগুলো দাঁত বের করে বলল,
-“ভাবীর তো দেখি একদম কম বয়স।”
তিতিরের বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘তাতে তোর কিরে ব্যাটা!’ কিন্তু বললনা। মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা, এরেঞ্জ ম্যারেজ তো।”
-“ও। আচ্ছা ভাই ৩ টার মধ্যে রুম ছেড়ে দিতে হবে কিন্তু।”
-“হ্যা হ্যা নো প্রব্লেম।”
ম্যানেজার বেড়িয়ে যেতেই মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে দিল। তিতির বলল,
-“এটা কি হলো?”
মুগ্ধ কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলল,
-“কি হলো?”
-“স্বামী-স্ত্রী বললেন কেন?”
-“তো? তোমাকে বউ বলেছি বলে কি তোমার জাত গেল?”
তারপর নিজের কলারটা একটু ঠিক করে বলল,
-“আমি কি ফেলনা নাকি?”
-“এসব বলার কি দরকার ছিল?”
-“না বললে রুম পেতাম না। আর তুমি রিয়াক্ট করছো কেন? বলেছি বলেই কি আমি রুমে ঢুকেই স্বামীদের মত বিহেভিয়ার শুরু করেছি?”
তিতির আর কথা বাড়ালো না। মুখে যাই বলুক কথাটা শুনে তো ওর ভালই লেগেছে। বরং কাজের কথা বলা যাক। বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা। এখন আমরা কি করবো?”
মুগ্ধ বিছানায় শুয়ে বলল,
-“গোসল করবো, খাব। তারপর বান্দরবান ফিরে যাব। আর তুমি যদি চাও তো রেমাক্রিও যেতে পারি। কারন, ওরা তো দুপুরে রেমাক্রি পৌঁছে ওখানকার গেস্ট হাউজে থাকবে। ভোরে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আর আমরা এখন রওনা দিলে সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে যাব।”
-“ফিরে যাওয়ার জন্য কি এত কষ্ট করে এসেছি নাকি? আমি নাফাখুম যাবই যাব।”
-“আচ্ছা। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে কিভাবে যাব সেটা নিয়ে।”
তিতির চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
-“কেন নৌকা ছাড়া অন্য কোনভাবে যাওয়া যায় নাকি?”
-“নাহ, একমাত্র উপায় নৌকা। কিন্তু দলছাড়া শুধু দুজন নৌকার জন্য রিস্কি হয়ে যায়। তার উপর একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য তো রিস্কটা আরো বেশি হয়ে যায়।”
-“এখানেও ডাকাত আছে?”
-“ডাকাতরা এদিকে আসেনা। এদিকটা জলদস্যুদের।”
-“ওমাগো! জলদস্যু!”
-“হুম, তবে জলদস্যুরা কাউকে ধরেছে এরকমটা কমই শোনা গেছে। ওরা সমুদ্রেই যায় বেশি। যখন ওখানে সুবিধা করতে পারেনা তখন এদিকে আসে। আর এদিকে এসে করবেই বা কি বলো? এদিকের মানুষের তো আর অত টাকা পয়সা নেই। ট্যুরিস্টও খুবই কম।”
-“ওরাও কি ডাকাতদের মত মেয়েদের প্রতি… ?”
থেমে গেল তিতির। তারপর মুগ্ধ বলল,
-“মেয়েদের প্রতি লোভ কার নেই বলো? ডাকাত, জলদস্যুরা না হয় বুঝলাম অশিক্ষিত, অভাবে বড় হওয়া। তাই শিক্ষা পায়নি, মানবিক বোধ জন্মেনি। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত সমাজে এমন অমানবিক পিশাচ কি নেই? সব মুখোশ পড়ে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই মুখোশটা টেনে খুলে ফেলছে।”
-“কই আপনার তো কোনো লোভ নেই।”
কথাটা বলে ফেলে কি যে ভাল লাগছিল তিতিরের! ইশ, সব ছেলেই যদি মুগ্ধর মত করে ভাবতো। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আসল ব্যাপারটা কি জানো?”
-“না তবে জানতে চাই।”
-“সব পুরুষ মানুষ খারাপ না। কিন্তু ওদের জন্য পুরো পুরুষ জাতটাকেই কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়। ওদের জন্যই সবার খারাপ কথা শুনতে হয়। অথচ প্রোপরশন টা কিন্তু ওই এক বাটি দুধে একটা মাছির মতই।”
-“কিন্তু রাস্তায় বেরোলে তো স্টেপে স্টেপে ছেলেরা পাশ দিয়ে আয় আর খারাপ খারাপ কথা বলে। তাহলে প্রোপরশনটা কোথায় গিয়ে দাড়ায় ভাবুন তো?”
-“ওটা তো টিজিং। টিজিং তারাই করে যারা রাস্তায় রাস্তায় থাকে। ওদের সংখ্যা তো কমই। ওদের দেখছো কিন্তু যারা রাস্তায় নেই বাসায় আছে তাদেরকে কি দেখতে পাচ্ছো?”
-“তা অবশ্য দেখছি না।”
-“আর ওদের দেখলে মনে হবে ওরা ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু আদৌ তা না। আমি তো কখনো ১ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার টাইম পাইনি। আমার ছোটভাই দৌড়ের উপর থাকে স্কুল, কোচিং নিয়ে। সেও টাইম পায় না। আমরাও আড্ডা দেই তবে বাসায় কাজিনদের সাথে। বাইরে আড্ডা দেই স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বন্ধুদের সাথে ক্লাসের ফাঁকে। রাস্তায় রাস্তায় টাইম পাস করার মত সময় আমাদের মত ফ্যামিলির ছেলেরা পায়না। আর আমাদের মত ফ্যামিলিই দেশে সবচেয়ে বেশি।”
মুগ্ধ ঘড়ি দেখে বলল,
-“দেরী হয়ে যাচ্ছে আমাদের। পরে গল্প করবো। এখন বাসায় একটা ফোন করো। তারপর গোসলে যাও।”
-“ও হ্যা। কিন্তু আপনি গোসল করবেন না?”
-“তুমি আগে করো।”
-“বাসায় ফোন করলে সবার সাথে কথা বলতে হবে আলাদা করে। তখন অনেক সময় লাগবে ততক্ষণে আপনি বোধহয় গোসল করে ফেলতে পারবেন।”
-“ও। ঠিকাছে তাহলে আমি আগে যাচ্ছি।”
তিতির মোবাইল বের করে দেখলো নেটওয়ার্ক নেই। মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নেটওয়ার্ক নেই তো। আমার বাবা তো টেনশনে হার্ট অ্যাটাক করবে।”
মুগ্ধ ব্যাগ থেকে কাপড় বের করছিল। তাকিয়ে বলল,
-“এয়ারটেল?”
-“হুম!”
-“কোন ভরসায় যে পাহাড়ে এয়ারটেল নিয়ে আসতে পারো!”
-“জানতাম না তো!”
-“আচ্ছা প্রব্লেম নাই আমারটা নাও।”
পকেট থেকে মোবাইল বের করে এগিয়ে দিল মুগ্ধ। তারপর গোসলে ঢুকে গেল। তিতির মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সিম্পল লক। কোনো প্যাটার্ন নেই। বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। বাবা চিন্তায় ছিলো। বাবাকে বুঝিয়ে বলল যে ও ভাল আছে আর আগামী ৬/৭ দিন কথা হবে না। কারন, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই। বাবা বলল ভাইয়া নাকি আগেই বলেছে এসব। তারপরেও মন কেমন করছিল, এখন কথা বলে ভাল লাগছে। মায়ের সাথেও হাই হ্যালো করে রেখে দিল।
ফোন রাখতেই তিতিরের কেন যেন ইচ্ছে করলো মোবাইলটা ঘাটতে। জানে এটা ঠিক না। তবু সোজা মেসেজ অপশনে চলে গেল। সব ফোন কোম্পানি আর মায়ের, বোনের, ভাইয়ের আর ফ্রেন্ডদের মেসেজ। সত্যিই কি ওর গার্লফ্রেন্ড নেই? তখন হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ আটকে গেল। নাম্বারটা “প্যারা” দিয়ে সেভ করা। কনভারসেশন টা এরকম ছিল,
Pera: Mugdho, ami tor proti mugdho!
Mugdho: Being mugdho is good for health.
Pera: I love you!
Mugdho: So? what can i do for u?
Pera: You should love me too.
Mugdho: Ken ami ki tor kase matha bandhaisi?
Pera: Emn korish kn always?
Mugdho: Ami emn e..
Pera: Eto vab kisher tor?
Mugdho: Tui e ajaira msg diya vab baraisos.
Pera: kauke valobasha ki dosh?
Mugdho: Na onk boro gun. ei onk boro gun onno kono channel e dekha ga.. kame dibo! Amr piche somoy noshto korish na amma.. khema de!
Pera: Amare amma boltesish kn tui? amare to amma koibo tor polapain.
Mugdho: Amr polapainer ki theka porseni tore amma koibo?
Pera: Ami jonmo dimu tyle ki arek betire amma koibo?
Mugdho: U are mad.. chaogol ekta.
Pera: Chagol pagol ja mon chay ko.. kintu ami shotti tor bacchar ma hoite chai
Mugdho: Tar mane tui amar loge sex korte chash?
Pera: sex, biya, baccha shob korte chai.
Mugdho: Biye to 100 miles dure.. tor moto behayar loge ami sex o korina.
বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে তিতির তাড়াতাড়ি ব্যাকে গিয়ে গিয়ে কাটল। যাতে হাইলাইটসে মেসেজ অপশনটা এসে না থাকে। ভাগ্যিস মুগ্ধ দরজাটা খুলে বের হওয়ার আগেই তিতির ফোনটা হাত থেকে রাখতে পেরেছিল।
মুগ্ধ শুধু জিন্স পড়ে বেড়িয়ে এসেছে খালি গায়ে। এটা কোন কথা? সদ্যভেজা লোমগুলো প্রথমবারের মত দেখে তিতির চোখ ফেরাতে পারছিল না। মুগ্ধ তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিল।
মুগ্ধ শার্ট পড়তে পড়তে বলল,
-“তিতির তুমি গোসলে যাও। আমি খাবার কিনে নিয়ে আসি। আর আমাদের তো রেমাক্রি পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দুপুরে নৌকায় রান্না করার জন্য কিছু বাজার করতে হবে। ওটাও করে নিয়ে আসি।”
-“নৌকায় রান্না কিভাবে সম্ভব?”
-“এখানের নৌকাগুলো তো অনেক দূরে দূরে যায়। নৌকাতেই রান্নার সব ব্যবস্থা থাকে। চুলা, হাড়ি, বটি, ইভেন মশলা বাটার পাটা সব থাকে মাঝিদের কাছে।”
কথা শেষ করেই একটা হাসি দিল মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“ওহ।”
-“এখন কি খাবে সেটা বল?”
-“ভাত। যা দিয়ে হোক ভাত হলেই হবে। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
-“একদম মনের কথা বলেছো। আমার মনটাও এখন ভাত চাইছিল।”
-“সকালে ভাত খেতে পারিনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভাত না খেতে পেলে মরেই যাব।”
-“এক্সাক্টলি! আচ্ছা এখন তো সাড়ে নয়টা বাজে। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরবো। তুমি গোসল করে একেবারে রেডি হয়ে নেবে। আর হ্যা, সালোয়ার-কামিজ পড়বে।”
-“আচ্ছা।”
বের হতে গিয়ে আবার ফিরলো মুগ্ধ। জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা তোমার কি কোনো স্কিন প্রব্লেম আছে? মানে এলারজি কিংবা অন্যকিছু?”
-“নাহ। কেন বলুন তো?”
-“এসে বলছি। দরজা লাগাও। আর কেউ আসলে দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করবে কে? আমি না হলে দরজা খুলবে না। যেই হোক। ম্যানেজার আসলেও না, কোন অজুহাত দিয়ে দেবে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ বেড়িয়ে যেতেই তিতিরের মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। যেই ছেলেটা অন্য মেয়েদের সাথে ওইভাবে কথা বলে সেই ছেলেটাই ওর এত খেয়াল রাখছে! সেটা কি শুধুই ওর সাথে আছে বলে নাকি অন্য কিছু!
মুগ্ধ বাইরে যেতে যেতে মাকে ফোন করে কথা বলল। বাবাকে ফোন করে ৫ হাজার টাকা বিকাশ করতে বলল ইন্সট্যান্ট। কখন কিসে লাগে বলা যায়না। এরপর সামনে কি আছে কে জানে! কিন্তু আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানালো মুগ্ধ! ভাগ্যিস সাফিদের হারিয়েছিল। নাহলে হয়তো এসব কিছুই হতোনা। গতকাল সারাদিন আর সারারাত.. ভয় ছিল, বিপদ ছিল তবু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের অন্যতম একটা সময় ছিল। তিতিরের জন্য অন্যরকম একটা ফিলিং হচ্ছে যা কখনো অন্য কারো জন্য হয়নি! কিন্তু তিতিরেরও কি কোনো ফিলিং হচ্ছে? নাকি হচ্ছে না? ফিলিং না হলে কি কাল রাতে ওভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো? ফিলিং না হলে কি জিজ্ঞেস করতো কিরকম মেয়ে ওর পছন্দ? মুগ্ধ সিওর যে তিতিরেরও কিছু ফিল হচ্ছে। যদি না হয় তাহলে ও বুঝবে ভালবাসার কিছুই বোঝেনা ও। ব্যাপারটা আরেকটু ঘাটিয়ে দেখতে হবে ১০০% সিওরিটির জন্য।
কেনাকাটা শেষ করে এসে মুগ্ধ দরজায় নক করলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“কে?”
মুগ্ধর মাথায় দুষ্টুমি চাপলো তাই কিছু বলল না। আবার নক করলো। তিতির বলল,
-“কে?”
এবারও মুগ্ধ কথা বলল না। নক করলো। তিতির বলল,
-“না বললে খুলবো না তো!”
-“আরে বাবা খুলো।”
তিতির দরজা খুলে বলল,
-“ঢং তো ভালই করতে পারেন।”
মুগ্ধ কিছু বলতে পারলো না। ওর চোখ আটকে গেছে। তিতির গোসল করে হালকা বেগুনী মানে জারুল ফুলের রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। ওর গায়ের হালকা গোলাপী রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে সব। কোনো প্রসাধনী নেই মুখে। চুলগুলো এখনো আঁচড়ায়নি। এলোমেলো চুল বেয়ে বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। এত স্নিগ্ধ রূপ কেবল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতিতেই দেখেছে ও, কোনো মানুষের মাঝে দেখেনি। এক ফোটা পানিকেই তখন খুব হিংসে হচ্ছিল। কারন সেটা ছিল তিতিরের চোখের বরাবর গালের উপর।
মুগ্ধকে এভাবে হা করে চেয়ে থাকতে তিতির অপ্রস্তুতবোধ করছিল। আবার কেন জানি ভালও লাগছিল খুব। কত মানুষই তো ওকে হা করে চেয়ে দেখেছে। এত ভাল তো লাগেনি কখনো।
কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা ছিলনা। মুগ্ধর হঠাৎ খেয়াল হলো ও বেহায়ার মত অপলক দৃষ্টিতে দেখছে তিতিরকে। স্বাভাবিক হয়ে বলল,
-“চলো খেয়ে নেই। ভাত পাইনি। রুটি-ভাজি চলবে তো?”
-“হ্যা, ঠিক আছে।”
-“বাজার করে এনেছি। নৌকায় উঠেই ভাত রান্না করবো।”
-“আচ্ছা।”
খেয়েদেয়ে সব গুছিয়ে ফেলার পর মুগ্ধ বলল,
-“তুমি কি সুতির ওড়নাওয়ালা কোন সালোয়ার-কামিজ এনেছো?”
-“হ্যা কেন?”
-“আসলে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিতে হবে। জর্জেট দিয়ে দিলে তো আর লাভ নেই। কিছু মনে করোনা এভাবে বলছি বলে। এই যায়গাগুলো দুজনের জন্য রিস্কি। একবার যে বিপদে পড়েছি তাতে আবার পড়তে চাইনা।”
-“বুঝেছি। আচ্ছা চেঞ্জ করতে হবেনা আমি ওড়নাটা রেখে শাল নিয়ে নিচ্ছি।”
তিতির একটা শাল বের করে মাথায় ঘোমটা দিল। মুগ্ধ শালটা মাথা থেকে খুলে ওর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,
-“মাথা ঢাকা কম্পলসারি না। গা ঢাকাটা কম্পলসারি, সরাসরি না বললে কিছুই বোঝোনা দেখছি।”
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মুগ্ধ বাজারের ব্যাগ থেকে একটা কাজলের কৌটা বের করে তিতিরের হাতে দিল। তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“কাজল লাগাবো? কিন্তু আমি তো পেনসিল কাজল ছাড়া দিতে পারিনা।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“মুখে আর হাত পায়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে এই কাজলটা ভাল করে ব্লেন্ড করে লাগাবে।”
-“মানে মুখে কালি মেখে কালো সাজব?”
-“জানি এখন তুমি আমাকে অনেক খারাপ ভাববে। সন্দেহবাতিক ভাববে বাট আমি তোমার সেফটির জন্য এটা করতে বলছি। পাহাড়ে লুকানোর যায়গা ছিল লুকিয়েছিলাম। নদীতে কিন্তু চারপাশে পানি বিপদ এলে কোথাও যেতে পারবো না।”
তিতিরের বুকের মধ্যে হু হু করে লিলুয়া বাতাস বয়ে গেল। এতটা ভাবে মুগ্ধ ওকে নিয়ে! তিতির মুগ্ধর কথা মতই কাজলের কালি দিয়ে মুখ, হাত, পা, সব কালো করে ফেললো। তারপর মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-“ঠিক আছে?”
মুগ্ধ এগিয়ে এসে একটু কাজল নিজের দুহাতের অঙুলে ব্লেন্ড করে তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
-“কানে লাগাবে কে সুন্দরী?”
তারপর মুগ্ধ তিতিরের দুই কানে কালি লাগালো। ওর ছোঁয়া পেয়েই তিতির শিউরে উঠলো। তা দেখেই মুগ্ধর ভেতরে কি যেন হলো। সরে গিয়ে বলল,
-“তুমি নিজেই লাগাও।”
গেস্ট হাউজের বিল মিটিয়ে, আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে তারপর নৌকার ঘাটে গেল ওরা। নৌকা খুঁজছিল মুগ্ধ। হঠাৎ কোত্থেকে এক ছেলে দৌড়ে মুগ্ধ দাদা মুগ্ধ দাদা করতে করতে এল। তাকে দেখেই মুগ্ধর সেকি আনন্দ। তিতির বুঝলো না এই পাহাড়ী ছেলেটার সাথে এমন কি সম্পর্ক মুগ্ধর! কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“মংখাই, তোমাকে পেয়ে যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলবো! ঢাকা থেকে আসার আগেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার ফোন বন্ধ ছিল। ভেবেছি পাহাড়ে আছো বোধহয়। তারপর আবার থানচি এসে থেকে তোমাকে ফোন করছি। তোমার ফোন বন্ধ বলছিল। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”
-“দাদা, ফোন বন্দু না। আমি ইক্ষন রেমাক্রি তিকা আসলাম। উখানের নেটওয়াক তো জানেন।”
-“আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন।”
মংখাই নামের পাহাড়ী ছেলেটি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“শোনো, জানি তুমি মাত্র এসেছো। কিন্তু কিছু করার নাই, তোমাকে রেস্ট নেয়ার টাইম দিব না। তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”
মংখাই হেসে বলল,
-“দাদা আমার পা যদি বাংগাও তাকে তাও আমি যাব আপনের সাতে। আপনি না নিলেও জোড় করি যাব। নৌকা ঠিক করিচেন?”
-“না। তুমি যখন এসে পড়েছো তুমিই ঠিক করো। আর ইঞ্জিন নৌকা নিও।”
-“ইঞ্জিন নৌকায় তো ম্যালা শব্দ। আপনের না বাল্লাগেনা।”
-“হ্যা। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে চাই। কাল যে কি বিপদে পড়েছিলাম ভাই। আর কোনো বিপদ চাইনা।”
মংখাই এতক্ষণে তিতিরকে খেয়াল করলো। বলল,
-“ভাবী?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আরে না না, আমরা এক দলে ট্রিপে এসেছি। পরে ওদের হারিয়ে ফেলেছি। দুদিন আগেও কেউ কাউকে চিনতাম না কিন্তু এখন আমরা ভাল বন্ধু হয়ে গেছি।”
তিতিরের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভাবী কিনা জিজ্ঞেস করলো আর ও না বলে দিল! হ্যা বললে কি এবার ওর জাত যেত? মুগ্ধ তিতিরের দিকে ফিরে বলল,
-“ও হচ্ছে আমার এক ছোটভাই মংখাই। ও পাহাড়ী। কিন্তু দেখেছো কি সুন্দর বাংলা বলে?”
ছেলেটি হাসলো। হাসলো তিতিরও। মুগ্ধ বলল,
-“ও হলো এখানকার গাইড। ও সাথে থাকলে কোন চিন্তা নেই।”
মংখাই তো মুগ্ধর এমন কথায় ব্যাপক লজ্জা পাচ্ছিল। বলল,
-“দাদা, আমি নৌকা ঠিক করি?”
-“হ্যা হ্যা, আর প্লিজ একটা ছইওয়ালা নৌকা ম্যানেজ করো ভাই, আপু আছে তো।”
-“আচ্ছা আচ্ছা।”
যে সুন্দর সে সুন্দরই। নৌকার গুলুইয়ের উপর ঘোমটা মাথায় বসে থাকা কুচকুচে কালো তিতিরকে মুগ্ধর কাছে অপূর্ব রুপবতী লাগছে। তিতির তাকিয়ে নদীর চারপাশ দেখছে। ওর চোখ দুটো যেন নদীর সৌন্দর্যের তালে তালে তা তা থৈ থৈ করে নাচছে। নদীটা খুব বেশি প্রশস্ত না। তবে খুব কর্মচঞ্চল। নৌকায় নৌকায় মাঝিরা মাছ ধরছে। নদীর পাড়ে পাহাড়ী মহিলারা তাদের নিত্য কাজ করছে। কেউ কেউ কলসি কাখে হেটে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাহাড় থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার খেলায় মেতেছে। পুরো নদীতেই ভেলার মত লম্বা লম্বা কি যেন! দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো ইচ্ছে করে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো কি মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কিন্তু এখন না পরে। এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে।
মুগ্ধ নৌকার মাঝখানে শুয়ে ছিল। নৌকায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার মজাই আলাদা। মাঝিকে বলল,
-“ও মাঝি ভাই তোমার নাম কি?”
-“জ্বী আমার নাম লোকমান।”
-“এই তুমি বাঙালী! বাড়ি কই তোমার?”
-“ময়মনসিংহ।”
-“ও, তা এইখানে যে?”
-“পেট চালানের লাইগা আব্বায় আইসিলো।”
-“ও। বিয়াসাদি কি কইরালছ?”
-“হ, কইরলাছি।”
-“ও যাই হোক, আমরা তিনজনের একজনও বিয়াসাদি করিনাই। সাবধানে নৌকা চালাইয়ো কিন্তু। তোমার যেমন বউ আছে আমাদেরও কিন্তু হবু বউ আছে। ওই যে আপুরে দেখতেসো ওনারও কিন্তু হবু জামাই আছে, তো সবারই এখন জীবনের দাম অনেক। এখন তাড়াতাড়ি চালাও যাতে তিন্দুর পর আস্তে চালাইলেও সময়ের অভাব না পরে। বুঝলা রাত্রে নৌকায় থাকা যাবে না। সন্ধ্যার মধ্যে রেমাক্রি পৌঁছাতে হবে।”
লোকমান হাসতে হাসতে বলল,
-“কুনো চিন্তা কইরেন না বাইজান। এক্কেরে টাইমের মইধ্যে লইয়া যাইবাম।”
মংখাই বলল,
-“দাদা, ও ছোটকাল তেকেই এই সাংগুতে নৌকা চালায়। চিন্তা করিয়েন না। খুব অবিজ্ঞ।”
-“ভাল কথা মনে করসো।”
তারপর মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে ডাকলো,
-“তিতির..”
তিতির বলল,
-“হ্যা বলুন।”
-“আমরা যে নিলগিরি থেকে অনেক নিচে নদী দেখেছিলাম না? এটা কিন্তু সেই নদী, সাঙ্গু। সুন্দর না?”
-“হ্যা, সুন্দর। কিন্তু আমরা তো পাহাড়ি রাস্তায়ই এলাম। নদী তো অনেক নিচে ছিল। এত নিচে কিভাবে এলাম?”
-“কেন খেয়াল করোনি নিলগিরির পর খালি ডাউনহিল ছিল। তারপর থানচি বাজার থেকেও তো ঘাট অনেক নিচে।”
-“ও।”
হঠাৎ মনে পড়লো তিতির ভাত খেতে চেয়েছিল। উঠে বসে মংখাইকে বলল,
-“আমাদের রান্না করতে হবে বুঝলে? নৌকায় সব ব্যবস্থা আছে তো?”
-“জ্বী দাদা, সব ব্যবস্তাই আছে।”
তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“কি রান্না হবে?”
-“ভাত, মুরগি, ডাল, আলুভর্তা। চলবে তো?”
-“দৌড়োবে! আচ্ছা রান্নাটা আমি করি?”
-“তুমি! রান্না করতে পারো?”
-“সব পারিনা। তবে এসব পারি।”
-“কিন্তু তুমি পারবেনা তো। কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতে হবে। করেছো কখনো? স্টোভ সামলানো অনেক ঝামেলার কিন্তু।”
-“না করিনি কখনো।”
-“তাহলে থাক, আমিই করি।”
-“আচ্ছা দুজনে মিলেই করি? আপনি চুলাটা সামলাবেন, আর আমি রান্না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা।”
মংখাই বলল,
-“দাদা, আমিও আছি কিন্তু।”
মুগ্ধ বলল,
-“ও হ্যা হ্যা, মংখাই কিন্তু অনেক ভাল রান্না করে।”
-“দাদা, কুনোদিন রানতে দিননাই তো। নিজেই করিচেন।”
-“তা করেছি। কিন্তু তুমি তো পারো।”
মংখাই আর কথা বাড়ালো না।
নৌকা থানচি ছাড়তেই আস্তে আস্তে জনবসতি কমে যেতে লাগলো। ২০-২৫ মিনিট যেতেই তিতিরের মনে হলো নদীটা গহীন কোনো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভয় পাওয়ারও সময় নেই। রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে।
রান্না করতে গিয়ে তিতির সত্যিই ঝামেলায় পড়লো। একটা ধার ছাড়া বটি যা দিয়ে কিছুই কাটা যাচ্ছেনা। তার উপর আস্ত মুরগি তিতির জীবনে কাটেনি। সব সময় তো মায়ের কেটে রাখা মুরগি রান্না করেছে। এখন কি হবে! তিতির মুরগিটা হাতে নিয়ে অনেক চিন্তা করলো। কোনদিক দিয়ে যে কাটা শুরু করবে তা বুঝতেই পারছেনা। এজন্যই সব কাজ শিখে রাখতে হয়। মাছ মুরগি কাটা শিখতে গেলে বাবা সবসময়ই বলে এসব শিখে তুই কি করবি? তুই কি এসব করবি নাকি? তোকে রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেব। সে কি তোকে দিয়ে মাছ-মাংস কাটাবে? কাজের লোকেরাই তো সব করে দেবে। কিন্তু বাবা কি জানে ট্যুরে গেলে কেউ কাজের লোক নিয়ে যায়না! তাও ভাল জোর করে কয়েকটা রান্না শিখেছিল। ইশ মুরগিটা যদি কাটতে না পারে তো প্রেস্টিজের বারোটা বেজে যাবে। হঠাৎ মুগ্ধ ওর হাত পাতলো। বলল,
-“মুরগিটা আমাকে দাও। দেশী মুরগি তো, অনেক শক্ত। তুমি কাটতে পারবে না।”
তিতির দিয়ে দিল। মুগ্ধ বুঝতে পেরেছে যে ও মুরগি কাটতে পারেনা। তাই সরাসরি বলে লজ্জা না দিয়ে দেশী মুরগির দোহাই দিয়ে নিজে কাটতে নিল। মংখাই বলল,
-“দাদা, আমাকে দেন আমি কেটে দি।”
-“না না তুমি আপুর রান্নায় হেল্প করো। আমার সময় লাগবে না।”
তিতির চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিল। তাতে আলুসেদ্ধও দিয়ে দিল। মংখাই চুলাটা কন্ট্রোল করছে। মুগ্ধ মুরগিটা হাতে নেয়ার পর থেকে তিতির মুগ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে মুরগি কাটে সেটা এখনি শিখে নেবে ও। মুগ্ধ প্রথমে মুরগিটা হাতে নিয়ে পাঁজরার হাড়দুটো আলাদা করে একহাতে গলা আরেক হাতে পাঁজর ধরে টান দিয়ে দুভাগ করে ফেলল। মাগো এই টানটা কি করে দেবে তিতির! এত জোড় আছে নাকি ওর। তারপর ভাবলো সব মেয়েরা পারলে ও অবশ্যই পারবে। তারপর রান, থান আলাদা করে টুকরো করে কেটে নিল। তারপর বুকের মাংসটা কিভাবে কাটলো সেটাও দেখে নিল। এরপর মাথাটা কেটে নিল। তিতিরের মনে হলো মাথা কাটাটা আরো বেশি ডিফিকাল্ট। তারপর দেখলো মুগ্ধ মুরগিটার নাড়িভুঁড়ির মধ্যে থেকে গিলা, কলিজা বের করে আনলো। গিলাটা লম্বালম্বি একটু কেটে আংগুল দিয়ে টেনে টেনে ভেতরের ময়লাটা বের করে ফেলে দিল। এএএহ! এভাবে গিলা পরিস্কার করে। আর ভেতরে এত বিচ্ছিরি ময়লা থাকে! ইয়াখ.. ও আর জীবনে গিলা খাবেনা। সবশেষে মুরগির পা দুটো চুলায় পুড়িয়ে পুড়িয়ে চামড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছিঁড়ছিল মুগ্ধ। পায়েও এত কাহিনী করা লাগে! তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“পা কে খাবে?”
-“কেন খাওনা?”
-“না।”
-“আমি খাই, মংখাই খাও?”
-“জ্বী দাদা, খাই।”
-“হয়ে গেল! তুমি আর পাচ্ছো না।”
একথা বলেই মুগ্ধ হাসলো। তিতিরও হাসলো। তারপর মুরগিটা ধুয়ে এগিয়ে দিল। বলল,
-“নাও এবার রান্না করো।”
-“আপনি এত সুন্দর মুরগি কাটা শিখলেন কোত্থেকে?”
-“কেন মায়ের কাছ থেকে!”
-“ওহ।”
-“মা কি বলতো জানো?”
-“কি?”
-“বলতো, ‘মুগ্ধ মুরগি কাটা শেখ, মাছ কাটা শেখ, রান্না শেখ। তোর জন্য তো রাজকুমারী নিয়ে আসবো। সে যদি না পারে তোকে তো পারতে হবে। তাড়াতাড়ি শিখে নে।’ আর জানো আমিও দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে আগ্রহ নিয়ে শিখতাম। যাতে বউকে এসব করে দিতে পারি.. হা হা হা।”
তিতির ওর বাবার কথাগুলো আর মুগ্ধর মায়ের কথাগুলো মিলিয়ে নিল। এটা কি শুধুই কো-ইন্সিডেন্স নাকি কোনো ইশারা! খুশি যেন উপচে পড়ছিল তিতিতের। তিতির খুব যত্ন করে ভাত, আলুভর্তা, ডাল করে ফেললো। মুগ্ধও হেল্প করলো। কিন্তু প্রব্লেম হলো মুরগি রান্নার সময়। কিছুতেই তিতির মশলা বাটতে পারছিলনা। জীবনে প্রথম পাটায় হাত দিয়েছে। বাটছে ঠিকই কিন্তু কোনো কিছু আর এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছেনা। মুগ্ধ তাকিয়ে ছিল তাই তিতির খুব লজ্জা পেয়ে গেল। মুগ্ধ নিশ্চই এখন এটাও এর হাত থেকে নিয়ে নিজেই বেটে দেবে! হায় খোদা! কেন ও এসব পারেনা। মুগ্ধ বলল,
-“কখনো পাটায় হাতও দাওনি বোধহয়?”
-“না।”
-“বুঝেছি। আচ্ছা রেখে দাও। আমি ব্যবস্থা করছি।”
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-“আপনি বাটবেন এখন?”
মুগ্ধ বলল,
-“আরেনা। মা আবার এটা শেখায়নি। বলেছে বউকে ব্লেন্ডার কিনে দিতে। হা হা হা।”
তিতিরও হেসে দিল। মুগ্ধ আদা রসুন গুলো নিয়ে বটি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটলো। তিতির বলল,
-“এগুলো কি করবেন?”
-“এভাবেই দেব মুরগিতে।”
-“আস্ত আস্ত?”
-“আস্ত কই? দেখোনা কুচি কুচি।”
-“কেমন যে লাগবে!”
-“আমি নিজের মত রান্না করি। খাওয়ার সময়েই দেখো কেমন লাগে!”
মুগ্ধ নিজ হাতে রান্না করলো মুরগিটা।
সত্যি মুরগিটা কতটা যে মজা হয়েছিল তা খাওয়ার সময় টের পেল সবাই। নৌকা একটা তীরে ভিড়িয়ে ওরা খেয়ে নিয়েছিল। খাওয়া শেষে মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, তুমি এখন ছইয়ের মধ্যে চলে যাও, রেস্ট নাও। আমি না বললে বের হয়ো না।”
-“আচ্ছা।”
একথা বলেই ভেতরে ঢুকে গেল তিতির। মুগ্ধ ছইয়ের পর্দা টেনে দিল। তারপর ছইয়ে হেলান দিয় বাইরে বসে রইলো। হঠাৎ ভেতরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তিতির ঘোমটা ফেলে ছোট একটা আয়না হাতে নিয়ে নিজের মুখ ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখছে। মুগ্ধ আস্তে করে পর্দাটা সড়িয়ে গান ধরলো,
“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি..
কালো তারে বলে গায়ের লোক।
মেঘলা দিনে.. দেখেছিলেম মাঠে,
কালো মেয়ের কালো হরিন চোখ!
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে..
মুক্ত বেনী পিঠের ওপর লটে।
কালো!!!
তা সে যত কালোই হোক
দেখেছি তার কালো হরিন চোখ!
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।”
এটুকু গেয়েই মুগ্ধ আবার পর্দা টেনে দিল। তিতিরের এই প্রথম আফসোস হলো, “ইশ কালো কেন হলাম না।”
থানচির পর তিন্দুতে এসে কিছু জনবসতি দেখা গেল। কিন্তু সেটা খুবই কম। ১৫/২০ ঘরের বেশি হবেনা। এখানটায় প্রচুর স্রোত। ওদেরকে নেমে নদীর তীর ধরে হাটতে হলো। আর লোকমান, মংখাই মিলে নৌকায় দড়ি বেধে টেনে টেনে স্রোতের অংশটা পার করলো। তারপর ওরা আবার নৌকায় উঠলো। কিছুদূর পর আবার সেই স্রোত। আবার নামলো, আবার হাটলো। এভাবে অনেকবারই নামতে হলো। হাটতে হাটতে অনেক গল্পই হয়েছিল। তার মধ্যেই একবার তিতির বলল,
-“সাফি ভাইয়াদের হারিয়ে ফেলে ভালই হয়েছে বলুন। নাহলে এত এত এডভেঞ্চারের কিছুই হতো না। যদিও কাল ভয় পেয়েছিলাম বিপদে পড়ে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যারা দলেই আছে তারা তো এরকম পরিস্তিতিতে পড়েনি, তারা খুব মিস করলো।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“হাসছেন যে?”
-“আমরা কিন্তু এখনো বিপদ থেকে বের হতে পারিনি।”
-“নাহলে না পেরেছি, আমার আর ভয় করছে না। আপনি আছেন তো!”
কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা চলে এল বড়পাথর। এলাকার নামই বড়পাথর। এখানে কোন জনবসতি নেই। আছে শুধু বড় বড় পাথর। তাও আবার পানির মধ্যে। একতলা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু বিশাল বিশাল পাথর। যার কিছু অংশ পানির নিচে, কিছু অংশ পানির উপরে। ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন সাইজের পাথর। তার মধ্য দিয়েই নৌকা চালাচ্ছে লোকমান। সোজা তো আর চালানো যায়না। এঁকেবেঁকে প্রকান্ড পাথর গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। পানির নিচে আবার আছে ডুবোপাথর। নৌকা যদি কোনক্রমে একটা ডুবোপাথরের সাথে ধাক্কা লাগে তাহলে পুরো নৌকাই উল্টেপাল্টে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিতিরের বোধহয় এসব দেখে ভয় করছিল। কিন্তু কিছু বলছিল না। ছইয়ের ভেতর থেকেই এসব দেখছিল। মুগ্ধ ওর ভয় কাটানোর জন্য ওর সাথে টুকটাক গল্প করছিল।
-“জানো তিতির, এখানকার স্থানীয় মানুষেরা মানে পাহাড়ীরা এই বড়পাথরের সবচেয়ে বড় পাথরটাকে পুজো করে।”
-“কেন?”
-“সবচেয়ে বড় পাথরটাকে ওরা রাজা বলে মানে। ওদের বিশ্বাস বহুকাল আগে তিন্দু রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে সাঙ্গু নদীর এই যায়গায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর তারা সবাই পাথর হয়ে যায়। তাই স্থানীয়রা এটাকে ধর্মীয় স্থান বলে মানে, পুজো দেয়।”
রেমাক্রির দিকে যেতেই মুগ্ধ ছইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,
-“লোকমান ভাই আমাদের একটু রেমাক্রি ফলসের দিকে নিয়ে চলো। তুমি অনেক তাড়াতাড়ি আর সেফলি এনেছো, আলহামদুলিল্লাহ। এখনো হাতে সময় আছে। এত সুন্দর একটা যায়গা তোমার এই আপুর মিস করা কি ঠিক হবে? দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে তো, ওর হাসবেন্ড কেমন না কেমন হয় বলা তো যায়না বলো? সে যদি যদি ওকে নিয়ে এখানে না আসে?”
লোকমান হেসে বলল,
-“আচ্ছা ভাই।”
তিতির মনে মনে বলল, ‘আপনিই আমার হাসবেন্ড হয়ে যাননা।’ কিন্তু মুখে বলল,
-“রেমাক্রি ফলস আবার কোনটা?”
মুগ্ধ বলল,
-“এই যে সাংগু নদী, এটা রেমাক্রি খালের সাথে মিশে শেষ হয়ে গেছে। রেমাক্রি ফলস হলো রেমাক্রি খালের উৎপত্তিস্থল। ছোট ছোট পাহাড়ের কারনে ওখানে একটা ন্যাচারাল জলপ্রপাত তৈরী হয়েছে। অসম্ভব সুন্দর একটা জলপ্রপাত। রেমাক্রি যাওয়ার পথে পড়েনা। একটু ঘুরে যেতে হয় তাই অনেকেই ওখানে যায়না। ইভেন অনেকে জানেও না।”
-“ও।”
রেমাক্রি ফলসের দিকে যেতে যেতে দূর থেকেই যখন তিতির জলপ্রপাতটা দেখতে পেল তখন ও নিজের দুই গালে দুই হাত দিয়ে চোখগুলো বড় বড় করে অজান্তেই বলল,
-“ওয়াও। এটা কি? আমি কি সত্যি দেখছি, নাকি স্বপ্ন।”
মুগ্ধ মিটিমিটি হাসছিল আর মনে মনে বলছিল, ‘আমি জানি তুমি তোমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর যায়গাগুলোর একটাতে যেতে চলেছো। তুমি খুশি হয়েছো। জানি তুমি আরো অনেক অনেক বেশি খুশি হবে যখন তুমি জলপ্রপাতের বাঁধনহারা পানিতে পা রাখবে। তুমি যেমন জলপ্রপাতটায় যাওয়ার অপেক্ষায় আছো, আমিও তেমন তোমার ওই সময়ের খুশিটা দেখার অপেক্ষায় আছি। হ্যা, আজ আমি আর জলপ্রপাতটা দেখবো না, তোমার খুশি দেখবো.. তোমাকে দেখবো। তুমি প্রকৃতির চেয়ে কোনো অংশে কম নও।’
নৌকা রেমাক্রি ফলসের যত কাছে যাচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে। তিতির বিস্ময়ে কি করবে বুঝতে পারছিলনা। সেটা বোঝা গেল যখন ও নৌকায় বসা থেকে উঠে এসে দুহাতে মুগ্ধর বাহু জড়িয়ে ধরে নৌকার মধ্যেই লাফাতে শুরু করে দিল। আর বলল,
-“উফ, বলেন না কখন যাব? আমি কিন্তু নামবো।”
মুগ্ধও এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছিল তিতিরের আনন্দ আর উচ্ছলতা দেখে। এ যেন অন্য তিতির। বলল,
-“হুম নামবে।”
তিতির বলল,
-“লোকমান ভাই তাড়াতাড়ি চালান না।”
যখন ওরা রেমাক্রি ফলসে পৌঁছলো তখন পড়ন্ত বিকেলের আলো যেন জলপ্রপাতে একটা মায়াবী সৌন্দর্য যোগ করেছিল। হয়তো প্রকৃতির এই আয়োজন প্রথমবার তিতিরকে মুগ্ধ করার জন্যই। প্রথমে মুগ্ধ নামলো রেমাক্রি ফলসের পানিতে। তারপর তিতিরের হাত ধরে ওকে নামালো। তিতির স্যান্ডেল খুলে নামছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ওটা পড়ে থাকো। পাথর অনেল পিচ্ছিল আর অনেক ধার!”
তিতির তাই করলো। বিশাল জলপ্রপাত তবে প্রশস্তে, উচ্চতায় খুবই সামান্য। প্রায় ৮/৯ টি ধাপ একেবারে সিড়ির মত। কিন্তু একেকটা ধাপে অনেক যায়গা। একেকটা ধাপ যে কতটা ধারালো তা এর উপর থেকে পড়া পানির আকার দেখলেই বোঝা যায়। শেষ ধাপের পরই রেমাক্রি খাল। তিতিরকে হাত ধরে ধরে প্রত্যেকটা ধাপে নিয়ে গেল মুগ্ধ। তিতির পথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির উপর দিয়ে হাটছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। একেবারে উপরের ধাপে সবচেয়ে বেশি যায়গা। তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধ সেখানে চলে গেল। সেখানে পানি ছিল অন্য সব ধাপের চেয়ে বেশি। এত পানি পায়ের নিচে পেয়ে তিতির লাফাতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“এত লাফিও না। পা কেটে যাবে।”
জলপ্রপাতের পানি পড়ার শব্দে শুনতে পেল না তিতির। যদিও হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তবু চিৎকার করে বলল তিতির,
-“কি বলছেন? শুনতে পাচ্ছিনা.. জোড়ে বলুন, চিৎকার করে বলুন। আমার মত করে।”
তারপর আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মুগ্ধ হেসে তিতিরের মতই চিৎকার করে কথাটা আবার বলল। তিতির আবার চিৎকার করে উত্তর দিল,
-“যাক, পা কেটে যাক, সময় কেটে যাক। সারা জীবন কেটে যাক। আমি এখানেই থাকবো আর লাফাবো।”
তারপর আবার খিলখিলিয়ে হাসলো। আবার লাফাতে লাগলো। মুগ্ধ কিছু বলল না। শুধু শক্ত করে তিতিরের হাত ধরে রাখলো। পানির যেই স্রোত। ও ধরে না থাকলে এতক্ষনে তিতির রেমাক্রি খালে থাকতো। লাফাতে লাফাতে তিতির হঠাৎ পড়ে গেল। পড়ে যেয়ে ওর হাসি আরো বেড়ে গেল। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলো। ও নিজে তো ওঠার চেষ্টা করলোই না বরং মুগ্ধর হাত ধরে টান দিয়ে ওকেও ফেলে দিল। মুগ্ধ পড়ে যেতেই তিতির আরো জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো। আচমকা পড়ে যাওয়ায় মুগ্ধ ব্যালেন্স না রাখতে পেরে পানির স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছিল। আর তিতিরের তো কোন ব্যালেন্স ছিলই না। দুজনেই ভেসে ভেসে যাচ্ছে। তিতির খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু মুগ্ধ ভয় পাচ্ছিল। কি হবে এখান থেকে প্রথম ধাপে পড়লেই তো একে একে প্রত্যেকটা ধাপে পড়বে। তারপর সোজা উপড়ে! কি করবে! পা হাতড়ে খুজছিল, যদি কিছু একটা পাওয়া যায়। এখানে তো কত উঁচু নিচু পাথর আছে। যদি একটা উঁচু পাথরে পা টা আটকে যেত! তাহলে দুটো জীবন বেঁচে যেত!
একটা পাথর না হলেও একটা ছোট গর্তে পা আটকাতে পারলো মুগ্ধ। তিতির তখনও খিলখিলিয়ে চলেছে। মুগ্ধ একটা হাতে ধরে রাখতে পারছিলনা ওকে। তাই দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের কাছে না এনে নিজেই কাছে চলে গেল। ওকে কাছে আনতে গেলে হয়তো পাথরের ঘষায় ও আঘাত পেতে পারে। পানির স্রোতে তিতির মুগ্ধর বুকের মাঝে এসে ধাক্কা খেল। তাতেও হাসি। খুশিতে মেয়েটার মাথার তার একটা ছিড়ে গেছে বোধহয়।
ওদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো মংখাই আর লোকমান।
যখন ওরা রেমাক্রি পৌঁছল, সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। লাল আলোর আভায় ভরে গেছে চারপাশ। যায়গাটা বেশ পছন্দ হলো তিতিরের। থানচি ছিল সাধারন মফস্বলের বাজার এলাকার মত, তিতিরের একটুও পছন্দ হয়নি। কিন্তু এখানে নৌকার ঘাট থেকেই রেমাক্রি গ্রাম শুরু। ৩০/৪০ পাহাড়ী পরিবারের বসতি হবে। পুরো গ্রামটাই পাহড়ের উপর। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রামের একপ্রান্তে দেখা গেল একটা কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ পার করে ওপাশে ছোট্ট একটা পাহাড়। মুগ্ধ বলল,
-“ব্রিজের ওপাশে পাহাড়টার উপর যে বড় ঘর দেখতে পাচ্ছো সেটাই রেমাক্রির একমাত্র গেস্ট হাউজ। পুরোটাই কাঠের তৈরী, ইভেন ফ্লোরও কাঠের।”
-“ও। আচ্ছা, একটা ঘর এত বড় কেন?”
-“আরে না না বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ঘর। কিন্তু ওর ভেতরে কয়েকটা ঘর আছে।”
কাঠের ব্রিজটা পার হয়ে গেস্ট হাউজে গিয়েই মুগ্ধর আক্কেলগুড়ুম! রেমাক্রি গেস্ট হাউজ পুরোটাই খালি। ২৬ জনের কোন দলই আজ আসেনি। সাফিরা আজ ভোরে রওনা দিল অথচ এখনো পৌঁছতে পারেনি! কি হলো! এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর ডুবো পাথরের জন্য নদীতে নৌকা চলা একেবারেই নিষিদ্ধ।
গেস্ট হাউজটা আসলে একটা কটেজের মত। চারদিকে ঘিরে আছে একটা বারান্দা। কটেজে মোট ৪ টি ঘর। প্রত্যেকটি ঘরে দুটো করে বিছানা। আর দুই বিছানার মাঝেও অনেক যায়গা। ফ্লোরিং করার প্ল্যান ছিল বাকিদের। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। কোথায় চলে গেল সাফিরা। এতজন একসাথে থাকলে তো কোথাও কোন বিপদ হওয়ার কথা না। ওদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে মুগ্ধর। ৪ টা ঘরের একটাতে তিতির, একটাতে মুগ্ধ। আরেকটাতে যায়গা হলো মংখাই আর লোকমানের। যে যার ঘরে চলে গেল। মুগ্ধ ভেজা শার্টটা খুলে ফেলল। নদীতে গোসল করতে যাবে। গামছা আর টাউজার কাধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হলো। হঠাৎ পিছন থেকে সেই মিষ্টি ডাক,
-“এইযে শুনছেন?”
মুগ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-“হুম শুনছি তো, বলো।”
তিতির হেসে বলল,
-“গোসলের কি ব্যবস্থা এখানে?”
-“নদীতে গোসল করতে হবে।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“নদীতে!”
-“কেন সাঁতার জানোনা?”
-“তা জানি।”
-“তাহলে?”
-“মানে খোলা যায়গায় সবার সামনে গোসল করতে হবে?”
-“খোলা যায়গায় তবে সবার সামনে নয়। কারন, এই গেস্ট হাউজের পাশ দিয়ে নদীতে নেমে পড়বে। গ্রামের কেউ তো আর এই সাইড টাতে আসবে না। ওইযে টয়লেট টা দেখতে পাচ্ছো ওটা বড় ভাগ্যের জোড়ে পেয়েছো। আমি আগের বার যখন এসেছিলাম তখন ওটা ছিলনা।”
-“ও। তাহলে কি করবো?”
-“গোসল করে আর কি করবে? গোসল তো রেমাক্রি ফলসে হয়েই গেছে।”
-“না, ওখানে তো শুধু ভেজা হলো।”
-“বাই দ্যা ওয়ে, সকালে না গোসল করে এলে?”
-“হুম, কিন্তু এই কালি গায়ে নিয়ে ঘুমাবো? স্কিন ভারী ভারী লাগছে। গোসল না করে বাঁচবো না। ”
-“আচ্ছা, তাহলে যাও করে এসো। কেউ যাবেনা ওদিকে। আর গোসল করে চলে আসবে। ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করবে।”
-“আপনিও চলুন না আমার সাথে।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“এই প্রথম শুনলাম কোনো মেয়ে গোসল করতে যাওয়ার সময় অপরিচিত কোনো পুরুষ মানুষকে সাথে ডাকে।”
-“উফ আপনি না একটা যাচ্ছেতাই।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“আমি তো বলেছি শুধু আপনি পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন একটু। অপরিচিত যায়গা, তার উপর আলো কমে আসছে। আমার একা যেতে ভয় করছে।”
-“তাহলে বলছো যে মেয়েরা ছেলেদের উপর মাঝে মাঝে ডিপেন্ডেন্ট হয়?”
তিতির কপাল কুঁচকে বিরক্ত চোখে তাকালো। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ওহ সরি। তোমাকে তো আবার খোঁটা দেয়া যাবেনা। চলো চলো।”
-“আপনার কাধে দেখি কাপড়! আপনিও কি গোসলে যাচ্ছিলেন?”
-“হুম!”
-“ও। তাহলে তো হলোই।”
তিতির নদীর পাড়ে গিয়েই অবাক হয়ে গেল। এদিকটায় তীরটা একটু অন্যরকম। সিবীচে যেমন বালুর তীর থাকে এখানে ঠিক সেরকমই কিন্তু পাথরের তীর! অসংখ্য ছোট ছোট পাথর এখানে। পানিতে নেমেও পায়ের নিচে পাথর ছাড়া আর কিছু পেলনা। যায়গাটা কি যে ভাল লাগছিল তিতিরের! তিতির যখন গোসল করছিল মুগ্ধ তখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিল। কাজলের কালি উঠাতে বেশ কসরত করতে হলো তিতিরের। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তুলল। পায়ের কয়েকটা যায়গা আর ঘাড়ের পেছনের দিকটায় সামান্য জলছিল। জলপ্রপাতের পাথরের ধারে কেটে গেছে কিনা কে জানে! গেলে যাক। কি আর করা.. তিতির গোসল শেষে সেই শালটা গায়ে জড়িয়েই উঠলো। তারপর বলল,
-“তাড়াতাড়ি গোসল করতে যান। আমি কি দাঁড়াবো?”
-“পাগল! তুমি যাও চেঞ্জ করে নাও গিয়ে।”
তিতির চলে যাচ্ছিল। মুগ্ধ ডাক দিল,
-“শোনো..”
-“হ্যা বলুন।”
-“আমার মোবাইল আর ওয়ালেট টা একটু নিয়ে যাবে? তুমি না এলে পাড়েই রেখে নামতাম। কেউ তো আর আসবে না। তারপরেও তুমি যখন যাচ্ছোই তখন নিয়ে যাও।”
-“হ্যা, দিন।”
মোবাইল ওয়ালেট পকেট থেকে বের করে দিল। ওগুলো নিয়ে তিতির হাটা ধরলো। মুগ্ধ বলল,
-“দাড়াও দাড়াও..”
মুগ্ধ পকেটে কি যেন খুঁজছে। তারপর তিতির দেখলো মুগ্ধ কতগুলো ভেজা টাকা বের করলো। তিতির বলল,
-“রেমাক্রি ফলসে নামার সময় আপনি না মোবাইল ওয়ালেট সব মংখাই এর কাছে রেখে গিয়েছিলেন? তাহলে এগুলো ভিজলো কি করে?”
-“হ্যা, কিন্তু এই টাকাগুলো পকেটে ছিল খেয়াল করিনি।”
-“ও। ইশ কিভাবে আপনাকে ফেলে দিয়েছিলাম! ব্যাথা পেয়েছিলেন?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“নাহ, তুমি যাও। এ বিষয়ে পরে কথা হবে।”
তিতির চলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে ভাবলো, ‘এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!’ এবার নিশ্চিন্তে “প্যারা” মেয়েটার মেসেজ পড়া যাবে। কত বড় সাহস মেয়েটার! মুগ্ধকে ওসব মেসেজ পাঠায়!
তিতির যত দ্রুত সম্ভব গা মুছে চেঞ্জ করে নিল। তারপর মেসেজ পড়া শুরু করলো। যেখানে রেখেছিল সেখান থেকেই শুরু করলো,
Mugdho: Biye to 100 miles dure.. tor moto behayar loge ami sex o korina.
Pera: Meyeder ke ektu to respect korbi mugdho!
Mugdho: Nijer somman nijeke dhore rakhte hoy. tui rakhte parish nai. prostitute der respect kori kintu toke na. cz ora nijer shorir sell kore r tui free te bilash.
Pera: Cox’s Bazar er ghotonar jonno I’m really sry.. Shotti amr matha thik chilo na. Maf kore de na, jibon thakte ei dhoroner kono kaj r ami korbo na.
তিতির বসে পড়লো! মুগ্ধ এই মেয়েটাকে নিয়ে কক্সবাজার গেছে! এই মেয়েটা কি ওর কোনো এক্স? কষ্ট হচ্ছিল! কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছিল তিতিরের। ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল তিতির। কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো বাংলা সিনেমার মত অর্ধেক টা পড়ে রিয়াক্ট করাটা কি ঠিক হবে? না পুরোটাই পড়বে তিতির। হয়তো ও যা ভাবছে তেমন কিছুনা। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো,
Mugdho: Campus er je tour e tui jabi oi tour e ami r jibon thakte jabo na..
Pera: Ami shotti toke valobashi re.. amr ekta second jayna toke na vebe!
Mugdho: Allah’r waste r msg dish na. onk koshte etokkhon natha thanda rakhsi. r partesi na.
Pera: Msg dibo na to ki korbo? Etobar call dilam ekbar to dhorli na!
এরপর মুগ্ধ কোন রিপ্লাই দেয়নি। বোধহয় ফোন করেছিল কারন অনেক্ষণ পর মেয়েটাই আবার আরেকটা মেসেজ দিয়েছিল,
Pera: Tui etota kharap bhv korbi vabte parini.
আর কোনো মেসেজ নেই। তিতিরের আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছিল। আহ আহ কি শান্তি!
চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। বারান্দায় একটা বাল্ব জ্বালানো ছিল। মুগ্ধ কটেজের বারান্দায় বসে লাল রঙের ছোট ছোট কিছু খাচ্ছিল। লোকমান আর মংখাই বাজারে গেছিল। দরজা খোলার শব্দে মুগ্ধ তাকাতেই দেখতে পেল ভেজা কাপড় হাতে বেড়িয়ে এল তিতির। ওর পড়নে সাদা লং স্কার্ট আর নীল টপস। বাল্বের হালকা আলোয় মুগ্ধ দেখছিল তিতিরকে। এই রঙ দুটো বেশ মানিয়েছে তিতিরকে। বারান্দার একপাশে দড়ি টানানো ছিল। সেটাতে ভেজা কাপড় মেলার জন্য হাত উঠাতেই টপস টা উঠে গেল, আর তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর নাভি দেখা গেল। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল মুগ্ধ। ওর সারা শরীরে যেন ইলেক্ট্রিক শক লাগলো! কক্সবাজার ট্যুরে ইকরা যখন ওকে ইমপ্রেস করার জন্য ওর সামনে এসে কাপড় খুলে ফেলেছিল তখনও তো এরকম কোনো ফিলিং হয়নি। তিতির অবশ্য সুন্দরী কিন্তু ইকরাও তো তিতিরের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলনা। তবু তো ইকরার সৌন্দর্য ওকে টানেনি উল্টো অনীহা এসেছিল। তাহলে এখন ওর এরকম কেন লাগছে। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো ভালবাসা কি সত্যিই হয়ে গেল!
হঠাৎ ঘোর কাটলো সেই মিষ্টি স্বরে,
-“বসবো?”
-“হ্যা হ্যা বোসো।”
তিতির মুগ্ধর উল্টোপাশে মুগ্ধর দিকে ফিরে বসলো। মুগ্ধ তিরিরের দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“খাবে?”
-“কি এগুলো?”
-“ডুমুর! পাহাডী ডুমুর, একদম পাকা। খেয়ে দেখো অনেক মজা।”
তিতির একটা ডুমুর হাতে নিয়ে বলল,
-“এটা কিভাবে খায়?”
মুগ্ধ দেখিয়ে দিল প্রথমে ডুমুরকে দুহাতের আঙুল দিয়ে টেনে দুভাগ করতে হয়। তারপর একেকটা ভাগ উল্টে চুষে চুষে খেতে হয়। তারপর তিতির ডুমুর নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তিতিরের দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ আর চোখ ফেরাতে পারছিল না। তিতির বোধহয় ভাল করে চুল মুছতে পারেনা। তাই গোসলের পর ওর চুল থেকে টপটপ করে ফোটা ফোটা পানি পড়তে থাকে। তখনও তাই হচ্ছিল। তিতিরের বড় বড় চোখগুলো ছিল ডুমুরের দিকে। আর ওর আলতো আলতো গোলাপি ঠোঁট দিয়ে চুষে চুষে খাচ্ছিল সেই ডুমুর! সেই পরিবেশে সেই দৃশ্য যে কতটা ভয়ঙ্কর, মারাত্মক আর নেশাতুর হতে পারে তা যে না দেখেছে সে কোনদিনও বুঝবে না।
নাহ এটেনশন অন্যদিকে নিতে হবে! কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? তার চেয়ে অন্তত এই ডুমুর খাওয়াটা বন্ধ করা যাক। মুগ্ধ বলল,
-“বেশি খেয়োনা। পেট ব্যাথা করতে পারে।”
-“উম্মম্মম্মম্ম! অস্থির ফল একটা। এত মজা কেন? পেটে ব্যাথা হলে হবে। তাও আমি খাবো!”
-“নাহ। ঢাকা যাওয়ার সময় কিনে দিব। বাসায় গিয়ে খেয়ো।”
ঝুড়িটা সড়িয়ে রাখলো মুগ্ধ। তারপর বলল,
-“কদিন আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো। এবার একটু সেবা করো তো।”
-“সেবা! কি সেবা?”
-“আমার পিঠে খুব জ্বলছে। বোধহয় ছিলে টিলে গেছে, একটু স্যাভলন লাগিয়ে দাও। মংখাই কে দিয়ে লাগাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সেই যে বাজারে পাঠালাম আর তো খবর নেই।”
-“আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। কোনো প্রব্লেম নেই।”
-“আচ্ছা, বোসো আমি স্যাভলন ক্রিমটা নিয়ে আসছি।”
তিতির এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আপনি চুপ করে বসুন। আমি নিয়ে আসছি। স্যাভলন আমার কাছেও আছে।”
তারপর চলে গেল ওর ঘরে। জীবনেও এটুকুতে স্যাভলন লাগায়নি মুগ্ধ। কিন্তু আজ লাগাতে চাইছে। ব্যাথা কমানোর জন্য না। তিতিরের একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্য!
তিতির স্যাভলন এর সাথে মুগ্ধর ফোন আর ওয়ালেটও নিয়ে আসলো। বলল,
-“এই নিন ফোন আর ওয়ালেট! ভেজা টাকাগুলো টেবিলের উপর শুকোতে দিয়েছি।”
মুগ্ধ ওগুলো নিল তিতিরের হাত থেকে। তিতির ওর পাশে বসে বলল,
-“ওদিকে ঘুরুন আর শার্টটা খুলুন।”
মুগ্ধ শার্টটা খুলে ঘুরে বসতেই তিতির ওর পিঠে হাত রেখে আঁৎকে উঠলো,
-“ওমাগো! পুরো পিঠ ছিলে গেছে! লাল হয়ে গেছে। ইশ এটা রেমাক্রি ফলসে আমার ওই বোকামির জন্য হয়েছে না?”
-“সুন্দরীর হাতের ছোঁয়া দেখছি স্যাভলনের চেয়েও বেশি কাজে দিচ্ছে! হাতটা সরিওনা কিন্তু।”
একথাটা মুগ্ধ শুধু মজা করে বলেনি। মন থেকে বলেছে। তিতির ফাজলামো ভেবে ওর পিঠে আলতো করে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলল,
-“আপনি পারেনও।”
স্যাভলন লাগানো শেষ হতেই মুগ্ধ আবার ঘুরে বসলো। আর সাথে সাথে দেখতে পেল রিতিরের বাহুতে আর ঘাড়েও ছিলে গেছে। মুগ্ধ বলল,
-“এই পাক্নি! তোমার ঘাড়ে আর হাতেরও তো একই অবস্থা!”
-“তাই নাকি? এজন্যই বোধহয় জ্বলছিল গোসলের সময়!”
-“ওখানে স্যাভলন লাগাও।”
তিতির বাহুর ক্ষততে নিজেই স্যাভলন ক্রিম লাগালো। তারপর স্যাভলনের টিউবটা মুগ্ধর দিকে এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল,
-“নিন এবার আপনি একটু সেবা করুন।”
মুগ্ধ ওটা তিতিরের হাত থেকে নিতেই তিতির সব চুলগুলোকে ভাল করে সরিয়ে নিল একপাশে। তারপর ক্ষতর সাইডটা মুগ্ধর দিকে ধরলো। মেয়েটা কি পাগল! এমনটা কেউ করে? ও কি জানে মুগ্ধর ইচ্ছে করছিল ওই ভেজা চুল সরানো ঘাড়ে একটা গাঢ় চুমু খেতে! কিন্তু মুগ্ধর বিবেক খুব সহজেই সে লোভ সংবরন করলো। অঙুলের মাথায় স্যাভলন নিয়ে তা তিতিরের ঘাড়ে লাগিয়ে দিল। তিতির আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কালও তো ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল মুগ্ধকে। কিন্তু তখন তো এমন অনুভূতি হয়নি! খুব স্বাভাবিক লেগেছিল তিতিরের। আর আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কি অমূল্য সম্পদ যেন পেল। মনে মনে বলল, ‘কোন পুরুষের স্পর্শ আমি আজও লাগতে দিইনি আমার শরীরে। আপনিই প্রথম। আমি জানতাম আপনার স্পর্শ এতটাই মধুর হবে। আমি এ স্পর্শ সারাজীবনের জন্য চাই। ভাগ্যিস ঘাড়ে আঘাতটা পেয়েছিলাম।’
এর মধ্যেই মংখাই আর লোকমান চলে এলো। মংখাই বলল,
-“দাদা, হাঁস খুঁজতে খুঁজতে দেরী হয়ে গেল।”
কথা শেষ করে তিতরের দিকে তাকিয়েই মংখাই চমকে উঠলো,
-“আপু না কালা ছিলো?”
তিতির হেসে দিল। মুগ্ধও হেসে বলল,
-“ওইটা ছিল, প্রোটেকশন! বেশী রূপবতী মেয়েদের নিয়ে এই হলো প্রব্লেম। বুজলে মংখাই?”
-“জ্বী দাদা, বুজছি।”
তিতির লজ্জায় কি বলবে বুঝতে পারছিলনা। কথা ঘুড়িয়ে বলল,
-“আচ্ছা হাঁস কেন আনালেন?”
-“বার-বি-কিউ করবো। কাল মিস করেছিলাম মনে নেই?”
-“আপনার এত এনার্জি? এখন রান্না করবেন? কেন রেমাক্রি বাজারে না দেখলাম কত দোকান? ওখান থেকে কি খাওয়া যেত না?”
-“হ্যা, আমার এনার্জি একটু বেশি।”
গেস্ট হাউজের পাশেই আগুন জ্বালিয়ে বার-বি-কিউ এর ব্যবস্থা করেছে ওরা। হাঁস বার-বি-কিউ করতে করতে মুগ্ধ বলল,
-“এনার্জি কিন্তু তোমারও কোনো অংশে নেহাৎ কম না। এতদূর এসে পড়লে এখনো তোমার চেহারায় টায়ার্ডের ছাপ পড়েনি। এখনো কতটা প্রানোচ্ছল! ম্যাক্সিমাম মেয়েরা এই পর্যন্ত এসে হাল ছেড়ে দেয় আর মাফাখুম যাবেনা।”
তিতির হাসলো শুধু কিছু বলল না।
হাঁস বার-বি-কিউ টা এত টেস্টি হয়েছে! তিতির কখনো এত মজার বার-বি-কিউ খায়নি! খাওয়ার পর পরই সবাই শুয়ে পড়েছে।
মুগ্ধর ঘুম পাচ্ছিলনা। বার বার তিতিরের সেই ভেজা চুলের মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের পাতায়। কি অদ্ভুত! কখনো কোনো মেয়ের জন্য তো ও এতকিছু করেনি। কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা ফিলও করেনি ও। পাশের রুমেই আছে অথচ ওর জন্য কি অস্থিরতা! বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখলে হয়তো এ অস্থিরতা কমবে। ও কি তিতিরকে প্রোপোজ করবে নাকি আরেকটু টাইম নেবে! মাত্র দুদিনের পরিচয়ে এতো সিরয়াস একটা ডিসিশান নিয়ে নেবে! আগের সম্পর্কগুলোর মত কোনো ভুল সম্পর্কে আর জড়াতে চায়না ও। কারন এখন আর সময় নেই, মা ইমিডিয়েটলি ওর বিয়ে দিতে চান?
পাশের ঘরে কুম্ভকর্ণ তিতিরেরও কিনা ঘুম পাচ্ছিল না! ও খালি কাল থেকে মুগ্ধর সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা ভাবছিল। ইশ কাল রাতে এমন সময় ও আর মুগ্ধ পাশাপাশি শুয়ে ছিল। আর আজ দুজন পুরো দুঘরে! এটা কোনো কথা হলো! আচ্ছা ও কি করবে? ও কি মুগ্ধকে বলবে ওর ভালবাসার কথা? নাকি মুগ্ধর বলার জন্য অপেক্ষা করবে? মুগ্ধর ভেতর যদি ভালবাসা না জাগে মুগ্ধ কেন বলবে! ফোনের ওই প্যারা মেয়েটা প্রোপোজ করেছিল বলেই তো মুগ্ধ ওর উপর বিরক্ত। বেহায়া ভাবে। ও ভালবাসার কথা বললে যদি ওকেও বেহায়া ভাবে! ঘরের ভেতর পায়চারী করছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। প্রায় সাথে সাথেই মুগ্ধর গলা,
-“এই তিতির?”
তিতির দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। বলল,
-“কিছু বলবেন?”
-“ঘুমাওনি দেখলাম। মানে পায়ের আওয়াজ পেলাম। আমারও ঘুম আসছেনা। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে একটু বারান্দায় বসি?”
-“গান শোনাবেন?”
-“সিওর!”
তিতির বারান্দায় এসে বসলো। মুগ্ধ বলল,
-“দেখেছো পাহাড়ের পূর্নিমা কত অসাধারণ!”
-“হ্যা এত সুন্দর পূর্নিমা আমি আগে কখনো দেখিনি। কাল তো জঙ্গলে এত ভাল দেখাও যায়নি। তাছাড়া এই পুরো যায়গাটাই অসাধারণ। বান্দরবান আসার পর থেকে যতগুলো যায়গায় গিয়েছি তার মধ্যে এটা বেস্ট।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আর নিলগিরি?”
-“দুটোর তুলনা চলেনা। দুটোই দুটোর মত সুন্দর।”
-“এখানে আসতে আসতে তো প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছিল। আসল সৌন্দর্য দেখতে আলো লাগবে। কাল সকালে দেখো, তখন বুঝবে কি সুন্দর যায়গা!”
-“তা নাহয় দেখবো কিন্তু এখন গান শুনতে চাচ্ছি। মনটা আকুপাকু করছে গানের জন্য।”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে গান ধরলো…
“আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।
চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…
ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে,
সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে।
লাল লাল শাড়ী গুলো উড়ছে,
তার সাথে মন মোর দুলছে।
ওই দূর আকাশের প্রান্তে,
সাতরঙা মেঘগুলো উড়ছে।
এই বুঝি বয়ে গেল সন্ধ্যা,
ভেবে যায় কি জানি কি মনটা!
পাখিগুলো নীড়ে ফিরে চলছে,
গানে গানে কি যে কথা বলছে!
ভাবি শুধু এখানেই থাকবো,
ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে!
আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।
চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…”
আবার এলোযে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে।
চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…”
গানটা শেষ হতেই তিতির বলল,
-“উফফ সত্যি খুব ভাল গান আপনি। আর গানটাও এত জোস। একদম পারফেক্ট এখানে এই পরিবেশে।”
মুগ্ধ হাসলো আর খেয়াল করলো তিতিরের ভয়েসটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। একদম ঘুমে জড়ানো। তিতির সেই ঘুমু ঘুমু ভয়েসে বলল,
-“সত্যি আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা এখান থেকে। আচ্ছা, এই গেস্ট হাউজটা সারাজীবনের জন্য ভাড়া দিবেনা?”
মুগ্ধ আবার হেসে ফেলল। বলল,
-“তোমার মাথাটা দেখছি পুরোটাই গেছে। আচ্ছা ভাল কথা.. শোনো, কাল সকাল ৮ টা নাগাদ আমরা নাফাখুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরবো।”
-“সাফি ভাইয়াদের জন্য ওয়েট করবো না?”
-“হুম ৮ টা পর্যন্ত তো ওয়েট করবো। তার বেশি সম্ভব না। বেলা বেড়ে গেলে হাটতে কষ্ট হবে। আর ওদের জন্য এত ভাবতে হবেনা। ওরা ২৬ জন আছে। আমরা দুজন যেসব বিপদে পড়েছি ওরা সেসব বিপদে পড়বে না।”
-“ও।”
-“আচ্ছা, যাও যাও ঘুমাতে যাও এখন।”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আরেকটা গান শোনান না প্লিজ! তারপর ঘুমাতে যাব।”
কটেজের বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে রেমাক্রি গ্রামের ঘরগুলোতে হারিকেন আর কুপির আলোগুলো মিটিমিটি তারার মত জ্বলছে। কটেজের সামনেই জ্বলছে জোনাক পোকা। আর জ্বলছে তিতিরের জন্য মুগ্ধর বুক!
হঠাৎ মুগ্ধর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। আর সাথে সাথে একটা দুষ্টু গান ধরলো,
“এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
মায়াবী রাত মাতাল নেশাতে
আজ মনে মোরে চায় যে মেশাতে
দ্বীপ নিভিয়ে ঝড় যে বয়ে যায়..
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
আখিতে জ্বলে কামনারই বহ্নি
অঙ্গ যে চায় সঙ্গ যে তন্বীর
মনের কথা মনেই রয়ে যায়..
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!
আলেয়াকে মিছে ভালবেসোনা
দূরে থাকো কেন? কাছে আসোনা
কোরো না ভুল কে যে কয়ে যায়?”
এত কাছে দুজনে প্রেম ভরা যৌবনে
হঠাৎ ভুলে ভুল না হয়ে যায়!”
গান গাওয়ার সময় মুগ্ধ ইচ্ছে করেই তিতিরের দিকে তাকালো না। শেষ করে তাকাতেই মুগ্ধ দেখতে পেল তিতির বারান্দার ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। হায় খোদা! কখন ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা! বাচ্চা কাকে বলে! লাভ কি হলো ডুষ্টু গানটা গেয়ে? ওর লজ্জা পাওয়াটাই দেখা হলো না। মুগ্ধ ডাকলো,
-“তিতির? এই তিতির?”
তিতিরের কোনো সাড়াশব্দ নেই। মুগ্ধর আর ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। কি ইনোসেন্ট যে লাগছিল! মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর পাশে বসে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। চাঁদের আলোয় ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। উফ এত কেন ভাল লাগে তিতিরের আনকোরা মুখটা! চুলগুলো এলোমেলো। নিচের ঠোঁটটা সামান্য ভেতরের দিকে ঢুকে রয়েছে। কি মিষ্টি! কি মায়াবী! মুগ্ধর খুব ইচ্ছে করছে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিতে! কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? তারপর আবার ভাবলো কপালেই তো, ক্ষতি কি! কিন্তু তিতির যদি জেগে যায় আর মাইন্ড করে! করলে করবে। তখন বরং বোঝা যাবে তিতির ওকে ভালবাসেনা। আর যদি জেগে যায় কিন্তু রাগ না করে তাহলেও বোঝা যাবে যে তিতির ওকে ভালবাসে। পরক্ষণেই ভাবলো, ধুর কিসব ভাবছে ও। তার চেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুম দিক। উঠে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করলো মুগ্ধ। দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এল। আবার ওর পাশে বসলো। তারপর নিচু হয়ে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। নাহ তিতিরের ঘুম ভাঙলো না। ইশ! ঘুম ভাঙা উচিৎ ছিল। নেগেটিভ হোক পজেটিভ হোক ওর এক্সপ্রেশন টা থেকে তো অনেক কিছু বোঝা যেত। কয়েক সেকেন্ড বসে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে।
মুগ্ধ চলে যাওয়ার পর তিতির পাশ ফিরে বালিশটা জড়িয়ে ধরলো। হাত পা রীতিমত কাঁপছিল, ঠোঁটে ছিল বিশ্ব জয় করার হাসি! ও ঘুমের ভান করেছিল এতক্ষণ। কারন, মুগ্ধ যেই গান গাইতে শুরু করেছিল তাতে লজ্জায় মরে যেত পরে চোখে চোখ পড়লে। তাছাড়া মুগ্ধর কোলে ওঠার জন্যও এর চেয়ে ভাল উপায় আর নেই। কিন্তু তার সাথে যে ওর ঠোঁটের ছোঁয়াটাও পাবে তা ভাবেনি। এবার ও শিওর যে মুগ্ধ ওকে ভালবাসে। লোভে পড়ে করলে ঠোঁটে করত, অন্য কোথাও করতো। ভালবাসা থেকে করেছে বলেই কপালে করেছে। উফফ, তিতিরের কি যে আনন্দ হচ্ছে!
বিছানায় শুতেই মুগ্ধর খেয়াল হলো তিতির তো ঘুমে, দরজা লাগাতে পারবে না। দরজাটা সারারাত ভেজানো থাকবে? তিতিরকে এতটা আনসেফ রেখে ও ঘুমাতে পারবে না। নিজের খুঁটিনাটি যেসব জিনিসপত্র যা ও বের করেছিল তা আবার ব্যাগপ্যাকে ভরে নিয়ে তিতিরের ঘরে চলে গেল। তিতির টের পেলেও কিছু বলল না। মুগ্ধ ভেতর দরজায় খিল দিয়ে ব্যাগপ্যাকটা ফ্লোরে রেখে ঘরের অন্য বিছানাটায় শুয়ে পড়লো। তিতিরের দিকে আর এক বারের জন্যও তাকালো না। ও মেয়ে না ও একটা মায়াজাল!
খুব ভোরে ঠিকমতো আলো ফোটেনি তখন তিতিরকে ডাকলো মুগ্ধ,
-“এই তিতির, ওঠো ওঠো।”
তিতির একটু কান্নার ভাব করে পাশ ফিরে শুলো। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে ঝাকি দিয়ে দিয়ে ডাকছিল,
-“এই মেয়ে, ওঠো না প্লিজ। নাহলে খুব মিস করবা। ওঠো ওঠো।”
-“আয়ায়া, আমি ঘুমাচ্ছি তো.. উফফো।”
তিতিরের এই আহ্লাদী কথার সাথে ছিল সেই ঘুমু ঘুমু মাতাল করা ভয়েস! শুনে মুগ্ধর বুকের ভেতরটায় কিছু একটা চুরচুর করে পড়ছিল। ইচ্ছে করছিল ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে অনেক অনেক আদর করতে! আবার ডাকলো,
-“ওঠো না। একটু পর নাহয় আবার ঘুমিয়ো।”
তিতিরের কোনো হেলদোল নেই। বাবারে বাবা কি ঘুম! মুগ্ধ তিতিরকে ধরে উঠালো। তারপর বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করাতেই লুটিয়ে পড়লো মুগ্ধর বুকে। কাল থেকে বুকের ভেতরটা যে খরায় খা খা করছিল তাতে যেন ঝুমবৃষ্টি নামলো। তিতির ঘুমে পুরো কাদা! মুগ্ধ তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরেই টেনে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। মুগ্ধ পারতো ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু তাতে তো এতক্ষণ তিতির ওর বুকের মধ্যে থাকতো না! বারান্দায় নিয়ে মুগ্ধ তিতিরের গালে হাত দিয়ে বলল,
-“একবার চোখটা খোলো না.. তিতিরপাখি.. ও তিতিরপাখি.. তাকাওনা একবার।”
তিতির একটু সজাগ হলো। ঘুমে জড়ানো চোখদুটো খুলতেই হালকা আলোয় যেন এক কল্পলোক দেখতে পেল। চারদিকে মেঘ আর নীল, সবুজ পাহাড়ের এক অপূর্ব সমন্বয়। প্রকৃতি যেন এখানে উজার করে রেখেছে এর রূপের ঝাঁপি। ছোট ছোট মেঘের ভেলায় চড়ে কোন এক অপরূপা রাজকন্যা যেন নেমে এসেছে পাহাড় রাজার দেশে। নীল আকাশ হতে সূর্যের আলো যেন সেই রাজকন্যাকে সোনার মুকুট পড়িয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে উষ্ণ পরশে সকলের ঘুম ভাঙাবে বলে।
তিতির তখনও মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। এসব দেখতেই সোজা হয়ে দাড়ালো। কটেজের সিড়ি বেয়ে নেমে গেল সামনে। এখান থেকেই একপাশে ঘুমিয়ে থাকা রেমাক্রি বাজার দেখা যাচ্ছে। ছোট-খাট একটি বাজার। দোকান প্রায় ৩০ টির মত। বাজারের চারপাশে দোকান আর মাঝখানটা ফাঁকা। আসলে এগুলো প্রত্যেকটি এক একটি বাড়ি। সামনের অংশটুকু দোকান আর পিছনের অংশে তারা বসবাস করে। অন্যপাশে দেখা যাচ্ছে সেই সাঙ্গু নদী। তার ওপাশে গহীন জঙ্গল। আরেকপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। খুব দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না, হালকা কুয়াশা ছিল। তিতির এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেঘগুলো সামান্য উপড়ে। উড়ে গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। মুগ্ধ পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিতির একটা উঁচু পাহাড় দেখিয়ে বলল,
-“আমাকে ওই পাহাড়চূড়াতে নিয়ে যাবেন একবার?”
-“এত ঘুমালে কিভাবে নিয়ে যাব ঘুমকুমারী?”
তিতির এবার আর রাগ করলো না। চোখ বড় বড় করে তাকালো না। মুগ্ধর একটা হাত ধরে বলল,
-“নিয়ে চলুন না ওখানে? যদি সম্ভব হয় আরকি।”
মুগ্ধও ফাজলামো থেকে বেড়িয়ে এসে বলল,
-“আমি তোমাকে ওখানে নিয়ে যাব বলেই ডাকছিলাম। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। জাস্ট ৫ মিনিটে। নাহলে বিশাল মিস হয়ে যাবে।”
তিতির ৩ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে জাস্ট একটা শাল জড়িয়ে চুলগুলোকে হাতখোঁপা করতে করতে বেড়িয়ে এল,
-“চলুন।”
তিতিরের ওই হাতখোঁপা করার দৃশ্যটা মুগ্ধর চোখে আটকে রইলো। এই ছোট ছোট অতি সাধারণ ব্যাপারগুলো কেন যে মুগ্ধর এত ভাল লাগে! আর তিতিরের মধ্যেই বিধাতা যেন সব দিয়ে রেখেছেন যা মুগ্ধ সারাজীবন চেয়ে এসেছে।
মুগ্ধর কাধে ছোট একটা ব্যাগ দেখে তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“ব্যাগ নিচ্ছেন যে? আমারও নিতে হবে?”
-“নাহ, এত কথা বলার সময় এখন নেই। চলোতো।”
-“সময় নেই কেন? আর এত তাড়াহুড়োই বা কেন করছেন?”
-“বলবো, আগে তো চলো।”
মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ধরে ওকে পাহাড়ের উপড়ে ওঠাচ্ছিল। অনেক খাঁড়া একটা পাহাড়। এটা কোন ট্রেইলের মধ্যে পড়েনা তাই রাস্তাও নেই। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা বাঝিয়ে বাঝিয়ে উঠতে হচ্ছে।
প্রায় ২০ মিনিট ওঠার পর ওরা সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো। তিতির উঠেই বসে পড়লো, হাপাচ্ছিল। মুগ্ধ সেই ছোট ব্যাগটা থেকে পানির বোতল বের করে দিল তিতিরের দিকে। তিতির পানি খেয়ে বোতলটা মুগ্ধকে দিয়ে দিল। মুগ্ধ সেটা ব্যাগে রাখতেই তিতির বলল,
-“আপনি পানি খেলেন না যে? তৃষ্ণা পায়নি?”
-“নাহ, এটুকুতেই যদি হাপিয়ে যেতাম তাহলে কি উঁচু উঁচু পাহাড়ে ক্লাইম্বিং করে উঠতে পারতাম?”
-“তার মানে কি আমি কখনো ওসব পাহাড়ে উঠতে পারবো না?”
-“অবশ্যই পারবে। প্রথমেই তো আর কেউ পারেনা। ট্রেনিং নিতে হয়।”
-“ওহ।”
মুগ্ধ হাত বাড়িয়ে বলল,
-“হয়েছে, এবার ওঠো।”
তিতির মুগ্ধর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। মুগ্ধ তিতিরকে ঘুড়িয়ে দাঁড় করালো। তারপর ওর পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে একটা পাহাড় দেখিয়ে বলল,
-“শোনো, ওই দিকে তাকিয়ে থাকো।”
হঠাৎ কিছু মেঘ এসে তিতিরের গায়ে লাগলো। আর তিতিরের গায়ের সেই অংশটা ভিজে গেল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই মেঘ মেঘ! ইশ কি সুন্দর! আমার গায়ে এসে লাগলো।”
-“হুম নোড়োনা। এখনি তোমার গালে লাগবে।”
মুগ্ধর কথা শেষ না হতেই আবার মেঘ এসে লাগালো ওর গালে, মুখে, কানে। তিতির চোখ বন্ধ করে তা উপভোগ করলো। পরেরবার মেঘ আসতেই তিতির ধরতে গেল। আর মেঘ ওর হাতের উষ্ণতা পেয়ে গলে পানি হয়ে গেল। তিতির তা মুগ্ধকে দেখালো। মুগ্ধ হাসলো। মুগ্ধর মেঘের দিকে কোন মনোযোগ নেই। ওর সব মনোযোগ এখন তিতিরের দিকে। মেঘ ও জীবনে অনেক দেখেছে। এখন তিতিরকে দেখার পালা। তিতির বাচ্চাদের মত খালি মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মুগ্ধ বলল,
-“এই তোমাকে না বললাম ওই পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে থাকো।”
-“কেন ওদিকে কি?”
একথা বলে পাহাড়টার দিকে তাকালো। কিছুই দেখতে পেলনা। তারপর মুগ্ধর দিকে ফিরে বলল,
-“পাহাড় তো সব যায়গা থেকে দেখা যায়। কিন্তু এত কাছে মেঘ কোথাও পাইনি। আমি মেঘই ধরবো।”
মুগ্ধ তিতিরের মাথাটা ঘুড়িয়ে ধরলো সেই পাহাড়টার দিকে। বলল,
-“জাস্ট আর কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকো।”
কয়েক সেকেন্ড পর তিতির দেখতে পেল বিশাল এক সূর্য থালার মত একটা মাথা জাগিয়েছে পাহাড়ের ওপাশ থেকে। তিতির কোনো কথা বলতে পারলো না। কি অসাধারণ! আস্তে আস্তে সূর্যের এক প্রান্ত পুরো পৃথিবীকে তাতিয়ে উপরে উঠছে। আরো একটু উপরে.. তারপর আরো একটু উপরে। এভাবে একটু একটু করে পুরো সূর্যটাই যখন উপরে উঠে গেল তখন তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“সূর্যটা অনেক বড়। একেবারে অন্যরকম! পাহাড়ের সূর্য বুঝি এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়?”
-“শুধু পাহাড়ে নয় সূর্যোদয়ের সময় সূর্য সব যায়গাতেই এমন থাকে। কিন্তু শহরের মানুষ সূর্য ওঠার অনেক পরে ওঠে বলে সূর্যের এই রূপের কথা জানতে পারেনা। তাছাড়া ইট পাথরের দেয়ালের ভেতর থেকে এই সূর্যকে দেখার সুযোগ কোথায় বলো? এই রূপটা পাহাড় আর সমুদ্র থেকে সবচেয়ে ভাল উপভোগ করা যায়।”
-“আপনি কি করে আগে থেকে বুঝেছিলেন ওই পাহাড়ের আড়াল থেকেই সূর্যটা উঠবে?”
-“আমি আগেও এখানে এসেছিলাম, কটেজ থেকে দেখে মনে হয়েছিল এখানে এলে মেঘ ধরতে পারবো, তাই এসেছিলাম। এসে হঠাৎই এইরকম সূর্যোদয় দেখে সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। সূর্যোদয় আমি আগেও বহু দেখেছি সমুদ্রের পাড় থেকে, এর চেয়েও অনেক উঁচু পাহাড় থেকে। কিন্তু তবু এই যায়গা থেকে কেন জানি সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল।”
-“আপনার সেই ভাললাগাটা আজ আমাকে দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“না না, ধন্যবাদ নেবনা।”
-“তাহলে?”
-“তোমাকে ঋণী করে রাখবো।”
পাহাড়ে ওঠাটা যতটা কঠিন ছিল নামাটা আরো বেশি কঠিন মনে হলো তিতিরের। নিচে তাকাতেই ভয় করছে। এত খাড়া পাহাড়! মুগ্ধ বলল,
-“আরে এভাবে পা ফেলছো কেন? এত ভয়ের কিছু নেই।”
-“ভয়ের কিছু নেই মানে? কোথায় পা ফেলবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের হাত ধরে ধরে পাহাড় থেকে নামালো। তারপর কটেজের সামনে এসে তিতির নৌকা ঘাটের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
-“দেখুন দেখুন, সাফি ভাইয়ারা আসছে।”
মুগ্ধ তাকিয়ে দেখলো চারটা নৌকা এসে ঘাটে ভিড়েছে। সাফি এবং অন্যরা নৌকা থেকে নামছে। কাঠের ব্রিজটাতে উঠেই সাফি ওদেরকে দেখতে পেল। সেখান থেকেই হেসে হেসে বলল,
-“ভাই শুধু তোর পক্ষেই এটা সম্ভব! হারিয়ে গিয়েও আমাদের আগে এসে বসে আছিস!”
মুগ্ধও হাসি মুখে বলল,
-“আর তুই যেটা করেছিস সেটাও শুধু তোকে দিয়েই সম্ভব।”
ততক্ষণে সাফি ওদের কাছে চলে এসেছে। দুই ভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। সাফি বলল,
-“আমি তোকে না দেখে ভেবেছিলাম তুই প্রথম গাড়ীতে চলে গেছিস। নিলগিরি গিয়ে দেখি তুই নেই। আর তিতিরও নেই। কি যে ভয় পেয়েছিলাম। পরে দোলা বলল যে ও নাকি শিওর তিতির তোর সাথেই আছে।”
মুগ্ধ সাফিকে ছেড়ে বলল,
-“তুই নিলগিরি গিয়ে টের পেয়েছিস যে আমি নেই! তাহলে বোঝ তুই কোন জাতের ছাগল।”
-“সরি সরি ভাই।”
-“কাল রাতে কোথায় ছিলি? থানচি থেকে না ভোরে রওনা দিয়েছিলি?”
-“হ্যা, ভাই কি আর বলবো ভুল রাস্তায় গিয়ে দুনিয়ার ঘুরলাম।”
-“কেন মাঝিরা রাস্তা চিনে না? আর গাইড নেস নাই?”
-“মাঝিদের কথা কি আর বলবো। একজন বলল কোন রাস্তা দিয়ে জানি শর্টকাট মারবে আর অন্যরাও লাফাতে লাফাতে সেদিকে চললো। গাইডরা নিষেধ করেছিল। ওরা শোনেনি।”
-“বললে আবার শুনবে না কেন?”
-“গাইডও যে কি জুটসে কপালে! তোমার মংখাইরে খালি পায়ে ধরা বাকী রাখছি। সে বলে সে মাত্র নাফাখুম থেকে গেছে সে কোনক্রমেই আসতে পারবেনা।”
মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির এতক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“উনি কোন মংখাইয়ের কথা বলছে?”
তিতিরের কথা শেষ হতে না হতেই মংখাইকে দেখা গেল নদী থেকে ব্রাশ হাতে উঠে আসছে। সাফি বলল,
-“ওই মিয়া তুমি না কইলা আসবা না?”
মংখাই দাঁত কেলিয়ে বলল,
-“মুগ্ধ দাদা বললে তো না আসি পারিনা।”
মুগ্ধ মংখাইয়ের কাধ জড়িয়ে বলল,
-“আমার ভাই লাগেনা? না এসে পারবে কি করে?”
মংখাই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রইল। তিতিরের ভাল লাগছিল। মংখাই মুগ্ধর কত ভক্ত। আর সেটা শুধুমাত্র ওর ব্যবহারের জন্যই। ওদের মত মানুষদের এত আপন করে নিতে সবাই পারেনা।
মুগ্ধ বলল,
-“তারপর রাতে কোথায় থাকলি তোরা?” -“সন্ধ্যা নাগাদ কোনক্রমে তিন্দু আসতেই ডুবো পাথরে ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকাটা গেল উল্টে। বাকী তিনটা সেফলি ছিল, সামনেই। ভাগ্য ভাল ওই নৌকার সবাই সাঁতার জানতাম আর ওখানটায় পানিও কম ছিল। তাও পাথরে লেগে সবাই কমবেশি ব্যাথা পেয়েছি। তারপর সন্ধ্যা হয়ে গেছে নৌকা চালানোও নিষেধ তাই আমাদের এক গাইড বলল বড়পাথর এলাকায় নদীর একটা অংশে নাকি চর পরেছে। ওখানে থাকা যাবে। তো আমরা সেখানে গিয়েই তাঁবু গাড়লাম। খুব ভয়ে রাতটা পার করেছি ভাই। কতরকম রিস্ক ছিল চিন্তা কর।”
-“তা তো ছিলই। ভালয় ভালয় আসতে পেরেছিস সেজন্য শুকরিয়া কর।”
-“হুম। আল্লাহ বাঁচাইছে।”
-“যাই হোক, জীপ ছাড়ার কথা ছিল বান্দরবান বাস স্ট্যান্ড থেকে ৯ টায়। ছাড়ালি হোটেলের সামনে থেকে ৮ টায়। আমরা তো ৯ টার আগেই বাসস্ট্যান্ড গিয়ে দেখি জীপ নেই। হোটেলে গিয়ে শুনি ১ ঘন্টা আগে চলে গেছিস। আজব ব্যাপার!”
-“আরে আর বলিস না। জীপ ড্রাইভার এসে বলে জীপ রেডি চাইলে আমরা আগেও যেতে পারি। তো আমি দেখলাম সবাই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে রেডি। তাই ভাবলাম যত তাড়াতাড়ি যেতে পারবো ততই ভাল, রওনা দিয়ে দিলাম। তোরা কিভাবে কিভাবে এলি?”
-“অনেক কাহিনী! সব বলবো আগে ফ্রেশ হয়ে নে তোরা।”
এতক্ষণে দোলাও চলে এসেছে। তিতিরকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আহারে, বোনটা আমার! অনেক কষ্ট হয়েছে না?”
তিতির অযথাই অস্বস্তিবোধ করলো। বলল,
-“না না ঠিক আছি একদম।”
দোলা এবার ওকে ছেড়ে বলল,
-“এই তোমার কাপড় ভেজা কেন?”
তিতির হেসে বলল,
-“আমরা মেঘ ধরতে গিয়েছিলাম। মেঘ আমাদের ভিজিয়ে দিয়েছে।”
দোলা বলল,
-“কোথায়?”
তিতির অাঙুল দিয়ে দেখালো,
-“ওই যে উঁচু পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছো ওর চূড়ায় গিয়েছিলাম। সূর্যোদয়ও দেখে এসেছি।”
সাফি বলল,
-“ভাইয়া তুই আবার ওই রিস্কি পাহাড়টাতে গিয়েছিলি? তাও তিতিরকে নিয়ে? তোর কি মাথা খারাপ?”
মুগ্ধ বলল,
-“নো রিস্ক নো গেইন।”
তিতির বলল,
-“আসলেই। রিস্ক নিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তো আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের লিস্টে আরো একটা যোগ হলো।”
-“হ্যা কিন্তু জানের রিস্ক নিয়ে এসব করা উচিৎ না। তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার ফ্যামিলির কাছে কে জবাব দেবে বল?”
মুগ্ধ বলল,
-“আমি জবাব দেব।”
-“ভাইয়া তোর সাহস অতিরিক্ত বেশি।”
-“হুম। কারন আমি জানি আমি ওকে ওখানে সেফলি নিয়ে যেতে পারবো এবং সেফলি নিয়ে আসতে পারবো তাই নিয়ে গেছি। আর ও তোর মত ভীতু না যে অর্ধেকটা গিয়ে ফিরে আসবে। সি ইজ আ পিওর ট্রাভেলার। গত ২/৩ দিন ধরে আমাদের উপর দিয়ে যা গেছে অন্য কোনো মেয়ে হলে ভেঙে পড়তো, কান্নাকাটি করতো, বিরক্ত করতো। হার্ট অ্যাটাকও করতে পারতো। ও বলেই হাসি মুখে স্টেবল ছিল। বিপদকে বলেছে এডভেঞ্চার। ওকে নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো দুর্গম যায়গায় চলে যাওয়া যাবে। কোনো প্রব্লেম হবেনা।”
মুগ্ধর মুখে এসব কথা শুনে লজ্জায় কুকড়ে গেল তিতির। সাফি, দোলা মিটিমিটি হাসছিল। মুগ্ধ যে এরেস্ট হয়ে গেছে তা বুঝতে কারোরই বাকী রইল না।
তিতির যে ঘরে ছিল সে ঘরে ঢুকেই দোলা বলল,
-“ভাইয়ার ব্যাগ এখানে? তোমরা একসাথে ছিলে? এত ফাস্ট?”
তিতির কি বলবে ভেবে পেলনা। মুগ্ধ পেছন থেকে দোলার মাথায় একটা গাড্ডা মেরে বলল,
-“চিন্তাটাকে বিশুদ্ধ কর। আর মনটাকে ড্রাই ক্লিনার্সে দে। ওটা নোংরা হয়ে গেছে। সবাই তোর আর সাফির মত না। বাসের মধ্যেই কিসব করছিলি! ছিঃ”
তারপর নিজের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। দোলা চিৎকার করে উঠল,
-“ভাইয়া!! তুমি সবসময় কেন আমার পিছনে লেগে থাকো?”
-“আমি কোথায় পিছনে লাগলাম? তোমরা তো এক ঘরেই ছিলে! যা দেখেছি তাই বললাম।”
-“হুম। এই ঘুমকুমারী ঘুমিয়ে পড়েছিল দরজা না লাগিয়ে তাই আমি ওনার সেফটির জন্য এঘরে এসে শুয়েছি। অবশ্যই আলাদা বিছানায়।”
বলেই মুগ্ধ বেড়িয়ে গেল। দোলা তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই তুমি অস্বস্তি ফিল করছো কেন? আমরা ভাই বোনরা এমনই। সবসময় দুষ্টুমি করতে থাকি। কিছু মনে করোনা।”
-“না না আমি কি মনে করবো? আমি বুঝেছি।”
ওদের সবার মনই মোটামুটি খারাপ হয়ে গেল কারন আর্মি ক্যাম্প হতে শুধু মাফাখুম যাওয়ার পারমিশন মিলেছে। নাইক্ষ্যাং, সাতভাইখুম, ভেলাখুম কোনটারই পারমিশন পায়নি। ওদিকে কোনো জনবসতি নেই, পাহাড়ীরা শুধু মাছ ধরতেই ওদিকে যায় কিন্তু পুরো বর্ষাকাল বৃষ্টির কারনে ওদিকে কেউ যেতে পারেনি। আপাতত কোনো রাস্তা নেই, সব জঙ্গল! মুগ্ধ, সাফি অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল জঙ্গল কেটে রাস্তা বানিয়ে যাবে যেহেতু ৫ জন মাঝি ৫ জন গাইড আছে তার উপর ওরাও আছে কোনো প্রব্লেম হবেনা। কিন্তু কোনো কাজ হলোনা। আর্মিরা শুধু নাফাখুম পর্যন্তই পারমিশন দিল।
রেমাক্রি বাজার থেকে নাস্তা করে ৮ টার মধ্যে ওরা রওনা হয়ে গেল নাফাখুম জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। রেমাক্রি হতে গাড়ি তো দূরের কথা নৌকা ও চলাচল করতে পারে না বলে নাফাখুম পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা পায়ে হেটেই যেতে হয়। নাফাখুম যাওয়ার রাস্তাটা বড্ড সুন্দর, ঘন সবুজ পাহাড়ি জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অসম্ভব সুন্দর একটি ঝিরি। ঝিরিপথ ধরে হাটছে সবাই। তিতিরের খারাপ লাগছে। এই কদিন মুগ্ধ আর ও একসাথে ছিল। সারাক্ষণ টুকটাক গল্প করেছে আর আজ দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে। দোলা আপু সারাক্ষণ ওর পাশাপাশি হাটছে। মুগ্ধ কাছাকাছিই আছে, কথাও বলছে কিন্তু স্পেশালি ওকে কিছুই বলছেনা। শুধু দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। সবার সামনে তো আর মুগ্ধ সারাক্ষণ ওর সাথে বকবক করতে পারবেনা। কিন্তু তবু মন মানতে চাইছেনা।
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরকে থামালো,
-“এই দাঁড়াও দাঁড়াও।”
তিতির দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বলল,
-“কি হয়েছে?”
মুগ্ধ নিচু হয়ে তিতিরের একটা পা ধরে বলল,
-“নড়ো না। জোঁকে ধরেছে।”
তিতির কোন কথা বলল না। কারন ও টের পাচ্ছিল না জোঁকটা ধরলো কোথায়! ব্যাথা তো পাচ্ছেনা। উল্টো দোলা চেঁচিয়ে উঠলো,
-“মাগো এটুকু যেতে না যেতেই জোঁক?”
একটা ছেলে লবন নিয়ে দৌড়ে এল। মুগ্ধ চেনেনা তাকে। মুগ্ধ বলল,
-“না না লবন দিয়েন না। আমি এমনি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।”
মুগ্ধ জোঁকটা ধরে টেনে ছুটিয়ে আনলো। এতক্ষণে তিতিরের ব্যাথা লাগলো কারন জোঁকটা কামড়ে ধরেছিল আর মুগ্ধ তা টেনে ছুটাবার চেষ্টা করছিল। সাফি বলল,
-“ভাইয়া, লবন দিলে জোঁকটা একা একাই পড়ে যেত তো।”
মুগ্ধ কোনো কথা বলল না। জোঁকটা ছুটিয়ে ফেলার সাথে সাথে রক্ত পড়তে লাগলো। মুগ্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ের ক্ষতস্থানটায় বেধে দিয়ে বলল,
-“লবন দিলে জোঁক পড়ে যেত ঠিকই। কিন্তু ইনফেকশন হয়ে যেত। মাসখানেক ভুগতে হতো। এখন তা হবে না। রক্ত এমনি এমনি থেমে যাবে।”
তিতির কিছু বলল না। দাঁতে দাত চেপে রইলো। ওর কিছুই বলার নেই ও জানে ওর সবচেয়ে ভাল হবে যাতে মুগ্ধ তাই করবে।
কিছুদূর যেতেই দেখা গেল ঝিরির পানি অনেকটাই বেশি। মুগ্ধর হাটুর উপর পর্যন্ত যা তিতিরের কোমড় সমান হবে। তিতির বলল,
-“ইশ! পুরো ভিজে যাব। ভেজা কাপড়ে সারাটা দিন থাকতে হবে। আচ্ছা আর কোনো রাস্তা নাই এটুকু পার হওয়ার?”
সাফি বলল,
-“না, এটাই একমাত্র রাস্তা। পাশে তো পাহাড় দেখছোই। আর পাহাড় এবং আটকা যায়গা বলেই তো এখানে পানি জমে রয়েছে।”
মুগ্ধ তিতিরের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-“অলরেডি অনেকবার কোলে চড়ে ফেলেছো! আরেকবার কি চড়বে?”
তিতির চমকে তাকালো। মুগ্ধ বলল,
-“আই মিন টু সে তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে কোলে করে এটুকু পার করে দিতে পারি।”
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মনে মনে তো নাচছে কিন্তু একথার রিপ্লাই ও কিকরে দেবে? “হ্যা কোলে চড়বো” একথা কি বলা যায়? মুগ্ধ বোধহয় বুঝে নিল। আচমকাই তিতিরকে কোলে তুলে পানির ভেতর দিয়ে হাটা শুরু করলো। তিতির মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর দিকে। এতগুলো মানুষের সামনে মুগ্ধ যদি এতখানি পানির মধ্যে দিয়ে ওকে কোলে করে হাটতে পারে ও কেন পারবে না মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে থাকতে? মুগ্ধও কম না ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল তিতিরের চেয়ে থাকা চোখে। কি যে আনন্দ হচ্ছিল তিতিরের! খানিকটা অহংকারও! অহংকার তো খারাপ, তবু আজ তিতির অহংকার করবে। কেনই বা করবে না? গ্রুপে যে কয়েকটা মেয়ে তাদের সবার সাথে তাদের বয়ফ্রেন্ড আর শুধু একজনের সাথে ফ্রেন্ডরা আছে, তবু সবগুলো মেয়ে কোমড় সমান পানিতে হাটছে। ছেলেগুলো বড়জোড় ওদের হাত ধরে আছে। আর ও একজনের কোলে করে যাচ্ছে! হা করে তাকিয়ে তা সবাই দেখছে। নিজেকে তখন প্রিন্সেস মনে হচ্ছিল!
পুরাদস্তুর জঙ্গল যাকে বলে! কখনো বাঁশঝাড়, কখনো বিশাল বিশাল নাম না জানা গাছ, কখনো বিভিন্ন রকমের লতা, ছোট বড় পাহাড়! তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিরিপথটি। হাটতে হাটতে তিতির খেয়াল করছিল দোলা সাফির সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার টপিক কোমড় সমান পানি সাফি ওকে হাটিয়ে পার করিয়েছে। আর মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়ে পার করলো! দোলা চাপা স্বরে বললেও শুনতে পাচ্ছিল তিতির। দোলা বলছিল,
-“বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শেখ!”
সাফি বিরক্ত মুখে বলল,
-“প্রেমটা ওর সাথেই করতা।”
-“কি বললা তুমি?”
-“কি বলবো? তোমরা মেয়েরা এমন কেন? একজনকে একটা কিছু পেতে দেখলেই সেটা তোমাদেরও লাগবে! কিন্তু কেন?”
-“তুমি জানো আমি কত কষ্টে পানিটা পার হয়েছি?”
-“জানি। ইভেন তুমিও জানতা এরকম হতে পারে। জেনেই তো এসেছো। দোলা এখানে আমরা ঘুরতে এসেছি প্রেম করতে না। প্রেম ঘরের দরজা বন্ধ করেই করা যায়। তার জন্য জঙ্গলে আসতে হয়না।”
-“আবার প্রেম শুধু ঘরের দরজা বন্ধ করে না। জঙ্গলে এসেও করা যায়।”
-“উফ তুমি একটু চুপ করবা?”
-“কেন চুপ করবো? আমাকে কোলে নিলা না কেন তুমি?”
-“অদ্ভুত তো!”
-“অদ্ভুত না। বলো বলো?”
-“আমি কি ভাইয়ার মত স্ট্রং নাকি যে তোমাকে কোলে নিব? তোমাকে কোলে নিয়ে আমি হাটতে পারবো? প্রেম করার সময় দেখে নাও নাই কেন?”
-“কিহ? তুমি আমাকে মোটা বললা?”
-“কখন বললাম? আমি তো বললাম আমার কথা। তোমার ওজন ৫০ আমার ৬৩। কিভাবে কোলে করে হাটবো? তিতিরের বড়জোড় ৪৫/৪৬ হবে। সেখানে ভাইয়ার ৮০। ওর পক্ষে এটা ইজি ছিল। তোমার বেশি শখ লাগলে ওর কোলেই চড়ো গিয়ে।”
-“তুমি.. তুমি আমার সাথে কথাই বলবা না।”
-“আচ্ছা বলবোনা, যাও যাও.. হুহ।”
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“এইযে, তিতিরপাখি.. অন্যের ঝগড়া হা করে দেখতে হয়না।”
তিতির চমকে উঠে বলল,
-“না না, কই আমিতো অন্যের ঝগড়া দেখছিনা।”
-“আমি তো দেখলাম দোলা সাফি আবার লেগেছে। ওরা সারাদিন ঝগড়া করতে থাকে। এবার কি নিয়ে লাগলো?”
-“আমি অন্যের পারসোনাল কথা শুনিনা।”
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-“হাসছেন যে?”
-“এমনি।”
একথা বলেই আবার হাসলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টালো,
-“কেমন লাগছে এই বুনো সৌন্দর্য?”
-“ভালই। কিন্তু এত মানুষ না থাকলে একটু গা ছমছমে অনুভূতি হত।”
পথে আরো পাঁচবার জোকে ধরলো তিতিরকে। পঞ্চমবার মুগ্ধ তিতিরের ঘাড় থেকে জোক ছাড়াচ্ছে এমন সময় ও বলল,
-“আচ্ছা আপনি কি জোকেদের সাথেও ভাব করে গেছেন? আমাকে পাঁচবার ধরলো আর আপনাকে একবারও না। কি আজব!”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তোমার ব্লাডগ্রুপ কি বি+?”
-“হ্যা, আপনি কি করে জানলেন?”
-“যাদের ব্লাডগ্রুপ বি+ তাদের জোকে ধরে বেশি। মশা কামড়ায় বেশি।”
-“ও। হ্যা আপনি ঠিকই বলেছেন যেখানে কাউকে মশা কামডায় না আমাকে সেখানেও মশা কামড়ায়।”
-“হুম।”
-“আপনার ব্লাডগ্রুপ কি? যে জোকে ধরে না?”
-“ও+… এত বনে বাদারে ঘুরে বেড়াই। কোথাও জোকে ধরেনা। একমাত্র হাম হাম ঝড়নায় যাওয়ার সময় ধরেছিল একবার। ওখানে যাওয়ার রাস্তায় একটা যায়গা পড়ে। পুরো জোকের আখড়া।”
-“ওখানে আমি গেলে তো বোধহয় আমি শেষ।”
-“আমিও সেটাই ভাবছি।”
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে থামালো,
-“এই দাড়াও দাড়াও…।”
-“কি?”
তারপর মুগ্ধ ওর হাতের লাঠি দিয়ে গাছের ভেতর কিছু একটা দেখালো,
-“ওই দেখ।”
তিতির প্রায় লাফিয়ে উঠলো,
-“ওয়াও.. সাপ! বাট লাইট গ্রিন কালার! হাও কিউট। এত্ত সুন্দর সাপ আমি জীবনেও দেখিনি।”
-“ভয় লাগছে না?”
-“ভয় কিসের? আমি কি ওর কাছে যাচ্ছি না ও আমার কাছে আসছে? অযথা ভয় পাবো কেন?”
-“এক্সাক্টলি। এটাই অনেকে বোঝেনা। সাপ দেখলেই লাফালাফি শুরু করে দেয় ভয়ে।”
-“কিন্তু সাপের ক্ষতি না করলে
সাপ মানুষের ক্ষতি কক্ষনো করেনা।”
-“হুম, সেটাই।”
কিছুদূর যেতে না যেতেই সামনে দিয়ে একটা কুকুর আসছিল। একটু দ্রুতই হাটছিল কুকুরটা। কাছাকাছি আসতেই তিতির পেছনে দৌড়ে এসে ধাক্কা খেল মুগ্ধর সাথে। ওকে দৌড় দিতে দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছিল। মুগ্ধ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
-“জোকে নয়, সাপে নয়, ডাকাতে নয়, এমনকি পুরুষ মানুষেও নয়। বাঘিনী কিনা কাবু হলো কুকুরে?”
-“উফ আপনি মারাত্মক খারাপ লোক! সব মানুষেরই তো কোনো না কোনো ফোবিয়া থাকে। আমার আছে কুকুর ফোবিয়া। এটা নিয়ে এত মজা নেয়ার কিছু নেই।”
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-“এত হাসছেন যে! নিজে মনে হয় কিছুকেই ভয় পান না?”
-“হুম পাইতো।”
-“কি ভয় পান?”
তিতিরের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“মেয়েমানুষ!”
বলেই হেসে দিল মুগ্ধ।
ঝিরিপথ ধরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাটার পর দূর থেকেই জলপ্রপাতের জলকেলির শব্দ শুনতে পেল ওরা। কিন্তু তখনও জলপ্রপাতটা দেখা যাচ্ছিল না। তিতির আনন্দে লাফিয়ে উঠলো,
-“এসে গেছি!”
মুগ্ধ জানালো,
-“না মাত্র তো পানির শব্দ এল। আসলে ওখানে এত জোড়ে জোড়ে পানি পড়ে যে দূর থেকেও শব্দ শোনা যায়।”
-“ও।”
তারপর আরো ১৫/২০ মিনিট হাটার পর দেখা মিলল নাফাখুম জলপ্রপাতের। তিতির দূর থেকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে গেল জলপ্রপাতের কাছে। চোখে না দেখলে ভাবা যায় না কী ভয়ঙ্কর এর সৌন্দর্য! ৪০ ফিট প্রশস্ত এই জলপ্রপাত। যেমন এর রূপ তেমনই তার গর্জন। ভয়ঙ্কর স্রোতে পানি আছড়ে পড়ছে রেমাক্রি খালে। তবে খালটা এখানে তুলনামূলক সরু যার দুপাশে পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপরেই ওরা দাড়িয়ে আছে। বিশাল জায়গা জুড়ে কি বিচিত্র সেই পানি পড়ার আওয়াজ। কোথাও ঝরঝর, কোথাও গমগম, কোথাও কলকল। সামনে, পাশে, একটু দূরে, আরও দূরে শুধু উন্মত্ত স্রোতধারা। অজস্র স্রোতধারাগুলো মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে কে কত জোরে, সবেগে আছড়ে পড়তে পারে। জলপ্রপাতটায় দুটো স্টেপের মত আছে। প্রথম স্টেপ থেকে ভয়ঙ্কর সেই স্রোতধারা গুলো সেকেন্ড স্টেপে গিয়েই ছড়িয়ে পড়ছে খালে। খালের পানিগুলোর রঙ সবুজ। কিনারে দাঁড়িয়েই পানির ছাট লাগছিল তিতিরের গায়ে। তিতির একটা কথাও বলছিল না। অবাক চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল। মুগ্ধ এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। অন্যরা দুএকজন ওদের মতই কোনো এক কিনারে দাড়িয়ে জলপ্রপাতের তেজস্বী সৌন্দর্য দেখছে। আর ম্যক্সিমামই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
কিন্তু আধুনিকতার কোন ছোঁয়াই এখানে এখনো পৌঁছায়নি বলে নাফাখুমের ভার্জিনিটি পুরোপুরি অনুভব করা যায়। স্রষ্টার তুলির স্পর্শে যেন সবকিছুই এখানে বর্ণময়। ফুল, পাখি, প্রজাপতি প্রকৃতির সমস্ত রং যেন এরা উজাড় করে পেয়েছে। নাম না জানা মিষ্টি পাখির ডাক পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
মুগ্ধ বলল,
-“এখানে কিছুক্ষন থাকলে এক অদ্ভুত মোহময় ও প্রাচীন অনুভূতির গন্ধ পাওয়া যায়। তুমি কি পাচ্ছো?”
-“হুম পাচ্ছি বোধহয়। আর আমি এতক্ষণ এটাই ভাবছিলাম কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি অসাধারণ!”
-“হুম। বান্দরবানের প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করতে হলে অবশ্যই নাফাখুমে একবার আসা উচিৎ।”
-“সত্যি। আচ্চা এর নাম নাফাখুম কেন হল?”
-“এটা নিয়ে স্থানীয়দের বেশ কয়েকটি মিথ আছে। তার মধ্যে যেটা বহুল প্রচলিত সেটা বলি, ম্রোং ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। আর নাফা হলো নথ! আই মিন নোসপিন। তো আগে এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত তাদের নাকে নথ পড়িয়ে রাখা হত। তাই এর নাম নাফাখুম।”
-“মাছ পাওয়া যেত মানে? এই খালে মাছ পাওয়া যেত?”
-“হ্যা তবে বেশি পাওয়া যেত গর্তে।”
-“গর্ত আবার কোথায়?”
-“এইযে বিশাল উন্মত্ত জলরাশি দেখতে পাচ্ছো এর নিচে ছোট ছোট গর্ত আছে যার মুখগুলো ম্যানহোলের সমান। কিন্তু অনেক গভীর, ৩০/৪০ ফিট পর্যন্ত। ওখানেই মাছ বেশি থাকতো।”
-“সেকী! তাহলে তো এখানে নামাটা খুবই রিস্কি। কখন কে ওইসব গর্তের মধ্যে ঢুকে যাবে কেউ কিছু করতেও পারবে না।”
-“ওই স্রোতের ওখানে গেলে গর্তে ঢোকার সময় পাবেনা। স্রোতই ভাসিয়ে খালে ফেলে কোথায় নিয়ে যাবে টেরও পাবেনা।”
-“ওহ।”
হঠাৎ সাফির গলা পাওয়া গেল,
-“ভাইয়া, এদিকে আয়। ওরা অনেকেই নামতে চাচ্ছে। আমার সাহস হচ্ছে না ওদের নামতে দিতে। তুই আগে নেমে দেখা কিভাবে নামতে হবে। তারপর যদি কেউ সাহস করে তো নামবে।”
মুগ্ধ সাফিকে বলল,
-“ওয়েট আসছি।”
তারপরর তিতিরকে বলল,
-“আপনি নামবেন নাকি?”
-“হুম।”
-“প্লিজ নামবেন না। এটা ভয়ঙ্কর রিস্কি যায়গা।”
-“আমার কিছু হবে না। আমি ওই খালে সাঁতারও কেটে আসতে পারবো। তাছাড়া আমার কাছে প্রটেকশন আছে। চলো চলো।”
তিতিরের বুক দুরুদুরু করছিল। কি করছে মুগ্ধ এটা। কেন করছে? সাফি থামাচ্ছে না কেন? এত রিস্ক নেয়ার কি দরকার? যায়গাটা তো সত্যিই অনেক ভয়ঙ্কর। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে একটা বেল্টের মত কি বের করলো তার দুপাশে দড়ি বাধা। সেটাকে কোমরে আটকে নিল। জলপ্রপাতের দুপাশে কয়েকজন করে সেই দড়ি ধরে রাখলো। আর মুগ্ধ জলপ্রপাতের উপরের দিকটায় নামলো। সেখানে শুধু ছোট বড় পাথর আর জলপ্রপাতের স্রোতের পানির শুরু। তিতিরের মন চাইছে গিয়ে ওদের সাথে দড়িটা ধরতে। ওর মনে হচ্ছিল ও যদি দড়িটা না ধরে তাহলে মুগ্ধ সেফ থাকবে না। কিন্তু তিতিরের সব ভয় দূর হয়ে গেল যখন দেখলো মুগ্ধ তড়তড় করে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে লাগলো। নিচের দিকে স্রোতের তেজও বেশি পানিও বেশি। আস্তে আস্তে মুগ্ধ সেকেন্ড স্টেপটায় চলে গেল। পুরো জলপ্রপাতের পানি ওখানটায় গিয়েই পড়ছে। তিতিরের এবার নিঃশ্বাস টাই আটকে গেল। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে আর স্রোতের ধাক্কায় বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস যারা দড়ি ধরে ছিল তারা খুব শক্ত করে ধরে ছিল, আর মুগ্ধও পায়ের উপর সব জোড় দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর দড়িওয়ালাদের উদ্দেশ্য করে মুগ্ধ কিছু বলল। কিন্তু পানির শব্দে তিতির তা বুঝলো না। হঠাৎ দেখলো মুগ্ধ পায়ের ভয় ছেড়ে দিয়েছে। দড়িওয়ালা রা আরো শক্ত করে দড়ি ধরে আছে। মুগ্ধ তখন পানিতে ভাসছিল। আর কান্নায় ভাসছিল তিতিরের চোখদুটো। কেউ দেখলো না অবশ্য। সবার নজর তখন মুগ্ধর দিকে। একসময় এই দৃশ্যটাও তিতিরের চোখে সয়ে গেল। কান্না থামিয়ে চোখ মুছলো। এবার আর ভয় করছেনা। অনেকক্ষণ ওভাবে থাকার পর মুগ্ধ আবার পা ফেলল পাথরে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এল। উপড়ে উঠেই ব্যাগ থেকে পানি বের করলো এবং হাফ লিটারের পানির বোতল একটানে শেষ করলো। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলো। একটা পা সোজা আরেকটা পা ভাজ করা ছিল। হাফ প্যান্ট পড়া মুগ্ধর ভেজা পায়ের হাটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। লোমগুলো ভিজে কেমন হালকা সবুজ একটা ভাব এনেছে। ওগুলো যেন ডাকছে তিতিরকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল পা গুলো ধরতে। কিন্তু মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। এমনকি বলাও যায়না।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে উঠে বসলো মুগ্ধ। একজন এসে বলল,
-“ভাই বেশি খারাপ লাগছে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আরে নাহ! ইট ওয়াজ স্পিচলেস! আমি জাস্ট একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম। এটা আমার লাইফের সেকেন্ড টাইম। প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখনও এরকমই করেছিলাম। তবে হ্যা পানির স্রোত অনেক শক্তিশালী।”
সাফি বলল,
-“নামার ইচ্ছে ছিল। বাট তুইই বাকা হয়ে যাচ্ছিলি। আমি তো দাঁড়িয়েই থাকতে পারবো না বোধহয়।”
দোলা সাফিকে বলল,
-“এই না তুমি নেমোনা। অতিরক্ত ভয়ঙ্কর ছিল ব্যাপারটা।”
দেখা গেল কেউই সেভাবে নামলো না। উপরের দিকে নেমে হাত ধরাধরি করে পা ভিজিয়ে হেটে চলে আসলো। মুগ্ধ একা হতেই তিতির ওর কাছে গিয়ে বলল,
-“আমাকে ওখানে নিয়ে যাবেন?”
-“তুমি যাবে?”
-“হ্যা। একা তো আর যেতে পারবো না। আপনি যদি নিয়ে যান তো যাব।”
-“সিওর?”
-“১০০% কিন্তু আপনি আবার নামলে আবার কষ্ট হবে।”
-“কিসের কষ্ট? আবার নামলে আবার ফিল করতে পারবো। খালি কনফার্ম করো সত্যিই যাবা কিনা।”
-“সত্যিই যাব।”
আবার একই ভাবে সব ব্যবস্থা হলো। এবার একই বেল্টের মধ্যে দুজন। সবাই তিতিরের সাহস দেখে রীতিমত অবাক। যদিও একই বেল্টের মধ্যে দুজন বাধা ছিল তবু তিতির জোকের মত আঁকড়ে ধরেছিল মুগ্ধকে। আস্তে আস্তে উপর থেকে নিচে নামার সময়েই তিতিরের পা ফেলতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাল লাগছিল খুব বেশি। সেকেন্ড স্টেপে যেতেই তিতিরের পা ভেঙে আসছিল। স্রোতের এত জোড়! মুগ্ধ বলল,
-“ভরসা আছে তো আমার উপর?”
-“১০০% আছে।”
মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরকে উঁচু করলো। এবার আর মুগ্ধ পাথর থেকে পা সরালো না। তিতির চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। দু’পাশ থেকে উপর থেকে সব দিক থেকে স্রোতের পানি এসে পড়ছিল ওর গায়ে। তখন ও ভাসছিল জলপ্রপাতের উত্তল স্রোতধারায়। ভাসছিল প্রেমের জোয়ারেও। এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। স্রোত তিতিরের পা এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়েছে যে তিতিরের মনে হচ্ছিল ও সেই স্রোতের উপর শুয়ে আছে। বালিশটা ছিল মুগ্ধর শক্ত বুক! তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত! হঠাৎ তিতির উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মুগ্ধ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই তিতির হাসলো, হাসলো মুগ্ধও।
জলপ্রপাতের পানিতে ভাসতে ভাসতে আর স্রোতের ধাক্কা খেতে খেতে তিতিরের সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়ছিল। তিতির পানি থেকে ওঠার কথা মুগ্ধকে বলতে গিয়ে দেখলো কোনো কথাই বলতে পারছেনা। কথা বলার জন্য যে মিনিমাম শক্তিটুকু দরকার তা ওর ওই মুহূর্তে ছিলনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধ বলল,
-“এইযে তিতিরপাখি, চলো এবার ওঠা যাক। এর বেশি থাকলে পরে তোমার কষ্ট হবে।”
তিতির কিছু বলতে পারলো না। মুগ্ধ ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উপরে উঠলো। সাথে সাথে দোলা এসে ওদের বেল্ট আর দড়ি খুলে দিল। তিতির নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েছে। মুগ্ধর ব্যাগে আরো দুই বোতল পানি ছিল। একটা বের করে তিতিরকে খাওয়ালো। তিতির অর্ধেকটা পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ বাকি পানিটুকু খেয়ে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। হঠাৎ তিতিরের দিকে তাকাতেই দেখলো তিতির উঠে বসেছে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর হাসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাকিয়ে আছে জলপ্রপাতের সেই স্রোতধারা গুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পর তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আপনি জানেন না আপনি আমাকে আজ কি দিয়েছেন! এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। যতক্ষণ আমি ওখানে ছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্য কোনো এক জগতে আছি। যদিও আমার একফোঁটা শক্তি ছিলনা কিন্তু আমার খুব ভাল লাগছিল। খুব খুব খুব!”
মুগ্ধ হাসলো শুধু কিছু বললনা। দোলা বলল,
-“এত ভাল লাগছে তাহলে কাঁদছ কেন?” তিতির হাসতে হাসতে বলল,
-“আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না আপু। আমার এই কান্নাটা অবশ্যই খুশির কান্না! আমার জীবনে এত সুখের মুহূর্ত আগে কখনো আসেনি। কিন্তু কেন জানিনা কান্নাটা আমি থামাতে পারছিনা।”
মুগ্ধ বলল,
-“আমি তো দেখছি তুমি হাসিটাও থামাতে পারছ না!”
তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে টাওয়াল বের করে দিল। বলল,
-“নাও মাথাটা ভাল করে মুছে নাও।”
তিতির টাওয়াল নিল। মুগ্ধ ব্যাগ নিয়ে উঠে কোথায় চলে গেল। একটু পর ভেজা থ্রি-কোয়ার্টার পালটে শুকনো একটা পড়ে ফিরে এল। তিতির এখনো সেই যায়গায় একা একা বসে আছে। আর গ্রুপেরই একটা ছেলে ওর দিকে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে। নজরটা যে কোনদিকে তা বুঝতে মুগ্ধর অসুবিধা হলো না। ট্রিপে এসে ছেলেটাকে কিছু বলাও তো যাবে না। তিতিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“তিতির ব্যাগ তো আনোনি না?”
-“না।”
-“এক্সট্রা কাপড় যখন আনোনি ভেজাটা উচিৎ হয়নি।”
তিতির বলল,
-“প্রব্লেম নেই।”
-“প্রব্লেম আছে। দোলা ছোট একটা ব্যাগ এনেছে, ওকে জিজ্ঞেস করো তো ওর কাছে এক্সট্রা কাপড় আছে কিনা।”
তিতির উঠে গিয়ে দোলার সাথে কথা বলে ফিরে এল। বলল,
-“আপু ব্যাগে কাপড়চোপড় আনেনি। শুকনো খাবার এনেছে।”
-“ও।”
তারপর মুগ্ধ নিজের ব্যাগ থেকে একটা টি-শার্ট বের করে তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“নাও এটা পড়ো।”
তিতির অবাক চোখে,
-“এটা আপনার?”
-“হ্যা।”
এবার তিতির হো হো করে হেসে উঠলো,
-“ওর মধ্যে দুটো আমি ঢুকতে পারবো।”
-“সেটা আমি জানি। লাগলে তিনটা তুমি ঢোকো গিয়ে। যাও, আর একটা কথাও না বলে চেঞ্জ করে এসো। ওই ঝোপের আড়ালে গিয়ে চেঞ্জ করো।”
-“থ্যাংকস বাট সত্যি কোনো দরকার নেই। আমার ঠাণ্ডা লাগবে বলে বলছেন তো? আমার এটুকুতেই ঠান্ডা লাগেনা, কোনো প্রব্লেম হবেনা। এটা আপনিই পড়ুন।”
-“তিতির বাম পাশের চেক শার্ট পড়া ছেলেটা তোমার ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি দেখেছি, দেখে খুব রাগ লেগেছে। মন চাইছিল চোখদুটো গেলে দিই। ট্রিপে কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছিনা। তাই বলছি চেঞ্জ করো।”
তিতিরের চোখগুলো রসগোল্লা হয়ে গেল। নিজের কানকে বিঃশ্বাস করতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,
-“একদম ডিরেক্টলি না বললে কিছুই বোঝোনা কেন? আজব!”
তিতির আর একটা কথাও না বলে টি-শার্ট টা নিয়ে ঝোপের মধ্যে চলে গেল। তারপর টি-শার্ট টা বুকে জড়িয়ে ধরলো, স্মেল নিল। ইশ, মুগ্ধ কত খেয়াল রাখে ওর যতটা ও নিজেও রাখতে পারেনা। উড়তে ইচ্ছে করছে, উড়তে! মুগ্ধর স্মেলটাও এত মারাত্মক কেন?
মুগ্ধর টি-শার্ট টা তিতিরের হাটু সমান লম্বা হয়েছে, আর এত ঢোলা যে আরো দুএকজন ঢুকতে পারবে। তাতে কিছু যায় আসেনা। মুগ্ধর টি-শার্ট পড়া মানে অনেক কিছু যা কেউ বুঝবে না। আরেকবার টি-শার্ট টা নাকের কাছে এনে স্মেল নিয়ে বেড়িয়ে এল ঝোপের বাইরে। ওকে দেখে দোলা হেসে দিল। আরো অনেকেই হাসলো বোধহয় কিন্তু ও একটুও অস্বস্তিবোধ করছিল না। খুব পার্ট নিয়ে ছিল।
এবার ফেরার পালা। প্রায় ৪-৫ ঘন্টা নাফাখুমে কাটিয়ে ওরা ফেরার পথে হাটা ধরলো। পথে তিতিরকে ৯ বার জোকে ধরলো, মুগ্ধ একইভাবে জোক ছাড়িয়ে দিল। সবারই কেমন যেন কথাবার্তা ফুরিয়ে গেছিল, জলপ্রপাতের ঘোর কারোরই কাটেনি। সেই কোমড় সমান পানির যায়গায় এসে মুগ্ধ বিনাবাক্যে তিতিরকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করলো। কোলে নিতেই তিতির ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। একটা অদৃশ্য অধিকারবোধ দুজনের মধ্যেই কাজ করছিল। মুগ্ধর টি-শার্ট তিতিরকে দেয়ার কারনে মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে। এটাও একটা দেখার মত দৃশ্য ছিল। তিতিরের কেমন যেন লাগছিল! মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে আর লজ্জা লাগছিল ওর। হাতগুলো মুগ্ধর খালি গায়ে লাগছিল। আর যখনি সে হাতের কুনুই ওর বুকের লোমগুলোর সাথে লাগছিল তখন সুড়সুড়ি লাগছিল তিতিরের। যেদিন এসেছিল সেদিন মুগ্ধর মুখে খুব ছোট ছোট দাঁড়ি ছিল। এখন সেগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। তিতির সেদিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধকে এখন আরো বড় বড় লাগছে। তিতির মুগ্ধর গলার পিছনে দুহাত বেধে রেখেছিল। হঠাৎ একটা হাত দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে আরেকটা হাত নামিয়ে মুগ্ধর দাড়িতে রাখলো। মুগ্ধ চমকে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির লজ্জা পেয়ে ওর দাড়ি ছেড়ে দিয়ে আবার গলার পিছনে হাত বাধলো।
রেমাক্রি ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫ টা বাজল। সবাই ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিল। তারপর যে যার মত রেস্ট নিচ্ছিল। তিতির বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। খুব ক্লান্ত লাগছিল। পা গুলো যেন ভেঙে আসছিল। জানালা গুলো নিচু হওয়ার কারনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নদী, পাহাড় সবই দেখতে পাচ্ছিল তিতির। হঠাৎ বারান্দায় মুগ্ধকে দেখা গেল। মুগ্ধ ওকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,
-“কি ব্যাপার? ঘুমকুমারী না ঘুনিয়ে তাকিয়ে আছে যে!”
-“আমার এত ক্লান্ত লাগছে যে ঘুমাতেও পারছিনা।”
-“আরে ঘুরতে আসলে ওরকম একটুআধটু হয়। রাতে একবারে ঘুমিও। এখন চলো তো।”
-“কোথায়?”
-“রেমাক্রি বাজারে যাব। চলো মজা হবে।”
-“কি মজা?”
-“বাজারে কতরকম ফল, সবজি ওঠে। সব তুমি চিনবেও না।”
-“না প্লিজ আমি যাব না, আপনি যান। আমি এখন আরো হাটলে মরেই যাব।”
-“এহ! তুমি হাটলা কখন? কোলে কোলেই তো গেলে আসলে। আর জলপ্রপাতের পানিতে? সেখানেও তো কোলেই ছিলে।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“মানুষের উপকার করে আবার খোঁটা দিচ্ছেন? কি খারাপ আপনি।”
-“সেটাতো অবশ্যই।”
-“আপনি যান। আমি যাবনা।”
-“কোলে করে নিলে যাবে?”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। মুগ্ধও হেসে দিল। তারপর বলল,
-“আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও। আমি যাই।”
তিতির কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা ওর মনে নেই। ঘুম ভাঙলো দোলার ডাকে। উঠতেই দোলা বলল,
-“আহা ঘুমিয়ে ছিলে, ওদিকে তোমার আশিক তো তোমাকে ছাড়া মরেই যাচ্ছিল। মনের দুঃখে শেষে রান্নাই করতে চলে গেল।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। দোলা বলল,
-“আরে এত লজ্জার কি আছে? আমিই তো।”
-“নাহ আসলে তেমন কিছু না।”
-“ইশ আর লজ্জা পেয়ে মিথ্যে বলতে হবেনা। আমরা এতক্ষণ তোমাদের এডভেঞ্চারের গল্প শুনছিলাম।”
-“কোন গল্প?”
-“ডাকাতের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার গল্প।”
-“ওহ।”
-“তাইতো বলি দুজনের মধ্যে এত ভাব হলো কখন?”
তিতির কি বলবে লজ্জায় তো শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দোলা বলল,
-“তুমি খুব লাকি বুঝলে? তোমার আগে কোনো মেয়েকে ভাইয়া এতটা প্রায়োরিটি দেয়নি। ওদের একটা কাজিন আছে ‘ইকরা’। ভাইয়াকে পাগলের মত লাভ করে আর ভাইয়া পাত্তাই দেয়না।”
হঠাৎ তিতিরের মনে পড়লো সেইযে মেসেজ দেয় ‘পেরা’ সেই ইকরা নয়তো? কিন্তু সে তো ভার্সিটির, কাজিন তো না। নাকি কাজিনই বাট একই ভার্সিটিতে পড়ে। দোলা বলল,
-“এই বলোনা, কিভাবে প্রোপোজ করল?”
তিতির বলল,
-“প্রোপোজ! তুমি ভুল ভাবছো.. সত্যি প্রোপোজ করেনি। আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি।”
দোলা অবাক হয়ে বলল,
-“ভাইয়াও তাই বলল। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আই মিন তোমাদের মধ্যে রিলেশনশিপ চলছে সে ব্যাপারে আমি সিওর ছিলাম তা নাহলে কোলে নেয়া। একই দড়িতে পানিতে নামা। দুজনের কথাবার্তা, দুজনের দুজনের দিকে তাকানো! এসব কিভাবে সম্ভব!”
তিতির এবার বলল,
-“আসলে আমি ওনাকে পছন্দ করি। উনিও হয়তো করে কিন্তু কিছু বলেনি তো কখোনো। তাই সিওর না।”
-“ওয়াও, দ্যাটস গ্রেট। তুমি তাহলে ওকে বলে দাও তোমার ফিলিংসের কথা।”
-“না না আমি বলতে পারবো না।”
-“কেন?”
-“উনি যদি পছন্দ না করে আর রিজেক্ট করে তাহলে মানতে পারবো না। তার চেয়ে অপেক্ষা করি।”
-“সেকী! রিজেক্ট কেন করবে?”
-“হতেও তো পারে ওনার আমাকে পছন্দ না। আফটারঅল মাত্র ৩/৪ দিন ধরে চিনি আমরা একে অপরকে।”
-“আরে আমরা তো চিনি ভাইয়াকে। ও ভাল না বাসলে এরকম করতোই না।”
-“তবু আমি অপেক্ষা করবো আপু।”
-“কতদিন অপেক্ষা করবে? এর মধ্যে যদি অন্য কেউ ঢুকে পড়ে? আর ভাইয়া তার হয়ে যায়?”
-“উনি আমার হলে কখনোই অন্য কেউ ঢুকে পড়তে পারবে না। আর ঢুকলেও উনি তার হবে না। হলে বুঝতে হবে আমি ভুল ভেবেছি। উনি আসলে আমাকে ফিল করেনি।”
-“হায় আল্লাহ! কোন দুনিয়ায় আছি।”
তিতির দোলার হাত ধরে বলল,
-“প্লিজ আপু আমাকে ছুঁয়ে বলো যে তুমি ওনাকে আমার ফিলিংসের কথা কিছু বলবে না। আমি চাই উনি নিজ থেকে আমাকে বুঝুক আর প্রোপোজ করুক।”
দোলা তিতিরের হাত ধরে হেসে বলল,
-“আচ্ছা বলবোনা। দোয়া করি খুব তাড়াতাড়ি আমার বড় জা হয়ে যাও।”
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। দোলা হাসতে হাসতে বাইরে বেড়িয়ে গেল।
রাতে সবাই খেতে বসেছে। তিতির বারান্দায় দড়িয়ে ভাবছিল মুগ্ধরই কথা। এমন সময় পিছন থেকে মুগ্ধ বলল,
-“এইযে সুন্দরী, আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
-“মোটেই খোঁজেননি। আমি এখানেই ছিলাম।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা, তোমার ক্লান্তি গেছে?”
তিতির হেসে বলল,
-“হুম, ঘুমিয়েছি না?”
-“পা ব্যাথা?”
-“পা ব্যাথা আছে। এত হাঁটিনিতো কখনো।”
-“ওহ। হুম ডিনার করে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিও। ব্যাথা কমে যাবে।”
-“আচ্ছা।”
-“তোমার জন্য বাঁশ রেঁধেছি। চলো খাবে।”
-“কি?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বান্দরবানে বলেছিলাম না বাঁশ কুরুইল খাওয়াবো সুযোগ পেলে? ওটাই রান্না করেছি। ওটা আনতেই বাজারে গিয়েছিলাম।”
বাঁশ কুরুইল টা সত্যি অসাধারণ ছিল। নরম নরম আর খুব টেস্টি। চিকেন দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করেছে মুগ্ধ। তিতিরের মনে হলো এত সুস্বাদু খাবার ও আর খায়নি। খেতে খেতে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিল,’আমি আপনার কাছ থেকে সব রান্না শিখবো। তারপর আর আপনাকে রাঁধতে দেবনা। আমি আপনাকে রেঁধে খাওয়াবো।’
খুব ভোরে ওরা রওনা দিয়েছিল যাতে রাতে থানচিতে থাকতে না হয়। কারন, থানচি যায়গাটা কারোরই তেমন পছন্দ হয়নি। সন্ধ্যার মধ্যেই ওরা বান্দরবান পৌঁছলো। তারপর রাতের বাসে ঢাকা। ঢাকার বাসেও তিতির মুগ্ধ পাশাপাশি বসলো। তিতিরের মন খারাপ লাগছিল। পথ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, মুগ্ধ এখনো কিছু বলল ন। মুগ্ধ আর ও টুকটাক কত গল্প করছে। ম্যক্সিমাম ট্রাভেলিং রিলেটেড। ১০ দিনের ট্যুর ৫ দিনে শেষ হয়ে গেল পারমিশন না পাওয়ার কারনে। ৪০% টাকা ফেরত পেল। এই টাকা দিয়ে তো অন্য কোথাও ঘুরে আসা যায়! তিতিরের ইচ্ছে করছে মুগ্ধর সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে কিন্তু ও কখনোই তা বলতে পারবে না। এত চিন্তার মধ্যেও ও বেশ কয়েকবার ঘুমালো। উঠলো, গল্প করলো। কিন্তু মুগ্ধ কিছুই বলল না।
আস্তে আস্তে একসময় সকাল হল। বাস চলে এল ঢাকায়। মুগ্ধ আর তিতিরের গন্তব্য একই যায়গা, ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোড। দুজনে একটা সিএনজি নিল। তিতিরের বাসার সামনে এসে মুগ্ধ সিএনজি ছেড়ে দিল। একটা বাসা পরেই ওর বাসা। হেটেই চলে যেতে পারবে।
দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিতিরের বাসার সামনে রাস্তার অপজিটে। দুজনেরই মন খারাপ। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। ভেবে পেলনা কি বলবে। একসময় মুগ্ধ ম্লান হেসে বলল,
-“ওকে বাসায় যাও তাহলে।”
-“হ্যা যাচ্ছি।”
-“ভাল থেকো। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। সাবধানে থেকো।”
-“আপনিও ভাল থাকবেন।”
তিতির আর দাঁড়ালো না, চলে গেল। গেটের সামনে গিয়ে তিতির একবার পিছন ফিরে তাকালো। মুগ্ধ পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে ফিরে তাকাতে দেখেই হাসলো। তিতিরও একবার হাসলো। তারপর গেটের ভেতর ঢুকে গেল।
তিতির ভেতরে যাওয়ার পর মুগ্ধ উলটো ঘুরে নিজের বাসার দিকে হাটতে লাগলো। বাসার গেটের ভেতর ঢুকতেই মনে পড়লো তিতিরের ফোন নাম্বারটাই তো আনা হয়নি! কোনরকমে গেটটা খুলে দৌড় দিল। এক দৌড়ে চলে এল তিতিরের বাসার সামনে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
অন্যদিকে এক সিঁড়ি উঠে দোতলার অর্ধেকে যেতেই তিতিরের খেয়াল হল মুগ্ধর ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি। এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমতেই বাবার সাথে ধাক্কা লাগলো। বাবা ওকে দেখে খুশিতে বলে উঠলো,
-“ওরে বাবা! আমার আম্মা দেখি ১০ দিনের যায়গায় ৫ দিনে এসে গেছে। কিন্তু আম্মা দৌড়াচ্ছে কেন?”
-“বাবা সিএনজিতে আমার পার্স ফেলে এসেছি।”
এছাড়া আর বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা খুঁজে পেলনা তিতির। বাবা বলল,
-“বাইরে তো কোন সিএনজি নেই।”
-“ওহ! বাবা আমি আরেকটু খুঁজে দেখি?”
-“নেই তো মা। বাদ দে। কি এমন ছিল পার্সে?”
-“টাকা।”
-“ওহ। তাতে কি হয়েছে? টাকা গেছে যাক। আমার মেয়ে তো সেফলি ফিরে এসেছে।”
-“বাবা ওতে পাঁচ হাজার টাকা ছিল। ট্যুরের টাকা বেচে যাওয়ার ফেরত পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম ওটা দিয়ে কিছু করবো। বাবা আমি যাই?”
-“আরে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা? চল আমি তোকে এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি। এর জন্য নাকি আমার আম্মা এত সকালে বাইরে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে।”
তিতির মন খারাপ করে বাবার সাথে সিঁড়িতে উঠলো,
-“এত সকালে তুমি কোথায় গিয়েছিলে বাবা?”
-“নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। এত সকালে আর কোথায় যাব? চল চল। উপড়ে চল। আজ আমি নিজে বাজারে গিয়ে বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছটা নিয়ে আসব আমার আম্মার জন্য।”
কিন্তু তিতিরের অস্থির লাগছিল। একেকটা সিঁড়ি যেন একেকটা উঁচু পাহাড়ের চেয়েও বেশি উঁচু মনে হচ্ছিল।
প্রেমাতাল
মুগ্ধ তিতিরকে না পেয়ে নিজের বাসায় ফিরে এল। ভাল লাগছে না কিছু! সারারাত বাসের ঝাঁকুনি আর তিতিরকে নির্ভয়ে অপলক দেখার লোভ! এই দুটো কারনে ঘুমাতে পারেনি ও। ভেবেছিল বাসায় এসে ঘুমাবে। কিন্তু কিসের ঘুম কিসের খাওয়া। তিতিরকে কিভাবে পাবে সেই চিন্তায় ও অস্থির! যদিও বাসা চেনে কিন্তু কয় তলায় থাকে তা তো জানেনা। আর জানলেও বাসায় গেলে তিতিরের প্রব্লেম হতে পারে। কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো সাফিকে কল করলে নিশ্চই তিতিরের নাম্বার পাওয়া যাবে। অবশ্যই পাওয়া যাবে সব গ্রুপ মেম্বারের ডিটেইল ওর কাছে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সাথে সাথে কল করলো সাফিকে। সাফি ফোন ধরছে না। উফ এত বিরক্তিকর কেন ছেলেটা। সাফিকে অনেকবার ট্রাই করার পর দোলাকে ফোন করলো। দোলা তো আরো এক ধাপ এগিয়ে, ফোনই বন্ধ। নিজের গালে নিজে দুইটা চড় মারতে মন চাইছে। ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলেই জানতো। কখনো এমন কিছু করেনি যার জন্য পরে আফসোস করতে হয়েছে। সবসময় প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য রেডি থাকে। সব ব্যাপারে আগাম কনসার্ন থাকে। আর এখন তিতিরের ফোন নাম্বারটা আনতেই ভুলে গেল! এতটা বোকামি ও কিভাবে করলো! হ্যা চলে আসার সময় প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছিল তাই তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কিন্তু ফোন নাম্বারটা তো আগে নিয়ে রাখা উচিৎ ছিল। ওর জন্য নিলগিরি থেকে পেনহোল্ডার, রেমাক্রি বাজার থেকে ডুমুর আর পাকা পেঁপে কিনেছিল তাও দেয়া হয়নি। এত গাধা মুগ্ধ কবে হলো!
এবার সাফির মাকে কল করলো মুগ্ধ,
-“হ্যালো চাচী?”
-“হ্যা হ্যা মুগ্ধ বল বাবু।”
-“এই চাচী শোনোনা, সাফি কি ঘুমাচ্ছে? ওকে এতবার কল দিলাম ধরছেই না।”
-“মানে? ও তো তোর সাথেই ট্রিপে গেল। এখনো তো আসেইনি। তুই ওকে বাসায় খুঁজছিস! আমি তো কিছুই বুঝতে পারচ্ছিনা।”
মুগ্ধ বুঝতেই পারছে চাচী এখন চিন্তায় পড়ে যাবে তাই চাচীকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলল,
-“ওহ হো। আচ্ছা আচ্ছা আসলে আমি তো ওকে বান্দরবানে হারিয়ে ফেলেছিলাম বুঝলে? আমি এসে পড়েছি তাই ভেবেছি সাফিও বুঝি এসে পড়েছে। তুমি চিন্তা করোনা তো। ও এসে পড়বে।”
-“তুই যে বললি ফোন ধরছে না।”
-“তো কি হয়েছে? ফোনে তো কত প্রব্লেমই হতে পারে।”
-“ওহ, তাও ঠিক।”
-“আচ্ছা চাচী রাখি, তুমি অত চিন্তা করোনা।”
ফোন রেখেই মুগ্ধ আবার কল দিল সাফিকে। এবার ওর ফোন বিজি পাওয়া গেল। যাক পাওয়া যাবে তাহলে। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বার বার ফোন বিজি আসছেন আজব তো ছেলেটার কি ওয়েটিং সার্ভিসও একটিভ করা নেই? না মনে পড়েছে। ওয়েটিং সার্ভিস তো চালুই আছে। কতই তো ওকে ওয়েটিং এ পেয়েছে। তাহলে? উফ আর কিছু ভাল লাগছিল না মুগ্ধর।
মুগ্ধ সাফির ফোন বিজি পাবেনা কেন? এদিকে তিতিরও তো সাফিকে অনবরত ফোন করছিল মুগ্ধর নাম্বারের জন্য। সাফি তো ফোনই ধরছে না। হঠাৎ তিতিরের মনে পড়লো বাবাকে না মুগ্ধর ফোন দিয়ে ফোন করেছিল? ইয়েস! এত সহজে নাম্বারটা পাবে ভাবেনি ও। দৌড়ে বাবার ঘরে চলে গেল। বাবা রেডি হচ্ছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। তিতির বলল,
-“বাবা একটু ফোনটা নেই? জরুরী কল করার ছিল। আমার ফোনে না ব্যালেন্স নেই।”
-“হ্যা হ্যা, নিয়ে নে।”
তিতির ফোন নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। তারপর ভাবতে লাগলো কবে কখন ফোন করেছিল। হ্যা মনে পড়েছে সকালে ফোন করেছিল। গতকাল সকালে ছিল রাস্তায়, গত পরশু সকালে ছিল নাফাখুম। তার মানে পরশুর আগের দিন কল করেছিল। কললিস্ট চেক করতে গিয়ে মহাবিপদে পড়লো তিতির। কারন অনেক আননোন নাম্বার ছিল। এটা কোনো কথা! বাবা এত কথা কার সাথে বলে? যাই হোক বাবাকে ফোন ফেরত দিতে হবে তাই ফটাফট সেদিন সকাল থেকে ১২ টা পর্যন্ত যত কল এসেছে সব তুলে নিল একটা ডায়েরীতে। তারপর এক দৌড়ে গিয়ে ফোনটা বাবাকে ফেরত দিয়ে আরেক দৌড়ে ফিরে আসলো ঘরে। সব মিলিয়ে ৮ টা নাম্বার পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৩ টা এয়ারটেল! হায় খোদা এগুলো কেন তুললো ও। ওর এয়ারটেলে নেটওয়ার্ক ছিলনা বলেই তো মুগ্ধর নাম্বার থেকে কল করেছিল। ওগুলো বাদ দিলে থাকে ৫ টা নাম্বার। প্রথমটাতে কল দিল,
-“হ্যালো..”
ওপাশ থেকে কর্কশ মহিলা কন্ঠে,
-“হ্যালো কেডা? কেডা আপনে?”
তিতির ফট করে লাইনটা কেটে দিল। এটাও বাদ। পরের নাম্বারটাতে কল দিল। ওপাশ থেকে বলল,
-“হ্যালো তিতির আফা?”
তিতির অবাক,
-“আপনি কে ভাই?”
-“আফা আমি শরীফ।”
শরীফ ওদের দারোয়ান। কি বলবে! বলল,
-“ও আচ্ছা। শরীফ ভাই, আমি না একজনকে ফোন করতে গিয়ে ভুলে আপনাকে কল দিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা রাখি।”
-“আচ্ছা আফা।”
দুটো গেল। ৩য় নাম্বারটা টাইপ করতেই দেখলো এটা দেখলো এটা অলরেডি ওর ফোনবুকে আছে। ভাইয়ার এক্সট্রা ফোনের নাম্বার, নতুন নিয়েছে। তিনটা গেল। ৪র্থ নাম্বারটাতে কল করতেই একটা কর্কশ আর রাগী লোকের ভয়েস পাওয়া গেল। ঝাড়ি দিয়ে বলল,
-“হ্যালো কে?”
উফ এই মানুষগুলোর কি আর কোনো কাজ নেই? অলওয়েজ রামগরুড়ের ছানার মত মুখ করে বসে থাকে আর কাউকে পেলেই ঝাড়ি মারে। বাবার সাথে এদের এমন কি কাজ! যাই হোক, কি বলবে ও? যদি বাবার কেউ হয় তাই ‘মুগ্ধ বলছেন?’ একথা তো জিজ্ঞেস করা যায়না। আর জিজ্ঞেস করবেই বা কেন? ওর মুগ্ধ কখনো এভাবে কথা বলে না। মুগ্ধর ভয়েসটাও এমন কর্কশ না, কি মিষ্টি ভয়েস! খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। অযথা এই ব্যাটার সাথে কথা বলবে কেন ও? এমন সময় ওপাশ থেকে আবার বলল,
-“অই মিয়াঁ কে আপনে? কথা কন না ক্যান? কথা কন, নাইলে ফোন রাখেন। আজাইরা ফোন দিয়া ফোনটারে বিজি কইরা রাখসে! যত্তসব। ফোন রাখেন।”
তিতির ফট করে লাইনটা কেটে দিল। উফ এই গুন্ডা টাইপ ব্যাটার সাথে বাবার কি সম্পর্ক কে জানে! পরের নাম্বারটায় ডায়াল করলো অথচ জানলোই না যে এটাই ছিল মুগ্ধ। ও তিতিরকে খোঁজার জন্য সাফিকে কল করছিল তাই মাঝখানে অন্য কলে ডিস্টার্ব ফিল করায় ওরকম বিহেভ করেছে।
৫ম নাম্বারটা বন্ধ পেয়ে তিতির আবার সাফিকে কল করলো কিন্তু সাফির নাম্বার এখন বিজি। অদ্ভুত তো! এতক্ষণ ওর কল ধরেনি আর এখন অন্য কারো সাথে কথা বলছে? নিশ্চই দোলা আপুর সাথে কথা বলছে কিন্তু ওর কলগুলো দেখে একবার কি কল ব্যাক করা যেত না? কিন্তু তখন সাফির ফোন বিজি ছিল কারন, মুগ্ধ তখন পাগলের মত ফোন করে যাচ্ছিল সাফিকে। কিন্তু তিতির তা জানতেও পারলো না। ওদিকে মুগ্ধও জানলো না তিতির কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে ওর জন্য।
সারাটা দিন এরকমই চলতে থাকলো। অবশেষে লাঞ্চের পর দুজনেই সাফিকে কল করে সাফির নাম্বার বন্ধ পেল। কারন, ওদের দুজনের কলের তাড়নায় সাফির ফোন চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আর সাফি সকাল থেকেই দোলার বাসায় মরার মত ঘুমাচ্ছিল। তাই ও কারোরই কল ধরতে পারেনি।
মুগ্ধ কললিস্ট ঘেটে তিতিরের বাবার নাম্বার পেয়ে গেছিল। কিন্তু ওর বাবকে কল দিলে ওর যদি কোনো প্রব্লেম হয়? তাই দিলনা। মুগ্ধ ভাবলো সাফি বোধহয় ঘুমাচ্ছে তা নাহলে ফোন ধরতো। তাছড়া মুগ্ধ তো জানেই ট্যুর থেকে এসে সাফি সারাদিন ঘুমায়। আর হয়তো কথা বলার জন্য না চাচী ফোন করছিল বলে ওর ফোন বিজি ছিল। হ্যা তাই হবে কারন, চাচীকে ফোন দেয়ার আগে প্রত্যেকবার ফোন বেজে বেজে কেটে গেছে। চাচীকে ফোন দেয়ার পর থেকেই বিজি। চাচীও না এত টেনশন করতে পারে। সাফি বাসায় যায়নি আগে জানলে ও কখনোই চাচীকে কল দিত না। কোথায় গেল? দোলার বাসায় নয়তো! হতেও পারে। অপেক্ষা করতে লাগলো সাফি উঠে নিশ্চই কল করবে। তখন তিতিরের নাম্বারও পাওয়া যাবে। শুধু শুধু ওর বাবাকে কল দিয়ে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ও জানে সবুরের ফল মিষ্টি হয়।
তিতির অপেক্ষা করতে করতে একসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। এইচএসসি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর তিতিরের বাইরে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ভার্সিটি কোচিং। আজ ক্লাস নেই তবু বিকাল ৩ টার দিকে ক্লাসের কথা বলে বের হলো তিতির। একটা বাসা পরেই মুগ্ধর বাসা। বাসার সামনে যেতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করলো,
-“আপা কাউকে খুজতেছেন?”
-“হ্যা, ভাই আসলে আমি একজনকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে ফোন নাম্বার নেই কিন্তু উনি এই বাসাতেই থকে।”
-“ও। নাম কি?”
-“ওনার নাম মুগ্ধ।”
-“এটা আবার কেমন নাম! যাই হোক, আপা এই বাসায় এই নামে তো লেউ থাকে না।”
-“একটু ভাল করে সিওর হয়ে বলেন না।”
লোকটা বলল,
-“আসলে আমার কাছে সব ভাড়াটিয়া এবং তাদের সব মেম্বারদের নামের লিস্ট আছে। আমি এ বাসায় ৫ বছর ধরে আছি। সত্যি বলছি আপা, এই নামে এখানে কেউ নাই।”
তিতির মন খারাপ করে চলে আসলো। মুগ্ধ ওকে মিথ্যে বলল! কিন্তু কেন মিথ্যে বলবে? প্রচন্ড মন খারাপ হলো। হেটে নিজের বাসা পর্যন্ত আসতে যেন পা ভেঙে আসছিল। বাসায় ঢুকলো না তিতির। ছাদে চলে গেল। কিছুই ভাল লাগছে না ওর।
বিকাল ৫ টার দিকে বাসা থেকে বের হলো মুগ্ধ। তিতিরের বাসার সামনে যাবে। কি করবে জানেনা কিন্তু যাবে। আর অপেক্ষা করতে পারছে না। গেট দিয়ে বের হয়ে আবার ফেরত আসলো দারোয়ানকে ডেকে বলল,
-“লিটন ভাই শোনো।”
-“জ্বী ভাই বলেন।”
-“আমাকে খুঁজতে একটা মেয়ে আসতে পারে। তুমি তাকে নাম জিজ্ঞেস করবে। যদি নাম বলে তিতির তাকে আমার ফোন নাম্বার টা দিয়ে দেবে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ একথা বলে বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার ফিরে আসলো। বলল,
-“লিটন ভাই…।”
-“বলেন ভাই।”
-“নাম জিজ্ঞেস করা লাগবে না। আসলে একজনই আসবে নাম্বারটা দিয়ে দিও।”
লিটন হেসে বলল,
-“আচ্ছা ভাই।”
মুগ্ধ বলল,
-“আরেকটা ইম্পরট্যান্ট কথা। ও কিন্তু মেহবুবকে খুঁজবে না, মুগ্ধকে খুঁজবে। আমার ফ্যামিলি নেম মুগ্ধ বুঝলা? এখানে ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের সাথে থাকি তো তাই এখানে সবাই ফরমাল নামটাই ডাকে।”
-“হায় হায় ভাই আগে বলবেন না?”
-“কেন আসছিল? আর তুমি বলে দিসো মুগ্ধ এখানে থাকে না?”
-“হ্যা ভাই ৩ টার দিকে আসছিল। খুব সুন্দরী একটা মেয়ে অল্পবয়সী। কিন্তু ভাই আপনের নাম যে মুগ্ধ তা তো আমি জানতাম না। সবাই তো দেখি আপনেরে মেহবুব বইলাই ডাকে।”
-“শিট! আমি যে কেন তোমাকে সকালে বললাম না। উফফফ!”
-“সরি ভাই।”
-“না না। ঠিক আছে। তুমি কেন সরি হবা? আমি তো তোমাকে আগে বলি নাই।”
মুগ্ধ সোজা চলে গেল তিতিরের বাসার সামনে। রাস্তার অপজিটে দাঁড়িয়ে বাসার সব বারান্দা আর জানালাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো। এমনই একটা যায়গা একটা চায়ের দোকানও নেই, ধুর! শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই অস্বস্তিকর। হঠাৎ দেখলো একটা চা ওয়ালা আসছে, যারা ফেরি করে চা বিক্রি করে। থামালো মুগ্ধ,
-“ওই মামা চা দাও তো।”
লোকটা রাস্তায় বসলো। বলল,
-“মামা কি চা দিমু?”
-“যা আছে সব দাও।”
চা ওয়ালা বোকা হয়ে গেল। বলল,
-“মানে?”
-“লেবু চা দাও।”
লোকটা একটা ওয়ান টাইম কাপে চা দিল। মানে এখন টাকা নিয়ে চলে যাবে। মুগ্ধ বলল,
-“মামা তুমি আমার সাথে এখানে বসে থাকবা এক ঘন্টা। কত টাকা নিবা?”
-“আমি এইখানে বইসা থাকমু কেন?”
-“আমি চা খাব তাই। আর ঘন্টায় কত টাকা নিবা বলো আমি দিব।”
-“এক ঘন্টা ৫০ টাকা।”
-“আমি তোমাকে এক ঘন্টায় ১০০ টাকা দিব। তুমি খুশি মনে বসে থাক আর আমাকে চা খাওয়াও।”
চা ওয়ালা এই অফার পেয়ে খুশি হলো।
এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। চা ওয়ালাকে আরো এক ঘন্টার জন্য কন্ট্যাক করা হয়েছে। মুগ্ধ এই এক ঘন্টায় কয় কাপ চা খেয়েছে তা ও নিজেই জানেনা। তাও ভাল এই রাস্তাগুলো অনেক বড় বড় আর ভিড়ও থাকে না তাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও তেমন কারো নজরে আসেনি। কোনো বারান্দা বা জানালায়ও তিতিরকে দেখতে পায়নি।
তিতির ছাদ থেকে নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। ওর আর কিছুই ভাল লাগছে না। সাফিকে আবার কল দিল, নাম্বার বন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুম করে বৃষ্টি নামলো। কি যে দিন আসলো। পাহাড়ে পুরো শীত আসলেও ঢাকায় অল্প অল্প পড়তে শুরু করেছে। এই দিনে বৃষ্টি! অবশ্য ভালই লাগছে। তিতির বৃষ্টি দেখতে বারান্দায় গেল। বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল অ্যাশ কালারের শার্ট পড়া ছেলেটার দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওদের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি বারবার এদিক ওদিক করছে। এই ভরা সন্ধ্যার অন্ধকারেও মানুষ্টিকে চিনতে কষ্ট হলোনা তিতিরের। বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না উঠে আসতে চাইলো। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হলো। কিন্তু মুগ্ধ যে ওদের বারান্দার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। তিতির কয়েকবার হাত নাড়লো মুগ্ধ দেখতে পেলনা। তিতির ভেতরে আসলো। কি ছুঁড়ে মারবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কয়েকটা লিপস্টিক নিয়ে একটা রুমালে বাঁধলো। এই লিপস্টিক গুলোর আর দরকার নেই। এগুলোই নষ্ট হোক। তারপর তা নিয়ে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে মারলো মুগ্ধর গায়ে। মুগ্ধর গায়ে না লাগলেও মুগ্ধর সামনে এসেই পড়লো। তা দেখতে পেয়ে উপড়ে তাকাতেই তিতিরকে দেখতে পেল। মুগ্ধ ইশারা করলো তিতিরকে নিচে নামতে। তিতির ইশারায় বোঝালো আসছে। কিন্তু বাসায় কি বলে বের হবে এই ভর সন্ধ্যায়? তাও বৃষ্টির মধ্যে! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ড্রইং রুমে কেউ নেই। কিছু না বলেই যাক তাহলে পরে যা হওয়ার হবে। তিতির চোরের মত দরজা খুলে বেড়িয়ে এল। এক দৌড়ে নিচে, সেসময় দারোয়ানও ছিলনা গেটে, বাহ! দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। হেটে হেটে নয়। এক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো মুগ্ধর সামনে। ততক্ষণে তিতিরও ভিজে সপসপে। আর এক সেকেন্ডের অপেক্ষাও না করে মুগ্ধ বলল,
-“আই লাভ ইউ তিতির।”
মুগ্ধর চুল, চোখের পাতা, ঠোঁট বেয়ে বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। তিতির রিপ্লাই দিতে গিয়েও পারলো না। কথাটা যেন গলায় আটকে গেল। কেন এমন হলো! খুশিতে ও কথাই বলতে পারছে না। এক পা এগিয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো তিতির। মুগ্ধ উত্তর পেয়ে গেল।
তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরার পর মুগ্ধও তিতিরকে ধরলো কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এইযে তিতিরপাখি! এবার ফোন নাম্বারটা বলো।”
-“01*********”
-“আচ্ছা এবার বাসায় গিয়ে ভেজা কাপড় ছাড়ো। আমি বাসায় গিয়ে কল দিচ্ছি।”
-“আচ্ছা, কিন্তু একবার শুনেই নাম্বারটা মনে রাখতে পারবেন?”
মুগ্ধ নাম্বারটা বলল। তিতির দেখলো মুগ্ধ ঠিক নাম্বারই বলেছে। একবার শুনেই কি করে মনে রাখতে পারলো! ভালই হয়েছে তিতির এই টাইপের জিনিসগুলো মনে রাখতে পারেনা। এখন থেকে এগুলো মনে রাখার দায়িত্ব মুগ্ধকেই দিয়ে দিবে।
তিতির এক পা দুপা করে পিছিয়ে উলটো ঘুরে বাসায় ঢুকে গেল। সিঁড়িতে উঠতেই ওর খেয়াল হলো ও নিজের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরেছিল! ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। কেউ দেখে ফেলেনি তো? নিজের ফ্যামিলির কেউ না হোক আশেপাশের ফ্ল্যাটের কেউ দেখলেও বিপদ আছে কপালে।
তিতির বাসায় ঢুকে যেতেই মুগ্ধ নিজের বাসার দিকে রওনা হল। শত শত বৃষ্টির ফোটা রাস্তায় জমে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে টুপ করে পড়েই ছোট একটা সার্কেল হচ্ছে তারপর সেই সার্কেল বড় হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই সাধারণ দৃশ্যও আজ মুগ্ধর কাছে অসাধারণ লাগছে। মনে মনে তিতিরকে বলছিল, ‘আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালবাসো। তবু কেন আমার এতটা ভাল লাগছে তিতির?’
বাসায় গিয়ে কোনরকমে ভেজা কাপড় পালটে ফোনটা পলিথিন থেকে বের করলো। বৃষ্টি নামায় ও চা ওয়ালার কাছ থেকে একটা পলিথিন নিয়ে ফোনটা পেঁচিয়ে রেখেছিল। তবু ফোনটা ভিজে গেছে খানিকটা। ভালমতো মুছে নাম্বারটা টাইপ করতেই দেখলো সাজেশন এসেছে! তিতিরের নাম্বার আগে ইউজড হয়েছে ওর ফোনে! কিভাবে! সাজেশনে ঢুকতেই দেখলো সকালে এই নাম্বার থেকেই কল এসেছিল যাকে ও অনেক ঝেড়ে দিয়েছিল। তার মানে ও ওর বাবার ফোন ঘেটে নাম্বারটা বের করেছিল কিন্তু সিওর ছিলনা। ঝাড়ি খেয়ে কেটে দিয়েছিল। মুগ্ধ নাম্বারটা ডায়াল করল। প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে হার্টবিট বাড়ানো সেই কণ্ঠস্বর,
-“হ্যালো।”
-“হ্যালো। চেঞ্জ করেছো?”
তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই বসেছিল। অধীর আগ্রহে বসে থাকার পর মুগ্ধর এইটুকু কথা যেন একগুচ্ছ সাদা কামিনী ফুলের মত বুকের মাঝে এসে লুটিয়ে পড়লো। তিতির মনে মনেই সেগুলোকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে চাইলো,
-“হুম। আপনি?”
-“করেছি। মাথা মুছেছো ভাল করে?”
-“হুম।”
-“ঘোড়ার ডিম মুছেছো! তুমি তো মাথাই মুছতে পারোনা। টপটপ করে পানি পড়তে থাকে চুল থেকে।”
-“হ্যা তা ঠিক, এর চেয়ে ভাল মুছতে পারিনা।”
-“হ্যা সেজন্যই তো চিন্তায় পড়ে গেছি।”
-“কিসের চিন্তা?”
-“আমার বাচ্চাকাচ্চাদের তো সারাবছর ঠান্ডা লেগে থাকবে।”
-“মানে?”
-“মানে মা নিজেই যেখানে চুল মুছতে পারেনা সেখানে বাচ্চাদের চুল কি করে মুছবে?”
তিতির লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলো। মুগ্ধও তা বুঝতে পারলো। এরপর বলল,
-“অনেস্টলি স্পিকিং তিতির, আমার যে তিনটা গার্লফ্রেন্ড ছিল তাদের কারো সাথেই আমি বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত কথা বলিনি। কারও প্রতি এতটা মুগ্ধতা আমার ছিলই না। তোমার সাথে বললাম, ভবিষ্যতেও বলবো। তোমাকে আমার বাচ্চাদের মা হতেই হবে। চুল মুছতে না পারলেও প্রব্লেম নেই। আমি শিখিয়ে দেব। আর ছুটির দিনগুলোতে আমিই মুছে দেব। সকালে আর রাতে ওদেরকে আমিই খাইয়ে দেব। তুমি শুধু কষ্ট করে দুপুরে খাওয়াবে। বাইরে বেরোলে বাচ্চারা সব আমার কোলে থাকবে। একসাথে দুজন পর্যন্ত কোলে নিতে পারবো। অভ্যাস আছে, ছোট ভাইবোন দুটোকেই একসাথে কোলে নিতে হয়েছে। কিন্তু দুটোর পরের বাচ্চাগুলো অবশ্য তোমাকেই নিতে হবে।”
-“আপনি প্লিজ থামবেন? এগুলো কোনো কথা হলো?”
মুখে এসব বললেও তিতির মনে মনে উড়ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“থামবো কেন? কেবল তো শুরু।”
-“আপাতত অন্য কথা বলুন। আমার খুব লজ্জা করছে।”
-“এটাই তো মুশকিল। আমি তোমাকে কোনো কথাই আর লজ্জা দেয়া ছাড়া বলতে পারবো বলে মনে হয়না।”
-“ইশ! ওনার ওসব কথা শুনতে আমি যেন বসে আছি। আচ্ছা বলুন তো আপনার আমার জন্য এই ফিলিং টা কবে হয়েছে?”
-“স্পেসিফিক করে বলতে পারবো না। একটু একটু করে হয়েছে। তবে তোমার ঘুমন্ত মুখটার উপরই প্রথম ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর সেকেন্ড ক্রাশটা থানচি গেস্ট হাউজে গোসলের পর যখন তোমার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল তখন। কিন্তু এসব শুধুই ক্রাশ! ভালবাসা হয়েছে একসাথে পথ চলতে চলতে যখন দেখেছি তুমি ঠিক আমার মনেরই মতন, তখন। আর শুরুতে একদম এরকম ভাবিনি। আমি সাধারণত বাচ্চা মেয়েদের দিকে নজর দিই না।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“আমি বাচ্চা?”
-“অবশ্যই তুমি বাচ্চা। ৮ বছরের ছোট তুমি। আমার তোমার বয়সের কোনো মেয়ের সাথে প্রেমের কথা চিন্তা করতেও খারাপ লাগতো। বড়জোর আমার চেয়ে ২/৩ বছর ছোট যারা তাদের সাথে প্রেমটা প্রেফার করতাম। কিন্তু এখন বুঝলাম বাচ্চাদের সাথেই প্রেমে সবচেয়ে মজা।”
-“কিরকম?”
-“সেটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব না।”
-“ও। কিন্তু আমি তো আর এরকম বাচ্চা থাকবো না, বড় হবো একসময়… তখন?”
-“হুম অবশ্যই তুমি বড় হবে। আমিও কিন্তু এই বয়সেই থেমে থাকবো না। তুমি আজীবনই আমার থেকে ৮ বছর কম ম্যাচিওর থাকবে। তাই অলওয়েজ তুমি আমার কাছে বাচ্চাই থাকবে। বুঝেছো তিতিরপাখি?”
তিতির হাসলো কোনো কথা বলল না। মুগ্ধও উত্তরের অপেক্ষায় রইলো না। বলল,
-“এবার তুমি বলোতো তোমার এসব ফিলিং আসলো কবে, কিভাবে?”
-“আমিও জানিনা। আমারও একটু একটু করেই হয়েছে। কিন্তু আপনি যেরকম ক্রাশের কথা বললেন ওরকম বলতে গেলে বলতে হবে আমি প্রথম আপনার পায়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
-“হুম খেয়াল করেছি তো। কি লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ছিলে আমার পায়ের দিকে!”
-“ইশ! ছিঃ কখনোই লোভাতুর চোখে তাকাইনি। নরমালি তাকিয়েছি। আপনি যেরকম আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন ওরকমই।”
-“হুম আমি যেন বুঝিনা!”
-“বোঝেনই না।”
-“ভাল কথা মনে পড়েছে শোনো.. তুমি রেমাক্রি গেস্ট হাউজের বারান্দায় স্যাভলন লাগাতে দিয়েছিলে না আমাকে?”
-“হ্যা।”
-“ওভাবে ভেজা চুল সরিয়ে অত সুন্দর ঘাড় কোনো পুরুষের সামনে ধরলে কি হয় জানো?”
-“কি হয়?”
-“সেই পুরুষের চরিত্র নষ্ট হয়।”
-“মানে?”
-“তখন যদি ঘাড়ে একটা চুমু দিতাম কি হত? আমি চরিত্রহীনই তো প্রমানিত হতাম।”
তিতির লজ্জায় আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে বলল,’দিলেও খুশিই হতাম যেমনটা রাতে হয়েছিলাম।’
মুগ্ধ বলল,
-“আরে বাবা বার বার সাইলেন্ট মুডে চলে গেলে তো হবেনা। এটলিস্ট ভাইব্রেশনে আসো।”
-“শুনছি।”
-“নেক্সট টাইম ভুলেও একাজ করোনা। তাহলে কিন্তু আর ছাড়বো না।”
-“নেক্সট টাইম আপনিও খালি গায়ে আর হাফ কিংবা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে আমার সামনে আসবেন না।”
-“কেন? আসলে কি তুমিও চরিত্রহীনা হবে? তাহলে আমি বার বার ওভাবে তোমার সামনে আসতে চাই।”
-“না। কিন্তু মার লাগাতে পারি।”
-“মারকে কিভাবে আদরে পরিণত করতে হয় সেটা আমি ভাল করেই জানি সুন্দরী।”
-“উফফ অন্য কথা বলুন। খেয়েছেন দুপুরে?”
-“না টেনশনে কি খাওয়া হজম হতো?”
-“যান গিয়ে খেয়ে নেন। পরে কথা বলছি।”
-“তুমি খেয়েছো?”
-“হুম। খেতে ইচ্ছে করছিলনা। জোড় করে খেয়েছি। আমার বাসায় না খেয়ে থাকা অসম্ভব। আর আমি ফিরেছি বলে বাবা দুপুরে বাসায় খেয়েছে আমাকে সাথে করে।”
-“ভাল করেছো। আমার মাও এরকম। কিন্তু অনেকদিন মায়ের সাথে বসে খাওয়া হয়না।”
-“যেতে পারেন না?”
-“যাই তো। প্রতি মাসে একবার যাই। তাছাড়া ছোট ভাইবোন দের পরীক্ষা হয়ে গেলেই বাবা ছাড়া ফুল ফ্যামিলি ঢাকায় চলে আসবে। তখন শুধু শান্তি আর শান্তি।”
-“ওদের কি পরিক্ষা? কিসে পড়ে?”
-“স্নিগ্ধর জেএসসি পরীক্ষা আর পিউ এর এইচএসসি পরীক্ষা।”
-“বাহ নামগুলো সুন্দর তো। আগে বলেননি কেন?”
-“আগে তো তুমি জিজ্ঞেস করোনি। আর এখন তো ওদের কথা অনেক বলতে হবে। বার বার ছোট ভাই ছোট বোন বলতে কেমন লাগে না? তাই নাম বলে দিলাম।”
-“ভাল করেছেন। এখন খেয়ে আসুন না প্লিজ। আমি তো আছিই.. কথাও হবে।”
-“পরে খাব।”
-“না এক্ষুনি খেতে হবে নাহলে আর একটা কথাও বলবো না।”
-“উফ কি ব্ল্যাকমেইল রে বাবা।”
-“যান না প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
-“ওকে। ১০ মিনিটে খেয়ে আসছি।”
-“হুম আপনি যান। আমি অপেক্ষা করছি।”
এরপর মুগ্ধ খেতে গেল। তিতির ফোন হাতে বসে ছিল। ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই ওদের কাজের মেয়েজে ডাকলো,
-“চম্পা, এই চম্পা…”
চম্পা এসে বলল,
-“জ্বী আফা..”
-“ভেতরে আয়।”
-“গেট লাগাইন্যা দি।”
-“ওহ দাঁড়া খুলছি।”
তিতির দরজা খুলে দিতেই চম্পা ঘরে এল। তিতির ওর ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে সব লিপস্টিক গুলো তুলে চম্পার হাতে দিয়ে হেসে বলল,
-“এগুলো এখন থেকে তোর।”
চম্পা অবাক,
-“আফা আমনের মাতার গন্ডগোল হইসে নাকি? এত দামি জিনিসগুলা আমারে দিয়া দিতাসেন যে!”
-“ওড়নার আঁচলটা মেলে ধর তো।”
চম্পা হতভম্ব হয়ে তিতিরের কথামত আঁচল মেলে ধরল। তিতির এবার মেকাপ বক্স আর নেইপলিশ গুলো তুলে ওর আঁচলে দিয়ে বলল,
-“এগুলোও তোর।”
-“আফা সব দিয়া দিতাসেন ক্যা?”
-“এগুলো তুই আমাকে রেগুলার ইউজ করতে দেখেছিস কখনো? চাচী, ফুপি আর আপুদের কাছ থেকে গিফট পেতে পেতে এত জমে গেছে।”
-“হ কিন্তু মাঝেমইধ্যে তো এগুলান লাগান দেহি।”
-“হুম। আগে মাঝেমধ্যে লাগতো। কিন্তু এখন থেকে আর মাঝেমধ্যেও লাগবে না। তাই তোকে দিয়ে দিলাম। এখন তুই যা।”
চম্পার বিস্ময় কাটছিল না। বিস্ময় নিয়েই চম্পা ঘর থেকে বের হলো, তিতির আবার দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর তিতির আবার বিছানায় শুয়ে মুগ্ধর ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কল এল। তিতির মহানন্দে ফোন ধরলো,
-“হ্যালো।”
-“হুম, খেয়েছি। এবার খুশি?”
তিতির হেসে বলল,
-“হুম খুশি।”
মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা একটা ইম্পরট্যান্ট কথা জানার ছিল।”
-“কি বলুন?”
-“নিজের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরার সাহস তুমি পেলে কোথায় বলোতো? আমার কিন্তু খুব ভয় করছিল।”
-“আমি নিজেও জানিনা। বাসায় আসার পর ভয় লেগেছে কিন্তু তখন আমার হুশ ছিলনা। সারাদিন কত খোঁজার পর পেয়েছি জানেন?”
-“হুম জানি।”
-“কি করে জানেন?”
-“তুমি বিকাল ৩ টার দিকে আমার বাসায় এসে দারোয়ানের কাছে আমার খোঁজ করেছিলে।”
-“হ্যা, কিন্তু সে বলেছে মুগ্ধ নামের কেউ ওই বাড়িতে থাকেই না। আসল ঘটনা কি? আপনি কি আসলেই ওই বাসাতে থাকেন?”
-“হ্যা।”
-“তাহলে উনি মিথ্যে বলল কেন?”
-“মিথ্যে বলেনি। আসলে আমার ফরমাল নেম হলো মেহবুব চৌধুরী। নিক নেম মুগ্ধ। তো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, অফিস সব যায়গাতে সবাই আমাকে মেহবুবই ডাকে। বাসায় যে ফ্রেন্ডদের সাথে থাকি ওদের মধ্যে দুজন ভার্সিটি ফ্রেন্ড আর একজন স্কুলফ্রেন্ড। ওরাও মেহবুব ডাকে, ভাড়াটিয়ার লিস্টেও মেহবুব চৌধুরী। তো দারোয়ান কিভাবে জানবে বলো?”
-“ও, তাহলে সে আপনাকে বলল কিভাবে আমি খুঁজতে গিয়েছিলাম? আমি তো মুগ্ধকেই খুঁজেছি।”
-“আমি বের হবার সময় ওকে বললাম আমার খোঁজে একটা মেয়ে আসতে পারে। যে মুগ্ধকে খুঁজবে। আমার ডাক নাম মুগ্ধ। যদি কেউ আসে আমার নাম্বারটা যেন দিয়ে দেয়। তখন ও বলল অলরেডি একজন এসেছিল, ও বলেছে এই নামে কেউ থাকেনা, এইতো।”
-“ওহ।”
-“জানি আরো খুঁজেছিলে। তোমার বাবার মোবাইল ঘেঁটে আমাকে কল করেছিলে কিন্তু আমার ঝাড়ি খেয়ে আর কথা বলোনি। কথা বললে কিন্তু সকালেই পেতাম। তুমি আমার কণ্ঠস্বর না চিনলেও তোমারটা আমি চিনতাম।”
-“তার মানে আমি ঠিক নাম্বারই বের করেছিলাম? ওই কর্কশ কণ্ঠী লোকটা আপনি ছিলেন?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তখন তোমাকে খুঁজছিলাম তো পাচ্ছিলাম না তাই মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে ছিল। তার উপর তুমি ফোন দিয়ে কথা বলছিলে না। তাই ঝেড়ে দিয়েছি। আই এম সরি ফর দ্যাট মাই তিতিরপাখি।”
আহ কি মিষ্টি কি মিষ্টি! তিতির বলল,
-“আমি যখন বুড়ী হয়ে যাব তখনও আপনি আমাকে এভাবেই তিতিরপাখি ডাকবেন?”
-“হুম সারাজীবন।”
-“দেখা যাবে।”
-“মানে?”
-“সবাইকে তো বলতে শুনি বয়ফ্রেন্ডরা প্রেম হওয়ার সময় অনেক কিছু বলে পরে সেগুলো ভুলে যায়।”
মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির বলল,
-“হাসছেন কেন?”
-“এমনি।”
-“হাসলে হবে না উত্তর দিন।”
-“যখন বলা বন্ধ করে দেব তখন নাহয় শাস্তি দিও।”
-“ওকে! শুনুন না আমি আপনাকে আরো খুঁজেছি। সাফি ভাইয়াকে সারাদিন কল করেছি। উনি ধরেনি, কিন্তু নিশ্চই দেখেছে কারন কল করতে করতেই ওনার ফোন অনেকবার বিজি পেয়েছি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ও তুমিও কল করছিলে? এবার বুঝেছি। আসলে আমিও ওকে কল করছিলাম। তাই তুমি যখন কল করেছো তখন আমি বিজি পেয়েছি আর আমি যখন কল করেছি তখন তুমি বিজি পেয়েছো। দেখেছো আমাদের দুজনের কি অবস্থা হয়েছিল? সেটা কি শুধু শুধুই? তুমি আমার বাচ্চাদের মা হবে বলেই তো।”
-“ধ্যাত! বলুন না সত্যি আপনিও কল করছিলেন?”
-“হুম। কারো সাথে কথা বললে ওয়েটিং দেখাতো। ওর ওয়েটিং সার্ভিস চালু করা আছে।”
-“ওহ!”
কিচ্ছুক্ষণ থেমে তিতির বলল,
-“কিন্তু এখন আরেকটা কথা বলার ছিল।”
-“বলো.. তোমার সব কথা শোনার জন্যই বসে আছি।”
-“আমি যে সেই কখন থেকে আপনি আপনি করে যাচ্ছি সেদিকে তো কারো খেয়াল নেই। একবারও তো বলল না তুমি করে বলতে।”
মুগ্ধ মজা করে বলল,
-“কে বলোতো? কার এতবড় সাহস?
-“আপনি! বুঝেও আবার ঢঙ করছে।”
মুগ্ধ হা হা করে হাসলো। তারপর বলল,
-“সিরিয়াসলি সবসময় তুমিতেই যে রোমান্টিকতা আসে তা কিন্তু না। তোমার মুখে ওই আপনিটাই আমার বেশ লাগে। তোমার ওই আপনি, শুনছেন, শুনুন এগুলো কত যে রোমান্টিক আর কত যে মিষ্টি লাগে তা তুমি বুঝবে না।”
-“তাহলে কি আমি আজীবন আপনাকে আপনি করেই বলবো?”
-“তোমার ইচ্ছে।”
-“অবশ্য হুট করে আপনি থেকে তুমি বলাটাও মুশকিল।”
-“তোমার যখন যা ইচ্ছে তুমি ডাকতে পারো। কিন্তু শুধু তুমি করে বললে, কোলে উঠলে আর জড়িয়ে ধরলেই তো হবে না। বৃষ্টিতে ভিজে যে কথাটা বলেছিলাম তার উত্তর চাই।”
-“এতকিছুর পর আবার উত্তরের কিছু বাকী থাকে নাকি?”
-“থাকে কারন, আমি উত্তরটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
তিতির লাজুক স্বরে বলল,
-“আমি বলতে পারবো না।”
-“সিরিয়াসলি, এই প্রথম শুনলাম কোন মেয়ে ঢাকা শহরের খোলা রাস্তায় নিজের বাড়ির সামনে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা পায়না কিন্তু ঘরের মধ্যে ফোনে “আই লাভ ইউ” জাস্ট তিনটা শব্দ বলতে লজ্জা পায়।”
-“হুম কারন, সবাই তিতির না।”
মুগ্ধ হেসে হেসে বলল,
-“দ্যাটস হোয়াই মুগ্ধ মার্ডারড বাই তিতির।”
তিতিরিও হেসে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা ফোর্স করবোনা। কিন্তু অপেক্ষা করবো।”
এভাবেই শুরু হয়েছিল এই দুই প্রেমাতালের একসাথে পথচলা। পাঁচ বছর কেটে গেলেও তিতিরের মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। সব স্পষ্ট কানে বাজে আজও। রাস্তায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল তিতির।
আজ ওরা দুজন দুজনের থেকে আলাদা। কোন যোগাযোগ নেই, দুজনের ফোন নাম্বার দুজনের কাছে থাকলেও কথা হয়না। দেখা হয়না প্রায় ৭ মাস হতে চললো। খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে তিতির। মেনে নিয়েছে মানুষের জীবনের সব চাওয়া পূরণ হয়না। প্রতি রাতে কাঁদে সকালে উঠে সেই কান্নার সৎকার করে প্লাস্টিক একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয় সারাদিন। এই রুটিনে বেশ মানিয়ে গেছে তিতির। মানিয়ে গেছে মুগ্ধও কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মুগ্ধ ফোন করে, মাসে হয়তো একবার। যখন মুগ্ধ আর কোনভাবেই নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনা তখনই ফোন করে কিন্তু ওর ওই একটা ফোনকল তিতিরের সব ওলট পালট করে দেয়। পাগলের মত হয়ে যায়। না পারে মুগ্ধর কাছে যেতে না পারে ওকে ছাড়া থাকতে আর না পারে মরে যেতে। যেন হাজার হাজার বিষলতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ওকে। আর সেই বিষলতা গুলো থেকে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে আসা হাজার হাজার বিষপোকা তাদের সূঁচালো ঠোঁট দিয়ে খুবলে খুবলে রক্তাক্ত করে ফেলে ওর ভেতরটা। কাল রাতে মুগ্ধ ফোন করার পর তিতিরের আবার সেই অবস্থাই হয়েছে। আরো বেশি পাগল পাগল লাগছে গানটা শুনে.. “ভাল আছি ভাল থেকো।”
হঠাৎ তিতিরের মাথাটা ঘুরে উঠলো। সামনের সবকিছু অন্ধকার আর আবছা হয়ে আসলো। তরতর করে ঘামতে লাগলো। বড্ড রোদ উঠেছে নাকি? কত হবে তাপমাত্রা? কাল যেন কত ছিল? ৪০ ডিগ্রি ছিলনা? নাকি ৪২? মনে করতে পারছিলনা তিতির। পা ভেঙে আসছিল। গায়ের সব শক্তিগুলো কোথায় গেল? দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না কেন? ও প্রানপণে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কোন রাস্তায় আছে? কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুটপাতে লুটিয়ে পড়ে।
মুগ্ধ চোখ খুলে রাখতে পারছেন। ঘুমের জন্য না। চোখদুটো প্রচন্ড জ্বলছে তাই। গতকাল তিতিরের সাথে কথা হওয়ার পর সারারাত আর ঘুমাতে পারেনি। ফোন না দিয়েই বা কোথায় যাবে? মন তো আর সবসময় এত বাধা মানতে চায়না। নিঃশ্বাসটা আটকে যায় মাঝে মাঝে। স্নিগ্ধ, পিউ আর মায়ের দায়িত্ব ওর উপর না থাকলে আল্লাহ কে বলতো নিঃশ্বাসটা যেন সারাজীবনের জন্য বন্ধ করে দেয়। এখন তাও পারেনা। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে সাময়িকভাবে সবকিছু থেকে একটু দূরে থাকা যায়। কিন্তু দুদিন ধরে অফিসে কাজের চাপ কম। তাই এখন ব্যস্থতাও নেই তিতিরের স্মৃতির হাত থেকে রেহাইও নেই।
লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। পিয়ন এসে লাঞ্চের জন্য ডেকে গেছে অনেকক্ষণ আগে। মুগ্ধ উঠলো। ফোন ওয়ালেট পকেটে ঢুকালো। প্রায় সাথেই সাথেই ফোনটা বেজে উঠলো। তিতির! তিতির ফোন করেছে! কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব।গত ৭ মাসে তিতির একটাবারও ফোন করেনি ওকে। ফোন রিসিভ করলো। না তিতির নয় একাটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে এল ওপাশ থেকে,
-“হ্যালো।”
-“হ্যালো।”
-“মুগ্ধ বলছেন?”
-“ইয়েস। আপনি কে? এটা তো তিতিরের নাম্বার।”
-“দেখুন ভাইয়া, আমি ওনার নাম জানিনা। উনি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। তাই ওনার ব্যাগ ঘেটে ফোনটা বের করতে বাধ্য হয়েছি। ফোন লক করা আর ইমারজেন্সি কল লিস্টে কেবল আপনার নাম্বারটাই পেলাম তাই আপনাকে কল করলাম।”
তিতির রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে এই সেনটেন্সটাই যথেষ্ট ছিল মুগ্ধর ভেঙে পড়ার জন্য। কিন্তু মুগ্ধ ভেঙে পড়েনি। কঠিন সময়ে স্টেবল থাকার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দিয়েছে। স্বাভাবিক স্বরে
-“ওহ ওকে ওকে! কোথায় আছেন?”
-“বনানী, চেয়ারম্যান বাড়ি।”
-“ভাই, আমার ১০-১৫ মিনিট লাগবে। আপনি কি ততক্ষণ একটু থাকবেন ওর পাশে?”
-“শিওর। আপনি আসুন।”
অফিস থেকে বের হতে হতেই মুগ্ধ চিন্তা করছিল, তিতির এখানে কি করছে? ওর বাসা, ইউনিভার্সিটি সবই তো ধানমন্ডিতে। তবে কি মুগ্ধর কাছেই এসেছিল?
১৫ মিনিট লাগলো মুগ্ধর অফিস থেকে আসতে। দূর থেকেই দেখতে পেল তিতিরকে। দেখামাত্রই এক দৌড়ে চলে গেল ওর কাছে। একটা মেয়ের কোলে ওর মাথাটা রাখা। আশেপাশে কয়েকটা ছেলে আর একজন বুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছে। নার্ভাস লাগছে, তিতিরকে কখনো এভাবে দেখেনি ও। ওদের কাছে গিয়ে বলল,
-“স্কিউজমি, আমিই মুগ্ধ।”
একটা ছেলে বলল,
-“আমি শ্রাবন। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। এইযে ওনার ফোন।”
মুগ্ধ ফোনটা নিয়ে তিতিরের পাশে বসতেই ছেলেটি বলল,
-“ভাইয়া উনি পুরোপুরি সেন্সলেস হননি। অন্য কোনো প্রব্লেম হয়েছে তাকাতে পারছিলনা আর কথাও বলতে পারছিলনা। ওনার চোখেমুখে পানি দেয়া হয়েছে। পানি খাওয়ানোও হয়েছে। কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি। তারপর আর চোখ খোলেনি।”
-“ওকে আমি ওকে আশেপাশে কোনো হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।”
-“ইটস ওকে ব্রাদার! চোখের সামনে এরকম দেখে এটুকু না করে পারা যায়না। আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
-“হ্যা।”
মুগ্ধ একটা সিএনজি ডেকে তিতিরকে নিয়ে উঠলো। শ্রাবন ছেলেটা বলল,
-“ভাইয়া আমরা ওনার খবর পাবো কিভাবে?”
মুগ্ধ ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিয়ে বলল,
-“থ্যাংকস এগেইন।”
-“ইটস ওকে! টেক কেয়ার অফ হার।”
সিএনজি ছাড়তেই মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের সাথে হেলান দিয়ে শোয়ালো। তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বিদ্ধস্ত হয়েছে চেহারা। মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচটা কিছুটা কালো হয়েছে। ওর ফ্যামিলির মানুষগুলোর কি এগুলো চোখে পড়েনা? তিতির একটু তাকানোর চেষ্টা করলো। দুইতিন সেকেন্ড তাকিয়েই ওর চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল আবার। মুগ্ধ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল কাছের একটা ক্লিনিকে।
ডাঃ তিতিরকে দেখে বলল,
-“ওনার প্রেশার লো হয়ে এরকম হয়েছে। আর উনি বোধহয় রাতে ঘুমায়না একদমই, খাওয়াদাওয়াও ঠিকমত করেনা। শরীর খুব দুর্বল। তবে চিন্তা করবেন না, ওনার জ্ঞান আছে। কে হন আপনি ওনার?”
-“বয়ফ্রেন্ড।”
-“ঝগড়া হয়েছিল নাকি?”
-“না।”
-“তাহলে ওনার ডিপ্রেশন টা কিসের?”
-“একচুয়েলি ওর ফ্যামিলি আমাদের সম্পর্কটা মানেনি। তাই নিয়েই বোধহয় ও আপসেট।”
-“বোধহয় মানে? আপনি ঠিকমতো জানেনও না? ফ্যামিলি বয়ফ্রেন্ড সবাই মিলে কেয়ারলেস হলে তো এমন হবেই।”
-“ডক্টর, আমাদের ৭/৮ মাস ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল, রাস্তার লোকজন ওর মোবাইলের ইমারজেন্সি কল লিস্টে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করে তখন আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। যোগাযোগ না রাখলে কি করে কেয়ার করবো বলুন?”
ডাঃ কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কি ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বলল,
-“আমি ওনাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি, দুএক ঘন্টা ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। আর কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ভিটামিন। রেগুলার খেতে বলবেন।”
ইনজেকশন দেয়ার সময় ও একটু ব্যাথা পেয়ে কুঁকড়ে গেল। একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কোনো কথা বলতে পারল না। তিতিরের এমন নিথর দেহ আর নিস্তেজ মুখটা সহ্য করতে পারছিল না মুগ্ধ। বলল,
-“ডক্টর আমি ওকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”
-“ওনার তো ঘুম দরকার।”
-“হুম বাসায় গিয়ে ঘুমাবে।”
-“আচ্ছা নিয়ে যান।”
পিউ দরজা খুলেই অবাক। বলল,
-“ভাবী! ভাইয়া, ভাবীকে কোথায় পেলি? কি হয়েছে ওর?”
মুগ্ধ তিতিরের ঘুমন্ত মাথাটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ওর হাতগুলো ঝুলছিল। এই দৃশ্যটা পিউ নিতে পারছিল না। মুগ্ধ ভেতরে ঢুকতেই পিউ আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বলনা ভাবীর কি হয়েছে? অজ্ঞান হয়ে গেছে?”
-“প্রেশার লো হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিল।”
-“তারপর? তুই পেলি কিভাবে?”
মুগ্ধ পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল পিউকে। তারপর বলল,
-“ওকে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তাই ঘুমাচ্ছে।”
মুগ্ধ তিতিরকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। শুইয়ে দিল বিছানায়। পিউ গেল পিছন পিছন। মুগ্ধ পিউকে জিজ্ঞেস করলো,
-“মা বাসায় নেই?”
-“না।”
-“কোথায় গেছে?”
-“ইকরাপুদের বাসায় গেছে। চলে আসবে।”
-“স্নিগ্ধ?”
-“কলেজে।”
-“কলেজ ছুটি হয়েছে ২ টায়। এখন সাড়ে ৩ টা বাজে। এখনো কলেজে কি?”
-“ভাইয়া, ওদের কলেজে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে তো তাই।”
-“ও। তুই কোথাও যাচ্ছিস নাকি?”
-“হ্যা ভাইয়া, ক্লাস আছে।”
-“যা তাহলে।”
-“ভাবীকে কি একটু পরেই বাসায় দিয়ে আসবি?”
-“ঘুম থেকে উঠলে দিয়ে আসব।”
-“ইশ! আমার ফিরতে ফিরতে রাত হবে। ওর সাথে একটু কথাও বলতে পারলাম না।”
-“কথা বলে আর কি হবে? যে সারাজীবন দূরে থাকবে সে দূরেই থাক।”
পিউ কি বলবে! শান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা ওর নেই। তিতিরের অবস্থা দেখে ওর নিজেরই বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পরীর মত মেয়েটা কেমন হয়েছে দেখতে! তার উপর বড় ভাই। চুপ করেই থাকলো। মুগ্ধ বলল,
-“ক্লাসে যা। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি আছি, আজ আর অফিসে যাবনা।”
-“আচ্ছা। ভাইয়া তুই কি লাঞ্চ করেছিলি? নাহলে ভাত দেই তোকে?”
-“করেছি।”
-“আচ্ছা, যাচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে দে।”
পিউ চলে গেল। মুগ্ধ আবার এসে বসলো তিতিরের পাশে। তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঘুমের জন্য যাকে আদর করে ঘুমকুমারী ডাকতো আজ সে নাকি প্রয়োজনীয় ঘুমটুকুও ঘুমায় না। মুগ্ধর ইচ্ছে করছে তিতিরকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতে। আচ্ছা এমন কোনো মন্ত্র যদি থাকতো বুকে জাপ্টে ধরে মন্ত্রটা পড়লেই প্রিয়জনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।তাহলে ও আজ সারাদিন সেই মন্ত্রটা পড়তো।
কত সুন্দর করে কেটে গিয়েছিল ওদের ৪টা বছর। যেন স্বপ্ন! হঠাৎ করেই প্রপোজ করেছিল.. আর তিতির ইন্সট্যান্ট রিপ্লাই দিয়েছিল জড়িয়ে ধরে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল এই স্বপ্নটা। সকালে যখন মুগ্ধ অফিসে যেত তিতির তখনো ঘুমে। যেদিন ওদের সম্পর্কটা হয়েছিল তার পরের দিন সকালের ঘটনা,
তিতির ঘুমিয়ে আছে। ফোনটা বেজেই চলেছে। চোখ না খুলেই ফোন হাতরে কোনোরকমে কানের কাছে ধরে হ্যালো বলল। সেই হ্যালো টা মুগ্ধর বুকে একটা ফুলের টোকা দিয়েছিল। মুগ্ধ বলল,
-“আমার ঘুমকুমারী এখনো ঘুমাচ্ছে?”
-“হুম আমার স্কুল কলেজ সব সকালে ছিল। ঘুমাতে পারিনি। প্লিজ ঘুমাতে দাওনা।”
আবার সেই ঘুম মাখানো কণ্ঠস্বর। সবগুলো শব্দ যেন একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে। বেশ লাগছে শুনতে। বান্দরবানে যখন ওকে রেমাক্রিতে সূর্যোদয় দেখাতে নিয়ে যাবে বলে ঘুম থেকে ওঠাচ্ছিল তখনও এভাবেই কথা বলেছিল তিতির। কিন্তু এখন একটু অন্যরকম লাগছে কেন? বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেছে বলে বেশি আহ্লাদ করছে নাকি? তারপর আচমকাই মুগ্ধর খেয়াল হলো তিতির ওকে তুমি করে বলেছে। এটাই ডিফারেন্স। বাহ! ওর মুখে আপনি তুমি সবই কেন এত ভাল লাগে! মুগ্ধ বলল,
-“এত সিডাক্টিভলি কথা বললে কিন্তু তোমার ঘরে চলে আসব।”
-“আচ্ছা আসো।”
মুগ্ধর হাসি পেল। ও কি ঘুমের ঘোরে থেকেই কথা বলছে এখনো! তা নাহলে তো এধরণের রিপ্লাই না দিয়ে উলটো লজ্জা পেত। মুগ্ধ বলল,
-“আসলে কিন্তু….”
মুগ্ধ কিছু বলার আগেই তিতির বলল,
-“আদর দিতে হবে কপালে বান্দরবানের মত করে। কিন্তু আমি উঠবো না।”
-“ওরে দুষ্টুটা! তুমি জেগে ছিলে?”
-“হ্যা তো। আমি তোমার কোলে চড়ার জন্য ঘুমের ভান করেছিলাম।”
-“ফাজিল মেয়ে, যাও তোমাকে আর কোলেই নিব না।”
তিতির নগদ কান্না করে দিল।
-“অ্যাআআআআ… আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে সারাজীবন কোলে নিবা। আমার ফ্রেন্ডরা ঠিকই বলেছিল। ছেলেরা বয়ফ্রেন্ড হওয়ার পর বদলে যায়।”
কান্না শুনে মুগ্ধ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল,
-“আরে না পাগলী। নিব নিব।”
-“না নিবানা। আমি বুঝে গেছি। প্রমাণ তো পেয়েই গেছি। কাল সন্ধ্যায় কোলে চড়ার লোভেই তো আমি তোমাকে রাস্তার মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে আমাদের নিউ বর্ন রিলেশনশিপ সেলিব্রেট করবে। কিন্তু তুমি করোনি। ফোন নাম্বার নিয়ে ভেগে গেছো। এখন আমার কি হবে! অ্যাআআআআআ।”
মুগ্ধ হাসতে হাসতে কুটিকুটি হলো। তিতির বলল,
-“আমি কাঁদছি আর তুমি হাসছো! তুমি পচা।”
-“সরি বাবা। তুমি কান্না করোনা প্লিজ। সত্যি আমার এমনটাই ইচ্ছে করছিল। আই সয়ার, যদি এটা তোমার বাসার সামনে না হয়ে অন্য যেকোনো যায়গা হতো আমি এটাই করতাম। দেখোনি বান্দরবানে আমি তোমাকে কারনে অকারনে কতবার কোলে নিয়েছি? কোলে নিতে তো আমার ভাল লাগে। কিন্তু কাল আমার ভয় করছিল যদি তোমার বাসার কেউ দেখে ফেলে!”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“না না না। এসব কথায় আমি ভুলবো ন।”
-“আচ্ছা যাও। আমাদের বিয়ের পর যখন তোমাকে বাসায় নিয়ে আসব। তখন গাড়ি থেকে নামিয়ে আর এক পা হাঁটাবো না তোমাকে। যত উপরেই হোক না কেন তোমাকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাব।”
-“প্রমিস?”
-“প্রমিস!”
-“যদি আমি মোটা হয়ে যাই তবু নিবে?”
-“হ্যা নিব। আমার তিতিরপাখিকে নিবনা কাকে নিব বলো?”
-“কেন তোমার বেবিদের নিবে না? কালকেই না বললে বেবিদের তুমিই কোলে কোলে রাখবে। আমাকে নিতে হবে না। দুইজনকে নাকি একসাথেই কোলে নিতে পারবে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা.. ওদেরকেও নিব। কিন্তু ২ টার পরের গুলোকে তোমার নিতে হবে সেটা কিন্তু ভুলে যেওনা।”
-“আচ্ছা, কিন্তু ওদের যখন নিবে তখন কি আবার আমাকে কোলে নেয়া বন্ধ করে দিবে?”
-“না তো। আমার তিতিরপাখিকে তো আমি সারাজীবন কোলে নিব। কিন্তু বেবিরা যখন ছোট থাকবে হাটতে পারবে না যতদিন ততদিন তো কোলেই রাখতে হবে তাই না? তো তখন হয়তো তোমাকে একটু কম নিতে পারবো।”
-“তাহলে তখন আমিই ওদের কোলে নিব। আর তুমি আমাকে কোলে নিও?”
মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে তুমি খুশি থাকবে তো?”
-“হ্যা.. খুউউউব।”
-“আচ্ছা, এখন বলোতো আমার ঘুমকুমারীর ঘুমটা কেন এত তাড়াতাড়ি ভাঙালাম?”
-“কেন?”
-“অফিসে যাওয়ার আগে মুখটা না দেখে যাই কি করে বলোতো?”
-“কিন্তু আমি তো এখন বের হতে পারবো না। কি বলে বের হব?”
-“বের হতে হবে না। তুমি শুধু বারান্দায় আসো। আমি তোমার বাসার সামনেই আছি। পুরোপুরি সামনে না, একটু লেফট সাইডে।”
তিতির লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। দৌড়ে গেল বারান্দায়। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে অপজিটের ফুটপাতে। ফুল ফরমাল, গ্রে কালারের শার্ট ব্ল্যাক প্যান্টের সাথে ইন করা, ব্ল্যাক টাই, সানগ্লাস, কানে ফোন। এই প্রথম ওকে ফরমাল দেখছে। উফফফ এত মারাত্নক লাগছে মুগ্ধকে। ওকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলে হাসলো।
মুগ্ধও তিতিরকে দেখছিল মুগ্ধ চোখে। হোয়াইট স্লিভলেস টি-শার্ট পড়ে আছে। চুলগুলো মারাত্মকভাবে এলোমেলো। চোখে ঘুম। কানে ফোন। মুগ্ধকে দেখেই হাসলো।
মুগ্ধ বলল,
-“ম্যাম আপনি এলোচুলে আমার সামনে দয়া করে আসবেন না। আমার প্রব্লেম হয়।”
-“কি প্রব্লেম?”
-“ওহ.. ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাকে তো আবার সব ডিরেক্টলি বলতে হয়। আচ্ছা পরে বলবো। আজ বেশি সময় নেই।”
-“আচ্ছা।”
-“থাক এখনি শোনো, এলোচুলে তোমাকে অনেক আবেদনময়ী লাগে।”
-“আবেদনময়ী মানে যেন কি? আমি বাংলায় একটু উইক আছি।”
-“হায়রে! তোমাকে সেক্সি লাগে। যতই চাইলাম সেক্সি ওয়ার্ডটা স্কিপ করতে তুমি বলিয়েই ছাড়লে।”
কি লজ্জাটাই যে তিতির পেয়েছিল! আর কোনো কথা বলতে পারেনি। তারপর দুপুর ১২ টায় ফোন করে বলল,
-“এই আপনি কি সকালে আমার বাসার সামনে এসেছিলেন? নাকি আমি স্বপ্নে দেখেছি? কল লিস্টে দেখলাম ২০ মিনিটের মত কথা বলেছি কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না।”
-“স্বপ্ন না, গিয়েছিলাম।অফিসে আসার আগে বউয়ের মুখটা একবার দেখে না আসলে হয়? আজ তো ক্লাসও আছে, ফিরতে ফিরতে রাত!”
-“ও। আমি কি খুব উল্টোপাল্টা কিছু বলেছি? আসলে ঘুমের ঘোরে আমি অনেক হাবিজাবি বকি।”
মুগ্ধ হাসলো। তারপর বলল,
-“না উল্টোপাল্টা কিছু বলোনি। যা বলেছো ভালই বলেছ। মনে না থাকলে আমি রাতে ফিরে তোমাকে বলব।”
-“আচ্ছা। অফিসে থাকতে ফোন করা যাবেনা?”
-“হুম যাবে। বাট অনেকক্ষণ কথা বলা যাবে না। আমি তোমাকে লাঞ্চ টাইমে ফোন করবো। এখন রাখি?”
-“আচ্ছা।”
রাতে বাসায় ফিরে সব বলতেই তিতির খুব লজ্জা পাচ্ছিল আর অস্বীকার করেছিল যে ও এসব বলেনি। মুগ্ধ তাতেও মজা পেয়েছিল। তিতিরের সব খুঁটিনাটি বিষয়কে ঘিরেই ছিল মুগ্ধর আনন্দ।
ওদের সম্পর্ক তখন ৪ মাস চলছিল। তিতির পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়নি। প্রাইভেটেই ভর্তি হয়েছে। ওদিকে মুগ্ধর মাস্টার্স কম্পলিট হয়ে গেছে। তখনই মুগ্ধ আগের চাকরিটা ছেড়ে এখনকার চাকরিটায় জয়েন করেছিল। আগের অফিস ধানমন্ডিতেই ছিল। এখনকারটা বনানী। ধানমন্ডি থেকে বনানী অফিস করাটা ডিফিকাল্ট লাগলেও মুগ্ধ বাসা চেঞ্জ করেনি কারন এখানে তিতির আছে। এখান থেকে চলে গেলে যখন তখন তিতিরের সাথে দেখা করাটা এতটাও ইজি হবে না।
তখনকারই একটা দিন মুগ্ধ কেবল অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েছে। এমন সময় তিতিরের ফোন,
-“হ্যালো।”
-“হ্যা তিতিরপাখি বলো।”
-“বাসায় ফিরেছো?”
-“হ্যা, একটু আগেই। তুমি কোথায়?”
-“ভার্সিটিতে।”
-“এখনো? সন্ধ্যা হয়ে গেল তো। আবার বৃষ্টিও তো নামলো।”
-“হ্যা, একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে ছিল। সবাই মিলে একটু সেলিব্রেট করছিলাম।”
-“ও।”
-“এই শোনোনা, তুমি কি অনেক টায়ার্ড?”
-“না তো। কেন তুমি জানোনা তোমার বাচ্চাদের বাবা একটুতেই টায়ার্ড হয়না?”
-“উফ আবার শুরু হয়ে গেছে!”
-“রেগে যাচ্ছো কেন? বাচ্চাদের বাবা অন্য কাউকে বানানোর ইচ্ছে আছে নাকি?”
তিতির হেসে বলল,
-“কামড় দিব কিন্তু।”
-“দাওনা প্লিজ। তোমার কামড়ে অন্তত তোমার ঠোঁটের ছোঁয়াটা পাওয়া যায়। চুমু তো আর দাওনা।”
-“এই রাখলাম। কি বলতে ফোন করেছি তা শোনার নাম নেই যত হাংকিপাংকি কথা বলে চলেছে।”
-“আচ্ছা সরি সরি। বলোনা কি বলবে।”
-“বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে।”
-“ভেজো। তবে বাসায় এসে। রাস্তা দিয়ে একা একা ভিজতে ভিজতে এসোনা।”
-“উঁহু। তোমার সাথে ভিজতে ইচ্ছে করছে।”
-“ও। তুমি তাহলে ভার্সিটিতেই থাকো। আমি আসছি।”
মুগ্ধ একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো। মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে এখন। ১০ মিনিটে রিক্সা তিতিরের ভার্সিটির সামনে গিয়ে থামতেই তিতির দৌড়ে এল। মুগ্ধ সরে বসলো। তিতির রিক্সায় উঠতেই মুগ্ধ রিক্সাওয়ালাকে বলল,
-“মামা চালাও। ১১ নাম্বার রোডে খালি যাইয়ো না। আর যেদিকে তোমার মন চায় যাও।”
রিক্সা চলতে শুরু করলো। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। ভিজে দুজনে চুপচুপে হয়ে গেছে। মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তিতির লাফিয়ে উঠলো। পড়েই যাচ্ছিল, মুগ্ধ ধরে ফেলল,
-“এত লাফালাফির কি আছে?”
-“সুড়সুড়ি লাগে। ধুরো ছাড়ো না।”
-“সিরিয়াসলি? ছাড়লে খুশি হবে? সত্যি তো?”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“না, কিন্তু ওভাবেও জড়িয়ে ধরোনা প্লিজ। নরমালি ধরে রাখো।”
মুগ্ধ ওর কথামত আলগাভাবে ধরলো। তারপর তিতিরের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-“আই লাভ ইউ।”
-“হুম, জানি।”
-“আমি আজও উত্তরটা পেলাম না।”
-“সময় হলেই পাবে।”
মুগ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আল্লাহ সেই দিনটা আমি জীবিত থাকতেই দেখিও।”
তিতির মুগ্ধর হাতটা নিয়ে একটা কামড় দিল। মুগ্ধ ফিসফিস করে বলল,
-“একদিন তো একটা চুমু দিলেও পারো। সবসময় কামড়ই দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।”
তিতির সেকথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
-“তোমাকে না আমি একদিন নিষেধ করেছি থ্রি-কোয়ার্টার পড়ে আমার সামনে আসবেনা।”
-“পড়ে দেখেছি। কিছুই হয়না তাই আবার পড়েছি। আর তুমিই বলো বৃষ্টিতে ভিজে একটা ফুল প্যান্ট নষ্ট করা কি ঠিক?”
-“তোমার সাথে কথা বলাটাই বৃথা।”
মুগ্ধ আর এই অহেতুক বিষয়ে কথা বাড়ালো না। বলল,
-“তোমাকে কি এখন কিছুতেই বিয়ে দেবে না?”
-“না। স্টাডি শেষ হওয়ার আগে তো অসম্ভব।”
-“মা আজও বিয়ে কর বিয়ে কর বলছিল। আমার এক কাজিন আমাকে অনেক পছন্দ করে। ও এমনভাবে মায়ের মাথা খেয়েছে যে মা ওকেই বিয়ে করতে বলছে।”
তিতির আতঙ্কিত স্বরে বলল,
-“মানে?”
মুগ্ধ দেখল তিতিরের চোখে পানি এসে পড়েছে। সেকেন্ডের মধ্যে মুখটা লাল হয়ে গেল। মুগ্ধ ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এই পাগলী! কাঁদছ কেন? বললেই কি আমি বিয়ে করছি নাকি? আমার উপর বিশ্বাস নেই?”
তিতির একটা কথাও বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“আমি এমনিতেই ওকে পছন্দ করিনা। ইভেন হেট করি। তুমি না থাকলেও আমি আর যাই হোক ওকে বিয়ে করতাম না।”
-“ওর নাম কি?”
-“ইকরা।”
-“কেমন কাজিন তোমার?”
-“ফুপাতো বোন।”
-“ওর নাম্বার কি তোমার মোবাইলে ‘প্যারা’ লিখে সেভ করা?”
-“হ্যা। তুমি কি করে জানলে?”
-“সরি আমি তোমার পারমিশন ছাড়া তোমার মোবাইল ধরেছিলাম আর মেসেজ পড়েছিলাম।”
-“আরে ধুর পাগলী। কিসের সরি? যা আমার তা তোমারও। আমার কোনো জিনিস ধরার জন্য তোমার পারমিশন নিতে হবে না। তাছাড়া, আমার জীবনে সিক্রেট বলে কিছু নেই যা তোমার কাছে লুকাতে হবে।”
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“যাই হোক, বাদ দাও ওর কথা। আসল কথা বলি। মা যখন ওকে বিয়ে করার কথা বলছিল তখন আমি মাকে তোমার কথা বলে দিয়েছি।”
তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
-“বলার পর মা বলল, ‘তাহলে তো হলোই। চল বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাই।’ আমি বললাম, ‘মা তিতির খুব বাবু একটা মেয়ে। ওর ফ্যামিলি এখনই ওকে বিয়ে দেবে না।’ তারপর মা কতক্ষণ আফসোস করলো এতদিন পর মেয়ে একটা পছন্দ করেছি তাও এত ছোট! আরো কত কি! তারপর বুচ্ছো পিউকে ফেসবুকে তোমার ছবি পাঠিয়ে বলেছি মাকে দেখাতে। তোমার ছবি দেখে মা পুরো পাল্টি খেল।”
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-“পছন্দ করেনি না? তুমি যে কেন ছবি পাঠাতে গেলে? ছবিতে আমাকে আরো ছোট ছোট লাগে। কোন ছবিটা পাঠিয়েছো?”
যেই ছবিই পাঠাই না কেন মা ছবি দেখে বলেছে, ‘মুগ্ধ তুই এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছিস বাপ। ছোট হয়েছে তো কি হয়েছে? ওর বিয়ের বয়স হতে হতে হয়তো তোর ৩০/৩২ বছর হয়ে যাবে তাতে কি! পুরুষ মানুষের বয়সে কি আসে যায়?”
কথা শেষ হতেই মুগ্ধ হো হো করে হেসে দিল। তিতিরের আতঙ্ক কমেছে, ও তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ বলল,
-“আমার মা বুচ্ছো পুরা একটা সিনেমার ক্যারেকটার। তার ব্যাবহারে তোমার মনে হবে যে সে তোমারই বয়সী। একদম বাচ্চাদের মত করে। মা আরো কি বলেছে জানো? বলেছে, ‘আগে তোর পছন্দ করা একটা মেয়েকেও আমার ভাল লাগেনি। এই মেয়েটা একদম হিরার টুকরা। কোথায় পেলি?’ হা হা হা মা পারেও।”
-“সত্যি আন্টি আমাকে পছন্দ করেছে?”
-“কি বললে?”
-“কি বলেছি?”
-“আমার মা তোমার আন্টি হয়? এক থাপ্পড় মারবো, মা বলো।”
তিতির মুগ্ধর আরো কাছে এসে ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এই বলোনা, মা আমাকে পছন্দ করেছে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হুম, খুব।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“এত পছন্দ করেছে যে তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। সামনাসামনি দেখতে চায়।”
-“মা যেন কবে ঢাকায় আসবে?”
-“সামনের মাসেই তো পিউ এর পরীক্ষা। পরীক্ষা হয়ে গেলে পিউকে নিয়ে সবাই আসবে। আমাকে আর পিউকে নতুন বাসায় তুলে দিয়ে মা-বাবা স্নিগ্ধকে নিয়ে চলে যাবে। স্নিগ্ধর পরীক্ষা পর্যন্ত বাবা-মা ওখানেই থাকবে। পরীক্ষা শেষ হতেই মা স্নিগ্ধকে নিয়ে পার্মানেন্টলি চলে আসবে। বাবা ট্রান্সফার পেলে আসবে নাহলে ওখানেই থাকবে।”
-“ও। তখন তুমি ধানমন্ডি ছেড়ে চলে যাবে না?”
-“তো কি? যখন বলবে তখনই বান্দা হাজির হয়ে যাবে।”
তিতির হেসে বলল,
-“আমি জানি।”
-“তিতির জানো মা বলছিল তোমাকে চিটাগাং নিয়ে যেতে। যদি সম্ভব হতো সত্যি তোমাকে নিয়ে যেতাম। ইশ! নাভাল রোডের কাঁকড়া ফ্রাই! পতেঙ্গা রোডের বাইকরাইড সবকিছু যেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!”
-“সম্ভব না কেন?”
-“মানে? সম্ভব না কেন তুমি জানো না?”
-“কেন?”
-“বাসায় কি বলে যাবে তুমি?”
-“বলবো ট্যুরে যাচ্ছি।”
-“সিরিয়াসলি?”
-“হ্যা! কিন্তু এভাবে বিয়ের আগেই তোমাদের বাসায় চলে গেলে কেউ আমাকে খারাপ ভাববে না তো?”
-“কে খারাপ ভাববে? আমার মা? বললাম না আমার মা কেমন? একটু বোকাসোকা। কিন্তু পাগল একটা। তোমাকে ভাল লাগলে তোমার জন্য জান দিয়ে দেবে।”
-“আর বাবা?”
-“বাবার সময় কোথায় কিছু ভাবার? আর আমি বাবার সাথেও ফ্রি। নো প্রব্লেম তিতিরপাখি। তাছাড়া তুমি তো আর আমার সাথে থাকবে না। পিউ এর সাথে থাকবে। কিন্তু তুমি কি সত্যি যেতে পারবে?”
-“পারবো।”
-“তাহলে পরশুই চলো। আমিতো এমনিতেই পরশু যাব বলেছিলাম না তোমাকে?”
-“ও হ্যা। আচ্ছা, আমি আজ রাতেই তোমাকে কনফার্ম করছি।”
-“ওকে। ওই মামা রিক্সা এইখানেই থামাও।”
তিতির বলল,
-“এটা তো ১০ নাম্বার।”
মুগ্ধ ভাড়া দিতে দিতে বলল,
-“এত পাক্নামি করো কেন? নামো রিক্সা থেকে।”
তিতির নামলো। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে ১০ নাম্বার রোডে ঢুকলো। তিতির পানিতে হাটবে বলে স্যান্ডেল খুলে ফেলল। তারপর স্যান্ডেলের ফিতাটা আঙুলের সাথে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-“দেখেছো বৃষ্টি আরো বেড়েছে। আজ বাসায় ফিরতেই ইচ্ছে করছে না।”
-“রাস্তাঘাটে মানুষজন এত কম কেন জানো? বৃষ্টির জন্য! আর তুমি কিনা বৃষ্টির জন্য বাসায় যেতে চাচ্ছো না?”
তিতির মুগ্ধর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
-“হুম আমার তো বৃষ্টি আর মুগ্ধকে একসাথে খুব ভাল লাগে।”
-“রিয়েলি? আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের নাম কিন্তু বৃষ্টি ছিল।”
তিতির অবাক চোখে তাকালো মুগ্ধর দিকে। বলল,
-“তোমাকে বলেছিনা তুমি তোমার এক্স হিস্ট্রি আমাকে শোনাতে আসবে না?”
-“আমি কোথায় বললাম? তুমিই তো বললে!”
তিতিরের এক হাতে স্যান্ডেল আরেক হাতে ব্যাগ থাকায় মারতে পারলো না। কিন্তু ঠিকই তেড়ে এসে কামড়ে দিল মুগ্ধর হাতে। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি তিতিরকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। কয়েক পা হেঁটেই মুগ্ধ বলল,
-“আমি তোমাকে কোলে নিব বলেই রিক্সা ছেড়ে দিয়েছি। বুঝেছ তিতিরপাখি?”
তিতির কিছু না বলে শুধু হাসলো। কিছুদূর যেতেই একটা পুলিশের গাড়ি দেখা গেল। ভেতর থেকে একটা পুলিশ ডাক দিল,
-“এইযে হিরো? এটা কি সিনেমা করার যায়গা? দিস ইজ পাবলিক প্লেস!”
তিতির আস্তে আস্তে বলল,
-“এই আমাকে নামিয়ে দাও।”
মুগ্ধ বলল,
-“চুপ করে খালি দেখে যাও। প্রয়োজনে আমার কথায় তাল মেলাবে।”
মুগ্ধ গাড়িটার কাছে গিয়ে বলল,
-“সরি স্যার। ও বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, হাটতে পারছে না। তাই কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি। সামনেই আমাদের বাসা।”
পুলিশ বলল,
-“ও, আচ্ছা যান তাহলে।”
-“থ্যাংকস।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়েই আবার ব্যাক করলো। গাড়িটা স্পীডে চালিয়ে চলে যেতেই ওরা দুজনে হেসে দিল। তিতির বলল,
-“ইউ আর জিনিয়াস!”
-“তো কি? ওদের ভয়ে আমি তোমাকে কোল থেকে নামাবো নাকি? ধুর ওদের পাত্তা দেয় কে?”
-“বাহ রে! এখন পার্ট নেয়া হচ্ছে? খুব তো স্যার স্যার করছিলে!”
-“স্যার স্যার করিনি। স্যার বলে সম্বোধন করেছি। ওটা ভদ্রলোকেরা করে।”
১০ নাম্বার রোড শেষ হতেই মুগ্ধ তিতিরকে নামিয়ে বলল,
-“কিন্তু এবার নামাতেই হবে। বাকিটা আমাদের আলাদা যাওয়া উচিৎ।”
তিতির কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
-“ধরা পড়লে খবর আছে। অনেক বেশি সাহস দেখাই আমরা। আসলে আমাদের ধানমন্ডির মধ্যেই দেখা করা উচিৎ না।”
-“হুম, বাসায় যাও এখন তাহলে। এত বেশি বৃষ্টিতে ভিজলে আবার ঠান্ডা লাগবে।”
তিতির মুগ্ধকে বিদায় জানিয়ে হাটতে শুরু করলো। মুগ্ধ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তিতির ৭/৮ পা গিয়েই দৌড়ে ফিরে আসলো। মুগ্ধ বলল,
-“কি?”
তিতির মুখে কিছু বলল না, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো লোকজন নেই। স্যান্ডেল আর ব্যাগ হাত থেকে ফেলে দিল। তারপর আচমকা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরে সামলে নিল। তারপর নিজেও জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর তিতির ওকে ছেড়ে নিচু হয়ে ব্যাগ আর স্যান্ডেল তুলে হাঁটা শুরু করলো। একবারও আর মুগ্ধর দিকে তাকালো না। মুগ্ধ পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিল তিতির ব্যাগটা কাধের উপর ফেলে পেনসিল হিলের চিকন ফিতাগুলো আঙুলে ঝুলিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগলো। যেন ওর মত সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই।
মুগ্ধ কলাবাগান বাস কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। ১০:৩০ এ বাস ছাড়বে। সামনেই সাফি আর দোলা বসে আছে। ওরা এসেছে হেল্প করার জন্য। কারন তিতিরকে পৌঁছে দিতে আসবে ওর বাবা এবং ভাইয়া। তিতির বাসায় বলেছে এবারও টিওবি থেকেই যাচ্ছে খাগড়াছড়ি ট্রিপে। যেহেতু তিতিরের বাবা, ভাইয়া সাফি-দোলাদের চেনে তাই ওদেরকে নিয়ে এসেছে মুগ্ধ। ১০:২৫ বাজে, এখনো তিতির আসছে না দেখে মুগ্ধ দোলাকে দিয়ে ফোন করালো। তিতির জানালো ও প্রায় এসে গেছে।
মুগ্ধ আগে থেকেই বাসে উঠে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিতির এসে পড়লো ওর বাবার সাথে। বাবা তিতিরকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাস না ছাড়া পর্যন্ত। অগত্যা দোলা সাফিকেও বাসে উঠতে হলো। বাস ছেড়ে দেয়ার পরও তিতিরের বাবা দাঁড়িয়ে ছিল। তিতির জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল,
-“বাবা, তুমি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাও।”
-“হ্যা যাচ্ছি।”
তারপর হাত নেড়ে টা টা বলল তিতির। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটায় উঠলো। বাস ততক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছে। বাস যেদিকে যাচ্ছে রিক্সা যাচ্ছে তার উলটো দিকে তাই বাবাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না তবে রিক্সাটা দেখা যাচ্ছে। তবু তিতির তাকিয়েই আছে। মুগ্ধ বলল,
-“বাস তো ছেড়ে দিয়েছে, এবার মুখটা ভেতরে আনো। হুট করে আরেকটা বাস চলে আসতে পারে।”
তিতির শুনলো না। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো। তিতিরের চোখভর্তি পানি। মুগ্ধ অবাক,
-“সেকি! কাঁদছ কেন?”
এতক্ষণ চোখে জমে থাকা পানিটা একফোঁটা পড়লো গাল বেয়ে। বলল,
-“আমি কখনো বাবাকে মিথ্যে বলে কোথাও যাইনি। খুব ভালবাসি বাবাকে। সব থেকে বেশি। আর আজ সেই আমি বাবাকে মিথ্যে বলে এতদূর যাচ্ছি। আমার খুব খারাপ লাগছে।”
মুগ্ধ কি বলবে বুঝতে পারলো না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। তিতিরের চোখ মুছে দিয়ে হাত ধরে বলল,
-“চলো আমরা নেমে যাই। যাওয়া লাগবে না। আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।”
-“না আমি যাব।”
-“আরে পাগলী! আমি রাগ করে বলছি না। সত্যি বলছি এরকম খারাপ লাগা নিয়ে গেলে কি তোমারও ভাল লাগবে বলো?”
-“আমি জানি তুমি রাগ করে বলোনি। কিন্তু আমি যাব।”
-“কেন জেদ করছো?”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কারন, আমার লাইফে বাবা যতটা ইম্পরট্যান্ট তুমিও ঠিক সমান ইম্পরট্যান্ট!”
মুগ্ধ কিছু বললনা শুধু মনে মনে ভাবলো, হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলে গেছেন “কিশোরী মন বড়ই রহস্যময়।”
বাস শাহবাগ পৌঁছতেই দোলা আর সাফি বিদায় নিয়ে নেমে গেল। যাত্রাবাড়ী থেকে প্যাসেঞ্জার উঠানোর পর বাসের লাইট অফ করে দিল। আবছা আলোয় মুগ্ধ দেখলো তিতির সিটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে চুপ! মুগ্ধ ওকে ঘাঁটালো না। থাকুক কিছুক্ষণ নিজের মত। বাস যখন কাঁচপুর ব্রিজে উঠলো তিতির তখন বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখলো। মুগ্ধ আবার ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে এসে বলল,
-“এটা করো না। রিস্কি খুব।”
তিতির হেসে বলল,
-“সবসময় তো করছি না। এখন একটু নদীর গন্ধ নিলাম। আবার যখন নদী পড়নে তখন একটু নেব। নিতে দেবে না?”
তিতিরের মুখে হাসি দেখে মুগ্ধ একটু স্বস্তি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধর ফোন এল। পিউ ফোন করেছে,
-“হ্যালো, ভাইয়া?”
-“হুম বল।”
-“তোরা রওনা হয়েছিস?”
-“হ্যা, মাত্রই কাঁচপুর ব্রিজ পার হলাম।”
-“ওহ! তিতির আপু তোর পাশেই না?”
-“না পিছনে।”
-“পিছনে মানে? তোরা পাশাপাশি সিট পাসনি?”
-“যেমন প্রশ্ন ছিল তেমনই উত্তর ছিল।”
-“উফফ! বাদ দে। আপুকে দে না একটু কথা বলি?”
-“কাল সকালেই তো জলজ্যান্ত পেয়ে যাবি। এখন আবার কথা বলে কি করবি?”
-“দে না। শুধু আমি না, আম্মুও কথা বলবে।”
মুগ্ধ ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে বলল,
-“একটু কথা বলবে? পিউ খুব চাইছে।”
তিতির বলল,
-“দাও, আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?”
তিতির ফোনে ধরে বলল,
-“হ্যালো..”
পিউ ওপাশ থেকে বলল,
-“ওমা কি মিষ্টি ভয়েস গো তোমার! আমার ভাইটার আবার ডায়াবেটিস না হয়ে যায়।”
তিতির হাসলো। পিউ বলল,
-“হাসিটাও সুন্দর। উফ কখন যে তোমাকে দেখবো আমার আর তর সইছে না।”
তিতির বলল,
-“তোমাদের সবাইকে দেখার জন্যও আমার মনটা অস্থির হয়ে আছে। তোমার ভাইয়া তো সবসময় তোমাদের গল্প করে।”
-“তাই?”
-“হুম।”
-“এই শোনো আপু… মা তোমার সাথে কথা বলবে, নাও।”
তারপর হুট করেই পিউ ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে দিল। মা ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তিতির সালাম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন আছেন আন্টি?”
মা বলল,
-“এইতো আম্মু ভাল আছি। কিন্তু বড্ড অস্থির লাগছে। তোমরা সেফলি আসবে তারপর আমি শান্তি পাব।”
আহা কী অবলীলায় কথা বলছে! যেন হাজার বছরের চেনা। খুব ভাল লাগছিল তিতিরের। কথা শেষ হতেই মুগ্ধ বলল,
-“আমার মা তোমাকে দেখার আগেই মানে শুধু ছবি দেখেই পটে গেছে। শুধু তোমার সাথে কথা বলেই ফোন রেখে দিল। আমার সাথে কথাই বলতে চাইলো না।”
তিতির হেসে বলল,
-“জেলাস?”
-“নাহ! মা যত তোমাকে পছন্দ করবে আমার তো ততই ভাল লাগবে তাই না?”
তিতির আচমকা মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও ধরলো। পুরো বাস অন্ধকার। তিতির মুগ্ধর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
-“আমি খুউউউব হ্যাপি।”
মুগ্ধও তিতিরের মত ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”
-“তোমাকে পেয়ে।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“আমিও খুব হ্যাপি! লাকি অলসো.. তোমাকে পেয়ে।”
তারপর তিতির আর কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ আবিস্কার করলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের মনেই হাসলো মুগ্ধ। প্রায় এক ঘন্টা পর একটা স্পিড ব্রেকার পার হওয়ার সময় বাসটা নড়ে উঠতেই তিতিরের ঘুমটা ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই হেসে দিল তিতির। তারপর মুগ্ধকে ছেড়ে দুই পা উঠিয়ে গুটিসুটি হয়ে নিজের সিটে মাথা রেখে মুগ্ধর দিকে ফিরে বসলো। তারপর মুগ্ধর হাত ধরে বলল,
-“একটা কথা বলবে?”
ইশ! তিতিরের ঘুমু ঘুমু ভেজা ভেজা ভয়েসটা কাছ থেকে কি যে সুন্দর লাগছে। ভয়েস যদি খাওয়া যেত মুগ্ধ এক্ষুনি খেয়ে ফেলতো। তিতির আবার হাতে নাড়া দিয়ে বলল,
-“বলোনা, বলবে?”
মুগ্ধ বলল,
-“হুম, বলো কি?”
-“ইকরা কিসে পড়ে?”
-“ভার্সিটিতে।”
-“আমার সমান?”
-“না তোমার চেয়ে অনেক বড়। ও আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। এখন বোধহয় সেকেন্ড ইয়ার।”
-“ও। আচ্ছা ও কক্সবাজারে কি করেছিল? যার জন্য তোমার কাছে মাফ চাইছিল?”
-“অনেক খারাপ একটা কাজ করেছিল।”
-“সেটা তো তোমাদের মেসেজ দেখে আমি বুঝেছি। কিন্তু কি করেছে বলোনা? তুমি তো বলেছ বলবে।”
-“আমি তো বলতেই পারি কিন্তু তুমি তো সহ্য করতে পারবে না। আর লজ্জাও পাবে।”
-“সহ্য করতে না পারার কি হলো? পারব, বলোতো।”
-“আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই ও আমাকে কিস করেছে।”
-“কোথায়?”
-“ঠোঁটে।”
-“মানে?”
-“বোঝোনি?”
-“তুমি করতে দিলে কেন?”
-“আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম রে বাবা। যখন টের পেয়েছি তখন তো উঠে চড় মেরেছি একটা।”
-“কিন্তু ততক্ষণে তো ও যা করার করেই ফেলেছে।”
-“নাহ, এর পরেও করেছে।”
-“কি করেছে?”
তিতিরের চোখেমুখে আতঙ্ক। মুগ্ধ বলল,
-“ও শার্ট পড়া ছিল। হঠাৎ শার্টের বাটনগুলো সব খুলে ফেলেছিল।”
-“কিহ?”
আবছা আলোয় মুগ্ধর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিতিরের মুখটা লাল হয়ে গেছে। চোখে পানিও এসে গেছে, পড়ার অপেক্ষা শুধু। মুগ্ধ বলল,
-“কাঁদলে কিন্তু একটা থাপ্পড় মারবো। আমি কি তাকিয়েছিলাম নাকি ওর দিকে? আমি তো ওকে চড় মেরে ঘর থেকে বের করেই দিয়েছিলাম।”
-“কক্সবাজারে এটা কি করে সম্ভব? আর কেউ ছিলনা?”
-“সবাই মহেশখালী গিয়েছিল। আমার পা কেটে যাওয়ার আমি যাইনি। আর ও যে যায়নি কিকরে বলবো বলো? আমি তো ঘুমিয়েই ছিলাম।”
তিতির আর কিছু বলল না। মন খারাপ করে বসে রইলো। মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কি মনে হয় তোমার মুগ্ধ বিলিয়ে দেয়া অর্ডিনারি জিনিস হাত পেতে নেয়?”
-“না।”
-“তাহলে মন খারাপ করছো কেন?”
-“জানিনা।”
মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আনলো। তারপর বলল,
-“তোমার মুগ্ধর তো শুধু তার তিতিরপাখির উপর লোভ! অনেক লোভ জানো?”
তিতির মিটিমিটি হাসলো। কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর বলল,
-“তোমাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। অনেক দিন আগে থেকেই ভেবেছি কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
-“কি বলো?”
-“বান্ধরবানে একটা কথা বলেছিলে মনে আছে?”
-“বান্দরবানে তো কত কথাই বলেছি। কোনটার কথা বলছ এখন?”
-“ওইযে.. ইউ নেভার কিসড ইউর এক্স বিকজ অফ হার লিপস্টিক।”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। বলল,
-“হ্যা বলেছি তো। আর এটা ট্রু!”
-“তারমানে কি যেহেতু তোমার টোটাল ৩ জনের সাথে সম্পর্ক ছিল। তাই ওকে ছাড়া তুমি বাকি দুইজনের সাথে কিস করেছো?”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“হ্যা করেছি। এটা তো একটা নরমাল ব্যাপার। তোমাকেও তো কতবার করতে চেয়েছি তুমি তো পারমিশন দাওনি।”
-“ওরা কি চাইতেই পারমিশন দিয়ে দিল?”
-“হ্যা। পারমিশন লাগেনি ওরাও উদ্যোগী ছিল।”
-“আমার অবাক লাগে তুমি কি টাইপের মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে!”
-“সবাই তো আর তোমার মত লাজুকলতা না।”
-“তোমার ওরকমই পছন্দ না? আমার টাইপ মেয়ে তেমন পছন্দ না?”
এবার মুগ্ধ একটু সিরিয়াস হয়ে বলল,
-“তিতির, তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা যে প্ল্যান করে হয়নি তা তো তুমি জানোই। সম্পর্কটা না করে বাঁচতাম না, তাই করেছি। ৫ দিনে বুঝে গিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া ভাল থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমার সাথে ওদের তুলনা করা চলে না। আর তুমি যেমন তেমনভাবেই আমি তোমাকে ভালবেসেছি, তেমবভাবেই ভালবাসতে চাই বাকীটা জীবন। আমার কি ধরনের মেয়ে পছন্দ অপছন্দ তা তুমি ভাবতেও যেও না। শুধু জেনে রেখো তোমাকে আমার পছন্দ!”
আহ! তিতিরের আবার উড়তে মন চাইছে। কিছু বলল না, মনে মনে উড়তে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“এই অনেক সিরিয়াস সিরিয়াস কথা হয়েছে। এবার একটু তাকাও না আমার দিকে।”
তিতির তাকালো। মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তিতির মুগ্ধর গালে হাত রেখে বলল,
-“তোমার দাড়িটা এখন একদম পারফেক্ট সাইজ। বেশি বড়ও না, আবার বেশি ছোটও না। কেন যে ক্লিনসেভ করো!”
-“অফিসের জন্য।”
-“ধুর! অফিসকে বলবা এটা ফরমাল হওয়ার নতুন স্টাইল।”
-“তাই অনেক সুন্দর লাগছে?”
-“অন্নেক!”
-“তাহলে একটা চুমু দাও।”
তিতিরের জন্য ভালই হলো। এতক্ষণ দাড়ির দিকে তাকিয়ে তিতিরের একটা চুমু দিতেই ইচ্ছে করছিল। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে কিন্তু ওইযে লজ্জা! লজ্জায় পারেনা।
মুগ্ধ গাল বাড়িয়ে আছে। যদিও অন্ধকার আর এত রাতে সবাই ঘুমাচ্ছে তবু তিতির আশেপাশে তাকিয়ে একবার দেখে নিল। তারপর মুগ্ধর বাড়িয়ে রাখা গালটাতে একটা চুমু দিল। তিতির যখন সরে যাচ্ছিল তখন মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে ইচ্ছেমত ওর গালে গাল ঘষে দিল। তিতির ব্যাথায় উঁহ করে উঠলো। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
-“আস্তে। কি সব সাউন্ড করছো! কেউ শুনলে কি ভাববে জানো? বোকা মেয়ে কোথাকার!”
তিতির মুগ্ধর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বলল,
-“দাড়ি না যেন তাঁরকাটা।”
একথা শুনে মুগ্ধ হেসে গড়িয়ে পড়লো। তারপর বলল,
-“তোমার না দাড়ি ভাল লাগে?”
তিতির মুগ্ধর আরো কাছে এসে বলল,
-“ভাল লাগে তো। এখনো লাগে। দাড়ি দিয়ে আরো যত খোঁচাই দাও না কেন তবু ভাল লাগবে। আই জাস্ট লাভ ইট।”
-“তাই? তাহলে আরেকবার দিই?”
-“দাও।”
মুগ্ধ এবার তিতিরের গালে নয় ঘাড়ে দাড়ি ঘষে দিল। তিতির ছিটকে সরে গেল। ওপাশে মুগ্ধর একটা হাত না থাকলে তিতির জানালার উপর পড়ে ব্যাথা পেত। তিতির ঘাড়ের সেখানে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। ওর হার্টবিট ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“ব্যাথা পেয়েছ?”
তিতির আবার সেই ভেজা স্বরে বলল,
-“না।”
কিন্তু মুখ তুলে তাকালো না তিতির। একইভাবে বসে রইলো। মুগ্ধ ওকে বুকে টেনে নিল। তারপর তিতিরের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
-“পাগলী! শান্ত হও। এখনি এত অস্থির হলে ভবিষ্যতে কি করবে?”
তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা, তোমার কি খুব ভাল লেগেছিল?”
তিতির চুপ। মুগ্ধ বলল,
-“জাস্ট সে ইয়েস অর নো।”
তিতির এবারেও চুপ করে রইলো। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা যাও সহজ করে দিচ্ছি। ভাল না লাগলে তুমি আমার বুক থেকে উঠে তোমার সিটে গিয়ে বসো। আর যদি ভাল লাগে তাহলে এভাবেই থাকো আমার বুকে।”
তিতির আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো ন। দুই হাত দিয়ে আরো শক্ত করে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“জানতাম তো!”
বাসের লাইট জ্বলে উঠতেই দুজন দুজনকে ছেড়ে যে যার সিটে চলে গেল। বাস কুমিল্লার একটা হোটেলে ২০ মিনিটের ব্রেক দিল। মুগ্ধ বলল,
-“চলো ডিনার করে আসি।”
-“আমি তো ডিনার করেই এসেছি। আমি ৮ টার মধ্যে ডিনার করি।”
-“ডায়েটকন্ট্রোল না?”
-“ডায়েটকন্ট্রোল বলে কথা না। আসলে সবারই রাত ৭/৮ টার মধ্যে ডিনার কম্পলিট করা উচিৎ। নাহলে ক্যালরিটা বার্ন হওয়ারর সু্যোগ পায়না। তুমি খাওনি?”
-“হা হা হা… ৭/৮ টায় আমি নাস্তা করি, ১২ টায় ডিনার। ঘুমানোর আগে না খেলে রাতে ক্ষুধায় আমার ঘুম আসে না।”
তিতির বলল,
-“এটা কিন্তু ভাল অভ্যাস না।”
-“কেন? এত যে খাই আমার কি কোনো ভুরি আছে?”
-“তা নেই।”
-“নেই আর হবেও না কারন, আমি যেমন অনেক খাই তেমন এক্সারসাইজও করি। না খেলে গায়ে শক্তি হবে কি করে? স্লিম মেদবিহীন থাকার জন্য কম খাওয়াটাকে আমি কখনোই প্রেফার করি না। তাহলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়না, দুর্বল হয়ে যায়।”
-“কিন্তু, আমি নিয়মের বাইরে একটু খেলেই মোটা হয়ে যাব। এপাশ ওপাশ সমান হয়ে ব্যাঙের মত দেখাবে।”
-“কেন এক্সারসাইজ করবে।”
-“এক্সারসাইজটা হয়ে ওঠে না। সকালটা তো ক্লাস করেই কেটে যায়। ক্লাস না থাকলে ঘুম।”
-“তোমার ক্লাস তো থাকে ৯ টায়। তার আগে এক্সারসাইজ করবে।”
-“কিভাবে? ৯ টায় হলেও তো সাড়ে ৮ টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়।”
-“আধা ঘন্টায় রেডি হও আর ব্রেকফাস্ট করা হয়ে যায়?”
-“হ্যা।”
-“এক্ষেত্রে তুমি অনেক ফাস্ট। সো ঢাকা ফিরে আসার পর ইচ্ছেমত খাবে। খালি সুগারটা এভয়েড করার ট্রাই করবে। আর ঘুম থেকে উঠবে সাড়ে ৭ টায়। এক্সারসাইজ করবে সাড়ে আটটা পর্যন্ত। তারপর আধা ঘন্টায় রেডি হয়ে খেয়েদেয়ে ক্লাসে চলে যাবে।”
-“সুগার এমনিতেই এভয়েড করি, পছন্দ না। কিন্তু সাড়ে ৭ টায় ওঠা সম্ভব না। এমনিতেই আমার ঘুম বেশি তার উপর এখন রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমাতে লেট হয়ে যায়।”
-“তাহলে রাতে বেশিক্ষণ কথা বলব না।”
-“কেন? তোমার কি মনে হয় আমি ডায়েটকন্ট্রোল করে দুর্বল হয়ে গেছি? বান্দরবানে দেখোনি অন্যসব মেয়েদের থেকে আমি কতটা স্ট্রং ছিলাম?”
-“হ্যা হয়তো আছো বাট ডায়েটকন্ট্রোল না করলে আরো স্ট্রং থাকবে। তাছাড়া আমার বাচ্চাগুলোও তো পুষ্টি পাবে না।”
তিতির লজ্জা পেয়ে খামচি দিল মুগ্ধকে। মুগ্ধ বলল,
-“উফ মারছো কেন? যেটা সত্যি সেটাই তো বললাম রে বাবা।”
-“উফ তুমি চুপ না করলে আমি আরো মারব।”
-“না সত্যিই কিন্তু তোমার ডায়েটকন্ট্রোল করা উচিৎ না।”
-“ডায়েটকন্ট্রোল না করলে মোটা হয়ে যাব।”
-“আরেকটু মোটা তো হওয়াই উচিৎ।”
-“কি বলো তুমি? এই ফিগার বানানোর জন্য সব মেয়েরা হা হুতাশ করে মরে। আর তুমি কিনা মোটা হতে বলছো?”
-“তোমার ফিগার ঠিক আছে তবে গায়ে আরেকটু মাংস হলে ভাল হতো। আরো এট্রাক্টিভ লাগত তখন। অন্যদের কথা জানিনা তবে আমার চোখে লাগত। তাছাড়া এখন জড়িয়ে ধরলে গায়ের মধ্যে হাড্ডি ঢুকে যায়। তুমিই বলো আমাকে জড়িয়ে ধরে মজা পাওনা? সেটা তো এই কারনেই যে আমার গায়ের হাড্ডির খোঁচা তোমাকে খেতে হয়না।”
তিতির মুগ্ধর হাতে ইচ্ছেমত খাঁমচাতে লাগলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল।তিতিরের হাত ধরে বলল,
-“পরে আরো মেরো। কিন্তু এখন না গেলে তো ব্রেক টাইমটুকু বাসে বসেই কেটে যাবে। চলো তো।”
-“যেতে হবে না দাঁড়াও।”
এই বলে তিতির ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করলো। তারপর সেটা মুগ্ধর হাতে দিয়ে বলল,
-“খাও, আমি নিজের হাতে রেঁধেছি তোমার জন্য।”
-“ওয়াও, হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
মুগ্ধ বক্সটা খুলতেই দেখলো বিরিয়ানি রান্না করে এনেছে তিতির, সাথে কাবাব। মুগ্ধ ঘ্রাণ শুঁকে বলল,
-“সিরিয়াসলি তুমি রান্না করেছো? এত সুন্দর ঘ্রাণ!”
-“হুম আমি রান্না করেছি। বিরিয়ানি কিন্তু এই প্রথম রান্না করলাম। ঘ্রাণ ভাল হলেও খেতে ভাল নাও হতে পারে। তাড়াহুড়োয় টেস্টও করতে পারিনি।”
মুগ্ধ বক্সটা নিয়ে নিজের সিটে বসলো। তারপর তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তিতির, বিরিয়ানি আমার অনেক পছন্দ।”
-“জানি তো, সেজন্যই তো বিরিয়ানি রেঁধে আনলাম।”
মুগ্ধ হেসে বক্স্ব রাখা চামচটা দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তিতির আগ্রহে চেয়ে রইলো মুগ্ধ কি বলে সেটা জানার জন্য। কিন্তু মুগ্ধ কিছুই বলছে না শুধু খেয়েই চলেছে। অর্ধেকটা যখন শেষ হলো তখন মুগ্ধ বলল,
-“আহহা! দ্যাত আমি একাই খেয়ে চলেছি। তোমাকে দিচ্ছি না। কি খারাপ আমি। নাও হা করো।”
তিতির হা করলো। মুগ্ধ ওকে খাইয়ে দিল। তিতির খেয়ে বুঝলো বেশ ভালই হয়েছে রান্নাটা। কিন্তু মুগ্ধ কিছু বলছে না কেন? তিতির বলল,
-“খাবাবগুলো খাচ্ছো না যে?”
মুগ্ধ একটা কাবাব তুলে মুখে দিল। তারপর বলল,
-“মাছের কাবাব?”
-“হুম।”
-“বাহ! অস্থির জিনিস তো।”
আরেকটা খেল। তারপর বিরিয়ানি রেখে এক এক করে সবগুলো কাবাব খেল। বলল,
-“এই তিতিরপাখি তুমি একটা নাও।”
-“নাহ তুমি খাও।”
মুগ্ধ জোড় করে একটা খাইয়ে দিল। তারপর বিরিয়ানিটা শেষ হতেই মুগ্ধ বলল,
-“চলো, বাইরে যাই।”
-“কেন?”
-“চা খাব, ওয়াশরুমে যাব।”
তিতির উঠলো। হোটেলে ঢুকে ওয়াশরুমে গেল। ফিরে এসে মুগ্ধকে কোথাও পেলনা। ফোনটাও তো ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় মুগ্ধর কাছে দিয়ে গিয়েছিল। হোটেল থেকে বেড়িয়ে একই কোম্পানির এতগুলো বাস দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল কারন ও বুঝতে পারছিল না কোনটা ওদের বাস! এখন কি হবে? আচ্ছা ও কি ওয়াশরুম থেকে এখনো বের হয়নি? তা তো হবার কথা না। তাহলে কি কাউন্টারে গেল কিছু কিনতে? উলটো ঘুরে দৌড় দিতেই মুগ্ধর সাথে ধাক্কা লাগলো। মুগ্ধর হাতে থাকা ওয়ান টাইম কাপের দুই কাপ চা উলটে পড়লো মুগ্ধর শার্টের বুক আর পেটের কাছটাতে। তিতির ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
-“সরি সরি। আমি খেয়ালই করিনি। পুড়ে গেল বুঝি বুকটা?”
-“পুরে তো সেদিনই গেছে যেদিন ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিলে কিন্তু দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিলে?”
তিতির খানিকটা হাপাচ্ছিল। বলল,
-“আমি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এদিক ওদিক খুঁজছিলাম। টেনশনেই দৌড় দিয়ে ফেলেছি।”
-“কেন তোমাকে না বলেছিলাম আমি চা নিব? আমি তো তোমাকে দেখেছিলাম বের হতে। আমি ভেবেছি তুমি সামনে থাকবে।”
-“ওহ খেয়াল করিনি বোধহয়।”
-“আচ্ছা আসো আমার সাথে। চা নিয়ে আসি।”
চা নিয়ে আসতে আসতে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল। বাসে উঠেই চা খেল ওরা। চা খাওয়া শেষ হতেই মুগ্ধ উপর থেকে ওর ব্যাগ টা নামালো। ব্যাগ থেকে একটা শার্ট বের করে পড়নের শার্টটা খুলে ফেলল। তিতির হা করে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ শার্টটা পড়তে পড়তে বলল,
-“মেয়েদের অনেক সুবিধা বুঝলে? ওরা অনেক ব্যাপারে এক্সট্রা প্রিভিলেজ পায়।”
তিতির বলল,
-“কখনোই না। মেয়েদের কোনো ব্যাপারেই সুবিধা নেই।”
-“আছে আছে। যেমন ধরো আমি চেঞ্জ করছি আর তুমি যে লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছিলে সেই ঘটনাটা যদি উলটো হতো যেমন তুমি চেঞ্জ করছো আর আমি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তাহলে আমি হয়ে যেতাম চরিত্রহীন, লুচ্চা ব্লা ব্লা ব্লা। বাট তোমার কিন্তু কোনোই দোষ হচ্ছে না।”
তিতির অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-“সরি। কিন্তু আমার সামনে চেঞ্জ করোনা কক্ষনো। আমার চোখ চলে যায়।”
মুগ্ধ ব্যাগটা আবার উপরে উঠিয়ে রেখে বসলো। তারপর তিতিরের কাছে এসে বলল,
-“সাবধানে থেকো। মাঝেমধ্যে চোখ কিন্তু আমারও চলে যায়। বাধা দিলেও শোনেনা।”
তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। ওর দুষ্টুমি মাখা হাসি দেখে তিতির খুব লজ্জা পেল। তারপর আর তাকালোই না ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আনলো। বুকের মধ্যে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“আমার বউটা যে এত ভাল রান্না করতে পারে আমি তো আগে বুঝিনি।”
তিতির মুখ তুলে চাইল মুগ্ধর দিকে। তারপর বলল,
-“তাই সত্যিই ভাল হয়েছে?”
-“হুম।”
-“আচ্ছা, সারাজীবন যদি আমি তোমাকে মজার মজার রান্না করে খাওয়াই তুমি কি সারাজীবনই আমাকে এভাবে আদর করবে?”
-“হুম, আরো কত কত আদর করবো!”
তিতির চোখ নামিয়ে মুগ্ধর বুকে মুখ গুঁজে চুপ করে রইলো। মুগ্ধ বাসের সিটের মাথাটা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো কিছুক্ষণের জন্য। ঘুমিয়ে পড়েছিল। তিতিরের দিকে তাকাতেই বুঝলো ও ঘুমন্ত। রাত তখন অনেক। বাসের ম্যক্সিমাম লোকজনই ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তিতির যেভাবে বাকা হয়ে আছে পরে তো কোমড়,ঘাড় ব্যাথা করবে। তাই মুগ্ধ ডাকলো,
-“তিতির এই তিতির?”
তিতির মাথা উঠিয়ে সেই ঘুমে জড়ানো মাদকময় কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে ডাকছো কেন?”
-“এভাবে শুয়ে থাকলে তোমার গা ব্যাথা হয়ে যাবে। একটু এদিকে এসে শোও।”
-“পারব না আমি। দুইটা মেয়েকে তো লিপকিস করেছোই, এখন আর আমার গা ব্যাথার কথা চিন্তা করে কি হবে? মনে যে কত ব্যাথা হয়েছে! সেটা দূর করতে পারবে?”
-“কেন বাবা? ওরা তো আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল তখন। এইযে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হয়েছো আমি তোমাকে কত আদর করিনা বলো? করতেই হয় রে বাবা। এটা নিয়ে কষ্ট পেওনা প্লিজ।”
-“তার মানে কি তুমি আমাকে যেভাবে আদর করো ওদেরও সেভাবে আদর করেছো?”
-“না, এতটা না। বাট করেছি তো।”
তিতির কান্না করে দিল,
-“অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা.. তুমি এত এমন, আমি আগে বুঝিনি।”
-“কেমন?”
-“অন্নেক পচা। একদম ভালবাসো না আমাকে।”
মুগ্ধ তিতিরের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-“কেন বাবা? এরকম কেন বলছো? আমি তো তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। তুমি বোঝোনা?”
-“হ্যা বুঝি। খুব ভাল করে বুঝি যে আমাকে ওদের মত অত ভালবাসো না। আমিও তো তোমার গার্লফ্রেন্ড! কখনো আমাকে লিপকিস করেছো?”
-“আমি তো করতে চেয়েছিই। তুমিই পারমিশন দাওনি!”
-“অদ্ভুত তো! আমি লজ্জা পেয়ে না না বলি। তুমি পারমিশনের অপেক্ষা করো কেন? পারমিশন চাইলে কি আমি কখনো বলতে পাড়বো যে, হ্যা আসো আমাকে কিস্সি করো?”
মুগ্ধ খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে তিতির এখনো ঘুমের ঘোরে থেকেই এসব বলছে! হয়তো ঘুম থেকে উঠে সবটা ভুলেও যাবে। কিন্তু ওর খারাপ লাগছে। ঘুমের ঘোরে তিতিরের বলা উল্টাপাল্টা কথা শুনে সবসময় ওর হাসি পায়। এখনো পাচ্ছে কিন্তু তারপরেও মনের কোন কোনায় কষ্টও হচ্ছে। কেন যে তিতিরকে সব বলতে গেল! ও তো একটা মেয়ে তার উপর বাচ্চা মানুষ! ওর খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। মুগ্ধকে চুপ থাকতে দেখে তিতির আবার বলল,
-“দেখেছো এখনো কিস্সি করছো না। তুমি তোমার এক্সদেরকেই বেশি ভালবেসেছিলে।”
মুগ্ধ বলল,
-“করবো। এখন তো জানলাম তোমার ইচ্ছে আছে। এখন করবো। তবে আজকে এই বাসের মধ্যে না।”
কান্নার ভাব করে তিতির বলল,
-“কেন?”
-“ছিঃ বাসে কেউ কিস করে? কত মানুষ আছে না?”
-“ওহ তাই তো।”
-“বাসায় গিয়ে। ওকে?”
-“জানি বাসায় গিয়ে তুমি ভুলে যাবে।”
একটু বিরক্ত হয়ে একথা বলে আবার কান্নার ভাব করলো। তারপর মুগ্ধকে অবাক করে দিয়ে তিতির নিজের সিটে দুই পা উঠিয়ে পা ভাজ করে গুটিসুটি মেরে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো মুগ্ধর কোলে মাথা রেখে। মুগ্ধ জাস্ট হা করে চেয়ে রইলো। এটুকু যায়গার মধ্যে এভাবে কি করে ঘুমানো সম্ভব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না।
তিতির যেভাবে শুয়েছে বাস একটু ব্রেক করলেই পড়ে যাবে। মুগ্ধ দুহাত দিয়ে ওকে নিজের কোলের মধ্যে ধরে রাখলো। সত্যি ঘুমকুমারী নামটা সার্থক! নিজের মনেই হাসলো মুগ্ধ। তিতির একটু আগে যখন ঘুমের ঘোরেই বলেছিল, ‘কি হয়েছে ডাকছো কেন?’ ইশ তখন ওর ভয়েসটা কি মারাত্মক শোনাচ্ছিল! বুকের মধ্যে লাগছিল একদম। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল। তারপর চেয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বাসটা একটা স্পীড ব্রেকার পার হলো। আর বাসটা সামান্য নড়ে উঠলো। তিতির পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মুগ্ধ ধরে ফেলল। তিতির নড়ে উঠে পাশ ফিরলো। কি অদ্ভুত মেয়ে! এটুকু যায়গার মধ্যে আবার পাশ ফিরছে। হেসে ফেললো মুগ্ধ। কিন্তু তিতির শুধু পাশ ফিরলই না মুগ্ধর কোমড়ও জড়িয়ে ধরলো। এখানেই শেষ নয়, ও মুগ্ধর পেটের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিল। পেটের মধ্যে গরম নিঃশ্বাস পড়ায় প্রথমে ওর সুড়সুড়ি লাগছিল পরে আস্তে আস্তে সয়ে গেল। বাসের সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু মুগ্ধ এমনিতেই যেখানে বাসে ঘুমাতে পারে না, এই অবস্থায় তো অসম্ভব! এই মুহূর্তটা ও কিছুতেই মিস করতে চায় না।
তিতির ঘুম যখন কিছুটা ভাঙলো, ও বুঝতে পারছিল না ও কোথায়! কিন্তু ঘ্রাণটা খুব চেনা, মুগ্ধ! কিন্তু মুগ্ধ এত রাতে কিভাবে এল? লুকিয়ে লুকিয়ে? কিন্তু সেটা কিভাবে? চম্পা কি দরজা খুলে দিয়েছে? বাবা-মা, ভাইয়া কেউ দেখে ফেলেনি তো! এসব প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন সময় বাসটা একটু নড়ে উঠতেই তিতির মনে পড়লো ওরা বাসে করে চিটাগাং যাচ্ছে, ওর হবু শ্বশুরবাড়ীতে। এমা! ও এভাবে মুগ্ধর পেটের মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিল ও? ইশ জেগে উঠলে মুগ্ধ খুব ক্ষ্যাপাবে আর লজ্জা দেবে। তিতির উঠলো না ঘুমের ভান করে পরে রইলো। মুগ্ধর পেটের লোমগুলো শার্টের উপর দিয়েই তিতিরের চোখেমুখে লাগছিল! উফ কি আরাম! মুগ্ধ যদি কয়েকটা বাটন খুলে দিত তাহলে ও এখানে প্রান ভরে চুমু খেত। খুব ইচ্ছে করছে। ওকে কি বলবে? ইশ কখনো বলতে পারবে না ও।
নাহ আর কতক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকবে? মুগ্ধর নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে। কোল থেকে মাথাটা উঠাতেই ও বলল,
-“মাম, আপনার ঘুম ভাঙলো?”
-“ইশ তোমার কত কষ্ট হলো!”
উঠে যেতে নিল তিতির। মুগ্ধ ওকে উঠতে দিলনা। নিজেই কোল থেকে উঠিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো তারপর বলল,
-“কষ্ট হয়নি। থাকো এখানে ভাল লাগছে।”
-“তুমি এতক্ষণ একা একা বোর হওনি?”
-“নাহ! একা কোথায় আমার ঘুমকুমারী তো ছিল আমার কাছে। খুব কাছে!”
-“একটা গান শোনাবে?”
-“এখানে?”
-“তাতে কি হয়েছে? এই যেরকম নিচু ভয়েসে কথা বলছি সেরকম ভয়েসেই গাও।”
-“গলা না খুলে গান গাইলে কি সুন্দর হয়?”
-“সুন্দর হওয়া লাগবে না। আমি জানি তুমি ভাল গাও। একদিন খারাপ হলেও ক্ষতি নেই।”
মুগ্ধ গাইতে শুরু করলো,
“তুমি ভরেছ এ মন…..
এক নিঝুম অরন্যে।
বসন্তে পাহাড়চূড়ায় আর বৃষ্টি দিয়ে।
মরুভূমির ঝড়ে আর ঘুমন্ত সাগরে।
তুমি ভরে দাও এ মন ফিরে এসে!
তুমি ভরেছ এ মন…..
এক নিঝুম অরন্যে।
আমায় ভালবাসতে দাও
এ জীবন দিয়ে।
যেন হারাই তোমার মিষ্টি হাসিতে
যেন থাকো সারাক্ষণ এই বাহুডোরে
ফিরে এসো এ জীবনে নতুন করে।
তুমি ভরেছ এ মন…..
এক নিঝুম অরন্যে।”
প্রেমাতাল
ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙলো মুগ্ধর। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তিতির ওর বুকের মধ্যে ঘুমাচ্ছে। তিতিরের দিকে চোখ পড়তেই ওর রাতের পাগলামির কথা মনে পড়ে গেল। একা একাই হেসে ফেলল মুগ্ধ। আস্তে আস্তে আকাশটা সাদা হতে লাগলো। বাসে সামনে কয়েকজনের ঘুম ভেঙেছে। ওদের এভাবে কেউ দেখুক আর উল্টোপাল্টা কথা বলুক তা মুগ্ধ চায়না তাই তিতিরকে ঠেলে উঠালো। তিতির বিরক্ত হয়ে বলল,
-“কেন? উফফফফো! আমি উঠতে পারব না।”
-“এভাবে জড়াজড়ি করে ঘুমালে লোকে কি বলবে বলোতো?”
তিতির ঘুমের ঘোরেই বলল,
-“লোক নেই।”
-“আছে সারা বাস ভরতি লোক। উঠো না বাবা। বাসায় গিয়ে আবার ঘুমিও।”
তিতির উঠে গিয়ে নিজের সিটে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তিতিরকে আবার ডাকলো মুগ্ধ,
-“তিতিরপাখি, ওঠো.. তোমার শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছি।”
তিতির ঘুমের ঘোরে মাথা উঁচু করে বলল,
-“কোথায়?”
-“ওইযে দেখো চিটাগাং গেট চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ পরই নামব। ততক্ষণে তুমি তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, চোখেমুখে পানি লাগিয়ে ঘুম কাটাও।”
-“ধুর, লাগবেনা। চলোতো তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। সারারাত ঘুমিয়েও ঘুম কাটেনা। কি অদ্ভুত!
বাস থেকে নেমে মুগ্ধ যখন সিএনজি ঠিক করছে, তিতির তখন বোতলের পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে নিল। সিএনজিতে উঠেই তিতির বলল,
-“এই আমার নার্ভাস লাগছে।”
-“কেন?”
-“প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি! নার্ভাস লাগবে না?”
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-“যদি গিয়ে দেখো বাসায় কেউ নেই।”
-“মানে?”
-“মানে যদি গিয়ে দেখো, বাসায় কেউ নেই শুধু তুমি আর আমি?”
-“অপেক্ষা করবো। কেউ নেই তো কি হয়েছে? চলে আসবে।”
-“আর যদি না আসে?”
তিতির বিরক্ত হয়ে বলল,
-“রহস্য করবে না তো, অসহ্য। এমনিতেই নার্ভাস লাগছে তার উপর উনি আসছে ওনার রহস্যের ঝুলি নিয়ে।”
মুগ্ধ কিছু বলল না। একা একা হাসতে লাগলো। মুগ্ধর হাসি দেখে তিতিরের গা জ্বলে যাচ্ছিল।
সিএনজি কয়েকবার ডানে বায়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বামে মোড় নিয়ে যেখানে থামলো যায়গাটা শহরের বাইরে। তার ডানপাশে ছিল একটা চা বাগান। বামপাশে একটা রাস্তা উপরের দিকে উঠে গেছে। তিতির বলল,
-“যায়গাটা অসাধারণ।”
তিতির নিজের ব্যাগটা উঠাতে যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“আমাকে দাও।”
-“আমি পারব।”
-“যখন নিজের ব্যাগ টেনেছ তখন তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলে না। আমিও কিছু বলিনি। কিন্তু এখন তো আমি তোমাকে ব্যাগ টানতে দেব না। থার্ড, ফোরথ বাচ্চাদের টানার জন্য শক্তি সঞ্চয় কিরে রাখো।”
তিতির আর কিছু বলল না। এই পাগলের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মুগ্ধ তেমন কিছুই আনেনি। ছোট্ট একটা ব্যাগ কাধে। তিতিরের ব্যাগটাও সেটার উপরে নিয়ে নিল। ওই রাস্তায় উঠতেই তিতির বলল,
-“এত উঁচু কেন রাস্তাটা? আর সিএনজিটা ছাড়লে কেন? কতদূর হাটতে হবে? হটছিই বা কেন? এদিক দিয়েই কি তোমার বাসায় যেতে হয়?”
-“এতগুলো প্রশ্ন?”
-“থাক বলতে হবে না।”
একথা বলেই তিতির আবার হাটা ধরলো। মুগ্ধ তিতিরের একটা হাত ধরে বলল,
-“আরে রাগ করছো কেন?”
তিতির থামছিল না। মুগ্ধ হঠাৎ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তিতিরের রাগ উধাও। তারপর হাটতে হাটতে মুগ্ধ বলল,
-“রাস্তাটা এত উঁচু কারন আমরা একটা টিলার উপর উঠছি।”
-“টিলা মানে জানি কি? টিলা, ঢিবি এগুলো আমি বুঝিনা।”
-“ঢিবি বলে সামান্য উঁচু যায়গাকে। টিলা বলে ছোট পাহড়কে। মাঝারি গুলো মেইনলি পাহাড়। আর নিলগিরি টাইপ উঁচুগুলোকে বলে পর্বত। তোমার দেখি বাংলা ভোকাবোলারিতে ব্যাপক সমস্যা! আমার বাচ্চাগুলোকে কি শিখাবে?”
তিতির একটা চিমটি দিল মুগ্ধকে। তারপর বলল,
-“তোমার বাচ্চাদের তুমি শিখাবে। আমার অত দায় পড়েনি।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“কতকিছুর দায় যে পড়বে এখন কি বুঝবে সুন্দরী?”
তিতির বলল,
-“মানে?”
-“মানে কিছু না, আগে তোমার আগের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিই। সিএনজি ছেড়ে দিয়েছি কারন এখানকার সিএনজি বান্দরবানের মত তেলে চলে না। গ্যাসে চলে, যদিও প্রব্লেম হয়না তবু এটুকুর জন্য আমি রিস্ক নিতে চাইনা। বেশি হাটতে হবে না, আর সামান্য একটু। আর হ্যা, এদিক দিয়েই আমার বাসায় যেতে হবে। এই টিলার উপরেই আমার বাসা।”
-“সিরিয়াসলি? এত সুন্দর যায়গায় তোমার বাসা?”
-“তো? প্রকৃতিপ্রেম কি এমনি এমনি হয়েছে?”
-“ওয়াও। যায়গাটা অনেক সুন্দর।”
-“সুন্দরের দেখেছো কি? আগে উপরে উঠি?”
উপরে উঠে মুগ্ধ যেখানে তিতিরকে কোল থেকে নামালো তার সামনেই একটা গেট। গেটটা লাগানো। মুগ্ধ কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলল,
-“পাঁচ মিনিট ওয়েট করো।”
তারপর গেট বেয়ে তড়তড় করে উপরে উঠে ওপাশে চলে গেল। ভেতর থেকে লাগানো গেটটা খুলে বলল,
-“আসুন বেগাম। শ্বশুরবাড়িতে আপনাকে সুস্বাগতম!”
তিতির হেসে ব্যাগগুলো উঠাতে যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“অপরাধ মার্জনা করবেন বেগাম! ওগুলো আনার জন্য এই বান্দা এখনো জীবিত রয়েছে, আপনি আপনার স্বর্ণপদযুগল রেখে এই বাড়িটিকে ধন্য করুন।”
তিতির হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলো। ও খুব এক্সাইটেড। মুগ্ধ বেড়িয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে আসলো। তারপর বলল,
-“চলো।”
গেটের ভেতর লম্বা একটা রাস্তা। দুইপাশে অসংখ্য গাছ, সব চেনেও না তিতির। রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ছোট্ট একটা দোতলা বাসা। বিল্ডিং এর কাছাকাছি দুটো গাছের মাঝে একটা হ্যামক ঝোলানো। অপজিটের একটা গাছের ডালে দড়িতে কাঠ বেধে একটা দোলনা বানানো হয়েছে। ছাদে একটা কবুতরের বাসাও দেখা যাচ্ছে। গেটের দুপাশের লাইট, বাউন্ডারি, হ্যামক, দোলনা, কবুতরের বাসা সব মিলিয়ে তিতির বুঝলো এসবই কোন সৌখিন মানুষের কাজ! কে হতে পারে? মা, বাবা, স্নিগ্ধ, পিউ নাকি মুগ্ধ? যেই হোক সবকিছু এত ভাল লাগলো যে ওর এখানেই স্থায়ী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মুগ্ধকে বলতে হবে তবে এখন না পরে। তিতির হাটতে হাটতে বলল,
-“এটা তোমাদের নিজেদের বাসা?”
-“হ্যা, দাদা বানিয়েছিল। সামনে যে চা বাগান টা দেখেছো ওখানে দাদা চাকরি করতো। তখনই এই টিলাটা কিনে বাসা বানায়। প্রথমে এটা কাঠের ঘর ছিল। আস্তে আস্তে বিল্ডিং হয়েছে বাট আই মিস দ্যাট উডেন হাউজ।”
-“কিন্তু তুমি যে বলেছিলে তোমাদের বাড়ি চিটাগাং এ না। বাবা চাকরীর জন্য থাকে?”
-“হ্যা, আমাদের বাড়ি তো কুমিল্লা। দাদা এখানে চাকরী করতো, বাসা বানিয়েছে। আস্তে আস্তে সবাই চলে এসেছে তা বলে তো আমরা চিটাগাং এর হয়ে গেলাম না। তাই না?”
-“ও। দাদা এখন কোথায় থাকে?”
-“দাদা-দাদী কেউই বেঁচে নেই এখন।”
-“সরি।”
-“হুম এসো। আর শোনো মাকে পা ধরে সালাম করতে আপত্তি নেই তো? মানে জানি কারো পা ধরে সালাম করতে নেই কিন্তু মা খুব খুশি হবে।”
-“না না আপত্তি কিসের? আমি করবো।”
মুগ্ধ বেল বাজালো। তিতিরের প্রচন্ড নার্ভাস লাগছিল। একটা ১৩/১৪ বছরের ছেলে বেড়িয়ে এল। বলল,
-“কাকে চাই?”
মুগ্ধ বলল,
-“মেহতাব চৌধুরী আছেন?”
-“না, উনি একটা অপারেশনে গেছেন। কোন মেসেজ থাকলে আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।”
তিতির বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে। মুগ্ধ বলল,
-“ওহ। আমরা কি একটু ভেতরে আসতে পারি? আসলে আমরা খুবই টায়ার্ড।”
-“আপনার পরিচয়?”
-“আমি মেহবুব চৌধুরী। মেহতাব চৌধুরীর একমাত্র বড় ছেলে।”
-“ওহ! আর ওই সুন্দরী কিশোরীটি কে? ওনার পরিচয় তো দিলেন না?”
-“আপনি মেহদিন চৌধুরীকে চেনেন? মেহতাব চৌধুরীর একমাত্র ছোট ছেলে।”
-“জ্বী চিনি।”
-“ওই কিশোরীটি তার বড় ভাবী।”
ছেলেটা দুই কদম সামনে এসে চোখদুটো বড় বড় করে বলল,
-“ভাইয়া তুমি বিয়ে করে ফেলেছো? আম্মু যে বলল গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আসছো? একা একা কেন বিয়ে করলে? আমরা কি বাধা দিতাম?”
এতক্ষণে মুগ্ধর মা আর পিউ চলে এল। মা তিতিরের কাছে এসে ওর মুখটা ধরে বলল,
-“মাশাল্লাহ! চোখদুটো যেন ধন্য হয়ে গেল। কি মিষ্টি দেখতে তুমি মা।”
তিতির লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। তারপর পা ছুঁয়ে সালাম করলো। মা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কী লক্ষী মেয়ে গো।”
স্নিগ্ধ বলল,
-“মিষ্টি আর লক্ষী হলে কি হবে? দেখে তো মনে হচ্ছে আমার চেয়েও ছোট।”
মুগ্ধ সব দেখছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। পিউ স্নিগ্ধকে একটা ধমক দিয়ে তিতিরের কাছে এসে বলল,
-“আপু ভেতরে এসো তো। পাগলদের পাগলামি চলতেই থাকবে। তোমরা যে এতটা পথ জার্নি করে এসেছো সে খেয়াল কারোর নেই।”
মা বলল,
-“ওহো তাই তো। তোমাকে দেখে সব ভুলে গেছি। ভেতরে এসো মা, ভেতরে এসো।”
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে তিতির একবার মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ ওকে চোখ মেরে দিল। এর অর্থ কি ছিল কে জানে! ভেতরে ঢুকে পিউ তিতিরকে ওর ঘরে নিয়ে গেল। বলল,
-“শোনো এখনি তো ভাইয়ার ঘরে থাকার পারমিশন পাবে না। তাই আমার ঘরেই থাকতে হবে। আর আমি কিন্তু আপু টাপু বলতে পারবো না। এখন থেকেই ভাবী বলবো আপত্তি নেই তো?”
-“নাহ। তোমার যা ইচ্ছে তুমি বলো।”
-“আচ্ছা, আর অনেক গল্প হবে আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
তিতির ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো মা বসে আছে। ওর এখন আর একটুও নার্ভাস লাগছে না, শুধু লজ্জা লাগছে। মা বলল,
-“চলো চলো নাস্তা করবে। সবাই তোমার জন্য বসে আছে।”
সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিল। তিতির রুমে ঢুকতেই মুগ্ধ ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তিতির জানে কেন! তিতিরের চুল দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এই দৃশ্য অনেক দিন পর দেখছে মুগ্ধ। পাগল একটা।
মুগ্ধ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালো। কারন তিতিরকে ও ভাগে পেলনা। সকালে স্নিগ্ধ কতক্ষণ পাগলামি করে স্কুলে চলে গেল। তারপর সারাটাক্ষণ মা আর পিউ মিলে ওর সাথে গল্প করলো, ম্যাক্সিমাম মুগ্ধর ব্যাপারে। মুগ্ধ কি পছন্দ করে কি অপছন্দ করে এসবই। খুব ভাল লাগছিল তিতিরের। পিউ ঘুরে ঘুরে পুরো বাসাটা ওকে দেখালো। তারপর মা যখন রান্না করতে চলে গেলে পিউ ফিসফিস করে বলল,
-“এবার ভাইয়ার কাছে একটু যাও। নাহলে বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। বেচারার চেহারা দেখে আমি তো অবাক। কখনো কোনো মেয়ের জন্য আমি ওর এমন ফিলিং দেখিনি জানো?”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। পিউ বলল,
-“আরে আমার কাছে লজ্জা কি? যাও না। ভাইয়া সেই সকাল থেকেই একা একা তোমার দুক্ষে নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। যদি তোমাকে একটু না ছাড়ি তাহলে হয়তো তোমাকে আর আমাদের কাছে আনবেই না।”
-“ও না আনলেও আমি আসব। এত আদর বুঝি আমি নেব না?”
পিউ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
-“ভাবী তুমি অনেক ভাল। তোমাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।”
তিতির পিউএর গাল ধরে বলল,
-“আর তুমিও এত্ত কিউট যে খালি আদর করতে ইচ্ছে করে।”
-“আচ্ছা আচ্ছা, এবার ভাইয়ার কাছে একটু যাও। আমার ভাইয়াটাও কিন্তু অনেক কিউট।”
তিতির মুগ্ধর ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। মুগ্ধ খালি গায়ে ঘুমাচ্ছে। তিতির ওর পাশে বসলো। খুব ইচ্ছে করছিল ওর বুকে হাত রাখতে। কিছু না ভেবেই তিতির মুগ্ধর বুকে হাত রাখলো। এই প্রথম বোধহয় ওর যা ইচ্ছে হলো তাই করলো। মুগ্ধর ঘুম ভেঙে গেল কিন্তু তিতিরের স্পর্শ বুঝতে পেরে ঘুমের ভান করে রইলো। তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে মুগ্ধর বুকে একটা চুমু দিতে। কিন্তু মুগ্ধ যদি জেগে যায়? ওর যা পাতলা ঘুম! জেগে গেলে যাবে। তিতির মুগ্ধর বুকে একটা চুমু দিয়ে উঠতে নিয়ে আর উঠতে পারলো না। মুগ্ধ ওকে জড়িয়ে ধরেছে। তিতির বলল,
-“ছাড়ো। কেউ এসে পড়বে।”
-“আসুক! তো কি হয়েছে? মুগ্ধ কাউকে ভয় পায় নাকি?”
-“তুমি ভয় না পেলেও আমি পাই, ছাড়ো।”
-“আরে এত ছটফট করছো কেন? শোনো না।”
-“কি?”
-“তুমি এটা কেন করলে?”
-“কোনটা?”
-“এইযে আমার বুকে হাত রাখলে, চুমু দিলে।”
তিতিরের মাথাটা মুগ্ধর বুকের উপর ছিল। তিতির মুগ্ধর বুকে জোড়ে একটা কামড় দিয়ে বলল,
-“ঘুমের ভান করে ছিলে? ছিঃ তুমি একটা খুব খারাপ।”
-“ভাল হয়েছে, আমি খারাপই। আর তাই এখন তুমি যেটা করেছো সেটা আমিও করবো।”
-“কোনটা? কি করবে?”
-“তুমি কি করেছো সেটা তুমিই চিন্তা করো। ঠিক সেটাই করবো। আমি নিজের মুখে বললে তো আবার রাগ করবে।”
তিতির লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। কি করবে এখন? মুগ্ধর হাতে কামড় দিল। মুগ্ধ এটার জন্য রেডি ছিল না। তাই হাত আলগা হতেই তিতির উঠে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হতে নিল। কিন্তু তার আগেই মুগ্ধ দৌড়ে ধরে ফেলল ওকে। তিতির বলল,
-“ছেড়ে দাও। মাফ চাই এরকম আর করবো না।”
মুগ্ধ পেছন থেকে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে একটা চুমু দিতেই ও লাফিয়ে উঠলো। নিজেকে প্রাণপনে ছাড়াতে চাইলো মুগ্ধর হাত থেকে। মুগ্ধ ওর হাত আলগা করে দিল তিতির কি করে দেখার জন্য। তিতির নিজেকে কোনরকমে ছাড়িয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা কি হলো? মুগ্ধ বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে চেয়ে রইল তিতিরের চলে যাওয়া পথের দিকে। তিতিরের গায়ের ধাক্কায় দরজাটা এখনো নড়ছে।
মুগ্ধ হিসাব মেলাতে পারছিল না। কাল রাতে তিতির ঘুমের ঘোরে বলেছে মুগ্ধ কেন ওকে আদর করেনা! এখন আবার আদর করতে যেতেই এরকম করলো যেন ও চাচ্ছেই না। অল্পবয়সী মেয়েদের সাথে প্রেমে এই এক ঝামেলা বটে! তারা কখন যে কি চায় বোঝা বড় দায়। কিন্তু তিতির আজ যেভাবে চলে গেল তাতে ও কিছুটা অপমানিত বোধ করছে। ওর নিজের উপর যে পরিমাণ কন্ট্রোল আছে তাতে ও তিতিরকে বছরের পর বছর একফোঁটা না ছুঁয়েও থাকতে পারবে।
লাঞ্চ টাইমে আবার দেখা হলো তিতিরের সাথে। কিছুই বলল না মুগ্ধ। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। উঠে বেসিনে হাত ধুচ্ছে এমন সময় মা বলল,
-“মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আয় না।”
-“কোথায়?”
-“ওম্মা! এদিকে যা যা ঘোরার মত যায়গা আছে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়। পতেঙ্গাও তো যেতে পারিস।”
-“পতেঙ্গা যাওয়ার সময় কোথায়? এখন তো ৩ টা বেজেই গেছে।”
তিতির চিন্তায় পড়ে গেল। মুগ্ধ এভাবে বলছে কেন? রাগ করেছে নাকি? কিন্তু রাগ কেন করবে? বুকে কিস করতে না চাইলে কি ওভাবে বের হয়ে যেত ঘর থেকে? আচ্ছা মুগ্ধ কি সত্যিই করতো? নাকি ওকে লজ্জা দেয়ার জন্য বলেছিল? মুগ্ধ তো মজা করে কত কিছুই বলে! তারপরও, বললেও এভাবে প্রিপারেশন নিয়ে ধরে তো না কখনোও। ইশ কেন যে মুগ্ধর বুকে ঘুমন্ত অবস্থায় ওভাবে কিস করতে গিয়েছিল! খুব ভুল হয়েছে। কিন্তু ও কিইবা করবে? মুগ্ধকে যে ওর কতরকমভাবে আদর করতে ইচ্ছে করে তা তো ও কোনোদিনও উচ্চারনও করতে পারবে না।
মা বলল,
-“তাহলে আশেপাশে ঘুরিয়ে আন। বেচারি বাসায় বসে বোর হচ্ছে না?”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি বাসায় বোর হচ্ছো?”
তিতির বলল,
-“না, পিউ আর আন্টির সাথে ছিলাম সারাদিন, একটুও বোর হইনি।”
-“ওকে।”
মুগ্ধ নিজের ঘরে চলে গেল। মনে হলো এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে রাগ করে কি হবে? ও তো রাগটা বুঝেই না। সে যাই হোক, ওর আসলে কি হয়েছিল? ও কি রাগ করেছিল? নাকি লজ্জা পেয়েছিল? লজ্জা তো সবসময়ই পায় কিন্তু এভাবে রিফিউজড কখনো, কিছুতে করেনা।
মুগ্ধ ঘরে ঢোকার পর মা তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওর আবার কি হলো? রাগ করেছে কেন? ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?”
-“না তো!”
-“ঝগড়া না হলেও কোন কারনে রেগে আছে।”
-“কি করে বুঝলেন আন্টি?”
-“আরে, আমার ছেলের সব বিহেভিয়ার আমার মুখস্থ। খুব বুঝতে পারছি তোমর উপরেই কোন কারনে রাগ করেছে। আর তুমি জানোই না?”
-“ও আমার সাথে কখনোই রাগ করেনি, তাই বুঝতে পারছি না।”
পিউ বলল,
-“ভাবী, ভাইয়া আসলেই রাগ করেছে। তুমি দেখো গিয়ে কি হয়েছে!”
ওদের কথার মাঝেই মুগ্ধ শার্ট পড়তে পড়তে নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“মা, বাবা কি বাইকটা নিয়ে বেড়িয়েছে?”
-“না, তোর বাবা তো ঢাকা গেছে কাল, অফিসের গাড়িতে গেছে। বাইক গ্যারেজেই আছে। তুই চিন্তা করিস না, তোর বাবা কালই চলে আসবে। তিতিরের সাথে দেখা হবে।”
-“ওহ। আচ্ছা বাইকের চাবিটা দাও।”
-“ও তোরা বেরোবি? আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।”
-“তোরা না, আমি একা বের হব। শহরে যাব, কাজ আছে।”
-“তুই তিতিরকে একা রেখে বের হবি?”
-“একা কোথায়? তোমরা আছ তো।”
-“একটা থাপ্পড় মারবো, ওকে নিয়ে যা।”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি আসলেই যাবে? গেলে রেডি হয়ে আসো। আর আমি কিন্তু আজকে ঘোরাতে পারবো না। আমি কাজে যাচ্ছি।”
তিতিরের তবু যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি বলবে! ওকে বলতে হলো না। মা বলল,
-“যাবে না কেন? ছোট মানুষ বাসায় বসে থাকবে নাকি সারাক্ষণ? তোর কাজ তুই করবি ও তোর সাথে থাকবে। বাইকে করে যাবে আসবে এতেই তো ঘোরা হবে।”
তারপর তিতিরের দিকে ফিরে বলল,
-“মা যাও রেডি হয়ে নাও।”
তিতির বলল,
-“পিউ তুমিও চলো।”
পিউ বলল,
-“না না আমি যাব না। আমার কাজ আছে। তোমরা যাও।”
তিতির পিউএর রুমে গেল। ৫ মিনিটের মধ্যেই মুখটা ধুয়ে, ড্রেস চেঞ্জ করে চুলগুলো একটা ঝুটি করে বেড়িয়ে এল। মা চাবি এনে মুগ্ধর হাতে দিতে দিতে তিতিরের দিকে চেয়ে বলল,
-“ওমা এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কি মনে হয় মা তোমার ছেলে অর্ডিনারি কাউকে বিয়ে করতে চলেছে? তিতির ঠিক তেমন যেমনটা তোমার ছেলের জন্য দরকার।”
একথা বলেই মুগ্ধ বের হল। মা তিতিরের কাছে এসে বলল,
-“অতটাও রাগ করেনি। যাও যাও। দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্য।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বেড়িয়ে গেল। বাইকে উঠে বসে মুগ্ধর কাধে হা রেখে পিছনে ফিরতেই পিউ, মা হাত তুলে টা টা দিল। তিতিরও টাটা দিল। ওরা যখন টিলার উপর থেকে যখন নামছিল স্নিগ্ধ স্কুল থেকে ফিরছিল। ওদের বাইকে দেখতে পেয়েই দু’অাঙুল মুখে দিয়ে একটা সিটি বাজালো। মুগ্ধ থামলো না। যেতে যেতেই জোরে জোরে বলল,
-“কানের নিচে একটা দিব ফিরে এসে।”
স্নিগ্ধ চিৎকার করে বলল,
-“ভাবী বাঁচাবে।”
ততক্ষণে মুগ্ধ অনেকদূর চলে গেছে। তাই আর উওর দিল না। তিতির বলল,
-“ও অনেক দুষ্টু না?”
-“হুম, মারাত্মক।”
মুগ্ধ তিতিরকে জিজ্ঞেস করল,
-“পতেঙ্গা রোডে বাইকরাইডে যাবে?”
তিতির মুগ্ধকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠের উপর মাথা রেখে বলল,
-“তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখেই যাব।”
-“যদি জাহান্নামে নিয়ে যাই?”
-“যাব।”
মুগ্ধ তিতিরকে পতেঙ্গা রোডে নিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিল। উন্মত্ত বাতাস যেন ওদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দুইপাশে গাছ, মাঝখানে পিচঢালা রাস্তা। সমুদ্রের ঠেউএর শব্দ! আহ, আনন্দ রাখার যায়গা পাচ্ছে না তিতির। অথচ আসার আগে বলছিল ঘোরাতে পারবে না।
এরপর সন্ধ্যা নেমে এলে মুগ্ধ ওকে নিয়ে নাভাল রোডে চলে গেল কাঁকড়া খেতে। তিতির বলল,
-“তোমার না কাজ আছে? এখানে এলে যে?”
-“হ্যা, ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করার কাজ। ওদের বলে দিয়েছি, ওরা এখানেই আসবে।”
-“ও।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল গরম গরম মশলা দিয়ে লাল করে ভাজা কাঁকড়া। মুখে দিয়েই তিতির বলল,
-“এত মজার কাঁকড়া আমি কোনদিনও খাইনি।”
-“হুম জানি তো। কুয়াকাটার লেবুবনের কাঁকড়া আরো মজা।”
-“আমি যাব।”
-“হুম, অবশ্যই নিয়ে যাব কোনো একদিন। ওখানে কাঁকড়া ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে।”
-“কি আছে?”
-“ওখান থেকে সূর্যাস্ত, সূর্যদোয় দুটোই ভাল দেখা যায়। একটা জাতীয় উদ্যান আছে যেখানে অসংখ্য গাছ আর বিভিন্নরকম পাখি দেখা যায়, পাশেই সমুদ্র। যায়গাটা খুবই শান্তির। লাল কাঁকড়ার দ্বীপও আছে একটা। লেবুবনের ওইদিকটাও অনেক সুন্দর। একপাশে সমুদ্র আরেকপাশে বালুতে জন্মানো গাছ। অসাধারণ।”
-“আর বোলোনা, আমার এখনি যেতে ইচ্ছে করছে।”
-“আচ্ছা যাও আর বলব না।”
তিতির হঠাৎ মুগ্ধর একটা হাত ধরে বলল,
-“তোমার বাসার সবাই এত ভাল কেন?”
-“সবার সাথে এমন ভাল না। তোমাকে পছন্দ হয়েছে তাই তোমার সাথে এত ভাল।”
-“সত্যি?”
-“হুম সত্যি। আচ্ছা তুমি বাসায় কয়দিনের কথা বলে এসেছো?”
-“৫ দিন।”
-“কিন্তু আমার ছুটি তো তিনদিন। একদিন আজ চলেও গেল।”
-“হুম জানি তো। তবু আমি এক্সট্রা টাইম নিয়ে এসেছি। আগে চলে গেলে তো আর প্রব্লেম নেই।”
-“ও। আচ্ছা তোমার এক্সট্রা টাইমের কথা শুনে একটা আইডিয়া এল মাথায়।”
-“কি?”
-“তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে চলো যাওয়ার সময় একটা দিন বান্দরবানে ঘুরে আসি। আমাদের বাসা থেকে ১ ঘন্টাও লাগে না যেতে। ধরো সকালে বের হলাম সারাদিন ঘুরে রাত্রের বাসে ঢাকা চলে গেলাম। বান্দরবান সিটিতেই ঘুরাঘুরি করবো। আমার কিছু পছন্দের যায়গা আছে, তোমাকে সেসব যায়গায় নিয়ে যাব।”
-“ইটস আ গ্রেট আইডিয়া। কিন্তু তোমার তো ছুটি নেই।”
-“আমি তো আর ছুটি নিয়ে আসিনি। আজ সরকারি ছুটি ছিল। কাল-পরশু শুক্রবার-শনিবার। অফিসে বলিওনি বাড়ি আসব। তুমি যদি বান্দরবান যাও তো তখন ছুটি নিয়ে নেব।”
-“আমি যাব প্লিজ।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধর ফ্রেন্ডরা এল। মুগ্ধ তিতিরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অনেক আড্ডা হলো তারপর ফিরে এল বাসায়। রাতে সবার সাথে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। অবশেষে ১ টার দিকে যে যার মত ঘুমাতে গেল। বিছানায় শুয়েই আছে শুধু ঘুম আসছে না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো মুগ্ধর। ওপাশ থেকে তিতিরের গলা,
-“হ্যালো..”
-“হুম বলো।”
-“কি করছো?”
-“শুয়ে আছি।”
-“শুয়ে শুয়ে কি করছো?”
-“করার মানুষ তো এখানে নেই। পিউএর ঘরে।”
তিতির মুচকি হেসে বলল,
-“জানো,ঘুম আসছে না আমার!”
-“জীবনেও বিশ্বাস করিনা। বাসের মধ্যেই যেভাবে ঘুমিয়েছো আর এখানে বিছানায়ও তোমার ঘুম আসছে না?”
-“তখন তো তুমি পাশে ছিলে।”
-“তো?”
-“তুমি পশে থাকলে এত শান্তি লাগে। তোমার ছোঁয়া পেলে আবেশে ঘুম চলে আসে।”
-“হুম সেজন্যই তো দুপুরবেলা ওরকম করলে!”
-“ইশ, সরি।”
-“আচ্ছা এত কাছে থেকেও ফোনে কথা বলার কোনো মানে হয়না। চলো ছাদে যাই। বের হও রুম থেকে। বাই দ্যা ওয়ে পিউ কি জেগে?”
-“নাহ ও ঘুমিয়ে পড়েছে।”
-“আচ্ছা দেন বের হও। ছাদে যাই।”
তিতির বেরিয়ে এল। মুগ্ধ ওর হাত ধরে ছাদে চলে গেল। মুগ্ধ আকাশের চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“দেখেছো আমাদের একসাথের সব মুহূর্তগুলোতে চাঁদ আমাদের সাথে।”
-“হুম! আমরা লাকি।”
মুগ্ধ সিঁড়িরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর বলল,
-“এবার বলোতো দুপুরে ওরকম করলে কেন?”
-“সরি, আমার আসলে খুব লজ্জা লাগছিল, তুমি যা বলছিলে! ছিঃ আর ভয় করছিল যদি কেউ চলে আসে।”
-“এখন ভয় করছে না?”
-“নাহ! এখন তো রাত।”
-“তার মানে কি রাতে তোমার সাথে যা করতে চাইব তাইই করতে দিবে?”
-“ইশ! কক্ষনো না।”
একথা বলেই তিতির সরে যেতে চাইলো। মুগ্ধ বলল,
-“খুব শক্ত করে ধরেছি, আমি নিজে না ছাড়লে ছাড়াতে পারবে না।”
তিতির মুগ্ধর বুকে কামড় দিল। মুগ্ধ ব্যাথা পেলেও ছাড়লো না। বলল,
-“তোমার যত অত্যাচার আর যত ভালবাসা সব আমার বুকের উপর কেন? আমি কি কখনো তোমার…”
কথা শেষ করতে দিলনা তিতির। একটা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুগ্ধ ওর সেই হাতে চুমু খেল।
তিতির বলল,
-“প্লিজ, একটু সামলে কথা বলো। তোমার কিছু কিছু কথায় আমার খুব বেশি লজ্জা লাগে।”
মুগ্ধ ওর হাতটা সরিয়ে দুহাতে তিতিরের মুখটা ধরে বলল,
-“তোমার লজ্জামাখা মুখটা দেখতেও তো আমার খুব বেশি ভাল লাগে।”
তিতির একথায়ও চোখ নামিয়ে নিল। চাঁদের আলো পড়ে কি মায়াবী দেখাচ্ছে তিতিরকে! মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারছিল না। নিচু হয়ে তিতিরের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিতেই তিতির আবার হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। বলল,
-“না, প্লিজ!”
মুগ্ধ তিতিরকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তিতির চলে গেল না। দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধ পকেটে হাত গুজে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তিতিরের মনে হলো মুগ্ধ আবার রাগ করেছে। কিন্তু মুগ্ধ তখন রাগ করেনি, নিজেকে সামলে নিচ্ছিল। তিতির মুগ্ধর কাছে এসে বলল,
-“রাগ করো না প্লিজ। আমার কেমন জানি লাগে। কখনো করিনি তো।”
বলতে বলতেই তিতির কান্না করে দিল। মুগ্ধ অবাক। তিতির আর দাঁড়ালো না, হাঁটা শুরু করলো নিচে যাওয়ার জন্য। মুগ্ধ দৌড়ে ওকে ধরে ফেলল,
-“এই পাগলী কি হচ্ছেটা কি? আমি রাগ করেছি কে বলল? তুমি যতদিন না চাইবে আমি কিছুই করবো না। কান্না থামাও।”
-“আমি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডদের মত স্মার্ট নই।”
-“শোনো কাল রাতে তুমিই কান্না করতে করতে বলেছিলে আমি আমার এক্সদের কিস করেছি কিন্তু তোমাকে করিনি। তার মানে আমি ওদের তোমার থেকে বেশি ভালবেসেছিলাম। কেমন লাগে এসব কথা শুনতে?”
-“ইশ, জীবনেও আমি এসব বলিনি।”
-“বলেছ বাবা। আরো অনেক কিছু বলেছো”
-“কি বলেছি?”
মুগ্ধ সবটা বলল। তিতির সব অস্বীকার করে মুগ্ধর হাত ছেড়ে নিচে চলে যেতে নিল। মুগ্ধ আবার ওর হাত ধরে থামিয়ে গান শুরু করে দিল। মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গানটা,
“সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করোনা
আজ নিশীথে থাকো কাছে
না বোলোনা।
অনেক শিখা পুড়ে তবে
এমন প্রদীপ জ্বলে
অনেক কথার মরন হলে হৃদয় কথা বলে
না না চন্দ্র হারে কাজল ধোয়া জল ফেলোনা।
একেই তো এই জীবন ভরে
কাদের বোঝাই জনে
আজ পৃথিবীর ভালবাসার
সময় গেছে কমে
না না একটু ফাগুন আগুন দিয়ে না জ্বেলোনা।
সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করোনা
আজ নিশীথে থাকো কাছে
না থাকবো।
প্রেমাত
মুগ্ধর পরিবারের সবাই যেমন ছিল ওর বাবা ছিল তার পুরোপুরি উলটো। উনি খুব সিরিয়াস টাইপের মানুষ। কিন্তু মুগ্ধ বেশ সাবলীল ছিল ওর বাবার সাথে। তিতির ভাবতেও পারেনি এতবড় একটা ইন্টারভিউ ওকে দিতে হবে ওনার কাছে। সকালবেলা ১০/১১ টার দিকে উনি এসেছিল। তিতির-মুগ্ধ তখন বাগানে ছিল। বাবা ওদের দেখতে পায়নি। কিন্তু ওরা দেখতে পেয়েছিল। ওনার ইউনিফর্ম দেখে তিতির মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিল,
-“তোমার বাবা পুলিশ?”
মুগ্ধ হেসে বলেছিল,
-“হ্যা।”
-“কই কখনো বলোনি তো!”
-“তুমিওতো কখনো জিজ্ঞেস করোনি।”
-“তা বলে তুমি বলবে না?”
-“বাদ দাও, শোনো মায়ের মত ওনাকেও পা ধরে সালাম করতে যেও না যেন। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ ভাববে। এমনি মুখে সালাম দিও।”
তিতির পরে বুঝেছিল মজাটা। ওর বাবা এত এত কোশ্চেন করেছিল যে তিতিরের মনে হচ্ছিল ও কোন আসামী। প্রশ্নপর্ব শেষ হতেই উনি বলেছিল,
-“মুগ্ধ এমন সময় হুট করে তোমাকে নিয়ে আসলো যখন আমি খুবই ব্যস্ত। শুধু তোমার সাথে দেখা করার জন্যই আমি বাসায় এসেছি। আবার লাঞ্চের পরই চলে যাব ৩ দিনের জন্য। তবে এই তাড়াহুড়ো করে আসাটা সার্থক। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
লাঞ্চ করেই বাবা চলে যায়। যাওয়ার সময় মুগ্ধকে সাথে করে নিয়ে যায়। তিতিরের বিকালটা মা আর পিউএর সাথে সুন্দরভাবে কেটে যায়। ওরা এত আপন করে নিয়েছে যে তিতিরের মনেই হচ্ছে না ও প্রথমবার এসেছে।
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে গেল। মুগ্ধর আসার খবর নেই। তিতির মুগ্ধকে ফোন করল কিন্তু মুগ্ধ ধরলো না। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ কলব্যাক করলো,
-“আমার তিতিরপাখি টা কি করছে?”
-“তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
-“আমাকে বাবা একটা কাজে পাঠিয়েছিল। কাজ শেষ, আমি ফিরছি ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই।”
-“তাড়াতড়ি আসো না। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
-“সারপ্রাইজ? আমি যদি খুব তাড়াতাড়ি চালাই তাহলেও তো ৩০ মিনিট লাগবে। তার আগে তো পারবো না বাবা।”
-“এই না না। আস্তে চালাও, কোনো সারপ্রাইজ নেই।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“আচ্ছা, বাইকটা তুমি ঢাকা নিয়ে যাওনা কেন? তাহলে এতদূর থেকে অফিসে যেতে কষ্ট হতো না। দেড়ঘন্টা আগেও রওনা দিতে হতো না।”
-“এটাতো বাবার বাইক! মাকে পেছনে নিয়ে ডেটে যায়।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ আরো বলল,
-“আমাদের এদিকটা শহর থেকে কতদূরে দেখেছো? বের হওয়ার সময় রিক্সা,সিএনজি যে কোনটাই পাওয়া মুশকিল তখন এই বাইকটাই কাজে দেয়। পিউ, স্নিগ্ধ সবাই চালাতে পারে।”
-“সিরিয়াসলি?”
-“হুম।”
-“বাহ!”
-“তাহলে তুমিও একটা বাইক কিনে নাও।”
-“নাহ, আমি একটা গাড়ি কিনবো।”
-“ও।”
-“মনে মনে কি ভাবছো গাড়ি কেনার এত টাকা কোথায় পাবো?”
-“না না তা কেন ভাববো?”
-“ভাববে না কেন? আমার বাবার তো অনেক টাকা নেই, আমারও নেই। গাড়ি কেনার টাকা কোথায় পাব ভাবা উচিৎ তোমার!”
-“কোথায় পাবে?”
-“নতুন অফিস আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট! এক বছরের মাথায় একটা প্রমোশন হতে পারে। হয়ে গেলে আমি ইচ্ছে করলে কার লোন অথবা হোম লোন নিতে পারবো। তখন আমি কার লোন নিব।”
-“ওহ।”
-“শোনো তিতির, এরকম হয়ে থাকলে কিন্তু তোমার সংসার ভেসে যাবে।”
-“মানে? বুঝিনি।”
-“মানে এইযে তোমার হাসবেন্ড কি করছে, কেন করছে, কিভাবে করছে তুমি তার খবর রাখবে না? আমি বললাম গাড়ি কিনবো তুমি জিজ্ঞেসও করলে না কিভাবে কিনবো! একটু কৌতূহল থাকা ভাল। তা নাহলে তোমার হাসবেন্ড দুনিয়ার আকাম করে বেড়ালেও তুমি টের পাবে না। হাসবেন্ডের এধরণের সকল কার্যকলাপ সম্পর্কে জানার অধিকার ওয়াইফের আছে। ”
তিতির হেসে বলল,
-“তোমার ব্যাপারে আমার অনেক কৌতূহল। কিন্তু তোমার কাজের ব্যাপারে কোন কৌতূহল নেই। আমি জানি তুমি যাই করবে ঠিকই করবে, তুমি কোনো অন্যায় করতেই পার না।”
-“বিঃশ্বাস ভাল, অন্ধবিশ্বাস ভাল না।”
-“তেমনি ভালবাসা ভাল, অন্ধভালবাসা ভাল না। তুমি আমাকে অন্ধভাবে ভালবাসো, আমি তোমাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করি.. যাও কাটাকাটি।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“এসব কথা বলে আর সময় নষ্ট করোনা প্লিজ, আসো।”
-“এত তাড়া কিসের? চুমু দিবে?”
-“এই আমি রাখি।”
তিতির ফোন রেখে দিল। তিতির মনে মনে বলল, ‘আমি তো নিজে থেকে দিতে পারব না। কিন্তু তুমি যদি চাও আজ আর বাধা দেবনা আমি।’
মুগ্ধ ফিরলো প্রায় ৩৫ মিনিট পর। রাত প্রায় ১০ টা বাজে। বাড়িতে ঢুকেই দেখলো ড্রইংরুমে পিউ টিভি দেখছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“সবাই কোথায় রে?”
-“সবাই নাকি ভাবী?”
-“মারবো এক চড়। বাসায় ঢুকে সবসময়ই তো আমি সবার খোঁজ নেই। এটা কি নতুন নাকি?”
-“আচ্ছা সরি, স্নিগ্ধ পড়তে বসেছে। মা আর ভাবী রান্নাঘরে। ভাবী যেন কি বানাচ্ছে।”
-“ও।”
মুগ্ধ নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তিতির টের পেয়েছে মুগ্ধ এসেছে। ও এখন মাছের কাবাব বানাচ্ছে যেটা মুগ্ধ খুব পছন্দ করেছিল। তাই এখনো ওর সামনে যেতে পারেনি। বুকটা ঢিপঢিপ করছে যেন প্রেম হওয়ার পর ওদের প্রথম দেখা হতে যাচ্ছে। মুগ্ধ এসেছে শুনে মা ওর জন্য চা বানাচ্ছিল। শেষ হতেই বলল,
-“এই নাও, চা টা মুগ্ধকে গিয়ে দাও।”
-“এত রাতে চা?”
-“ও খায়। বাসায় ফিরেই চা খায়। তাতে নাকি ও এনার্জি পায়।”
-“ওহ, আচ্ছা।”
-” আর তোমাকে দেখে কি বলল আমাকে বলতে হবে কিন্তু। লজ্জা পেলে চলবে না।”
একথা শুনেই তিতির লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। মা ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আচ্ছা লজ্জা পেও। লজ্জাতেই তোমাকে মানায়, তাছাড়া এই যুগে লাজুক বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে কে জানে পরে কেমন হয়ে যাবে।”
তিতির কিছু বলল না। মুচকি হাসলো। মানুষটা কত সরল নাহলে ভবিষ্যতের চিন্তার কথা এভাবে কেউ মুখের উপর বলে! মা আবার বলল,
-“যাও যাও, নাহলে চা এখানেই ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
তিতির চা নিয়ে মুগ্ধর ঘরে ঢুকলো। মুগ্ধ পিছন ফিরে হাতমুখ মুছছিল। দরজা খোলার শব্দ পেতেই ও পিছনে তাকিয়ে ওর চোখ আটকে গেল তিতিরকে দেখে। গাঢ় নীল পাড়ের নীল রঙের তাতের শাড়ি পড়ে আছে তিতির। শাড়ি পড়া এই প্রথম দেখছে। হাতে চায়ের কাপ। কানে গলায় গয়না পড়েছে, ওগুলো চেনে মুগ্ধ ওর মা ওর বউয়ের জন্য বানিয়ে রেখেছে আর হাতে দুটো চুরিও দেখা যাচ্ছে, ওগুলো ওর মায়ের। আর কোনো সাজগোজ নেই। চুলগুলো খোলা। তিতির জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুগ্ধর দিকে তাকাচ্ছে না। লজ্জা লাগছে। মুগ্ধর তো চোখে পলকই পড়ছে না, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তিতিরকে একদম অন্যরকম লাগছে। কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। তারপর খেয়াল হতেই হাতের টাওয়াল টা ফেলে দিয়ে মুগ্ধ তিতিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তিতির চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“তোমার চা।”
মুগ্ধ কাপটা ধরে টেবিলে রাখলো। তারপর তিতিরের আরো কাছে এসে তিতিরের মুখটা দুহাতে ধরে চোখে চোখ রেখে নিচু গলায় বলল,
-“একটা কথা রাখবে?”
মুগ্ধর গলা হালকা কাঁপছিল। তিতিরেরও একই অবস্থা। চোখ সরালো না। বলল,
-“হুম রাখবো, বলো।”
-“বিয়ের দিন থেকে প্রতিদিন তুমি শাড়ি পড়বে? আজীবন?”
-“হুম, তুমি বললে পড়বো।”
-“বউ হলে তোমাকে মারাত্মক লাগবে।”
তিতির এবার মাথা নিচু করে হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলোকে সরিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“এতবড় একটা সারপ্রাইজ পাব সত্যিই ভাবিনি।”
তিতির শুয়ে আছে কিন্তু ঘুম আসছে না। পিউ ওর পাশে শুয়ে বিভিন্নরকম গল্প জুড়ে দিয়েছে। প্রত্যেকটা কথা এত আগ্রহ নিয়ে বলছে যে তিতির হাসি হাসি মুখ করে শুনছে, নিজের অজান্তেই পিউয়ের কথায় তাল মেলাচ্ছে। কিন্তু একটা শব্দও তিতিরের কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। ওর মাথায় একটা ব্যাপারই ঘুরছে! মুগ্ধ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। তখন ডিনার টাইম হয়ে গিয়েছিল আর সবাই জেগেও ছিল তাই মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে তখনই রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। তারপর খেয়েদেয়ে যাওয়ার সময় সুযোগ বুঝে বলেছিল,
-“শাড়িটা চেঞ্জ করোনা। রাতে পিউ ঘুমিয়ে পড়লে আমার ঘরে পারলে একবার এসো। ভেবো না, খেয়ে ফেলব না। শুধু দেখব, দু’চোখ ভরে দেখবো, প্রাণভরে দেখবো। তখন তোমাকে দেখতেই পারিনি। এসো কিন্তু, অপেক্ষা করবো।”
পিউ ঘুমাচ্ছে না, যাবে কি করে ও? এমন সময় মুগ্ধর ফোন এল। তিতির ধরলো না। পিউ বলল,
-“আরে ধরো, কথা বলো। আমি নাহয় একটু পরেই বলি। আমার সামনে অস্বস্তি লাগলে বারান্দায় গিয়েও কথা বলতে পারো।”
তিতির বারান্দায় চলে গেল। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই মুগ্ধ দু’লাইন গাইল,
“আর কত রাত একা থাকবো?
চোখ মেলে দেখবো না তোমাকে,
স্বপ্নের রঙে ছবি আঁকব….
-“আমি কি করবো বলো? পিউ তো ঘুমাচ্ছে না। ওর সামনে দিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”
-“না না পাগল? ছোট বোন না আমার?”
-“সেটাই।”
-“কতক্ষণ আর, ঘুমিয়ে পড়বে একসময়। তারপর এসো। আমি জেগে আছি, নো প্রব্লেম।”
-“আচ্ছা।”
-“শোন?”
-“কি?”
-“এই সারপ্রাইজিং প্ল্যান টা কি মায়ের ছিল?”
-“হুম, নাহলে গয়নাগাটি কোথায় পেতাম? আর আমি তো শাড়িও পড়তে পারিনা। মা পড়িয়ে দিয়েছে।”
-“ওহ। ওগুলো কি মা তোমাকে একেবারে দিয়ে দিয়েছে?”
-“হুম। কিন্তু আমি বলেছি এগুলো এখন মায়ের কাছেই থাকবে। আমি বউ হয়ে এলে দিতে। এখন এগুলো আমি যত্ন করে রাখতে পারব না। তাছাড়া বাসায় যাওয়ার পর আম্মু জিজ্ঞেস করলে বলবোই বা কি?”
-“ওহ, তাও ঠিক।”
-“সেজন্যই নেইনি। মাকে বুঝিয়ে বলেছি, মা বুঝেছে।
-“দেখেছো আমার মা কত রোমান্টিক?”
-“হুম। সত্যি অনেক অনেক রোমান্টিক।”
-“আচ্ছা তিতির, তুমি এখন যাও পিউ কে ঘুম পাড়াও।”
তিতির হেসে ফোন রেখে দিল। তিতির ঘরে ঢুকতেই গল্প কন্টিনিউ করলো পিউ।
তিতির চোখ মেলে দেখলো পিউ নেই পাশে। আলো দেখে কান্না পেল ওর। সকাল হয়ে গেছে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ৮ টা বাজে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই তো নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মুগ্ধর ৩ টা মিসড কল আর ২ টা মেসেজ জমে আছে। ফার্স্ট মেসেজটা ওপেন করলো,
“Amar ghumkumari ki amake opekkhay rekhe ghumiye porlo?”
রাত ২ টার দিকে এসেছে এই মেসেজ।
সেকেন্ড মেসেজ,
“Accha ghumao tahole, bt amr ghumer 12 ta beje gese, tmr neel shari pora bou mukhta chokhe vashche.. Good night.. ok?”
এই মেসেজটা এসেছে ভোর সাড়ে ৪ টায়। তিতির এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। পিউ রুমে ঢুকে দেখলো তিতির কাঁদছে। বলল,
-“ভাবী কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?”
তিতির কান্না থামাতে চাইছে কিন্তু পারছে না, কিছুতেই কান্না থামছে না। পিউ বলল,
-“আরে বলোনা কি হয়েছে? প্লিজ বলো। আমার খুব খারাপ লাগছে।”
তিতির কি বলবে ভেবে পেলনা। সত্যিটা তো আর বলতে পারবে না। তিতিরের হাতে মোবাইল দেখে পিউ জিজ্ঞেস করলো,
-“কোনো খারাপ খবর পেলে নাকি?”
তিতিরের মাথায় কিছু আসলো। ও বানিয়ে বলল,
-“তোমার ভাইয়া অনেকগুলো কল করেছিল, অনেক রাতে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম ধরতে পারিনি। মাত্র দেখলাম। ও সারারাত জেগে ছিল।”
পিউ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আহারে! ভাবী, ফোন ধরতে পারোনি বলে কাঁদছ! তুমি ভাইয়াকে এত্ত ভালবাসো? ”
তিতির বলল,
-“না, ও সারারাত জেগে আমাকে কল করেছে, নিশ্চই মিস করছিল। অথচ আমি এমন মরা ঘুম দিয়েছি যে কিছু টেরই পাইনি। ও আমাকে যেমনভাবে ভালবাসে আমি কোনদিনও বোধহয় সেভাবে বাসতে পারব না। আমি খুব খারাপ।”
পিউ তিতিরের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“এই পাগলী! কান্না করে না। ভাইয়া রাতে ঘুমায়নি তো কি হয়েছে? এখন তো ঘুমাচ্ছে। ও তো এতক্ষণ ঘুমায় না, ভোরবেলাই উঠে যায়। কাল রাতে ঘুমায়নি বলেই হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে।”
কোন কথায় কাজ হলোনা তিতির কাঁদতেই থাকলো। মা পিউকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো,
-“পিউ এই পিউ? এতক্ষণ লাগে আসতে? কি করছিস তুই?”
ঘরে ঢুকতেই মা তাজ্জব বনে গেলেন। কাছে এসে পিউকে সরিয়ে তিতিরের কাধে হাত রেখে বললেন,
-“কি হয়েছে আমার লক্ষী আম্মুটার? কাঁদছে কেন?”
তিতির কিছু বলল না। পিউ সবটা বলতেই মা হেসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-“বাহ! আমার ছেলে দেখছি খুব ভাগ্যবান। এটুকুর জন্য বউ এমনভাবে কাঁদছে! বউটা যদিও একদম ছেলেমানুষ, একদম আনাড়ি! কিন্তু বুকে প্রেম আছে গদগদ! আজ বুঝলাম ছেলে আমার কি করে তোমার জন্য এত পাগল হলো!”
তিতির এ কথায় লজ্জা পেয়ে গেল। মা তিতিরের চোখদুটো মুছে বলল,
-“সত্যি এই দুদিন আমি তোমাকে যতটুকু দেখেছি তাতে আমি বুঝে গেছি, আমার ছেলে তোমার সাথে ভাল থাকবে। এই চুজি, মুডি ছেলেটাকে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। আজ আমি নিশ্চিন্ত! ওকে সারাজীবন এমনভাবেই ভালবেসো মা। কখনো ওকে একলা ছেড়ো না। তোমার আর কিচ্ছু করতে হবে না, আর কোনো দায়িত্ব নেই। বাকী সবকিছু আমার ছেলেই সামলে নেবে।”
তিতির কিছু বলল না। কিন্তু কান্না থামলো। পিউ বলল,
-“ভাবী তোমাদের বাস যেন কয়টায়?”
-“তোমার ভাইয়া তো বলেছিল ১১ টায়।”
মা বলল,
-“যাবেই যখন আরো আগে রওনা দিলে ভাল হতো। রাত হয়ে যাবে না যেতে যেতে?”
পিউ বলল,
-“ভাইয়া বুঝবে ওসব! এসব ব্যাপারে আমাদের চেয়ে ভাইয়ার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, ১১ টার বাসে যখন যাচ্ছে নিশ্চই ভাল বুঝেই যাচ্ছে।”
তিতির কিছু বলল না। মা বলল,
-“আচ্ছা মা, এখন ওঠো। শাড়ি পালটে নাও। ফ্রেশ হয়ে নাও।”
-“আমি একেবারে গোসল করে ফেলব। সারাদিন তো জার্নি করতে হবে।”
-“ও হ্যা। ঠিকাছে করো।”
মা ঘর বের হবার সময় পিউকে বলল,
-“মুগ্ধকে এখনি ডাকিস না। সারারাত যখন ঘুমায়নি আরেকটু ঘুমাক।”
তিতির গোসল করে ড্রইং রুমে আসতেই মা বলল,
-“তিতির নাস্তা করে নাও। আমরা সবাই অনেকক্ষণ আগেই নাস্তা করে ফেলেছি।”
-“ও উঠুক, একসাথেই খাব।”
-“ওর তো উঠতে দেরী হতে পারে। তুমি খেয়ে নাও না।”
-“দেরী হলেও সমস্যা নেই। আমার খিদে পায়নি।”
-“পাগলী।”
সাড়ে নটার দিকে তিতির পিউয়ের ঘরে বসে শেষ গোছগাছ টা সেড়ে নিচ্ছিল। পেছন থেকে মুগ্ধ বলল,
-“এইযে সুন্দরী! এভাবে ছলনা করলে আমার সাথে? এটা কি ঠিক হলো?”
তিতির এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে গিয়ে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও ওকে জড়িয়ে ধরতেই কেঁদে ফেলল।”
-“আরে আরে! কি হলো এটা? কাঁদছ কেন?”
-“সরি, আমাকে মাফ করে দাও।”
-“মাফ এর কথা আসছে কোত্থেকে?”
-“তোমাকে আমি সারারাত অপেক্ষা করিয়েছি। তারপর ভোম্বলের মত ঘুমিয়েছি। আমি খুব খারাপ। আমি অমানুষ। আমি জঘন্য।”
-“এই পাগলী, থামো। নাহলে চড় মেরে দাত ফেলে দেব। কতবড় সাহস! আমার বউকে যা তা বলা!”
তিতির থামছেই না। মুগ্ধ তিতিরের মুখটা তুলে ভেজা চোখে চুমু দিয়ে বলল,
-“আজ রাতে তো বাসে একসাথেই থাকবো, পুষিয়ে দিও।”
তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“অনেক হয়েছে। এবার থামো আর ব্রেকফাস্ট করতে চলো। আধাঘণ্টার মধ্যে বের হতে হবে নাহলে বাস মিস করবো।”
ওরা যখন বের হচ্ছিল মুগ্ধর মা তিতিরকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমু দিলেন। পিউকেও জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল তিতির। এদের ছেড়ে যেতে কেন জানি কষ্ট হচ্ছে, এরা যেন পর কেউনা। শুধু ২/৩ দিন না শতজনমের চেনা।
প্ল্যানমাফিক ওরা ১১ টার বাসে বান্দরবান রওনা হল। যদিও ১ ঘন্টা লাগার কথা কিন্তু প্রায় ১ টা বেজে গেল পৌঁছতে। বাস থেকে নেমে মুগ্ধ বলল,
-“বান্দরবানে এখন আমাদের কাজ হলো খালি খাওয়া।”
-“মানে? আসলেই এখানে কি প্ল্যান তার কিছুই বলোনি আমাকে।”
-“বলবো কি করে? এসব ডিসকাশন বাসায় বসে করলে প্রব্লেম না?”
-“হুম। এখন বলোনা আমরা কোথায় কোথায় যাব? এই নিলগিরি যাব?”
-“নাহ। নিলগিরি অনেক দূর রে বাবা। আমরা এখন আমার প্রিয় এক রেস্টুরেন্টে ভাত খাব। তারপর নীলাচল যাব। নীলাচল থেকে ফিরে আবার যাব আরেকটা প্রিয় রেস্টুরেন্টে কাবাব খেতে। তারপর ১০ টার বাসে ঢাকা।”
-“নীলাচল কি নিলগিরির মতই না?”
-“না নীলাচল ১৬০০ ফিট উঁচু। তবে সৌন্দর্যের দিক থেকে কোন অংশে কম না, অস্থির অস্থির।”
-“ওহ, ওয়াও।”
-“চলো চলো আগে খেয়ে নিই। তারপর নীলাচল যাই।”
-“আমার অত খিদে পায়নি। এসেও খেতে পারি।”
-“না, তখন স্পেশাল আইটেম গুলো শেষ হয়ে যাবে আর নীলাচলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।”
-“আচ্ছা, তাহলে চলো।”
মুগ্ধ একটা রিক্সা ডাকলো,
-“এই মামা, রাজার মাঠ যাবা?”
-“১৫ টাকা।”
-“হ্যা চলো।”
রিক্সায় উঠেই মুগ্ধ ফিসফিস করে তিতিরের কানে কানে বলল,
-“মজার ব্যাপার কি জানো? এখানকার রিক্সায় শহরের মধ্যে তুমি যেখানেই যাওনা কেন ভাড়া ১৫ টাকা।”
-“সেটা কি করে সম্ভব?”
-“সম্ভব কারন, শহরটাই এমন ছোট। শহরের বাইরে আবার ভাড়া বেশি।”
-“ওহ।”
রিক্সা থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নাম “চড়ুইভাতি”। অপজিটে একটা মাঠ। তিতির বলল,
-“এটাই রাজার মাঠ?”
-“হুম।”
ভেতরে ঢুকতেই ম্যানেজার হাত বাড়িয়ে বলল,
-“আরে মুগ্ধ ভাই যে!”
মুগ্ধ হ্যান্ডশেক করে বলল,
-“কেমন আছেন রফিক ভাই”
-“ভাল। অনেকদিন পর এলেন।”
-“ওইতো ভাই আসলেই দৌড়ের উপর ভেতরে চলে যাই। শহরে তো থাকা হয়না।”
এরপর লোকটা তিতিরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাবী নাকি?”
-“হ্যা।”
-“বাহ! বসেন বসেন কি খাবেন বলেন?”
মুগ্ধ এক নিঃশ্বাসে বলল,
-“বাঁশ কুরুইল, বেম্বো চিকেন, রুপচাঁদা ফ্রাই। আর ভর্তা যা আছে।”
তিতির বলল,
-“এতকিছু কে খাবে?”
-“তুমি না খেতে পারলেও আমি পারবো। সো ডোন্ট ওরি।”
খাওয়া শুরু করতেই তিতির অবাক। রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে মনেই হচ্ছে না। একদম বাসার রান্নার মত। এত মজার রুপচাঁদা ফ্রাই তো মাও করতে পারেনা বাসায়। আর পাহাড়ী আইটেম দুটোর তো কোনো তুলনাই হয়না। লাস্ট মোমেন্টে মুগ্ধ বলল,
-“কি বুঝলে?”
-“অসাধারণ!”
-“আর দুটো রুপচাঁদা নেই কি বলো? ভাত খাওয়ার যায়গা তো আর নেই পেটে। শুধু মাছ খাই?”
-“আমিই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম যে আরো দুটো মাছ নাও।”
আরো দুটো মাছ নেয়া হলো খাওয়াও হলো। আর সবশেষে কফি। কফিতে চুমুক দিয়ে তিতির বলল,
-“কফিটাও জোস!”
-“হুম।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আবার বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রিক্সা নিল ওরা। রিক্সায় উঠেই তিতির বলল,
-“তোমার সাথে থাকলে আমি পুরা মটুস হয়ে যাব। দেখো ৩ দিনে কি ফুলে গেছি।”
-“ফুলে যাওনি। তবে একটু ভরা ভরা লাগছে। বেশ লাগছে, অত টিংটিঙে থাকার চেয়ে এই ভাল।”
এতক্ষণে রিক্সা চলে এসেছে। ভাড়া মিটিয়ে দুজনে হাটছে। মুগ্ধ বলল,
-“নীলাচলের জন্য একটা কিছু নিতে হবে।”
তিতির কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আর বলা হলো না তার আগেই মুগ্ধ দৌড় দিল। তিতির কিছুই বুঝলো না মুগ্ধ দৌড় কেন দিল! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলো মুগ্ধ একজনকে ধরে মারতে শুরু করেছে। মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। এখন লাথি মারছে। উফ কি ভয়ঙ্কর! কি অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে মুগ্ধ! লজ্জায় তিতির কান চেপে ধরলো। একি সত্যিই মুগ্ধ নাকি অন্য কেউ? মুগ্ধ এতটা হিংস্র কি করে হলো! আর ওর মুখের ভাষা এতটা নিচে নামলো কি করে। তিতির দৌড়ে চলে গেল ওদের কাছে। গিয়ে দেখলো মুগ্ধ যে ছেলেটাকে মারছে সে হাসু। তিতির বিস্ময়ে হাত চেপে ধরেছে মুখে। আশপাশ থেকে অনেক লোক এসে ভীর হয়ে গেছে কিন্তু কেউ এসে থামাতে সাহস পাচ্ছে না। তিতির কি আগাবে? এগিয়ে থামাবে ওকে? বুঝতে পারছে না কিছুই। সিএনজি মহাজন এসে বলল,
-“ভাই কি হইসে আমাগো একটু কন। এমনে মারতাসেন ক্যান?”
মুগ্ধ হাসুর কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
-“বল কি করিসিলি? বল? তুই না বললেও আমি বলবো। সব প্রমাণও কিন্তু আছে, ডিসাইড কর কি করবি। তাড়াতাড়ি, হাতে সময় নাই।”
হাসু মুগ্ধর পা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ভাইজান আমারে মাফ কইরা দেন। খোদার কসম আর জীবনে এমুন কাম করুম না।”
মুগ্ধ ওকে সজোরে লাথি মেরে ফেলে দিল রাস্তায়। তারপর বলল,
-“তোরে মাফ চাইতে কেউ বলে নাই। সেদিন কি করসিলি সেইটা বল সবার সামনে।”
মহাজন হাসুকে রাস্তা থেকে তুলে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে ভাইজান রে চিনোস? কি করসিলি? এমনে মারতাসে ক্যান?
মুগ্ধ ওকে আবার মারতে যাচ্ছিল তার আগেই ও গড়গড় করে সব বলে দিল। কিভাবে ডাকাতদের হেল্প করেছিল সব। শেষে আবার মুগ্ধর পা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“বিঃশ্বাস করেন ভাইজান আমার এইসব কাজ করিনা। কিন্তু সেদিন না করলে ওরা আমারে মাইরা ফালাইতো। ভয় দেখাইয়া আর টাকার লোভ দেখাইয়া রাজী হইতে বাধ্য করসে।”
মুগ্ধ আবার লাথি মেরে বলল,
-“ঘরে মা নাই? বোন নাই? বউ নাই? তাদের জন্য চিন্তা হয় না? অন্য মেয়েরাও কারো না কারো মা, বোন, বউ। শালা অমানুষের বাচ্চা।”
মহাজন বলল,
-“ভাইজান এবার আপনেরে আমি চিনছি। ৪/৫ মাস আগে অরেই আমি পাডাইসিলাম আপনের লগে। মাফ কইরা দিয়েন ভাই। অয় যে এমুন আমি আগে জানতাম না।”
তারপর হাসুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আইজ থেকা তুই আর আমার সিএনজি চালাইতে পারবি না। ডাকাইতগো লগেই কাম কর যাইয়া। যা দেনা-পাওনা আছে সাজের বেলা আইসা নিয়া যাইস।”
মুগ্ধ আর কোন কথা না বলে তিতিরের হাত ধরে বেড়িয়ে এল ভীর কাটিয়ে।
জীপে বসে আছে তিতির-মুগ্ধ। জীপ চলছে উঁচু নিচু পাহাড়ী রাস্তায়। গন্তব্য নীলাচল। অনেকখানি রাস্তা চলে এসেছে। দুজনের একজনও একটি কথাও বলেনি। তিতিরের বিস্ময় এখনো কাটেনি। আজ মুগ্ধর অজানা এক রূপ ঝুলি থেকেই যেন বেরিয়ে এল তিতিরের সামনে। খুব ভয় পেয়েছিল তিতির। রেগে গেলে কি মুগ্ধ ওর সাথেও এত বাজে ভাষায় কথা বলবে? এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তিতিরের। সত্যি সারাজীবন একসাথে থাকলেও মানুষ চেনা যায়না। ওর তো মাত্র ৪ মাস!
একসময় নীরবতা ভেঙে মুগ্ধ বলল
-“ভাবছো আমি খুব খারাপ?”
-“না।”
-“তাহলে? কথা বলছো না, দূরে বসে আছো! এসবের কারন কি?”
-“কই?”
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এগিয়ে ওর হাতটা ধরতেই তিতির আচমকা সরে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“ভয় কেন পাচ্ছো?”
তিতির ভাবলো সত্যিই তো, ও কেন ভয় পাচ্ছে! বলল,
-“কই নাতো! ভয় পাচ্ছি না।”
মুগ্ধ তিতিরের হাতটা ধরে বলল,
-“শোনো তিতির, তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি তোমার আমাকে ভয় করছে। তুমি আমাকে এরকম ভাবোনি হয়তো তাই এক্সেপ্টও করতে পারছো না। কিন্তু তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারন দেখি না। ও অনেক বড় একটা অন্যায় করেছিল। রাগটা আমার সেদিনই উঠেছিল কিন্তু তোমার সেফটির কথা ভেবে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”
তিতিরের মনে পড়লো মুগ্ধর মা বলেছিল মুগ্ধর অনেক রাগ, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মুগ্ধ বলল,
-“দেখো, আমি অল্পতে রাগি না কিন্তু কেউ বেঈমানি করলে প্রচন্ড রেগে যাই।”
তিতির ভয়ে ভয়ে বলল,
-“বেঈমানকে তার বেঈমানির শাস্তি দেয়ার জন্য আল্লাহ আছেন।”
-“হ্যা অবশ্যই আছেন। আমি তো শাস্তি দেইনি। আমি শুধু প্রটেস্ট করেছি। আমার প্রটেস্ট করার ধরনটা এমন। আমার বাবা ছোটবেলা থেকে আমকে এভাবে প্রটেস্ট করতে শিখিয়েছেন। তার কারন, মার কেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। আমাদের সোসাইটিতে সবাই ক্রাইম করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর আমরা কাপুরুষের মত হাত গুটিয়ে বসে থাকি! আমরা যত হাত গুটিয়ে বসে থাকবো ক্রাইম ততই বাড়তে থাকবে।”
তিতির চুপ করে বসে রইল। এতক্ষণে একবারও তাকায়নি মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো? কিছু বলো।”
-“তোমাকে তখন আমার অচেনা লাগছিল। তোমার ফেসটাও বদলে গিয়েছিল।”
মুগ্ধ তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“কান পেতে শুনে দেখো তো, এই হৃদস্পন্দন অচেনা কিনা?”
তিতির শুনলো ওর চেনা সেই শব্দ, ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ! পেল সেই চেনা ঘ্রাণ। মুগ্ধ একটু সময় দিল তিতিরকে। তারপর বলল,
-“তিতির প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই ভাল খারাপ দুটো দিক থাকে। ভালটা খুব সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু খারাপটা একসাথে থাকতে থাকতে সামনে আসে।”
তিতিরের মনে হলো মুগ্ধ তো ঠিকই বলছে। অন্যায় দেখলে যারা চুপ করে থাকতে পারে না তারাই তো প্রকৃত মানুষ। বলল,
-“আমি হঠাৎ তোমকে এভাবে দেখছি বলে হজম করতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু প্রটেস্ট করা কোনো খারাপ কাজ না। সো এটাকে তোমার খারাপ দিক বলা যাচ্ছে না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমি অনেক স্ল্যাং ইউজ করেছি তিতির। তুমি তো জানতে না তোমার মুগ্ধ এত স্ল্যাং ইউজ করে।”
তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“শুধু মেরেই প্রটেস্ট করা যেত, স্ল্যাং টা এক্সট্রা ছিল যার কোনো দরকার ছিল না। বাট এধরনের সিচুয়েশনে এমনই হয়, আই কান্ট কন্ট্রোল মি। এটা আমার খারাপ দিক। এজন্যই বললাম আজ আমার খারাপ দিকটা তোমার সামনে এসেছে। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে তোমার সবটা জানা দরকার। সব জেনেশুনে তারপর ডিসিশন নাও।”
তিতির মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে বলল,
-“কিসের ডিসিশন?”
-“আমার সাথে সারাজীবন থাকার ডিসিশন।”
তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“একদম বাজে কথা বলবে না। আমি ডিসিশন অনেক আগেই নিয়ে ফেলেছি। এখন তুমি যেমনই হও না কেন আমি তোমার সাথেই থাকব।”
-“যদি আমার আরো আরো খারাপ দিকগুলো তোমার সামনে আসে তবুও থাকবে?”
-“তবুও থাকব।”
-“যদি জানতে পারো আমার আরেকটা গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও?”
তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে দিয়ে ওকে মারতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ হাসতে হাসতে ওর দুই হাত একসাথে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এল। তারপর মুখটা ধরে গালে একটা চুমু দিল। তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রাখলো।
নীলাচলের সামনের টিকেট কাউন্টারে জীপ থামতেই মুগ্ধ আর ড্রাইভার নামলো টিকেট কাটতে। তিতিরও নেমে দাঁড়ালো। চিকন রাস্তা দুই ধারে খাদ! অনেক নিচে দূরে বান্দরবান সিটি দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সাঙ্গু নদী আর অজস্র উঁচ নিচু পাহাড়। মুগ্ধ পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল,
-“চলো।”
-“এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম?”
-“মাত্র ৬ কিমি তো!”
-“ওহ।”
মুগ্ধ জীপের দরজা খুলতেই তিতির বলল,
-“আবার জীপে উঠব কেন?”
-“এটা তো কাউন্টার। আরেকটু যেতে হবে। হেটে যাবে নাকি?”
-“ওহ।”
জীপ সাঁই করে একবার নিচুতে গিয়ে আবার উঁচুতে উঠে নীলাচলে নামিয়ে দিল। মুগ্ধ জীপটাকে পার্কিং এ দিয়ে ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে বলল,
-“আমরা হাইয়েস্ট ২ ঘন্টা থাকব। তুমি যেখানে ইচ্ছা অপেক্ষা করতে পারো। এসে তোমাকে ফোন দিলে তুমি চলে এসো।”
চওড়া সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল তিতির। ওর মনে হলো ওরা কোনো পার্কে বেড়াতে এসেছে। মানুষের অভাব নেই। মুগ্ধ ওর হাত ধরে বাম পাশের একদম কিনারে নিয়ে গেল। এখানটায় ইটসিমেন্ট দিয়েই গাছের গুড়ির ডিজাইন করে তা দিয়ে বারান্দার মত বানিয়েছে। এখানে এসে সামনে তাকাতেই তিতিরের মন ভাল হয়ে গেল। মুগ্ধ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-“কি এখন ভাল লাগছে তো?”
-“হুম। তুমি বুঝতে পেরেছিলে প্রথমে আমার ভাল লাগেনি?”
-“হ্যা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তোমার এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝেছি।”
তিতির হাসলো।এরপর মুগ্ধ ওকে হাত ধরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির দেখলো এখানে একটা গোল দোতলা বিল্ডিং আছে। কাছাকাছি যেতেই বুঝলো এটা একটা রেস্টুরেন্ট। মুগ্ধ রেস্টুরেন্টের দোতলায় চলে গেল। দোতলায় স্টাফদের রেস্টরুম বোধহয়। মুগ্ধ একটা ওয়েটারকে ডেকে বলল ছাদে যেতে চায়। ওয়েটার বলল,
-“পারমিশন নাই।”
মুগ্ধ ওয়েটারের হাতে ১০০ টাকা গুঁজে দিতেই ওয়েটার হেসে হেসে বলল,
-“ভাই আসলে তো এভাবে কাউকে উপরে যেতে দেইনা। বেশিক্ষণ থাকবেন না।”
-“হ্যা হ্যা আমি একটু তোমার আপুকে উপর থেকে পাহাড় দেখিয়েই চলে আসব।”
উপড়ে উঠতে উঠতে তিতির বলল,
-“পুলিশের ছেলে হয়ে তুমি ঘুষ দিচ্ছ?”
-“এটা ঘুষ না। আমাকে ও কিছু দিচ্ছে আমি ওকে কিছু দিচ্ছি, শোধবোধ। তাছাড়া আমাকে অত অনেস্ট ভাবার কোনো কারন দেখি না। আমার প্রয়োজনের জিনিসটা আমি যেভাবে হোক আদায় করে নিই। এটা আমার আরেকটা খারাপ দিক।”
একথা বলেই হাসলো মুগ্ধ। উপরে উঠেই তিতির বুঝলো কেন মুগ্ধ ঘুষ দিয়ে হলেও এখানে নিয়ে এসেছে ওকে। মুগ্ধ একেবারে কিনারে নিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আশেপাশে তাকিও না। দূরে থাকাও। যতদূরে চোখ যায়।”
তিতির তাই করলো। তারপর মুগ্ধর বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বলল,
-“খুব মনে পড়ছে নীলগিরির কথা। কিভাবে পাহাড় দেখিয়েছিলে আমাকে। আমি তো দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
-“হুম।”
-“আচ্ছা তুমি কি সবাইকে ওভাবে পাহাড় দেখাও?”
-“নাহ, তোমার মধ্যে মুগ্ধতা বেশি তাই তোমাকে দেখিয়েছি।”
এখান থেকে সব পাহড়গুলোকে নীল দেখাচ্ছে। এজন্যই বোধয় এটার নাম নীলাচল। ডান পাশে তাকাতেই দেখতে পেল কয়েকটা ঘর। সবগুলোর চাল নীল। তিতির জিজ্ঞেস করল,
-“ওটা কি?”
-“নীলাচল এস্কেপ রিসোর্ট।”
-“ওখানে কি টুরিস্টরা থাকতে পারে?”
-“হ্যা। গুজব আছে আর্মিরা ছাড়া কেউ থাকতে পারেনা কিন্তু আসলে পারে। আমি তো এক রাত থেকেছি উইদাউট এনি রেফারেন্স।”
-“সত্যি?”
-“হ্যা।”
তিতির ঘুরে দাঁড়াল। মুগ্ধর গলার পিছনে দুহাত বেঁধে বলল,
-“আমি থাকব।”
-“মানে?”
-“তুমি কাল ছুটি নিতে পারবে?”
-“কেন?”
-“তাহলে আজ রাতে ফিরব না। এখানেই থাকব।”
-“পাগল হলে নাকি?”
-“প্লিজ প্লিজ না করোনা।”
-“বান্দরবান টু ঢাকার টিকেট আমি গতকালই চিটাগাং থেকে কেটে রেখেছিলাম।”
-“তো? এখন ফেরত দেয়া যাবে না? আর ফেরতই কেন? আমরা তো যাবই বাট আজকের বদলে কাল বা পরশু। দুদিন পাহাড়ে থাকব। শুধু তুমি আর আমি।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের কোমর জড়িয়ে বলল,
-“আমার পাগলীটার মাথা দেখছি পুরো খারাপ হয়ে গেছে।”
-“এই বলোনা টিকেট চেঞ্জ করা যাবে?”
-“তা যাবে, পরিচিত। অপরিচিত হলেও যেত.. কিন্তু।”
তিতির মুগ্ধর মুখ চেপে ধরে বলল,
-“এত কিন্তু কিন্তু করোনা প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
মুগ্ধ ওর মুখ চেপে ধরা তিতিরের হাতে চুমু দিয়ে বলল,
-“যদিও আগে বুকিং না দিলে পাওয়া যায় না। তবু চলো দেখছি কি করা যায়।”
ভাগ্য ওদের সাথে ছিলনা। নীলাচলে একটা রুমও পাওয়া গেল না। ইভেন এখন বুকিং দিলে তিন মাস পরে পাওয়া যাবে। একথা শুনে তিতিরের মন খারাপ হয়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“প্রমিস তোমাকে এখানে আবার আনবো। এই নীল চালওয়ালা এস্কেপ রিসোর্টেই রাখবো। নিলগিরি হিল রিসোর্টেও রাখবো। কিন্তু মন খারাপ করোনা বাবা।”
-“তাহলে অন্যকোথাও থাকি? আজ আমার ঢাকা যেতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকা গেলেই তো আর তোমাকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমরা অনেক কাছাকাছি থাকি তিতির। আর হতে পারে দূর থেকে তবু তো এই মুখটা প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার সময় দেখিয়ে যাই। কাছ থেকেও তো দুএকদিন পর পর দেখা হয়।”
তিতির রাগে গটগট করে বলল,
-“তুমি থাকতে চাচ্ছো না? ওকে চলো।”
বলেই হাটা শুরু করলো। মুগ্ধ দৌড় দিয়ে ওকে ধরে ফেলল। বলল,
-“এই পাগলী! আমি কি বলেছি থাকতে চাচ্ছি না? তোমার কথার প্রেক্ষিতে ওই কথা বললাম।”
তিতির মাথাটা এক দিকে হেলিয়ে বলল,
-“তাহলে বল থাকবে।”
-“আচ্ছা আচ্ছা থাকব। মিলনছড়ি হিল রিসোর্টের কথা মনে আছে বলেছিলাম?”
-“হ্যা, পাখির নামে নাম সব কটেজের।”
-“হুম। ওখানে থাকবে?”
তিতির লাফিয়ে উঠে বলল,
-“উফফফ… ওয়াও!!! চলো চলো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আন্দাজে গিয়ে কি করবো? খালি থাকলে ফোনেই পাব। চলো নিচে চায়ের দোকান আছে। চা খাই আর খুঁজি কোথায় থাকা যায়।”
-“খুঁজতে হবে? যদি পাওয়া না যায়? আচ্ছা এত বড় বান্দরবানে আমাদের থাকার যায়গা হবে না?”
-“শোনো, সিটিতে তো হোটেলের অভাব নেই। কিন্তু ওখানে থেকে লাভ নেই। কোনো রিসোর্টে থাকলে থাকাটা সার্থক হতো।”
-“তাহলে?”
-“রিসোর্ট না পেলে থাকব না। চলে যাব।”
তিতির মন খারাপ করে রইল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা তুমি যে আজ রাতে থাকতে চাচ্ছো তোমার ভয় করছে না?”
-“কিসের ভয়? তুমি আছো না? তুমি থাকতে ভয় কিসের?”
-“আরে ভয়টা তো আমাকে নিয়েই।”
-“তোমাকে নিয়ে কি ভয়?”
-“তোমাকে একা পেয়ে যদি ভুল কিছু করে ফেলি।”
-“আমি জানি আমার মুগ্ধ কোন ভুল করতে পারেনা। এর আগেও আমরা অনেক রাত দুজনে একসাথে থেকেছি।”
-“হ্যা, তখন তো তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলেনা।”
-“তাতে কি?”
-“তাতে কি জানোনা? মুগ্ধর তো তোমার উপর অনেক লোভ জন্মেছে যা আগে ছিলনা।”
তিতির মুগ্ধর পিঠে ঘুষি দিতে দিতে বলল,
-“তুমি শুধু শুধু আমাকে কনফিউজড করবে না।”
মুগ্ধ হাসতে লাগলো। তিতির মারপিট থামিয়ে মুগ্ধর হাত জড়িয়ে হাটতে হাটতে বলল,
-“তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে।”
চায়ের দোকানগুলো পাহাড়ের পাশেই। টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। অনেক রকম পাহাড়ী জিনিস পাওয়া যায় এখানে। বেঞ্চে বসতেই তিতির খেয়াল করলো ফ্লোরটা কাঠের। দেয়ালগুলো বাশের। ওরা যেখানে বসে ছিল তার দেয়ালগুলো বারান্দার মত অর্ধেক। দূরের সব দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে যা উপর থেকে দেখেছিল কিন্তু এখান থেকে আবার অন্যরকম লাগছে। অত দূরে লাগছে না। মনে হচ্ছে কাছেই। মুগ্ধ দোকানী মেয়েটাকে বলল,
-“দিদি দুটো চা দিয়েন।”
তারপর তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ম্যাম, বলেন কয়দিনের ছুটি নেব?”
-“দু’দিন।”
-“বুঝে বলো। কারন তারপর আবার বায়না ধরলে রাখতে পারব না। দু’দিন ছুটি নিলে মরতে মরতে হলেও তিন দিনের দিন অফিসে এটেন্ড থাকতে হবে।”
-“হ্যা হ্যা দুদিনই। কাল আর পরশু। কারন, কাল রাতে আমরা রওনা দিব। পরশু সকালে পৌঁছে সারাদিন রেস্ট নিবে। পরের দিন অফিস যাবে।”
-“শুধু আজ রাত আর কালকের দিনটা থাকবে তো?”
-“হ্যা।”
-“আচ্ছা। তাহলে আমি শুধু কালই ছুটি নেব। রেস্ট লাগে না। এতদিন তো রেস্ট করলামই।”
-“তবু জার্নি করে ফিরে একটু রেস্ট নিবে না?”
-“আরে না। একটা ছুটি মানে অনেক কিছু। এভাবে রেস্ট নিয়ে নষ্ট করার মানে হয়না। আমি ট্যুরে গেলে ভোরবেলা ফিরেই অফিস যাই, অভ্যাস আছে।”
তিতির আর কিছু বলল না। মুগ্ধ ফোন করে একদিন ছুটি নিয়ে নিল। তারপর মিলনছড়ি হিল রিসোর্টে ফোন দিয়ে জানতে পারলো কোন কটেজ খালি নেই। তিতির বলল,
-“এখন কি হবে?”
-“দেখছি।”
কিছুক্ষণ নাম্বার ঘেটে তারপর বলল,
-“তিতির, আমি এখন ফোন করছি আমার সবচেয়ে প্রিয় রিসোর্টের কেয়ার টেকারের কাছে। অমায়িক লোক, অনেকটা মংখাইয়ের মত। দোয়া করো যাতে ওখানে একটা ব্যবস্থা হয়।”
-“ওকে।”
তিতির খুব এক্সাইটেড ছিল। ফোন করল,
-“হ্যালো।”
-“হ্যালো, বংশী দা.. মুগ্ধ বলছি।”
-“আরে সাহাব। আপ? আপ কাহাসে?”
-“বান্দরবান থেকেই। কোনো কটেজ খালি আছে? বউ নিয়ে এসেছি।”
-“আপ সাদি ভি কার লিয়া? সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ!”
-“হ্যা দাদা। এবার একটা কটেজ দাওনা গো।”
-“লেকেন দুখ কি বাত ইয়ে হে সাহাব, কোয়ি ভি কামরা খালি নেহিহে।”
-“আহা। গেল সব।”
-“কা গায়া সাহাব?”
-“খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের “হলিডে ইন” এই থাকব। আমার বউটা ওইরকম যায়গা খুব পছন্দ করত।”
-“আফসোস কি বাত হে। আগার আপ হামকো কুছ দিন পেহলে বাতা দে তো হাম আপকো অর বিবিজিকো লিয়ে ও লেকওয়ালা কামরা রাখ দেতা।”
-“হুট করে এসেছি। কোনো প্ল্যানিং ছিলনা দাদা। আচ্ছা, কি আর করা। রাখছি তাহলে।”
-“আচ্ছা সাহাব, কেয়া আপ হামকো কুচ সামে দে সাকতা? হাম ম্যানেজার সাহাব কো পুছকে বাতা তা হু কেয়া তাম্বু খাটানা যাবে কি নেহি!”
-“দাদা আমি তো তাঁবু আনিনি।”
-“হামারে পাস তো হেয়।”
-“ওহ, আচ্ছা দেখ তাহলে।”
-“ঠিক হেয় সাহাব। ম্যানেজারবাবু বান্দরবান গায়া হেয়। কুছ দের বাদ আয়েগা।”
-“আচ্ছা আচ্ছা।”
আরো কয়েকটা রিসোর্টের ফোন নাম্বার ছিল মুগ্ধর কাছে। একে একে সব গুলোতে ফোন করলো মুগ্ধ। কোনোটাতেই কোনো কটেজ খালি নেই। তিতিরের মনটা পার্মানেন্টলি খারাপ হয়ে গেল। আর মুগ্ধ শেষপর্যন্ত বংশীর আশায় রইলো।
বিকেলটা নীলাচলে কাটিয়ে ওরা বান্দরবানে ফিরে এল। সন্ধ্যা হতে হতে মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেল যার নাম মেঘদূত। এটা যে রেস্টুরেন্ট সেটা বুঝতেই কতক্ষণ সময় লেগে যায়। বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের শুরুতেই রাস্তার ডান পাশে একটা বড় একতলা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর একপাশে বিশাল কিচেন আর কাউন্টার। অন্যপাশে রেস্টুরেন্ট, এসি জোন। সামনে বাগান। বাগানে কম করে হলেও ১০/১২ টা টেবিল। মাঝখানে পানির ফোয়ারা। মুগ্ধ তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় বসবে? ভেতরে না বাগানে?”
-“অবশ্যই বাগানে।”
বাগানের কোনো টেবিলই খালি ছিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা টেবিল খালি হলো। মুগ্ধ বলল,
-“এখনে গিয়ে অর্ডার করতে হয়। তুমি বসো আমি অর্ডার করে আসি।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ অর্ডার করে ফিরে এসে বলল,
-“মুখটা প্যাঁচার মত করে রেখোনা তো। তোমাকে পেঁচিমুখী রুপে মানায় না।”
তিতির ক্ষেপলো না, মারলো না কিছুই করলো না। চুপ করে বসে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“আরে বাবা। আমি তো চেষ্টা করলাম। এত মন খারাপ করার কি আছে? কদিন পর নাহয় আগে থেকে বুকিং দিয়ে আসব।”
তিতিরের মন তাতে ভাল হল না। ও বলল,
-“আমি কোন কিছু একবার ঠিক করলে তারপর যদি না করতে পারি খুব অস্থির লাগে, আর কিছুই ভাল লাগে না তখন।”
-“দেখছি তো বাবা। একটু ধৈর্য ধর। বংশী ম্যানেজারের সাথে কথা বলেই জানাবে। থাকার ব্যবস্থা হলে তো জানাবেই নাহলেও জানাবে। কারন ও জানে আমি অপেক্ষা করছি।
খাবার চলে এল। মুগ্ধ গপাগপ খাচ্ছে। তিতির এখনো মুখেই দেয়নি। মুগ্ধ ওকে খাইয়ে দিতে চাইল। বলল,
-“একবার খেয়ে দেখো খাবাবগুলো। ঢাকায় কোথাও নেই এত টেস্টি কাবাব। আর এই কাবাব টার নাম “অস্কার পুলে”। সাথে বসনিয়া রুটি। আমার জানামতে বসনিয়া রুটি পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের আর কোথাও অস্কার পুলে পাওয়া যায়না। একবার মুখে দিয়ে দেখ জাস্ট, অমৃত।”
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তুমি খাও।”
মুগ্ধ রেখে দিল। বলল,
-“যাও আমিও খাবনা। খিদে নিয়ে সারারাত বসে থাকব।”
এমন সময় মুগ্ধর ফোন বেজে উঠলো। বংশী কল করেছে। তিতির ওর হাত আটকে ধরে বলল,
-“প্লিজ ফোন ধরোনা। যদি বলে ব্যবস্থা হয়নি আমি হার্ট অ্যাটাক করবো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আরে দুটোই তো হতে পারে। ফোন না ধরলে জানবো কি করে?”
-“জানিনা আমি।”
ফোন কেটে গেল ততক্ষণে। এবার মুগ্ধ নিজেই কল করলো।
প্রেমাতাল
তিতির ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে মুগ্ধর দিকে। ও বংশীর কথা তো শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু মুগ্ধ চুপ করে থেকে একসময় বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা নো প্রব্লেম। হুট করে এলে এমনটা হতেই পারে। আচ্ছা বংশী দা। রাখছি তাহলে।”
ফোন রাখতেই তিতির বলল,
-“ব্যবস্থা হয়নি না?”
মুগ্ধ তিতিরের গাল টিপে দিয়ে বলল,
-“মন খারাপ করোনা। আমি সামনের মাসেই আগে থেকে বুকিং দিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”
তিতির বলল,
-“আমি পারমিশন পাব না।”
-“পাবা পাবা।”
-“না পাবনা।”
-“আচ্ছা বাদ দাওনা এখন, যেভাবেই হোক আমি তোমাকে নিয়ে আসবো। এখন একটু খাও।”
তিতির প্লেট এগিয়ে নিল। খাওয়া শুরু করে বলল,
-“হ্যা, এতক্ষণ তো টেনশনে ছিলাম তাই খেতে পারছিলাম না। এখন তো আর কোনো টেনশন নেই, সব শেষ।”
-“বোকার মত কথা বলোনা তিতির। কিসের সব শেষ?”
তিতির কিছু বলল না, মন খারাপ করে খেতে থাকলো। হঠাৎ তিতিরের চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা লাচ্ছির দিকে। ৪ গ্লাস লাচ্ছি আর সাথে হাফ লিটারের বোতলের এক বোতল লাচ্ছি। তিতির বলল,
-“এত লাচ্ছি দিয়ে কি হবে?”
-“খাব। গ্লাসের গুলো এখন খাব। বোতলের টা রাস্তায় যেতে যেতে খাব। নষ্ট হয়ে যাবে নাহলে আরো নিতাম। এটা আমার প্রিয় লাচ্ছি। সব ইনগ্রিডিয়েন্স গুলো এত পারফেক্ট পরিমাণে দেয় যে একদম পারফেক্ট একটা লাচ্ছি হয়। তিতির এতক্ষণে হাসলো। বলল,
-“তুমি পাগল একটা।”
-“না, খাদক।”
রাস্তার অপজিটে আর্মিদের একটা সুপার শপ ছিল। খাওয়া শেষ হতেই মুগ্ধ ওই শপটা দেখিয়ে বলল,
-“চলো ওই শপটাতে একটু যাব।”
-“কি কিনবে আবার?”
-“চকলেট কিনবো।”
-“তুমি যাও। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই বরং ভাল লাগছে। তুমি যাও। কেনাকাটা শেষ করে এসো। আমি এখানেই বসে থাকি।
মুগ্ধ আর জোর করলো না, চলে গেল। মুগ্ধ যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো। তিতির ভিজে যাচ্ছে, ধুর! সবগুলো টেবিলের উপর ছাতা আছে, শুধু ওদেরটাতেই নেই। ভেতরে চলে যেতে পারে কিন্তু তাহলে তো মুগ্ধ ওকে খুঁজে পাবে না। ফোনটাও তো ব্যাগে আর ব্যাগ মুগ্ধর কাছে। যখন বৃষ্টির জোর বাড়লো তখন তিতিরের ভালই লাগলো ভিজতে। এর মধ্যেই মুগ্ধ দৌড়াতে দৌড়াতে এল। এসেই ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির বলল,
-“কোথায় যাচ্ছি?”
-“সিএনজি ঠিক করেছি।”
-“ওহ।”
মুগ্ধ বলল,
-“ভিজছিলে কেন তুমি?”
-“তো কি? যদি হারিয়ে যাই, আমার ফোন তো তোমার কাছে।”
মুগ্ধ তাকিয়ে দেখলো তিতিরের ঠোঁট বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে আর সেই ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো তিতির ওর ঠোঁট দিয়ে পিষে ফেলছে কথা বলার সময়। মুগ্ধর সেই ফোটাগুলোকে এখন হিংসা হচ্ছে। তিতির বলল,
-“কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
-“এমনি, চলো চলো।”
সিএনজিতে উঠেই মুগ্ধ আবার তাকালো তিতিরের দিকে। ওর ঠোঁটদুটো ভিজে সপসপে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে মুগ্ধর প্রচন্ড ইচ্ছে করছে ওই ভেজা ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে। এই অন্ধকারে সিএনজিতে সেটা পাওয়াও সম্ভব। কেন যেন মনে হচ্ছে তিতির আজ বাধা দেবে না। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল মুগ্ধ। ওদের প্রথম চুমুটা কিনা এভাবে হবে? নাহ! সুন্দর, পারফেক্ট একটা সময়ের জন্য মুগ্ধ অপেক্ষা করবে। যখন কোনো তাড়া থাকবে না, কেউ দেখে ফেলার আতঙ্ক থাকবে না আর যখন তিতিরের কোনো সংকোচ থাকবে না।
সিএনজি বাস স্ট্যান্ড পার হওয়ার পর তিতির বলল,
-“এই আমরা বাস স্ট্যান্ড পার হয়ে এলাম তো।”
মুগ্ধর ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখেই তিতির বুঝে ফেলল। বলল,
-“আমরা আজ থাকছি?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা, বংশী ফোন দিয়ে কনফার্ম করেছিল তখন, আমি তোমার সাথে একটু মজা করছিলাম। আর তাঁবুতে থাকতে হবে না। আমরা কটেজ পেয়েছি।”
তিতির একমুখ হাসি নিয়ে এক লাফ দিয়ে মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-“তুমি এত পাগলী কেন?”
তিতির ওর পিঠে খামচি মেরে বলল,
-“তুমি এত খারাপ কেন? কি মন খারাপ হয়েছিল আমার।”
মুগ্ধ হঠাৎই তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে কোলের মধ্যে উঠিয়ে নিল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ পাগলী!”
তিতিরের ইচ্ছে করছিল রিপ্লাই দিতে কিন্তু দিলনা। যখন দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে তখনই দিবে। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ কি শুধু লাভ ইউ টু বললেই হয়? আরো কত উপায় আছে! তিতির তারই একটা বেছে নিল। মুগ্ধর শার্টের ডান পাশের কলারটা সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিল ওর গলার ডান পাশে। তারপর ইচ্ছেমত চুমু দিল। মুগ্ধর পায়ের রক্ত এক লাফে মাথায় উঠে গেল। হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। নিজ উদ্যোগে করা তিতিরের প্রথম আদর। মুগ্ধ ওকে জাপ্টে ধরে রাখলো নিজের বুকের মধ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে যখন ওরা “রিসোর্ট হলিডে ইন” এ পৌঁছল, গাড়ির শব্দ পেয়ে বংশী দৌড়ে এল,
-“আইয়ে বিবিজি আইয়ে। আল্লাহ মেহেরবান কি হাম আপকো লিয়ে কুছ কার পায়া।”
তিতির হাসলো কিছু বলল না। ওদের ব্যাগ দুটো জোর করে নিয়ে নিচ্ছিল। মুগ্ধ দিলনা। জিজ্ঞেস করলো,
-“বংশী বিবিজিকে কেমন দেখলে? পছন্দ হয়েছে?”
বংশী মাথা নিচু করে বলল,
-“সাহাব ইয়ে আপনে কেয়া পুছা? মুজহে তো লাগা কি বেহেশত সে কোয়ি হুর আগেয়া।”
মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা তা ঠিক, কিন্তু বেশি বাচ্চা না?”
-“লেড়কি কাভি বাচ্চা নেহি হোতি সাহাব। উহারা পালাট কে সাত সাত জোয়ান বান যাতা।”
কথা বলতে বলতে ওরা রিসিপশনে চলে এল। তিতির বসলো। মুগ্ধ ফর্মালিটিজ সেরে তিতিরকে নিয়ে কটেজের সামনে যেতেই তিতির বলল,
-“আমরা এখানে থাকব?”
-“হ্যা।”
-“আর ইউ সিওর?”
-“হ্যা।”
-এই পুরো কটেজটা আজকের জন্য আমাদের?”
মুগ্ধ এবার হেসে দিল। তারপর বলল,
-“হ্যা।”
তিতির আরেকবার তাকিয়ে দেখে নিল কটেজটাকে। ছোট্ট একটা একতলা ঘর। কিন্তু দোতলা সমান উঁচু। নিচতলা সমান যায়গা ফাকা। টোঙ ঘরের মত করে বানানো। সামনেই চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির উপরে দোচালা ডিজাইনের চাল। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বারান্দা। বারান্দা দিয়েই ভেতরে ঢোকার দরজা দেখা যাচ্ছে। তিতির পা বাড়াতেই মুগ্ধ থামালো,
-“এই দাঁড়াও।”
-“কেন?”
-“বংশী একটা ছেলেকে পাঠালো না আমাদের ব্যাগ নিয়ে?”
-“হ্যা।”
-“ও বের হোক, তারপর আমরা যাব।”
-“আচ্ছা।”
ছেলেটা বের হয়ে চলে যেতেই মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তিতির মুগ্ধর গলার পিছনে দু’হাত বাধলো, মুখে হাসি। মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠে গেল। ভেতরে নিয়ে নামালো। তিতির ভেতরটা দেখে বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলো। পুরো রুমটাই কাঠের, ইভেন দেয়াল, ফ্লোর সব কাঠের। রুমে ঢুকেই হাতের ডান পাশে বিছানা সাদা বেড কভার বিছানো। বিছানার পাশেই বিশাল আয়নার বিলাশবহুল ড্রেসিং টেবিল। একটু সরে একটা আলমারি। সব ফার্নিচার ম্যাচিং ডিজাইনের। বাম পাশের দেয়ালের কর্নারে একটা দরজা, হয়তো টয়লেট। বাকী দেয়ালটুকু পুরোটাই সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা, নিচে কি? জানালা নাকি? কে জানে। সামনের দেয়ালে থাই গ্লাস লাগানো সিলিং থেকে ফ্লোর পর্যন্ত পুরোটা। এখানেও সাদা পর্দা। মুগ্ধ পর্দাটা টেনে দিয়ে তিতিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
-“কি ম্যাম? পছন্দ তো?”
-“পছন্দ হবে না মানে? আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না কি দেখছি আমি!”
-“আচ্ছা শোনো, অনেকক্ষণ ভেজা কাপড়ে আছো। চেঞ্জ করো। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। সারারাত যখন এখানেই আছো তখন সব দেখতে পারবে আস্তে আস্তে।”
-“আচ্ছা। আমি বাথরুমে যাচ্ছি চেঞ্জ করতে। তুমি রুমেই চেঞ্জ করে নাও।”
-“হুম।”
তিতির যখন ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে যাচ্ছিল মুগ্ধ বাধা দিল। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-“এই নাও। এটা পড়ো।”
-“এটা কি?”
-“শাড়ি। তোমার জন্য কিনলাম একটু আগে।”
-“মানে আর্মি শপটাতে তুমি এজন্যই গিয়েছিলে?”
-“হ্যা। কাল তো একটু দেখেছি শাড়ি পড়া বউ তিতিরপাখিকে। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে ইচ্ছে হলোনা।”
-“কিন্তু শাড়ি পড়তে তো আরো অনেক কিছু লাগে। পেটিকোট, ব্লাউজ। ওগুলো কোথায় পাব স্যার? কাল তো পিউয়ের টা পড়েছিলাম।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তোমার কি আমাকে বলদ মনে হয়? আমি আর যাই হইনা কেন বলদ নই। আর মেয়েদের ব্যাপারে সবই জানি সো শাড়ি পড়তে কি লাগে না লাগে তা আনবো না ভাবলে কি করে?”
তিতির হেসে বলল,
-“জানি আমি। কিন্তু আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা। কালই প্রথম পড়লাম। তাও মা পড়িয়ে দিয়েছিল।”
-“তো তুমি দেখোনি মা কিভাবে পড়িয়েছিল?”
-“হুম দেখেছি, শিখেছি কিন্তু অনেক প্যাঁচ। সব ভুলে গেছি।”
-“হায় খোদা! এখন শাড়ি পড়ানোটাও আমার শিখিয়ে দিতে হবে?”
-“তুমি পারো?”
-“পারব না কেন? মুগ্ধ সব পারে।”
-“কিভাবে পারো?”
সন্দেহের দৃষ্টি তিতরের চোখে। মুগ্ধ বলল,
-“ইউটিউবে আজকাল কি না শেখা যায় বলো? আমার খুব সাধ জেগেছিল শাড়ি পড়া দেখবার। কিন্তু জিএফ বউ কিছুই তো ছিলনা। তাই ইউটিউব থেকেই দেখেছি। আর শিখেও ফেলেছি।”
-“তুমি ওই মেয়েটার পেটের দিকে তাকিয়েছিলে?”
মুগ্ধ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোন মেয়ে?”
-“ইউটিউব ভিডিওতে যে মেয়েটা শাড়ি পড়া শেখাচ্ছিল?”
মুগ্ধর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। বলল,
-“হ্যা। মানে একটা সুন্দরী মেয়ে চোখের সামনে সুন্দর, মসৃন পেট বের করে শাড়ি পড়ছে। আর আমি কি চোখ বন্ধ করে থাকবো বলো? আমি কি পুরুষ মানুষ নই?”
-“তুমি সত্যি দেখেছো?”
-“হ্যা দেখেছি। বাট আই প্রমিস আমি আর কোনো শাড়ি পড়া মেয়ের পেটের দিকে তাকাব না। তখন তো তুমি ছিলে না তাইনা?”
তিতির উত্তর নাদিয়ে রাগ করে বাথরুমে ঢুকে গেল। ঢুকে তো ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। বাথটাব, হাই কমোড সব আছে। কিসের সাথে কিসের কম্বিনেশন! যাই হোক, ওর মুডটা অফ! মুগ্ধ কি বলল এটা! সত্যি কি দেখেছে নাকি ওকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলেছে কে জানে!
প্যাকেট টা খুলতেই তিতির দেখলো সিলভার পাড়ের লাল তাতের শাড়ি এনেছে মুগ্ধ। উফ শাড়িটা এত সুন্দর কেন? মুগ্ধর পছন্দ আছে বলতে হবে। সাথে লাল ব্লাউজ, পেটিকোটও আছে। ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ার অনেক চেষ্টা করলো তিতির কিন্তু পারলো না। কোনোভাবে পেঁচিয়ে বেড়িয়ে এল। বাইরে এসে দেখলো মুগ্ধ সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ইশ! কাল রাতে ঘুমাতে পারেনি বলেই হয়তো এখন ওর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। তিতির ওর কাছে গিয়ে ভেজা চুলগুলো মুগ্ধর চোখের উপর ধরলো। কয়েক ফোঁটা পানি পড়তেই মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে হেসে দিল। তারপর তিতিরের দিকে তাকাতেই চোখে যেন নেশা ধরলো। লাল শাড়িতে কিযে অপূর্ব লাগছে তিতিরকে! কাল নীল শাড়িতে বউ বউ লাগছিল আর আজ লাল শাড়ি, ভেজা চুল সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নতুন বউ বিয়ের পরদিন সকালে গোসল করে বেড়িয়েছে! কি বলবে! কিভাবে এক্সপ্রেশ করবে তিতিরকে দেখে ওর ভেতরে কি হচ্ছে। বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধ।
মুগ্ধ এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে তিতির লজ্জায় কোনো কথাই বলতে পারছিল না। মুগ্ধ আচমকা তিতিরকে কোলে তুলে নিল তারপর টয়লেটের পাশের দেয়ালের পর্দা সরিয়ে দরজা ঠেলে বারান্দায় চলে গেল। বারান্দাটা দেখে আরও একবার মুগ্ধ হলো তিতির। সামনে বিশাল লেক। লেকটা কি কৃত্রিম না প্রাকৃতিক কে জানে! মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে পরে। এখন আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
বারান্দাটা বেশ বড়। বারান্দায় কোনো ছাদ দেই। আর ঘরের সাথে লাগোয়া দেয়কলটি ছাড়া বাকি তিন দিকের দেয়ালগুলো ছোট ছোট হাটুসমান। প্রত্যেকটা কর্নারে ফুলের টব। একপাশে একটা সাদা রঙের সোফা। একটা ইরানি লাইটও জ্বলছিল বারান্দার এক কোনায়। মুগ্ধ তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিল। কারন লাইট টা চোখে লাগছিল। যদিও আকাশে মেঘ ছিল, পূর্নিমাও ছিল। মেঘের বিচরণ যেন খেলছিল ওদের সাথে। সরে গেলেই জোছনায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। আর মেঘে চাঁদ ঢেকে যেতেই আবছা অন্ধকারে লুকোচুরি খেলছিল। তিতির লেকের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ লাইট অফ করে তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই তিতির বলল,
-“একটা গান শোনাবে?”
মুগ্ধও আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল গান শোনাবে তাই বিনাবাক্যে শুরু করে দিল,
“মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদেরও দুল..
খোঁপায় তারার ফুল
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
কন্ঠে তোমার পড়াবো বালিকা
হংস সাড়ির দোলানো মালিকা
বিজরী জরির ফিতায় বাধিব
মেঘরঙ এলোচুল…
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়ে..
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি
আলতা পড়াব পায়ে..
আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিবও প্রিয়া
তোমারি হেরিয়া গাহিবে আমার
কবিতার বুলবুল
দেব খোঁপায় তারার ফুল
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।”
গানটা শেষ হতেই তিতির বলল,
-“এটা শুধু একটা গান ছিলনা। তার চেয়েও যেন অনেক বেশি কিছু ছিল।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হুম চলো বসি।”
একথা বলেই মুগ্ধ সোফায় গিয়ে বসলো। তিতিরও যাচ্ছিল পেছন পেছন। হাঁটা শুরু করতেই পায়ে বেঝে তিতিরের শাড়ির কুচি খুলে গেল। তিতির কুচিগুলো কুড়িয়ে নিল। মুগ্ধ উঠে এসে হেসে বলল,
-“এসো আমি পড়িয়ে দেই।”
-“না আমি পারব।”
এই বলেই তিতির ঘরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ তিতিরের কোমর আঁকড়ে ধরে আটকালো। তারপর বলল,
-“পারলে প্রথমবারই পারতে। একবার পড়িয়ে দেইনা। কি হয়েছে? আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমি আমার বউকে শাড়ি পড়িয়ে দেব তাইতো শিখেছিলাম।”
-“কিন্তু তখন যে বললে..”
-“ওটা তো তোমাকে রাগানোর জন্য বলেছি।”
তিতির দাঁড়ালো। মুগ্ধ দেখলো তিতির শাড়ি উলটো পড়েছে। শাড়িটা ঠিক করে পড়িয়ে তিতিরের সামনে হাটু গেরে বসে যখন কুচি দিচ্ছিল তখন তিতির বলল,
-“ব্লাউজটা একদম ঠিক মাপের হয়েছে। তোমাকে তো আমি কখনো বলিনি তাহলে মাপ জানলে কোত্থেকে?”
-“তোমার মাপ আমি জানবো না তো জানবে কে? তোমার পা থেকে মাথা অবধি কত শতবার চোখ দিয়ে মুখস্থ করেছি জানো?”
তিতির লজ্জা পেল। মাঝে মাঝে মুগ্ধ যে কিসব বলে, মুখে কিছু আটকায় না। এরপর মুগ্ধ বলল,
-“অবশ্য মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে কিভাবে শাড়ি পড়লে জানো?”
-“কিভাবে?”
-“আগের যুগে ওভাবে পড়তো। এখন যা দিনকাল পড়েছে তাতে অবশ্য ওভাবে শাড়ি পড়া যাবে না আমাদের সমাজে। তবে হাজবেন্ডের জন্য প্রত্যেক মেয়েরই পড়া উচিৎ। পাহাড়ীরা তো এখনো পড়ে।”
-“কিভাবে বলবে তো?”
-“চোখের বালি সিনেমা টা দেখেছো? ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমা।”
-“কোনটা ওইযে প্রসেনজিৎ, ঐশরিয়া আর রাইমা সেনের টা?”
-“চোখের বালি একটাই হয়েছে।”
-“দেখিনি, তবে ট্রেইলর দেখেছি।”
-“ওখানে ঐশরিয়া কিভাবে শাড়ি পড়েছে দেখেছো?”
-“ব্লাউজ ছাড়া? পেঁচিয়ে?”
-“হ্যা, মারাত্মক লাগে… উফ।”
-“ছিঃ”
-“ছিঃ কেন? সবার সামনে পড়ার কথা তো বলছি না।”
তিতিরের এত লজ্জা লাগছিল! মুগ্ধ কিভাবে যে বলে এই কথাগুলো কে জানে! শেষমেশ তিতির বলল,
-“প্লিজ তুমি থামবে?”
-“তুমি কেন এত লজ্জা পাচ্ছো? তোমার জন্য তো ব্লাউজ এনেছিই।”
তিতির আর কথাই বলল না। ওর সাথে এ নিয়ে আরো কথা বললে আরো লজ্জা দেবে। কুচি দেয়া শেষ হতেই মুগ্ধ তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-“নাও এবার গুঁজে নাও।”
তিতির শাড়ি উলটো গুঁজছিল মুগ্ধ ধরে ফেলল,
-“শাড়ি গুঁজতেও জানোনা? কি শেখালো তোমার শ্বাশুড়ি মা তোমাকে?”
তিতির কিছু বলল না, হাসছিল। মুগ্ধ কুচিগুলো ঠিক করে ধরে গুঁজে দিল। এই কাজ করতে গিয়ে তিতিরের নাভিতে চোখ চলে গেল, তারপর ঠোঁটও অটোমেটিক্যালি চলে গেল। নাভির ডানপাশে চুমু দিল মুগ্ধ। তিতির শিউরে উঠলো। দুহাত দিয়ে ওর চুল খামচে ধরে সরিয়ে দিতে চাইলো। মুগ্ধ সরলো না। আশেপাশে আরো কয়েকটা চুমু দিল। মুগ্ধর ঠোঁটের প্রতিটা স্পর্শে তিতির কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর সরে সরে যাচ্ছিল। তিতিরের পিছনেই ছিল ঘরের দেয়াল। কাঁপতে কাঁপতে আর সরতে সরতে ও দেয়াল পর্যন্ত চলে গেল। পেছনে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ব্যালেন্স রাখছিল। মুগ্ধ উঠে দাঁড়াল?
কতক্ষণ পর তিতির ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পা রাখলো। মাটিতে ভর দিতেই তিতির টের পেল ও সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মুগ্ধর কোমরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঢলে পড়লো মুগ্ধর বুকের উপর। নিঃশ্বাস পড়ছিল ঘন ঘন। মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে উপরে তুলল তারপর নিজের ঠোঁট দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে দিল। ইশ একি সুখ মুগ্ধ দিচ্ছে ওকে! এত সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল ও! আচ্ছা মুগ্ধকে কেমন দেখাচ্ছে এখন? দেখার জন্য তিতির চোখ খুলে তাকালো। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই তিতিরের লজ্জা লাগলো, চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“কাঁদছিলে কেন?”
তিতির কিছু না বলে মুগ্ধর বুকে মুখ লুকালো। খুব ভাল লাগছে ওর, এত ভাললাগা কি করে বোঝাবে মুগ্ধকে? যেভাবেই হোক ও যে বোঝাতে চায়।
মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রইলো। এত ভাল অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি ওর। এর আগেও অসংখ্যবার চুমু খেয়েছে প্রাক্তন প্রেমিকাদের। কিন্তু আজ মনে হলো জীবনের প্রথম চুমু ছিল এটা। প্রথম অভিজ্ঞতা। তিতিরের আনাড়িপনা ও লজ্জা ব্যাপারটাতে অন্যরকম মাধুর্য এনে দিয়েছে। তিতির ভালই করেছে ওকে এতদিন অপেক্ষা করিয়ে। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়!
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তিতিরও গলা জড়িয়ে ধরল, কিন্তু তাকাতে পারলো না ওর দিকে। মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়েই বারান্দায় রাখা সোফাটায় বসলো। তারপর বলল,
-“চুপ করে আছো যে? কথা বলবে না?”
তিতির নিচু স্বরে
-“কি বলবো?”
-“কেমন লাগলো সেটা বলো?”
-“তুমি তো সবই বোঝো। আমি আর কি বলবো?”
-“বুঝি তো কিন্তু আমার তিতিরপাখিটার মুখে কি শুনতে ইচ্ছে করে না?”
তিতির মুগ্ধর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“সুখের সমুদ্রে ডুবে ছিলাম। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। যদি এত সুখের মুহূর্ত আর না আসে?”
তিতিরের উষ্ণ নিঃশ্বাস কানে লাগতেই মুগ্ধ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তিতিরকে বুকের উপর নিয়েই সোফাতে শুয়ে পড়লো। তিতির উপুর হওয়াতে ওর ভেজা চুলগুলো মুগ্ধর মুখের উপর পড়লো। মুগ্ধ চুলগুলোকে সরিয়ে বলল,
-“সুখের সমুদ্রে তো তোমাকে নিয়ে মাত্র পা ভেজালাম। এখনি মরতে চাও? যখন সাঁতার কাটবো তখন কি বলবে?”
একথা শুনে লজ্জায় তিতির আচমকাই উঠে পড়ল। মুগ্ধ আঁচল টেনে ধরতেই তিতির দাঁড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ কাত হয়ে সরে তিতিরকে বসিয়ে বলল,
-“আরে এখনি না তো! বিয়ের পরে। তুমি তো মাত্র ১৭। ১৮+ কাজ কি আমি তোমার সাথে করতে পারি বলো?”
তিতির কিছু বলল না, শুধু হাসলো। মুগ্ধ ওকে বুকে নিয়ে বলল,
-“ইশ একটু তাড়াতাড়ি বড় হও না, বিয়ে করি।”
-“বড় হওয়ার মন্ত্র থাকলে আজই পড়ে বড় হয়ে যেতাম।”
-“তাই? সাঁতার কাটার এত ইচ্ছে?”
তিতির মুগ্ধর বুকে কিল মারতে মারতে বলল,
-“তুমি এত খারাপ কেন?”
-“তুমি এত লক্ষী বলে।”
এমন সময় মুগ্ধর ফোন বাজল। বংশী ফোন করেছে। মুগ্ধ ফোন ধরলো। বংশী কি বলল তা তো তিতির শুনতে পেল না কিন্তু তারপর মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা, হ্যা.. তুমি নিয়ে এসো।”
ফোন রাখতেই তিতির বলল,
-“কি নিয়ে আসতে বললে?”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“কি? হাসছো যে?”
-“না মানে একটা কথা মুখে চলে এসেছিল, বললে তুমি লজ্জায় আমার সামনেই আর আসতে না তাই গিলে ফেলেছি। ওটা ভেবেই হাসলাম।”
তিতিরের মনে মনে রাগ হলো। এহ সারাদিন রাজ্যের আজেবাজে কথা বলতে থাকে, এখন একদম তুলসী পাতা হয়ে গেছে! কথাটা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করলেও আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না তিতির। বংশী এসে দরজায় নক করতেই মুগ্ধ গিয়ে খুলে দিল। পিছন পিছন তিতিরও ঘরে ঢুকলো। তিতিরকে শাড়ি পড়া দেখেই বংশী বলল,
-“দেখলিজিয়ে সাহাব, বিবিজিকো আব ছোটা নেহি লাগতা।”
তিতির হাসলো।মুগ্ধও হেসে বলল,
-“হ্যা।”
-“সাহাব, ডিনারপে কেয়া খায়েগা আপ দোনো?”
মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই তুমি কি খাবে?”
তিতির বলল,
-“খেয়ে না এলাম? আমি আর কিছু খাব না।”
-“খেয়েছি তো সেই ৬/৭ টার সময়। এখন তো ১০ টা বাজতে চলল।”
-“হোক।”
বংশী বলে উঠলো,
-“নেহি বিবিজি.. ইয়ে সাহি বাত নেহি! রাত কা খানা বহত জারুরি হোতা হেয়।”
মুগ্ধ বংশীকে বলল,
-“তোমার বিবিজির কথা বাদ দাও.. ও খাবে কি খাবে না আমি দেখে নেবো। তুমি দুজনের জন্য নরমাল কিছু নিয়ে এসো ১১ টার দিকে। যেমন ধরো ভাত, মাছ, ভর্তা।”
-“সাহাব, চিকেন গুতাইয়া হেয়। ও ভি দিব?”
-“ওহ ওয়াও। অবশ্যই দিবে।”
বংশী চলে গেল। যাওয়ার সময় মুগ্ধর হাতে একটা বোতল দিয়ে গেল। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“এটা কি?”
-“এটা দিতেই তো বংশী এসেছিল।”
-“হ্যা কিন্তু জিনিসটা কি?”
-“মহুয়া।”
-“সেটা কি? মদ?”
-“ছি, এভাবে বলো না। যদিও ওই টাইপেরই। কিন্তু মহুয়া ইজ মহুয়া। চরম একটা জিনিস। খাসিয়ারা বানায় ফল দিয়ে।”
-“মানে কি? মদ তো মদই। তুমি যদি ওটা খাও আমার ধারেকাছেও আসবে না। ছিঃ আর তুমি মদ খাও আমি ভাবতেও পারিনি। আমি জানতাম তোমার কোনো নেশা নেই।”
মুগ্ধ বোতলটা সোফার সামনের টি-টেবিলের উপর রেখে তিতিরের কাছে এসে বলল,
-“আরে বাবা, আমাকে একটু বলার সুযোগ দাও।”
তিতির সরে গিয়ে বলল,
-“কি সুযোগ দেব? ছিঃ তুমি মদ খাও ভাবতেই আমার গা গোলাচ্ছে।”
মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“শোনো তিতিরপাখি, আমার সত্যিই কোনো নেশা নেই উইদাউট ইউ। ইভেন অকেশনালিও এসব করিনা শুধু বান্দরবান আর কুয়াকাটা গেলে মহুয়াটা খাই। তাও প্রত্যেকবার না। এটা অন্যরকম স্বাদ। আমি প্রথমবার যখন খেয়েছিলাম তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম যে বউয়ের সাথে একবার খাব। সেজন্যই বংশীকে দিয়ে আনিয়েছি।”
তিতির চোখ বড় বড় করে বলল,
-“আমি খাব?”
-“হ্যা, মানে অল্প।”
তিতির সরে গেল। বিছানায় বসে বলল,
-“অসম্ভব।”
মুগ্ধ তিতিরের পাশে বসলো। বলল,
-“এক চুমুক খেয়ে ট্রাই করো। ভাল না লাগলে খেয়ো না।”
তিতির হ্যা না আর কিছু বলল না। প্রসঙ্গ পাল্টালো,
-“বাদ দাও, আচ্ছা উনি না বলেছিল কোনো কটেজ খালি নেই, তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করবে। তাহলে পরে আমরা কটেজ কিভাবে পেলাম?”
-“ওহ এই কটেজটা অলরেডি বুকিং দেয়া। যারা বুক করেছে তারা কাল আসবে। তাই আজ আমাদের দিতে পারলো।”
-“ও।”
মুগ্ধ তিতিরের একটা হাত ধরে বলল,
-“তুমি রাগ করেছো?”
-“কেন?”
-“মহুয়া আনালাম বলে?”
-“না তা না কিন্তু আমি এগুলো পছন্দ করি না।”
-“এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি নেশা জাতীয় কোন কিছুই আমি রেগুলার করি না।”
তিতির আহ্লাদ করে হাসলো। তারপর বলল,
-“আচ্ছা ঠিকাছে।”
মুগ্ধ হঠাৎই বলল,
-“সিরিয়াসলি তোমাকে শাড়ি পড়ায় বড় লাগছে। একদম বউ বউ।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের কোমর ধরে কাছে নিয়ে আসলো। তারপর বলল,
-“বিয়ের পর সবসময় আমার সাথে যখন থাকবে ফর সিওর তুমি খুব বিরক্ত হবে।”
-“কেন?”
-“এইযে, তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়বো না যে। বুকেই রাখবো।”
-“তখন আর এত আকর্ষণ থাকবে না।”
-“কে বলল তোমাকে?”
-“পুরোনো হয়ে যাব না?”
-“কিছু জিনিস কখনো পুরোনো হয়না তেমনি কিছু মানুষও কখনো পুরোনো হয়না। প্রতিদিন নতুন করে ভাললাগা জন্মায় তাদের প্রতি।”
-“সত্যি তো?”
-“সত্যি।”
ওদের গল্প চলতেই থাকলো। এক সময় বংশী খাবার দিয়ে গেল। তিতির বলল,
-“আমার না তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, দিই?”
-“কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য! প্লিজ দাও।”
তিতির এলোমেলো চুলগুলোকে হাতখোঁপায় বেঁধে কোমরে আঁচল গুঁজে নিল। মুগ্ধ তাকিয়ে রইলো ভ্যাবলার মত। একদম গিন্নী গিন্নী লাগছে। এই সৌন্দর্য কোথায় ছিল এতদিন?
তিতির হাত ধুয়ে ভাত নিল প্লেটে। ভাত মেখে মুগ্ধর মুখে সামনে তুলে ধরলো। মুগ্ধ তখনও তাকিয়ে। তিতির বলল,
-“কি হলো? নাও খাও।”
মুগ্ধ হা করলো তিতির খাইয়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“তুমিও খাও।”
-“তুমি খাও, আমার ইচ্ছে করছে না।”
-“ওকে আমিও খাব না, রাখো।”
-“আচ্ছা আচ্ছা খাচ্ছি, বাপরে বাপ! ব্ল্যাকমেইলর একটা।”
তিতিরও খেল। মুগ্ধ হেসে দিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিতির যখন হাত মুখ ধুয়ে প্লেটগুলো গোছাচ্ছিল। পিছন থেকে মুগ্ধ ওকে ধরে নিজের দিকে ফেরালো। কপালে একটা চুমু দিল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
-“তোমাকে যতটা বাচ্চা ভাবি ততটা বাচ্চা তুমি নও।”
-“একথা কেন বললে?”
-“এইযে এত সুন্দর করে খাইয়ে দিলে। তারপর এই খোঁপা! আঁচল কোমড়ে গোঁজা। সব মিলিয়ে পারফেক্ট বউ।”
-“আমার সবই তো তোমার পারফেক্ট লাগে। আমার খারাপটা বলোতো। ভাল শুনতে শুনতে আমি টায়ার্ড।”
-“তোমার খারাপটা হচ্ছে তুমি খুব কিপটা।”
-“কি কিপটামি করেছি?”
-“আদর করতে কিপটামি করো সবসময়। নিজে থেকে তো শুধু জড়িয়ে ধরো আর কিছুই না। আমাকেও করতে দাওনা।”
তিতির লাজুক মুখে বলল,
-“আজ তো দিয়েছি।”
মুগ্ধ তিতিরের শাড়ির ভেতর দিয়ে কোমরের কার্ভে হাত রেখে বলল,
-“তাই?”
তিতির একটু নড়ে উঠে বলল,
-“ছাড়ো সুড়সুড়ি লাগে।”
মুগ্ধ আস্তে আস্তে হাতটা উপরের দিকে ওঠাতে লাগলো। তিতির ছটফট করতে লাগলো। সরে যেতে চেয়েও পারলো না। মুগ্ধর একহাত ওকে ধরে রেখেছে। অবশেষে বলল,
-“দোহাই লাগে ছাড়ো। নাহলে মরে যাব।”
মুগ্ধ হাত সরিয়ে নিল, ছেড়ে দিল। তারপর বলল,
-“দেখেছো! আমি কিছু করতাম না জাস্ট দেখালাম তুমি কত কিপটা।”
তিতির নিচু স্বরে বলল,
-“আমার খুব সুড়সুড়ি লাগছিল।”
মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,
-“হুম জানি, আমি দুষ্টুমি করছিলাম।”
তিতির মুগ্ধর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এটাতে কখনো কিপটামি করিনা আমি।”
মুগ্ধও ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“হুম, আর এটাই আমাকে সবথেকে বেশি শান্তি দেয়। যতক্ষণ তুমি দূরে থাকো, উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উথাল পাথাল করতে থাকে বুকের মধ্যে। তারপর যখন এসে জড়িয়ে ধরো সব ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর একটিও পাবে না।”
তিতির বলল,
-“আমারও একই অবস্থা হয়।”
কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ বলল,
-“এই চলো মহুয়া খাই, তুমি কখন ঘুমিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই।”
-“আমি কিন্তু অল্প একটু খাব।”
-“হুম। অল্পই পাবে, বেশিটা পাবে কোথায় আমারই লাগবে ওটুকু।”
-“খেলে কি নেশা হয়?”
-“অল্প খাবেতো, নেশা হবে কোত্থেকে?”
-“তুমি তো বেশি খাবে।”
-“আমার তো অভ্যাস আছে রে বাবা। আরো বেশি খেয়েও নেশা হবে না। আর নেশা হলেও তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নেশা হলে আমি খুব ঠান্ডা হয়ে যাই। চুপচাপ বসে থাকি।”
-“ও।”
মুগ্ধ বংশীকে ফোন করে বরফ আনালো। বরফ, গ্লাস আর মহুয়ার বোতল নিয়ে ওরা বারান্দায় চলে গেল। মুগ্ধ গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিতেই তিতির বলল,
-“পানি মেশাবে না?”
-“আরে এটা ওইটাইপ না বাবা। এটা মহুয়া। পানি মেশানো লাগে না। পানি মেশালে টেস্টই চলে যাবে।”
-“ও।”
মুগ্ধ এক গ্লাস খেয়ে ফেলেছে, তিতির তখনো একটু খানি হাতে নিয়ে বসে রয়েছে ওর পাশে, মুখে দেয়নি। মুগ্ধ তা দেখে বলল,
-“খেতে যদি একান্তই ইচ্ছা না করে জোর করে খেওনা।”
-“না, তেমন কিছু না।”
তিতির মুখে দিল। ঘ্রাণটা সুন্দর, খেতেও টেস্টি কিন্তু গলা দিয়ে নামার পর কেমন যেন লাগলো। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর তিতির বলল,
-“ওয়াও, গ্রেট!”
-“কি?”
-“টেস্ট টা! খাওয়ার কতক্ষণ পরে বেশি ভাল লাগে।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বলেছিলাম।”
গ্লাসের টুকু শেষ করে তিতির বলল,
-“আমি আরো খাব।”
-“পাগল? নেশা হয়ে যাবে তোমার।”
-“না না হবে না। প্লিজ আরেকটু দাও না।”
-“না বাবা, এমন করোনা। টেস্টটা অনেক ভাল বলে তোমাকে আমি টেস্ট করিয়েছি। তার মানে এই না যে আমি তোমাকে আরো দিতে পারি। এটা অনেক কড়া।”
মুগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিতির বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। তারপর মুগ্ধ টেনে নিয়ে নিল। বলল,
-“ইশ কেন যে আনতে গেলাম।”
-“কেন? খুব ভাল করেছো আনতে দিয়ে। খুব মজা তো।”
ততক্ষণে তিতিরের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ আর খেলনা। তিতির সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধ বুঝলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে, যাক বাবা, বাঁচা গেল। নেশা হওয়ার আগে ঘুমিয়ে পড়লো। মুগ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তিতিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে। ইশ, পৃথিবীর সব সুখ যেন এই মুখটার মাঝে। মুগ্ধ এগিয়ে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। চুমু দিয়ে আর উঠতে পারলো না তিতির ওর শার্টের কলার ধরে ফেলেছে কখন যেন। ছাড়াতে যেতেই তিতির চোখ খুলে বলল,
-“আগে বলো খুলবে?”
মুগ্ধ অবাক,
-“কি খুলবো?”
-“এই পচা শার্ট টা।”
-“পচা? এটা তো তোমারই পছন্দের শার্ট। তুমিই দিয়েছিলে।”
-“নাহ এটা খুব পচা। এটা তোমার বুকের লোমগুলোকে ঢেকে রেখেছে, আমি কিসসি করতে পারছি না।”
মুগ্ধর বুঝে গেল, নেশা ভাল ভাবে হয়েছে। হবেই তো, বোতলে মুখ লাগিয়ে গিলেছে! পাগলী একটা। ওকে তারাতারি ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। মুগ্ধ ওকে কোলে নিতে যাচ্ছিল। তিতির বলল,
-“খবরদার, এভাবে কোলে নিবে না। শার্ট খোলো আগে।”
মুগ্ধ অগত্যা শার্ট খুললো। তিতির সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিল, শার্ট টা ঘরের দরজায় লেগে মাটিতে পড়লো। মুগ্ধ বলল,
-“খুশি?”
তিতির সেকথার উত্তর না দিয়ে মুগ্ধকে ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল সোফার উপর। ওর বুকে মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল কতক্ষণ, তারপর অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল মুগ্ধর বুকটা। মুগ্ধর তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। চুমু দিতে দিতে একসময় তিতির ওর গলাতেও চুমু দিল, তারপর গালেও দিল। মুগ্ধ ওর মুখটা ধরে বলল,
-“শোনো তিতির, তোমার নেশা হয়ে গেছে, চলো ঘরে গিয়ে ঘুমাবে।”
-“উফফফো! এমন পূর্ণিমারাতে এত সুন্দর পরিবেশে কেউ ঘুমায়?”
-“হুম, ঘুমায়।”
-“জানো, কেন আজকে থাকতে চেয়েছিলাম?”
-“কেন?”
-“তুমি আমাকে যতবার কিসসি করতে চেয়েছো আমি দিইনি। পরে খারাপ লেগেছে। আমি জানতাম থাকলে একসাথেই থাকবো আর তুমি আমাকে কিসসি করতে চাইবে, তখন আমি আর বাধা দিবনা। সেজন্য থাকতে চেয়েছি।”
-“হুম, আমি যদি সুযোগ নিয়ে আরো অনেক কিছু করে ফেলতাম তখন?”
উত্তর দিল না তিতির। বলল,
-“জানো তুমি যখন কিসসি করেছিলে তখন আমি কেন কেঁদেছিলাম?”
-“জানতে তো চেয়েছিলাম, তুমি বলোনি।”
-“তুমি এত সুন্দর আদর করে ধরেছিলে আমাকে আর এত সুন্দর করে কিসসি করেছিলে যে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন অস্থির অস্থির করছিল। আমি সেই অস্থিরতাটা সহ্য করতে পারছিলাম না। কেমন যেন! সেজন্যই কান্না এসে গিয়েছিল আর আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।”
মুগ্ধ তিতিরের মুখটা নিজের বুকে রেখে বলল,
-“ওহ, আহারে!”
তিতির মুখটা আবার তুলল। মুগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই শোনোনা, তখন আমি আবেশে কোনো এক অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারিনি তুমি কিভাবে আমাকে কিসসি করেছিলে! আর আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল, শুধু অস্থির অস্থির লাগাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমাকে আরেকবার ওভাবে কিসসি করবে?”
মুগ্ধ হাসলো আর ভাবলো, ইশ কি ইনোসেন্ট! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ বলে মনে হচ্ছিল। তিতির ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
-“ভাবছো তো নিজে না করে তোমার কাছে চাইছি কেন? আমি তো জানিনা কিভাবে করতে হয়। তখন তো বুঝতে পারিনি। আমাকে একটু শিখিয়ে দাও না। আমিও তোমার মত করে তোমাকে আদর দিতে চাই।”
মুগ্ধ তিতিরকে সরিয়ে উঠে বসলো। তারপর দাঁড়াল। তিতির বলল,
-“দাও না, প্লিজ। আর কখনো তোমাকে ফিরিয়ে দেব না।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তিতির বলল,
-“কিসসি না করে ঘুমাবো না।”
তিতির তখনো মুগ্ধর গলা ধরে আছে। মুগ্ধ বলল,
-“জানি।”
মুগ্ধ তিতিরের কানের নিচ দিয়ে চুলের ভেতর হাত গলিয়ে ওর মুখটা কাছে নিয়ে এল। তারপর তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। তিতিরও একসময় মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ যখন ছাড়তে চাইলো তিতির ছাড়লো না। পারলে ও মুগ্ধর গলায় ঝুলেই উঠে আসে। মাঝে মাঝে আবার কামড়ও দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে হাঁপাতে লাগলো। মুগ্ধ উঠে যাচ্ছিল। তিতির ধরে রাখলো। মুগ্ধ হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি? আরো?”
তিতির এক্সাইটমেন্টে, নেশা আর ঘুমের মধ্যে কি যে বলল বুঝতে পারলো না মুগ্ধ। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“বুঝিনি কি বললে! আবার বলবে?”
-“তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডদের কি এভাবেই কিসসি করতে?”
-“আরে নাহ!”
-“তাহলে কিভাবে করতে?”
-“কেন এসব জিজ্ঞেস করছো?
তিতির কান্না করে দিল,
-“বলোনা..”
-“এভাবে করতাম না। তুমি আবার কাঁদছ কেন?”
-“এভাবে চুলের ভেতর হাত দিয়ে ধরতে?”
-“নাহ।”
-“ওইভাবে কোমরে ধরতে?”
-“না।”
-“উপরের ঠোঁটটায় কি…..”
মুগ্ধ তিতিরের মুখ চেপে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“শোন পাগলী! আমি কখনো কাউকে এভাবে আদর করিনি। যতটা ভালবাসলে এভাবে আদর করা যায় ততটা ভাল শুধু তোকেই বেসেছি। আর তোর পরেও আমি অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবো না। মাথায় কিছু ঢুকেছে?”
তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“উফফফ, বাঁচালে!”
তিতিরের পাগলামি দেখে মুগ্ধর নিজেরই মাথা ঘুরছিল। ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল মুগ্ধ। একসময় ঘুমিয়েও পড়লো তিতির। হয়তো কাল ঘুম থেকে উঠে তিতিরের কিছুই মনে থাকবে না। কিন্তু মুগ্ধর জীবনে তিতিরের সাথে বিয়ে, সংসার আরো আরো যতকিছুই হোক না কেন আজকের এই স্পেশাল রাতটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে!
সেই পাগলী তিতির আর আজকের তিতিরের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ৪ বছর পর্যন্ত সত্যি কোনো পার্থক্য ছিল না। গত সাত মাসে যেন হঠাৎই বড় হয়ে গেল।
তিতির ডানদিকে কাত হয়ে নিজের হাতের উপর মাথা শুয়ে আছে। এই বিছানায় ওর বউ হয়ে শোবার কথা ছিল, আর আজ অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলনা মুগ্ধ। তাই বোধহয় ভাগ্যবিধাতা বুঝিয়ে দিল তিনি চাইলে কি থেকে কি হয়ে যেতে পারে।
৭ মাস আগে তিতির না, মুগ্ধ শুয়ে ছিল এখানে। কপালে তিতিরের হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে ওকে দেখতে পেয়েছিল মুগ্ধ। আজকালও খানিকটা এরকম ব্যাপার ঘটে, ও কপালে স্পর্শ পায় কিন্তু চোখ খুললেই বুঝতে পারে সবটা স্বপ্ন ছিল। সেদিন চোখ খুলে দেখছিল সবুজ পাড়ের হালকা কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়ে মাথার কাছে বসে আছে তিতির। চুলগুলো খোলা। আহ কি অপূর্ব লাগছে। কোনো অকেশন ছাড়া শাড়ি পড়লে বুঝতে হবে কোন সুখবর আছে। তাই বুঝেই মুগ্ধ তিতিরের হাতটা কপালের উপর থেকে সরিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে বলল,
-“আমার বউটা আজ কি সুখবর দেবে?”
তিতির হাতটা ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। মুগ্ধ ছাড়ছিল না। উলটো দুলাইন গান শুনিয়ে দিল,
“ছেড়োনা ছেড়োনা হাত
দেবোনা দেবোনা গো যেতে
থাকো আমার পাশে…”
তিতির বলল,
-“উফ কেন ছাড়ছি সেটাও তো বুঝতে হবে।”
মুগ্ধ ছাড়লো। তিতির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি মারলো না কেউ নেই। দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দিল। তারপর মুগ্ধর পাশে এসে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো। তিতির মুগ্ধর গালে হাত বুলিয়ে বলল,
-“অনেক বড় কোনো সুখবর দেব আজ। যা আগে কখনো দেয়নি। এর চেয়ে বড় সুখবর আর হতেই পারে না।”
-“হোয়াট? কিভাবে সম্ভব?”
-“তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কিসের কথা বলছি?”
-“হ্যা, তুমি প্রেগন্যান্ট! এর চেয়ে বড় সুখবর আর কিছু হতে পারেনা কিন্তু কিভাবে সম্ভব। আমি তো কিছুই করিনি।”
তিতির ওকে সরিয়ে দিল,
-“ধ্যাত, মুডটাই নষ্ট করে দিলে।”
-“এই না না বলো বলো। দুষ্টুমি করছিলাম তো।”
তিতির তবু মুখ ঘুরিয়ে রইল। মুগ্ধ তিতিরের কান ধরে বলল,
-“এই কান ধরছি, সরি। এবার বলোনা কি হয়েছে?”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো। তারপর বলল,
-“তোমার এই বিছানায় আমার জন্য পার্মানেন্টলি জায়গা করো। শিগগিরই আসছি।”
-“মানে কি? বিয়ের কথা বলছো?”
-“হ্যা… কাল বাসায় একটা প্রোপোজাল এসেছিল। বাবা ওটার কথা আমাকে বলতেই আমি তোমার কথা বাবাকে বলে দিয়েছি।”
মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে বসলো। বলল,
-“আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন! তারপর কি হলো?”
তিতিরও উঠে বসেছে ততক্ষণে। বলল,
-“তারপর সব জিজ্ঞেস করলো তোমার ব্যাপারে আমি বললাম। তারপর মা আর ভাইয়া, ভাবীকে ডেকে সবটা বলল বাবা। সব শুনে বোধহয় সবারই পছন্দ হয়েছে। তাই বলেছে প্রোপোজাল পাঠাতে। উফ বিশ্বাস করো এত সহজে সবাই মেনে নেবে ভাবিনি।”
-“ওয়াও, গ্রেট!”
-“জানো, ভাইয়া তো হাসছিল আর বলছিল তুই এতদিন প্রেম করেছিস টেরই পাইনি। ছোটবেলায় তুই এত শান্ত থাকতি যে বাসায় কোনো বাচ্চা আছে বোঝা যেত না। সেরকমই হলো ব্যাপারটা।”
-“বাহ।”
-“হুম।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বুকে টেনে নিল। তারপর বলল,
-“তিতির কি যে ভাল লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। অবশেষে আমার এতদিনের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।”
তিতির হেসে বলল,
-“আর আমারও। এবার বাইরে চলো.. পিউ, স্নিগ্ধ সবাই বাসায়। আর তোমারও তো অফিসে যেতে হবে।”
-“ও হ্যা, তুমি যাও। আমি একবারে রেডি হয়ে বের হচ্ছি।”
পরের শুক্রবারই মুগ্ধ ফুল ফ্যামিলিসহ প্রোপোজাল নিয়ে গেল তিতিরের বাসায়। শুধু বাবা ছাড়া কারন, মুগ্ধর বাবা দুবছর আগে একটা অপারেশনে গিয়ে মারা যায়। কথাবার্তা বলে দুই ফ্যামিলিই দুই ফ্যামিলিকে পছন্দ করলো। মুগ্ধর মা চাইলো আগামী মাসের মধ্যেই বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলতে তিতিরের বাবা-মাও রাজী হয়ে গেল। ডিনারও সেড়ে ফেলল। তারপর হঠাৎ তিতিরের বাবা বলল,
-“কীরে তান্না কখন আসবে? আজ ও বাইরে গেল কেন?”
ভাবী বলল,
-“বাবা, ওর বন্ধুর বাবা হঠাৎই মারা গেছে, তাই গিয়েছিল। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ও ঝিগাতলা পর্যন্ত চলে এসেছে, কথা হয়েছে।”
মুগ্ধর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো তান্না নামটা শুনে। তান্না! কোন তান্না? ৩/৪ বছর আগে যাকে মেরে এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল সেই তান্নাই কি তিতিরের ভাই? সর্বনাশ! তাহলে তো সব শেষ। মুগ্ধ তরতর করে ঘামছিল। সেই তান্না যেন না হয়। সেই তান্নাই যদি হয় তাহলে সারাজীবনের জন্য ও হারাবে তিতিরকে। আল্লাহ কি এতটা নিষ্ঠুর হবে? হঠাৎ লাল শাড়ি পড়া তিতির এসে দাঁড়াল ওর পাশে। বলল,
-“তোমার কি হল? মুখটা এমন লাগছে কেন?”
-“নাহ, কিছুনা।”
তিতিরকে যে মুগ্ধ কি বলবে তা ও বুঝতে পারছিল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তান্না চলে এল। ড্রইং রুমে ঢুকে কি অমায়িক ভঙ্গিতে মুগ্ধর মাকে সালাম দিয়ে বলল,
-“সরি আন্টি, আমি অনেক দেরী করে ফেললাম।”
তারপর মুগ্ধর দিকে চোখ পড়তেই তান্না দাঁড়িয়ে পড়লো, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ প্রাণপণে আল্লাহ কে ডাকছিল যেন এই মুহূর্তে ওর মৃত্যু হয়। কারন এরপরই যেভাবে তিতিরকে ওর জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হবে তা ও সহ্য করতে পারবে না। শেষবারের মত তিতিরের হাসিমুখটা দেখে নিল। এরপর থেকে তো তিরিরের জীবন থেকে সবহাসি শেষ হয়ে যাবে।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটি। সেদিনও ছিল শুক্রবার। মুগ্ধ নিজের রুমে বসে তিতিরের সাথে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎই কলিং বেল বেজে উঠলো। মুগ্ধ পাত্তা দিল না, আবার বাজতেই তিতির বলল,
-“কি হলো? দরজা খুলছ না যে?”
-“আরে বাসায় তমাল, সম্রাট ওরা আছে। কেউ নিশ্চই খুলবে, অযথা আমি আমার বউকে রেখে দরজা খুলতে যাব?”
তিতির বলল,
-“যেন আমি কাছে আছি?”
এরপর পরপর কয়েকবার বেল বাজতেই মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা, আমি পরে কল দিচ্ছি।”
-“হুম, ঠিকাছে।”
দরজা খুলতেই দেখলো ওদের বাসার বাড়িওয়ালার ছেলে মিথুন আর মিথুনের ফ্রেন্ড তান্না দাঁড়িয়ে। দুজনই মুগ্ধর চেয়ে দুএকবছরের ছোট। মুগ্ধ বলল,
-“আরে, তোমরা যে! এসো এসো।”
ভেতরে ঢুকেই মিথুন বলল,
-“মেহবুব ভাই, আপনারা বাসা নেয়ার সময় যে কন্ডিশনগুলো দেয়া হয়েছিল তা কি আপনারা ভুলে গেছেন?”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“না তো ভুলব কেন? কি হয়েছে?”
-“একটু আগে আপনাদের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে ঢুকেছে।”
-“এটা হতেই পারে না। প্রথমত, কেউ মেয়ে নিয়ে আসবে না, দ্বিতীয়ত, আমি আজ সারাদিন বাসায় কেউ এলে আমি জানতাম।”
তান্না বলল,
-“ভাইয়া আমি যখন উঠছিলাম আমি নিজে দেখেছি।”
-“বলো কি!”
-“জ্বী।”
মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমরা বাসা সার্চ করতে পারো।”
মিথুন বলল,
-“তাই করতে হবে।”
মুগ্ধ বলল,
-“এসো।”
মিথুন বলল,
-“তান্না তুই যা, আমি দরজার সামনেই থাকি, যাতে এদিক দিয়ে পাচার করতে না পারে।”
মুগ্ধ তান্নাকে নিয়ে গেল। প্রথমে সম্রাটের রুমে ঢুকে দেখলো কেউ নেই। মুগ্ধ ভাবল, ‘সম্রাট কি বাইরে গেল? কখন গেল? না বলেই গেল?’
এরপর মুগ্ধর রুম খুঁজে ওরা তমালের রুমে যেতে নিয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লাগানো। তান্না বলল,
-“কি বুঝলেন?”
মুগ্ধ দরজায় নক করলো,
-“তমাল? এই তমাল? দরজা খোল।”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তান্না কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিল। ততক্ষণে মিথুন চলে এসেছে তমালের দরজার সামনে। তারপর আরো কয়েকবার নক করার পর ভেতর থেকে দরজা খুলে বেড়িয়ে এল তমাল। পেছনে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা একটা মেয়ে। মেয়েটাকে চিনতে কষ্ট হলোনা মুগ্ধর। তমালের গার্লফ্রেন্ড সুপ্তি। কিন্তু তমাল ওকে বাসায় নিয়ে আসার মত বোকামিটা কেন করলো? আর যদি আনেও মুগ্ধকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করল না? এতবড় মুখ করে বলা কথা এখন কোথায় যাবে মুগ্ধর! মিথুন বলল,
-“এই মেয়ে ব্যাচেলর বাসায় আসতে পারছো আর মুখ দেখাইতে শরম? ঘোমটা দিয়া তো ঘোমটার অসম্মান করলা! দেখি মুখ দেখাও।”
তমাল বলল,
-“ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে, ওকে ছেড়ে দেন। আমাকে যা বলার বলেন।”
তান্না বলল,
-“শালার চোরের মার বড় গলা।”
তারপর মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এইযে, মেহবুব ভাই।এইবার কি বলবেন? খুব তো বলসিলেন মেয়ে আনেন না বাসায়। এটা কি বের হলো রুম থেকে?”
মুগ্ধ কিছু বলার আগেই মিথুন বলল,
-“আরে এগুলা মেয়ে নাকি সস্তা ** কতগুলা।”
মুগ্ধ বলল,
-“এবার বেশিবেশি হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে যেতে দাও। বাকীটা আমরা বুঝে নিচ্ছি।”
মুগ্ধ জানে সুপ্তি এলাকারই মেয়ে। ওর মুখটা কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে। মিথুন বলল,
-“আপনাদের সাথে তো বুঝবো আসল বোঝা। আগে এই **টার সাথে বুঝে নেই।”
সুপ্তির গায়ে ধাক্কা মেরে বলল,
-“চুলকানি বেশি না? তাই ব্যাচেলর বাসায় আসো?”
একথা শুনেই তমাল মিথুনের মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। সেই ফাঁকে মুগ্ধ সুপ্তিকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিল। সুপ্তি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তান্না দৌড়ে ধরতে চাইল, মুগ্ধ ওকে ধরে আটকে রাখলো। তান্না বলল,
-“মিথুন তরে আমি কইসিলাম সবগুলার গুরু এইটা। দেখ মেয়েটারে কেম্নে বাইর কইরা দিল।”
মিথুন তখন ব্যস্ত ছিল তমালের ঘুষির জবাব দিতে। মুগ্ধ বলল,
-“তোমরা যা ইচ্ছা ভাবতে পারো কিন্তু ও একটা মেয়ে, ভুল করে ফেলেছে হয়তো একটা। তাই বলে ওকে এভাবে অপমান করাটাও ঠিক না। ও তো তোমার আমার মতই কারোর বোন তাই না?”
মিথুন উঠে এসে মুগ্ধর কলার ধরলো। তান্না বলে উঠলো,
-“শালা বানী দেয়া বন্ধ কর। তোর এত লাগে ক্যান? সব একেই চক্র না? তোর গার্লফ্রেন্ড ও নিশ্চই আসে! আসে দেখেই বন্ধুর টারে সাপোর্ট দিচ্ছিস যাতে তুই ধরা খাইলে বন্ধু সাপোর্ট দেয়। সবগুলা **বাজ।”
মুগ্ধ বলল,
-“তান্না মুখ সামলে কথা বলো। আমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে আরেকটা কথা বলার সাহস দেখিওনা। তাহলে কপালে দুর্ভোগ আছে।”
তান্না বলল,
-“ক্যান তোর গার্লফ্রেন্ডের রেট কি দুইটাকা বেশি নাকি?”
এরপর মুগ্ধ আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। উন্মাদের মত মেরেছিল সেদিন তান্নাকে। কোনো হুঁশজ্ঞান ছিল না। মিথুন শত চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। মার খেয়ে তান্না দৌড়ে সিঁড়িতে চলে গেল নামার জন্য। মুগ্ধও দৌড় দিয়ে ধরে ফেলেছিল। মারতে মারতে নামিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে। পুরো সিঁড়ি রক্তে মেখে গিয়েছিল। তারপর রাস্তায় ফেলে কি মারটাই না মেরেছিল মুগ্ধ ওকে। সাথে মুগ্ধ শুরু করেছিল বাপ মা তুলে কি অকথ্য ভাষায় গালাগালি! রাস্তায় মানুষের ভীর হয়ে গিয়েছিল। একজন থামাতে যেতেই মুগ্ধ তাকে এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছিল যে তা দেখে কেউ আর আগানোর সাহস করেনি। তারপর একসময় মার খেতে খেতে যখন তান্না অজ্ঞান হয়ে যায় তখন ওকে ছাড়ে মুগ্ধ।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠতেই মুগ্ধর ভাবনায় লাগাম পড়লো। উঠে গিয়ে দরজা খুলল, মা এসেছে। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো,
-“তিতির কোথায়?”
-“আমার ঘরে।”
মা সোজা মুগ্ধর ঘরে চলে গেল। মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বলল,
-“একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার!”
মা বিছানায় তিতিরের পাশে বসেছে। মুগ্ধ চেয়ার টেনে বসে বলল,
-“তুমি জানলে কিভাবে যে ও এসেছে?”
-“পিউ ফোন করেছিল।”
-“ও।”
মা আবার বলল,
-“মেয়েটার চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। চেহারার মাধুর্যটাই চলে গেছে। ডাকাত ফ্যামিলি একটা।”
-“বাদ দাও না মা।”
-“কেন বাদ দিব? ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির জন্যই আজ আমার সংসারে কোন শান্তি নেই, সুখ নেই, আনন্দ নেই। যতটুকু ছিল তাও শেষ করে দিয়েছে। এতদিনে তোর বউ এসে নাতি নাতনীতে ঘর ভরে যাওয়ার কথা ছিল। ওর জন্য বিয়ে করলি না। ৪ বছর অপেক্ষা করলি ওর স্টাডির জন্য। লাভ কি হলো? উলটো অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো। এখনও বিয়ে করছিস না। বয়স চলে যাচ্ছে। তুই শুধু শুধুই ওর জন্য অপেক্ষা করছিস। দুনিয়া উলটে গেলেও ওর ফ্যামিলি কোনদিনও মানবে না। আর ও পারবেও না ওর ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে।”
-“মা এখন কি এসব কথা বলার সময়?”
-“অবশ্যই। ইভেন এখনই পারফেক্ট সময়। দেখ ওর অবস্থা, এসব দেখেও যে ফ্যামিলি ইগো নিয়ে বসে থাকতে পারে তারা বিবেকহীন। তাই ওর আশা এবার চিরদিনের জন্য ছেড়ে দে। তুই বুদ্ধিমান ছেলে, জানি এর বেশি কিছু আর তোকে বলতে হবেনা।”
মুগ্ধ চুপ, মা এবার প্রসঙ্গ পালটালো,
-“ওকে নাকি ঘুমের ওষুধ দিয়েছে?”
-“ঘুমের ইঞ্জেকশান।”
-“তাহলে? বাসায় যাবে কি করে? দেখ তুই ওকে বাসায় এনেছিস এটা নিয়ে না ওর ভাই আবার ঝামেলা করে।”
-“না মা। ডাক্তার বলে দিয়েছে জাস্ট ৩/৪ ঘন্টা ঘুমাবে। তারপরও না উঠলে ডেকে উঠিয়ে দিয়ে আসব।”
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“এর চেয়ে অনেক ভাল হত ইকরা কে যদি বিয়ে করতি। এসব আমার আর ভাল লাগেনা।”
-“মা ইকরাকে আমি পছন্দ করিনা।”
-“যাকে পছন্দ করো তার কাছে তো তোমার ভালবাসার দাম নেই। তাই যে তোমাকে পছন্দ করে তাকেই তোমার বিয়ে করা উচিৎ। ইকরার মত লক্ষী মেয়ে কতটা চায় তোকে! ও তোর বউ হলে সারাজীবন তোর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো।”
-“বউ কি পায়ের কাছে পড়ে থাকার মত জিনিস মা?”
মা মেজাজ খারাপ করে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“তিতিরের কাছে আমার ভালবাসার দাম নেই এটাও তুমি ভুল বলেছ মা।”
-“হ্যা দাম আছে কিন্তু ওর কাছে ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির ভালবাসার দাম তার চেয়েও বেশি।”
-“সেটাই কি স্বাভাবিক না?”
-“না স্বাভাবিক না, আমি যে ফ্যামিলি ছেড়ে তোর বাপের সাথে চলে এসেছিলাম, তার মানে কি এই যে আমি আমার ফ্যামিলিকে ভালবাসতাম না?”
-“তা বলিনি মা, সবার তো আর সেই সাহস টা থাকে না।”
-“শোন মুগ্ধ, বিয়ে করে ফেললে সব ফ্যামিলিই একসময় মেনে নেয়। আমাদের ফ্যামিলি কি মানেনি? তুই হওয়ার পর মেনেছে কিন্তু মেনেছিল ঠিকই। তিতির যদি চলে আসতো তোকে বিয়ে করতো ওর ফ্যামিলিও এক সময় মেনে নিতো।”
-“মা তোমাদের সময়ে পালিয়ে বিয়ে করার একটা ট্রেন্ড ছিল। যা এখন নেই।”
কতক্ষণ রক্তচক্ষু নিয়ে মা তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল,
-“যা ইচ্ছে কর, এত মানুষ মরে আমি মরি না কেন কে জানে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতিরের দিকে তাকালো মুগ্ধ। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে না মুগ্ধর। হচ্ছে না তিতিরের উপরেও। দুজনই হয়তো তাদের যার যার যায়গা থেকে ঠিক। শুধু মুগ্ধই ভাঙা সেতুর রেলিং ধরে ঝুলে আছে।
সেদিন তান্না খুব স্বাভাবিকভাবে মুগ্ধর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল হ্যান্ডশেক করার জন্য। তিতিরের বাবা বলেছিল,
-“এই আমার ছেলে।”
মুগ্ধ হ্যান্ডশেক করলো। তান্না বলল,
-“বাবা পরিচয় করাতে হবে না, উনি আমাকে ভালভাবেই চেনেন।”
তিতির বলে উঠলো,
-“তোমরা একে অপরকে চেনো?”
তান্না বলল,
-“হ্যা, চিনি। খুব ভালভাবেই চিনি। তো ভাইয়া, আপনি আমার বোন কে বিয়ে করতে চান? সত্যি আমি অবাক! কেন আপনার সেই গার্লফ্রেন্ডের খবর কি?”
সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওদের দুজনকে। মুগ্ধ এতটা ভয় আগে কোনদিন, কোনো সিচুয়েশনে, কাউকে পায়নি যতটা ভয় পাচ্ছে আজ তান্না কে। খুব অসহায় লাগছে। কোনরকমে বলল,
-“তখনও তিতিরই আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল।”
তান্না বলল,
-“রিয়েলি? গল্পটা বেশ।”
তিতিরের বাবা এতক্ষণে কথা বলল,
-“ব্যাপারটা কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তান্না তুই ওকে কিভাবে চিনিস?”
-“বাবা উনিই মেহবুব। মিথুনদের বাসার দোতলায় থাকতো। বুঝতে পেরেছো কার কথা বলছি?”
বাবা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধর সত্যিই সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। বাবা মুগ্ধর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তিতির আংটিটা ফেরত দিয়ে দাও।”
তিতির অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে! মুগ্ধর মা বলল,
-“কেন ভাই? কি হয়েছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওদের পরিচিত হওয়ার সাথে তিতিরের আংটি খুলে ফেলার কি সম্পর্ক রয়েছে?”
তিতিরের বাবা বলল,
-“এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমি কোনো গুন্ডা ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা।”
তিতির কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে! কিন্তু এটা বুঝতে পারছে সমস্যা বিরাট কিছু কারন মুগ্ধ প্রচন্ড নার্ভাস। মুগ্ধকে খুব কঠিন সময়েও নার্ভাস হতে দেখেনি তিতির। তাই ভয়ে তিতির আর কোনো কথা বলতে পারছিল না। কিন্তু যা দেখছে তাতে বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে লাগলো। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে, মুখে আঁচল চেপে ধরে আছে তিতির। মুগ্ধর মা বলল,
-“গুন্ডা মানে? আমার ছেলেকে গুন্ডা কেন বলছেন? ও কি করেছে?”
-“আন্টি সেসব কথা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে আমি মুখে আনতে পারবো না। তাই ভাল হয় আপনি মেহবুব ভাইয়ার কাছ থেকেই এসব জেনে নিয়েন। উনি সত্যি ঘটনাটাই বলুক আর রঙচঙ মিশিয়েই বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
তিতিরের বাবা হাতজোড় করে বলল,
-“মাফ করবেন, এ বিয়ে সম্ভব না। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
একথা শুনে মুগ্ধর কি যে হলো সাথে সাথে তিতিরের বাবার সামনে দুই হাটু মুড়ে বসে পা ধরে বলল,
-“অাঙ্কেল, একথা বলবেন না প্লিজ। আমি যা করেছিলাম ভুল করেছিলাম। আজ আপনার পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করুন।”
তিতিরের বাবা আর একটি কথাও না বলে চলে গেল নিজের ঘরে। পেছন পেছন তিতিরের মাও গেল। বাবার পাশেই তান্না দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তান্নার পা ধরে বলল,
-“তান্না তুমি আমার ছোটই হবে তবু যে হাতে তোমাকে মেরেছিলাম সে হাতেই আজ তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ ক্ষমা করো, তিতিরকে আমার থেকে আলাদা করোনা।”
এই দৃশ্য দেখে পিউয়ের চোখে পানি এসে গেল। স্নিগ্ধ্বও তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। এটা কি ওদেরই বড়ভাই? যে কোনদিন কারো সামনে মাথা নিচু করেনি সে আজ একজনের পর একজনের পা ধরে মাফ চেয়ে যাচ্ছে!
তান্না সরে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
-“নিচে দারোয়ানকে বললে গেট খুলে দেবে।”
তখনও মুগ্ধ ফ্লোরে বসা। ওর মা ওকে তুলে বলল,
-“চল।”
মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। মুগ্ধ,পিউ,স্নিগ
্ধকে নিয়ে ওদের মা তিতিরদের বাসা থেকে বেড়িয়ে এল। বের হওয়ার আগে একবার মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকালো। তিতির ওর ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আর কোনদিন মুগ্ধ তিতিরের চোখের জল মুছে দিতে পারবে না। ওর আজকের এই যত্ন করে পড়া লাল শাড়ি, চোখের কাজল সব মিথ্যে হয়ে গেল।
মুগ্ধ খুব ভেঙে পড়েছিল। পিউ, স্নিগ্ধ, মা সবার মনেই কৌতূহল ছিল আসলে কি এমন হয়েছিল তান্না আর মুগ্ধর মধ্যে? মা জিজ্ঞেস করতেই মুগ্ধ পুরো ঘটনাটা বলল। মা বলল,
-“ওদের আশা তাহলে ছেড়ে দে। তিতিরকে বল একদম খালি হাতে চলে আসতে।”
ওদিকে ওরা চলে যাওয়ার পর তান্না গিয়ে বাবার ঘরে ঢুকলো। তিতির ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। তান্নাকে বাবার ঘরে যেতে দেখে তিতিরও গেল। আসল ঘটনাটা কি সেটা ওর জানতেই হবে। ঘরের দরজায় পা রাখার আগেই তিতির শুনতে পেল তান্না বাবা-মাকে বলছে,
-“তিতির হয়তো কান্নাকাটি করবে তোমরা আবার গলে যেওনা।”
-“তান্না এসব কিছুই আমাকে বলতে হবে না। আমার খুব ভালভাবেই মনে আছে তুই এক সপ্তাহ হসপিটালে ছিলি। কয়েক মাস লেগেছিল সুস্থ্য হতে।
-“ওই ছেলে যদি ভাল হতো আমাকে মারার জন্য ওদের বিয়ে আটকে থাকতো না বাবা। ও একটা ক্যারেক্টারলেস। ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে মেয়ে নিয়ে আসতো ভাড়া করে। চিন্তা করো একবার। আর আমাকে মারার সময় কি বাজে বাজে গালি যে দিচ্ছিল বাবা তার একটাও যদি তিতির শোনে ও ঘৃনায় মরে যাবে। আমার নাকি কোন জন্মের পরিচয় নেই, মাকে নিয়ে কতটা বাজে কথা বলেছিল বাবা আমি কিছুই ভুলিনি! তার সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে তো কিছুতেই মানব না বাবা।”
তিতির বিস্ময়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরে ছিল তান্নার কথা শুনে। মুগ্ধ ভাড়া করে মেয়ে নিয়ে আসতো! অসম্ভব.. তিতির চেনে মুগ্ধকে। মুগ্ধ কখনোই ওরকম না। কিন্তু মার আর গালাগাল! সেটা তো তিতির নিজেই চোখেই দেখেছে কতবার! তবু সবটা জানতে হবে। বাবা-ভাইকে পরে ফেস করবে। আগে পুরোটা মুগ্ধর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। তিতির নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর ফোন করলো মুগ্ধকে। ওপাশ থেকে ভেসে এল,
“আপনার ডায়ালকৃত নামারটি এখন বন্ধ আছে। দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।”
তিতির অবাক হলো, মুগ্ধর মোবাইল তো কখনো বন্ধ থাকেনা। আজ তবে বন্ধ কেন? চোখে পানি যেন আজ আটছেই না। উপচে উপচে পড়ছে।
কাঁদতে কাঁদতে তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। বার বার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, মুগ্ধকে আর ও পাবেনা। আর ঠিক তখনই ওর চোখে ভেসে উঠছিল মুগ্ধর সাথে কাটানো দিনগুলো, ওদের সব স্পেশাল মুহূর্তগুলো! কত স্বপ্ন, কত প্ল্যানিং, কত কথা দেয়া নেয়া সব এভাবে শেষ হয়ে যাবে? এসব ভাবনার অবসান ঘটালো একটি ফোনকল। রিংটোন শুনে তাকাতেই তিতির দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, Mugdho is calling..
লাফিয়ে উঠে ফোন ধরলো তিতির। মুগ্ধর গলায় হ্যালো শুনতেই কান্নাটা আরো বেড়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“আরে পাগলী এত কাঁদছ কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“আই লাভ ইউ।”
-“আই লাভ ইউ টু মাই তিতিরপাখি।”
-“তোমার সাথে থাকতে না পারলে আমি মরে যাব। প্লিজ কিছু একটা করো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
-“হ্যা, অবশ্যই করবো। তুমি আর কান্না করোনা প্লিজ। দেখো সব ঠিক করে দেব।”
-“জানো কতবার তোমাকে ফোন করেছি! কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিল।”
-“হ্য ফোন আছাড় মেরেছিলাম, ভেঙে গেছে, পিউ কুড়িয়ে দিয়েছে অবশ্য কিন্তু অন হচ্ছিল না। অথচ তোমার খোঁজটাও নিতে পারিনি তাই আগের ফোনটা আলমারির চিপা থেকে খুঁজে বের করেছি। যাই হোক তোমার বাসার পরিস্থিতি কি? তান্না তোমাকে স্পিচ দিয়ে দিয়েছে না একটা আমার বিরুদ্ধে?”
-“না, আমি তখনই ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছি। কিন্তু তুমি ফোন কেন ভেঙেছো?”
-“আরে ইকরা**টা ফোন করে পিঞ্চ করছিল তোমাদের বাসা থেকে আমাকে রিজেক্ট করেছে সেটা নিয়ে। আমি তো ওর ফোন ধরিনা। তাই আননোন নাম্বার থেকে ফোন করেছে, বোঝো কি পরিমাণ বেয়াদব একটা।”
-“ছিঃ প্লিজ তুমি স্ল্যাং ইউজ করোনা তো।”
-“আমি তো এমনই, খারাপ।”
-“উফ, আজাইরা কথা বলোনা। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না ইকরা আপু এত তাড়াতাড়ি জানলো কি করে?”
-“কিভাবে আবার মা বলেছে। মাঝে মাঝে মা যা করে।”
এতক্ষণে তিতিরের কান্না থেমে এসেছে। বলল,
-“মায়ের উপর কখনো রাগ করোনা। মা তো একটু সহজ সরলই। দুনিয়ার কোন প্যাঁচই বোঝেনা।”
-“না, মায়ের উপর রাগ করিনি।”
-“আচ্ছা, এবার আমাকে বলোতো তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছিল?”
মুগ্ধ কোনো ভনিতা না করে সব বলল। যা ঘটেছিল তার এক বর্ণও চেঞ্জ বা লুকায়নি। উলটো তান্না কি কি বলেছিল আর ও কিভাবে মেরেছিল কি কি গালি দিয়েছিল তার সবটা বলল। মুগ্ধ যতক্ষণ বলছিল তিতির ততক্ষণ একটা কথাও বলেনি। মুগ্ধর বলা শেষ তখনো তিতির চুপ করে রইলো। তারপর মুগ্ধ বলল,
-“তিতির? চুপ করে আছো কেন? কিছু তো বলো।”
তিতির এখন আর মোটেও কাঁদছে না। রাগ হচ্ছে। মুগ্ধর উপরও যেমন রাগ হচ্ছে, ওর ভাইয়ের উপরও রাগ হচ্ছে। বলল,
-“আমাকে ভুলে যাও।”
-“মানে? তিতির আমি জানি আমি যা করেছিলাম ঠিক করিনি কিন্তু তোমার ভাই যেটা করেছিল সেটাও কিন্তু ঠিক করেনি। তুমি এরকম কথা বলোনা তিতির। এতবড় শাস্তি আমাকে দিওনা।”
-“আমি কিছুই করছি না। এতকিছু যখন ঘটে গেছে আমার ফ্যামিলি কখনোই রাজী হবেনা তাই বললাম আমাকে ভুলে যাও।”
-“সব ফ্যামিলি এরকম বলে। আমরা বোঝাব তিতির। দেখো বোঝালে ঠিকই বুঝবে।”
-“কি বুঝবে বলো? তুমি আমার ভাইকে কিসব গালি দিয়েছো চিন্তা করে দেখো একবার।”
-“তিতির রাগ উঠলে যখন মানুষ গালি দেয় তখন এতকিছু মিন করে দেয়না, মুখে যা আসে তাই বলে গালি দেয়।”
-“তুমি আমার ভাইয়ের জন্ম পরিচয় নিয়ে কথা বলেছো। আমার মা কে নিয়ে বাজে কথা বলেছো তোমার মনে হয় এরপরেও আমার বাবা, আমার ভাই তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে?”
-“আমি কি জানতাম তান্না তোমার ভাই? সবসময় তো ভাইয়া ভাইয়া বলেছো। একদিনও নামটা বলেছো?”
-“মারামারি আর গালাগালি তোমার স্বভাব। রাগ কন্ট্রোলের আর যেন কোনো উপায় নেই তোমার। আমি তো আগেও কতবার দেখেছি।”
-“তোমাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার সহ্য হয়না।”
-“বাহ! ভাল তো। কি বীরপুরুষ আমার।”
-“তিতির, তোমার ভাই যে তোমার রেট জিজ্ঞেস করেছে তাতে কি ওর কোনো দোষ নেই? তুমি তো ওর নিজের বোন।”
-“ও যদি এটা বলেও থাকে তো জানতো না যে ও ওর বোনের সম্পর্কে বলছে।”
-“ভাইয়ের বেলায় এখন ‘যদি’ বলছ? তার মানে আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? আর হবেই বা কিভাবে! তোমার ভাইয়ের যা এক্টিং দেখলাম আজ। বলে কিনা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে বলতে পারবে না কি হয়েছে! আরে ও তো দুমুখো সাপ ওর মুখ কি সোনা দিয়ে বান্ধানো নাকি! যে ওর মুখ দিয়ে ভাল কথা ছড়াবে! -“মুখটাকে একটু সামলাও।”
-“তোমার ভাই বুচ্ছো বাসার মধ্যে ভেজাবিড়াল হয়ে থাকে। সেটা নিশ্চই ফ্যামিলিতে গুডবয় হয়ে থাকার জন্য?”
-“দেখা তিতির, আমি সত্যি জানতাম না যে ও তোমার ভাই। কিন্তু বিশ্বাস করো ও শুরু না করলে আমিও ওকে কিছুই বলতাম না।”
-“নাইবা জানলে, তুমি না সবসময় সবাইকে বলো একটা মেয়েকে বাজে কথা বলার আগে ভাবা উচিৎ সেও তোমার বোনেরই মত কারো বোন। তাহলে কারো মাকে নিয়ে বলার আগে এটা ভাবলে না সেও কারো মা।”
-“দেখো আমি তো চাইলে তান্নাকে গালাগাল করার ব্যাপারটা তোমার কাছে গোপন করতে পারতাম। আমিতো করিনি তিতির। পুরোটাই বলেছি তোমাকে। আর প্লিজ আল্লাহর দোহাই লাগে তিতির, একটু বোঝো.. কাউকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয়ার মানে এটা না যে তার মা কুত্তা। মানে হলো গিয়ে সে একটা বাবু কুত্তা। তেমনি অন্য গালিগুলোও অমনই।”
এভাবেই অনেক তর্কাতর্কি হয়েছিল সেদিন। অনেক রাতে ভাইয়া দরজায় নক করলো। অনেকবার নক করার পর তিতির দরজা খুলল। বাবা-মা, ভাইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকেই তিতিরের মা বলল,
-“তিতির, ওই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হওয়া কখনো সম্ভব না। তোমার কি কিছু বলার আছে?”
তিতির দেখলো বাবা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। রুমে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তান্নাও কোনো কথা বলছে না।
-“মা, তোমরা ওকে যেমন ভাবছ ও তেমন নয়। ওই ঘটনাটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমি ওকে চার বছর ধরে চিনি। ও আসলে খারাপ না। আমার সম্পর্কে কেউ কোন আজেবাজে কথা বললেই শুধু রেগে যায় ও। তখন রাগারাগি, গালাগালিটা ওর চলে আসে। সবার তো আর ১০০% ভাল দিক থাকে না।”
মা অবাক হয়ে বলল,
-“এতকিছুর পরেও একথা বলছিস? মা, ভাইয়ের সম্মানের কোন দাম নেই তোর কাছে?”
তান্না বলল,
-“তোর মতামত জানতে চেয়েছিলাম।”
তিতির বলল,
-“আমি মুগ্ধকেই বিয়ে করবো। ও ভাল খারাপ যেমনই হোক না কেন ওর সাথে আমি হ্যাপি থাকবো।”
এতক্ষণে বাবা বলল,
-“তিতির তুমি যদি মনে করো তুমি এডাল্ট, তোমার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পারবে তাহলে জেনে রাখো আমরা তোমার বাবা-মা, তোমাকে জন্ম দিয়েছি, লালনপালন করেছি, যত্ন করেছি, ভালবাসা দিয়েছি তাই তোমার উপর আমাদের অধিকার আছে। আমরা কোনোভাবেই তোমাকে আগুনে ফেলে দিতে পারব না। যাই হোক, আমরা কখনো এই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেব না। তারপরেও যদি করতে চাও তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাও। কখনো আর ফিরে আসবে না। তুমি ভুলে যেও তোমার বাবা মা আছে। আমরাও ভুলে যাব আমাদের একটা মেয়ে ছিল। সব সম্পর্ক সেদিনই শেষ হয়ে যাবে যেদিন তুমি ওর সাথে নতুন সম্পর্কে বাধা পড়বে।”
একথা বলে বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। তান্নাও বলল,
-“রক্তের সম্পর্কের প্রতিদান, ছোটবোনকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রাতের পর রাত জেগে কাধে নিয়ে হাটার প্রতিদান, অসুস্থ বোনের বিছানার পাশে বসে কাঁদার প্রতিদান, বোনের আবদার পূরণ করার জন্য দিনরাত এক করে বাবা-মাকে রাজী করানোর প্রতিদান, বোনের পরীক্ষার সময় অযথা জেগে থেকে বোনকে সঙ্গ দেয়ার প্রতিদান! সব প্রতিদানগুলো এতসুন্দর করে পাব ভাবিওনি কোনদিন। থ্যাংকস।”
একথা বলে ভাইয়া বের হয়ে গেল। ভাইয়ার চোখে পানি দেখে মা বলল,
-“আগে যদি জানতাম, তুই জন্মানোর পরই তোর মুখে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলতাম।”
তারপর মাও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তিতির ফ্লোরে বসে পড়ে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
প্রত্যেকটা মানুষই সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট স্টক নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সেই স্টক শেষ হয়ে গেলে যেমন আর পাওয়া যাবে না তেমনি শেষ না হলেও মৃত্যুর আগে যেভাবেই হোক শেষ হতে হবে। তিতিরের সুখের স্টক শেষ বোধহয়। আর কষ্টের স্টকে তো হাতই পড়েনি এতদিন। ছোটবেলা থেকে কেঁদেছে অনেকবারই তবে সেটা শুধুই সুখে,আবেগে। আজ থেকে যে কষ্টের কান্না শুরু, বুঝতে অসুবিধা হলো না তিতিরের। এটাও বুঝতে পারছে মুগ্ধকে ও কখনোই পাবে না। তবু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে।
মাঝরাতে আবার ফোন করলো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“ঘুমাওনি কেন? সকালে অফিস নেই?”
-“কাল শনিবার।”
-“ও হ্যা। খেয়াল ছিল না।”
-“তোমাকে বাসা থেকে এখনো কিছুই বলেনি?”
-“বলেছে।”
-“কি বলেছে?”
কে কি বলেছে সবটা মুগ্ধকে খুলে বলল তিতির। সব শুনে মুগ্ধ বলল,
-“সো নাও ইউ হ্যাভ জাস্ট 2 অপশনস টু পিক ওয়ান।”
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“তো কি ডিসিশান নিলে?”
তিতির চুপ, মুগ্ধও কিছু বলল না.. সময় দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিতির বলল,
-“তোমাকে বিয়ে করলে আমার ফ্যামিলি ছাড়তে হবে। সেটা তো পারব না আমি।”
-“জানতাম আমি।”
-“আমি তোমাকেও অনেক ভালবাসি কিন্তু বাবা-মা ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করেছে আমার জন্য তাদের আমি কষ্ট দিতে পারব না।”
-“হুম। কিন্তু তিতির তুমি যদি চলে আসো, আমরা বিয়ে করে ফেলি তারপর এক সময় তোমার ফ্যামিলি ঠিকই মেনে নেবে। এখন কষ্ট পেলেও তখন তো সব ঠিক হয়ে যাবে তাইনা?”
-“যারা পালিয়ে বিয়ে করে তাদের সবারই ফ্যামিলি এক সময় না এক সময় মেনে নেয়। তাই আমরা ভাবি সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কি ঠিক হয়? কতটুকু ঠিক হয় বলো তো? বাবা-মায়ের মনে যে ক্ষতর সৃষ্টি হয় সেটা কি কখনো মিলিয়ে যায়? যায়না, হয়তো সন্তানের মুখ চেয়ে মেনে নেয় একসময়। কিন্তু ক্ষতটা ভেতরে রয়েই যায়।”
মুগ্ধ ভাবলো, বাহ তিতির বড় হয়ে গেছে! এই চিন্তাটা মুগ্ধর মাথায় আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু আসেনি। আসলো তিতিরের মাথায়। তিতির ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
-“কিছু বলো?”
-“আমার আর কিছু বলার নেই। যা ভাল মনে হয় করো।”
এভাবেই চলতে থাকলো, তখন প্রতিদিন ওদের কথা হত। কেমন আছো কি করোর পর ওদের কথা ফুরিয়ে যেত। তারপর শুধু শুধু কতক্ষণ ফোন কানের কাছে ধরে রেখে তারপর রেখে দিত। মুগ্ধ কোনো ফাজালামো করতে পারতো না। তিতিরও তেমন কথা খুঁজে পেত না। ওরা একসাথে থাকলেও ওদের জীবনে কোন সুখ ছিল না। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর কথায় কথায় হুট করে একদিন মুগ্ধ রেগে গিয়ে বলল,
-“যেইনা ফ্যামিলি তার জন্য আবার জান দিয়ে দিচ্ছে। আমার জীবনে আমি এত ফালতু ফ্যামিলি দেখিনি।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“কি বললে তুমি?”
-“যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। তোমার ফ্যামিলির কাছে নিজেদের ইগোর মূল্য সবচেয়ে বেশি। তোমার সুখ কিচ্ছু না।”
তিতির কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। হঠাৎই পায়ের তলা থেকে একদল কীট যেন ঢুকে গেল পায়ের ভেতর। পা থেকে সমস্ত শিরা,উপশিরা বেয়ে বেয়ে রকেটের গতিতে বুকের মধ্যে উঠে এসে একটা মোচড় দিয়ে আবার বেয়ে বেয়ে উঠে গেল মাথায়। তারপর আবার একটা মোচড় দিয়ে পানির রূপ ধরে বেড়িয়ে এল চোখ দিয়ে! মুগ্ধ এভাবে কথা বলল ওর সাথে? তিতির জানে ওকে ছাড়া থাকতে মুগ্ধর কষ্ট হয়। ওর কি কষ্ট হয়না? এতবড় পৃথিবীতে একমাত্র মুগ্ধই তো ছিল ওকে বোঝার মানুষ। এখন সেও বুঝতে পারছে না!
মুগ্ধ সাথে সাথেই আবার কল দিল। কয়েকবার ধরলো না তিতির। কিন্তু মুগ্ধ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। অবশেষে না ধরে থাকতে পারলো না। তিতির ভেবেছিল মুগ্ধ সরি বলার জন্য ফোন করছে। কান্নাটা কোনভাবে থামিয়ে, চোখ মুছে ফোনটা ধরলো। মুগ্ধকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে ও কাঁদছিল। কিন্তু ফোন ধরতেই মুগ্ধ ঝাড়ি দিয়ে বলল,
-“কথা বলছি তার মধ্যে না বলে ফোন কাটলে কেন?”
-“এমনি।”
-“এমনি মানেটা কি? ফ্যামিলি তোমার একলারই আছে? আর কারো নেই?”
-“সবারই ফ্যামিলি আছে আর সবার ফ্যামিলির প্রতিই তাদের দূর্বলতা আছে। তাই আমার ফ্যামিলি নিয়ে আর আজেবাজে কথা বলোনা।”
-“কেন বলবো না? তোমার তোমার ভাই ইচ্ছেমত বাবা-মার ব্রেইন ওয়াশ করবে আর তারা কিছু যাচাই না করেই ওয়াশড হবে। তোমার ভাই তাদের ছেলে আর তুমি কি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে যে তোমার দিকটা দেখবে না?”
-“তোমার সাথে কথা বলার আর কোন ইচ্ছে আমার নেই।”
-“তোমার সাথে কথা বলার জন্য লাগে আমি বসে আছি? ফোন রাখো!”
শেষের ‘ফোন রাখো’ টা মুগ্ধ প্রচন্ডভাবে ধমকে বলল। তিতির বলল,
-“তুমি রাখো।”
-“আর একটা কথা বললে তোমার ভাইরে আমি খুন করবো। এক্ষুনি ফোন রাখো।”
-“আমি ফোন দিয়েছি মনে হয়? তুমি ফোন দিয়েছো, তুমিই ফোন রাখবে।”
-“ধুর বা*।”
একথা বলেই ফোন রেখে দিল মুগ্ধ। আবার কান্নায় ভেসে গেল তিতির। আচ্ছা ঠিকাছে এই ব্যাবহার করলো তো মুগ্ধ? মনে থাকবে।
আশ্চর্যজনকভাবে তিন চারদিন চলে গেল অথচ মুগ্ধ একবারও ফোন করলো না। থাকতে না পেরে তিতিরই কল করলো। ওই নাহয় প্রথমে সরি বলবে। কিন্তু কল ঢুকছে না। তিতির অবাক হলো। অনেকবার ট্রাই করলো। কিন্তু কল ঢুকছেই না! ভাবীর রুমে গিয়ে ভাবীর ফোন থেকে কল করতেই কল ঢুকলো। এবং মুগ্ধ সেই কল রিসিভও করলো। কথা না বলে কেটে দিল তিতির। ভাবীকে বলল,
-“যদি কল ব্যাক করে তো বলবে নাম্বার টাইপ করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিলে। পরে অপরিচিত গলা শুনে কেটে দিয়েছো।”
-“কে মুগ্ধ ভাইয়া?”
তিতির দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
-“হ্যা।”
-“রাগারাগি হয়েছে?”
তিতির ম্লান হেসে বলল,
-“সব তো শেষই, এখন রাগারাগি হলেই কি আর না হলেই কি!”
ভাবী অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তিতির নিজের ঘরে চলে এল। তার মানে মুগ্ধ ওকে ব্লক করে রেখেছে। ফেসবুকে ঢুকলো ম্যাসেজ করার জন্য। কিন্তু মেসেজ গেল না। মুগ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে! কতক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ও পারে পিউ বা মা কে কল করতে। কিন্তু করবে না। কেন করবে? মুগ্ধ তো ইচ্ছে করেই সবকিছু থেকে ব্লল কিরেছে যাতে ওর সাথে আর কথা বলতে না হয়। ঠিকাছে মুগ্ধ পারলে ও অবশ্যই পারবে। তিতির সিদ্ধান্ত নিল কোনভাবেই আর মুগ্ধর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। যেদিন মুগ্ধ নিজ থেকে যোগাযোগ করবে সেদিন মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুব কথা শুনিয়ে দেবে সেদিন।
সারাটা দিন মাস্টার্সের ক্লাস আর ফ্রেন্ডস নিয়ে ব্যস্ত থাকতো তিতির। কিন্তু রাতটা কাটতেই চাইতো না। একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি তিতির। ঘুম তো আসতোই না, কোনভাবে ঘুমিয়ে পড়লেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত। আগে এত স্বপ্ন দেখতো না। ইদানিং বেড়েছে। মানুষের মন যত বেশি অশান্তিতে থাকে তত বেশি স্বপ্ন দেখে একথা বুঝি আসলেই সত্যি।
৫ মাস পর যেদিন মুগ্ধ ফোন করলো তিতিরকে কোনো কথাই শোনাতে পারেনি সেদিন ও। পারেনি কোনো অভিমান করতে, পারেনি আহ্লাদ করতে, এমনকি পারেনি ওর সামনে কাঁদতেও। যেন অনেক দূরের মানুষ। কঠিন হয়ে থাকতে পেরেছিল শুধু। সেদিন মুগ্ধ বলেছিল,
-“সরি তিতির, লাস্ট যেদিন আমাদের কথা হয়েছিল সেদিন আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছি।”
তিতির বলেছিল,
-“৫ মাস পর সরি ফিল করলে?”
-“নাহ, ২/৩ দিন পরেই সরি ফিল করেছিলাম কিন্তু ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। তোমাকেও ব্লক করে রেখেছিলাম কারন যেহেতু দূরেই থাকতে হবে তাই অভ্যাস করছিলাম।”
-“বাহ ভালই তো। তা অভ্যাস ভেঙে ফোন করতে গেলে কেন?”
-“আসলে আমার মোবাইলে তোমার যে ছবিগুলো ছিল ওগুলো পিসিতে রেখে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। যাতে সবসময় সামনে না পরে। সামনে পড়লেই তো দেখতে থাকি আর মায়া বাড়ে। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার জন্যই এসব করেছিলাম। আজ হঠাৎই তোমার একটা ছবি সামনে পড়লো। তারপর লোভ হলো অন্য ছবিগুলো দেখার, দেখলাম। তারপর লোভ আরো বাড়লো তোমার ভয়েস রেকর্ডিং গুলোও শুনলাম। তারপর তোমাকে লাইভ শোনার লোভ হলো। আর থাকতে না পেরে কল করলাম। এখন তোমাকে লাইভ দেখার লোভ হচ্ছে।”
-“এতদিন যখন কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছো তো এখনো পারবে, বাকী জীবনটাও পারবে।”
-“হুম, কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছি, করতে তো আর পারলাম না। অনেক কষ্ট হয়েছে এই ৫ টা মাস। জানি তোমারও কষ্ট হয়েছে। অনেক কষ্ট দিয়েছি, ক্ষমা করো।”
-“না না একদম ঠিকই করেছো তুমি। ৫ মাস যে পারে সে সারাজীবনও পারবে।”
-“ওকে বাট, এটলিস্ট স্কাইপে তে আসো?”
তিতিরের বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল তখন কিন্তু কান্নাটা চেপে রাখলো। বড্ড অভিমান হলো। ইশ ৫ টা মাস একটা কথা না বলে থেকেছে আর এখন এসেছে চেহারা দেখতে! চিন্তা করলো বেঁচে থাকতে এ চেহারা আর দেখাবে না মুগ্ধকে। বলল,
-“না স্কাইপে তে আসতে পারবো না। ইন্টারনেট নেই।”
তারপর থেকে গত দুই মাসে মুগ্ধ অনেকবারই ফোন করেছে। প্রথম কয়েকবার ফোন ধরেনা তিতির, তারপর ঠিকই ধরে, না ধরে পারেনা। কিন্তু দুজনের কথাবার্তা যতক্ষণ হয় এধরণের কথাই হয়। তিতিরের অভিমানটা একসময় চলে যায় কিন্তু তবু শক্ত থাকে কারন ও জানে ওর ফ্যামিলি মানবে না। তাই আর জড়াতে চায় না। যত জড়াবে কষ্ট তত বাড়বে। মুগ্ধ জানে তিতির কেন এত স্ট্রং হয়ে থাকে, ও জানে তিতির যত কাটা কাটা কথাই বলুক না কেন ওর বুকের মধ্যে মুগ্ধর জন্য যে ভালবাসা ছিল তা আজও আছে। সেখানে অনেক বরফ জমিয়ে ফেলেছে মুগ্ধ, এখন গলাতেও হবে ওরই। তাই হাল ছাড়েনি।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। তিতির এখনো ওঠেনি। এরপর না গেলে ওর বাপ-ভাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। তখন আরেক অসান্তি হবে। মুগ্ধ তিতিরের মাথার কাছে বসে চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে ডাকলো,
-“তিতির? এই তিতির?”
তিতির উঁ করে নড়ে উঠলো। মুগ্ধ বলল,
-“উঠবে না?”
-“না।”
তিতিরের সেই ঘুমন্ত কন্ঠস্বর যা শুনলে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় মুগ্ধর। ও তিতিরের মাথাটা বালিশ থেকে উঠিয়ে নিজের কোলে নিল। তারপর আবার ডাকলো,
-“ওঠো না বাবা, বাসায় যেতে হবে তো।”
-“না আজকে যাব না, তুমি টিকেট ক্যান্সেল করে দাও। আজও আমি তোমার আদর খাব।”
মুগ্ধর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শরীরে কাঁপন ধরলো। অনেকদিন পর সেই পুরোনো অনুভূতি। যেন আবার ওরা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তিতির ঘুমের মধ্যে আহ্লাদ করছে। মুগ্ধ তিতিরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“পাগলী, এত ভালবাসা লুকিয়ে কেন রাখো?”
কিন্তু তিতির তখনো ঘুমে। মুগ্ধ আরো কয়েকবার ডাকার পর চোখ মেলে তাকালো ওর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর লাফিয়ে উঠে সরে গেল তিতির। মুগ্ধ কিছু বলল না। তিতির ভাবতে লাগলো ও তো ছিল রাস্তায়! মুগ্ধর বাড়িতে এল কি করে? আর ওর বুকের উপরই বা পড়ে ছিল কেন? ইশ বুকটা ধকধক করছে। কতদিন পর মুগ্ধ ওর সামনে! মুগ্ধ বুঝতে পারলো বোধহয় তাই বলল,
-“তুমি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলে। একটা ছেলে তোমার ফোনের ইমারজেন্সি কললিস্টে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করে। তারপর আমি সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাই, সেখানে তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দেয়া হয়। তারপর আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি ঘুমানোর জন্য। ওই অবস্থায় তোমার বাসায় দিতে গেলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে হতো। তখন তো আরেক গ্যাঞ্জাম লাগতো। তাই এখানে এনেছি।”
তিতিরের মনে পড়ে গেল। বলল,
-“কোন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম?”
-“চেয়ারম্যান বাড়ি।”
-“চেয়ারম্যান বাড়ি কি করে আসলাম? আমি তো ছিলাম ধানমন্ডি। লেকের ধার ধরে হাটছিলাম।”
-“মানে কি? তুমি হাটতে হাটতে ধানমন্ডি থেকে বনানী এসেছো?”
তিতিরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তিতির দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। মুগ্ধ ওর হাত ধরে বলল,
-“কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
তিতির বলল,
-“না ঠিকাছে।”
-“আগে কখনো এমন হয়েছে?”
-“নাহ। আর আমি বাসায় যাব, অনেক দেরী হয়ে গেছে।”
-“আচ্ছা, চলো। তার আগে একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ভাল লাগবে।”
হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই তিতির দেখলো মুগ্ধর মা বসে আছে একটা ট্রে নিয়ে। ট্রে ভর্তি দুনিয়ার খাবার-দাবার। তিতিরকে দেখেই উনি উঠে এলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“ইশ, মা কি চেহারা করেছো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করোনা না?”
তিতির একটু হাসার চেষ্টা করল,
-“না না আন্টি খাই তো। আসলে বয়স বাড়ছে তো, আগের মত অত ছোট তো নেই।”
-“এহ আমার কাছে বয়সের কথা বলছো? বলোনা। এই অবস্থা কেন হয়েছে জানিনা ভাবছো? এত ভেঙে পড়োনা মা। তোমার ফ্যামিলি যখন মুগ্ধকে মেনে নেবেই না আর তুমিও যখন পারবে না ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে তাহলে সেটাই বাস্তবতা ভেবে মেনে নাও। সুখী হবে।”
তিতির কিছু বলল না, মাথা নিচু করে রইলো। মা বলল,
-“এসো মা একটু ভাত খেয়ে নাও।”
-“নাহ, আন্টি আমি এখন খাব না।”
-“একটা মাইর দিব ধরে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে। খাব না বললে তো হবে না।”
মুগ্ধর মা তারপর জোর করে খাইয়ে দিল তিতিরকে। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মা বলল,
-“মুগ্ধ, তুইও তো খাসনি। একটু প্লেটে নিয়ে খেয়ে নে না বাবা।”
মুগ্ধ একটা প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে খেল। তারপর তিতিরকে নিয়ে বের হলো।
তিতির পাশে বসে আছে। মুগ্ধ ড্রাইভ করছে। মুগ্ধর নিজের গাড়ি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় নিজেই ড্রাইভ করে যায়। তারপর ড্রাইভার গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসে। মা,পিউ,স্নিগ্ধ ব্যবহার করে। সন্ধ্যায় ড্রাইভার আবার গাড়ি মুগ্ধর অফিসে দিয়ে আসে। মুগ্ধ ডাইভ করে ফেরে। প্রথমবার যখন মুগ্ধর প্রমোশন হয় তার পরপরই বাবা মারা যায়। লোন নিতে সাহস পায়নি তখন। পুরো ফ্যানিলির দায়িত্ব যে এখন ওর উপর! তারপরের বছর আবার প্রোমোশন হয় তখন মুগ্ধ কারলোন নিয়ে গাড়িটা কেনে। গাড়িতে বসতেই তিতিরের মনে পড়ে গেল এই গাড়িটা নিয়েও ভাইয়া কত কিছুই না বুঝিয়েছে বাবাকে। এত তারাতারি গাড়ি কিনলো কি করে? কি এমন চাকরী করে? নির্ঘাত অসৎ পথে আয় করেছে। বাপ পুলিশ ছিল না? ম্যাক্সিমাম পুলিশরাই তো দুই নাম্বার হয়। দুই নাম্বারের ছেলেও হয়েছে দুই নাম্বার। আঙ্কেলের মত অমন মানুষ সম্পর্কে ওসব কথা শুনে তিতির কান্না করে দিয়েছিল। নিজের ভাইকে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘সবাই তোর মত দু’মুখো সাপ না। তোর যোগ্যতা নেই বলে তুই চাকরীতে উন্নতি করতে পারিসনি। বাপের টাকায় ফুটানি মারছিস। মুগ্ধর যোগ্যতা আছে তাই মুগ্ধ উন্নতি করতে পেরেছে।’ কিন্তু বলতে পারেনি তিতির। ছোটবেলা থেকেই ও কখনো বাসায় কারো মুখের উপর কথা বলেনি। এখনো বলেনা তবু ওকে পদে পদে শুনতে হয় ও বেয়াদব। কারন ও ফ্যামিলির সবার সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারে, ‘আমি মুগ্ধকে ভালবাসি।’
জ্যামে পড়লো ওরা। গাড়িতে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুজনের একজনও কোন কথা বলেনি। মুগ্ধ একটা গান প্লে করলো,
“আমার আকাশ জুড়ে
বিশাল পাখির ডানা
তোমার ভেতর দিয়ে আমার আনাগোনা
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময়ে একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে..
রাত পেড়িয়ে দিন আসে
দিন পেরিয়ে রাত
প্রত্যেকদিন বাড়ছে শুধুই এই অজুহাত।
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময়ে একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে..
সব বুঝতে সময় লাগে
ভুল বুঝতে নয়।
কার সাধ্য ঘোচাবে
আমাদের সংশয়?
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময় একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে।”
হঠাৎ তিতির গানটা বন্ধ করে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো গানটা বন্ধ কেন করলে?”
-“গানটা খুব বাজে ছিল।”
মুগ্ধ মৃদু হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। বাকী রাস্তাও তিতির আর একটা কথাও বলল না। বিজয় স্মরনী থেকে ধানমন্ডির দিকে না গিয়ে তেজগাঁর দিকে যেতেই তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?”
-“এখন কথা কেন বলছো? এতক্ষন যেমন কথা বলার প্রয়োজন মনে করোনি তেমন এখন ও করার দরকার নেই।”
তিতির বলল,
-“বাসায় যেতে দেরী হলে প্রব্লেম হবে।”
-“কোন প্রব্লেম হবে না। সারাদিন তো বাসার বাইরে, কেউ তো একবার ফোন করে খবরও নিল না! আর যদি প্রব্লেম হয়ও তাতে আমার কি?”
তিতির আর কোন কথা বলল না। আসলেই রাত ১০ বাজলে হয়তো কেউ ফোন করবে তার আগে ইদানিং কারোর সময়ই হয়না ওকে নিয়ে চিন্তা করার। হাতিরঝিল গিয়ে লেকের ধারে গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-“সমস্যা কিরে বাবা তোমার? প্ল্যান করে দেখা তো করিনি। হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে। এখন একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও তোমার সমস্যা?”
-“হ্যা, অনেক সমস্যা।”
একথা শুনে রাগ ধরে রাখতে পারলো না মুগ্ধ। আচমকা তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। প্রথমে তিতির ওকে সরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও এক ইঞ্চি সরাতে পারলো না মুগ্ধকে। তারপর কি যেন হলো তিতিরের, তখন ও নিজেও মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে সাড়া দিল।
সবসময় এরকমই হয় নিজ থেকে তিতির কখনোই এগিয়ে আসে না। কিন্তু মুগ্ধ যখন একবার শুরু করে দেয় তিতির আর ছাড়তেই চায়না। নেশা হয়ে যায় ওর। বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন, ‘মধুতে যে মরে তাকে বিষ দিয়ে মারতে নেই।’ কোন বইতে যেন লিখেছেন? ‘সবিনয় নিবেদন’ নাকি ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ তে? এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তা সে যে বইতেই লিখুক না কেন কথা সত্য। তাই মুগ্ধ ওকে মধু দিয়েই মারলো। অনেকদিন ধরে এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মুগ্ধ! কিন্তু তিতির তো দেখাই করতে চাইতো না। যাই হোক, এবার কিছু তো একটা হবে। ফলাফল নিশ্চিত সুপ্রসন্ন!
তারপর তিতিরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এল মুগ্ধ। পুরো রাস্তায় কেউ কোন কথা বলেনি। তিতির আর একটি বারের জন্যও তাকালো না মুগ্ধর দিকে। গলির মাথায় যেতেই তিতির বলল,
-“আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। বাসার সামনে তোমার সাথে যেতে চাচ্ছি না।”
-“হুম, ঠিকাছে তুমি বোসো। আমি তোমার জন্য একটা রিক্সা নিয়ে আসি।”
-“রিক্সা লাগবে না, এটুকু তো হেটেই চলে যেতে পারব।”
-“তোমার শরীরটা এখন উইক। পারবে না।”
-“বেশী বাড়াবাড়ি করো না। এটুকু কোন রিক্সা যায় নাকি? দুই কদমে চলে যেতে পারবো।”
একথা বলেই তিতির গাড়ি থেকে নামছিল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে থামালো। বলল,
-“সবকিছু নিয়ে আরেকটু ভেবো প্লিজ। আরেকটা বার ট্রাই করো বাবা-মাকে রাজী করাতে? তোমাকে ছাড়া থাকার অনেক চেষ্টা করেছি তিতির, পারছি না।”
তিতির একথার কোন উত্তর না দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“আমি আসছি।”
তিতির যতক্ষণ ধরে হেটে হেটে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ। তিতির একবারও পেছন ফিরে তাকালো না।
বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লো তিতির। কয়েক সেকেন্ড পর ভেতর থেকেই উঁকি মারলো। মুগ্ধ ততক্ষণে ঘুরে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। তারপর চলে গেল। যতক্ষণ গাড়িটা দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো তিতির। মুগ্ধ চোখের সীমানার বাইরে যেতেই উপরে চলে গেল। দু’বার বেল দেয়ার পরও কেউই দরজা খুলছে না। তিতিরের কষ্ট হচ্ছিল দূর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে। এরপর তিতির কলিং বেলের সুইচটা অনেকক্ষণ চেপে ধরে রইলো। তখন চম্পা এসে দরজা খুলে দিয়ে আবার দৌড়ে চলে গেল ড্রইং রুমে। তিতির দরজা আটকে ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পেল মা ডিভানে শুয়ে আছে, বাবা আর ভাবী সোফায় বসে। আর চম্পা ফ্লোরে বসে আছে। যে যেখানে যেভাবেই থাক না কেন সবার মনোযোগ টিভির দিকে। টিভিতে একটা ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়াল চলছে। যেখানে এই মুহূর্তে একটা ছেলেকে কোন এক পার্টিতে তার শ্বশুর সবার সামনে অপমান করছে। একটা মেয়ে কাঁদছে, মেয়েটা সম্ভাবত ছেলেটার স্ত্রী। মা উত্তেজনায় শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
-“দেখসো দেখসো কি ভাল ছেলেটাকে কিভাবে অপমান করতেছে। অমানুষ একটা, আরে ব্যাটা খালি টাকাই দেখলি! নিজের মেয়েটার সুখের দিকে তাকাইলি না!”
তিতিরের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। হায়রে জীবন! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা লাগালো।
আয়না ধরে নিজের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে তিতির। মাত্র কিছুক্ষণ আগে মুগ্ধ ছিল এখানে। নিজেই নিজের ঠোঁট স্পর্শ করলো। মুগ্ধকেই অনুভব করতে পারছে। ইশ কি সুখ দিল মুগ্ধ। আচ্ছা, মুগ্ধর যখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যাবে তখনও কি মুগ্ধ এভাবেই সুখ দেবে ওর বউকে? হয়তো দেবে না, কিন্তু সত্যি যদি দেয়! তাহলে সেটা কিভাবে সহ্য করবে তিতির? ধুর, তিতির তো জানবেই না তো সহ্য করার ব্যাপারটা আসছে কোত্থেকে? কিন্তু এসব তো শুধু ওর অধিকার, অন্য কাউকে পেতে দেবে না ও। মুগ্ধর শেষ কথাটা কানে বাজছিল। ‘আরেকবার চেষ্টা করো’। কিন্তু কিভাবে চেষ্টা করবে ও? কম চেষ্টা তো করেনি।
রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবা বলল,
-“তিতির মা..”
তিতির বাবার উল্টোদিকে ঠিক মুখোমুখি বসা ছিল। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“জ্বী বাবা, বলো?”
-“তোর চাচ্চু তোর জন্য যে প্রপোজাল টা এনেছিল সেটা কিন্তু এসলেই ভাল। ছেলেটা তোর ছবি দেখে তোকে খুবই পছন্দ করেছে। এখনো বিয়ে করেনি। একবার কথা বলে দেখ, ভাল লাগতেও তো পারে। ছেলেটা কিন্তু অসাধারণ, লাখে একটা যাকে বলে।”
তিতির মুখের ভাতটুকু শেষ করে স্পষ্ট স্বরে বলল,
-“বাবা, আমি বিয়ে করলে মুগ্ধকেই করবো এবং তোমাদের সম্মতিতেই। অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে কেটে ফেললেও আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।”
মা টেবিলের উল্টোদিকে বসে ছিল। উঠে এসে তিতিরের গালে একটা চড় মারলো। এত জোরে মারলো যে তিতির টাল সামলাতে না পেরে পাশে বসে থাকা ভাবির গায়ের উপর গিয়ে পড়লো। মা বলল,
-“কোন বিয়েসাদির দরকার নেই তোর। এমনি থাকবি আজীবন। মাস্টার্স কম্পলিট হলেই চাকরী খুঁজবি। বিয়ে দেব না তোকে।”
মা একথা শেষ করেই আবার নিজের চেয়ারে বসে খাওয়া শুরু করলো। তিতির উঠে সোজা হয়ে বসতেই তান্না বলল,
-“বাবা, আজীবন লক্ষী মেয়ে লক্ষী মেয়ে বলেছ না? দেখো এখন তোমার লক্ষী মেয়ের অধঃপতনের নমুনা।”
তিতির উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে ফ্লোরে বসে কাঁদতে লাগলো। কেউ পেছন থেকে ডাকলো না আজ। অথচ আগে ও একবেলা না খেয়ে ঘুমাতে পারতো না। ঘুমিয়ে পড়লেও মা নাহয় ভাইয়া প্লেটে করে ভাত এনে ওর মুখে তুলে খাইয়ে দিত। ও ঘুমের ঘোরেই খেত। ওর ফ্যামিলির কেউ কখনো ওর কোন কিছুতে বাধা দেয়নি, কখনো খোঁচা দিয়ে কথা বলেনি গায়ে হাত তোলা তো বহুদূরের কথা। মাত্র কিছুদিনের ব্যাবধানে সবকিছু কেমন বদলে গেল।
তারপর আরো কয়েক মাস পার হয়ে গেল। এর মধ্যে মুগ্ধ অনেকদিনই ফোন করেছে, তিতির কখনো ধরেছে, কখনো ধরেনি। ধরে কি বলবে সেই তো এক কথা নিয়ে তর্কাতর্কি হবে। কি লাভ এসব করে! কিন্তু একদিন রাতে ইন্টারনেট অন করতেই হোয়াটস এ্যাপে মেসেজ এল। মুগ্ধর নাম দেখেই বুকটা কেঁপে উঠলো তিতিরের। মুগ্ধ একটা অডিও পাঠিয়েছে। তিতিরের মন বলে, ‘তারাতারি প্লে কর তিতির’। আর ওর ব্রেইন বলে, ‘খবরদার তিতির, ভুলেও প্লে করিস না। মরবি মরবি।’ শেষপর্যন্ত মনেরই জয় হলো। তিতির অডিওটা প্লে করতেই মুগ্ধর গিটারের টুংটাং শুরু হয়ে গেল। তারপর গান….
“যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে,
কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে।
আমার চোখে ঠোঁটে গালে
তুমি লেগে আছো..
যেটুকু রোদ ছিল লুকোনো মেঘ
দিয়ে বুনি তোমার শালে ভালবাসা,
আমার আঙুলে হাতে কাধে
তুমি লেগে আছো..
তোমার নখের ডগায় তীব্র প্রেমের মানে,
আমিও গল্প সাজাই তোমার কানে কানে,
তাকিয়ে থাকি হাজার পরদা ওড়া বিকেল,
শহর দুমড়ে মুচড়ে থাকুক অন্য দিকে।
ট্রাফিকের এই ক্র্যাকার ফোনই..
আমাদের স্বপ্ন চুষে খায়।
যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত
নতুন আলুর খোসার এই ভালবাসা,
আমার দেয়ালঘড়ি কাঁটায়
তুমি লেগে আছো..
যেমন জড়িয়ে ছিলে ঘুম ঘুম বরফ পাশে,
আমিও খুঁজি তোমায় আমার আশেপাশে,
আবার সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাওয়া জাহাজ পাশে,
বুকে পাথর রাখা আর মুখে রাখা হাসি,
যে যার নিজের দেশে
আমরা স্রোত কুড়োতে যাই।
যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত
নতুন আলুর খোসার এই ভালবাসা
আমার দেয়ালঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো।
যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে
আমার চোখে ঠোঁটে গালে
তুমি লেগে আছো।”
গানটা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না তিতির। কান্নায় ভেঙে পড়লো তিতির। গানটার প্রত্যেকটা শব্দ যেন ওদের জন্যই লেখা হয়েছে। ও আগেও বহুবার শুনেছে এই গানটা, তখন ওর এরকম ফিলিং হয়নি। মুগ্ধও যেন একটু বেশিই আবেগ দিয়ে গেয়েছে। কেন মুগ্ধ এমন করছে! মুগ্ধ এমন করলে ও বাঁচবে কি করে? মুগ্ধ কি একটুও বোঝে না? মুগ্ধকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিভাবে দেখবে! একটা ছবিও তো নেই। মুগ্ধর ছবিওয়ালা ফোন, মেমরি কার্ড সবই তো কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেছিল ভাইয়া। মুগ্ধ তো ইদানীং ফেসবুকও ইউজ করে না। শুধু হোয়াটস এ্যাপের এই ছবিটা দেখে তো মন ভরছে না তিতিরের। কোনভাবে রাতটা পার করলো। তারপর সকাল সকাল উঠেই ৮ টার মধ্যে রেডি হয়ে বের হয়ে গেল তিতির। সিএনজি নিয়ে ৯:১৫ এর মধ্যেই তিতির পৌঁছে গেল মুগ্ধর অফিসের সামনে। না মুগ্ধর সামনে যাবে না, শুধু দূর থেকে একবার দেখেই চলে যাবে। মুগ্ধর অফিস ১০ টায়। কখন আসবে কে জানে। মাত্র সকাল হলো এখনি রোদ খা খা করছে। ওড়নাটা মাথায় তুলে ঘোমটা দিয়ে নিল। মুগ্ধর অফিসের ঠিক অপজিটে একটা বিউটি স্যালুন। তার সামনে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো তিতির। মুগ্ধ যেদিক দিয়েই আসুক না কেন তিতির ওকে দেখতে পাবে। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর পৌনে ১০ টার দিকে দেখলো মুগ্ধর গাড়িটা এসে অফিসের সামনে থামলো। গাছের আড়াল থেকেই লুকিয়ে দেখছিল তিতির। রাস্তার এপাশ-ওপাশ হলেও দুরত্ব অনেক। তবু তিতিরের দেখতে প্রব্লেম হচ্ছিল না। মুগ্ধ গাড়ি নিয়ে বেজমেন্টে চলে গেল। হায় খোদা! যদি বেজমেন্ট থেকেই লিফটে উঠে যায় তাহলে তো ও দেখতেই পাবে না। না মুগ্ধ বেজমেন্ট থেকে ফিরে এল। সিকিউরিটির সাথে কথা বলছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, টাই, সানগ্লাস সব মিলিয়ে কি যে দারুন লাগছে মুগ্ধকে! শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করছে। মুগ্ধ সিকিউরিটির সাথে কথা বলা শেষ করে হাসছিল। ইশ কি মারাত্মক সে হাসি! কতদিন পর দেখছে তিতির। অবশেষে মুগ্ধ ভেতরে চলে গেল। এক পা ভেতরে দিয়েই আবার ফিরে এলো। আশেপাশে তাকালো, কি খুঁজছে ও? পকেট থেকে ফোন বের করলো। তারপর পরই তিতিরের ফোনে কল এলো। মুগ্ধ ফোন করেছে! ভাগ্যিস ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। কিন্তু মুগ্ধ কি কিছু বুঝতে পারলো নাকি এমনিতেই ফোন করেছে? কি করবে ফোন কি ধরবে নাকি ধরবে না? ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। মুগ্ধ বিরক্ত হয়ে আবার কল দিল। তিতির কি করবে কি করবে করেও কলটা রিসিভ করেই ফেলল।
-“হ্যালো।”
-“হ্যা, হ্যালো তিতির.. তুমি কোথায়?”
-“এইতো ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। এত সকালে তুমি?”
-“আসলেই ক্যাম্পাসে যাচ্ছো?”
-“হ্যা, ক্লাস আছে।”
এমন সময় মুগ্ধর সামনে দিয়ে একটা গাড়ি গেল। যার ভেতর গান বাজছে,
“Nothing gonna change my love for u…”
গানটা মুগ্ধ একই সাথে ফোনের মধ্যেও শুনতে পেল। ব্যাস মুগ্ধ এখন সিওর তিতির আশেপাশেই আছে। মুগ্ধ আশেপাশে হাটছে আর খুঁজছে। বলল,
-“তিতির, সিরিয়াসলি বলো.. তুমি কোথায়? তুমি কি বনানী? যদি এসে থাকো তো মিট মি প্লিজ। আমি তোমাকে দেখতে চাই।”
-“না, আমি বনানী কেন আসতে যাব? আমি ধানমন্ডিতে।”
এমন সময় মুগ্ধ দেখে ফেলল তিতিরকে। এক দৌড় দিল রাস্তা ক্রস করার জন্য। অর্ধেকটা আসতেই একটা গাড়ি এসে পড়লো, তিতির আঁৎকে উঠলো। মুগ্ধ থেমে গেল। গাড়িটা চলে যেতেই মুগ্ধ আবার দৌড় দিল। এক দৌড়ে তিতিরের সামনে। তিতির কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারলো না। এমনভাবে ধরা খাবে ভাবেনি। মুগ্ধ বলল,
-“পাবলিক প্লেস না হলে এমন একটা চড় মারতাম এখন তোমাকে যে জীবনে ভুলতে পারতে না। ফাজিল মেয়ে, যেমন ভাই তেমনি তার বোন।”
তিতিরের কান্না পেল, কিন্তু কাঁদলো না। একটুও রাগ করলো না। তিতির জানে এটা মুগ্ধর ভালবাসা প্রকাশেরই একটা ধরণ।
মুগ্ধ আর অফিসে গেল না। ফোন করে ছুটি নিয়ে নিল। তিতিরকে নিয়ে হাইওয়েতে চলে গেল। একসময় মুগ্ধ বলল,
-“এমন আর কখনোই করোনা তিতির। জানো তোমাকে একটা বার দেখার জন্য আমার মনটা কেমন করে? আর তুমি কিনা লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখে চলে যাও। এমন করে কি লাভ বলো?”
তিতির একথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,
-“একটা কথা রাখবে?”
-“কি?”
-“আগে এটা জিজ্ঞেস করলে বলতে ‘বলো’ আর এখন বলছ ‘কি?’ এখন আর আগের মত ভরসা নেই তোমার।”
-“আরে না না পাগলী! আমি তো অন্য কথা বলছিলাম হঠাৎ তুমি অন্য কথা বলায় জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। বলো কি কথা রাখতে হবে।”
-“আমি প্রায় ১ বছর ধরে বাসায় বন্দী। কেউ বেধে রাখছে না, কিন্তু নিজেই বের হইনা। প্রায় প্রতিদিনই কথা শুনতে হচ্ছে বাসায়। আর পারছি না। আমাকে একটু কোথাও নিতে যাবে?”
-“হ্যা বলো কোথায় যেতে চাও।”
-“ঢাকার বাইরে, একদিনের জন্য জাস্ট। একটু রিফ্রেশড হতে চাই।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“মানে? ঢাকার বাইরে যাবে? তোমার ফ্যামিলি জানলে…”
আর বলতে দিল না তিতির। মুখ চেপে ধরলো। তারপর বলল,
-“একটা দিনের জন্য আমি সবকিছু থেকে দূরে চলে যেতে চাই। যেখানে ফ্যামিলি থাকবে না, প্রব্লেম থাকবে না, দুশ্চিন্তা থাকবে না, ভয় থাকবে না, শুধু তুমি আর আমি থাকবো। নিয়ে যাবে না?”
-“হুম নিয়ে যাব। কবে যাবে বলো?”
-“এক্ষুনি।”
-“মানে? এখন যাবে? বাসায় বলে এসেছো?”
-“নাহ, আজ আমার গ্রুপ স্টাডির জন্য ফ্রেন্ডের বাসায় থাকার কথা ছিল। সেই হিসেবেই আমি বলে বেড়িয়েছিলাম। গত পরশু ও আমার বাসায় ছিল। প্রব্লেম নেই। আর আমার আসলে এই মুহূর্তেই মনে হলো কোথাও গেলে ভাল লাগবে। সুযোগও আছে কিন্তু তুমি ছুটি কি পাবে?”
-“আজ তো ছুটি নিয়েই নিয়েছি।”
-“কিন্তু আজ তো থাকবো। কাল আসবো। কালকের ছুটি নিতে হবে না?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“মাথাটা গ্যাছে না? কাল শুক্রবার।”
-“ওহ, আমার খেয়ালই ছিল না।”
-“ওকে, কোথায় যাবে বলো।”
-“তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।”
-“কক্সবাজার?”
-“ধুর, ওটাতো আরেক ঢাকা। খালি বিল্ডিং আর বিল্ডিং।”
-“তাহলে?”
-“এনি আদার অপশন?”
-“পাহাড়ে তো কতই গিয়েছি দুজনে। চলো এবার সিলেটে যাই। ওখানে আমাদের একসাথে যাওয়া হয়নি। পাহাড়, নদী, ঝড়না সবই আছে।”
-“আচ্ছা।”
-“কিন্তু আমি তো উলটো এসে পড়েছি। এমন সৌভাগ্য হবে জানতামও তো না।”
-“এখন ঘুরে যাও।”
মুগ্ধ গাড়ি ঘোরালো। তিতির বলল,
-“আমি যদি ঘুমাই তুমি কি রাগ করবে?”
-“রাগ কেন করবো?”
-“এত লম্বা জার্নি, আমি ঘুমাবো আর তুমি এতটা রাস্তা একা একা বোর হয়ে ড্রাইভ করবে।”
-“আরে নাহ পাগল, তুমি পাশে থাকলে কিছুতেই আমি বোর হইনা।”
-“তবু, আচ্ছা চলো বাসে যাই। তাহলে তোমাকে কষ্ট করে ড্রাইভ করতে হবে না।”
-“না বাসে গেলে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে, গাড়িতে গেলে দুপুরের মধ্যে পৌঁছতে পারবো। আর তুমি তো জানো ড্রাইভ করতে আমার অনেক ভাল লাগে।”
-“আচ্ছা। বাসায় জানাবে না?”
-“পরে। যখন ব্রেক নেব তখন জানিয়ে দেব।”
-“আচ্ছা।”
এরপর তিতির মুগ্ধর দিকে ফিরে সিটে হেলান দিয়ে মুগ্ধর একটা হাত টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এক হাতে চালাতে পারবে?”
-“হুম। তো কয়হাত লাগবে?”
-“তাহলে এই হাতটা আমার কাছেই থাকুক? আমি একটু ঘুমাই। জানো অনেক রাত ধরে ঘুমাতে পারি না আমি। এখন তোমার স্মেল নিয়ে নিয়ে ঘুমাবো, ঘুমাই?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ঘুমাও।”
তিতির শুনতে পেল না মুগ্ধর শেষ কথাটা। কারন ও ততক্ষণে ঘুমে তলিয়ে গেছে। মুগ্ধর হাত-পা কাঁপছে। আজ কতদিন পর তিতির স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে ওর সাথে। ঘুরতে যেতে চেয়েছে! তাও আবার ঢাকার বাইরে! ইভেন যাচ্ছেও! কি যে ভাল লাগছে মুগ্ধর। মুগ্ধ জানে এ ভাললাগা ক্ষণিকের তবু যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুতেই সুখ।
তিতির চোখ মেলে দেখলো গাড়িতে ও একা। মুগ্ধ নেই, গাড়ি একটা শপিং মলের সামনে পার্ক করা। এটা কোথায় বুঝতেও পারছে না। তিতির মোবাইল বের করে মুগ্ধকে কল করলো,
-“হ্যালো, আমার ঘুমকুমারীর ঘুম ভেঙে গেল?”
-“হুম। আপনি আমাকে একা রেখে কোথায় চলে গেছেন?”
-“তুমি লক করা আছো তাই একা রেখে আসলেও প্রব্লেম নেই। আমি তোমককে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি ওঠোনি তখন। আমি মলে ঢুকেছি, কিছু কেনাকাটা আছে।”
-“কি আবার কিনবে?”
-“আরে হুট করে এসেছি না? সাথে জামাকাপড় তো নেই, পড়বো কি? দুজনের জামাকাপড় কিনতে ঢুকেছি।”
-“শুধু তোমারটা কেন তাহলে। আমার আজ ফ্রেন্ডের বাসায় থাকার কথা ছিল না? একটা এক্সট্রা সালোয়ার-কামিজ আছে সাথে।”
-“ওহ, সেটা ভাল কথা কিন্তু বিছনাকান্দিতে কি তুমি সালোয়ার-কামিজ পড়ে পানিতে নামবে? সামলাতে পারবে তো?”
তিতির উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
-“আমরা বিছনাকান্দি যাব?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তো সিলেট এসেছি কেন?”
-“ওয়াও, আমি খুশি ধরে রাখতে পারছি না। বাই দ্যা ওয়ে, সিলেট এসেছি মানে? আমরা কি সিলেট চলে এসেছি?”
-“হ্যা।”
-“বাপরে! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি?”
-“ব্যাপার না।”
-“তুমি কোনো ব্রেক নাওনি?”
-“নাহ।”
-“কষ্ট হয়েছে অনেক?”
-“আরে না।”
মুগ্ধ ততক্ষণে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে এসেছে। গাড়ির দরজা খুলে বলল,
-“আসুন ম্যাম।”
তিতির হেসে বেড়িয়ে এল। শপিং মলে ঢুকে কেনাকাটা করছে এমন সময় তিতির লেডিস শার্ট দেখছিল। কয়েকটা কালারের মধ্যে বেবি পিংক টা বেছে নিল তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“এটা নিও না। ব্ল্যাক কিংবা নেভি ব্লু টা নাও।”
-“কেন এটা খারাপ লাগছে? তুমি তো বলেছিলে আমাকে লাইট কালারে ভাল লাগে।”
মুগ্ধ বলল,
-“এটা পড়ে পানিতে নামবে? নাকি এমনি পড়তে নিচ্ছো?”
-“পানিতে নামার জন্যই তো নিচ্ছি।”
-“তোমার সেন্স অফ হিউমার ভাল, কিন্তু মাঝে মাঝে সেটা কাজে লাগাও না কেন?”
-“কি করলাম আবার? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
মুগ্ধ এবার কাছে এসে নিচু স্বরে বলল,
-“হালকা কালারের ড্রেস পড়ে ভিজলে সব দেখা যায়।”
তিতির লজ্জা পেয়ে পিংক টা রেখে নেভি ব্লু টা নিল। পিংক টা এমনভাবে ছুড়ে রাখলো যেন ওটাতে কোন পোকা পড়েছে।
কেনাকাটা শেষ করে ওরা লাঞ্চ করে নিল। তারপর গাড়িতে উঠতেই তিতির বলল,
-“আমরা উঠছি কোথায়? হুট করে এলাম রুম পাব তো?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বুকিং দেয়া হয়ে গেছে।”
-“সিরিয়াসলি? কোথায়?”
-“শুকতারা ন্যাচার রিট্রিট।”
তিতির চোখদুটো বড় বড় করে বলল,
-“রিসোর্ট?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা।”
-“ওয়াও। খুব ভাল হয়েছে, আমার হোটেলে একদম ভাল লাগে না।”
-“সেজন্যই তো রিসোর্টে থাকবো।”
কিন্তু হঠাৎই চিন্তায় পড়ে গেল তিতির। বলল,
-“কিন্তু খরচটা তো অনেক বেশি হয়ে যাবে।”
-“তাতে কি? কতদিন তো কোথাও যাই না। হোকনা একটু খরচ, ডেইলি ডেইলি তো যাচ্ছি না।”
-“কেন যাওনা?”
-“তুমি ছাড়া এখন আর কোথাও যেতে ভাল লাগে না।”
তিতির চুপ হয়ে গেল। কে জানে এটাই হয়তো মুগ্ধর সাথে শেষ ট্যুর!
রিসোর্টের রিসিপশানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বলল,
-“স্কিউজমি, আমাদের বুকিং ছিল।”
ম্যানেজার একটা ফর্ম দিল ফিলাপ করার জন্য। এতদিন যত যায়গায় গিয়েছে এসব ফর্মালিটিজ মুগ্ধই করেছে। আজ ফর্মটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল। যা সবসময় মুগ্ধ লিখে এসেছে আজ তা লিখলো তিতির।
Mr. Mehbub Chowdhury Mugdho with Mrs. Titir Mehbub.
…………………………………………….
…………………………………………….
…………………………………………….
ফর্মালিটিজ শেষ করতেই একজন কেয়ারটেকার ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে রুম খুলে দিয়ে বলল,
-“স্যার, লাঞ্চ করবেন?”
-“না না আমরা লাঞ্চ করে এসেছি। ডিনার করবো এখানে।”
-“ওকে স্যার, কিছু লাগলে ইন্টারকমে ১০১ এ কল করলেই হবে।”
-“ওকে, থ্যাংকইউ।”
-“মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।”
ছেলেটি চলে যেতেই মুগ্ধ-তিতির ঘরে ঢুকলো। তিতিরের মনটাই ভরে গেল। বিশাল একটা ঘর। লাল ইটের সিরামিকের দেয়াল। বেতের বিছানা, বেতের আলমারি, বেতের ড্রেসিং টেবিল, সাথে কাঠের ফ্রেম করা আয়না। ঘরের পুরো একটা দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে থাই গ্লাস লাগানো। ওপাশে একটা বারান্দা, বারান্দায় যাওয়ার জন্য বড় একটা দরজাও আছে, দরজাটাও গ্লাসেরই। ভেতর থেকেই দেখলো বারন্দার ওপাশে যতদূর চোখ যায়, শুধু পাহাড় দেখা যায়। পুরো গ্লাসের দেয়ালটায় লাল রঙের পর্দা লাগানো। বেড কভার, বালিশের কভার সব সাদা। বিছানায় সামনে, টয়লেটের সামনে পর্দার সাথে মিলিয়ে লাল রঙের পাপোশ বিছানো। সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগলো। তিতির দরজা খুলে বারান্দায় গেল। সেখানে গিয়ে আরেকটা সারপ্রাইজ পেল। বারান্দার একপাশে বাগানের মত ঘাস লাগানো হয়েছে, পাশে সাদা গোল সিরামিকের টবে ফুলের গাছ। অন্যপাশে একটা ডিভান রাখা। পুরো বারান্দায় রেলিং বলে কিছু নেই। তবে বাউন্ডারি আছে, সেখানেও ঘাস ও ছোট ছোট বাগানবিলাশ লাগানো হয়েছে। আর বারান্দার ওপারে উন্মুক্ত পাহাড়, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বান্দরবান আর সিলেটের দূরে থাকা সবুজ সৌন্দর্যের একটা পার্থক্য রয়েছে। বান্দরবানের দূরের সবুজগুলো গাঢ় সবুজ। আর সিলেটের দূরের সবুজগুলো হালকা সবুজ, কিন্তু উজ্জল। তবে দুটো সৌন্দর্যই চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো। কারো সাথে কারো তুলনা করা চলে না।
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলের গন্ধ নিল। তিতির মুগ্ধর বাহুডোরে থেকেই ফিরলো মুগ্ধর দিকে। তারপর মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মুগ্ধ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“দেখো অবস্থা। এজন্য নিয়ে এলাম নাকি?”
তিতির চোখ তুলে মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ ওর চোখ মুছে দিল। তিতির বলল,
-“তুমি ফর্মটা কেন আমাকে ফিলাপ করতে দিলে?”
-“কেন, কি হয়েছে তাতে?”
-“মিস্টার এন্ড মিসেস লেখার পর আমার কেমন যেন একটা ফিলিং হলো।”
মুগ্ধ হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন?”
-“জানিনা, কেমনই যেন! বোঝাতে পারব না।”
-“সবসময় তো আমিই ফিলাপ করি এবং তখন আমার এই ফিলিং টাই হয়। তোমাকে এটার সাথে পরিচয় করানোর জন্যই আজ তোমাকে ফিলাপ করতে দিয়েছি।”
তিতির আবার কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“সব ঠিকঠাক থাকলে তো আজ আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফই থাকতাম।”
-“আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফই তিতির। আমাদের আত্মার বিয়ে অনেকদিন আগেই হয়ে গেছে। তোমার কি মনে হয়না আমাদের সম্পর্কটা শুধু একটা প্রেম না। তার থেকেও অনেক বেশি কিছু?”
-“হয় তো।”
-“হুম, এবার কান্নাটা থামাও না বাবা। আর গোসলে যাও। আমরা বিকেলে বের হব।”
-“কোথায় যাব?”
-“কোথাও একটা যাব। কোথায় তা এখনো জানিনা।”
মুগ্ধ তিতিরের চোখটা আবার মুছে দিল। তিতির বলল,
-“তুমি আমাকে কতদিন ধরে কোলে নাও না বলোতো?”
মুগ্ধ একথা শুনে এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। কোলে তুলে নিল তিতিরকে। তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে নামাতে নিল আর তিতির বলে উঠলো,
-“নামিও না, নামিও না।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“কেন?”
-“গোসল করবো না? বাথারুমে দিয়ে আসো।”
-“ওহ, ওকে।”
মুগ্ধ তিতিরকে বাথারুমে রেখে ফেরার সময়ই তিতির শাওয়ার ছেড়ে ওকে ভিজিয়ে দিল। মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে বলল,
-“এটা কি করলে বলোতো?”
তিতির হো হো করে হেসে দিল। মুগ্ধও ওকে টেনে শাওয়ারের নিচে এনে ভিজিয়ে দিল। কোথায় তিতির সরে যাওয়ার চেষ্টা করবে তা না করে মুগ্ধর টাই টা আলগা করে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিল। তারপর ওর গলার পিছনে দুহাত বেঁধে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ওর চোখের দিকে। মুগ্ধ যখন বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারলো তখন তিতিরের ওড়নাটা টেনে ফেলে দিল। তারপর তিতিরের কোমর জড়িয়ে উঁচু করে শূন্যে তুলে নিজের সমান করে বলল,
-“উইল ইউ কিস মি?”
তিতির চোখ নামিয়ে হাসলো। শাওয়ারের পানি তিতিরের চুল বেয়ে বেয়ে এসে পড়ছে মুগ্ধর ঠোঁটে, চোখে, বুকে। মুগ্ধ বলল,
-“এমনভাবে করো তিতির যার ফিল টা আমার মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে?”
তিতির মুগ্ধর দুই গালে হাত রেখে আরো একটু কাছে চলে গেল। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট বসালো। শাওয়ারটা ছাড়াই রইলো। বেশ অনেকক্ষণ পর মুগ্ধ আচমকা তিতিরকে নামিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে পাগলের মত চুমু খেতে লাগলো। তিতিরের ঠোঁটের কত যায়গায় যে কামড়ে দাগ বসিয়ে দিল তার কোন হিসেব নেই। অবশ্য তিতির যে মুগ্ধর কত চুল টেনে ছিঁড়লো তারও কোনো ইয়ত্তা নেই। মুগ্ধও একসময় তিতিরের ঠোঁট ছেড়ে গলায় নেমে এল। হাত চলে গেল কোমরে। পাগলামি চলতেই থাকলো। তিতিরের চোখ দুটো বন্ধ, ঘনঘন নিঃস্বাস ফেলছে। তখনই মুগ্ধ একটা হাত কোমর থেকে সরিয়ে তিতিরের পিঠের কাছে নিয়ে গেল। গলায় চুমু খেতে খেতেই তিতিরের পিঠ বরাবর কামিজের চেইনটা খুলে ফেললো। ভেজা পিঠে ভেজা হাত রাখতেই মুগ্ধর খেয়াল হলো তিতির আজ কিছুতেই না করছে না মুগ্ধকে কিন্তু ওর ফ্যামিলি তো সত্যিই কোনদিন মানবে না। একদিন হয়তো তিতিরের বিয়েও হবে অন্যকারো সাথে সেদিন যদি তিতিরের আফসোস হয় আজকের দিনটার জন্য? চেইনটা আবার লাগিয়ে দিল। তিতির অবাক হয়ে চোখ খুললো। মুগ্ধ বলল,
-“তারাতারি গোসল করে বেড়িয়ে এসো। এর বেশি ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
একথা বলে তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে ঘরে চলে গেল মুগ্ধ।
মুগ্ধ বেড়িয়ে যাওয়ার পর তিতির যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই বসে পড়লো। পাগলের মত কাঁদতে লাগলো। কান্নাটা কোনভাবেই থামাতে পারছে না। কিন্তু কেন কাঁদছে তা ও নিজেও ধরতে পারছে না। এত আদর পেয়ে সুখে কাঁদছে নাকি যা পেলনা তার জন্য কাঁদছে!
মুগ্ধ বাথরুম থেকে বের হয়ে নতুন কেনা টাওয়াল টা নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল। ডিভানে বসে শার্টটা খুলে ছুড়ে ফেলল ফ্লোরে। টাওয়াল টা পড়ে প্যান্ট টা খুলে সেটাও ছুড়ে ফেলল। রাগে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়লো। তান্নাকে পেলে এখন খুন করতো ও। শুধুমাত্র তান্নার জন্য আজ নিজের তিতিরকে আদর করতেও হাত কাঁপে মুগ্ধর। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মে যে পাপ করে ফেলেছে, আল্লাহ কাঁদার ক্ষমতাটা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। তিতিরের গোসল এখনো হয়নি? ওকে ওই অবস্থায় ওভাবে ফেলে আসায় কি কষ্ট পেয়েছে? ওর ওই অবাক দৃষ্টি তো অন্তত তাই বলছিল। ও কি এখন কাঁদছে?
মুগ্ধ বাথরুমের দরজায় নক করলো,
-“তিতির? আর কতক্ষণ? আজ এত টাইম লাগছে যে? পরে ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
তিতির চোখ মুছে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
-“আসছি।”
মুগ্ধ তিতিরের গলা শুনেই বুঝলো ও কেঁদেছে। তখন ওর আরো বেশি অসহায় লাগতে শুরু করলো। কি করবে ও? ওর হাতে কি সত্যি কিছু আছে?
তিতির গোসল শেষ করে খেয়াল করলো জামাকাপড় ভেতরে আনেনি। রিসোর্টের টাওয়ালটা গায়ে পেঁচিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘরে উকি দিল। কিন্তু মুগ্ধকে দেখতে পেল না। মুগ্ধ আবার কোথায় গেল! তখনই বারান্দায় চোখ পড়তেই মুগ্ধকে দেখতে পেল। বলল,
-“এই, শোনোনা।”
মুগ্ধ বারান্দা থেকেই বলল,
-“কি?”
-“আমি তো কাপড় আনিনি।”
-“ওহ দাড়াও, দিচ্ছি।”
-“শোনো।”
-“কি?”
-“টাওয়াল আছে ভেতরে। শুধু কাপড় দিলেই হবে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ নতুন কেনা পোলো শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার নিয়ে দরজার সামনে এসে বলল,
-“নাও।”
তিতির হাত বাড়ালো। মুগ্ধ ওর হাতে ওগুলো দিল। কিছুক্ষণ পর তিতির বেড়িয়ে আসতেই মুগ্ধ ঢুকলো। কেউ কারো দিকে তাকালো না। তিতির চুল মুছে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হঠাৎ তিতিরের নজরে পড়লো শপিং ব্যাগ গুলোর দিকে। তিতির যখন অন্তর্বাস কিনছিল, মুগ্ধকে তখন ভাগিয়ে দিয়েছিল সেখান থেকে। ততক্ষণে মুগ্ধও কিছু কিনেছিল যা দেখেনি তিতির। ও অবশ্য গাড়িতে উঠে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু মুগ্ধ বলেছিল,
-“তুমি কি কিনেছো আমি দেখতে চেয়েছি? যেহেতু চাইনি তুমিও আমারগুলো দেখতে পারবে না। সবারই পারসোনাল জিনিস থাকতে পারে।”
তিতির উঠে গিয়ে শপিং ব্যাগ গুলো খুলতেই দেখলো অরেঞ্জ,রেড আর এশ কালারের কম্বিনেশনের একটা জর্জেট শাড়ি ব্ল্যাক পাড়! সাথে ব্ল্যাক কালারের রেডিমেড স্লিভলেস ব্লাউজ, ম্যাচিং পেটিকোট, বাহ! মুগ্ধর বরাবরই সবদিকে খেয়াল থাকে আর পছন্দটাও ফার্স্টক্লাস। সব ইউনিক জিনিস ওর চোখে পড়ে। ঝটপট শাড়িটা পড়ে ফেলল তিতির। শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের খারাপ লাগাটা এখন আর ওর মধ্যে নেই। কারন, মুগ্ধ বেড়িয়ে যখন ওকে এভাবে দেখবে মুগ্ধরও ভাল লাগবে।
হলোও তাই। দরজা খুলে খালিগায়ে টাওয়াল পড়া মুগ্ধ চুল ঠিক করতে করতে বেড়িয়ে এল। তিতিরকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। তিতির হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-“সারপ্রাইজ!”
-“দিলে তো আমার সারপ্রাইজ টা নষ্ট করে।”
-“নষ্ট হয়নি। আমি সারপ্রাইজ পেয়েছি। তাইতো ইচ্ছে হলো তোমাকেও দেই।”
মুগ্ধ তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“সত্যি সারপ্রাইজড হয়েছি।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
তিতিরের মাথায় শয়তানি ঘুরঘুর করছিল। খুব ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর পড়নের টাওয়ালটা একটা টান দিয়ে খুলে ফেলতে। বেশ হতো। কিন্তু একাজ ও করতে পারবে না। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। মুগ্ধ সরে গিয়ে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করলো। প্যান্ট পড়তে পড়তে বলল,
-“ভাল হয়েছে শাড়ি পড়েছো। চলো সিলেট সিটিটা আজ ঘুরে ফেলি।”
-“হুম চলো।”
-“আর রিসোর্টের ভেতরেও কিন্তু অনেক কিছু আছে। এটার অনেক বড় এরিয়া।”
-“অনেক কিছু বলতে?”
-“ইকো পার্ক, সুইমিংপুল আরো কি কি যেন।”
-“আর কালকের প্ল্যান কি?”
-“কাল সকাল সকাল আমরা একবারে বেড়িয়ে পড়বো। বিছনাকান্দি ঘুরে দুপুরেই রওনা দিব। রাতের মধ্যে ঢাকা। রাত হলেই তো তোমার বাসায় খোঁজ পড়বে, তাই না?”
-“হ্যা।”
মনটা সামান্য খারাপ হলো তিতিরের। সুন্দর সময় কেন এত তারাতারি চলে যায়? আনমনে ভাবছিল ও। এমন সময় মুগ্ধ আচমকা তিতিরের চুল মুছে দিতে শুরু করলো। বলল,
-“চুলগুলো আজও মুছতে শিখলে না।”
তিতিরের চোখে পানি এসে গেল। অনেক কষ্টে কান্নাটাকে হজম করে নিল। ইশ, আজীবনের জন্য তিতির মুগ্ধর এই টুকরো টুকরো ভালবাসা গুলো হারিয়ে ফেলবে একসময়। মুগ্ধ হয়ে যাবে অন্য কারো স্বামী, তিতির হয়ে যাবে অন্য কারো স্ত্রী! তার আগেই যদি জীবনটাকে থমকে দেয়া যেত? ইশ এমন করলে কেমন হয় আজ তিতির কোনো একটা বিষ কিনে নিয়ে আসবে লুকিয়ে লুকিয়ে, তারপর সেই বিষ গোপনে রাতের খাবারের সাথে মিশিয়ে মুগ্ধকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে পড়ে থাকবে এখানে। ওদের ভালবাসার হ্যাপি এন্ডিং হবে। আইডিয়াটা কিন্তু বেশ। কিন্তু বিষ কোথায় পাওয়া যায়? ওষুধের দোকানে কি পাওয়া যায়?
-“এই তিতির? কি হলো? কি ভাবছো?”
তিতির ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এল। বলল,
-“তেমন কিছুনা। আমাদের প্রথম পরিচয়ের কথা ভাবছিলাম।”
-“ওহ। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি শাড়ি পড়া শিখতে গেলে কেন?”
-“তো? প্রত্যেকবার মায়ের কাছে যেতে ভাল লাগে নাকি?”
-“না মানে, তুমি যদি না শিখতে তাহলে আমি সেই ছোটবেলার মত আবার পড়িয়ে দিতে পারতাম।”
তিতির কোমরে হাত দিয়ে এক টানে কুচিগুলো খুলে ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর বলল,
-“ইচ্ছে করলে যেমন কোন কাজ শেখা যায়, ইচ্ছে করলে তেমন কোন কাজ ভোলাও যায়। আমি ভুলে গেছি কিভাবে শাড়ি পড়তে হয়।”
মুগ্ধ হেসে শাড়িটা তুলে নিল। পড়াতে পড়াতে বলল,
-“তুমি ইদানীং অনেক দুষ্টু হয়েছো।”
-“তোমাকে না পেয়ে না পেয়ে।”
মুগ্ধ আর কিছু বলল না। মনোযোগ দিয়ে শাড়ির কুচি দিতে লাগলো। কুচি দেয়া শেষ করে হাটু গেড়ে বসে কুচিগুলো কোমরে গুঁজে দিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“পৃথিবী গোল, কিছু কিছু ঘটনার রিপিটেশন তো হতেই পারে, তাই না?”
তিতির অন্যদিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা লাজুক হাসি দিল। মুগ্ধ তিতিরের নাভির ডানপাশে চুমু খেল। তিতির হাসতে হাসতে পিছিয়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“এত হাসির কি হলো?”
-“সুড়সুড়ি লেগেছে।”
-“বাহরে! এমনই বুঝি হয়? প্রথমবার তো হাসোনি, সুড়সুড়ি তখন কোথায় ছিল?”
-“আরে তখন তো বুঝেই উঠতে পারিনি কি হচ্ছে!”
মুগ্ধ উঠে দাঁড়ালো। তিতির কাছে এসে মুগ্ধর বুকের লোমের মধ্যে নাক ঘষলো, গাল ঘষলো আর তারপর ঠোঁটও ঘষলো। মুগ্ধ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সবটা অনুভব করছিল। তারপর তিতির সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতদুটো মুগ্ধর বুকের ঠিক মাঝখানটায় মেলে রাখলো। তারপর মাথা উঁচু করে মুগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার যখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে তখন এরকম খালিগায়ে তাকে বুকে নেবে না। নিতে হলে কিছু একটা পড়ে তারপর নিবে।”
-“আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। করলে এতদিনে করে ফেলতাম।”
-“তবুও, করতে হতেও পারে তাই বলছি সব করতে পারো কিন্তু তাকে খালি বুকে হাতও রাখতে দেবে না। চুমুও দিতে দেবে না বুকে। এটা শুধু আমার রাজত্ব করার যায়গা।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“হেসোনা, হাস্যকর লাগতে পারে কিন্তু আমার এরকম কিছু কথা রাখতে হবে তোমাকে।”
-“ওকে রাখবো। বাকীগুলো কি?”
-“তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারবে না।”
-“ওকে দিবনা, তারপর?”
-“হাঁস বার-বি-কিউ করে খাওয়াবে না।”
-“ওকে, স্পেসিফিকলি হাঁস বললে তাই জিজ্ঞেস করছি তাহলে কি মুরগী বার-বি-কিউ করে খাওয়ানো যাবে?”
-“যাবে।”
-“আচ্ছা আচ্ছা, ওকে। তারপর?”
-“তার ভেজাচুল মুছে দিতে পারবে না।”
-“ওকে দিবনা, নেক্সট?”
-“তার সাথে লিপকিস করার সময় আর যেখানে ইচ্ছা সেখানে হাত রাখতে পারো কিন্তু এক হাত কোমরে আরেক হাত কানের নিচে রাখবে না।”
মুগ্ধ মুখ টিপে টিপে হেসেই চলেছে। বলল,
-“আচ্ছা, তারমানে লিপকিস করা যাবে?”
-“হ্যা, যাবে। কিন্তু হাত সাবধান।”
-“আচ্ছা, তারপর?”
-“তাকে কক্ষনো কোলে নিতে পারবে না।”
-“ওকে নিবনা, আর?”
-“কখনো ওর কপালে কিস করবে না।”
এবার একটু বেশিই হাসলো মুগ্ধ। বলল,
-“আচ্ছা করবো না। তারপর?”
-“তোমরা দুজন কখনো একসাথে গোসল করবে না।”
-“এই এই, ওয়েট ওয়েট.. এতক্ষণ তুমি সেসবই নিষেধ করেছো যা যা আমি তোমার সাথে করেছি। কিন্তু এটা কি বললে? আমি তুমি তো কখনো একসাথে গোসল করিনি। তাহলে এটা না করলে কেন?”
-“আমার ইচ্ছে!”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“ওকে, তিতিরপাখি! বিয়েই তো করবোনা। তবু যদি কোনদিন করি তো তুমি যা যা নিষেধ করলে তার সব আমি মনে রাখবো।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
বিকেলটা রিসোর্টের মধ্যের ইকো পার্ক আর শহরের মধ্যেই একটা চা-বাগানের আশেপাশে ঘুরে কাটালো ওরা। ভেতরে ঢোকার পারমিশন পেল না। তারপর সন্ধ্যা হতেই ওরা মাজারে গেল। আর তারপর মাজার থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠেই মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“বলোতো এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?” পাশে বসে তিতির আনমনে চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে আচড়াচ্ছিল। মুগ্ধর প্রশ্ন শুনে বলল,
-“কোথায়?”
-“সুরমা নদীতে একটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে। স্টাইল করে বলতে গেলে বলতে হবে ওটা একটা ছোট জাহাজ। কিন্তু আসলে একটা লঞ্চ।”
তিতির হাসলো। বলল,
-“রেস্টুরেন্টে গিয়ে কি হবে?”
-“খাব।”
-“ডিনার না রিসোর্টে করবে বললে?”
-“এটা প্রি-ডিনার। সন্ধ্যার নাস্তা।”
-“পারোও তুমি।”
-“অবশ্যই পারি। এক যায়গায় এসেছো সেখানকার স্পেশাল খাবার গুলো খাবে না?”
-“তুমি খাও।”
রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কপালে একটা মাঝারী সাইজের কালো টিপ থাকলে ভাল লাগতো।”
-“ও হ্যা, তুমি তো টিপ আর কাজল পছন্দ করো। কিন্তু সাজ পছন্দ করো না এই ব্যাপারটা আমার মাথায় সেট হয়ে গেছে। তাই সাথে কিছুই রাখা হয় না।”
-“থাক, এটা নিয়ে আবার আফসোস করতে বসোনা যেন।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“এইযে তুমি শুধু স্যুপ নিলে আমি অন্যকিছু খেতে জোড় করলাম না কেন বলোতো?”
-“কেন?”
-“কারন, এখান থেকে বেড়িয়ে আমরা আরেকটা রেস্টুরেন্টে যাব। এখানে কম খেলে সেখানে ভাল করে খেতে পারবে তাই।”
তিতির হেসে বলল,
-“মানে কি? কি ঢুকেছে তোমার পেটে আজ?”
-“আমি অনেক খেতে পারি, সেটা তুমি তো জানোই। আসলে আমি যেটা খেতে বেড়িয়েছি এখানে সেটা নেই তাই আরেকটাতে যেতে হবে।”
-“সেটা কি?”
-“সাতকড়া গরুমাংস।”
-“সাতকড়া কি?”
-“অস্থির জিনিস। অনেক স্বাদ, অনেক।”
-“কিন্তু সেটা কি বলবে তো?”
-“একটা ফল, দেখতে লেবুর মত। যেটা দিয়ে গরুমাংস রান্না করা হয়। কিযে স্মেল রে ভাই। এটা সিলেটের স্পেশাল জিনিস। সিলেট ছাড়া আর কোথাও পাবে না।”
-“ওহ। তোমার বলার ধরণ দেখে খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“অবশ্যই খাবে।”
-“খেতে পারবো কিনা কে জানে!”
-“কেন?”
-“ঠোঁট জ্বলছে। কত জায়গায় কেটেছে কে জানে!”
-“ইশ, আসলেই? কেটে গেছে?”
-“কামড়ালে কাটবে না?”
-“শুধু জ্বলছে না ব্যাথাও করছে?”
-“ব্যাথাও করছে।”
-“আহারে, সরি।”
-“সরি বলোনা। শোধ করে দিব রাতেই।”
মুগ্ধ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
-“রিয়েলি? আমি চারপায়ে খাড়া।”
-“তোমার পা দুটো।”
-“হ্যা, তোমার দুটো সহ বলেছি।”
হাসলো তিতির। মুগ্ধও সে হাসিতে তাল মেলালো।
ওখান থেকে ওরা চলে গেল নবান্ন রেস্টুরেন্টে। সাতকড়া গরুমাংস আর পরোটা অর্ডার করলো। মুগ্ধকে অবাক করে পরপর তিন প্লেট গরুমাংস নিল তিতির। সাথে চারটা পরোটাও শেষ। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“কি বলেছিলাম না?”
তিতির খেতে খেতে বলল,
-“একটু ঝাল বেশি কিন্তু পৃথিবীতে এত মজার কিছু থাকতে পারে আমার জানা ছিল না, জাস্ট ওয়াও। স্মেলটাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তারপর সাতকড়ার টুকরাগুলোও খেতে খুব মজা”
-“পৃথিবীতে এর চেয়ে মজার জিনিস অবশ্যই আছে। আসলে এধরণের জিনিস আমরা সচরাচর খাই না তো। তাই হঠাৎ খেলে অনেক ভাল লাগে। আর এটা ঝাল কিছু না। রান্নাটাও ঝাল হয়নি, তোমার ঠোঁট কেটে গেছে তাই ঝাল লাগছে।”
-“হুম, আচ্ছা.. এগুলো কিনতে পাওয়া যায় কোথায়?”
-“বাজারে অভাব নেই। আর রাস্তার পাশেও ঝুড়ি ভরে নিয়ে বসে থাকে দেখোনি লেবুর মত?”
-“খেয়াল করিনি। যাই হোক, যাওয়ার দিন আমি নিয়ে যাব।”
-“আচ্ছা। রান্নার সিস্টেম জানোতো?”
-“না, আলদা কোনো সিস্টেম আছে নাকি? ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করে মাংসের মধ্যে দিয়ে দেব।”
-“আজ্ঞে না। শুধু খোসাটাই রান্না করতে হয়। ভেতরের অংশটা খেতে হয়না ফেলে দিতে হয়, ওটা তিতা।”
-“ও।”
-“আর মাংসটা যেভাবে ইচ্ছা রান্না করে নামানোর ২০-৩০ মিনিট আগে দিয়ে রান্না শেষ করতে হবে। শুরুতেই দিলে তিতা হয়ে যাবে। খুবই সেন্সেটিভ জিনিস।”
ওর কথা শুনে কতক্ষণ হাসলো তিতির। বলল,
-“সত্যি, তোমার সাথে ছাড়া আমি কোথাও গেলে শুধু সেখানে যাওয়া হবে আর আসা হবে। সেখানকার কিছুই জানা হবে না, পাওয়া হবে না। সব কিছুই ঝাপসা থাকবে অথচ আমি বুঝবোও না।”
-“আমিও প্রথমে কিছুই জানতাম না তিতির। আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে জেনেছি। যেখানে যাবে সেখানকার রাস্তাঘাট, মানুষজন, পরিবেশ সবকিছু খেয়াল করলে আপনাআপনি সব জেনে যাবে।”
যখন ওরা রিসোর্টে ফিরলো তখন ৯ টা বাজে। রুমে ঢুকে চেঞ্জ করার জন্য কাপড় নিল তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“পড়ে থাকোনা শাড়িটা।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা। এই চলোনা বারান্দায় গিয়ে বসি। বারান্দাটা অনেক সুন্দর।”
-“তুমি যাও, আমি চেঞ্জ করে আসছি।”
বারান্দায় গিয়ে তিতিরের চোখে পড়লো ফ্লোরে মুগ্ধর জামাকাপড় পড়ে আছে। ওগুলো তুলে রুমে ঢুকতেই মুগ্ধ বলল,
-“হায় হায়, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওগুলোর কথা। দাও আমাকে দাও, ধুয়ে দেই তারাতারি, না শুকালে ঝামেলায় পড়ে যাব।”
-“না, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।”
-“আরে আমি ধুতে পারবো তো।”
-“জানি, আমিও ধুতে পারবো। আমি থাকতে তুমি ধোবেই বা কেন?”
-“আরে! মেয়ে বলে কি? তুমি কি আমার কাপড় ধোয়ার জন্য আছো নাকি?”
-“আমার ইচ্ছে, আমি ধোব। সরো তো।”
তিতির জোড় করে কাপড়গুলো ধুয়ে দিল। মুগ্ধ খালি গায়ে সাদা রঙের একটা হাফ প্যান্ট পড়ে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিল। তিতির কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে ঘরে এসে মুগ্ধর কোলের মধ্যে শুয়ে পড়লো। বলল,
-“টিভিটা বন্ধ করোনা।”
মুগ্ধ টিভি বন্ধ করে বলল,
-“তুমি পাশে ছিলে না তাই দেখছিলাম।”
-“ভাল করেছো, এখন তো আমি চলে এসেছি।”
মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“তাই তো দেখছি।”
-“তুমি আবার খালি গায়ে? কিছু একটা পড়ো।”
-“আমি তো বাসায় খালিগায়েই থাকি, অভ্যাস।”
-“এসব দেখে দেখে আমার নজর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
-“সিরিয়াসলি তিতির তোমার কথাবার্তা শুনলে মনে হয় কি ছেলেদের বুকের লোম যেন অতি বিশেষ কিছু। কিন্তু আসলে কিছুই না। অতি সামান্য জিনিসকে তুমি মহিমান্বিত করেছো।”
-“আমার কাছে অতিসামান্য না।”
-“আচ্ছা বুচ্ছি কিন্তু হঠাৎ শুয়ে পড়লে যে? এখনি শোধ করবে নাকি?”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“জানিনা।”
মুগ্ধ বলল,
-“প্লিজ শোধ করে দাওনা।”
-“আমি পারবো না।”
-“তখন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে।”
তিতির লজ্জা পাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“এখনো ব্যাথা করছে ঠোঁট?”
-“হুম।”
-“এসো, বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করে দিই।”
তিতির সরে গিয়ে বলল,
-“ইশ না। অনেক ব্যাথা।”
-“আচ্ছা, আলতো করে।”
এবার আর তিতির সরলো না। তারপর মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে আলতো করেই চুমু খেতে লাগলো।
তার মধ্যেই তিতিরের ফোনটা বেজে উঠলো। বাবা ফোন করেছে, উঠে বসে ফোনটা ধরলো তিতির,
-“হ্যা, বাবা বলো।”
-“কী অবস্থা মা তোর? কেমন আছিস?”
তিতির হেসে বলল,
-“সকালেই তো মাত্র এলাম বাবা, ভাল আছি।”
-“ও হ্যা তাই তো। তুই কোথাও গেলে ঘর অন্ধকার হয়ে থাকে। তা কি করছিস?”
-“প্রজেক্ট ওয়ার্কটা করছিলাম বাবা, এখন একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। একটু পর আবার করবো। যেভাবেই হোক, দুদিনের মধ্যেই কম্পলিট করতে হবে।”
-“হুম, কাল কখন আসবি?”
-“বাবা, আমি কাল নাও আসতে পারি। প্রজেক্ট ওয়ার্ক টা কম্পলিট হলেই আসব। নাহলে আসব না। পরশু আসবো।”
-“সেকী!”
-“রুপাদের বাসাতেই তো আছি বাবা, টেনশান কিসের? নাকি বিশ্বাস হচ্ছে না? আন্টির সাথে কথা বলবে?”
-“না না ছি ছি, আন্টির সাথে কেন কথা বলবো? আর টেনশান না। আসলে তোকে না দেখলে ভাল লাগে না তো। তুই লাগলে থাক কালকেও সমস্যা নেই।”
-“ওকে বাবা। ডিনার করেছো?”
-“নাহ, এখন করবো।”
-“আমিও।”
-“ঠিকাছে মা। আমি তাহলে রাখছি। তান্না ফোন করলে ধরিস না। কাল আসবি না শুনলে আবার কি না কি বলবে তোকে। আমি ওর সাথে কথা বলে নেব।”
-“আচ্ছা বাবা। তুমি যা বলবে।”
ফোন রেখে মন খারাপ করে বসে রইল তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো?”
-“বাবাকে কতগুলো মিথ্যে বললাম!”
-“হুম, তাই দেখলাম আর অবাক হলাম।”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার জন্য আমি সব পারি।”
-“শুধু ফ্যামিলির অমতে আমাকে বিয়েটা করতে পারো না।”
-“এটা করলে আমার বাবা মরে যাবে। বিশ্বাস করো শুধুমাত্র বাবার জন্যই আমি এটা পারি না।”
-“আচ্ছা বাদ দাও, এসব ভেবে মন খারাপ করার কোন মানে হয়না। কিন্তু এটা বলো বাবাকে কেন বললে কাল ফিরবে না।”
-“ও হ্যা, আরেকটা দিন থাকতে ইচ্ছে করছিল খুব, তাই আরেকটা দিনের পারমিশন নিলাম।”
-“আর বললে যে আন্টি মানে রুপার আম্মুর সাথে কথা বলিয়ে দেবে। এটা বললে কোন সাহসে?”
তিতির হেসে বলল,
-“জানি বাবা কথা বলবে না তাই বলেছি। জানি এটা অন্যায়। কিন্তু বাবা যদি ছেলের কথা না শুনে একটা বার সব যাচাই করে দেখতো। জেদ না ধরে থেকে তোমার আমার বিয়েতে রাজী হতো তাহলে তো আজ আমাকে এতবড় মিথ্যেবাদী হতে হতোনা। আর আমাকে নকল মিসেস তিতির মেহবুব হতে হতোনা। আসল মিসেস তিতির মেহবুবই হতাম। তখন আজ যা করছি তা অন্যায় বা খারাপ হতো না।”
মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে টেনে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল,
-“তুমিই একমাত্র আসল মিসেস তিতির মেহবুব। সেদিনই কনফার্ম হয়েছিলে যেদিন আমি লাভ ইউ বলার পর তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা, শোনো।”
-“বলো।”
-“তালগাছে উঠবে?”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“কি? তালগাছে উঠতে যাব কেন? আর আমি গাছে উঠতে পারিও না।”
-“ছোটবেলায় কখনো বাবা তোমাকে পায়ের তলায় ঠেকিয়ে উপর উঠিয়ে দোলায়নি?”
হঠাৎ মনে পড়ে গেল তিতিরের। বলল,
-“হ্যা হ্যা। বাবা এরকম করতো, ভাইয়াও করতো। পায়ের তলাটা আমার পেটের সাথে ঠেকিয়ে আমাকে উঁচু করে ফেলতো। আমি উপুর হয়ে থাকতাম। বাবা বলতো এটা তালগাছ। উফ কি যে মজার ছিল ছোটবেলাটা।”
-“সেটার কথাই বলছি। উঠবে?”
-“তুমি ওঠাবে?”
-“হ্যা।”
-“কিন্তু আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি। বাবা তো নিতো সেই ছোট থাকতে। যখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি।”
-“আমার কাছে তুমি এখনো ছোটই, এসো তো। তোমাকে তালগাছে উঠাই।”
মুগ্ধ তিতিরকে তালগাছে উঠিয়ে হাতে হাত ধরে রাখলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো তিতিরের। ও জানে মুগ্ধর সাথে সারাটা জীবন থাকলে পার্থিব সমস্ত সুখগুলো মুগ্ধ ওর পায়ের কাছে এনে রাখতো যা পৃথিবীর আর কেউ পারবে না। তিতির খিটখিট করে হাসছে। আর মনে মনে হাজার ফোটা চোখের জল জমিয়ে ফেলছে পরে ফেলার জন্য। এখন ফেলা যাবে না। মুগ্ধ কত সখ করে ওকে তালগাছে উঠিয়েছে। কাঁদলে কষ্ট পাবে না?
-“উফ, এবার নামাও। আমি টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি।”
কোনমতে হাসি থামিয়ে তিতির একথা বলল। মুগ্ধ ওকে তালগাছ থেকে নামিয়ে ওভাবেই পা ভাজ করলো। তিতির সেই ভাজ করা পায়ে হেলান দিয়ে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“তালগাছে উঠালে তুমি আর টায়ার্ড হলাম আমি।”
-“স্বাভাবিক, কারন তুমি অতিরিক্ত হেসেছো।”
তিতির বলল,
-“গরম লাগছে।”
-“হ্যা, এসি রুম হলে ভাল হতো কিন্তু শুধু নন-এসিগুলোই খালি ছিল। ইশ, তোমার কষ্ট হচ্ছে না?”
-“আমার বাপের বাড়িতে এসি নেই যে এসি ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”
একথা শুনে মুগ্ধ হাসলো। বলল,
-“গরম কিন্তু কাপলদের জন্য অনেক ভাল।”
-“কিভাবে?”
-“জানোনা?”
-“কোনটার কথা বলছো?”
-“বসন্ত প্রেমের ঋতু, আর গ্রীষ্ম ?”
-“ঘুমের?”
-“নাহ, বসন্ত প্রেমের ঋতু, আর গ্রীষ্ম কামের।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“ধ্যাত।”
-“সিরিয়াসলি, এটা তুমি জানোনা?”
-“শুনেছি, কিন্তু এটা একটা ফালতু কথা।”
-“মোটেও না, এটা সত্যি। দেখোনা গরমের দিনেই মানুষের বাচ্চাকাচ্চা বেশি হয়। আগের বছর গরম থেকে প্রসেসিং শুরু হয়তো।”
তিতির মুগ্ধকে মারতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আমাকে মেরে কি লাভ? সত্যি বলছি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা এত বেশি কেন বোঝোনা? একমাসও তো ঠিককরে শীত পড়ে না। অলমোস্ট সারাবছরই গরম।”
যখন খোঁপা করছিল তখন মুগ্ধ হা করে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ প্রায়ই এভাবে তাকিয়ে থাকে তাই তিতির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি।”
-“কি?”
-“যখন তুমি খোঁপা করতে থাকো আমার তোমাকে দেখতে খুব ভাল লাগে।”
-“এটা কিকরে ভাললাগার মত কিছু হতে পারে?”
-“আমার ভাল লাগে। মনে আছে রেমাক্রিতে তোমাকে যখন মেঘ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন তুমি খোঁপা করতে করতে কটেজ থেকে বেড়িয়ে এসেছিলে?”
-“কি জানি হতে পারে। খেয়াল নেই।”
-“হুম, সেই দৃশ্য দেখে আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লেগেছিল। অন্যরকম সুন্দর লাগে যখন তুমি খোঁপা করতে থাকো।”
-“তুমি না বলেছিলে আমাকে খোলা চুলে ভাল লাগে? আর আমারও তো মনে হয় আমকে খোলা চুলেই ভাল লাগে।”
-“তুমি আমার কথাটা ধরতে পারোনি, খোঁপা করা অবস্থায় ভাল লাগে সেটা বলিনি। চুলগুলো দুহাতে নিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খোঁপা করে হাত নামিয়ে আনা পর্যন্ত এই সময়টা খুব ভাল লাগে।”
-“ওহ। তোমার চোখ আছে বলতে হবে। তোমার মত করে যদি দুনিয়ার সব ছেলেরা তাদের গার্লফ্রেন্ড দের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো তাহলে ঘরে ঘরে এত অশান্তি হত না।”
মুগ্ধ তিতিরের একটা হাত ধরে হাটতা কাছে নিয়ে আসলো। তারপর হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলল,
-“সব মেয়েরা যদি তোমার মত করে তাদের বয়ফ্রেন্ডদের রেসপেক্ট করতো তাহলে ছেলেরাও মুগ্ধ হয়ে তাদের গার্লফ্রেন্ডদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা বাদ দাও, একটা কথা শোনোনা?”
-“কি?”
-“এখানে কি মহুয়া পাওয়া যায়? খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“অসম্ভব। ওই জিনিস আমি তোমাকে আরর জীবনে খেতে দেব না। মাতাল হয়ে যাও তুমি। যাদের কন্ট্রোল নেই তাদের খাওয়ার অধিকারও নেই।”
-“নাহয় একদিন একটু হলাম কন্ট্রোললেস!”
-“নো নো। এই ভুল আমি আর করতে লাগিনি।”
তিতির মুগ্ধর হাত ধরে বলল,
-“প্লিজ প্লিজ, একটুখানি খাব।”
-“না, আর এখানে ওসব পাওয়াও যায়না। আর পাওয়া গেলেও আনতাম না।”
তিতির মন খারাপ করে ফেলল। মুগ্ধ বলল,
-“রাগ করে লাভ নেই। সত্যি এখানে ওসব পাওয়া যায়না। আর গেলেও কোথায় পাওয়া যায় আমি জানিনা।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে। রাগ করিনি তবে ওরকম কিছু হলে ভালই হতো।”
-“হুম। আমার পাগলপ্রায় অবস্থা হতো আর কি!”
-“আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো না?”
-“কি”
অন্য কারো সাথে যখন বিয়ে হবে তখন কি করবে না করবে সে ব্যাপারে যে এত নিষেধাজ্ঞা দিলাম, তুমি আমাকে কোন নিষেধাজ্ঞা দেবে না?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা একটা নিষেধাজ্ঞা আছে।”
-“কি?”
-“তুমি কারো সামনে কখনো লজ্জা পেও না।”
তিতির চোখ নামিয়ে হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“লজ্জা পেলে তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে, লোভ হয়। চাইনা সেই লোভটা আর কারো হোক।”
-“তুমি একটা পাগল।”
-“অবশ্য এটাও ঠিক যে তুমি আমার সামনে যত লজ্জা পাও পৃথিবীর অন্য কোন ছেলের সামনে ততটা পাবে না।”
-“কিভাবে বুঝলে?”
-“মেয়েরা যার সামনে যত বেশি লজ্জা পাবে বুঝতে হবে তাকে তত বেশি ভালবাসে। তুমি আমার থেকে বেশি করে কাউকেই ভালবাসতে পারবে না। জানি সেটা।”
তিতির আর কোন কথা না বলে মুগ্ধর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারলো না ও। কেঁদেই ফেলল। ওর চোখের পানি মুগ্ধর বুকে পড়তেই মুগ্ধ বলল,
-“তিতিরপাখি, কাঁদছ কেন?”
-“আমাদের দুজনের কারো ভালবাসায়ই তো কোন খাঁদ নেই। তো আমরা কেন দুজন দুজনকে পাবো না, বলো? কি ভুল করেছি আমরা?”
মুগ্ধ তিতিরের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-“আমার বাঁ পাঁজরের হাড় দিয়ে বোধহয় আল্লাহ তোমাকে বানায়নি। অথচ আমরা ভালবেসে ফেলেছি। ভুলটা আমাদের এখানেই।”
-“তাহলে তোমার জন্য আমার বুকটা কেন এত পোড়ে?”
-“ভালবাসো যে।”
তিতিরের কান্না থামলো না। বলল,
-“আমি মানি না এসব। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। আর তোমাকেও অন্য কারো হতে দেব না। কেউ তোমাকে বিয়ে করতে আসলে খুন করে ফেলবো আমি তাকে।”
মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। তারপর তিতিরের মুখটা ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কান্না থামাও, আমার কথা শোনো।”
তিতির কান্নাটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। মুগ্ধ বলল,
-“হয়তো জীবনে এরকম সময় আমরা আর পাব না। এভাবে কান্নাকাটি করে এত মধুর সময়কে বিধুর করার কোন মানে হয়?”
তিতির চুপ। মুগ্ধ আবার বলল,
-“শোনো, আমরা যে দুদিন এখানে আছি, কান্নাকাটি তো দূরের কথা। একবার মনও খারাপ করবে না। চলোনা স্বপ্নের মত করে কাটাই এই দুটো দিন।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
ঠিকাছে বলেও তিতির কাঁদতে লাগলো। মুগ্ধ একটু সময় দিল তাই আর কিছু বলল না। ওকে জড়িয়ে ধরে রইলো শুধু।
কাঁদতে কাঁদতে তিতির কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। বাসায় কল করে মায়ের সাথে কথা বলে নিল। কতক্ষণ টিভি দেখলো, নিউজপেপার পড়লো। ঘুমানোর চেষ্টা করলো ঘুমও আসছে না। ঘুম যখন আসছেই না এক কাপ কফি খাওয়া যায়। একটা কফির অর্ডার করে কফিও খেয়ে নিল। সময়ই কাটছে না। আসলে তিতির ঘুমিয়ে আছে বলে ওর মনে হচ্ছে ওর পৃথিবীটাই ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান ছিল তিতিরের জন্য প্রথমে ভেবেছিল আজই সারপ্রাইজটা দিয়ে দেবে। পরে যখন তিতির আগামীকালও থাকার পারমিশন নিল তখন ঠিক করলো কাল দেবে। কিন্তু এখন তো ইচ্ছে করছে ওকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আজই দিতে। নাকি কালই দেবে? দোনোমনা করতে লাগলো। তিতির ঘুমিয়ে থাকলেই তো আরেঞ্জমেণ্টটা সহজ হবে। কাল যদি না ঘুমায়?”
-“তিতির? এই তিতির? ওঠোনা প্লিজ। কতক্ষণ ধরে ডাকছি বলোতো?”
-“উম্মম্মম্ম, আম্মি ঘুম্মাই।”
-“জানি তো, একটু পর আবার ঘুমাবে। আমিও ঘুমাবো। কিন্তু এখন একটু চোখ মেলে তাকাও।”
তিতির ঘুমের ঘোরেই তাকালো। বলল,
-“কি?”
-“কোলে উঠবে?”
-“হুম”
মুগ্ধ এতক্ষণ বিছানার পাশে বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। তিতির তাকিয়ে ছিল মুগ্ধর দিকে। ঘুমে জড়ানো কন্ঠে বলল,
-“তোমার বুকটা এত সুন্দর কেন? দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
মুগ্ধ বলল,
-“হুম, আমারও। এবার উঠেন আপনি।”
-“তোমারও মানে? তুমি কিভাবে তোমার বুক খাবে? তোমার গলা কি এতটা ফোল্ড হয়? তারচেয়ে আমাকে খেতে দিলেই ভাল হতো।”
তিতিরের ঘুমের ঘোর কাটেনি। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা, তো বুকে আসো।”
তিতির লাফিয়ে উঠে মুগ্ধর বুকে ঝপিয়ে পড়লো। মুগ্ধ ওকে কোলে নিতেই ওর খেয়াল হলো ঘরের লাইট বন্ধ। আর সারাঘরে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে। মোহময় পরিবেশ। তিতিরের মুখ দিয়ে অজান্তেই বেড়িয়ে গেল,
-“ওয়াও।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ড্রেসিং টেবিলের উপরেও দুটো মোম জ্বালানো ছিল। মুগ্ধ ওকে কোল থেকে নামিয়ে দু’চোখের উপর চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। তিতিরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারপর মুগ্ধ ওকে আয়নার দিকে মুখ করে দাঁড় করালো। বলল,
-“চোখ খুলবে না।”
তিতির আদুরে কন্ঠে বলল,
-“আচ্ছা।”
হঠাৎ গলায় কিছুর স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো তিতির। মুগ্ধ ওকে একটা নেকলেস পড়িয়ে দিচ্ছে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং হালকা একটা নেকলেস। তারপর মুগ্ধ পেছন থেকে তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হাসি একটা মুখে লাগিয়ে তাকিয়ে রইল আয়নায়। তিতিরের একে তো চোখে ঘুম তার উপর মোমের আলোয় নিজেদেরকে আয়নায় দেখতেও বেশ লাগছিল। আবেগে আর কথা বলতে পারছিল না ও। মুগ্ধ তিতিরের ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে একটা চুমু খেল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ।”
তিতির শুধু মাথাটা মুগ্ধর দিকে ফিরিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ টু।”
তারপর মুগ্ধ পেছন থেকেই তিতিরের গালে হাত রেখে ওর ঠোঁটে চুমু খেতে লাগলো। তিতিরের প্রায়ই যেটা মনে হয় সেটাই মনে হচ্ছিল তখন। ইশ, এখনি যদি ওরা মরে যেত!
সকাল সকাল গাড়ি ছুটে চলেছে গোয়াইনঘাটের পথে। শহর ছেড়েছে অনেকক্ষণ। গোয়াইনঘাট থেকে নৌকায় করে যাবে বিছনাকান্দি। মুগ্ধ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
-“একটা সুপুরুষ ছেলের সাথে কিস করতে করতে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে আমি আগে জানতাম না। তাও আবার দাঁড়ানো অবস্থায়!”
তিতির মন খারাপ করে বলল,
-“আর কত পচাবে?”
-“আজীবন পচাব, আজীবন খোঁটা দিব। কি করে পারলা ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়তে? আর তারপর এত ডাকলাম উঠলেই না।”
-“কখনোই এত ডাকোনি। হয়তো একটা ডাক দিয়েছো, আমি উঠিনি তাই আর ডাকোনি।”
-“আজ্ঞে না ম্যাম, আমি আপনাকে কম হলেও ৪/৫ বার ডেকেছি।”
-“ইশ না।”
-“এখন এই কথা বললে একটা গাড্ডা দিব মাথার মধ্যে।”
-“সরি।”
-“এখন সরি বলে কি হবে? ২ রাত থাকবো তার মধ্যে একটা চলেই গেল।”
-“আমি কি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি বলো?”
-“কি জানি!”
-“মানে কি? তুমি ভাবছো আমি ইচ্ছে করে ঘুমিয়েছি?”
তিতিরের অপরাধবোধ দেখে মুগ্ধর খুব মজা লাগছিল। ওকে আরো তাতানোর জন্য বলল,
-“হতেও পারে।”
-“নাহ, বিশ্বাস করো। কখন ঘুমিয়েছি টেরই পাইনি।”
-“ভাল করেছ।”
-“আমি সত্যি সরি। আমাকে মাফ করে দাও।”
মুগ্ধ অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“এখন এগুলো বলে লাভ নেই। সারারাত আমার একা একা অনেক কষ্ট হয়েছে। ঘুমই আসছিল না। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি।”
তিতির নিজের কান ধরে বলল,
-“এই দেখো কান ধরছি। এবার তো মাফ করো।”
মুগ্ধ ভাব ধরে বলল,
-“ঠিকাছে ঠিকাছে। কান ধরতে হবে না।”
-“আমি আজ রাতে এক মিনিটের জন্য ঘুমাবো না।”
-“এহ, জোকস অফ দ্যা ইয়ার।”
-“সত্যি।”
মুগ্ধ এবার হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-“তোহ, সারারাত জেগে কি করবে?”
তিতির এবার লজ্জা পেল। কিন্তু ওর কথার অর্থ না বোঝার ভান করে বলল,
-“কি আর করবো? যা করি তাই করবো! ওই মানে গল্পগুজব আর কি! আর ঘুমালে তুমি ঘুমানোর পর ঘুমাবো।”
মুগ্ধ এতক্ষণ পর হেসে দিল। তিতিরের বুকের ভার নেমে গেল। বুঝতে পারলো মুগ্ধ আসলে রাগ করেনি দুষ্টুমি করছিল। কিন্তু রাগ করার মতই একটা ঘটনা ঘটেছে। গতরাতে কিস করতে করতেই কি করে যে ঘুমিয়ে পড়লো। ইশ এত সফটলি আদর করছিল মুগ্ধ, আরামেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। দোষ কি তাহলে ওর? তিতির যখন এসব ভাবছিল মুগ্ধ তখন বলল,
-“দেখা যাবে বাসর রাতেও তুমি নাক ডেকে ঘুমাবে। আর আমি বসে বসে মশা মারবো।”
একথায় তিতির চমকে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও খেয়াল হলো, যেখানে ওদের বিয়েই হবে না সেখানে এসব কি নিয়ে ভাবছে মুগ্ধ! দুজনেই চুপ হয়ে গেল। কেউ এই বিষয়ে আর কোন কথা বলল না।
দুপাশে জমি মাঝখানে রাস্তা। জমির কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারনে পানি উঠে গেছে। হঠাৎ গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“কি হলো?”
-“তরমুজ খাব।”
তিতিরের নজরে পড়লো রাস্তা দিয়ে একটা তরমুজের ভ্যান যাচ্ছে। মুগ্ধ নেমে দুটো তরমুজ কিনে আনলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
-“তোমার না তরমুজ প্রিয়?”
-“হুম। তোমারও তো প্রিয়।”
-“সেজন্যই নিলাম।”
-“হ্যা কিন্তু কেটে আনলে না কেন? কাটবো কি করে?”
-“তরমুজ আবার কাটা লাগে নাকি?”
-“তো খাব কি করে?”
-“যখন খাব তখনই দেখো।”
কিছুদূর গিয়ে মুগ্ধ একটা কালভারটের সামনে গাড়ি থামালো। তারপর তিতিরকে বললো,
-“নামো।”
তিতির নামলো। মুগ্ধ একটা তরমুজ নিয়ে নামলো। তারপর কালভারটের পাথুরে ফুটপাতের সাথে বারি দিতেই তরমুজটা ফেটে গেল। আরেকবার বারি দিতেই তরমুজটা ভেঙে কয়েকটা অসমান টুকরা হয়ে গেল। তিতির হেসে দিল।
তিতির পড়ে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার আর শার্ট। মুগ্ধ পড়ে ছিল হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা যখন ভাঙা তরমুজ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিল লোকজন যেতে যেতে হা করে দেখছিল। তিতির বলল,
-“উম্মম্মম্মম্ম, তরমুজটা অন্নেক মিষ্টি।”
-“হুম। কালো তরমুজগুলো মিষ্টিই হয়।”
-“এই, দেখো এরকমভাবে তরমুজ খেয়ে আমার হাতমুখ পুরো মেখে গেছে।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“হাসছো কেন?”
-“এমনি।”
-“এমনি না, এমন দুষ্টুমার্কা হাসি তুমি তখনই দাও যখন তোমার মাথায় কোনো দুষ্টুমি ঘুরতে থাকে।”
মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করেই বলল,
-“আচ্ছ, তারাতারি খেয়ে শেষ করো। রওনা হতে হবে।”
-“বলো না কেন হাসলে?”
-“পরে বলছি বাবা। একটু পরে বলি?”
-“আচ্ছা।”
তরমুজ খাওয়া শেষ হতেই আবার দুজনে গাড়িতে উঠলো। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিল। তিতির বলল,
-“ইশ তরমুজের রস লেগে মুখ, গাল আর হাতগুলো কেমন আঠা আঠা মিষ্টি মিষ্টি হয়ে আছে! তোমারও এমন হয়েছে?”
-“কই না তো। দেখো তুমি।”
-“আসলেই তোমার এরকম হলো না কেন?”
-“আমি কি তোমার মত হালুম হুলুম করে খেয়েছি নাকি?”
-“ইশ, আমি বলে হালুম হুলুম করে খেয়েছি? তুমি এটা বলতে পারলে?”
মুগ্ধ হাসতে লাগলো। তিতির বলল,
-“আচ্ছা যাও আমি হালুম হুলুম করেই খেয়েছি। খুশি? এবার আমার ব্যাগ থেকে একটু পানিটা বের করে দাও। হাতমুখ ধোব।”
গাড়ি থামালো মুগ্ধ। বলল,
-“দেখি কেমন মিষ্টি মিষ্টি হয়েছে?”
একথা বলেই মুগ্ধ আচমকা তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। তারপর বলল,
-“তোমার ঠোঁট এম্নিতেই অনেক মিষ্টি। তরমুজের রস তার কাছে তুচ্ছ।”
তিতির লজ্জা পেয়ে লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
-“এটা করবো ভেবেই তখন হেসেছিলাম।”
তিতির আর কিছু বলল না।
গোয়াইনঘাট থেকে ওরা একটা নৌকা নিল। সাথে জুটে গেল ছোট্ট একটা গাইড। বয়স ১৩/১৪ হবে। নৌকা চলতে শুরু করতেই মুগ্ধ তার সাথে আর মাঝির সাথে গল্প জুড়ে দিল। তিতির খেয়াল করলো নদীর চারপাশটা বড্ড সুন্দর। সবুজ আর সবুজ। নদীর পানিটাও কি সুন্দর। দূরের পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুগ্ধ মাঝিকে বলল,
-“মামা, আগে পান্থুমাই চলো। ওদিকটা ঘুরে বিছনাকান্দি যাবা।”
মাঝি মাথা নাড়লো।
দূর থেকেই প্রথমবার যখন পান্থুমাই ঝরনা দেখতে পেল তিতির দুইহাত নিজের গালে রেখে চিৎকার করে উঠলো,
-“ওয়াও, এটা কি দেখতে পাচ্ছি আমি?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“এটাই পান্থুমাই ঝরনা।”
-“এত সুন্দর কিভাবে? উফফফ।”
নৌকা আরো যত কাছে যেতে লাগলো ঝরনার পানি পড়ার শব্দ আরো কাছে আসতে লাগলো। বিশাল বিশাল সবুজ গাছে ভরা দুই পাহাড়ের মাঝখানে সুন্দরী ললনার মত কোমর বাঁকিয়ে আছে পান্থুমাই। একসময় নৌকাটা থামিয়ে দিল মাঝি। তিতির বলল,
-“মামা, থামালেন কেন এখন? যান না। আমি ওই ঝরনার নিচটায় যাব।”
মাঝি কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,
-“প্রথমত, ওই ঝরনার নিচে গেলে স্রোত নৌকা উলটে দেবে। দ্বিতীয়ত, ওই ঝরনাটা ইন্ডিয়াতে।”
-“মানে কি এত সুন্দর একটা ঝরনা কিনা ইন্ডিয়াতে? অথচ এত কাছে! ধ্যাত শুধু দেখতেই পারলাম। ছুতে পারলাম না।”
-“হুম, যদিও ঝরনাটা আমাদের দেশে না কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা তাও ঝরনাটা দেখতে পারি। অথচ ওটা ইন্ডিয়াতে হওয়া স্বত্তেও ইন্ডিয়ানরা দেখতে পারে না। দেখতে হলে ওদের ভিসা নিয়ে এপাড়ে আসতে হবে। নাহলে ওই ব্রিজটা দিয়ে কোথাও যেতে হবে।”
তিতির ব্রিজটা দেখলো। একদম ঝরনার সামনে দিয়ে একটা ব্রিজ এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলে গেছে। তারপর বলল।
-“ওদের ঝরনা ওরা কেন দেখতে পারবে না?”
-“কারন ঝরনাটা একদম সীমান্তে, এবং পুরোটাই আমাদের দেশে মুখ করা।”
-“ইয়েস! একদম ঠিক হয়েছে।”
এতক্ষণে ঝরনার কাছে যেতে না পারার আফসোস কাটলো তিতিরের।
মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে চলল বিছনাকান্দির পথে। নদীটি মোটেও গভীর না। কাছাকাছি যেতেই নৌকা এক যায়গায় আটকে গেল। যায়গাটা বোধহয় একটু উঁচু। গাইড রাজু আর মুগ্ধ নামলো নৌকায় ধাক্কা দিয়ে যায়গাটা পার করার জন্য। নামতেই দেখলো ওখানে হাটু সমান পানি। তিতির মুগ্ধকে বলল,
-“আমিও নামবো।”
মুগ্ধ বলল,
-“নামবে? নামো।”
তিতিরও নেমে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই পানি ছিটকে এসে খানিকটা ভিজিয়ে দিল ওদেরকে। তিতিরের খুব আনন্দ হলো। হাসতে লাগলো, ওকে এভাবে হাসতে দেখে মুগ্ধরও ভাল লাগলো। নৌকা যখন আবার একা একা চলতে শুরু করলো মুগ্ধ বলল,
-“এবার ওঠো তিতির।”
-“না আমি উঠবো না। নৌকা ধরে ধরে পানির মধ্যে হাটবো।”
মাঝি বলল,
-“আপু সামনে তো অনেক পানি। হাটতে পারবেন না ওখানে।”
মুগ্ধ কথা না বাড়িয়ে তিতিরকে কোলে উঠিয়ে নৌকায় তুলে দিল। তারপর নিজেও উঠলো। তিতির রাগী রাগী মুখ করে মুগ্ধর দিকে তাকালো। মুগ্ধ হাসি হাসি মুখ করে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়লো। তবে সেলিব্রেটিদের মত হাত দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে নয় শুধুই ঠোঁটের ইশারায়। তারপর তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিল।
এই যায়গাটায় নদী থেকে পাথর উঠানো হয়। পাথর উঠিয়ে নদীর পারে একের পর এক রেখে রেখে পাথরের পিরামিড বানিয়ে ফেলেছে কতগুলো।
তিতির সেই পাথরের পিরামিড গুলোই দেখছিল। আর দেখছিল বিছনাকান্দির পাহাড়। না পৌঁছালেও পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দুপাশে পাহাড়, মাঝখানে ফাঁকা। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো দুপাশের পাহাড় একদম সমান উচ্চতার। আল্লাহ বুঝি গজফিতা দিয়ে মেপে মেপে বানিয়েছেন। তিতির ভেবেছিল দূর থেকে পাহাড়গুলোকে নীল মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছে পাহড়গুলো আসলেই নীল রঙের। পাহাড়ের নীচের দিকটা গাঢ় নীল, উপরটা হালকা নীল। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, এদিকে তাকাও.. পানিটা দেখো।”
তিতির তাকাতেই দেখতে পেল পানিটা স্পষ্ট দুই রঙের। একপাশে নদীর পানি যেমন হয় হালকা সবুজ ভাব, আরেকপাশে স্বচ্ছ নীল পানি। পানির নিচের বালু, ছোট ছোট মাছ, শৈবাল সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিতির এক্সাইটমেন্টে মুগ্ধর হাত চেপে ধরে বলল,
-“এটা কি করে সম্ভব?”
-“সবই আল্লাহর সৃষ্টি।”
-“উফফ এত সুন্দর পানি।”
তিতির নীলপানি গুলো হাতে করে উঠালো। হাতের মধ্যেও পানিগুলো নীলই দেখালো। তিতির মুগ্ধকে বলল,
-“দেখো, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আকাশের রিফ্লেকশান বুঝি। কিন্তু পানিগুলো আসলেই নীল।”
-“নীলই তো। এখানে সবই নীল। এখনি বুঝবে না। পৌঁছে নিই তখন বুঝতে পারবে।”
বিছনাকান্দি পৌঁছেই তিতিরের চোখে নীলের নেশা ধরে গেল। আকাশ নীল, পাহাড় নীল, পানি নীল। নীলের যে কতরকম শেড হতে পারে তা বিছনাকান্দি এলেই দেখা যাবে। ওরা নৌকা থেকে যেখানে নেমেছে তার একটু সামনে থেকেই পাথর শুরু। ছোট বড় অসংখ্য পাথর। সামনেই ভারতীয় সীমান্ত, ওপাশে শিলং। শিলং থেকে বয়ে আসা নদীটিই সেই নীল পানির উৎস। অজস্র পাথরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটি। এখানে নদীতে হাটুসমান পানি। তার নিচে পাথর। যেখানে ওরা নৌকা থেকে নেমেছে সেখানে গিয়ে নদী গভীর হয়েছে। নীল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল তিতির! নিজের অবচেতন মনেই একটার পর একটা পাথর লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে নেমে যাচ্ছিল পানিতে। মুগ্ধ মাঝির ফোন নাম্বার নিচ্ছিল যাওয়ার সময় যোগাযোগ করার জন্য। নাম্বার নিয়ে তাকাতেই দেখে তিতির অনকদূর নেমে গেছে। মুগ্ধ দৌড়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে গিয়ে গিয়ে ভেজা পিচ্ছিল পাথরে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলল। রেগে গিয়ে বলল,
-“তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি তো আল্লাহর রহমতে কম না, তাহলে মাঝে মাঝে এমন গাধামি কেন করো?”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“আমি কি করলাম?”
-“আমি ফোন নাম্বারটা নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না? একা একা নামছিলে কেন? সাহস ভাল কিন্তু এত সাহস তো ভাল না।”
-“ইশ, সরি। তুমি যে আসছিলে না খেয়ালই করিনি। আমি তো ভেবেছি তুমি সাথেই আছো।”
-“খেয়াল করবেনা কেন?”
-“আরে এত সৌন্দর্য দেখে আমার তো মাথাই ঠিক নেই, পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাগ করোনা প্লিজ।”
-“ড্যাম ইওর রাগ। জানো পাথরগুলো কতটা পিচ্ছিল? পিছলে পড়ে গেলে শুধু ব্যাথাই পাবে তা না স্রোতের সাথে ভেসে হারিয়ে যাবে নদীর মধ্যে।”
-“আমি তো সাঁতার জানি।”
-“হেহ! সাঁতার জানে। স্রোতের ভয়াবহতার ব্যাপারে কোন আইডিয়া আছে?”
তিতির প্রায় কান্না করে দিচ্ছিল। চোখে পানি ছিল না কিন্তু গলাটা কেঁপে উঠলো যখন বলল,
-“সরি আর এরকম করবো না।”
মুগ্ধর বুকটাও সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। বলল,
-“আরে আরে কাঁদছ নাকি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই একটু কড়া কথা বলে ফেলেছি।”
তিতির সামলে নিল। বলল,
-“না, ঠিকাছে।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তারপর পানির মধ্যে নামতে নামতে বলল,
-“বকেছি তো পরে বেশি আদর করে পুষিয়ে দেব। মন খারাপ করোনা প্লিজ। তুমি যদি পা পিছলে পড়ে যেতে? ব্যাথা পেতে না বলো? পাথরের সাথে ঘষা খেয়ে তোমার এই সুন্দর সুন্দর পা গুলো ছিলে যেত না?”
-“তুমি আমার পা দেখেছো কিভাবে?”
-“কেন তুমি যখন যখন থ্রি-কোয়ার্টার পড়েছো তখন তখনই তো দেখেছি।”
-“যখন যখন বলতে? আমি তো ট্যুরে যাওয়া ছাড়া পড়িনা।”
-“ওইতো, নাফাখুম ট্রিপে দেখেছি। আজ দেখেছি।”
-“মানে কি? এখন নাহয় বুঝলাম দেখেছো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড, তাকাতেই পারো! কিন্তু নাফাখুম ট্রিপে তো আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না, তখন কেন দেখেছো?”
মুগ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-“না মানে, এত সুন্দর জিনিস দেখে কি চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় বলো? তাছাড়া আমি ততদিনে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। আকর্ষণ টা একটু বেশিই ছিল। তোমার সবকিছুতে নজর দিতাম।”
তিতির চোখ বড় বড় করে বলল,
-“সবকিছু বলতে?”
ততক্ষণে ওরা পানিতে নেমে গিয়েছে। তিতিরকে পানির নিচে পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,
-“না না, নেগেটিভলি নিও না। মানে আমি তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। একদিন তোমার পেটও দেখে ফেলেছিলাম।”
তিতিরের চোখগুলো এবার বেড়িয়ে আসতে চাইলো। বলল,
-“নাফাখুম ট্রিপে?”
-“হুম।”
-“কিভাবে?”
-“ওইযে যেদিন আমরা রেমাক্রি পৌঁছেছিলাম তুমি গোসল করে বাইরে এসে কাপড় মেলে দিচ্ছিলে তখন তোমার টপসটা উঠে গিয়ে পেট বের হয়ে গিয়েছিল।”
-“তার মানে তো এক্সিডেন্টলি বের হয়ে গেছিল। আর তুমি কিনা হা করে দেখছিলে?”
-“না বাবা, আমি একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।”
-“কে জানে!”
-“কিন্তু তারপর অনেকদিন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠতো সেই দৃশ্য, উফফফ!”
তিতির ওর বুকে একটা কিল দিয়ে বলল,
-“যাহ, অসভ্য একটা।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা শোনো না, যখন তোমাকে কোলে তুলে হাটছিলাম তখন আশেপাশের মানুষগুলো তাকিয়ে ছিল।”
-“হুম, খেয়াল করেছি আমি। দেখুক গিয়ে।”
-“তুমি খুব এনজয় করো না? মানুষ যখন হা করে দেখে আমাদের?”
-“করি তো। খুব প্রাউড ফিল করি আমি।”
মুগ্ধ হাসলো।
কথা বলতে বলতেই মুগ্ধ পানিতে শুয়ে পড়লো। কিন্তু একটা হাত দিয়ে তিতিরকে ধরে রেখেছিল। তিতির বলল,
-“এই এত স্রোতের মধ্যে তুমি শুয়ে পড়লে যে? আমার ভয় লাগছে।”
মুগ্ধর পুরো শরীর পানির নিচে। মাথাটা পানি থেকে উঠিয়ে বলল,
-“কিছু হবে না, প্রটেকশন আছে। ওই দেখো পা একটা পাথরে আটকে রেখেছি।”
-“প্লিজ ওঠো তুমি। আমার ভয় করছে কারন, আমার বসে থাকতেই প্রব্লেম হচ্ছে। তুমি ধরে না রাখলে স্রোতের তোরে কবেই ভেসে যেতাম।”
-“তুমি আমাকে নিয়ে নাফাখুমের মত ভয়ঙ্কর যায়গায়ও ভয় পাওনি আর এখানে ভয় পাচ্ছো?”
-“ওখানে তো সেফটি বেল্ট ছিল।”
-“এখানেও পা ঠেকানো ওই পাথরটা সেফটি।”
-“উফ তিতির তুমি না!”
উঠে বসলো মুগ্ধ। তারপর বলল,
-“আমি তোমাকে ধরে রেখেছি, তুমি একটু শোও।”
-“এত মানুষের মধ্যে আমি শোবো?”
-“এত মানুষ কোথায় পেলে? বিছনাকান্দিতে অনেক মানুষ হয়। এখন তো মানুষ নেই বললেই চলে।”
-“তবু, যেকয়জন আছে তারা আমার অপরিচিত।”
-“বাপরে, বিছনাকান্দির বিছনায় না শুয়ে গেলে অনেক বড় কিছু মিস করবে। কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে নেই বাবা। একা থাকলে হয়তো তাকাতো, কিন্তু এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আছে সাথে। ওরা তো বুঝে তাকালে চোখ গেলে দেব।”
তিতির একটা হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লো পানির মধ্যে। মুগ্ধ হাত ধরে থেকে বলল,
-“পুরো শরীর পানির নিচে ডুবিয়ে দাও। শুধু মাথাটা পাথরটার উপরে রাখো তাহলে কানে পানি যাবেনা।”
তিতির তাই করলো। মুগ্ধ বলল,
-“আরে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? চোখ বন্ধ করে রাখো।”
তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ আবার বলল,
-“হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দাও পাখির মত তাতে পানির মধ্যে শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারবে।”
তিতির তাই করলো। তারপর মুগ্ধ ওকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিতেই তিতির তাকিয়ে বলল,
-“আমি পারবো ব্যালেন্স রাখতে কিন্তু তুমি ধরে থাকো ভাল লাগে।”
-“না তিতির। কিছু কিছু জিনিস ফিল করতে একা হওয়া প্রয়োজন। এখানে কোন মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে ফিল করা যায় এমন কিছু ফিল করাতাম তোমাকে। যেহেতু মানুষজন আছে তাই একটা কথাও না বলে যেভাবে বললাম ওভাবেই থাকো কিছুক্ষণ। আমি পাশেই আছি।”
তিতির আর কথা বলল না। মুগ্ধ যেভাবে বলল সেভাবেই শুয়ে রইলো। কোনো অজানা পাহাড়ের অজানা ঝরনার গা বেয়ে নেমে আসা হিমশীতল পানি তিতিরের সারা অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এভাবে ছোঁয়ার জন্য আবার শাস্তি দেবে না তো মুগ্ধ? একথা ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠলো তিতির। আস্তে আস্তে টের পেল নদীর কলকল ধ্ধনিতে মুখরিত চারপাশ। শব্দটা যেন ওর বুকের ভেতর হচ্ছে, আসলে তা তো না। কিন্তু শব্দটা পানির মধ্যে আর স্রোতের পানিগুলো কানের এত কাছে যে অন্য কোনো শব্দ আর কানে আসছে না। শব্দটা আস্তে আস্তে কেমন যেন করুন শোনালো। কিন্তু এত অসাধারণ যে কোনো ওস্তাদের বাজানো সানতুর, সেতার বা সারদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হলো না। কখন যে তিতিরের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে মিশে গেল সে পিয়াইন নদীর নীল জলে তা কেউ জানলো না।
একসময় মুগ্ধ বলল,
-“এবার চোখ দুটো খুলে আকাশের দিকে তাকাও।”
তিতির তাকাতেই অন্যরকম এক অনুভূতি রইলো। একটু আগের সব অনুভূতি তো রইলোউ সাথে আরো যোগ হলো খোলা নীল আকাশের সৌন্দর্য। এবার মনে হতে লাগলো ও এমন কোনো অচেনা জগতে আছে যেখানে একই সাথে পাখির মত আকাশে ওড়া যায় আবার জলকন্যার মত পানিতে সাঁতারও কাটা যায়।
কয়েক ঘন্টা পানিতে থাকার পর যখন ওরা পানি থেকে উঠলো হঠাৎই বৃষ্টি নামলো, ব্যাপক বৃষ্টি। তিতির চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছিল। কিন্তু মুগ্ধর প্রচন্ড ক্ষুদা লেগেছে। দুপুর পেড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে, সেই সকালে খেয়ে বেড়িয়েছে। পথে আসতে আসতে হাবিজাবি খেয়েছে,
-“তিতির, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে একটা জিনিস।”
তিতির চোখ খুলে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কি?”
-“ভাত খেয়ে পানিতে নামা উচিৎ ছিল। স্রোত ছিল যে অনেক, স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে পানিতে থাকায় এনার্জি শেষ।”
-“আহারে! তো খেয়েই নামতে।”
-“খেয়াল ছিল না, তাছাড়া তখন তো আর ক্ষিদেও ছিল না।”
-“ও।”
-“তোমার ক্ষিদে পায়নি?”
-“বুঝতে পারছি না। আসলে আমি এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছি না।”
-“স্বাভাবিক, প্রথমবার এমনই হয়। কিন্তু আমার তো ভাত খাওয়ার জন্য জানটা বের হয়ে যাচ্ছে।”
-“ইশ।”
ততক্ষণে মাঝি আর রাজু ওদের দেখতে পেয়ে চলে এসেছে। তিতির ওদের জিজ্ঞেস করলো,
-“ওই দোকানটাতে ভাত পাওয়া যায়?”
রাজু বলল,
-“না আফু, চিপস, কেক, বিস্কুট আছে।”
মুগ্ধ বলল
-“ভাত হাদারপাড় ছাড়া পাওয়া যাবে না না?”
-“না।”
তিতির বললো,
-“হাদারপাড় গিয়ে খাই তাহলে।”
মুগ্ধ বলল,
-“আমার লাশ যাবে তাহলে। কারন, ওইটা অনেক দূর।”
-“ধুর, তোমার যত আজেবাজে কথা।”
তিতির দোকানে চলে গেল।”
মুগ্ধ বলল,
-“আরে আরে, কোথায় যাও?”
-“তোমার লাশ হওয়া ফেরাতে।”
দোকানে গিয়ে বলল,
-“ভাই, এখানে ভাত পাওয়া যাবে?”
দোকানদার বলল,
-“না।”
-“চাল পাওয়া যাবে?”
মুগ্ধ ততক্ষণে দোকানের সামনে চলে এল। বলল,
-“আরে পাগল এটা কি চালের দোকান?”
দোকানদার বলল,
-“এইখানে চাল নাই।”
তিতির বলল,
-“প্লিজ কিছু চাল বিক্রি করুন, যেভাবেই হোক। আমার স্বামী ক্ষুধার জালায় মারা যাচ্ছে।”
তিতিরের কথায় মাঝি আর রাজু হেসে দিল। মুগ্ধ আর দোকানদার হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,
-“প্লিজ ভাত নাহলে চাল কিছু একটার ব্যবস্থা করুন।”
দোকানদার কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বলল,
-“এই আমার ক্ষিদে নেই, চলো। অযথা বিরক্ত করছো ওনাকে, থাকলে তো দিতোই।”
মুগ্ধ জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল তিতিরকে। পেছন থেকে দোকানদার ডাকলো,
-“ও ভাই দাঁড়ান।”
ওরা দাঁড়ালো। দোকানদার বলল,
-“আমার বউ খুদের ভাত পাডাইছিল। আমি আর আমার ভাই খাওয়ার পরও আছে। খাইবেন?”
তিতিরের মুখে বিশ্ব জয় করার হাসি ফুটে উঠলো। মুগ্ধ কিছু বলার আগেই লাফিয়ে পড়ে বলল,
-“হ্যা খাবে, খুদের ভাত তো ওর খুব প্রিয়।”
মুগ্ধর মনে পড়ছে না খুদের ভাত কবে ওর প্রিয় ছিল।
দোকানদার উঁচু উঁচু করে বেড়ে একপ্লেট খুদের ভাত দিতেই তিতির মুগ্ধর হাতে দিয়ে বলল,
-“এই নাও খাও।”
আরেকপ্লেট যখন দিতে নিল, তিতির বলল,
-“না না আর লাগবে না। আমি খাব না। ওর জন্যই চাইছিলাম।”
মুগ্ধ এখনো খাওয়া শুরু করছেনা দেখে দোকানের দাওয়ায় বসে তিতির হাত ধুয়ে নিজেই খাইয়ে দিল। মুখে দিয়ে মুগ্ধর মনে হলো অমৃত খাচ্ছে। শুধু ক্ষুদার জন্য না। রান্নাটাও ছিল চমৎকার। বোম্বাই মরিচ দিয়ে রান্না করেছে বোধয়। ঘ্রাণেই অর্ধেক পেট ভরে গেল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা শরীরে বিয়ে না করা বউ কিংবা বউয়ের থেকেও বেশি এমন মানুষটার হাতে তারই ভালবাসা দিয়ে জোগাড় করা খাবার খেতে খেতে মুগ্ধর বুকের ভেতর আবেগের তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মেয়ে হলে হয়তো এতক্ষণে কেঁদেই ফেলতো। নাইবা পেল ওকে সারাজীবনের সহধর্মিণী হিসেবে, যা পেয়েছে ওর কাছ থেকে এমনকি এখনো পাচ্ছে তা অনেকে ভালবেসে সার্থক হয়ে বিয়ে করা বউয়ের কাছ থেকেও এর একশোভাগের এক ভাগ পায়না। মুগ্ধ বলল,
-“শুধু আমাকে দিচ্ছো কেন? এতটা কি আমি একা খেতে পারবো?”
-“হ্যা পারবে।”
-“না পারবো না, তুমিও খাও। আর এটা অনেক টেস্টি। না খেলে মিস করবে।”
-“উফ তুমি খাও তো।”
-“তুমি না খেলে আমিও খাব না।
অগত্যা তিতিরও খেল মুগ্ধর সাথে। খাওয়া শেষ হতেই তিতির দোকানদারকে বলল,
-“ভাই আপনার নাম কি?”
-“সুরুজ আলী।”
-“সুরুজ ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার এই ঋণ কোনদিনও শোধ করতে পারবো না। আপনি জানেন না আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন।”
সুরুজ আলী কোন অজানা কারনে লজ্জা পেল। বলল,
-“না না আপা কি যে বলেন।”
মুগ্ধ বলল,
-“সুরুজ ভাই, আমি জানি আপনি এটা বিক্রি করেন না। আপনার স্ত্রী যত্ন করে আপনার জন্য রান্না করে পাঠিয়েছে। তবু আমরা ক্ষুদার সময় খেয়েছি। আপনি যদি দামটা রাখেন আমি খুব খুশি হব।”
সুরুজ আলী বলল,
-“না না, ভাইজান আমি টাকা রাখতে পারমু না। এটা তো আমার ব্যবসার জিনিস না। আর বাড়তিই ছিল।”
-“তবু ভাই, রাখেন। আর লজ্জা দিয়েন না। এমনিতেই আমার বউ অনেক লজ্জায় ফেলেছে।”
সুরুজ আলী টাকা রাখতে চাচ্ছিল না। মুগ্ধ জোর করে তার হাতের মুঠোও টাকা গুঁজে দিল। তিতির বলল,
-“সুরুজ ভাই, আজ থেকে আপনি আমার ভাই। আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আপনার বাড়িতে বেড়াতে আসব। ভাবীকে বলবেন এরকম খুদের ভাত রান্না করতে। এটা পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু খাবার।”
সুরুজ আলী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। লোকটি বোধহয় খুব আবেগী। কারন, তিতিরের কথায় তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বলল,
-“অবশ্যই আসবেন আপা।”
নৌকার কাছে যেতে যেতে তিতির বলল,
-“আমি তোমাকে লজ্জায় ফেলেছি না?”
মুগ্ধ একহাতে ওকে বুকে ধরে হাটতে হাটতে বলল,
-“এত ভালবাসিস কেন রে পাগলী?”
তিতির আহ্লাদে আটখান হয়ে গেল। মুগ্ধ আবার বলল,
-“আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবে, না?”
-“যেটা বাস্তবে কখনো হবার নয় সেটা যদি কল্পনাতে ভেবে সুখ পাওয়া যায় তাতে দোষের কি?”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিল। তিতির চোখ বন্ধ করে তা সাদরে গ্রহন করলো। তারপর বলল,
-“আচ্ছা, তখন যে বলেছিলে মানুষজন না থাকলে দুজনে মিলে উপভোগ করা যায় এমন কিছু করতে। সেটা কি?”
-“তোমাকে একবার আমার বুকে, আরেকবার পিঠে নিয়ে সাঁতার কাটতাম।”
-“সিরিয়াসলি?”
-“হ্যা।”
-“পারবে তুমি?”
-“কেন পারবো না? তোমার ওজন কত ৫০?”
-“না, ৪৮।”
-“আর আমার ৮০, ভরসা হয়না? তাছাড়া পিউকে পিঠে নিয়ে সাঁতরাতে পারলে তোমাকে নিতে পারবো না? তোমরা তো অলমোস্ট সেম। ওর ওজন হয়তো তোমার থেকে সামান্য বেশি।”
-“তাহলে প্লিজ চলো… এখন তো মানুষজন একদম নেই বললেই চলে।”
মুগ্ধ হাসতে লাগলো।
বৃষ্টি, ব্যাপক বৃষ্টি! ঝুমবৃষ্টি… নদীর নীল পানিতে বৃষ্টির ইয়া বড় বড় ফোঁটা পড়ছে, আর শামুকের শেপ তৈরি হচ্ছে পানিতে। তার মধ্যে উলটা সাঁতার দিচ্ছে মুগ্ধ। মুগ্ধর বুকের উপর ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে তিতির। যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিল মুগ্ধ ততটা হচ্ছে না। কারন, তিতিরও পা দিয়ে সাঁতরাচ্ছে মুগ্ধর বুকের উপর শুয়ে। দুজনই একসাথে পা দিয়ে পানিগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে সাঁতার কাটছে আর পাগলের মত হাসছে। হাসির শব্দ ফাঁকা যায়গায় বার বার বাজছে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন মিলিয়ে যাচ্ছে তখন বড্ড করুণ শোনাচ্ছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসেনা ওদের। ওরা আজ ভাসছে। আজ ওরা মানুষ নয়। ওরা জলমানব আর জলমানবী।
গোয়াইনঘাটে নৌকার ঘাট থেকে কিছুটা আগে গাড়ি রেখেছিল মুগ্ধ। সাঁতরে সাঁতরে শরীর ক্লান্ত দুজনেরই। যা খেয়েছিল তা সব শেষ। এটুকু হেটে গাড়ির কাছে আসতেও খুব কষ্ট হলো। এসে মুগ্ধ বলল,
-“তুমি গাড়িতে ঢুকে চেঞ্জ করে নাও। তোমার হয়ে গেলে আমি ঢুকবো।”
-“এখানে আমি চেঞ্জ করবো?”
-“হ্যা কে আছে দেখবার জন্য? আশেপাশে তো কেউ নেই।”
-“তা ঠিক, তবুও।”
-“আরে মানুষ গাড়িতে সেক্স করতে পারলে তুমি চেঞ্জ করতে পারবে না?”
-“ছিঃ তুমি অলওয়েজ নোংরা কথা বলতে পছন্দ কেন করো?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমি একটা নোংরা লোক যে তাই।”
তিতির গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“নিচু হয়ে চেঞ্জ করে নাও। চিন্তা করোনা কেউ আসতে নিলে আমি তোমাকে বলবো। আর আমিও তাকাবোনা।”
তিতির চেঞ্জ করে সামনে চলে গেল। তারপর মুগ্ধ ঢুকে চেঞ্জ করে গাড়ি স্টার্ট দিল। তখনও বাইরে তুমুল বৃষ্টি।
হাদারপাড় পৌঁছতেই মুগ্ধ বলল,
-“তিতির চলো ভাত খেয়ে নিই, এখানে ভাতের হোটেল আছে।”
-“এখন আবার নামতে ইচ্ছে করছে না। একেবারে রিসোর্টে গিয়ে খাই।”
-“ক্ষিদে পেয়েছে খুব।”
-“ও, আচ্ছা চলো তাহলে।
কয়েক কদম হেটেই ওরা একটা হোটেলে ঢুকলো। খেতে খেতে তিতির বলল,
-“এই ভাতগুলো এমন কেন?”
-“আতপ চালের ভাত যে!”
-“আমরা কোন চালের ভাত খাই তাহলে?”
-“সিদ্ধ চালের।”
-“ও। ধুর এগুলো আমার গলায় আটকাচ্ছে।”
-“আহারে আমার তিতিরপাখিটা রে। এইবেলাটা একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও। রাতে রিসোর্টে খাব।”
-“অন্য কোনো হোটেলে খেতাম।”
-“লাভ নেই পুরো সিলেটে আতপ চালের ভাত হয়। রিসোর্টে আছি বলে যা চাচ্ছি তাই পাচ্ছি। ইভেন সিদ্ধ চালের ভাতও।”
-“ও।”
মুগ্ধ গপাগপ পেটপুরে খেয়ে নিল। কিন্তু তিতির কোনরকমে অর্ধেকটা ভাত খেল। তারপর বাইরে আসতেই দেখলো সন্ধ্যা নেমে গেছে। মুগ্ধ বলল,
-“এখানে মেলা হচ্ছে দেখলাম, যাবে?”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“এই বৃষ্টিতে মেলা হচ্ছে?”
-“সিলেটে তো ডেইলিই বৃষ্টি হয়। তার জন্য কিছু থেমে থাকে না। আর স্টল আছে তাই কোন প্রব্লেমও নেই। ঢাকার বাইরের মেলাগুলো কিন্তু অনেক উপভোগ্য হয়।”
-“ও, আচ্ছা চলো যাই ঘুরে আসি।”
-“চলো। ভিজে যাব কিন্তু যেতে যেতে।”
-“ভিজলে ভিজবো। একেবারে রিসোর্টে গিয়ে চেঞ্জ করে নেব।”
-“আচ্ছা, চলো তাহলে।”
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তিতির বুঝলো মুগ্ধর কথা ঠিক, ঢাকা শহরের মেলার থেকে এখানকার মেলা বেশি সুন্দর। খুব ভাল লাগলো ওর। একটা দোকানে ঘুরতে ঘুরতেই মুগ্ধ ডাক দিয়ে বলল,
-“এই এদিকে এসো।”
তিতির মুগ্ধর কাছে গিয়ে বলল,
-“কি?”
মুগ্ধ ওকে একটা লাল মনিপুরী শাড়ি দেখিয়ে বলল,
-“দেখো, শাড়িটা সুন্দর না?”
-“হ্যা সুন্দর।”
-“তোমার জন্য নিই।”
-“এই না। এমনিতেই যেটা কাল কিনেছো ওটা বাসায় নিতে পারবো না। আরেকটা নিয়ে কি হবে?”
-“আজকে রাতে পড়বে। আমি হা করে দেখবো। দেখোনা শাড়িটা কত্ত সুন্দর লাল। তোমাকে খুব ভাল দেখাবে এটাতে।”
-“লাল শাড়িতে তো কত্ত দেখেছো! আচ্ছা কালকের শাড়িটাও তো অর্ধেকটা লাল। রিসোর্টে গিয়ে ওই শাড়িটা পড়বোনে তখন দেখো। এটা কিনে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করোনা।”
-“টাকা নষ্ট বলছো কেন? এসব শাড়ির দাম বেশি না। তাছাড়া, আমি দেখবো। সেটার কি দাম নেই? এজন্যই আমি কোনকিছু কেনার আগে বলিনা। বলে কিনতে গেলেই তুমি এরকম উল্টাপাল্টা কথা বলে মুড নষ্ট করে দাও। এরকম করলে তোমার সংসার ভেসে যাবে কিন্তু।”
-“আচ্ছা আচ্ছা, সরি খুব ভুল হয়েছে আমার। যাও কেনো।”
মুগ্ধ শাড়িটা কিনে নিল। তারপর বলল,
-“তিতির, আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। ৫ মিনিটে আসছি, তুমি এই দোকানটাতেই দাঁড়াও। অন্য কোথাও যেও না। ফোন কিন্তু গাড়িতে। পরে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাবনা।”
-“তুমি চিন্তা করোনা, আমি এখানেই থাকবো।”
তিতির শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ চোখে পড়লো পাশেই একটা লোক কিছু একটা বিক্রি করছে। মানুষ খুব খাচ্ছে। তিতির লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“মামা, এগুলো কি?”
লোকটা উত্তর দিল,
-“ভাং এর শরবত।”
তিতিরের মনের ভেতরটা নেচে উঠলো.. ভাং এর শরবত! শুধু শুনেই এসেছে, জীবনে খায়নি। এখন দেখেই খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুগ্ধ এলে কিছুতেই খেতে দেবে না। বলবে, ‘নেশা হয়ে যাবে।’ আরে বাবা হোক না, একটু আধটু নেশা হলে কি হয়!
সাতপাঁচ ভেবে মুগ্ধ আসার আগেই এক গ্লাস খেয়ে ফেলল তিতির। পরে আরেক গ্লাস দিতেই মুগ্ধ চলে এল। ওকে দেখতে পেয়ে বলল,
-“তিতির, কি খাচ্ছো এগুলো?”
-“ও তুমি চলে এসেছো? অনেক মজার জিনিস, খাওনা।”
একথা বলেই গ্লাস টা মুগ্ধর দিকে ধরলো।
-“আগে বলবে তো কি এটা?”
-“সারপ্রাইজ! খাও না।”
মুগ্ধ খেয়ে বলল,
-“এটা তো ভাং, তুমি এটার আগেও খেয়েছো?”
-“এক গ্লাস মাত্র।”
-“সর্বনাশ করেছো।”
তারপর ভাং এর দাম মিটিয়ে তিতিরকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গাড়িতে উঠেই তিতির বলল,
-“এই তুমি রাগ করেছো?”
মুগ্ধ ঝারি দিয়ে বলল,
-“নাহ, আনন্দে নাচছি।”
-“এত রাগ কেন করছো? ভাং তো অনেক মজা।”
-“কিছুক্ষণের মধ্যেই নেশা হয়ে যাবে, তখনকার পাগলামিগুলো কে সামলাবে?”
তিতির দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
-“কেন তুমি।”
-“একটা কথাও বলবেনা আমার সাথে।”
মুগ্ধ এমন ব্যবহারে তিতিরও রাগ করলো। কি এমন করেছে ও! এক গ্লাস ভাং ই তো খেয়েছে। তার জন্য এমন ব্যবহার? তিতির সত্যিই আর একটা কথাও বলল না।
রিসোর্টে ফিরে তিতিরের দিকে তাকাতেই মুগ্ধ দেখতে পেল তিতির ঘুমাচ্ছে। ওর গায়ের কাপড় খানিকটা শুকিয়ে গেছে। ওর নিজের গায়ের কাপড়েরও পানি ঝরে গেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা? ইশ এভাবে বকাটা উচিৎ হয়নি। কিন্তু মাঝেমাঝে এমন বোকামি করে মেয়েটা!
পাড়ি পার্ক করে তিতিরকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেল। ভেতরে ঢুকে ওকে কোলে নিয়েই দরজাটা লক করে দিল। তারপর ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিল এমন সময় তিতির ওর কলার টেনে ধরে মিষ্টি একটা হাসি দিল। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“ঘুমের ভান করা হচ্ছিল?”
-“এত বকলে কি করবো তাহলে?”
তিতিরের গলা শুনেই মুগ্ধর বুঝতে বাকী রইলো না যে ওর নেশা হয়ে গেছে। আর হবেই বা না কেন ওরই তো মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বলল,
-“এত বকলাম কোথায়? কিন্তু এত বকার মতই কাজ করেছো তুমি।”
-“একটু ভাং ই তো খেয়েছি। খেলে কি কয়?”
-“নেশা হয়রে বাবা।”
তিতির মুগ্ধর কলার ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে, একদম কাছে। তারপর বলল,
-“নেশা হলেই তো ভাল। নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগে। দুনিয়াটা ঘুরতে থাকে বেশ লাগে আমার।”
মুগ্ধ মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তিতির আচমকা ওর ঘাড়ে হাত রেখে আরো কাছে এনে ওর ঠোঁটে উথাল পাথাল চুমু দিতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্টারকমে ফোন এল। মুগ্ধ উঠে যেতেই তিতির চিৎকার করে বলল,
-“কে ফোন করেছে? আমি ওর চাকরি খাব।”
মুগ্ধ একথায় হেসে দিল। তারপর ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ম্যানেজার বলল,
-“স্যার আপনার ওয়ালেট টা পড়ে গিয়েছিল রিসিপশানে। আমি কি এটা এখন পাঠিয়ে দেব? নাকি পরে?”
-“ওহ! থ্যাংকস আ লট। প্লিজ পাঠিয়ে দিন।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কেয়ারটেকার ছেলেটি ওয়ালেট নিয়ে এল। মুগ্ধ সেটা কালেক্ট করে ভেতরে আসতেই তিতির ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমি ওই শাড়িটা পড়বো।”
-“ওহ হো। ওটা তো গাড়িতে। তোমাকে কোলে করে নিয়ে এলাম না? ওগুলো তো আনা হয়নি। দাঁড়াও নিয়ে আসছি।”
তিতির মুগ্ধকে আরো শক্ত করে ধরে বলল,
-“না তুমি যেতে পারবে না, ওই বদ ছেলেটাকে বলো দিয়ে যেতে। তাহলে মাফ করে দেব একটু আগে যে ডিস্টার্ব করেছে সেজন্য।”
মুগ্ধ তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,
-“ওর কাছে কি গাড়ির চাবি আছে? পাগলী! তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি নিয়ে আসছি।”
মুগ্ধ শাড়ি, ভেজা কাপড় সব নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল,
-“আমি ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে আসি। তুমি শাড়িটা পড়ে নাও।”
তিতির শাড়ি পড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলো মুগ্ধ ডিভানে বসে আছে। তিতির মুগ্ধর সামনে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালো আর বলল,
-“কেমন লাগছে আমাকে?”
মুগ্ধ তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে কোমর জড়িয়ে বলল,
-“পরী, আমার পরী।”
তিতির তার সেই মিষ্টি হাসিটা দিল। মুগ্ধ বলল,
-“চোখ বন্ধ করো।”
তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ মেলা থেকে কেনা একপাতা টিপ বের করলো পকেট থেকে। তারপর একটা লাল টিপ পড়িয়ে দিল তিতিরের কপালে। তিতির চোখ খুলতেই বলল,
-“শাড়ির সাথে টিপ না হলে চলেই না।”
তিতির মুগ্ধর গলাটা ধরে পায়ের বৃদ্ধাঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে মুগ্ধর একদম কাছে চলে গেল। ও চাইছে মুগ্ধ ওকে আদর করুক। মুগ্ধও বুঝতে পারলো। তিতিরের কোমরটা আরো শক্ত করে ধরে চুমু খেল ওর ঠোঁটে। অনেকক্ষণ ধরে। তারপর হঠাৎ ই বিদ্যুৎ চমকালো। বৃষ্টি নামলো। তারপর আচমকাই তিতিরকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“চলোনা, ভিজি।”
-“ভিজবো। সারাদিন তো প্রাকৃতিক বৃষ্টিতে ভিজেছিই। এবার অন্য বৃষ্টিতে ভিজবো।”
-“কোন বৃষ্টি?”
-“দেখাচ্ছি।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে করে হেটে হেটে নিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। যতক্ষণ কোলে ছিল তিতির ততক্ষণই মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। তেমনি মুগ্ধও তাকিয়ে ছিল তিতিরের ঠিক চোখের দিকে।
তিতিরকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ওর আঁচলটা পেটের উপর থেকে সরে গেল। এই দৃশ্য দেখামাত্রই মুগ্ধ যেন সব কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলল। নাভিতে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল কতক্ষণ। তারপর ঠোঁট না সরাসরি জিহ্বা দিয়ে আদর করতে লাগলো ওর নাভিতে। তিতির মুগ্ধর চুলগুলো খামচে ধরে সাপের মত মোড়ামুড়ি করতে লাগলো। উফফ কি করছে মুগ্ধ! ও তো সুখে মরেই যাবে! কিছু বলতে গিয়েও তিতির একটা কথাও বের করতে পারলো না। হঠাৎ মুগ্ধ ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো ঘষে দিল তিতিরের পেটে। তিতির ব্যাথায় একটা চিৎকার দিল। মুগ্ধ ওর ঠোটে চুমু দিয়ে চিৎকার থামালো। তারপর তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। কি মায়া! আল্লাহ কি পৃথিবীর সব মায়া ওর মুখটাতে দিয়ে রেখেছে? তিতির চোখ খুললো। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। মুগ্ধ তিতিরের মুখটা ধরে কপালে একটা চুমু দিল। তিতির আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। মুগ্ধ বোঁজা চোখদুটিতেও চুমু দিল। তারপর গালে চুমু দিল, তারপর ঠোঁটের আশেপাশে। তারপর আবার ঠোঁটে চুমু খেল। এরপর নেমে গেল গলায়। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। তিতির ততক্ষণে মুগ্ধর কান কামড়াতে শুরু করে দিল।
তারপর মুগ্ধ উঠে বসলো। তিতিরের কোমরটা ধরে ওকেও উঠিয়ে বসিয়ে আঁচলটা ফেলে দিল। আবার চুমু দিতে যাচ্ছিল এমন সময় তিতির ওকে বাধা দিল, টি-শার্টটা খুলতে বলতে চাইলো। কিন্তু সমস্ত আবেগ যেন গলার মধ্যে আটকে গেছে। বলতে না পেরে নিজেই খুলে ফেললো, মুগ্ধও হেল্প করলো। তারপর তিতির পাগলের মত কামড় দিতে লাগলো মুগ্ধর বুকে। মুগ্ধর খুব ব্যথা লাগছিল কিন্তু বাধা দেয়নি কারন একই সাথে ওর ভালও লাগছিল। আস্তে আস্তে তিতির কামড়ানো থামালো। এবার চুমু দিতে শুরু করলো। বুক থেকে চুমু দিতে দিতে উপরে উঠতে লাগলো। গলায় চুমু দিল তারপর গালে চুমু দিতেই মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর চুমু দিল। তিতিরও চুমু দিল। যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে কে কার থেকে বেশি আর নিবিড়ভাবে চুমু দিতে পারে! ততক্ষণে মুগ্ধর হাত চলে গেল তিতিরের কোমরে। শাড়ির কুচিগুলো ধরে কোমর থেকে খুলে পুরো শাড়িটাই ছুড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। তারপর মুগ্ধ তিতিরকে উলটো ঘুড়িয়ে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে চুমু দিল। একটা, দুটো, অসংখ্য। প্রত্যেকটা চুমুতে তিতির কেপে কেপে উঠছিল। ওর ব্লাউজের ফিতাটা মুগ্ধ একটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। ব্লাউজের পিছনের হুকগুলো খুলে পিঠে চুমু দিল। তারপর ব্লাউজটা টেনে খুলবার সময় বাধা দিল তিতির। কোনরকমে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
-“লাইট টা বন্ধ করে নাও প্লিজ।”
অস্থির মুগ্ধ বলল,
-“না, কেন?”
-“আমার লজ্জা লাগবে নাহলে।”
-“হুম, লাগুক। আমি তো তোমার লজ্জাটাই দেখতে চাই। আই লাভ ইট।”
-“না প্লিজ, আমি তাহলে মরে যাব।”
-“আমি তো তাহলে কিচ্ছু দেখতে পারবো না।”
-“দেখা লাগবে না। আরেকদিন দেখো। আজ লাইটটা বন্ধ করো। পায়ে পড়ি তোমার।”
বাইরে তখন তুমুল বর্ষন। বাতাস আর বৃষ্টির তোড়ে বারান্দার দরজার পর্দা ভেতরে এসে উড়ছে। মুগ্ধ গিয়ে লাইট টা বন্ধ করে ফিরে এল। তবু বাগানের লাইটের যতটুকু আলো আসছে তাতে সব স্পষ্ট না হলেও আবছা দেখা যাচ্ছে সবই। তারপর ব্লাউজটা খুলে ফেললো। তিতির লজ্জায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। কি করবে ও? একদিকে মুগ্ধ কাছে আসতেই লজ্জায় মরে যায় অপরদিকে নিজের সর্বস্ব তুলে দিতে ইচ্ছে করে ওর জিম্মায়। মরতে ইচ্ছে করে মুগ্ধর হাতে। মুগ্ধ উপুর হয়ে শুয়ে থাকা তিতিরের সারা পিঠে চুমু দিতে লাগলো। তারপর তিতিরকে নিজের দিকে ফেরাতেই তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধও ধরলো। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মুগ্ধ তিতিরকে আবার শুইয়ে দিল। ঠোঁটে চুমু খেল। তারপর চুমু খেল গলায়, বুকে, পেটে। তিতিরের কাঁপতে কাঁপতে বেহুশ হয়ে যাবার অবস্থা। কিছু ভাললাগা থাকে না অসহ্যকর? সেরকমই কিছু ছিল।
তিতির চোখ বন্ধ করে ছিল। হঠাৎই মুগ্ধর ঠোঁটের স্পর্শ পেল পায়ে। লাফিয়ে উঠে নেশাভরা কন্ঠে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ কি করছো?”
-“ছিঃ বলছো কেন?”
-“আমার পায়ে মুখ দিচ্ছো কেন?”
-“তো কি হয়েছে?”
-“আমার পাপ হবে।”
-“কিচ্ছু হবেনা। তোমার পায়ের উপর লোভ আমার কতদিনের জানো? একটু আদর করতে দাও।”
তিতির আর কিছু বলল না। জানে আর কিছু বলেও লাভ নেই, মুগ্ধ শুনবে না। দুইপায়ে মন ভরে চুমু খেয়ে মুগ্ধ উঠে এল। তিতিরের নাভির দু’ইঞ্চি নিচে চুমু খেতে খেতে মনে হলো কি করছে ও! আর তিতিরও আজ কিছুতেই বাধা দিচ্ছে না। ও তো ভাং খেয়ে আউট অফ মাইন্ড হয়ে গিয়েছে। কাল ঘুম থেকে উঠে যদি এসবের জন্যই আফসোস করতে থাকে? তাহলে মুগ্ধ নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। মুগ্ধ সরে গিয়ে শুয়ে পড়লো তিতিরের পাশে। তিতির মুগ্ধর হাতটা সরিয়ে বাহুতে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো ওকে। মুগ্ধও ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। কিচ্ছুক্ষণ পর তিতির ওর উপড়ে উঠে শুয়ে ওর বুকে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বুঝতে পারছে তিতির আরো আদর চাইছে। ওরও যে ইচ্ছে করছে। কি করবে? তিতিরের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
-“তিতিরপাখি?”
-“হুম।”
-“আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ না?”
তিতিরের বলতে ইচ্ছে করলো, ‘না থামা উচিৎ না’ কিন্তু পারলো না। বলল,
-“জানিনা।”
-“উচিৎ, কারন এটা পাপ।”
তিতির মুগ্ধর বুকের উপর থেকে মাথা না তুলেই বলল,
-“পাপ কেন হবে? আমরা তো দুজন দুজনকে ট্রু লাভ করি। প্রায় গত ৬ বছর ধরে তো তোমাকে আমি আমার বর বলেই মেনে এসেছি। আর তুমিও তো আমাকে বউই ভাব।”
-“শুধু ভাবিই না। মনেপ্রাণে মানিও সেটা। কিন্তু আমাদের বিয়ে তো হয়নি না?”
-“আমার ফ্যামিলির জন্য হয়নি। আমার বাবা মা রাজী হলে অন্তত দু’বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়ে যেত।”
-“হ্যা, কিন্তু হয়নি তো বাবা। আর এর থেকেও ইম্পরট্যান্ট কথা হলো তোমার আমার বিয়ে কখনোই হবে না তাই তোমার ভার্জিনিটি নষ্ট করার কোনো রাইট আমার নেই। যখন অন্যকারো সাথে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে, আজকের ভুল টাই তোমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে সেদিন। তাই কোন ভুল করতে চাচ্ছি না।”
তিতির আর কিছু বলল না। মনে মনে বলল, ‘মুগ্ধ তুমি এতটা ভাল না হলেও পারতে।’ কখন ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তা ও টের না পেলেও মুগ্ধ পেল। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু জড়িয়ে ধরে রইলো। মনে মনে বলল, ‘তিতির, জানি আমাদের বিয়ে অসম্ভব। তবু যদি কখনো কোনভাবে এই অসম্ভবটা সম্ভব হয় তাহলে এই মুহূর্তে যতটা কষ্ট তোমাকে দিলাম তার হাজার গুন সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দেব।’
তিতির কখন যেন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ ওকে বুকের উপর থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলো শরীরটা ভার হয়ে আছে। বুকের ভেতর ব্যাথা করে উঠলো। বুকে হাত দিতেই দেখতে পেল বুকের লোমগুলো ভিজে গেছে তিতিরের চোখের জলে। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠলো। ও জানেনা একটা মেয়েকে আদর করে তারপর চূড়ান্ত আদরের সময় ছেড়ে দিলে কেমন লাগে কিন্তু নিজেকে দিয়ে এটা বুঝতে পারছে একটা ছেলের কেমন লাগে! তিতির যেমন হাজার ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে ওর বুকের উপর তেমনি ওর নিজেরও হাজার ফোঁটা চোখের জল বুকের ভেতর জন্ম নিয়ে বুকের ভেতরই ঝরে গেছে। তিতিরের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল মুগ্ধ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের আবছা অন্ধকারে থাকা পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ বুঝতে পারছিল ওর চোখ জ্বলছে। কাঁদলে নাকি হালকা লাগে? বুকের ভেতর এত কান্না অথচ কাঁদতে পারছে না কেন ও? কান্নার কি কোন মন্ত্র আছে? যেটা পড়ে মেয়েরা এত কাঁদে? নিশ্চই আছে যেটা ও জানেনা আর জানেনা বলেই কাঁদতে পারেনা। সারা শরীরের রক্ত যেন ফুটছে। আবার যেতে ইচ্ছে করছে তিতিরের কাছে, কিন্তু না ও যাবে না। তিতির কষ্ট পেয়েছে, আবার কষ্ট দেয়ার মানে হয়না। আর ওরও উচিৎ কন্ট্রোলে থাকা। কিন্তু সারাটা রাত কিভাবে কাটাবে ও? বারান্দার মধ্যে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। নিজের শরীরটাকে ব্লেড দিয়ে কেটে কুচিকুচি করতে পারলে বোধহয় এ অস্থিরতা কমতো। আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে গেল মুগ্ধ। ওর টি-শার্ট, তিতিরের শাড়ি সব ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওগুলো তুলে রাখলো। তারপর খেয়াল হলো ও এখনো সেই আধাভেজা হাফপ্যান্ট টা পড়ে আছে। চেঞ্জ করে নিল। তারপর শুয়ে পড়লো। তিতির ওর দিকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো চোখের উপর এসে পড়েছে। চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিল মুগ্ধ। তিতির ওর ছোঁয়া পেয়ে ঘুমের ঘোরেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধর একটু শান্তি লাগলো। তিতিরকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। একফোঁটা না ঘুমিয়ে কাটলো মুগ্ধর রাতটা। সারাটা রাত ধরে যত আজগুবি চিন্তা করছিল। তার মধ্যে একবার তান্নাকে খুন করার প্ল্যানও করে ফেলেছিল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওরা ঢাকা রওনা দিল। দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে গেল। তিতির ওদের বাসার গলির মোড়েই নেমে গেল। নামার আগে মুগ্ধ বলল,
-“থ্যাংকস ফর লাস্ট টু ডেস।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ আবার বলল,
-“সেদিন অফিসের জন্য যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, তখন ভাবিওনি এরকম কিছু হতে পারে। দুদিন, দুরাত যেন স্বপ্ন দেখলাম।”
-“থ্যাংক ইউ টু গত দুটো দিন আমাকে দেয়ার জন্য। আমার কাছেও স্বপ্নই ছিল।”
তিতির গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“কাল তোমার একটা কথার রিপ্লাই দিতে পারিনি। আজ দেই?”
-“সিওর। কোন কথাটা?”
-“কাল বলছিলে না আমার ভার্জিনিটি নষ্ট করার রাইট তোমার নেই? কিন্তু তুমি কি এটা জানো আমার মনের ভার্জিনিটি তুমি অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।”
মুগ্ধ হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,
-“আসি তাহলে। ভাল থেকো, নিজের যত্ন নিও।”
তিতির হাটা শুরু করতেই মুগ্ধ গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে চলে গেল তিতিরের কাছে। বলল,
-“তুমি রাগ করেছো কালকের জন্য? আই এম রিয়েলি সরি।”
-“রাগ করিনি। এটা বলার ছিল কিন্তু কাল বলতে পারিনি তাই আজ বললাম। সত্যিই রাগ করিনি। রাগ করলে কথা বলতাম? যাই হোক, তুমি এখন যাও। তোমাকে এখানে আমার সাথে কেউ দেখলে কি হবে জানোই তো।”
-“ওকে। আর সবসময় তো ফোন দেইনা, মাঝে মাঝে দিলে ধরো প্লিজ।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা, যাও এখন.. টাটা।”
বাসায় ফিরে তিতির গতকাল রাতের ঘটনাগুলো নিয়েই ভাবছিল। ইশ কি সুন্দর করে আদর করে মুগ্ধ! আচ্ছা ওর যখন অন্য কোন মেয়ের সাথে বিয়ে হবে তখন কি তাকেও মুগ্ধ এভাবেই আদর করবে? না! মরেই যাবে ও তাহলে! মুগ্ধ শুধু ওর। সেই মুগ্ধ অন্য কোন মেয়েকে ওর মত করে আদর করবে, অন্য কোন মেয়ে ওর মুগ্ধকে স্পর্শ করবে এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। আগুন জ্বালিয়ে দেবে, প্রয়োজনে খুন করবে। তবু ওর মুগ্ধকে ও অন্য কারো হতে দেবে না। আচ্ছা এমন কিছুই কি করা যায়না যাতে বাবা-মা রাজি হয়ে যায় মুগ্ধর সাথে বিয়ে দিতে? আর কিছুই কি করার নেই? তিতির কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসলো। উল্টোপাল্টা আঁকিবুকি করলে তিতিরের মাথায় ভাল ভাল আইডিয়া আসে। তাই করলো। কিন্তু কোন আইডিয়া এল না। সন্ধ্যাবেলা বাসার সবাই সিরিয়াল দেখতে বসেছে। এমন সময় তিতির চা বানাতে গিয়ে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল শুনতে পেল। সাথে সাথে ওর মাথায় একটা আইডিয়া এল। আইডিয়াটা নিয়ে সারারাত ভাবলো। ইয়েস, এর চেয়ে ভাল আইডিয়া হতেই পারেনা। বাবা-মা রাজী হতে বাধ্য।
খুশিতে ঘুমই আসছিল না তিতিরের। মুগ্ধকে ফোন করলো কিন্তু কিছু বলল না। একবারে সারপ্রাইজ দেবে।
মুগ্ধর মনটা বোধহয় খারাপ। সব কথাতে শুধু হু হা করছে। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমার মনটা কি খারাপ?”
-“হ্যা তিতির, আমি কালকের জন্য লজ্জিত।”
-“কেন?”
-“অতটা উচিৎ হয়নি। আমার মাথা ঠিক ছিলনা।”
তিতির হেসে বলল,
-“কেন ভাং এ ধরেছিল তোমাকে?”
-“জানিনা, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আমার কোন কিছুতে নেশা হয়না। কিন্তু ভাং টাতে আমি অভ্যস্থ নই।”
-“বাদ দাও না। কাল যা গেছে গেছে। ওটা নিয়ে আর ভেবোনা। সামনের দিনের কথা ভাবো।”
-“আমি তো কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।”
এসব কথায় তিতিরের খারাপ লাগছিল। তাই ও প্রসঙ্গ পালটে বলল,
-“তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস কাল রাতের জন্য। তুমি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছো ভালবাসার বৃষ্টি কাকে বলে। তুমি আমাকে ফিল করিয়েছো সুখ কতটা সুখের হতে পারে!”
মুগ্ধর বুকের ভার হালকা হলো এটা ভেবে যে, যাক ঘুরে এসে তিতিরের মনটা তো ফ্রেশ হয়েছে। একটু হলেও ভাল আছে আগের চেয়ে। কিন্তু তখনও মুগ্ধ জানেনা কি চলছিল ওর মনের মধ্যে।
পরদিন দুপুর ১১/১২ টার দিকে তিতির হুট করে রান্নাঘরে গিয়ে বলল,
-“মা তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
-“এখন রান্না করছি, পরে বলিস।”
-“ইটস আর্জেন্ট।”
মা ওর দিকে ফিরে বলল,
-“কি বল?”
-“আমি প্রেগন্যান্ট।”
মায়ের হাত থেকে খুন্তিটা পরে কয়েকবার উল্টিপাল্টি খেয়ে একসময় থেমে গেল। তিতিরের একফোঁটা ভয় করলো না। বরং কথাটা বলতে পেরে বেশ হালকা লাগলো।
মা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শীতল গলায় বলল,
-“কি করে হলো এসব?”
তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো। নিজের মেয়েকে কেউ এসব জিজ্ঞেস করে? এমনি লজ্জা লাগছে আবার ডিটেইল জানতে চাচ্ছে। এমন তো না যে মা জানেনা কি করে মানুষ প্রেগন্যান্ট হয়। ওকে চুপ থাকতে দেখে মা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করে হলো? আমরা তো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে বলেছিলাম এ বিয়ে কক্ষনো সম্ভব না। যোগাযোগ রাখিস না, তুইও তো বলেছিলি যোগাযোগ নেই। তাহলে প্রেগন্যান্ট হলি কি করে?”
তিতির মনে মনে ভাবলো, ও আচ্ছা মা এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছে! বলল,
-“আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হয়েছে মা। আমরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারি না।”
-“এই অকাজ কোথায় করেছিস? ওই বদমাইশ টা তোকে হোটেলে নিয়ে গেছে?”
তিতির লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেলে হবে না ওকে বলতেই হবে। বলল,
-“না মা। ওর বাসায়।”
-“কি করে হয় এসব? দেশে কি প্রটেকশন ছিল না?”
তিতিরের লজ্জায় এবার মরেই যেতে ইচ্ছে করছিল। চুপ করে রইল। মা একটু থেমে আবার বলল,
-“আমি আগেই বুঝেছিলাম এই ছেলে সুবিধার না।”
তিতির যেকোনো মূল্যে মুগ্ধকে চায়। বুকে সাহস রেখেই বলল,
-“মা ও তো জোর করে আমার সাথে কিছু করেনি। যা হয়েছে আমার স্বজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় হয়েছে।”
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মা এব্যাপারে আর কথাই বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
-“তুই প্রেগন্যান্সির কথা জানলি কি করে?”
-“টেস্ট করিয়েছি।”
-“বাহ! আমার মেয়ে দেখছি অনেক এডভান্স।”
তিতির মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো যেন মা এটা জিজ্ঞেস না করে যে কোথায় টেস্ট করিয়েছে। তাহলে তো মহাবিপদ। ঠিক তখনই মা জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় টেস্ট করিয়েছিস?”
-“হসপিটালে।”
-“কয় মাস?”
কি বলবে! আন্দাজে বলে দিল,
-“আ.. দুই মাস হবে।”
-“এরকম আন্দাজে বলছিস কেন? ঠিক করে জানিসও না? আবার মা হতে যাচ্ছে! যত্তসব।”
“মা হতে যাচ্ছে” এই কথাটা শুনে একটা অদ্ভুত ফিলিং হলো। ফিলিং টা তো জোস! ওকে নিশ্চুপ দেখে মা বলল,
-“কবে টেস্ট করিয়েছিস?”
-“দেড় মাস আগে।”
-“দেড় মাস আগে মানে? দ্বিতীয় মাসে যাস নি?”
প্রতি মাসে যেতে হয়! নাকি মা বিশ্বাস করতে না পেরে ঢপ মারছে! কিছুই বুঝতে পারছে না তিতির। মা বলল,
-“আমি জানতাম ওই ছেলে এরকম ইরেস্পন্সিবলই হবে।”
তিতিরের খুব অসহায় লাগলো। মা মুগ্ধকে দোষ দিচ্ছে! মুগ্ধ যদি ইরেস্পন্সিবল হয় তাহলে দুনিয়াতে রেস্পন্সিবল বলে কোন শব্দই নেই। কিন্তু তিতির কোন প্রতিবাদই করতে পারলো না। যাই হোক, বিয়ের পরে তো জানাজানি হবেই যে ও মিথ্যে বলেছিল তখন তো মায়ের ভুল ভাঙবে, তখন ঠিকই বুঝবে মুগ্ধ কতটা ভাল। দুজনে এটুকু খারাপ হয়ে যদি সারাজীবনের জন্য দুজনে এক হতে পারে তো দোষের কি?
মা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
-“তোর ভাবীকে বল বাকী রান্নাটা শেষ করতে। আমার মাথা ঘুরছে। তোর বাপ ভাই কে একথা আমি কি করে বলবো আমি জানিনা।”
মা নিজের রুমে ঢুকতেই তিতির লাফিয়ে উঠলো। ইয়েস! মা পজেটিভ। চিন্তার চোটে বকতেও ভুলে গেছে!
লাঞ্চের সময় সবাই স্বাভাবিক। তার মানে মা এখনো কাউকে কিছু বলেনি। মাকে চিন্তিত দেখালো। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। লাঞ্চ শেষ করে তিতির নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকালো। এরপর মুগ্ধকে কল করলো। মুগ্ধ ফোন ধরেই বলল,
-“তিতির, পরে কল করছি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
-“শোনো, শোনো.. এক মিনিট দাওনা। শুধু একটা কথাই বলবো।”
-“আচ্ছা বলো।”
-“তুমি বাবা হতে চলেছো।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“হোয়াট?”
তিতির হেসে বলল,
-“হুম।”
মুগ্ধ কিছু বলার আগেই একটা মেয়ের মিষ্টি গলা পাওয়া গেল। মুগ্ধকে বলল,
-“মে আই কামিং স্যার?”
-“নো।”
-“ওহ, সরি স্যার। একচুয়েলি ওনারা চলে এসেছে।”
-“এসেছে তো কি হয়েছে? বসতে বলেন, চা-কফি খাওয়ান। আমি ডেকে নিব। আপনি এখন যান।”
-“ওকে স্যার।”
তারপর মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা বলো কি হয়েছে? ইন শর্ট বলবে। ক্লায়েন্ট বসে আছে, আমি মিটিং এ বসবো।”
-“ওহ, সরি আমি দুষ্টুমি করছিলাম।”
-“নাহ এটা শুধু দুষ্টুমি না। কাহিনী কি তাড়াতাড়ি বলো।”
-“আরে সিরিয়াসলি এটা দুষ্টুমি ছিল। তুমি ফ্রি থাকলে দুষ্টুমিটা আরেকটু কন্টিনিউ করতাম। জাস্ট তোমাকে এই ফিলিং টা দেয়ার জন্য যে বাবা হচ্ছো শুনলে কেমন লাগে, হোক না মিথ্যেমিথ্যি।”
-“এরকমটা হলে আমি বিজি শুনেও এক মিনিট চাইতে না বলার জন্য।”
-“আরে নারে বাবা। সত্যি আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এরকম বিজি। আর তুমি কি বাবা হওয়ার মত কিছু করেছো যে বাবা হবে?”
-“না।”
-“তাহলে? যাই হোক, ওই মিষ্টি কণ্ঠী মেয়েটা কে?”
-“আমার কলিগ।”
-“তো ওরকম ঝাড়ি মারলে কেন? মিষ্টি করেই তো বলতে পারতে।”
-“অফিসের কলিগ আমার ঘরের বউ না যে মিষ্টি করে কথা বলবো। আর ও ঝাড়ি আরেকটা খাবে আমি না বলার পরেও ভেতরে আসবার জন্য, যেতে বলার আগ পর্যন্ত বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য। কারন, ও দেখেছিল আমি ফোনে কথা বলছি। কেউ ফোনে কথা বলার সময় তার সাথে কথা বলতে হয়না এটা নরমাল
ম্যনার। এটুকু না জেনে চাকরি করতে চলে আসলে তো হবে না।”
-“থাক, এত বকাবকি করো না।”
-“এটাই সিস্টেম। আমার বস আমাকে ঝাড়বে। আমি আমার জুনিয়র কে ঝাড়বো, ও আবার ওর জুনিয়র কে গিয়ে ঝাড়বে। এই হ্যায়ারারকি সব যায়গায় আছে।”
-“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা মাথা ঠান্ডা করো। এতটা মাথা গরম করার মত কিছু হয়নি। তুমি আসলে বাবা হচ্ছো না। আমি দুষ্টুমিই করছিলাম। তুমি যাও মিটিং এ বসো।”
একথা বলে তিতির একটা চুমু দিলো। মুগ্ধ বলল,
-“এসবে আমার কিছু হয়না, লাইভ লাগে আমার।”
-“গতকালই তো লাইভ দিলাম।”
-“হ্যা সেটা তো অনেক আগে।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে যাও তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, বাই।
-“বাই, কিন্তু কিছু ঘাপলা আছে। রাতে দেখছি ব্যাপারটা।”
একথা বলে মুগ্ধ ফোন রেখে দিল।
বিকেলে মা এসে দরজায় নক করলো। তিতির দরজা খুলতেই মা বলল,
-“১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে।”
-“কেন মানে? ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না? ওই ইরেস্পন্সিবল টা তো তোকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি!”
-“নিয়েছে তো মা।”
-“নিয়েছে তো টেস্ট করাতে। দু’মাস হয়ে গেছে অথচ একবারও চেকাপ করাতে নেয়নি যখন, তখন তো ও অবশ্যই ইরেস্পন্সিবল। যাই হোক, এত কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।”
একথা বলে মা চলে গেল।
তিতির ভাবনায় পড়ে গেল। কি হবে এখন? ডাক্তারের কাছে গেলে তো ধরা পড়ে যাবে ও আসলে প্রেগন্যান্ট না। তখন? কি করবে? মুগ্ধকে ফোন করে যে বুদ্ধি চাবে সেটাও সম্ভব না। ও এখন মিটিং এ, ফোনটা নিশ্চিত সাইলেন্ট করা। তবুও একটা ফোন করলো। মুগ্ধ ধরলো না। টেনশানে তিতিরের গা কাঁপছে। এতদূর এসে ধরা খেয়ে প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে ভাবতেই তিতিরের কান্না পেল। ইশ, কেন মিথ্যের উপর ভর করে ব্ল্যাকমেইল করতে গেল? মুগ্ধকে বলে সত্যি সত্যি প্ল্যান করে প্রেগন্যান্ট হত! তারপর নাহয় ব্ল্যাকমেইল টা করতো! এত তাড়াহুড়ার তো কিছু ছিল না। উফ কি হবে এখন? এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে তিতিরের মনে এই কথাটাই এল যে, ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করে যদি ম্যানেজ করা যায়? সে যদি মাকে সত্যিটা না বলে তাহলেই তো আর কোন প্রব্লেম নেই কিন্তু কোন ডাক্তার কি সেটা করতে রাজী হবে? কেন হবে না যদি সেভাবে বোঝানো যায়? কিন্তু আলাদা করে কথা বলার সুযোগটাই যদি না পায়? পাবে না কেন? ও বলবে যে ওর মায়ের সামনে লজ্জা লাগছে। তাহলে তো ডাক্তার ওর মাকে সামনে রাখবে না। অবশেষে এই ভরসায় তিতির বের হলো। মা একটা কথাও বলল না পুরো রাস্তায়।
তিতিরকে ওদের এলাকারই একটা ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই তিতিরের চক্ষু চড়কগাছ! ইমা আন্টি! এটাই ইমা আন্টির ক্লিনিক তাহলে? ড. ইমা তিতিরের মায়ের বান্ধবী। একে কি করে কনভেন্স করবে ও? হায় খোদা। মানুষ নিজের অবিবাহিত মেয়ের প্রেগনেন্সি চেকাপ করাতে পরিচিত মানুষের কাছে যায় এই প্রথম দেখলো ও। সবাই তো এরকম কেস এ লুকিয়ে চুরিয়ে অপরিচিতদের কাছেই যায় গোপন রাখার জন্য।
চেম্বারে ঢুকে বসার পর তিতির বলল,
-“মা তুমি বাইরে যাও।”
ড. ইমা বলল,
-“ওর বোধহয় লজ্জা লাগছে। স্বাভাবিক প্রথমবার তো। তুই বাইরে অপেক্ষা কর। আমি ডেকে নেব।”
তিতিরের মা বলল,
-“না না আমি বাইরে যাব না। ওর মোটেও লজ্জা লাগছে না। আমার চোখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সব কথা বলেছে। ওর লজ্জাশরম সব গেছে। যে মেয়ে বিয়ে না করেই কারো সাথে শুতে পারে তার আবার লজ্জা কিসের?”
একথা শোনামাত্রই তিতিরের চোখ ফেটে কান্না এল। একটা শব্দও করলো না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। এ যেন পানি না রক্ত!
ড. ইমা বলল,
-“আহা, মাথা ঠান্ডা কর। কি সব বলছিস। তুই বাইরে যা তো। আমি দেখছি।”
মা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইরে চলে গেল। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই উঠে এসে ড. ইমার পা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আন্টি, প্লিজ আমাকে বাঁচান।”
-“আরে আরে করছো কি? পা ছাড়ো। এই পাগলী মেয়ে কি হয়েছে?”
-“আন্টি, আমার ফ্যামিলি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হচ্ছেনা। ৬ বছরের সম্পর্ক আমাদের। অনেকদিন ধরে অনেকভাবে চেষ্টা করছি, কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই আমি এবার প্রেগনেন্সির কথা বলেছি। আসলে আমি প্রেগন্যান্ট নই, আমার বয়ফ্রেন্ড এসব করার মত ছেলেই না। কিন্তু প্লিজ আন্টি আপনি মাকে সত্যি কথাটা বলবেন না।”
-“সেকী!”
-“হ্যা।”
-“কিন্তু আমি কি করতে পারি?”
-“আপনি শুধু বলবেন সব ঠিকাছে, কোন প্রব্লেম নেই। আমি যে প্রেগন্যান্ট না সেটা প্লিজ বলবেন না।”
-“আরে আগে পা তো ছাড়ো।”
ড. ইমা তিতিরকে টেনে উঠিয়ে পাশের চেয়ারটাতে বসালো। বলল,
-“তিতির, আমি এটা কি করে লুকাবো বলো, তোমার মা তোমাকে এখানে এবরশন করাতে নিয়ে এসেছে।”
তিতিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। উনি আরো বলল,
-“তোমাকে একথা বললে কি তুমি আসতে? তাই চেকাপের কথা বলে এনেছে।”
তিতিরের কান্না আরো বাড়লো। ড. বলল,
-“বাচ্চাদের মত কান্না করো না। এসব না করে বাবা-মাকে বোঝাও যে তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকেই বিয়ে করতে চাও।”
-“অনেক বুঝিয়েছি আন্টি। কোনটাতে কাজ হয়নি বলে আজ এই পথ বেছে নিয়েছি।”
-“তিতির, যেভাবে তুমি এসে আমার পা জড়িয়ে ধরেছো! আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। বড্ড মায়া লাগছে, কিন্তু আমি কি করবো মা? আমার যে কিছুই করার নেই। তাও ভাগ্য ভাল যে তুমি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট হওনি। হলে একটা জীবন পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলা হতো। আমি মায়ায় পড়ে না করলেও তোমার মা তোমাকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত।”
তিতির কেঁদেই চলেছে। ড. আন্টি আবার বলল,
-“শুধু তোমার মা বলে কথা না। আমার এই ক্লিনিকে কয়েকদিন পরপর এরকম মায়েরা আসে তাদের মেয়েদের নিয়ে এবরশন করাতে। আজকাল অহরহ ঘটছে এসব। কাউকে তো দেখলাম না মেনে নিয়ে মেয়ের পছন্দমত বিয়ে দিয়েছে। আমি একজন মা বলেই বুঝি কোনো মায়েরাই এসব মানতে পারেনা। নিজে যখন মা হবে তখন বুঝতে পারবে। আসলে মায়েরা চিন্তা করে, যে ছেলে বিয়ের আগে এসব করতে পারে তারা আর যাই হোক ভাল ছেলে না তাই বিয়ে দিতে রাজী হয়না। প্রত্যেকটা মা ই তো চায় তার মেয়ের ভাল একটা ছেলের সাথে বিয়ে হোক। টাকা পয়সা, লেখাপড়া, চাকরী, যোগ্যতা সবকিছুর আগে দেখে চরিত্র। তার মেয়েরই ভাল জীবনযাপনের আশায়। তাই বলছি এভাবে বাবা-মা কে বিয়েতে রাজী করানো যায়না।”
-“কি করবো আন্টি? কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। আমি তো পারতাম ইচ্ছে করলেই পালিয়ে গিয়ে ওকে বিয়ে করতে। ওদের বাসার সবাই রাজী। আমাদের কোন প্রব্লেমই হতো না। কিন্তু বাবা-মায়ের কথা ভেবেই তো পারিনি। যাদের কথা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছি আরেকজনকেও দিচ্ছি তারা কি পারেনা একটু আমার কথাটা ভাবতে?”
-“হ্যা, সেটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু তুমিও মা খুব বাজে একটা ওয়েতে গিয়েছো। এভাবে হবে না, অন্যভাবে বোঝাও।”
ড. আন্টি মাকে ডেকে বলল,
-“তোর মেয়ে প্রেগন্যান্ট না। শুধুমাত্র তোদেরকে বিয়েতে রাজী করানোর জন্য একথা বলেছে। ও ছেলেটাকে প্রচন্ড ভালবাসে। বুঝতে পারছিস একটা মেয়ে কখন ভয়ডর, লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে একথা বলতে পারে? কতটা ভালবাসলে? তাছাড়া ও তো পারতো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে। তা না করে তোদেরকে রাজী করানোর চেষ্টা করছে। এবার মেনে নে বোন।”
তিতিরের মা তখনই তিতিরকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা চড় দিল। তারপর ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রিক্সায় উঠিয়ে সোজা বাসায়। পুরো রাস্তা একটা কথাও বলল না হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো শুধু। বাসায় ঢুকেই এক সেকেন্ড দেরী না করে নিজের ঘরে চলে গেল। তিতিরও গেল নিজের ঘরে কিন্তু দরজা আটকালো না। এমন সময় ফোন এল মুগ্ধর। এখন ধরতে সাহস পেল না। মা যদি আসে? ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল।
মা নিজের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে সেই ৩ ফিটের কাঠের স্কেল টা নিয়ে এল যে স্কেল টা ছোটবেলায় বানানো হয়েছিল তিতিরের ছবি আঁকার জন্য। একপাশে একটু ভেঙে যাওয়ায় ওটা আর তিনি ব্যাবহার করতে দেয়নি তিতিরকে। আজ সেই বহু বছরের অব্যহৃত স্কেলটি দিয়ে ইচ্ছেমত মারলো তিতিরকে। তিতির বরাবরই সবার খুব আদরের ছিল। কেউ কখনো ওর গায়ে হাত তোলেনি। মুগ্ধর কথা জানার পর কয়েকটা চড় থাপ্পড় খেয়েছে বটে কিন্তু এমন মারের সাথে পরিচিত ছিল না তিতির। মা এতই পাগলের মত মারছিল যে, কখন তিতির ফ্লোরে পড়ে গেছে সেদিকে খেয়ালই করেনি। তিতির একটা কথাও বলল না। নীরবে কাঁদতে লাগলো শুধু। এত জোড়ে মারার পরও চিৎকার করছেনা বলে মা আরো জোরে মারছিল। প্রথমে ভাবী আর চম্পা ছাড়া কেউ বাসায় ছিল না থামাবার মত। ভাবী থামাতে আসায় মা ভাবীকে এমন ধাক্কা দিল ভাবী গিয়ে পড়লো দরজার উপর। মাথায় ব্যাথা পেল। আর আগাতে সাহস পেলনা। কাঁদতে লাগলো শুধু। চম্পা তো এগোলোই না, দূরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। মায়ের শরীরের সব শক্তি একসময় শেষ হয়ে গেল। এবার সেও কাঁদতে লাগলো। একসময় বাবা এল। চম্পা দরজা খুলেই বলল,
-“খালুজি আফারে বাঁচান।”
বাবা অস্থির হয়ে বললেন,
-“কি হয়েছে তিতিরের?”
চম্পা বাবাকে নিয়ে এল তিতিরের ঘরে। মেয়েকে ফ্লোরে মরার মত পড়ে কাঁদতে দেখে বাবা ছুটে এলেন,
-“কি হয়েছে মা? কি হয়েছে?”
তিতিরের গায়ে স্কেলের দাগ বসে গেছে। তিতির কিছুই বলতে পারলো না শুধু হিচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভাবী বলল,
-“বাবা, তিতির আর মা বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে হঠাৎই মা তিতিরকে মারতে লাগলো কেন তা জানিনা।”
এমন সময় তান্নাও রুমে ঢুকলো। মা যখন তিতিরকে মারতে শুরু করে ভাবী তখনই তান্নাকে ফোন করেছিল। ফোন পেয়ে তান্না দৌড়ে এসেছে। তান্না তিতিরকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বাবা এবার মাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন,
-“তুমি আমার মেয়েকে এভাবে মারার সাহস কোথা থেকে পেলে? কি করেছে ও? মুগ্ধর সাথে বিয়ের কথা বলেছে তো? এ আর নতুন কি? তাই বলে এভাবে মারবে তুমি?”
মাকে চুপ থাকতে দেখে তান্না বলল,
-“কি হলো মা? বলছো না যে? এভাবে মারলে কেন ওকে? ইশ দাগ বসে গেছে।”
তান্নাও কেঁদে ফেললো। বাবা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বের করে দিব বাসা থেকে। আমার মেয়েকে জানোয়ারের মত মেরে এখন চুপ করে বসে কাঁদছে।”
মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে পুরো ঘটনাটা বললো। সবাই কয়েক সেকেন্ড চুপ। সবার আগে কথা বলল তান্না। চোখ মুছে কান্না থামিয়ে বলল,
-“শোন তুই যদি ভাবিস যে এসব করলে আমরা তোকে ওই হারামজাদার সাথে বিয়ে দেব তাহলে ভুল ভাবছিস। কোন কিছু করে লাভ হবে না। এটা অসম্ভব। তোর মায়ের প্রতি সম্মান না থাকতে পারে আমার আছে, আমাদের আছে।”
বাবা চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
মা বলল,
-“ওকে যদি বিয়ে করতেই চাস তো চলে যা ওর কাছে, আমরা তো তোকে আটকে রাখিনি। ভাববি তোর বাপ-মা, ভাই কেউ নেই। আমরাও ভাববো আমাদের কোন মেয়ে নেই।”
তিতির কথা বলতে পারছিল না। সারাশরীর ব্যাথায় বিষের মত হয়ে আছে। অনেক কষ্টে বলল,
-“আমি গেলে তো অনেক আগেই যেতাম। তোমাদের পারমিশন ছাড়া বিয়ে করবো না বলেই তো মানাতে চাইছি। প্লিজ মা মেনে নাও না।”
তান্না ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলল,
-“ও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মেরে ফেলো, আমার আর কিছু বলার নেই।”
মা তিতিরকে বলল,
-“তোকে পেটে ধরেই বড় পাপ করেছি আমি।”
সবাই একে একে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। শুধু চম্পা ঘরের এক কোনায় বসে কাঁদতে লাগলো। তিতির উপুর হয়ে শুলো। পিঠটা বিছানায় রাখতে পারছে না। পিঠের এমন কোন যায়গা নেই যে স্কেল পড়েনি। কোথাও কোথাও একই যায়গায় বারবার পড়েছে। উপুর হয়েও ব্যাথা অনুভব করলো। বুকে, পেটেও বোধহয় দুএকটা লেগেছে। বাবা এসে এভাবে দেখে অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভাইয়া এসে ওর গায়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু মনের ভেতর এর চেয়েও যে কত ব্যাথা আর দাগ রয়েছে তার খবর তো কেউ রাখেনা।
তিতির বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করলো। বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“চম্পা, দরজাটা লক করে চলে যা।”
চম্পা চুপচাপ দরজা লক করে বেড়িয়ে গেল। তিতির ফোন দিল মুগ্ধকে। মুগ্ধর গলায় আতঙ্ক!
-“তিতির, কি হয়েছে তোমার? ফোন করলে তখন আমি মিটিং এ ছিলাম। পরে এতবার ফোন করলাম ধরলে না?”
তিতির গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এরকম তো আগেও হয়েছে।”
-“হ্যা কিন্তু আজ আমার মনটা কেমন করছিল! কি হয়েছে বলোতো?”
-“বাবা-মা, ভাইয়া সবাই আমার রুমে ছিল তাই ধরতে পারিনি।”
-“কেন তুমি কি অসুস্থ? আর ভয়েসটা এমন লাগছে কেন? দুপুরে তো সুস্থই ছিলে। কি হলো এর মধ্যে?”
-“বলবোনে, তুমি কোথায়?”
-“অফিসে।”
-“এখনো বাসায় যাওনি?”
-“না, ৮ টার মত বেজে যাবে বের হতে। অনেক কাজ। তুমি বলো না কি হয়েছে?”
-“বাসায় যাও তারপর বলবো।”
-“না তিতির আমার টেনশান হচ্ছে। বলো প্লিজ। নাহলে কাজে মন বসাতে পারবো না।”
-“নতুন কিছু না, তোমার আমার ব্যাপারটা নিয়েই বাসায় আবার একটু ঝামেলা হয়েছে।”
-“তিতির, তোমাকে কি মেরেছে?”
তিতিরের কান্না পেল। কি করে পারে ও সবকিছু বুঝতে? মুগ্ধ আবার বলল,
-“কি হলো চুপ করে আছো কেন? তোমাকে কি মেরেছে?”
তিতির ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
-“হ্যা।”
মুগ্ধ বুঝি কিছু একটা তে ঘুষি দিল। প্রচন্ড শব্দ হলো। আর বলল,
-“উফ! এটাই শুধু বাকী ছিল।”
মুগ্ধর গলাটা রাগে কাঁপছে। তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“কে মেরেছে? নাকি সবাই মিলে?”
-“মা।”
-“কি দিয়ে মেরেছে?”
-“স্কেল।”
-“কি এমন বলেছিলে?”
-“ডিটেইল টা রাতে বলি?”
-“আচ্ছা, তোমাকে কি অনেক মেরেছে?”
মুগ্ধ এমনভাবে বলল যেন ওর গায়ে ব্যাথা লাগছে। তিতির হেসে ফেলল। বলল,
-“মোটামুটি। কিন্তু তুমি আহ্লাদ করছো বলে ব্যাথাটা কমে যাচ্ছে।”
-“আমাকে শান্তনা দিও না তো।”
-“এখন তুমি সামনে থাকলে আমার কপালে একটা কিস করতে, তাইনা?”
-“ধুর! কি সময় কি কথা!”
-“আমাকে একটা কিস করো। দেখবে আমার অর্ধেকটা ব্যাথা চলে যাবে।”
-“ফোনের মধ্যে কিস করতে পারিনা আমি। ফোনে কিস করে লাভ কি? তুমি কি পাবে?”
-“হুম পাব।”
মুগ্ধ একটা কিস করলো। তিতির বলল,
-“তুমি এত দুষ্টু কেন বলোতো?”
-“কেন?”
-“এইযে কিস করতে বললাম কপালে আর করলে ঠোঁটে!”
মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এসব বলছে তা বুঝতে বাকী রইলো না মুগ্ধর।
ব্যাথায় কুঁকড়ে ছিল তিতির। রাতে খেতে গেল না। কেউ ডাকতেও এল না। ১০ টার দিকে ফোন দিল মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“বাসায় গিয়েছো?”
-“হ্যা।”
-“ফ্রেশ হয়েছো?”
-“হুম।”
-“খেয়েছো?”
-“তুমি তো জানো তিতির আমি এত তাড়াতাড়ি খাই না। যাই হোক, এখন তো বলো কি এমন বলেছিলে যে মা তোমাকে এত মারলো?”
সকালে মাকে প্রেগনেন্সির কথা বলা থেকে শুরু করে পুরো ঘটনাটা তিতির মুগ্ধকে খুলে বলল। শুধু মারের ব্যাপারটা ডিটেইলে বলল না। বললে শুধু শুধু অনেকটা কষ্ট পাবে মুগ্ধ।
সব শুনে মুগ্ধ বলল,
-“যেটুকু আশা ছিল রাতেও পানি ঢেলে দিলে।”
-“মানে?”
-“তোমার ফ্যামিলির কাছে তুমি আমাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিলে।”
-“কিভাবে? শেষে তো জানলোই যে আমি প্রেগন্যান্ট না।”
-“হ্যা, কিন্তু যেহেতু তুমি প্রেগনেন্সির কথা বলতে পেরেছো সেহেতু আমি তোমার সাথে করেছি। এটাই ভাবছে মা তুমি দেখে নিও।”
-“রাগ করোনা প্লিজ। আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে। আমি ভেবেছিলাম এবার রাজী হয়ে যাবে।”
-“তুমি আমার সাথে একবার ডিসকাস করে নিতে পারতে। তাহলে তো আমি নিষেধ করতাম।”
-“সরি, আসলে আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
-“হায়রে আমার সারপ্রাইজিং প্রিন্সেস রে! সবকিছুতেই কি সারপ্রাইজ দেয়া লাগে? লাগে না বরং লাইফের বড় বড় ডিসিশান দুজনে মিলে নিতে হয়।”
-“সরি, এমন আর কখনো হবে না। এরপর থেকে সবকিছু তোমার সাথে ডিসকাস করে করবো।”
-“সেই সুযোগটা তুমি পাবে কোথায়? আমার সাথে তো তুমি থাকতেই পারবে না। কদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে। আর আমারও।”
তিতিরের প্রচন্ড কান্না পেল। কিন্তু ও কাঁদল না। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, কাল একটু দেখা করবে?”
-“কখন?”
-“দিনের বেলায় তো পারব না। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হলেও ৫/৬ টা বাজবে। ধানমন্ডি যেতে আরো ১ ঘন্টা।”
-“তার মানে সন্ধ্যাবেলা। ঠিকাছে, পারব।”
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা ওদের দেখা হলো। তিতিরের সারাটা শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। হাটতেও কষ্ট হচ্ছে। তিতিরের গলির সামনে থেকে মুগ্ধ ওকে পিক করে নিল। তারপর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতেই তিতির বলল,
-“এখানে যাব না।”
-“তাহলে কোথায় যাবে বলো?”
-“কোন নদীর পাড়ে।”
-“কোন নদীর পাড়ই রাতের বেলা সেফ না। নদীর পাড়ে অন্য কোনদিন নিয়ে যাব।”
-“আমি কোন রেস্টুরেন্টে যেতে চাচ্ছি না। এমন কোথাও যেতে চাচ্ছি যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”
-“এমন যায়গা এখন কোথায় পাব?”
-“গাড়িতেই থাকি। গাড়িটা কোথাও পার্ক করো।”
-“কতক্ষণ থাকতে পারবে?”
-“৯ টা?”
-“বাসায় প্রব্লেম হবে না?”
-“আমার খোঁজখবর আজকাল সেভাবে কেউ রাখেনা। ভালমতো বুঝে গেছে আমি আর যাই করি পালাবো না। ৯ টার মধ্যে বাসায় না গেলে ফোন করবে।”
মুগ্ধ একটানে হাতিরঝিল চলে গেল। পৌঁছে জিজ্ঞেস করলো,
-“নামবে?”
-“না।”
মুগ্ধ অভ্যাসবসতই কথা বলতে বলতে তিতিরের একটা হাত নিজের কোলের মধ্যে নিচ্ছিল। তিতির হাতটা দিতে সংকোচ করছিল। কিন্তু ততক্ষণে মুগ্ধ দেখে ফেলেছে ওর হাতে মারের দাগ গুলো। নীল হয়ে আছে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে মুগ্ধর কান্না পেল। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
-“আর কোথায় মেরেছে?”
-“এতকিছু হিসেব করে কি মেরেছে? ইচ্ছেমত মেরেছে। পরে গিয়েছিলাম তাই পিঠেই বেশি লেগেছে।”
-“উল্টো ঘোরো।”
-“কেন?”
-“ঘোরো তুমি।”
মুগ্ধর চোখমুখ শক্ত। তিতির জানে কেন মুগ্ধ ওকে ঘুরতে বলছে। কিন্তু এখন ওর কথা না শুনলে তো তুলকালাম বাধাবে। তিতির এসব ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ তিতিরকে ধরে উল্টো ঘুরিয়ে চুলগুলো সরালো। সাথে সাথেই দেখতে পেল ঘারের উপর মারের দাগ। মুগ্ধ তিতিরের কামিজের চেইনে হাত দিতেই তিতির বলল,
-“কি করছো?”
-“একদম চুপ।”
তারপর মুগ্ধ চেইনটা খুলল। পুরো পিঠটা দেখে শিউরে উঠলো। পিঠে একফোঁটা যায়গা নেই যেখানে দাগ নেই। একটা দাগের উপর বাকা হয়ে পড়েছে আরেকটা দাগ। সারা শরীরটাই নীল হয়ে আছে। এটাকে মার বলে না। এটাকে বলে পেটানো। এলোপাথারি পিটিয়েছে ওকে। এই দৃশ্য দেখামাত্রই রাগে মুগ্ধর কপালের দুপাশের রগদুটো ফুলে উঠলো। দাঁতে দাঁত কাটলো। অতঃপর চোখ ভরে গেল জলে। চেইনটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বাইরে তাকালো। তিতির ওকে স্বভাবিক করার জন্য জড়িয়ে ধরলো। সেই ফাঁকে মুগ্ধর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই তিতির দেখার আগে তা নিজের হাতে মুছে ফেললো। তিতির বলল,
-“এই, এত কিপটামি করছো কেন? হোল্ড মি।”
-“ধরার জন্য যায়গা থাকা লাগবে তো। কোথাও তো বাদ রাখেনি।”
মুগ্ধর গলা কাঁপছিল। তিতির ওকে আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মুগ্ধও তিতিরকে খুব সাবধানী হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ ধরতেই তিতিরের পিঠে ব্যাথা লাগলো কিন্তু অন্তরে লাগলো হাজার ফুলের ছোঁয়া। তিতির বলল,
-“এরকম আরো হাজারবার মার খেয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায় তাহলে আমি তাতে খুশিমনে রাজী।”
মুগ্ধ বলল,
-“এইটুকুন একটা মেয়ে তোমার কত ধৈর্য! আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখী করবে দেখো।”
-“সেই সুখটা তুমি ছাড়া যেন না হয় সেই দোয়াটা করো!”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“হাসছো যে?”
-“এমনি।”
সেদিন বাসায় এসে রাতের বেলা লুকিয়ে চোখের জল ফেললো মুগ্ধ। ওর অসহায়ত্ব, অপারগতা আর মাথা গরম করে করা ভুলের কারনে আজ তিতির এতটা শাস্তি পাচ্ছে। নিজেকে মনে হলো নর্দমার কীট।
তারপর কদিন ধরে মুগ্ধ অনেক চিন্তাভাবনা করলো। তিতিরের সাথে ঠিকমতো কথা বলল না। দেখা করলো না। তাই সপ্তাহখানেক পর এক ছুটির দিনের সকালে তিতির হুট করে গিয়ে উপস্থিত হলো মুগ্ধর বাসায়। পিউ দরজা খুলে ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।
-“ভাবীইইইই! ওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভেতরে এসো।”
-“কেমন আছো পিউ?”
-“ভাল, তুমি কেমন আছো ভাবী?
-“আমিও ভাল। আন্টি কোথায়?”
-“মা রান্নাঘরে। দাঁড়াও, ডেকে আনছি।”
ততক্ষণে মা নিজেই চলে এল কে এসেছে দে জন্য। তিতিরকে দেখেই বলল,
-“ওমা, এ আমি কাকে দেখছি? আমার মা যে!”
তিতির সালাম দিয়ে বলল,
-“কেমন আছেন আন্টি?”
-“ভাল মা। তোমার চেহারাটা দিন দিন এমন কেন হয়ে যাচ্ছে মা? জীবনে যাই হয়ে যাক, সেটা তোমাকে দেখলে যেন কিছুতেই বোঝা যায় মা। একটু নিজের যত্ন নিতে হবে।”
-“চেষ্টা তো করি আন্টি।”
-“হুম। অলওয়েজ স্ট্রং থাকবে। আল্লাহ যা করে ভালর জন্যই করে।”
তিতির চুপ করে রইলো। মা আবার বলল,
-“চলো নাস্তা করবে।”
-“আন্টি আমি নাস্তা করে এসেছি। আমি এখন কিছু খাব না। দুপুরে ভাত খাব একসাথে।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে। মুগ্ধর কাছে যাও, ঘরেই আছে। ওঠেনি এখনো।”
একথা বলে আন্টি রান্নাঘরে চলে গেল। পিউ তিতিরকে টেনে নিয়ে গেল ভাইয়ের ঘরের সামনে। তারপর বলল,
-“যাও যাও, কেউ তোমাদের ডিস্টার্ব করবে না।”
তিতির লজ্জা পেল। পিউ আবার বলল,
-“আরে ধুরো, লজ্জা পেতে হবে নাগো ভাবি। তুমি যাও তো।”
পিউ চলে যেতেই তিতির দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। মুগ্ধ নেই ঘরে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ। ও ওয়াশরুমেই গেছে বোধহয় তাহলে। তিতির ব্যাগটা সোফার উপর রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আন্টি এভাবে বললো কেন, খুব কি চেঞ্জ এসেছে ওর মধ্যে?
মুগ্ধ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এল। বেড়িয়ে তিতিরকে দেখেই অবাক হয়ে গেল। তিতির ওর দিকে তাকাতেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। বলল,
-“তুমি কখন এলে?”
-“কিছুক্ষণ আগে।”
-“হঠাৎ?”
-“ফোন ধরছিলে না তো কি করবো? আমি থাকতে পারছিলাম না।”
মুগ্ধ টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিতে দিতে বলল,
-“আমাকে ছাড়াই তো থাকতে হবে সুন্দরী। থাকতে পারছোনা বললে তো আর হবে না।”
-“এভাবে বলছো কেন?”
তিতির দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তিতিরের উল্টো পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আমি এতদিন খুব সিরিয়াসলি চিন্তা করলাম সবটা নিয়ে। আমি আগেই জানতাম তান্না কখনো আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের আশায় ছিলাম, যদি কখনো তাদের মন গলে! কিন্তু তোমাকে যেদিন মারলো সেদিন থেকে আমি বুঝে গিয়েছি তাদের মন কখনো গলবে না। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের আর যোগাযোগ না রাখাই উচিৎ। সেটা আমাদের দুজনের জন্যই ভাল হবে।”
তিতির মুগ্ধর কাছে গিয়ে ওর বুকে হাত রেখে বলল,
-“এমন কথা বলোনা প্লিজ।”
-“আমি না ভেবে বলছি না। গত এক সপ্তাহ ধরে দিনরাত আমি এসব নিয়েই ভেবেছি তিতির।”
-“বাবা-মা না মানলে কি? আমরা আমাদের মত সম্পর্ক রাখবো। সেটা তো আর তারা আটকাতে পারবে না।”
-“না তিতির, এভাবে সম্পর্ক রাখা যায়না।”
তিতিরের কান্না পেয়ে গেল। বলল,
-“তুমি এরকম কথা বলছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
-“আমি রিয়েলিটি যা তাই বলছি।”
-“তুমি যখন কাউকে বিয়ে করবে তখন আমি নিজেই সরে যাব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তো সম্পর্ক রাখাই যায়।”
-“আমি কখনো বিয়ে করবো না”
-“আমিও তো করবো না। তাহলে সম্পর্কটা রাখতে দোষ কি?”
-“দোষ আছে। তোমার সাথে কথা বললে আমি কন্টিনিউয়াসলি কথা না বলে থাকতে পারিনা। তোমার সাথে দেখা করলে ডেইলি দেখা করতে ইচ্ছে করে। তোমার একটু কাছে গেলে আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করে।”
-“তাতে সমস্যাটা কি? আমি কি তোমাকে কিছুতে নিষেধ করেছি?”
-“না কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে স্মৃতির পাল্লা ভারী হচ্ছে।”
তিতির এবার কেঁদেই ফেললো। মুগ্ধ বলল,
-“কাঁদছো কেন? কেঁদে কি হবে? কাঁদলে যদি সমস্যা মিটে যেত তো দুজন মিলে কাঁদতাম। কিন্তু মিটবে না, কান্না থামাও নাহলে আমি কথা বলতে পারবো না। আমি এই কথাগুলো তোমাকে দু’তিন দিনের মধ্যেই বলতাম। তুমি আজ আসায় আজ বলছি।”
সবসময়ই তিতির কাঁদলে মুগ্ধ পাগল হয়ে যায়, চোখ মুছিয়ে দেয়, বুকে নিয়ে আদর করে কান্না থামায়। আর আজ ও কত স্বাভাবিক। বন্ধ ঘরের মাঝেও দূর থেকে এসব বলছে! একবার চোখটাও মুছিয়ে দিচ্ছে না! এই কি তিতিরের চেনা মুগ্ধ! পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়লো তিতিরের মাথার উপর। তিতির মুগ্ধকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
-“তুমি এভাবে বলোনা। আমার তোমাকে অচেনা লাগছে।”
-“না আমি বলবো। যত কষ্টই হোক তিতির বাস্তবতাটা ফেস করতেই হবে।”
তিতির কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। মুগ্ধ একটু থেমে আবার বলল,
-“ধরো সিলেটে আমরা যেভাবে ছিলাম, আমি যা পেয়েছি আসার পর থেকে তা আমার প্রতিদিন পেতে ইচ্ছে করে। একটা রাত আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি। সম্পর্ক থাকলে আমাদের মধ্যে আরো অনেক কিছু হবে কারন, এখন আমাদের মধ্যে কন্ট্রোলটা নেই বললেই চলে। আগে আমরা জানতাম একদিন না একদিন আমরা দুজন দুজনের হবোই। তাই তুমিও আগে সবকিছুতেই বাধা দিতে, আমিও তোমার বাধা শুনতাম। শত ফাজলামো করলেও কখনোই সেভাবে আগাইনি। আর এখন যখন দুজনেই জানি আমাদের এক হওয়াটা আর কখনোই সম্ভব না, তখন তুমিও কিছুতেই বাধা দাও না আর আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। পাগল হয়ে গিয়েছি দুজন দুজনের জন্য। কন্ট্রোললেস হয়ে গিয়েছি। শুধু মনে হয় আর তো পাব না, এই শেষ। অসম্পূর্ণ, অনিশ্চিত সম্পর্কগুলো এমনই হয়।”
তিতির চুপচাপ সব শুনছে আর কাঁদছে। মুগ্ধ আবার বলল,
-“তিতির, যতই বলি বিয়ে করবো না বিয়ে করবো না বিয়ে আমাদের করতেই হবে। কারন আমাদের ফ্যামিলি। তোমার যে ফ্যামিলি! এমন কিছু করবে যে তুমি বাধ্য হবে বিয়ে করতে। আর আমার মা! সে তো প্রতিনিয়ত আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এখনো সাকসেসফুল হয়নি কিন্তু কবে যে হয়ে যাবে জানিনা। বিয়ে আমাদের দুজনেরই করতে হবে তিতির কিন্তু যে কোন একজনের আগে হবে। সেই দিনটি হবে আমাদের দুজনের জীবনের সবচেয়ে অসহ্যকর দিন। সেদিন আমরা দুজনই থাকবো অসহায়। অসহায়ত্বের চেয়ে কষ্টের কিছু নেই এই পৃথিবীতে। আমরা যদি এর পরেও সম্পর্ক রাখি তাহলে আরো ক্লোজ হতে থাকবো। তখন ওই দিনটি ফেসই করতে পারবো না তিতির।”
তিতির ঝাঁপিয়ে পড়লো মুগ্ধর বুকে। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তুমি এমন করোনা প্লিজ। যতদিন একসাথে থাকা যায় আমরা থাকিনা প্লিজ? যতটুকু পাব ততটুকুতেই তো শান্তি।”
মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো না। বলল,
-“না তিতির, শান্তি নেই। আমি নিশ্চিন্তে তোমাকে আদর করতে পারিনা। মন খুলে কথা বলতে পারিনা। সবসময় হারানোর ভয়, অতঙ্ক। এভাবে পারছি না আর। এই ঝুলন্ত অবস্থার একটা শেষ হওয়া চাই।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো। মুগ্ধর হাটু জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। আমি মরে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরকে উঠালো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিতিরকে এভাবে কষ্ট দিতে ওর বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুগ্ধ শক্ত করলো নিজেকে। অনেকক্ষণ পর তিতির নিজেই উঠে দাঁড়ালো। কান্না আরো বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই মুগ্ধর বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই তুমি দেখছো না আমি কাঁদছি?”
মুগ্ধ চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তিতির উন্মাদের মত মুগ্ধর হাতদুটো দিয়ে নিজের চোখের জল মুছিয়ে বলল,
-“আমার চোখের পানি মুছে দাওনা। দাওনা মুছে।”
মুগ্ধ ওর চোখের পানিও মুছে দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তিতির এবার মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। একটু পর মুগ্ধর হাতদুটো নিজের কোমরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ধরো না আমাকে।”
মুগ্ধ ধরলো না। তিতিরের কান্না থামলোই না। আবার বলল,
-“এমন করোনা, আমি মরে যাব। প্লিজ এমন করোনা। আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা। আমাকে ছোড়ো না।”
মুগ্ধ এতক্ষণে বলল,
-“তাহলে তুমি ছাড়ো, তোমার ফ্যামিলিকে!”
তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ আরো বলল,
-“হ্যা যেহেতু তারা অপশন দিয়েই দিয়েছে হয় ফ্যামিলি নাহয় আমি। দেন ইউ হ্যাভ টু পিক অনলি ওয়ান।”
তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিছু বলল না শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ বলল,
-“তুমি আজ আর যেওনা। আজই বিয়ে করবো। তাহলেই তো আমাদের আর দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে হবে না।”
-“তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?”
-“যদি তাই ভাবো তবে তাই।”
তিতির চোখ মুছলো। বিশেষ লাভ হলোনা, সংগে সংগে আবার গাল ভিজে গেল নতুন চোখের জলে। বলল,
-“আমি জানি আমার ফ্যামিলির কাছে তুমি অনেক অপমানিত হয়েছো। তোমার তাদের উপর রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু তো আমার ফ্যামিলি। আমি রাগ করতে পারিনা, উল্টো আমার ফ্যামিলি নিয়ে তুমি কিছু বললে আমার গায়ে লাগে। এখন যাই ব্যবহার করুক, ছোটবেলা থেকে যে ভালবাসা আর সাপোর্ট দিয়েছে তা আমি ভুলতে পারিনা। আর সবাই যেমন তেমন আমার বাবার জন্য আমি পারিনা। আর তুমি যে ভালবাসাটা আমাকে দিয়েছো তা সব মেয়েদের স্বপ্ন থাকে। তুমি আমার রক্তে মিশে গেছো, তা থেকে আলাদা করতে পারবো না কিছুতেই। তাই বাবা আর তুমি দুজনকেই আগলে থাকতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো তুমি! আর করতে হবে না। আজ থেকে তুমি ফ্রি।”
একথা বলেই তিতির ব্যাগটা সোফার উপর থেকে তুলে বেড়িয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। মুগ্ধ বলল,
-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“বাসায়।”
-“দাঁড়াও, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
তিতির পিছনে ফিরে তাকিয়ে হেসে বলল,
-“লাগবে না, আমি চলে যেতে পারবো।”
তিতিরের চোখ উপচে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা আমি জানি তুমি একা যেতে পারবে কিন্তু যেহেতু তুমি আমার বাসায় এসেছো, আমার একটা দায়িত্ব আছে।”
-“নাহ, আমার প্রতি আজ থেকে তোমার আর কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। অনেক দিয়েছো তুমি আমাকে, কোনদিনও ভুলবো না।”
কথা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে গেল। ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মা বলল,
-“তিতির, তুমি কাঁদছ কেন মা?”
-“আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। মাফ করবেন বলেছিলাম দুপুরে একসাথে খাব। সেটা এখন আর সম্ভব না।”
ততক্ষণে মুগ্ধ বেড়িয়ে এসেছে ঘর থেকে। তিতির বেড়িয়ে যেতেই মা পেছন পেছন যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ওকে যেতে দাও মা।”
মুগ্ধ আটকালো না তিতিরকে। ওর মা এসে আচমকাই ওর গালে একটা চড় মারলো। মুগ্ধ আকাশ থেকে পড়লো! মা শেষ কবে ওকে মেরেছিল মনে করতে পারছে না। পিউ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। মুগ্ধ বলল,
-“এটা কি হলো?”
মা বলল,
-“তুই মেয়েটাকে এভাবে কাঁদালি কেন?”
-“মা মাঝেমধ্যে না আমি তোমাকে বুঝেও বুঝিনা। এমনিতে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকো। সারাদিন রাত আমাকে বলতে থাকো বিয়ে কর, বিয়ে কর। আর আজ তিতিরকে কাঁদিয়েছি বলে তুমি আমাকে মারলে?”
-“না বোঝার কি আছে? আমি তো তিতিরকে খুব পছন্দ করি। ওর মত লক্ষী, ধৈর্যশীল আর সংসারী মেয়ে খুব কমই হয়। ও তোর বউ হলে মরেও নিশ্চিন্তে থাকতাম। কিন্তু তিতিরের ফ্যামিলি তো কোনদিন ওকে তোর সাথে বিয়ে দেবে না। সেজন্যই আমি তোকে বিয়ে দিতে চাই। বয়স কি কম হয়েছে?”
-“কমই তো, মাত্র ৩১ গেল।”
-“তোর বাপ এই বয়সে এক ছেলের বাবা হয়েছিল।”
“হ্যা কিন্তু বাবা তো..”
কথা শেষ করতে দিল না মা। তার আগেই বলল,
-“আরেকটা চড় মারবো এটা নিয়ে কথা প্যাঁচালে।”
মুগ্ধ থেমে গেল। মা বলল,
-“যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল”
মুগ্ধ বলল,
-“কোনটা?”
-“কি হয়েছে? ও ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল কেন?”
-“মা আজ আমি ওর সাথে অনেক কড়া কথা বলেছি। অনেক কষ্ট দিয়েছি ওকে।”
-“কেন?”
-“দরকার ছিল এটার।”
-“কি বলছিস তুই? মেয়েটা সারাক্ষণ ফ্যামিলি থেকে কষ্ট পায়, কোথায় তুই একটু সাপোর্ট দিবি তা না তুই উল্টো কষ্ট দিচ্ছিস আর বলছিস দরকার ছিল?”
-“হ্যা দরকার ছিল। এবার ও খুব শীঘ্রই চলে আসবে আমার কাছে। যেটা ও এতদিন পারছিল না।”
-“এত সিওর হচ্ছিস কি করে?”
-“আমি ওকে খুব ভালভাবে চিনি মা। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। আজ আমি আঙুল বাঁকিয়েছি, এখন শুধু ঘি ওঠার অপেক্ষা।”
-“এজন্যই বলে ছেলেরা অমানুষ। মেয়েদের নিয়ে বাজী খেলতে ওরা একটুও ভাবে না।”
-“হ্যা মা, তুমি ঠিক বলেছো। ছেলেরা অমানুষই হয়। কারন, তাদের কাছে প্রিয়জনের একদিনের হাসির চেয়ে সারাজীবনের সুখটা বেশি ইম্পরট্যান্ট। আর তার জন্য তারা সবকিছু করতে পারে।”
একবুক কান্না মুগ্ধর গলায় এসে আটকে গেল। মায়ের এবার কষ্ট হলো। কাছে এসে মুগ্ধর গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“একবার দেখেছো ওর গায়ের দাগগুলো? এমন মার মেরেছে শরীরের একটা যায়গাও বাদ রাখেনি। কি অমানুষিক নির্যাতন করেছে ভাবতেও পারবে না।”
মা অবাক হয়ে বলল,
-“সেকি! কে মেরেছে? কবে মেরেছে? কই আমিতো কোন দাগ দেখলাম না।”
-“সপ্তাহখানেক আগে ওর মা মেরেছে ৩ ফিট লম্বা স্কেল দিয়ে। পুরো শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। এখন কি অবস্থা জানিনা। ফুলহাতা জামা পড়েছে বলে দেখতে পাওনি।”
-“ইশ।”
মায়ের চোখ ছলছল করছিল, মুগ্ধরও। মুগ্ধ বলল,
-“যেদিন মেরেছে তার পরদিনই আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম মা। ওকে দেখে এসে থেকে আমার মাথা খারাপ হয়েছিল। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। অথচ মেয়েটা হাসিমুখে আমাকে শান্তনা দিচ্ছিল। কিভাবে পারলো এরকম একটা মেয়েকে এভাবে আঘাত করতে? বলো না মা এমন ফ্যামিলি কখনো দেখেছো তুমি? আজ মেরেছে কাল এর থেকে খারাপ কিছু করবে। আমি আর ভরসা করতে পারছি না ওকে ওর ফ্যামিলির কাছে রেখে। আবার নিয়ে আসার অধিকারও নেই। কি করবো বলো? তাই আমি এটাই চেয়েছি হয় ও ফ্যামিলিকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসুক নাহয় ওর ফ্যামিলির কাছেই থাকুক, তারা মারুক কাটুক যা খুশি তাই করুক.. জানবোও না অসহায়ত্বেও ভুগবো না। অপশন দুটো অথচ চুজ করতে হবে একটা। অপশন কিন্তু আমি দিইনি, ওর ফ্যামিলি দিয়েছিল কিন্তু আমরা মানছিলাম না। খুব বড় ভুল ছিল সেটা আমাদের। যে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই সেই সম্পর্ক এভাবে চলতে পারেনা মা। এর তো একটা শেষ হওয়ার দরকার ছিল। করে দিলাম শেষ। বাট শি উইল কাম ব্যাক।”
মা মুগ্ধর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
-“হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। বি স্ট্রং।”
-“আমি তো স্ট্রং ই মা। খুব স্ট্রং, পাথরের মত। দেখলে না যার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি আমি গড়াতে দিইনি আজ তার চোখের হাজার ফোঁটা জল ঝরলাম। আমি সবই পারি মা।
তিতির মুগ্ধর বাসা থেকে বের হয়েই একটা সিএনজি নিল। চোখের পানি মুছে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ এতটা বদলে গেছে? সত্যি বদলে গেছে নাকি অন্যকিছু? মাথায় কিছু ঢুকছে না। মুগ্ধ এতটা নিষ্ঠুর কবে হলো? হ্যা অন্যদের সাথে মুগ্ধর নিষ্ঠুরতা ও আগে দেখেছে কিন্তু ওর সাথে? কি করে পারলো মুগ্ধ। একবার চোখটা মুছিয়ে দিল না! ওর হাতদুটো কোমরে রাখার পর ও জড়িয়ে না ধরে হাত সরিয়ে নিল! ব্ল্যাকমেইল করলো! কিন্তু মুগ্ধ তো জানে তিতির শুধু বাবার জন্যই যেতে পারেনা। পৃথিবীর সবাই জাহান্নামে যাক কিন্তু মুগ্ধ কেন ওকে বুঝবে না? ওর সবকিছু বোঝার মানুষ যে এখন একমাত্র মুগ্ধই ছিল। আজ সেও কিনা বুঝে না বোঝার ভান করলো। ঠিকই আছে, মুগ্ধ কত কষ্ট করেছে ওর জন্য! বিনিময়ে কিছুই তো পেল না। আর কত কষ্ট করবে? একদম ঠিক কাজ করেছে মুগ্ধ। এসব ভাবতে ভাবতেই কাঁদছিল আর ওড়নায় চোখ মুছছিল তিতির। কিন্তু যতই মুছছে সাথে সাথে আবার ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো।
দুপুর নাগাদ তিতির বাসায় ফিরলো। বাবা, ভাইয়া নামাজ পড়তে গিয়েছে। ভাবী ড্রইং রুমে টিভি দেখছে, মা বোধহয় গোসলে। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকালো তিতির। মুগ্ধর দেয়া সব জিনিসগুলো বের করে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল কতক্ষণ। কাঁদতে কাঁদতেই মুগ্ধর ছবি বের করলো। এই একটা ছবিই আছে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, কালো টি-শার্ট পড়া। চোখে সানগ্লাস। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কি সুন্দর করে হাসছে, হাসিটা দেখলেই বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করে। তিতির ছবিটাতে অসংখ্যবার চুমু খেল পাগলের মত। তারপর মুগ্ধর পাঠানো মেসেজগুলো বারবার পড়লো। ভয়েস রেকর্ডগুলো প্লে করতেই তিতিরের এতক্ষণের নীরব কান্নাটা ভয়ঙ্কর কান্নায় পরিণত হলো। চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাবী দরজায় নক করলো। কান্নার আওয়াজ পেয়ে এসেছে। তিতির দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ভাবীকে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“ভাবী, ভাইয়াকে একটু রাজী করাও না। তুমি বললে ভাইয়া মানবে। মুগ্ধকে ছাড়া তো আমি বাঁচবো না কেউ বোঝে না কেন?”
ভাবী জড়িয়ে ধরে বলল,
-“পাগলী মেয়ে! তুমি তো জানো তোমার ভাইয়া আমার কোন কথাই শোনে না। তবু আমি ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি।”
মা ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ রেডি করতে করতে বলল,
-“এত কান্নাকাটি কিসের?”
তিতির দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“মা, মাগো.. আমাকে তুমি মেরে ফেলো মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মুগ্ধকে ছাড়া আমার লাইফ ইম্পসিবল।”
মা স্বাভাবিক মুখে বলল,
-“তাহলে মরেই যা। আজিমপুরে রেখে আসবো।”
তিতিরের বলতে ইচ্ছে হলো, ‘আমি কি আসলেই তোমার নিজের পেটের মেয়ে?’
কিন্তু বলতে পারলো না। মা বলল,
-“প্লেট, গ্লাস গুলো টেবিলে সাজিয়ে দে যার যার যায়গামত।”
তিতির দেখলো ৫ টা প্লেট ৫ টা গ্লাস টেবিলের এক কোনায় রাখা। রাগ সংবরণ করতে একটা গ্লাস উঠিয়ে মাটিতে ছুড়ে ভেঙে ফেলল তিতির। মা বলল,
-“আরো চারটা আছে।”
তিতির প্লেটগুলো হাতে উঠিয়ে আছাড় মেরে ভাঙলো। মা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। তারপর তিতির এক হাতে সবগুলো গ্লাস ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেললো। মা বললো,
-“যা যা ভাঙলি সব তোর বাপের টাকায় কেনা তাই টের পেলি না। এক পয়সা আয় করার যোগ্যতা তো নেই নষ্ট করার যোগ্যতা খুব ভালভাবে আছে। যা পরিস্কার কর।”
চম্পা বলল,
-“খালা, আমি সব পরিস্কার করতাসি।”
-“না তুই করবি কেন? তুই কি নোংরা করেছিস? যে নোংরা করেছে সে পরিস্কার করবে।”
তিতির পানিসহ পানির জগটাও আছাড় মেরে ভাঙলো। তারপর ভাঙা কাঁচের উপর দিয়ে হেটে চলে গেল নিজের ঘরে। পায়ের মধ্যে যে কতগুলো কাঁচের টুকরো ঢুকেছে! প্রথম যখন ভাঙা কাচের উপর পা ফেলল তখন যা ব্যাথা না লাগলো তার চেয়ে অনেক বেশি লাগলো পরের স্টেপগুলোতে। প্রত্যেকবার পা ফেলার সময় ভাঙা কাচের টুকরোগুলো একটু একটু করে ভেতরে ঢুকছিল। ঘরের দরজা লাগিয়ে ওখানেই বসে পড়লো তিতির। বাম পা টা কোলের মধ্যে নিয়ে একটা একটা কাচ বের করছিল আর সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তারপর একইভাবে ডান পায়ের নিচের কাচগুলোও বের করে ফেলল তিতির। রক্তে লাল হয়ে গেছে জামাকাপড়, ফ্লোর সবকিছু। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠে আলমারি থেকে একটা ওড়না বের করে দু’টুকরো করলো। তারপর তা দিয়ে পা’দুটোকে বেধে নিল। তারপর চোখের পানি মুছে নিল। ওর সবকিছু এখন থেকে ওরই করতে হবে। এই পৃথিবীতে আজ আর ওর বলে কেউ নেই। সবাই যার যার।
সেদিন থেকেই তিতির একটা চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো। মায়ের খোঁটাটা দিনরাত শুধু কানে বাজে। দেখতে দেখতে তিতিরের মাস্টার্স শেষ হয়ে গেল। তারপর একটা চাকরিও পেয়ে গেল। প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েই তিতির যা যা ভেঙেছিল তা তা হুবহু ডিজাইনের এক সেট করে কিনে নিয়ে এল। মা দেখে নির্বিকার রইলেন।
এখন তিতিরের দিনকাল ব্যস্ততায় কাটে। সকালে অফিসে যায় সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। প্রায় একটা বছর পার হয়ে গেছে। সেদিনের পর আর একদিনও কথা হয়নি মুগ্ধর সাথে। না মুগ্ধ ফোন করেছে, না তিতির। বাবা মা তিতিরের বিয়ের জন্য এক ছেলেকে ঠিক করেছে, তান্নার বন্ধু। যে প্রায়ই বাসায় আসে আর তিতিরকে তার সামনে বসে থাকতে হয়। ছেলেটির নাম সুহাস। সুহাস ইঞ্জিনিয়ার, বেশ স্মার্ট, সুন্দর দেখতে, নম্রভদ্র। যেমনটা তিতিরের ফ্যামিলি চেয়েছিল। সুহাস যখন কথা বলে তিতির তা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না, শোনেই না। মুগ্ধর কথা ভাবতে থাকে। সুহাস যতক্ষণ সামনে থাকে তিতিরের মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। প্রতিদিন রাতে ফোন করে তিতির হাই হ্যালো করে ঘুমের ভান করে তখন সুহাস নিজেই ফোন রেখে দেয়। সুহাস আর ওর ফ্যামিলি যখন প্রথম দেখতে আসে তিতিরকে তখনই পছন্দ করে ফেলে। আর সুহাসের মা ওকে আংটি পড়িয়ে দেয়। সেদিনই সুহাসকে তিতির মুগ্ধর কথা সবটা খুলে বলেছিল। সব শোনার পর ও বলেছিল,
-“আমি এসব আগে থেকেই জানি। তান্না বলেছিল আমাকে।”
-“আপনি সব জেনেও আমাকে বিয়ে করবেন?”
সুহাস হেসে বলেছিল,
-“হ্যা, না করার তো কারন দেখছি না। বিয়ের আগে রিলেশনশিপ সবার থাকে। আমারও গার্লফ্রেন্ড ছিল। এনিহাও ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে, এখন আমি কি তার জন্য চিরকুমার হয়ে বসে থাকবো? সেটা তো আর সম্ভব না।”
-“আমাদের রিলেশনশিপ টা আজকালকার টিপিক্যাল রিলেশনশিপের মত ছিল না। অন্যরকম ছিল, আমি কখনোই ভুলতে পারবো না ওকে।”
-“এরকম মনেই হয় তিতির। কিন্তু বিয়ের পর সব অন্যরকম হয়ে যায়। সময় সব ঠিক করে দেয়।”
-“কিছুই ঠিক হবেনা, আমি জানি। আপনি কি এটা মেনে নিতে পারবেন যে আপনার স্ত্রী অন্য একজনকে ভালবাসে?”
-“তুমি বয়সেই বড় হয়েছো তিতির বাট স্টিল ইউ টক লাইক আ টিনেজার।”
-“যাই হোক, আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে পারবো না। আগে ওর বিয়ে হবে তারপর আমি বিয়ে করবো। ততদিন অপেক্ষা করতে পারবেন?”
-“তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবো।”
-“প্রথমদিনেই এরকম সিনেমার ডায়ালগ দিচ্ছেন কি করে?”
-“ওয়েল, প্রথম দিন হতে পারে আমাদের দেখা হওয়ার কিন্তু আমি তোমাকে অনেকদিন আগেই দেখেছিলাম। তখন তুমি বোধহয় ভার্সিটিতে পড়ো কেবল। সেদিনই তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম।”
তিতির আর কথা বাড়ায়নি। শেষে বলেছিল,
-“ঠিকাছে অপেক্ষা করেন। ওর বিয়েটা হয়ে গেলেই আমাদেরটাও হবে।”
-“ওকে আমার কোন তাড়া নেই। আমার শুধু তোমাকে পেলেই হবে।”
কিন্তু আজও তিতির প্রতিটা রাত মুগ্ধর সাথে কথা বলার তৃষ্ণা মেটায় পুরোনো ভয়েস রেকর্ডিং শুনে। আদরের তৃষ্ণা মেটায় পুরোনো আদরের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে। কোনদিন এসব ভেবে খুব ভাল লাগে কোনদিন আবার প্রচন্ড কান্না পায়। কোনদিন মিটিমিটি হাসে, কোনদিন কাঁদে। মাঝেমাঝে ভাবে একটা মিরাকল কি হতে পারে না? এভাবেই কাটছে তিতিরের জীবন।
আর মুগ্ধর প্রতিটি দিন কাটে অফিসের কাজের ব্যস্ততায়। আর রাত কাটে তিতিরকে ভেবে। একমাত্র মুগ্ধর বালিশটাই জানে মুগ্ধর চোখেরও জল গড়ায়। আজও মুগ্ধ অপেক্ষায় আছে তিতিরের।
মুগ্ধ ঘুমিয়ে ছিল। দিনটি শুক্রবার, অফিস নেই তাই বেশিক্ষণ ঘুমানো। হঠাৎ বুকের ভেতর কোন তপ্ত ছোঁয়া অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো তিতির ওর বুকের মধ্যে শুয়ে আছে। মুগ্ধও তিতিরকে আরো ভাল করে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে লাগলো। এ আর নতুন কি! মুগ্ধর প্রতিদিনকার স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো তাপটা যেন বেশি। আবার চোখ মেলে তাকালো। ঘুমটাকে ঝেড়ে ফেলে আবার তাকালো। এটা তো স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তব। প্রচন্ড গরম তিতিরের শরীর। কপালে, গলায় হাত দিল। জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে তিতিরের। মুগ্ধকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে তিতির হেসে ঘোর লাগা অসুস্থ স্বরে বলল,
-“আমি চলে এসেছি।”
মুগ্ধ বলল,
-“চলে এসেছো মানে? আর এত জ্বর নিয়ে এলেই বা কিভাবে?”
তিতির মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে জ্বরের ঘোরেই বলল,
-“তোমার এই স্লিপ্পি ভয়েসটা না খুব সেক্সি। কতদিন পর শুনলাম! আমি খাব।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তিতিরের দিকে।
তিতিরের শরীর প্রচন্ড গরম। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে। ও বোধহয় জ্বরের ঘোরে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি তাই চলে এসেছে। জ্বর কমলে, ঘোর কাটলে তো চলেই যাবে। শুধু শুধু মায়া বাড়াতে এল মেয়েটা!
-“এই দাওনা। খাবোতো!”
মুগ্ধর ঘোর কাটলো। বলল,
-“কি দেব?”
-“তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েসটা।”
-“ভয়েস কি খাওয়া যায় পাগলী?”
-“হুম খাওয়া যায়, আচ্ছা তোমাকে দিতে হবে না, আমি নিয়ে নিচ্ছি।”
একথা বলেই তিতির মুগ্ধর গলায় একটা গভীর চুমু খেল। মুগ্ধর চোখদুটো আবেশে বুঁজে গেল। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। প্রায় এক বছর পর! ভালবাসা এমন কেন হয় আজ এতবছর পরেও মনে হয় যেন প্রথম স্পর্শ!
কিছুক্ষণ পর তিতির টায়ার্ড হয়ে মুগ্ধকে ছেড়ে বালিশে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,
-“একা একা কেন এলে? আমাকে ফোন করতে আমি নিয়ে আসতাম।”
তিতির সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,
-“এই আমকে আজকেই বিয়ে করবে?”
-“সে সব পরে হবে, আগে বলো এত জ্বর নিয়ে এলে কেন?”
-“তোমার কাছে না এলে আমার জ্বর কি কোনদিনও ভাল হতো? হতো না, এখন তোমার কাসে এসেছি এক্ষুনি ভাল হয়ে যাব।”
কথাগুলো বেঝে বেঝে যাচ্ছিল। সেই পুরোনো অনুভূতি। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেমন একটার উপর একটা পরে লাফালাফি করে তেমনটাই ওর বলা প্রতিটি শব্দ একটার উপর আরেকটা পরে লাফালাফি করছে দুরন্ত বালিকার মত। “র” গুলো শোনাচ্ছে অনেকটা “ল” এর মত। বাচ্চা একটা! মুগ্ধ বলল
-“তুই এত পাগলী কেন রে?”
-“তুমি একটা পাগল যে তাই আমি একটা পাগলী!”
বলেই হিহি করে হেসে দিল তিতির। মুগ্ধর মনে হল এ যেন হাসি নয়, প্রচন্ড গরমের তাপদাহের পর কালবৈশাখীর উন্মাদ হাওয়া! হাসতে হাসতে তিতির পরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুহাতে তিতিরকে আলিঙ্গন করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“চোখমুখ এত শুকিয়ে গিয়েছে কেন? খাওনা ঠিকমতো?”
-“খাওয়া মজ্জা না।”
-“থাপ্পড় দিব একটা ধরে।”
তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“সকালেও নিশ্চই কিছু খাওনি।”
-“খেয়েছি তো।”
-“কি খেয়েছো?”
-“তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েস! উম্মম্মম্ম! ইয়াম ইয়াম, মজ্জা মজ্জা!”
মুগ্ধর হাসি পেল। বলল,
-“চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
-“নাহ নাহ নাহ, আমি তোমাক্কে খাবো!”
মুগ্ধ এবার না হেসে পারলো না। বলল,
-“আমাকে তো খালি পেটে খেতে পারবে না। আগে কিছু খেয়ে নাও তারপর আমাকে খেয়ো।”
-“ওহ তাই তো। মিষ্টি তো খাওয়ার পরে খেতে হয়।”
-“হুম। তুমি শুয়ে থাকো, আমি আসছি।”
মুগ্ধ উঠে ফ্রেশ হয়ে একটা টি-শার্ট পড়ে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই দেখলো স্নিগ্ধ ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে। মুগ্ধকে দেখেই স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাইয়া ভাবীর কি অবস্থা? দেখে খুব অসুস্থ লাগছিল।”
-“ওর মারাত্মক জ্বর।”
-“আমারও দেখে সেটাই মনে হচ্ছিল।”
-“আমি দরজা খুলতেই ভাবী বলে, ‘স্নিগ্ধ আমি একেবারে চলে এসেছি।’ আসল ঘটনা কি ভাইয়া?”
-“আমাকেও তাই বলছে। গড নোজ কি হয়।”
-“বলো কি? ওর ভাই যদি আবার ঝামেলা করে?”
-“করলে করুক, রাস্তার কুকুরদের আমি ভয় পাই না। কিন্তু তিতিরের উপর অত্যাচার করে এটাই আমার ভয়।”
-“সেটাই তো ভাইয়া। আর আম্মুও ঢাকায় নেই এই সময়।”
-“মা যেন কবে আসবে?”
-“পরশু আসার কথা।”
-“আচ্ছা আমি কথা বলে নিচ্ছি মায়ের সাথে। আর পিউ কোথায়?”
-“পরশু আপুর র্যাগ ডে না? এরেঞ্জমেন্ট করছে। কাল রাতে না বলল সকাল সকাল ও বেড়িয়ে যাবে। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও চলে গেছে।”
-“ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে।”
-“বুয়া এসে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে। তুমি আর ভাবী খেয়ে নাও।”
-“হুম।”
মুগ্ধ দেখলো ডাইনিং টেবিলে কিছুই নেই। স্নিগ্ধ বলল,
-“নাস্তা রান্নাঘরে বোধহয়।”
মুগ্ধ রান্নাঘরে ঢুকলো। হটপটে রুটি রাখা। পাশেই সবজি আর ডিমের অমলেট। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। কে বলেছে বুয়াকে এত আগে আগে অমলেট করতে। সব পান্তা হয়ে গেছে। মুগ্ধ ঠান্ডা অমলেটগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দুটো কাঁচা ডিম বের করে পোচ করতে করতেই তিতির চলে এল রান্নাঘরে। পেছন থেকে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরতেই মুগ্ধ চমকে উঠলো। বলল,
-“আরে, তুমি অসুস্থ শরীরে রান্নাঘরে কেন আসলা রে বাবা?”
-“আমি আর তোমাকে ছাড়া আর থাকবো না তাই চলে এসেছি। জানো আমি এতদিন তোমাকে ছাড়া অনেক কষ্টে ছিলাম।”
একথা বলে কেঁদেই ফেলল তিতির। মুগ্ধ চুলা বন্ধ করে পেছনে ফিরে তিতিরের চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-“আমি জানি।”
-“আর আমিও জানি যে তোমারও কতটা কষ্ট হয়েছে।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“হয়েছে এবার খেয়ে নাও পাখিটা।”
তিতির মুগ্ধর বুকে কামড় দিতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আরে কামড়াচ্ছো কেন?”
-“তুমি যে খেতে বললা?”
-“আমাকে পরে, আগে রুটি খাও। চলো রুমে চলো।”
তিতির কেবিনেটের উপর উঠে বসলো। তারপর পা ঝোলাতে ঝোলাতে বলল,
-“আমি যাব না। এখানে বসে খাব।”
-“এখানে গরম। রুমে চলো।”
-“আজ আমি কোথাও যাব না-হুমায়ুন আহমেদ স্যারের এই বইটা পড়েছো?”
-“পড়েছিবাবা। চলো তো।”
-“আজ আমি কোথাও যাব না। এখানে বসে খাব নাহলে খাব না।”
অবশেষে মুগ্ধ তিতিরের কথাই মেনে নিল। রান্নাঘরে বসেই তিতিরকে খাইয়ে দিল। তিতির বলল,
-“আমাকে ডিম দিবেনা। জানোনা আমি ডিম খাইনা।”
-“আচ্ছা এই দেখো, শুধু সবজি দিয়েছি।”
তিতির মুখে নিয়ে বলল,
-“এহ সবজিটা একদম মজা হয়নি। পচা পচা পচা। আমি খাবো না।”
-“আরে বাবা, পচা না, তোমার জ্বর তাই মজা লাগছে না।”
-“মা রান্না করলে অন্নেক মজা হয়। দ্মন পচা হয়না। মা কোথায়? মাকে দেখছি না কেন? আমি মায়ের কাছে যাব।”
তিতির নেমে গেল। মুগ্ধ হাত ধরে থামিয়ে বলল,
-“এই শোনো, মা বাসায় নেই কুমিল্লা গিয়েছে।”
-“সেকী! তাহলে আমাদের বিয়ে কি করে হবে?”
-“স্নিগ্ধ গিয়ে নিয়ে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
হাসি ফুটলো তিতিরের মুখে। তিতির আবার বসলো। তারপর বলল,
-“এই তুমি না আগে পুরোটা ডিম একবারে মুখে নিয়ে খেতে?”
-“হুম।”
-“এখন খাওনা, আমি দেখবো।”
মুগ্ধ তাই করলো। তিতির হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ ধরে ফেলল আর তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে বলল,
-“তোমার বুকটাতে এত শান্তি কেন?”
-“ভালবাসো যে অনেক তাই।”
-“শুধু সেজন্য নয়।”
-“তাহলে?”
-“তোমার বুকে ম্যাজিক আছে।”
-“ওটা তোমার বুকেও আছে।”
তিতির ওড়না সরিয়ে, জামার ভেতরে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“কই দেখিনা তো।”
-“আমারটা দেখতে পাও?”
-“নাতো।”
-“হুম, কারন… ম্যাজিক অলওয়েজ ইনভিজিবল হয়।”
-“ওহ।”
-“এবার রুমে চলো। তোমার ঘুম দরকার। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, মনে হয় সারারাত একফোঁটা ঘুমাওনি। আমার কাছে আসবে বলে শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা করেছো।”
-“হুম, তুমি মনের কথা বুঝতে পারো। তুমি খুব ভাল।”
-“আচ্ছা, এবার চলো।”
তিতির ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে মুগ্ধর গলা ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,
-“তাহলে আমাকে কোলে নাও… কোলে করে নিয়ে চলো রুমে।”
-“আচ্ছা এটুকু কষ্ট করে হেটে চলো। রুমে গিয়ে কোলে নিচ্ছি।”
-“নাহ, আমি হাটতে পারিনা। তোমার কোল মজা।”
-“ওইজন্যই তো রুমে গিয়ে কোলে নিব। ড্রয়িংরুমে স্নিগ্ধ বসে আছে। ওর সামনে কি করে কোলে নেই বলো?”
-“তাহলে কি হয়েছে? ওরও তো শিখতে হবে। ও যদি তোমার মত না হয় তাহলে ওর গার্লফ্রেন্ড কষ্ট পাবে না? ওরও শিখতে হবে কিভাবে গার্লফ্রেন্ড কে কোলে নিতে হয়।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“পাগলামি করেনা বাবা, ও আমার ছোট ভাই না? আমি ওর সামনে এটা করতে পারি?”
-“তাও ঠিক! কিন্তু ওর শিখতে হবে তো।” -“ওর শিখতে হবেনা ও পেকে ঝুনা হয়ে গেছে। আমি এতদিনেও যা করতে পারিনি ও অলরেডি ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে তা করে ফেলেছে।”
-“তুমি কিভাবে জেনেছো? ও তোমাকে বলেছে?”
-“না বলেনি। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি।”
-“ওহ। তাহলে হেটেই যাচ্ছি। কিন্তু প্রমিস করো, রুমে গিয়েই কোলে নিবে।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“রুমে চলোই না, কোল থেকে নামাবোই না।”
অবশেষে মুগ্ধ বোঝাতে সক্ষম হলো এবং তিতির হেটেই রুমে গেল। রুমে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিল। তারপর মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর হাটতে হাটতে বলল,
-“আমার তিতিরপাখিটার যে এখন একটু ঘুম দরকার।”
-“তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে বিছানা পর্যন্ত যাও।”
মুগ্ধ তাই করলো। তিতির বিছানায় শুয়ে বলল,
-“তুমিও শোও আমার সাথে।”
-“শুচ্ছি দাঁডাও, আগে তোমাকে একটা অষুধ খাইয়ে নেই।”
-“ই না। আমি ওষুধ খাবো না, ওষুধ খুব বাজে হয়।”
মুগ্ধ তিতিরের পাশে বসে বলল,
-“না খেলে তোমার সাথে শুবো না।”
-“তুমি খুব পচা। দাও ওষুধ দাও।”
মুগ্ধ ওকে একটা প্যারাসিটামল আর পানি দিল। তিতির বলল,
-“এতবড় অষুধ? খেতে গেলে আমি মরে যাব।”
-“ওকে, আমি ব্যবস্থা করছি।”
মুগ্ধ ওষুধটাকে ভেঙে চার টুকরা করে দিল। তিতির সেগুলো একটা একটা করে খেল। তারপর মন খারাপ করে বলল,
-“জানো বাবা সবসময় বড় ওষুধগুলো আমাকে ভেঙে দিত।”
মুগ্ধ বলল,
-“বাবারা তো এমনই হয়।”
-“কিন্তু আমার বাবা সবচেয়ে ভাল বাবা।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
মুগ্ধ উঠে যাচ্ছিল। তিতির বলল,
-“কোথায় যাও?”
-“আসছি।”
মুগ্ধ এক বালতি পানি নিয়ে এল। যখন তিতিরের মাথায় পানি ঢালছিল তখন তিতির বলে উঠলো,
-“এই তুমি আমার চুল ধুয়ে দিচ্ছো?”
-“হুম।”
-“তুমি কি আমাকে গোসলও করিয়ে দেবে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“প্রয়োজনে দেব।”
-“কবে দিবে?”
-“যেদিন প্রয়োজন পড়বে।”
-“কবে প্রয়োজন পড়বে?”
-“তাতো জানিনা।”
মাথায় পানি দেয়া শেষ করে মুগ্ধ নিজের টাওয়াল দিয়ে ভাল করে তিতিরের মাথাটা মুছে দিল। তিতির তো আহ্লাদে আটখানা। তারপর মুগ্ধ যখন টাওয়াল মেলে দিতে বারান্দায় গেল তিতির তখন বলল,
-“আমি তো ওষুধ খেয়েছি। এখন তো শোও।”
-“বালতিটা রেখে এসেই শুচ্ছিরে বাবা।”
মুগ্ধ যখন তিতিরের ডানপাশে শুয়ে পড়লো। তিতির মুগ্ধর গলা ধরে বলল
-“এই তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? কিছু তো বললে না।”
-“তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো এতকিছু করলাম। অবশ্যই করবো।”
-“আমি তোমার বুকে ঘুমাবো।”
মুগ্ধ তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মুগ্ধর আসলে টেনশন হচ্ছিল। তিতির যখন সুস্থ হবে তখন তো চলে যাবে, কিছুই করতে পারবেনা মুগ্ধ। এতদিন ওকে ছেড়ে থাকার একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল যা আজ ভেঙে দিল। এবার ও যখন চলে যাবে ভেতর থেকে কলিজাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। কেন এল ও? কিছুক্ষণ পর তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,
-“শোনো আমরা কখন বিয়ে করবো আজকে সন্ধ্যায় নাকি আজকে রাত্রে?”
-“ঘুমিয়ে ওঠো আগে। ওষুধ খেয়েছো তো জ্বর কমে যাবে, তখন বলবো।”
-“না এক্ষুনি বলতে হবে।”
-“না এখন ঘুমাতে হবে।”
তিতির মুগ্ধকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তুমি আসলে আমাকে বিয়েই করতে চাওনা। আমি বুচ্ছি এবার। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।”
-“আরে পাগলী! না না একথা কে বলল?”
-“আমি সব ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে এলাম আর এখন তুমি বলছো বিয়ে করবে না! এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।”
মুগ্ধ তিতিরকে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“না বাবা, আমি সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো কত কষ্ট করলাম, বোঝোনা তুমি? কিন্তু তুমি সুস্থ না হলে বিয়ে কি করে করবো বলো? আর মায়েরও তো আসতে হবে। তুমি একটু ঘুমিয়ে ওঠো তারপর এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।”
-“ওহ, আচ্ছা।”
-“এইতো আমার লক্ষীটা। একটু অবুঝ হলেও বোঝালে সব বোঝে।”
তিতির একটা বিশ্বজয় করার হাসি দিল। তারপর মুগ্ধ তিতিরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। তিতিরের জ্বর মনে হচ্ছে আরো বাড়ছে। মুগ্ধর বুকটা প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে। প্রচন্ড গরম! তবু খুব শান্তি লাগছে মুগ্ধর। পরম শান্তি! অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মুগ্ধ যখন ভাবলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে তখনই তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,
-“এই দেখোনা, আমার ঠোঁট ফেটে কি হয়েছে!”
মুগ্ধ বুঝলো তিতির কি চাইছে। কোন কথা না বলে আস্তে করে তিতিরকে উপরে উঠিয়ে ঠোঁটে আলতো চুমু খেল।
দুপুরবেলা তিতির ঘুম থেকে উঠলো। ওর এখন জ্বর নেই। রুমে একা শুয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে ও মুগ্ধর সাথে শুয়েছিল। মুগ্ধ কোথায় গেল! ঘর থেকে বের হয়ে কাউকে দেখতে পেল না। রান্নাঘরে যেতেই দেখলো মুগ্ধ রান্না করছে, পিউ হেল্প করছে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই পিউ এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।বলল,
-“ভাবী!”
তিতিরও পিউকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কেমন আছো?”
-“যেমন তেমন ছিলাম গো! তোমাকে দেখে খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।”
তিতির পিউয়ের গালে একটা চুমু দিল। পিউ বলল,
-“ভাবী! সত্যি চলে এসেছো? পার্মানেন্টলি?”
-“হ্যা।”
মুগ্ধ তাকালো তিতিরের দিকে। তিতিরও তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল তিতির। পিউ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে ফিরে বলল,
-“ভাইয়া, ভাবীর কিন্তু এখন জ্বর নেই।”
মুগ্ধ বলল,
-“এখন তাহলে ওর কথা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।”
তিতির মিটিমিটি হাসতে লাগলো। পিউ বলল,
-“ভাইয়া তোর আর কিছু লাগবে?”
-“না, রান্না অলমোস্ট কম্পলিট।”
-“আমি তাহলে গোসলে যাই।”
-“আচ্ছা, যা।”
পিউ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যেতেই তিতির মুগ্ধর পাশে এসে দাঁড়ালো। মুগ্ধ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“বাহ, জ্বর নেই দেখছি। কয়দিন ধরে জ্বর তোমার?”
-“চারদিন।”
-“এতদিনের ওষুধগুলো কি আগের মত ফুলের টবে গিয়েছে?”
-“হ্যা।”
-“ঠিক হয়নি। ওষুধ খেলে আরো আগে সুস্থ হয়ে যেতে।”
-“ওষুধ ভেঙে দেয়ার কেউ ছিলনা।”
-“বাবা?”
-“বাবা ছিল, কিন্তু দেয়নি। হয়তো ভেবেছে আমি বড় হয়েছি, এখন খেতে পারবো।”
মুগ্ধর রান্নাটা ততক্ষণে পুরোপুরি শেষ। চুলা বন্ধ করে হাত থেকে গ্লাভস খুলে রাখলো। তারপর আচমকা তিতিরের হাত ধরে একটানে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তিতিরও ধরলো। এতক্ষণে মুগ্ধর মনে হলো তিতিরকে ও পেয়েছে! কারন, তিতির এখন স্বজ্ঞানে। মুগ্ধ ওই অবস্থাতেই তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কি সত্যি সত্যি চলে এসেছো তিতির?”
-“হ্যা, সত্যি এসেছি।”
-“আর যাবে না তো?”
-“নাহ। মরে গেলেও আর যাব না।”
-“বাসায় কি বলে বেড়িয়েছো?”
-“কিছুনা। শুধু একটা মেসেজ করে দিয়েছি ভাইয়াকে।”
-“কি লিখেছো?”
-“লিখেছি আমি মুগ্ধর কাছে চলে যাচ্ছি। আজ আমরা বিয়ে করবো।”
-“তান্না কি রিপ্লে দিয়েছে?”
-“ভাইয়া লিখেছে, আর কোনদিনও ফিরে আসবি না। আমার বোন একটু আগের মেসেজটা দেয়ার সাথে সাথে মারা গেছে। বাবা-মাও মেসেজটা দেখে বলেছে তাদের মেয়ে মৃত।”
-“তারপর?”
-“আমি আর কোন রিপ্লে দেইনি।”
-“এই মেসেজ কখন দিয়েছো?”
-“সকালে।”
মুগ্ধ এবার তিতিরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতে ওর মুখটা তুলে চোখে চোখ রেখে বলল,
-“কিকরে আসতে পারলে বলোত? ভয় করেনি?”
-“নাহ, শুধু খারাপ লেগেছে। কি করবো যতকিছুই করিনা কেন এখন আর তাদের খুশি করতে পারিনা। অন্যদিকে তোমাকে ছেড়েও থাকতে আর পারছিলাম না। তাই শেষমেশ তোমার কথাই মেনে নিলাম যে বিয়ের পর একদিন না একদিন মেনে নেবে।”
-“আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার ভালবাসার উপর এটুকু বিশ্বাস আমার ছিল। আর এজন্যই আমি তোমার সাথে সেদিন ওরকম নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম। সেদিনের জন্য আমাকে তুমি মাফ করে দিও তিতিরপাখি।”
-“হুম। আমি পরে সেটা বুঝেছিলাম।”
-“সেদিনের ব্যবহারের জন্য রাগ নেই তো?”
-“নাহ। তোমার যদি আদর করার অধিকার থাকে তো রাগ, শাসন এবং খারাপ ব্যবহার করার অধিকারও আছে। সেদিন খুব কষ্ট পেলেও পরে বুঝেছিলাম আমি।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“আজ আমার জীবন সার্থক।”
-“এবার বলো কবে বিয়ে করবো?”
-“কাল।”
-“কাল কেন? আজই বিয়ে করবো আমি। কাল হয়ে গেলে আর বিয়ে করবো না।”
-“কেন?”
-“কি থেকে কি হয়ে যায় ঠিক নেই।”
-“তাহলে তো মোটেও তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। কখনো যেন তোমার মনে না হয় যে তুমি এভাবে চলে এসে হুট করে বিয়ে করে ভুল করেছো। আজ সারারাত চিন্তা করো আর তোমার ফ্যামিলি কি একশন নেয় দেখো। তাছাড়া, মাকে ছাড়া শুধু আমি তুমিই তো বিয়ে করতে পারবো না। আজ স্নিগ্ধকে পাঠাচ্ছি মাকে নিয়ে আসার জন্য। কাল এলেই বিকেলে আমরা বিয়ে করবো। ঠিকাছে?”
-“ওহ, মা কোথায় গিয়েছে?”
মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। একবার বলা স্বত্তেও ভুলে গেছে তিতির। জ্বরের ঘোরে ছিল কিনা। নিশ্চই তখনকার অনেক কথাই ভুলে গিয়েছে। বলল,
-“কুমিল্লা গিয়েছে।”
-“ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে কালই।”
লাঞ্চের পর পিউ আর তিতির বিয়ে নিয়ে টুকটাক প্ল্যানিং করছিল। বিকেলেই স্নিগ্ধ রওনা দিয়ে দিল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। তারপর পিউ বলল,
-“ভাইয়া আমার একটু বেরোতে হবে।”
-“কোথায় যাবি আবার।”
-“উফ ভাইয়া আমি তো বড় হয়েছি না? আমার অনেক পারসোনাল কাজ থাকতে পারে।”
-“ওহ, আচ্ছা আচ্ছা যাহ।”
পিউ চলে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-“তোমার ননদ তো আমাদের প্রেম করার সুযোগ করে দিয়ে গেল। কিন্তু অসুস্থ মানুষের সাথে কি প্রেম করবো আমি?”
-“কই এখন তো আর আমি অসুস্থ না।”
-“তাই না?”
মুগ্ধ হঠাৎ তিতিরকে কোলে তুলে হাটা শুরু করলো। প্রায় পুরো ফ্ল্যাট চক্কর দেয়া শেষ। তখন তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হলো তোমার? কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছো যে?”
-“সেকি! তুমিইনা সকালবেলা কোলে ওঠার জন্য লাফাচ্ছিলে?”
তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো,
-“ইশ! কখন?”
-“হ্যা, এখন তো অস্বীকার করবেই।”
সকালবেলা যা যা হয়েছে সবটা মুগ্ধ ডিটেইলে বলল তিতিরকে। স্নিগ্ধর সামনে কোলে উঠতে চেয়েছে, স্নিগ্ধকে শেখাতে চেয়েছে সেটা শুনে তো তিতির লজ্জায়ই মরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
-“সুন্দরী, এগুলো ঘোরে তোমার মনে, না?”
পুরোটা বিকেল ওরা বারান্দায় কফির মগ হাতে গল্প করে কাটিয়ে দিল। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে গল্প। খুব সিরিয়াস টাইপের গল্প। প্রায় এক বছর কে কিভাবে কাটিয়েছে, কার জীবনে কি হয়েছে সেসব গল্প। তিতির মুগ্ধকে সুহাসের কথাটা সব খুলে বলততেই মুগ্ধ খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
-“তার মানে তো বিয়ে পুরো ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। তুমি যেভাবে চলে এসেছো, ছেলেটা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা কে জানে।”
-“যেভাবে মন চায় সেভাবে নিক। আমি তো আর ওর সাথে প্রেম করিনি। ফ্যামিলি ঠিক করেছে।”
-“এলেই যখন বিয়েটা ঠিক হওয়ার আগেই আসতে।”
-“কেন তোমার কি কোন প্রব্লেম হচ্ছে? হলে বলো আমি এক্ষুনি চলে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরের ডানপাশে বসে ছিল। ডানহাতটা দিয়ে তিতিরকে টেনে বুকে নিয়ে বলল,
-“আরে পাগলী, তা বললাম কখন? জাস্ট এটাই বলতে চাচ্ছি এখন তোমার ফ্যামিলি বলবে তুমি তাদের মুখ পুড়িয়েছো।”
-“যা মন চায় বলুক, এখন আর আমি কিছুতেই কেয়ার করি না। বিয়েটা দু’মাস আগে ঠিক হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমি আরো ভাল করে বুঝলাম যে তুমি ছাড়া অন্য কাউকেই আমার ভাল লাগবে না। মন বসবেনা কারো প্রতি।অন্যকারো হয়ে থাকার চেয়ে সারাজীবন একা থাকাটা অনেক সহজ।”
-“আচ্ছা, আচ্ছা বাদ দাও। যা হয়েছে হয়েছে। তুমি যে ফাইনালি এসেছো এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,
-“তোমার জ্বরটা আবার আস্তে আস্তে আসছে মনে হচ্ছে।”
-“আসুক।”
-“ডাক্তার দেখিছিলে?”
-“না।”
-“৪/৫ দিন ধরে এত জ্বর আর তুমি ডাক্তার দেখাওনি?”
-“না।”
-“অফিসে গিয়েছো?”
-“যেদিন জ্বর এসেছিল সেদিন গিয়েছিলাম, পরে আর যেতে পারিনি।”
-“ও।”
-“আচ্ছা তিতির এখন যদি তোমার ফ্যামিলির কেউ তোমাকে নিতে আসে?”
-“আমি যাব না।”
-“সত্যি তো?”
-“১০০%।”
-“তিতির, কষ্ট পেও না। দেখো আমাদের বিয়ের পর তোমার বাবা-মা একদিন না একদিন মেনে নেবে।”
-“সত্যি মানবে তো?”
-“হুম মানবে, যখন আমাদের একটা বেবি হবে, তখন বেবিটাকে দেখলেই গলে যাবে।”
-“যদি না মানে?”
-“আরে মানবে মানবে। প্রত্যেকেরই নাতি-নাতনীর প্রতি অন্যরকম ভালবাসা থাকে। মুখ দেখলে দুনিয়া ভুলে যায়। আর কাজটা খুব দ্রুত করে ফেলবো বুঝলে। তান্নার বেবি হওয়ার আগে আমাদের টা হলে ভাল হয়।”
-“যদি ভাইয়ার আগে হয়?”
-“প্রব্লেম নেই তো। আমাদের আগে হলে ভাল, পরে হলেও ক্ষতি নেই। কেন তোমার ভাবী কি প্রেগন্যান্ট নাকি?”
-“নাহ।”
-“তাহলে তো হলোই, কাল আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। একদম নগদ নগদ আমি তোমাকে প্রেগন্যান্ট করে দেব। ওনলি আদর আর আদর। নো প্রটেকশন!”
-“ধ্যাত!”
লজ্জা পেয়ে তিতির উঠে দৌড় দিল। মুগ্ধ গেল পেছন পেছন। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ফেলতেই তিতির নিজেকে ছোটাতে চাইছিল। দুজনেই হাসছে, ধস্তাধস্তি তুমুল পর্যায়ে এমন সময় কলিং বেল বাজলো। মুগ্ধ ছেড়ে দিল ওকে। বলল,
-“যাও তোমার ননদ চলে এসেছে। বেঁচে গেলে।”
তিতির দরজা খুলেই হা হয়ে গেল। ইকরা দাঁড়িয়ে আছে। ইকরার সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল মুগ্ধর এক জন্মদিনে। তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে মুগ্ধদের বাসায়, অনেক আগে যখন ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। এমনিতে ইকরা যেমনই হোক, খুব মিশুক। যতবার ওদের দেখা হয়েছে ততবারই হাত ধরে ‘তুমি খুব লাকি’ ‘জাদু জানো নাকি? নাহলে মুগ্ধ ভাইয়ার মত মানুষ গলে যায়!’ এই টাইপের কথাবার্তা বলেছে ইকরা। আর প্রতিবারই তিতির ওকে অবাক চোখে দেখেছে আর ভেবেছে একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে!
ইকরা বলল,
-“ভেতরে ঢুকতে দেবে না?”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা হ্যা এসো।”
ইকরা আর তিতির ড্রইংরুমে বসলো। ততক্ষণে মুগ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ইকরাকে দেখেই ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। তিতির বলল,
-“ইকরা আপু তোমাকে কফি দেই?”
ইকরা হেসে বলল,
-“না না, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি কখন এলে?”
তিতির বলল,
-“আজ সকালে এসেছি।”
-“তিতির তুমি কি অসুস্থ? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।”
-“হ্যা আপু, একটু জ্বর ছিল।”
ইকরা তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“জ্বর তো এখনো আছে। ওষুধ খেয়েছো?”
-“হ্যা খেয়েছি।”
এতক্ষণে মুগ্ধ কথা বলল,
-“তুই হঠাৎ এখানে?”
ইকরা বলল,
-“এমনি তোদের খোঁজ নিতে এলাম, মামী নেই তার মধ্যে তোরা কেমন আছিস সেটা জানার জন্যই।”
-“তোর মামী তো আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নেই, খোঁজ নেয়ার কথা আজ মনে পড়লো?”
-“আমি প্রতিদিনই বাসায় এসে খোঁজ নিই। তুই থাকিস অফিসে জানবি কি করে?”
-“ওহ, ভেরিগুড!”
-“আর কাউকে দেখছিনা। বাসায় কি তোরা দুজনই?”
-“হ্যা, আমরা দুজনই। কোন প্রব্লেম?”
-“নাহ, আমার কি প্রব্লেম।”
-“দেন ইউ ক্যান গো নাও, আমরা একটু বিজি ছিলাম।”
ইকরা চোখমুখ শক্ত করে উঠে চলে গেল। মুগ্ধ গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। এতক্ষণ তিতির কথা বলছিল না। এবার বলল,
-“এভাবে না বললেও পারতে।”
-“প্লিজ তুমি এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলো না তো। আমি শিওর ও কোন না কোন ভাবে জেনেছে যে স্নিগ্ধ, পিউ কেউ বাসায় নেই আর তুমিও এসেছো। তাই স্পাইগিরি করতে এসেছে আমরা কি করছি না করছি সেটা নিয়ে।”
-“কিন্তু ও কিভাবে জানবে?”
-“জানার ইচ্ছে থাকলে অনেকভাবে জানা যায়। ও যদি না জেনে আসতো তাহলে তোমাকে দেখে অবাক হতো। কিন্তু ও অবাক হয়নি।”
-“ওহ, তাই তো।”
মুগ্ধ এবার তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“তোমার জ্বর একটু একটু করে বাড়ছে। আমার মনে হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।”
-“ধুর, আমি যাবনা। তোমার কাছে এসেছি এখন আমার জ্বর এমনিতেই চলে যাবে।”
-“তুমি জেদ করছো কেন?”
তিতির কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
-“তোমার চেয়ে বড় ওষুধ দুনিয়ায় আর নেই। আমি বাসায় বিছানা থেকেও নামতে পারছিলাম না আর তোমার কাছে এসে আমি দৌড়াদৌড়ি করছি। তুমি পাশে থাকলে আমার কোন ডাক্তার লাগবে না। আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর ওর মাথার কাছে বসে বলল,
-“রেস্ট নাও তাহলে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তিতির বলল,
-“ইকরাকে দেখলে আমার কি মনে হয় জানো?”
-“কি?”
-“মনে হয় একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? আমি চোখ ফেরাতে পারিনা জানো?”
-“তিতির, তুমি ওর থেকে অনেক বেশী সুন্দরী ছিলে। আমাদের আলাদা হওয়ার পর থেকে তোমার উপর দিয়ে যেসব ঝড় গিয়েছে তার প্রভাবে তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের বিয়ের পর দেখবে আবার ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
-“আমি আগে সুন্দর ছিলাম একথা ঠিক কিন্তু ওর মত সুন্দর তো ছিলাম না। ওর চোখ, চুল, স্কিন, ঠোঁট সবকিছু এত সুন্দর! আর কি স্লিম ফিগার মাশাল্লাহ।”
-“কি যে বলো তুমি! ওর চোখগুলো তো মাছের মত ছোট ছোট। আর চুল! ডেইলি চুলের মধ্যে কত কি লাগিয়ে বসে থাকে জানো? আর দুদিন পরপর বিউটি পার্লারে যায়। আর স্কিন? স্কিন কোত্থেকে দেখলে বুঝলাম না সব তো আধ ইঞ্চি মেকাপে ঢাকা থাকে অলওয়েজ। আর ঠোঁট! জঘন্য টেস্ট, খালি দেখতে ভাল হলে তো হবে না। আর ফিগার! কি বলবো তিতির, ওই পিচ্চি পিচ্চি.. না মানে এলসিডি টাইপ ফিগার আমার ভাল লাগে না। আমার তোমার মত ফিগার ভাল লাগে। আর শুধু আমি কেন বাংলাদেশের সব ছেলেরাই জানে মেয়েদের 32 ফিগারের চেয়ে 36 কতটা বেটার। কেন সেটা আর নাইবা বলি।”
তিতির লজ্জা পেয়ে মুগ্ধকে মারতে লাগলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-“আরে আমাকে কেন মারছো?”
-“মুখে লাগাম নেই কেন?”
-“এটা তো আমার জন্মগত স্বভাব।”
তিতির থেমে গেল। তারপর সিরিয়াস হয়ে বলল,
-“একটা কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবে না তো?”
-“না না বলো না?”
-“তুমি যে বললে ইকরার ঠোঁটের টেস্ট খারাপ! তুমি কি টেস্ট করেছো নাকি?”
মুগ্ধ একথা শুনে একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে বলল,
-“আমার লাইফের ফার্স্ট লিপকিস ওর সাথেই।”
ম্যাজিকের মত এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই তিতিরের চোখ জলে ভরে যায়। ও ইকরার সাথে যত ভাল ব্যবহারই করুক না কেন ও মনে মনে তো ইকরা কে অপছন্দই করে। ব্যাপারটা খেয়াল করে মুগ্ধ একটা হাত তিতিরের গালে রেখে বলল,
-“কষ্ট পেওনা তিতির।”
-“নাহ, কষ্ট পাচ্ছি না তুমি বলো?”
-“ছোটবেলায় ওর সাথে আমার সম্পর্কটা খুব ভাল ছিল। ওরা তো ঢাকাতেই থাকতো। ছুটিতে কুমিল্লা যাওয়ার আগে চিটাগাং যেত ওরা। তখন আমরা অনেক মজা করতাম। একসাথে খেলতাম, ঘুরতাম আরো কত যে মজা করতাম। কাজিনরা যেমন হয় আরকি! তখন আমি ছোট, এসএসসি দিব। ও বোধহয় সিক্সে পড়ে এক্সাক্টলি মনে নেই। তখন একদিন বিকালে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, ও এসে আমাকে কিস করে। ঘুমের ভেতর ছিলাম তো, আমিও করেছি। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভেঙে যায় এবং কতক্ষণ সময় লাগে বুঝতে যে কি হচ্ছে! যখন বুঝলাম তখন আমি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই। আমার লাইফের জঘন্যতম এক্সপেরিয়েন্স। তারপর থেকে আমি কাউকে কিস করার কথা ভাবতেই পারতাম না। পরে তো বড় হতে হতে আসল ব্যাপারটা বুঝেছি।”
তিতির নীরবে কাঁদছে। মুগ্ধ ওকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই টের পেল তিতিরের জ্বর বেড়েই চলেছে। পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“কেঁদোনা প্লিজ। আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। ওর প্রতি আমার কোন ফিলিংসই নেই। ভার্সিটির ট্যুরে কক্সবাজারে গিয়ে কি হয়েছিল তা তো তুমি জানো! ওকে ওভাবে দেখেও আমার মধ্যে কিছুই হয়নি।”
তিতির এতক্ষণ চুপচাপ কাঁদছিল। এবার ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল। মুগ্ধ থামানোর চেষ্টা করছিল। ওদিকে তিতির ওকে আঁকড়ে ধরে বলছে,
-“তোমাকে আমি কাউকে দেবনা। তুমি শুধু আমার। তোমার দিকে কাউকে তাকাতেও দেবনা আমি। খুন করে ফেলবো।”
-“আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে হয় করো।”
তিতির ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ইকরার কত বড় সাহস ও তোমাকে টাচ করে! ওর হাত কেটে টুকরো টুকরো করে মালা বানিয়ে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেব। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার।”
-“সেজন্যই তো সহ্য করতে পারিনা ওকে। দেখোনা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।”
তিতিরের কান্না থামছেই না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“শয়তান মেয়েটার এতবড় সাহস ও তোমার ঠোঁটে কিস করেছে? ওর ঠোঁট কেটে কুচিকুচি করে দোপেঁয়াজা করে আমি কুকুরকে খাওয়াবো।”
তিতিরের এধরণের কথায় মুগ্ধর হাসার কথা। কিন্তু হাসতে পারলো না। উল্টো খুব খারাপ লাগতে লাগলো তিতিরের এমন কান্না দেখে। কতটা ভালবাসে তিতির ওকে। অথচ তিতির এভাবে চলে না এলে তো সারাজীবন আলাদাই থাকতে হতো। ওর চোখ মুছে দিয়ে মুগ্ধ বলল,
-“কেঁদোনা, প্লিজ এমনিতেই তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছো। আমার অনেক খারাপ লাগছে। দেখো, আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। তোমাকে আনেক অনেক সুখে রাখবো।”
তিতির হঠাৎ মুগ্ধর বুক থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলো। তখনও কাঁদছিল। তারপর নিজের হাত দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছে দিতে দিতে বলল,
-“ইকরা আমার সম্পত্তিতে কেন হাত দিল? কেন কিস করলো এই ঠোঁটে? ওকে মেরে ফেলবো আমি।”
তারপর ওর ওড়না দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছতে লাগলো। মুছতে মুছতে বলছিল,
-“ইকরাকে আমি মেরে ফেলবো, মেরে ফেলবো।”
তিতিরের চোখে তখন অঝর শ্রাবন! মুগ্ধর বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই তিতিরের জ্বর মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেল। ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু ও কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলছে। অবশেষে মুগ্ধ ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে বলল, ‘ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে যাবে।’ মুগ্ধর বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেল। তিতিরের খারাপ কিছু হয়নি তো এটা ভেবে এতক্ষণ ওর মন কু ডাকছিল।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের সামনে যেতেই মুগ্ধ পড়লো বিপাকে। বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষাকাল টাকে এজন্যই মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে। কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট বৃষ্টি। এটুকু সময়ের জন্য গাড়িটা আবার বেজমেন্টে পার্ক করবে সেটা ভেবেই রাস্তায় পার্ক করেছিল। এখন তিতিরকে নিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যেতে গেলে তো তিতির ভিজেই যাবে। তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা দিয়ে রেখেছিল। আর মুগ্ধ একহাতে তিতিরকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, তুমি একা একা দাঁড়াতে পারবে না দু’মিনিট? আমি গাড়িটা নিয়ে আসি?”
-“হ্যা পারবো। তুমি গেলেও পারবো।”
-“সত্যিসত্যি তো?”
তিতির চোখ পিটপিট করে বলল,
-“না মিথ্যামিথ্যি তো।”
-“এক থাপ্পড় দিব নড়লে। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।”
-“ওক্কে! কিন্তু থাপ্পড় নিবনা, চুম্মা নিব।”
তারপর আবার মুখজোড়া হাসি দিয়ে চোখ পিটপিট করলো। হাসলো মুগ্ধ! এক জ্বরে ওর ভেতরের বাচ্চাটা বেড়িয়ে এসেছে।
মুগ্ধ চিন্তায় চিন্তায় গেল। গাড়ি নিয়ে এসেই হা হয়ে গেল। যা ভয় করছিল তাই তিতির নেই। চারপাশ খুঁজতে খুঁজতে দেখলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সাথে সাথে গিয়ে টেনে নিয়ে গাড়িতে ওঠালো। তিতির বলল,
-“উফফ, আমি ভিজবো। আমাকে ভিজতে দাও।”
মুগ্ধ ততক্ষণে গাড়িতে উঠেছে মাত্র। একটা চড় মেরে বলল,
-“আমি বলেছিলাম না কোথাও না যেতে?”
যদিও আস্তেই মেরেছে মুগ্ধ তবুও তিতির কান্না করে দিল,
-“তুমি আমাকে মারলে?”
-“খুব ভাল করেছি। তোমাকে আরো মারা উচিৎ। তোমার কোন আইডিয়া আছে এই জ্বরে বৃষ্টিতে ভিজলে কি হতে পারে? কিংবা একটা অসুস্থ রোগীকে একা কোথাও রেখে ফিরে এসে তাকে না দেখলে কেমন লাগতে পারে?”
তিতির ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো। বেশিদূরের হসপিটালে যায়নি তাই ফিরতেও দেরী হলো না। বাসায় ফিরতে ফিরতেই পিউকে ফোন দিল।
-“হ্যালো, পিউ তুই কই?”
-“এইতো ভাইয়া বাসায় ফিরছি। জামে পড়েছি।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে।”
-“কেন কিছু বলবি? বল না।”
-“তিতিরের জ্বর বেড়েছিল, ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তুই এখন না ফিরলে ফিরতে বলতাম।”
-“ও আচ্ছা। ডাক্তার কি বলল?”
-“ভাইরাস জ্বর। এন্টিবায়োটিকস দিয়েছে।”
পাশ থেকে তিতির বলল,
-“আমি পিউপাখির সাথে কথা বলবো। দাও দাও।”
মুগ্ধ ঝাড়ি মেরে বলল,
-“চুপ, একদম চুপ। বাসায় গিয়ে কথা বলো।”
-“অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।”
ওপাশ থেকে পিউ বলল,
-“ভাইয়া বকিস না তো। কথা বলতে চাচ্ছে যখন দে প্লিজ।”
মুগ্ধ দিল। তিতির ফোন ধরে বলল,
-“পিউউউ..”
-“হ্যা আমার সুইটি ভাবী বলো।”
-“জানো, তোমার ভাইয়া আমাকে মেরেছে?”
-“সেকী কেন?”
-“আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই।”
-“ওওও, সোনা ভাবীটা আমার, কেন ভিজলে এই জ্বর নিয়ে?”
-“আমি বৃষ্টি ভালবাসি যে তাই।”
-“আমিও, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। তারপর আমরা একসাথে ভিজবো। ওকে ভাবী?”
-“আচ্ছা।”
-“টাটা।”
-“টাটা।”
ফোন রাখার পর মুগ্ধ বলল,
-“এক কাজ করো। আমাদের বাসর রাত কাটাবার পর সকালবেলা পিউকে গিয়ে বইলো, ‘জানো পিউ তোমার ভাইয়া আমার সাথে সেক্স করেছে।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে।”
মুগ্ধ তিতিরের রিপ্লাই শুনে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো ওর দিকে।
বাসায় ফিরে দেখলো পিউ এখনো ফেরেনি। তিতিরের সিলেটের সেই কাপড়চোপড় সব মুগ্ধর কাছেই ছিল। সেখান থেকে কাপড় বের করলো। তারপর তাড়াতাড়ি তিতিরকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
-“জাস্ট বৃষ্টির পানিটুকু ধুয়ে ফেলতে যতটুকু লাগে ততটুকু গোসল করবে। বেশি হলে আবার চড় মারবো তখনকার মত।”
তিতির বলল,
-“তাহলে তুমিই গোসল করিয়ে দাওনা। আমি তো বুঝিনা বৃষ্টির পানি ধুতে কতটুকু গোসল লাগে। তারপর যদি আবার চড় খাই?”
মুগ্ধ বলল,
-“জাতে মাতাল তালে ঠিক। যাও একা গোসল করো।”
তিতির মুগ্ধর গলায় ঝুলে পড়ে বলল,
-“প্লিজ আসো না।”
অবশেষে মুগ্ধ গেল। তিতিরকে বৃষ্টির ভেতর থেকে আনতে গিয়ে ও নিজেও ভিজে গিয়েছিল। ওরও তো মাথাটা ধুতে হবে। তিতির লক্ষী বাচ্চার মত দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধ শাওয়ার ছেড়ে তিতিরের চুলগুলো ধুয়ে দিল। তিতিরও পাক্নামি করলো, হাত উপরে উঠিয়ে মুগ্ধর চুলগুলো ধুয়ে দিল। তারপর মুগ্ধ শাওয়ার বন্ধ করে বলল,
-“হয়ে গেছে ম্যাম। এখন দয়া করে চেঞ্জ করে আমাকে উদ্ধার করেন। আমি যাই?”
-“এই না।”
-“তো?”
তিতির এগিয়ে এসে মুগ্ধকে বলল,
-“তুমি মাঝেমাঝে এত আনরোম্যান্টিক হয়ে যাও কেন?”
-“অসুস্থ মানুষের সাথে রোমান্স করতে হয়না।”
-“ইশ, কে বলেছে তোমাকে?”
-“বলতে হয়না। এটা জানা কথা।”
-“ভুল জানো তুমি। অসুস্থ মানুষকে বেশি আদর করতে হয়, যত্ন করতে হয়।”
-“হ্যা যত্ন তো করছি। আদর করবো সুস্থ হওয়ার পর।”
-“না না না।”
তিতির মুগ্ধকে যেতে দিল না। হাতদুটো শক্ত করে ধরে রইলো। মুগ্ধ হেসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর বলল,
-“ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আরো বাড়বে। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে বের হয়ে এসো, পাগলী আমার!”
তারপর তিতির তার বিশ্বজয় করা হাসিটা দিল। মুগ্ধও হেসে বেড়িয়ে গেল।
রাত ৮ টা বাজে। তিতিরকে যতদ্রুত সম্ভব ওষুধ খাওয়াতে হবে কিন্তু তার জন্য তো ওকে কিছু খাওয়াতেও হবে। মুগ্ধ ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে রান্না ঘরে গিয়ে ভাত নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখে তিতির এখনো বের হয়নি। বাথরুমের দরজায় নক করলো মুগ্ধ,
-“তিতির? কি ব্যাপার এতক্ষণ লাগে?”
তিতির বেড়িয়ে এল। ওর চুল দিয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ বলল,
-“আজও চুল মুছতে শিখলে না? এদিকে এসো।”
মুগ্ধ নিজেই ওর চুলগুলো ভাল করে মুছে দিল। তারপর ভাত খাওয়াতে এলেই তিতির বলল,
-“আমি খাব না।”
-“না খেলে ওষুধ খেতে পারবে না। ওষুধ না খেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারবে না। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ না হলে তো তাড়াতাড়ি বিয়েও করতে পারবো না।”
-“আমি খাব।”
মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। তারপর খাইয়ে দিল। খেতে খেতে তিতির বলল,
-“না, আমরা কালই বিয়ে করবো সুস্থ হই বা না হই।”
-“আচ্ছা বাবা আচ্ছা.. ঠিকাছে কালই বিয়ে করবো, এখন তো খাও।”
তিতির খাওয়া শুরু করলো এমন সময় পিউ এল। তিতির হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“আমার পিউপাখি!”
পিউ এসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
-“ইশ, ভাবী তোমার তো অনেক জ্বর।”
তিতির বলল,
-“ঠিক হয়ে যাবে।”
মুগ্ধ তিতিরকে খাওয়াতে খাওয়াতেই পিউকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর সাথে কি ইকরার দেখা হয়েছিল?”
-“হ্যা, কেন ভাইয়া?”
-“ওকে কি বলেছিস যে তিতির এসেছে?”
-“হ্যা। না মানে… আপু স্নিগ্ধর কথা জিজ্ঞেস করছিল ওর সাথে নাকি কি কাজ আছে কিন্তু ও নাকি ফোন ধরছে না। পরে আমি বললাম আমি জানিনা ও তো বিকেলেই মা কে আনতে কুমিল্লা গিয়েছে। আপু জিজ্ঞেস করলো কেন মামীর তো আরো পরে আসার কথা। তখন না আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি ভাবীর কথাটা। কি হয়েছে ভাইয়া?”
-“বাসায় এসেছিল আমার মেজাজটা খারাপ করতে।”
-“সরি ভাইয়া।”
-“আমাকে বলছিল মা নেই তাই খোঁজ নিতে এসেছে। আমিতো আগেই বুঝেছি ও তিতির আসার খবরটা পেয়েই এসেছে।”
-“আমি বুঝতে পারিনি শুনেই ও চলে আসবে। তাহলে বলতাম না।”
-“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিকাছে। যা গেছে তা গেছে।”
-“ওকে ভাইয়া, আমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে নিই?”
-“হ্যা, যা।”
তিতিরকে খাওয়ানো শেষ করে ওষুধগুলো টুকরো টুকরো করতে করতে মুগ্ধ বলল,
-“কি আজব না? এতবছর প্রেম করেও জানতে পারলাম না যে তুমি আস্ত ওষুধ খেতে পারো না। জানলাম এসে আজ সকালে। আরো কত কি জানি অজানা আছে আমার।”
তিতির বলল,
-“আর আমার?”
-“তোমারও হয়তো আছে। সত্যিই প্রেম করে একসাথে থাকা আর বিয়ের পর একসাথে থাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য।”
তিতির বাচ্চাদের মত হাত তুলে বলল,
-“ইয়েএএএএ কি মজা কালকে আমাদের বিয়ে।”
মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা, অনেক মজা। তাই তুমি এখন ঘুমাও। আমি মাকে একটা ফোন করি?”
-“ওক্কে।”
তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ মাকে ফোন করলো।
-“মা, কখন রওনা হচ্ছো?”
মা বলল,
-“আমরা কাল খুব ভোরে রওনা দিয়ে দিব। সকাল সকাল পৌঁছে যাব। তারপর তিতিরকে নিয়ে একটু শপিং এ যাব। তুই কিন্তু বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট সব করে রাখিস যাতে সন্ধ্যানাগাদ বিয়েটা কম্পলিট হয়ে যায়।”
-“মা ওর তো অনেক জ্বর।”
-“ডাক্তারের কাছে না গিয়েছিলি?”
-“হ্যা, ওষুধ দিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছি।”
-“তাহলে তো হলোই। জ্বরে কিছু হবে না, বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া দরকার। তুই আর কথা বলিস না তো।”
-“আচ্ছা মা তাই হবে, সেফলি এসো। কাল দেখা হবে, রাখছি।”
-“আল্লাহ হাফেজ।”
যা ভেবেছিল মুগ্ধ তাই হলো। তিতির একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে, খুক খুক করে কাশছে। অনেকক্ষণ আগেই পিউ একবার এসেছিল রাত জাগবে বলে। মুগ্ধ বলেছে ‘আমার এমনিতেও টেনশানে ঘুম হবেনা। আমিই থাকি, তুই ঘুমা।’ পিউও বুঝেছে মুগ্ধ তিতিরের কাছে থাকতে চাচ্ছে তাই ও ভাইয়ের কথা মেনে নিল। তিতির কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি! বাতাসও ছিল তাই ফ্যান বন্ধ করতে হলো। মেয়েটা যা পাগলামি করে মাঝেমাঝে, খুব চিন্তা হয় মুগ্ধর! রাত ১ টা পর্যন্ত ঠায় বসে রইলো তিতিরের মাথার পাশে। তারপর তিতিরের পাশে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তিতিরের ঘুম ভেঙে গেল। ফিরলো মুগ্ধর দিকে। বলল,
-“পানি খাব।”
মুগ্ধ উঠে পানি দিল। খেয়ে তিতির বলল,
-“তুমি ঘুমাওনি এখনো?”
-“না, ভাবছি।”
-“কি নিয়ে ভাবছো?
মুগ্ধ তিতিরের একটা গাল টিপে দিয়ে হেসে বলল
-“ভাবছি তোমাকে নিয়ে।”
তিতির মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো,
-“আমাকে নিয়ে কি ভাবছো?”
মুগ্ধ তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমার বউটা যে কতটা পাগলী তাই ভাবছি।”
-“পাগলী? কেন কি করেছি আমি?”
মুগ্ধ সেকথার উত্তর না দিয়ে হঠাৎই বলল,
-“আচ্ছা তুমি কি সত্যি চলে এসেছো? আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সত্যি কি এই সুখটা আমার কপালে ছিল?”
-“কি সুখ?”
-“এইযে, বাকী জীবনটা তোমার সাথে কাটাতে পারবো, এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? প্রতিদিন তোমার মুখটা দেখে ঘুমাতে যাব, আবার ঘুম থেকে উঠেও তোমার মুখটা দেখতে পাব। আর কি লাগে জীবনে?”
একথা শুনেই তিতির জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ তো আকাশ থেকে পড়লো কান্নার মত কি বলল ও খুঁজে পেলনা! বলল,
-“কাঁদছ কেন তিতিরপাখিটা আমার?”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“শুধু মুখ দেখবে কেন? আদর করবে না কেন?”
মুগ্ধ এবার হেসে দিল। তারপর হঠাৎই মনে হলো তিতির তো এরকম পাগলামি করে পরে সব ভুলে যায়। রেকর্ডিং করে রাখলে কেমন হয়, কাল যখন সব অস্বীকার করবে তখন শুনিয়ে মজা করা যাবে। ফোন বের করে রেকর্ডিং অন করলো মুগ্ধ। তারপর তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“শুধু মুখ না সব দেখবো আর অনেক অনেক আদরও করবো।”
-“তাহলে করো আদর।”
-“হুম, আগে সুস্থ হও। তারপর অনেক অনেক আদর করবো।”
-“না, আমাকে এখনি আদর করতে হবে। তুমি এমন কেন? আদর করতে চাও না কেন? অলওয়েজ খালি হাগ আর কিসসি! আর কিচ্ছু করতে পারোনা তুমি?”
মুগ্ধ তিতিরের মুখে এসব কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। অসুস্থ না হলে এখনি বুঝিয়ে দিতো মুগ্ধ কি পারে আর না পারে! তিতির বলল,
-“খালি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো কেন? হুম? আর কিছু কি তোমার চোখে পড়ে না?”
-“তিতির পাগল হলে আবার?”
তিতির সেকথার পাত্তা না দিয়ে ওড়নাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। তারপর বলল,
-“এই দেখো কত্ত সুন্দর একটা ক্লিভেজ! জীবনে তো একবার তাকালেও না।”
মুগ্ধ অবাক হতে হতে শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। ওড়নাটা তুলতেই তিতির জোরে জোরে বলল,
-“খবরদার, ওটা ধরবা না। ফেলো ফেলো বলছি।”
মুগ্ধর ভয় করলো যদি পিউ চলে আসে! পিউকে দেখে হয়তো তিতির নালিশ করবে। কার কাছে কি বলছে সেই বোধ এখন ওর নেই। মুগ্ধ ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির তিতিরের কথামতো ওড়নাটা ফেলে দিল। তিতির মুগ্ধর একটা হাত নিয়ে ওর কোমরে রাখলো। তারপর বলল,
-“এখানে ধরো।”
মুগ্ধর নিঃশাস বন্ধ হবার জোগাড়। কোনরকমে বলল,
-“আস্তে কথা বলো পিউ উঠে আসবে নাহয়।”
-“আচ্ছা আস্তে কথা বলবো কিন্তু তাহলে আদর করো।”
-“তিতিরপাখি আমার, তুমি না অনেক লক্ষী! ঘুমাও প্লিজ, এভাবে আদর করা যায়না বাবা।”
তিতির এ ব্যাপারে কোন কথা না বলে বলল,
-“এই তুমি এই টি-শার্ট টা পড়ে আছো কেন? খুলো এটা, এটা খুব পচা।”
তারপর টি-শার্ট টা ধরে খুলতে চেষ্টা করতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আরে, পাগল হলে নাকি?”
তিতির জবাব দিল না। টি-শার্ট টা কামড়ে ছিঁড়তে চেষ্টা করলো। পাতলা টি-শার্ট হওয়ায় খানিকটা ছিঁড়েও গেল। তারপর মুগ্ধ নিজেই টি-শার্ট টা খুলে দিল। তিতির পাগলের মত হামলে পড়ে কামড়াতে লাগলো মুগ্ধর বুকে। কামড়াতে কামড়াতে একসময় রক্ত বের হয়ে গেল। মুগ্ধ বাধা দিল না।
একটু পর হঠাৎই তিতির উঠে সোজা হয়ে বসলো। মুগ্ধ বলল,
-“কি?”
তিতির উত্তর দিল না। আচমকাই মুগ্ধ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের কামিজটা খুলে ফেলল। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“এই কি করছো?”
কিন্তু ততক্ষণে তিতির খুলে ফেলেছে। মুগ্ধ কাঁথাটা তিতিরের গায়ে দিতেই তিতির সেটা ফেলে দিল। তারপর মুগ্ধর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টটা খুলতে চেষ্টা করলো। মুগ্ধ ধরে ফেলল। ওর সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস টা যেন গলায়ই আটকে যাবে। কোনভাবে বলল,
-“তিতির আমাকে এভাবে মেরোনা প্লিজ, লক্ষী না তুমি?”
তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তুমি এমন করছো কেন? কেন আদর করছো না? তুমি আসলে আমাকে আদর করতেই চাওনা।”
মুগ্ধ তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁথাটা আবার গায়ে দিয়ে দিল। তারপর ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,
-“আমি এভাবে কিছু করতে চাইনা তিতির। সুস্থ হয়ে তো সব ভুলে যাবে। কিন্তু আমি চাই আমাদের ফার্স্ট এক হওয়ার স্মৃতিটা সারাজীবন তুমি মনে রাখো। এত এত আদর করবো যা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আজকে শুধু পাগলামি করো না প্লিজ।”
তিতির কিছু বলল না আর। কাঁদতেই থাকলো। মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“তোমাকে আমার অচেনা লাগছে। সুস্থ থাকলে তুমি কখনোই এরকম করতে না, উল্টো লজ্জা পেতে। তোমাকে আমার ওইভাবেই ভাল লাগে। এখন থেকে তো তুমি সারাক্ষণ আমার কাছে থাকবে, অনেক অনেক আদর করবো, তুমি দেখে নিও।”
তিতির কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
কিন্তু মুগ্ধর চোখে আর ঘুম নেই, চলছিল বিরামহীন তুফান বাইরে ও ভেতরে!
ভোরে তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো ও আর মুগ্ধ জড়াজড়ি করে একটা কাঁথার মধ্যে শুয়ে আছে। মুগ্ধ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, ইশ কী মায়াবী লাগছে। কিন্তু বাসায় তো পিউ আছে। পিউ থাকতেও মুগ্ধ ওর সাথে ঘুমালো! পিউ কি মনে করলো! ধ্যাত, ছেলেটার না একফোঁটা লজ্জা নেই। উঠে বসতেই কাঁথা সরে গেল আর ও অবাক হয়ে দেখলো ওর গায়ে কিচ্ছু নেই। শুধু একটা সালোয়ার পড়া। তাড়াতাড়ি কাঁথাটা টেনে গায়ে জড়ালো। মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলো কাল রাতে কি হয়েছিল! কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওদিকে কাঁথা টান দিতেই মুগ্ধর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। মুগ্ধ বলল,
-“এখন আর ঢেকে কি হবে?”
তিতির লজ্জায় প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
-“তুমি এটা কেন করলে?”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“হায় খোদা! এখন আমার দোষ হলো?”
তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ উঠে বাথরুমে গেল আর বলল,
-“ড্রেস পড়েন।”
মুগ্ধ বাথরুমে ঢুকতেই তিতির তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে নিল। ভাবতে লাগলো কি হয়েছিল রাতে? মুগ্ধ ওভাবে কথা বলল যে! ও নিজেই কি জ্বরের ঘোরে কিছু করেছে? মুগ্ধ ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইয়ারফোন লাগালো। তারপর একটা নিজের কানে দিয়ে আরেকটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল। তিতির বলল,
-“এটা কি?”
মুগ্ধ মুচকি হেসে বলল,
-“শোনোই না মন দিয়ে।”
রেকর্ডিংটা শুনতে শুনতে তিতির লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হয়ে গেল। কি করবে কোথায় লুকোবে বুঝতে পারছিল না। পুরোটা শোনার পর তিতির আর লজ্জায় মুগ্ধর দিকে তাকাতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,
-“কি বুঝলে? কিছু বলো?”
তিতির একটা কথাও বলল না। মুগ্ধ মিটিমিটি হাসছিল আর বলছিল,
-“আহা! এখন লজ্জা পাচ্ছো কেন? এখন তোমার আশিকি কোথায় গেল?”
মা আর স্নিগ্ধ ফেরার পর ওরা সবাই মিলে মিটিং এ বসলো। তিতির বসলো একদম মুগ্ধর মার গা ঘেঁষে। মা ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। প্রথম কথা উঠলো কাকে কাকে দাওয়াত করা হবে। মুগ্ধ বলল,
-“এত দাওয়াত ফাওয়াতের কি দরকার মা? আপাতত নিজেরা নিজেরাই করি। কয়েক মাস পরে নাহয় অনুষ্ঠান করবো, তখন সবাইকে দাওয়াত দিও?”
মা বলল,
-“হ্যা সেটা তো করতেই হবে। কিন্তু এখনও তো তোর চাচা,ফুপী,মামা খালাদের না বলে পারবো না। অন্তত যারা ঢাকায় আছে।”
-“না মা, কাউকেই বলোনা। লাগলে সামনের মাসেই অনুষ্ঠান টা করবো। তবু আজ কাউকে বলো না।”
-“কিন্তু বিয়ের জন্য সাক্ষী লাগে।”
-“আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের ডেকে নিচ্ছি। রিলেটিভ কাউকে চাচ্ছি না। জানি এসেই পিঞ্চ করতে শুরু করবে, আজকের দিনে আমি মেজাজ খারাপ করতে চাই না।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু বাবা বিয়ে পড়াতে কাজী আসবে, রেজিস্ট্রি করতে উকিল আসবে, তোর ফ্রেন্ডরা আসবে তাই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা তো কিছু করতে হবে।”
-“হ্যা, সেটা তোমার যা মন চায় করো।”
-“বাসায় প্রায় সবই আছে।শুধু টুকটাক কিছু বাজার লাগবে।”
-“আচ্ছা আমি আর স্নিগ্ধ যাচ্ছি বাজারে, কি কি লাগবে লিস্ট করে দাও।”
-“দুজন গিয়ে কি করবি? তুই একা যা। স্নিগ্ধকে অন্য কাজে পাঠাবো।”
স্নিগ্ধ বলল,
-“কি কাজ আম্মু?”
মা বলল,
-“ওইযে ফুলের কাজ করে না? তুই ওদের আনতে যাবি। বাসরঘর সাজাবার জন্য।”
তিতির লজ্জা পেল, কিন্তু কিছু বলল না। ছোট ভাইবোনদের সামনে মুগ্ধও যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। বলল,
-“আরে না মা। বাসরঘর সাজানো লাগবে না।”
-“একটা থাপ্পড় মারবো যদি সবকিছুতে না না করিস। বিয়ে যেমনভাবেই হোক সেটা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের খুব স্পেশাল একটা দিন। সেটাকে স্পেশাল করার জন্য কিছু তো করতেই হবে। এই দিন জীবনে বারবার আসবে না।”
-“আচ্ছা আচ্ছা যা মন চায় করো।”
-“উকিল আর কাজীর সাথে কথা বলেছিস?”
-“হ্যা, ওনারা সন্ধ্যা ৬ টায় চলে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
মা এবার তিতিরের দিকে ফিরে বলল,
-“মা চলো আমরা একটু শপিং এ যাই। তোমাকে বউ সাজাতে হবে না?”
তিতির বলল,
-“না না, আন্টি আমি এখন শপিং এ যাব না।”
-“এখনো আন্টি বলছো? মা বলো।”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা মা। আমার মা।”
-“হ্যা, এবার বলো শপিং এ কেন যেতে যাচ্ছো না?”
-“এখন বিয়েটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট মা। কি পড়লাম কি সাজলাম সেটা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে কি লাভ? সময়ওতো নষ্ট হবে। আপনার ছেলের কাছে আমার কয়েকটা শাড়ি আছে। সেখান থেকে একটা শাড়ি পড়ে নেব।”
মা তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“মাগো, তোমার শ্বশুর বেঁচে থাকলে দেখতে কত কি করতো। আমাদের তো পালিয়ে বিয়ে হয়েছিল। খুব সাদামাটাভাবে হয়েছিল আমাদের বিয়ে। তাই মুগ্ধর বিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের অনেক স্বপ্ন ছিল। ইচ্ছে করছে না এমন চুপচাপ বিয়ে দিতে। যাই হোক, তুমি যখন চাইছো না শপিং এ যেতে আমি জোর করবো না। কিন্তু বউ তো সাজতে হবে মা। পালিয়ে গিয়ে আমাদের বিয়ে হলেও তোমার শ্বশুর আমাকে বেনারসি শাড়ি দিয়েছিল বিয়েতে। খুব যত্ন করে রেখেছিলাম মুগ্ধর বউয়ের জন্য। তুমি কি আজ ওটা পড়বে? আর মুগ্ধর বউয়ের জন্য যে গয়নাগুলো বানিয়েছিলাম সেগুলো?”
-“অবশ্যই পড়বো মা। আমি শুধু শপিং এ যেতে চাচ্ছিলাম না। আপনার বিয়ের শাড়ি পড়বো এটাতো আমার সৌভাগ্য।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে তাহলে।”
বিকাল ৪ টা। তিতির মুগ্ধর ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে। সাজগোজ কিছু নয়, শুধু একটা লাল বেনারসি। মুগ্ধর মায়ের বিয়ের বেনারসি। আর কানে ঝুমকা, গলায় নেকলেস, হাতে চুড়ি, কপালে টিকলি-টায়রা, নাকে নথ আর চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়েছে ব্যাস। ঘরের বিছানায় লাল রঙের একটা বেডকভার দেয়া হয়েছে। বিছানার উপর বেলী আর গোলাপ ফুল দিয়ে বাসরঘর সাজানো হয়েছে, সিম্পলভাবে সাজানো হয়েছে কিন্তু তিতিরের মনে হলো এত সুন্দর বাসরঘর এর আগে কোনদিনও দেখেনি ও। আজ রাতে এই বিছানায়ই মুগ্ধর হাতে তিতিরের মরণ হবে, সুখের মরণ। ভাবতেই লজ্জা লাগলো তিতিরের।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির ফিরে তাকাতেই সাদা পাঞ্জাবী পড়া মুগ্ধকে দেখতে পেল। মুগ্ধ ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ইশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে তিতিরকে। মুগ্ধ তিতিরের দিকে এগিয়ে গেল। ও এমন হা করে তাকিয়ে আছে যে তিতিরের লজ্জাই করছে। মুগ্ধ কাছে এসে আঁচলটা তুলে ঘোমটা দিয়ে দিল তিতিরের মাথায়। তারপর মুখটা দুহাতে ধরে বলল,
-“পুরা বউ, তোমাকে যে কি সুন্দর লাগছে তিতির। বলে বোঝাতে পারবো না। অসাধারণ অসাধারণ। দাঁড়াও..”
একথা বলেই মুগ্ধ আলমারির দিকে গেল। আলমারি খুলে সিলেটের সেই লাল টিপের পাতাটা বের করলো। একটা টিপ উঠিয়ে তিতিরের কপালে পড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
-“একদম পারফেক্ট বউ আমার।”
তিতির মুচকি হাসলো। বলল,
-“এই তুমি যে এমন সময় ঘরে এলে কেউ কিছু মনে করবে না?”
-“আরে না।”
-“আমি বাইরে যাই, কেউ যদি চলে আসে?”
মুগ্ধ তিতিরকে যেতে দিল না। বলল,
-“সবাই ব্যাস্ত, কেউ আসবে না। আর শোনো একটা কথা, আমি বোধহয় এ মাসে ছুটি পাব না। তাই হানিমুনের জন্য তোমাকে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।”
-“আমার কোন সমস্যা নেই।”
-“কাছে কোথাও গেলে যেতে পারতাম শুক্র, শনি বার।”
-“আমরা কোথায় যাব?”
-“কেন কাশ্মীর। সব ভুলে গেছো? আমরা প্ল্যান করেছিলাম না হানিমুনে কাশ্মীর যাব?”
-“ভুলিনি, মনে আছে। তবু যদি চেঞ্জ করো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
-“না চেঞ্জ করবো কেন? যেরকম প্ল্যান হয়েছিল সেরকমই হবে। যেহেতু ১২ দিনের ট্রিপ তাই এখনই যেতে পারছি না। এতগুলো দিনের ছুটি হুট করে পাওয়া সম্ভব না।”
-“আচ্ছা আচ্ছা সমস্যা নেই তো।”
-“তোমার পাসপোর্ট আছে?”
-“না।”
-“ওহ, তাহলে এর মধ্যে পাসপোর্ট টাও করে ফেলবো।”
-“আচ্ছা।”
“আচ্ছা তিতির, এসবের কোন মানে হয় বলো?”
-“কোন সবের?”
-“এইযে…. বাসরঘর রেডি, বিছানা রেডি, বর রেডি, বউ রেডি। অথচ শুধু একটা বিয়ের জন্য বসে থাকতে হচ্ছে, এর কোন মানে হয়? চলো শুরু করে দিই?”
তিতির মুগ্ধর বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-“যাহ, যত্ত আজেবাজে কথা!”
-“এহ, আজেবাজে কথা আমি বলি? কাল রাতে কি বলেছিলে? আমি হাগ আর কিস ছাড়া কিছুই করতে পারি না! আর শুধু কি বলা! কি যে করেছো! আমার ইজ্জত যায় যায় অবস্থা, প্যান্ট ধরে টানাটানি! ছিঃ এই ছিল তোমার মনে?”
তিতির লজ্জায় লুটিয়ে পড়ছিল। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“আজকে রাতে যে তোমার কি হবে তিতির! রেডি থেকো। কাল সারারাত আমাকে কষ্ট দিয়েছো। সব শোধ তুলবো আজ রাতে। খালি বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। খুব ভালভাবে বোঝাবো মুগ্ধ কি পারে আর কি পারে না।”
তিতির মুগ্ধর বুকে কিল মারতেই মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধও। তিতির বলল,
-“তুমি আমাকে আর গান শোনাও না কেন? সেইযে সিলেট গিয়েছিলাম। দু’দিনে একটা গানও শোনাওনি।”
-“তখন কি গান গাওয়ার মত মন মানসিকতায় ছিলাম? তুমিও তো শুনতে চাওনি।”
-“তা অবশ্য ঠিক।”
-“দুজনেরই তো তখন বুকের ভেতর কষ্টের চাষবাস চলছিল।”
-“হুম।”
-“এখন শুনবে?”
-“হ্যা। কিন্তু কেউ শুনলে কি ভাববে?”
-“শুধুমাত্র বাংলা সিনেমাতেই সম্ভব অনেক দূর থেকেও গান শুনতে পাওয়া। এটা বাস্তব, তাই এখানে বসে গাইলে তা বাইরে যাবেও না। আর কেউ হুট করে আসবেও না।”
-“তাহলে শুনবো, গাও.. আমি কান পেতে আছি।”
-“এটা আমার অনেক অনেক প্রিয় একটা গান তিতির। কিন্তু তবুও এই গানটা আমি কখনো তোমাকে শোনাইনি। জমিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের রাতে তোমাকে শোনাব বলে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি রাতে গান টান গাওয়ার যময় পাব না। তাই এখনই শোনাচ্ছি।”
তিতির লজ্জা পেয়ে সরে যাচ্ছিল,
-“উফফফ তুমি না!”
মুগ্ধ ওকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে হেলান দিয়ে গাইতে শুরু করলো,
“বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে
অনেক নতুন ভাষা
অনেক দিনের স্বপ্ন যে
অনেক দিনের আশা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তোমায় পেয়ে হয় যে মনে
আর জনমেও সাথে ছিলাম
আমরা দুজন মনের সুখে
অনেক জনম ঘুরে এলাম
চিরদিনই থাকবে একই
আমাদের এই ভালবাসা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তুমি আমার অনেক আপন
মেনে নিয়েও বলে এমন
হওনা তুমি আরো কাছে
হওনা তুমি আরো আপন
এক সাগরে মিলবো বলে
তোমার আমার স্রোতে ভাষা।
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে
অনেক নতুন ভাষা
অনেক দিনের স্বপ্ন যে
অনেক দিনের আশা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি!”
তিতির বরাবরই এভাবে মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে গান শুনতে পছন্দ করে। মুগ্ধর বুকের পাঁজর যেন প্রতিটা ধুকধুক এর মধ্য দিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তিতিরের গাল। আর গানের প্রতিটা কথা, সুর সাথে প্রিয় মানুষটার কণ্ঠস্বর কানের এত কাছে! গান শেষ করে তিতিরের কানে কানে মুগ্ধ বলল,
-“আজ রাতে তো তুমি শেষ।”
তিতির লজ্জায় লজ্জায় এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। মুগ্ধ হাত ধরে থামাতে গিয়ে খেয়াল করলো তিতিরের হাতে সুন্দর নকশা করা মেহেদি। বলল,
-“তুমি মেহেদি পড়েছো?”
-“হ্যা।”
-“আমি একদমই খেয়াল করিনি। কখন পড়লে? খুব সুন্দর হয়েছে। নতুন বউয়ের হাতে মেহেদি নাহলে কি হয়?”
-“জানো মাও এই কথাটাই বলেছিল। আমি পড়তে চাইনি প্রথমে, লজ্জা লাগছিল। পরে মা আর পিউয়ের জোরাজুরিতে পড়েছি।”
-“কখন লাগিয়েছো? আমি তো দেখলামই না।”
-“তুমি তখন বাজারে গিয়েছিলে। বাজার দিয়েই তো আবার চলে গেলে।”
-“হ্যা, কাজ ছিল তো। নিজের বিয়ের সব আয়োজন তো নিজেকেই করতে হচ্ছে।”
-“হুম, সেজন্যই দেখতে পাওনি।”
-“অল্পসময় রেখেছো তবু কি সুন্দর গাঢ় রঙ হয়েছে দেখেছো? তার মানে হচ্ছে তোমার বর তোমাকে অনেক ভালবাসবে।”
-“আমার বর তো আমাকে এমনিতেই অনেক ভালবাসে, মেহেদির রঙে কিছু যায় আসে না।”
মুগ্ধ ওকে কাছে এনে বলল,
-“ভালবাসা তো আজ রাতে টের পাবে সুন্দরী।”
তিতির এক ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। মুগ্ধ হাসতে লাগলো।
কিচ্ছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ড্রইং রুমে ইকরাকে দেখে। সাথে ফুপীও আছে। মা কি ওদেরকে বলেছে নাকি ওরা নিজ দায়িত্বে এসে হাজির হয়েছে? মা ভয়ে ভয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ কিছু বলল না। তবে আশেপাশেই থাকলো। কারন তিতির ওখানেই আছে, কখন যে ফুপী তিতিরকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বসে তার ঠিক নেই।
যেমন চিন্তা করলো তেমনই হলো কিছুক্ষণ পরই ফুপী তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“এভাবে বাবা-মা কে না জানিয়ে বিয়ে করছো তোমার ভয় করছে না?”
তিতির কি বলবে ভেবে পেল না আবার চুপ করে থাকলেও তো বেয়াদব ভাববে। ও ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে উত্তর দিল,
-“ফুপী, সবার বিয়েতে যে বাবা-মা থাকবে এমন তো কোন কথা নেই। আমার বাবা-মার বিয়েতেও তো মায়ের বাবা-মা ছিল না। তো? তারা কি সুখী হয়নি?”
-“তোর বাবা-মায়েরটা তো অন্য ব্যাপার ছিল। ভাবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল তাই।”
মা জানে মুগ্ধ আরো কথা বললে ওর মুখের লাগাম ছুটে যাবে। তাই মুগ্ধ কিছু বলার আগেই মা বলল,
-“ওদের ব্যাপারটা আমাদেরটার চেয়েও বেশি অন্য ব্যাপার। তোমরা তো সবটা জানো না তাই বুঝতে পারছো না।”
যেহেতু মা বলেছে তাই মুগ্ধ আর এব্যাপারে কিছু বলল না। পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“পিউ তুই তিতিরকে নিয়ে তোর ঘরে বা আমার ঘরে যা। আমার ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে নিচে। এক্ষুনি ওপরে চলে আসবে।”
পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে গেল। ইকরা লুকিয়ে চোখেরজল মুছে নিল তবু মুগ্ধর চোখ এড়ালো না। ইকরা কাঁদছে, কাঁদুক! শুধু ভালবাসলেই তো আর হয়না। ভালবাসার সঠিক পথটাও জানতে হয়।
মুগ্ধর ফ্রেন্ড তমাল চলে এসেছে। তমাল বলল,
-“এতদিনে তাহলে বিয়ে করছিস।”
মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-“কথা বলবিনা শালা, মেরে নাক ফাটিয়ে দেব। তুমি তো তোমার হিরোইনের সাথে বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে ফেলেছো আর আমি কেবল সুখের মুখ দেখলাম।”
তমাল মুগ্ধর কাধে হাত রেখে বলল,
-“সরি দোস্ত, আমার বোকামির জন্যই তোদের দুজনের জীবনে কাল নেমে এসেছিল। সেদিন আমার ওই কাজ করা উচিৎ হয়নি। সুপ্তিকে তো আমি ঠিকই বিয়ে করতে পেরেছি। কিন্তু আমার পাপে তোরা…”
মুগ্ধ তমালকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-“আরে থাম ভাই, ওইসব কথা বলে লাভ নেই। কপালে যা ছিল তাই হয়েছে, এখনো কপালে যা আছে তাই হতে চলেছে।”
তমাল চুপ, মুগ্ধ আবার বল,
-“সুপ্তি আর বাচ্চাদের আনিসনি কেন?”
-“সুপ্তি ওর বাবার বাড়িতে। পরে একদিন বউ দেখাতে নিয়ে আসবো।”
ওরা কথা বলতে বলতেই মুগ্ধর অন্য ফ্রেন্ডরা চলে এল। সবাই গল্পগুজব করছে। মা রান্নাবান্নায় ফিনিশিং দিতে গিয়েছে। ফুপী তাকে হেল্প করছে। ইকরা আর স্নিগ্ধও ড্রইং রুমের এক কোনায় বসে গল্প করছে। পিউ এসে ইকরাদের সাথে জয়েন করলো। তার মানে তিতির এখন একা। মনটা বারবার তিতিরের কাছে যেতে চাইছে। সবার চোখের আড়াল থেকে পা পিছিয়ে পিছিয়ে মুগ্ধ চোরের মত গিয়ে ঘরে ঢুকলো। তিতির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছিল। আচ্ছা, এজন্যই তাহলে পিউ বেড়িয়ে গিয়েছে। মুগ্ধ আচমকা গিয়ে তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তিতির লাফিয়ে উঠলো।
-“উফ তুমি না!”
-“ভয় পেলে কেন? কি ভেবেছিলে অন্য কেউ?”
-“নাহ, তবে হঠাৎ তো তাই চমকে গিয়েছিলাম।”
মুগ্ধ পেছন থেকেই তিতিরের কানের নিচে একটা চুমু দিল। তারপর বলল,
-“এই পৃথিবীতে মুগ্ধ ছাড়া আর কেউ কি আছে যে তোমার গায়ে টাচ করতে পারে?”
তিতির মুগ্ধর দিকে ঘুরে গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রাখলো। মুগ্ধ তিতিরের কোমরে হাত রাখলো। বলল,
-“লেটস হ্যাভ আ কিস! ইট উইল বি দ্যা লাস্ট কিস অফ আওয়ার আনম্যারেড আইফ।”
তিতির চোখ নামিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নিবিড়ভাবে চুমু খেল। তিতির ভেসে গেল অন্য কোন দুনিয়ায়। সিলেটের পর এই প্রথম মুগ্ধর এত কাছে আসা। যদিও কাল থেকে নাকি অনেক কিছুই হয়েছে সেসব কিছুই সেভাবে খেয়াল নেই তিতিরের। মুগ্ধ বলার পর সব মনে পড়লেও অনুভূতিগুলো তো আর পাওয়া যায় না। দুজনেই দুজনকে বেহুঁশ হয়ে চুমু খাচ্ছে। কেউই কেউকে ছাড়ছে না। কতক্ষণ যে পার হয়ে গেল কে জানে! হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠতেই তিতির ছেড়ে দিল,
-“যাও তোমার ফোন এসেছে।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমার ফোন পকেটে, তোমার ফোন এসেছে।”
মুখে হাসলেও মুগ্ধর কলিজার ভেতর অজানা একটা ভয় একটা কামড় দিয়ে উঠলো। তিতিরের ফোনটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা ছিল। তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানার ওপর। যেন ইলেক্ট্রিক শক লেগেছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুগ্ধর দিকে ফিরে ভয়ে ভয়ে বলল,
-“ভাইয়া।”
মুগ্ধর সারা শরীরের রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যা বোঝার বুঝে গেল মুগ্ধ। ফোনটা তুলে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-“ফোনটা ধরো।”
-“না প্লিজ, আমি ফোন ধরবো না।”
-“তিতির, আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে তুমি ফোনটা ধরো। আমার মনটা কেমন যেন করছে।”
-“না আমি ফোন ধরতে পারবো না।”
ওরা কথা বলতে বলতে কলটা কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা মেসেজ এল। তিতির বলল,
-“ভাইয়া মেসেজ দিয়েছে। আমার ভয় করছে মেসেজ টা ওপেন করতে। কোন বিপদ কি হয়েছে? আমি কি চলে এসে ভুল করলাম?”
মুগ্ধ ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো। মেসেজটায় ছিল,
“Baba heart attack koreche kalke, amader kauke kichu boleni. Aj amra ter peye hospital e anlam, sathe sathe emargency te admit koreche.. Dr. boleche onk deri hoye gese, Allah ke dakte… R kichu paren r na paren plz ektu doa korben, apnader notun jibon shuker hok!”
মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-“তিতির, আমাদেরকে বের হতে হবে এক্ষুনি।”
তিতির মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজটা পড়েই ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“আমার পাপে সব হয়েছে, শুধু এই ভয়টা পেয়ে আমি এতবছর আসতে পারিনি।”
-“এসব বলার বা ভাবার সময় এখন না তিতির। প্লিজ তুমি ওঠো।”
তিতিরকে ধরে ওঠলো মুগ্ধ। তিতিরের দৃষ্টি এলোমেলো। কেঁদেই চলেছে, কিছু করার নেই.. পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়েছে ওর মাথার উপর। ওর বাবা কি চলে যাবে? নাহ, আল্লাহ যেন এতবড় শাস্তি ওকে না দেয়। বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। বাবার কিছু হলে ও নিজেকে কক্ষনো ক্ষমা করতে পারবে না। আল্লাহ ওর পাপের শাস্তি যেন ওর বাবাকে না দেয়। মুগ্ধ বলল,
-“আরে কি হলো চলো? আর তার আগে শাড়িটা পালটে নাও। বাবা এভাবে তোমাকে দেখলে তার আরো ক্ষতি হতে পারে।”
তিতির গয়নাগাটি সব খুলল। তাড়াহুড়ো করে হাতের চুরি খুলতে গিয়ে খোদাই করা ডিজাইনের ঘষা লেগে হাত কেটে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না তিতির। মুগ্ধ যে ঘরে আছে সেদিকে খেয়াল নেই তিতিরের, ওর সামনেই শাড়ি খুলতে লাগলো। উফফ এত সেপটেপিন কেন লাগিয়েছে শাড়িতে! মুগ্ধ হেল্প করলো।
সবগুলো সেপটেপিন খোলা হতেই মুগ্ধ আলমারি থেকে একটা শার্ট নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়েই পাঞ্জাবিটা খুলে শার্ট টা পড়ে নিল। ওকে এভাবে চেঞ্জ করতে দেখেই মা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে মুগ্ধ? চেঞ্জ করলি? আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
-“তিতিরের বাবা হার্ট এট্যাক করেছে।”
মা নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। এর মধ্যে তিতির শাড়ি গয়না হাতে নিয়ে সালোয়ার কামিজ পড়ে বেড়িয়ে এল। ওগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বলল,
-“আমাকে মাফ করবেন মা।”
মা বলল,
-“এসব কথা এখন রাখো। তাড়াতাড়ি যাও।”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকাতেই মুগ্ধ বলল,
-“চলো।”
ওরা বেড়িয়ে গেল। সামান্য কজন অতিথিরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
মুগ্ধর ৭ তলার বাসা থেকে লিফটে উঠতেই তিতির তাকিয়ে দেখলো ম্যাক্সিমাম ফ্লোরে লিফট কল করা আছে অলরেডি। ৬ তলায় লিফটের দরজা খুলতেই তিতির মুগ্ধর হাত ধরে টেনে বের করলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগলো। অগত্যা মুগ্ধও দৌড় লাগালো। তিতিরের কান্না এক সেকেন্ডের জন্য থামেনি। গাড়িতে ওঠার পর থেকে তিতির বারবার ঘড়ি দেখছিল। মুগ্ধ বলল,
-“টেনশন করোনা। রাস্তায় জ্যাম নেই তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাব। তান্নাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো বাবা কোন হসপিটালে আছে?”
তিতির তাই করলো। তান্না কোন উল্টোপাল্টা কথা বলল না। সোজাসুজি বলে দিল কোন হসপিটালে আছে। মুগ্ধ বলল,
-“এ সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার কাছে আসার জন্য যদি আমি তোমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট না করতাম তাহলে তুমি আসতেও না আর এই অঘটন টাও ঘটতো না।”
-“নিজেকে দোষ দিও না। তুমি প্রেশার ক্রিয়েট না করলেও আমি আসতাম। বাসায় আমার উপর দিয়ে যা যাচ্ছিল তা আমি মানতে পারছিলাম না আর। তাই আমি গিয়েছি। কিনতি এটাও সত্যি বাবা নির্বাক ছিলেন সবকিছুতে। মা আর ভাইয়ার অত্যাচারে যেমন বাবা বাধা দেননি তেমনি নিজে এমন কোন কথা বলেনি যাতে আমি কষ্ট পাই। আর আমি বাবাকে এতটা কষ্ট দিলাম? আমি মানুষ না। আমি সত্যিই একটা কুলাঙ্গার।”
-“এসব বলেনা তিতির। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতির ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। চোখের পানি গাল বেয়ে বেয়ে পড়ে ওর জামা ভিজে গেছে। মুগ্ধর তো ক্ষমতা নেই এই কান্না থামাবার। আল্লাহ কেন এত কঠিন মুহূর্ত লিখে রাখে কপালে! মুগ্ধ বলল,
-“কাঁদেনা তিতির, কাঁদেনা। আমি বাবাকে হারিয়েছি। আমি বুঝি বাবা হারানোর কষ্টটা কেমন। তুমি অনেক ভাল আর অনেক লক্ষী একটা মেয়ে আল্লাহ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি এতটা কষ্ট দেবে না, দেখে নিও কিচ্ছু হবে না বাবার। তুমি তো বাবার কাছেই যাচ্ছো। তোমাকে দেখলে বাবার বুকের কষ্ট একদম কমে যাবে।”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমাকে ভালবেসে তুমি শুধু কষ্টই পেলে। আমি একটু সুখ দিতে পারলাম না তোমাকে।”
মুগ্ধ বাম হাতটা তিতিরের গালে রেখে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-“পাগলী এভাবে ভেবো না। যা পেয়েছি তা হাজার জনম তপস্যা করেও সবাই পায়না। আমার কোন আক্ষেপ নেই। তুমি আমার ভাগ্যেই লেখা নেই। এটা আমি মেনে নিলাম আজকে, তুমিও মেনে নাও।”
তিতির মুগ্ধর হাতটা ধরে কাঁদতে লাগলো। আজ শনিবার, রাস্তায় কোন জ্যাম নেই কিন্তু রাস্তা শেষই হচ্ছে না। বনানী থেকে ধানমন্ডি এটুকু রাস্তা যেন আজ হাজার মাইলের দূরত্ব হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা যেন একটা সেকেন্ডের ঘর পার করতে ৫ সেকেন্ড সময় নিচ্ছে।
হসপিটালে কেবিনের সামনেই তান্নাকে দেখা গেল। তিতিরের পেছন পেছন মুগ্ধও কেবিনে ঢুকতে নিতেই তান্না ওকে আটকে বলে,
-“তোর ভাগ্য ভাল যে আমার বাবা অসুস্থ নাহলে তোকে এখানেই মেরে পুঁতে দিতাম।”
একথা শুনে তিতির চমকে পেছনে তাকালো। মুগ্ধ চোখের ইশারায় ওকে ভেতরে যেতে বলল। তিতির ভেতরে গেল।
বাবার নিস্তেজ শরীর টা পড়ে আছে বিছানায়। বাবাকে এভাবে দেখে তিতিরের সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। বাবা ঘুমিয়ে আছে। বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতির। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো, ‘আল্লাহ, আমি যদি জীবনেও একটা ভাল কাজ করি তার বিনিময়ে বাবা জীবনটা রক্ষা করো।’
মুগ্ধকে তান্না কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। তবুও মুগ্ধ বসে রইল হসপিটালের লবিতে। ওর কেন যেন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
বাবার ঘুম ভাঙলো রাত ৮ টার দিকে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তিতির কাছে গিয়ে বসে বাবার হাতটা ধরে বলল,
-“সরি বাবা, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। তোমাকে না বলে আমি আর এক পা ও ফেলবো না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা, আমি আর কোনদিন এমন করবো না।”
তিতিরের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগলো। বাবা বললেন,
-“সুশান অনেক ভাল ছেলে। তোকে সুখে রাখবে। তুই চলে গিয়েছিস শুনেও বলেছে বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতেইই বলল,
-“হ্যা বাবা, আমি জানি সুশান অনেক ভাল। আমি সুশানকেই বিয়ে করবো বাবা। আমি তোমার সব কথা শুনবো। তুমি শুধু সুস্থ হয়ে ওঠো না বাবা প্লিজ।”
বাবা আর কিছু বললেন না, শুধু তিতিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রইলেন। যেন ছাড়লেই তিতির আবার পালিয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। যাতে বমি না হয় তাই ওনাকে ঘুমের অষুধ দেয়া হয়েছে। কেবিনে একটা এক্সট্রা বেড ছিল সেখানেই মা আর তিতির বসে আছে। চেয়ারে বসে আছে তান্না। মা বলল,
-“তান্না বাসায় চলে যা, সকালে তো আবার অফিসে যেতে হবে।”
তান্না বলল,
-“না না, আমি থাকবো। আমি গেলে ইঞ্জেকশান কে এনে দিবে। ১০ টায় ইঞ্জেকশান দিতে হবে তো আবার। এখন যে এনে দিয়ে যাব সেটাও তো সম্ভব না। ইঞ্জেকশান টা ঠান্ডা দিতে হয়। এখানে তো আর ফ্রিজ নেই।”
মা চাপা গলায় আস্তে আস্তে বলল,
-“কে আনবে মানে? যার জন্য এতকিছু সে আনবে। গায়ে বাতাস লাগিয়ে বাবার পাশে সঙের মতো শুধু বসে থাকলে তো হবে না।”
তান্না বলল,
-“না না, ও পারবে না। এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাড়ে যেতে হবে।”
মা বলল,
-“অবশ্যই পারবে, যে মেয়ে এতকিছু পারে সে মেয়ে সবই পারবে। যা বলেছি তাই কর।”
মায়ের খোঁচা দেয়া কথাগুলো তিতিরকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিল, কিন্তু কিচ্ছু বলার ভাষা নেই ওর। সত্যিই তো ওর জন্যই এতকিছু হলো। ও বলল,
-“ভাইয়া তুই যা, আমি পারব।”
রাত পৌনে দশটার দিকে তিতির গেল ইঞ্জেকশান কিনতে। মুগ্ধ হসপিটালের লবিতে বসেই দেখছিল তিতির বেরোচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো ওর সাথে কেউ আছে নাকি সেটা বোঝার জন্য। যখন বুঝলো কেউ নেই তখন পিছন পিছন গেল। তিতিরকে ডাকলো কিন্তু ও দাঁড়ালো না। ও কি ইচ্ছে করে দাঁড়ালো না নাকি ডাকটা শুনতে পায়নি! তিতির রাস্তা পাড় হতে নিল আর কোত্থেকে একটা গাড়ি চলে এল। মুগ্ধ দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
-“তিতির দাঁড়াও, গাড়ি আসছে তো।” তিতির সেকথা শুনলোও না নিজেও খেয়াল করলো না, ততক্ষণে গাড়িটা একদম কাছে এসে থেমে গেল। কিন্তু তবু তিতিরের গায়ে হাল্কা একটা ধাক্কা লাগলো। তিতির ছিটকে পড়ে গেল রাস্তায়। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ওঠালো। বলল,
-“কি করছিলে তিতির? রাস্তাটা দেখে পার হবে তো? এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? আরেকটু হলে তো সাংঘাতিক বিপদ হতো।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“তুমি এখনো এখানে কি করছো? যাওনি কেন?”
-“আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না।”
-“তুমি বাসায় চলে যাও। মা চিন্তা করবে।”
-“মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো যে এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
-“বাবার ইঞ্জেকশান কিনতে।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“তুমি কেন? তান্না কোথায়?”
-“মা ভাইয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সকালে অফিস আছে তো।”
-“তো? ছুটি নিতে পারতো না?”
-“ছুটি পায়নি হয়তো।”
-“দুনিয়ার এমন কোন অফিস আছে যে বাবার হার্ট এ্যাটাক হলেও ছুটি দেয়না?”
-“বাদ দাও।”
-“আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু কয়টাই বা বাজে এখন? এখন ইঞ্জেকশানটা এনে দিয়ে বাসায় যেতে তো ১১ টাও বাজতো না ওর। তোমার ভাই মনে হয় ১১ টা পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকে না?”
-“এসব বলে কি লাভ? কেন বলছো? উল্টো আমার দেরী করাচ্ছো। ১০ টায় বাবাকে ইঞ্জেকশানটা দিতে হবে।”
-“ও হ্যা সরি, চলো।”
মুগ্ধও গেল তিতিরের সাথে। ইঞ্জেকশান নিয়ে মুগ্ধ টাকা দিতেই তিতির বাধা দিয়ে বলল,
-“দিওনা তুমি। আমি দিচ্ছি।”
-“কেন তিতির? এটুকু কি আমি করতে পারিনা? মাত্র তো পাঁচশো টাকাই।”
-“না, আমি টাকা নিয়ে এসেছি। ফেরত নিতে পারবো না। ব্যাগ আনিনি দেখতেই পাচ্ছো।”
মুগ্ধ টাকাটা রেখে দিল। তিতির নিজের টাকাটা দিয়ে ইঞ্জেকশান নিল। তারপর দুজনে দোকান থেকে বেড়িয়ে সোজা হসপিটালের সামনে চলে এল। তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি আর আমাকে সেভ করতে বা সাপোর্ট দিওনা প্লিজ। আজ থেকে আমি একা। সব প্রতিকূল অবস্থা নিজেকেই ফেস করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বাবা, ভাইয়া আমাকে আগলে আগলে রেখেছে। তারপর সেই ১৭ বছর বয়স থেকে তুমি আগলে আগলে রেখেছো। আর কত? এবার তো নিজেরই নিজের হাল ধরতে হবে।”
-“তিতির, এভাবে বলো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“হয়তো হবে কিন্তু তোমার আমার পথটা আজ থেকে সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ভাল থেকো তুমি আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো।”
একথা বলে তিতির চলে গেল উপরে। মুগ্ধ তারপরেও অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলো হসপিটালে।
রাত একটার পর যখন মুগ্ধ বাসায় ফিরলো তখনও মা, পিউ, স্নিগ্ধ সবাই জেগে। মুগ্ধ বলল,
-“তোমরা এখনো জেগে বসে আছো কেন?”
মা বলল,
-“তিতিরের বাবা কেমন আছে?”
যদি বলে তান্না দেখতেও দেয়নি তো মা আবার কি না কি বলবে কে জানে! এখন অন্তত কোন কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না ওর। তাই বলল,
-“এখন ভাল আছে। মেডিসিন চলছে, চলবে।”
-“কি থেকে কি হয়ে গেল!”
-“তোমরা যে যার মত ঘুমাতে যাও। সারারাত জেগে থাকার মত কিছু হয়নি।”
কেউ আর একটা কথাও বলল না। যে যার মত ঘুমাতে গেল। মুগ্ধ ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই থমকে গেল মুগ্ধ! বাসর ঘর এখনো সাজানো! কমন সেন্সের এত অভাব কেন এদের? বিয়ে ভেঙে গেছে, বউ নেই কিন্তু বাসর ঘর এখনো আগের মতোই সাজানো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মুগ্ধ। তারপর এক হাতে টান দিয়ে সব ফুলগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিল। লাল রঙের বেডকভার টাও টেনে ফেলে দিল ফ্লোরে। কি হবার কথা ছিল আর কি হলো! একেই বলে ভাগ্য। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! কিন্তু কার উপর? কার উপর রাগ হলে একটু লাভ হবে? প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে কিন্তু চোখে পানি আসছে না। কেন আসছে না? কেন কাঁদতে পকছে না ও? কোন প্রশ্নের উত্তর আজ মুগ্ধর কাছে নেই। ও আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ফেইলার। সবার কাছে হেরে গেছে ও, সব কিছুর সাথে। এতদিনের ঝুলন্ত সেতু আজ ভেঙে পড়লো, বাহ!
ছোট্ট বেডসাইড টেবিলের উপরে ফ্রেমে রাখা ওদের কাপল ছবিটা হাতে নিল মুগ্ধ। দুজন দাঁড়িয়ে আছে, তিতির মুগ্ধর বামপাশে। মুগ্ধ তিতিরের কাধে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, তিতিরের বাম হাতটা মুগ্ধর বুকের উপর। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনের মুখেই হাসি। তিতির আর কখনো এই বুকে আসবে না। মাতাল করা দৃষ্টি, আর পাগল করা হাসি নিয়ে আর তাকাবে না। সব শেষ আজ। ৭/৮ বছর ধরে দেখা স্বপ্নটা সত্যি হতে পারলো না, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। এবার মা কে ও কি বোঝাবে? এতদিন তো বলতো, তিতির ফিরে আসবে তাই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখন? মা হয়তো কয়দিন চুপচাপ থাকবে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার টাইম দেবে। কিন্তু তারপর তো ঠিকই বিয়ের জন্য প্রেশার দিতে থাকবে। মা কেন বোঝেনা যে অন্য কোন মেয়েকে ও আর এই জায়গাটা দিতে পারবে না। অন্য কোন মেয়ের সাথে ওর এতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং কখনো হয়নি, হবেও না। অন্যকারো সাথে থাকা অসম্ভব, কেউ পারবে না তিতিরের মত হতে, কেউ না। অন্য কারো সাথে থাকার চেয়ে তিতিরকে ছাড়া থাকাটাও অনেক সহজ এটা মাকে কি করে বোঝাবে ও?
ঘড়ির কাটায় রাত আড়াইটা। তিতিরের বাবা ঘুমাচ্ছে, অন্য বেডে মাও ঘুমাচ্ছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তিতির, দৃষ্টি বাইরের দিকে। মায়ের পাশে ঘুমানোর মত যায়গা রয়েছে কিন্তু ওর চোখে তো ঘুম নেই। মুগ্ধ এখন কি করছে কে জানে। পাগলটার কত প্ল্যান ছিল আজকের রাতটাকে নিয়ে। আজ এক হবার কথা ছিল ওদের কিন্তু সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। ও তো হসপিটালের জানালার গ্রিলে চোখের জলের আহুতি দিচ্ছে কিন্তু মুগ্ধ? ওর তো ওর ঘরটাতেই থাকতে হবে, সেই ঘরে যে ঘরে ওদের জন্য বাসর ঘর সাজানো হয়েছিল। সেই ঘরে যে ঘরে বসে আজ বিকেলেও ও ভয় দেখিয়েছিল তিতিরকে। সে ঘরে কি করে থাকবে পাগলটা? তিতির নিজের পেটে হাত রাখলো, আর পারবে না ও মুগ্ধর বাচ্চার মা হতে! আর পারবেনা নাতি-নাতনীর মুখ দেখিয়ে বাবা-মার মন ভোলাতে। সব শেষ।
আজ দুটি মানুষের মৃত্যু হলো। যে মৃত্যু কেউ চোখে দেখতে পায়না। যে মৃত্যুতে কেই লাশ হয়ে যায় না। যে মৃত্যুর পর সৎকার করতে হয়না, লোক খাওয়াতে হয়না। যে মৃত্যু লুকিয়ে থাকে হাজার হাসির আড়ালে, লক্ষ সুখের মাঝের কাঁটা হয়ে। যে মৃত্যুতে জীবন শেষ হয়ে যায়না, শেষ হয়ে যায় শুধু সুখটুকু, অনুভূতিগুলো। আজ থেকে শুরু হলো দুটি মানুষের মৃতজীবন।
দুই সপ্তাহ পর তিতিরের বাবাকে বাসায় আনা হলো। তারপর তিতির একটু নিশ্চিন্ত হলো। ডাক্তার বলে দিয়েছে বাবাকে এখন থেকে খুব সাবধানে রাখতে হবে, উনি আর কোন ভারী কাজ করতে পারবেন না। এমনকি ওনাকে বাজার করতেও দেয়া যাবে না। ফুল বেডরেস্টে থাকতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।
তিতির ইদানিং খুব স্বাভাবিক আর হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে। সবকিছুই বাবাকে একটু ভাল রাখার জন্য। সারাদিন অফিস করে ফিরে বাবার সাথে গল্প করে তিতির, সারাক্ষণ হাসতে থাকে। তারপর রাতে যখন বিছানায় যায়, আস্তে আস্তে একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে রাতটা। যে তিতিরের ঘুমাতে কোন নির্দিষ্ট সময় বা বিছানা লাগতো না সে তিতির আজ সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে একটু ঘুমের জন্য, ঘুম আর আসেনা। আসবে কিভাবে, ঘুমের ওষুধ তো মুগ্ধর কাছে। সারাদিনের ব্যাস্ততার মধ্যে কোনভাবে ভুলে থাকা যায় মুগ্ধকে। কিন্তু রাতে? একসাথে থাক আর ফোনেই থাক রাতগুলো যে কতভাবে স্পেশাল করতো মুগ্ধ, নিজের জন্মটাকেই সার্থক মনে হতো তখন। আর আজ মুগ্ধর কণ্ঠস্বরটাও শুনতে পায়না ও। মুগ্ধ আর ওকে ফোন করেনা, ও নিজেও আর ফোন করেনা মুগ্ধকে। মুগ্ধর সাথে কাটানো মধুময় স্মৃতিগুলো ভেবে ভেবে কেটে যায় তিতিরের রাতগুলো। তারপর কোনদিন ভোরের দিকে ৩,৪ ঘন্টা ঘুমায়, কোনদিন তাও না। এভাবেই এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায় তিতির। এভাবেই কেটে যায় মুগ্ধহীন মৃতজীবনের অনেকগুলো মাস।
অফিস থেকে ফিরেই তড়িঘড়ি করে গোসলটা করে নিল তিতির। চুলগুলো কোনরকমে মুছে দ্রুত হেয়ার ড্রায়ারে শুকিয়ে নিল। তারপর মায়ের রেখে যাওয়া মেজেন্ডা রঙের কাতান শাড়িটা পড়ে নিল তিতির। চোখে কাজল টেনে বেড়িয়ে আসতেই মা বলল,
-“একি অবস্থা? একটুও সাজিসনি দেখছি। কেমন মরামরা দেখাচ্ছে! আয় আমার সাথে।”
মা তিতিরের হাত ধরে আবার ঘরে নিয়ে গেল। তিতির বলল,
-“আমাকে কিন্তু এভাবেই সুন্দর লাগছে।”
মা বলল,
-“না মা, একটু সাজতে হয়। হালকা একটু মেকাপ কর। আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে লিপস্টিক লাগা।”
এসব বলতে বলতে মা আলমারি থেকে গয়না বের করে আনলো। তিতির বলল,
-“আমি গয়নাগাটি পড়বো না মা। ভাল্লাগেনা আমার এসব পড়তে।”
-“বেশি না, শুধু এই দুলটা আর এই নেকলেসটা পড়ে নে। আর হাতে এই দু’গাছা চুড়ি। নাহলে একদমই খালি খালি লাগছে।”
তিতির আর কথা বাড়ালো না, ওগুলো পড়ে নিল। হালকা মেকাপও করলো, লিপস্টিকও লাগালো। মুগ্ধর সাথে পরিচয় হবার পর ও কোনদিন লিপস্টিক লাগায়নি। আজই প্রথম। মা বলল,
-“বাহ এখন কত সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।”
তিতির হাসলো। হাসিতো রেকর্ড করাই থাকে ঠোঁটের মধ্যে। প্রয়োজন হলেই তিতির ছেড়ে দেয় সেই রেকর্ড।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহাসের ফ্যামিলির সবাই চলে এল। সুহাসের বাবা-মা, দাদু, ভাই-ভাবি, ছোট বোন সবাই এসেছে। সবার মাঝে ঘোমটা মাথায় দিয়ে লাজুক মুখে বসে আছে তিতির। তিতিরের বাবা-মা, ভাই-ভাবিও আছে। সবাই কত গল্পগুজব করছে, কত হাসি-আনন্দ! আজ সবাই কত খুশি! হঠাৎ সুহাসের দিকে চোখ পড়তেই তিতির দেখলো সুহাস হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সুহাস অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওর যায়গায় মুগ্ধ হলে চোখ ফেরাতো না, বেহায়ার মত তাকিয়েই থাকতো। হাজার চেষ্টা করলেও কেউ কোনদিন মুগ্ধ হতে পারবে না, মুগ্ধ মুগ্ধই। তাই মুগ্ধর যায়গাটা এ অন্তরে সারাজীবন সুরক্ষিত থাকবে!
দুই ফ্যামিলির উপস্তিতিতে তিতির আর সুহাসের এঙ্গেজমেন্টটা হয়ে গেল। আজ সুহাস আলতো করে তিতিরের হাতটা ধরে যত্ন করে আংটি পড়িয়ে দিয়েছে। তারপর তিতিরও পড়িয়েছে। বাবা হাসছিল, বাবা খুশি। বাবার খুশির জন্য তিতির আজকাল সব করে। বাবার ভাল থাকার জন্যই আজও মৃত্যুর পথকে বেছে নিতে পারেনি তিতির।
আংটিটার দিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে রাত প্রায় ২ টার দিকে তিতির মুগ্ধকে ফোন করলো। প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরলো মুগ্ধ, ও বোধহয় জেগেই ছিল।
-“হ্যালো তিতির!”
-“কেমন আছো?”
-“ভাল, তুমি কেমন আছো?”
-“ভাল।”
-“মা, স্নিগ্ধ, পিউ সবাই ভাল আছে?”
-“হ্যা, কিন্তু মা সামান্য অসুস্থ।”
-“কি হয়েছে?”
-“তেমন কিছু না। ডায়াবেটিকস, হাই প্রেশার, এসব নিয়েই প্রব্লেম।”
-“ও।”
তারপর দুজনেই চুপ। একসময় মুগ্ধ বলল,
-“জানো? পিউয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
-“বাহ, কবে? কার সাথে?”
-“ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই। সামনের মাসের ৭ তারিখ।”
-“ওহ। তাহলে তো বেশিদিন বাকী নেই।”
-“হুম।”
-“আমাকে জানালেও না।”
-“কার্ড এলেই পৌঁছে যাবে তোমার কাছে। যদিও জানি তুমি আসবে না, তবু।”
-“আসব কিভাবে তোমার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখাবার অবস্থা তো আমার নেই।”
-“ফালতু কথা বলোনা তো।”
-“যাই হোক, পিউকে বলো আমার দোয়া সবসময় ওর সাথে থাকবে। ও অনেক অনেক সুখী হবে।”
-“হুম, তা এতদিন পর হঠাৎ তুমি আজ ফোন করলে?”
-“হ্যা, একটা কথা বলার জন্য।”
-“কি?”
-“আজ রাতে সুহাসের সাথে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে।”
-“ওহ! কংগ্রাচুলেশনস!”
-“থ্যাংকস।”
-“বিয়ে কবে?”
-“সামনের বছরের শুরুতেই।”
-“এত দেরীতে কেন?”
-“সুহাসদের কি একটা প্রব্লেম যেন আছে। তাই সময় লাগবে।”
-“ও।”
-“এবার তুমিও বিয়ে করে ফেল।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“হাসছো যে?”
-“এমনি। আচ্ছা, এখন রাখি। কাল আবার অফিস আছে।”
-“আচ্ছা।”
-“ভাল থেকো, সুখে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। টাটা…”
ফোন রেখেই তিতির কেঁদে ফেলল। কত কাছের মানুষ্টা আজ কত দূরের হয়ে গেছে! চাইলেই তাকে আর যা ইচ্ছা তা বলা যায়না। আংটিটা হাত থেকে খুলে রাখলো তিতির। এটুকুই ও পারে। আর তো কিছু ওর সাধ্যের মধ্যে নেই।
মুগ্ধ ইচ্ছে করেই ফোন রেখে দিল। আর কথা বলার মত শক্তি, সাহস আর মনের জোর নেই মুগ্ধর। রাত ২ টা বাজে, একসময় ৩ টা বাজবে। একসময় ৪ টাও বাজবে। কিন্তু মুগ্ধ ঘুমাতে তো পারবে না। একসময় সকাল হবে তারপর অফিসেও যেতে হবে। অফিসে না গেলে মা, ভাই-বোনদের খাওয়াবে কি? বাবা কেন এমন করলো? সবার দায়িত্ব ওর কাধে দিয়ে ফাঁকি মেরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল! ঠিক না, ঠিক না।
আজ তিতিরের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে, কিছুদিন পর বিয়ে হবে, বাসর হবে অন্য একটা ছেলের সাথে। নাকে নাকফুল পড়বে তিতির কিন্তু অন্য একটা ছেলের জন্য। অন্য কারো বাচ্চার মা হবে তিতির। আর ও হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে। কিছু করার নেই তো! ভালবাসা যে বড্ড অসহায়, বুকে প্রেম আছে কিন্তু বুকে জমানো সব আশার সলতেগুলো আস্তে আস্তে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। তবু বেঁচে থাকতে হবে মা, ভাই-বোনের জন্য। শালার মরারও উপায় নেই।
এলার্ম বেজে উঠতেই তিতির হাত বাড়িয়ে সেটাকে বন্ধ করলো। রাতে ঘুম আসেনা, ইনসমনিয়া হয়ে গিয়েছে বোধহয়। ঘুমাতে ঘুমাতেই ২/৩ টা বেজে যায়। তাই এলার্ম দিয়ে রেখেছিল, যাতে ভোর ৫ টায় উঠতে কোন প্রব্লেম না হয়।
তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখনো আলো ফোটেনি। এম্নিতেই তো শীতের দিনে সকাল কে ভোর মনে হয় আর ভোরকে রাত। কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নামলো। লাইট জ্বালিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে ঘরের দরজা খুলে বের হলো। রান্নাঘরে ঢুকে
পানি গরম দিয়ে তিতির একটা বাটিতে দুটো ডিম ভেঙে ভালভাবে ফেটে নিল। তারপর অন্য একটা বড় বাটিতে ময়দা, বেকিং সোডা, চিনি, লবণ একসঙ্গে চেলে নিল। এরপর তাতে ফাটানো ডিমের মিশ্রণটা ঢেলে দিল, সঙ্গে একটু বাটারমিল্ক দিয়ে পুরোটা একসাথে ব্লেন্ড করে নিল। এরপর এতে লাল রঙ (ফুড কালার) এবং ভ্যানিলা এসেন্স দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিল। তারপর গতকাল কিনে আনা হার্টশেপ মাঝারি সাইজের কেক প্যানটায় মিশ্রণটি ঢেলে ছড়িয়ে দিল। ৩৫০ ডিগ্রি প্রি হিটেড ওভেনে ২০ মিনিট বেক করতে দিয়ে দিল। চুলা জ্বালিয়ে গোসলের পানি গরম দিল, গোসল না করলে শীত লাগে বেশি। রান্নাঘরটা যতটুকু নোংরা হয়েছিল পরিস্কার করলো, যেকটা জিনিস মেখেছিল ধুয়ে রাখলো। কেক ডেকোরেশনের জন্য ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা ইত্যাদি ফ্রিজ থেকে বের করে পরিমাণমত একটা বাটিতে নিয়ে আবার ফ্রিজে রেখে দিল। বাটিটা ওর ঘরে রেখে আবার রান্নাঘরে ফিরে এল। রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে চোরের মত অপেক্ষা করতে লাগলো কেকটা বেক হবার জন্য। আর আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো যাতে মা এত তাড়াতাড়ি না ওঠে। যদিও মা ভোরে উঠে নামাজ পড়লেও ৬ টার আগে নিজের ঘর থেকে বের হন না। তবু ভয় ভয় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজ পেতেই বুক কেপে উঠলো তিতিরের। মা? যদি মা হয় কি বলবে ও এখন? ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির বুঝলো মা না, বাবা নামাজ পড়তে যাচ্ছে। ২০ মিনিট পর ওভেন থেকে কেকটা নামিয়ে কেকের মাঝখানে টুথপিক ঢুকিয়ে দেখলো বেক হয়েছে কিনা। হয়নি, আবার দিল ৫ মিনিটের জন্য। ৫ মিনিট পর একইভাবে চেক করে দেখলো বেক হয়ে গিয়েছে। ওভেন বন্ধ করে কেকটা নামিয়ে নিল। তারপর কেকটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক মা ওঠার আগে সব করতে পেরেছে। ফ্যান ছেড়ে কেকটা ঠান্ডা হতে দিয়ে গরম পানি নিয়ে গোসলে ঢুকলো তিতির।
গোসল করে বেড়িয়ে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে তিতির কেকটা ডেকোরেশন করতে বসলো। কেকের মাঝ থেকে কেটে তিনটা ভাগ করে নিল। একটি বাটিতে ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা দিয়ে বিট করে নিল। এরপর মিশ্রণটি কেকের নিচের অংশে খানিকটা দিয়ে কেকের আরেকটা অংশ দিয়ে চাপা দিল স্যান্ডউইচের মতো করে। তারপর আবার একইভাবে ক্রিমের মিশ্রণটি ঢেলে কেকের আরেকটা অংশ দিল। এবার কেকের উপরে চকলেট চিপস ও সুইট বল দিয়ে হালকা ডেকোরেশন করলো। ব্যাস রেড ভেলভেট চিজ কেক রেডি। কেকটাকে যত্ন করে বক্সে ঢুকিয়ে সরাসরি ব্যাগে চালান করে দিল তিতির।
আলমারি খুলে মুগ্ধর দেয়া চিকন সিলভার পাড়ের গাঢ় নীল শাড়িটা বের করলো তিতির। শাড়িটা শুধু একবারই পড়েছিল। শাড়িটা ওর খুব পছন্দের যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তাই বেশি পড়ত না ও। শাড়িটা পড়ার সময় কুচি দিতে দিতে আয়নায় একবার তাকালো। বাহ বেশ লাগছে তো! শাড়ি পড়া শেষ করে কানে সিলভার একটা ঝুমকা পড়লো। গাঢ় করে কাজলে চোখ আঁকলো। তারপর কপালে বড় একটা নীল টিপ পড়লো। হাতে কয়েকটা চুড়ি পড়লো। চুলগুলো খোলাই রাখলো। সাজ কমপ্লিট! এবার আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখলো, সব ঠিকঠাক আছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে ৭ টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে কি করবে! আধাঘন্টা শুয়ে রইলো। ৮ টা বাজতেই ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং এ গেল তিতির। টেবিলে বাবা, মা, ভাবী। ভাল হয়েছে ভাইয়া নেই, ও বোধহয় অফিসের জন্য বেড়িয়ে গিয়েছে, ৮ টায়ই বের হয় প্রতিদিন। ওকে দেখেই মা বলল,
-“বাহ, সুন্দর লাগছে তো তোকে। লিপস্টিক পড়িসনি কেন?”
-“লিপস্টিক ভাল্লাগেনা মা।”
-“তুই না একদম কেমন জানি!”
বাবা বলল,
-“কি দরকার? আমার মেয়ে তো এমনিতেই সুন্দর।”
তিতির খাওয়া শুরু করলো। ভাবী বলল,
-“সত্যি তিতির, তোমাকে কিন্তু সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে।”
মা বলল,
-“কি রে? আজ এত সাজগোজ? আবার শাড়িও পড়েছিস দেখছি।”
-“সব ভুলে যাও নাকি? তোমাকে বলেছিলাম না সেদিন আজ অফিসের পিকনিক। সব কলিগরা শাড়ি পড়বে, আমাকেও ধরলো। কি আর করা, পড়লাম।”
-“মাঝে মাঝে শাড়ি পড়বি, ভাল লাগে দেখতে।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা।”
নাস্তাটা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে পড়লো। ব্যাগটা খুব সাবধানে নিচ্ছিল ও, যাতে কেকটা নষ্ট না হয়, যদিও কিছু হবে না কারন কেকটা বক্সেই আছে তবু সাবধানের মার নেই। সুহাসের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার ৪/৫ মাস হলো! এঙ্গেজমেন্টের পর থেকে মা কত ভাল ব্যাবহার করে! আবার আগের মত। আসলে বাবা-মায়েরা সবসময় সন্তানের ভাল চান। কিন্তু ভাল চাইতে গিয়েই অনেক সময় কষ্ট দিয়ে বসে, বুঝে উঠতে পারেনা সন্তানের আসল ভালটা কোথায়! জেনারেশন গ্যাপের কারনেই এটা হয়। কিন্তু সন্তানরাও তো বাবা-মাকে তার চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে, বুঝে দিক আর না বুঝে দিক তিতিরও কম কষ্ট দেয়নি বাবা-মা কে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে আংটিটা খুলে টিস্যুতে পেঁচিয়ে ব্যাগের পকেটে রাখলো তিতির। রাতে বাসায় ফেরার সময় আবার পড়তে হবে।
ঘুম ভাঙার পরও শুয়ে রইলো মুগ্ধ তিতির যদি আসে! যদি আগের মত এসে ওর ঘুম ভাঙায়! আজকের দিনটা কি ও না এসে পারবে? অবশ্য নাও আসতে পারে, এখন তো ওর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। এখন তো চাইলেও এত সহজে আসতে পারবে না। যদি তিতির আসে সেই চিন্তা করে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে মুগ্ধ। আসলে ছুটি টা কাজে লাগবে আর না আসলেও রেস্ট নেয়া যাবে একটা দিন। কিন্তু মনে হচ্ছে আসবে। রাতে তিতির উইশ করেনি। যেহেতু উইশ করেনি, নিশ্চই কোন সারপ্রাইজ আছে। আবার নিজের মনকে সামলে নিল মুগ্ধ, এত বেশি ভাবলে পরে যদি না আসে তো খুব খারাপ লাগবে।
ওদিকে তিতির মুগ্ধর অফিসের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মুগ্ধ আসছে না। মুগ্ধ কি তাহলে আজ ছুটি নিয়েছে! মুগ্ধর বাসায় কি যাবে ও? না না যাওয়াটা ঠিক হবে না। মুগ্ধর মা ব্যাপারটা ভাল চোখে নাও দেখতে পারে। কি করবে! অফিস টাইম ১০ টা কিন্তু মুগ্ধ সাধারণত ৯:৩০-৯:৪৫ এর মধ্যে অফিসে আসে। ৯ টা থেকে অপেক্ষা করছে তিতির, যখন ১০:৩০ বেজে গেল তখন তিতির ফোন করলো মুগ্ধকে।
তিতিরের কল পেয়ে মুগ্ধর বুকের ভেতরটা নেচে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এল,
-“হ্যালো..”
-“হ্যালো, গুড মর্নিং।”
-“ব্যাড মর্নিং, তুমি আজ অফিসে যাওনি?”
-“না।”
-“কেন?”
-“ছুটি নিয়েছি।”
-“কেন? কোন কাজ আছে?”
-“নাহ তো। অফিস করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি।”
-“ওহ। তুমি কি ফ্রি আছো?”
-“হ্যাঁ, দেখা করবে?”
-“হ্যাঁ, চাচ্ছিলাম।”
-“কোথায় আসব বলো? আর কখন?”
-“এখনি এসো.. বনানী ব্রিজ।”
-“ওয়েট ওয়েট, বাই এনি চান্স তুমি কি বনানীতে? অফিসে গিয়েছিলে?”
-“অফিসে না, অফিসের সামনে।”
-“শিট! সরি।”
-“তুমি কেন সরি বলছো? আমি তো তোমাকে জানিয়ে আসিনি। তোমার তো দোষ নেই।”
-“আচ্ছা, শোনো আমি ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি ওদিকে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসো।”
-“আমি ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। তুমি ওখানে এসে ফোন দিও। আমি কোথায় থাকি ঠিক নেই।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ৫ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আলমারি খুলে একটা শার্ট হাতে নিতেই খেয়াল হলো তিতির অফিসের সামনে গিয়েছিল তার মানে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, নিশ্চই শাড়ি পড়েছে! পাঞ্জাবি পড়াটা আজ ফরজ। সামনেই তিনটা পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করা আছে। সাদা, লেমন, নীল। কোনটা পড়বে? আচ্ছা তিতির কি রঙের শাড়ি পড়েছে? কে জানে। যাই হোক, তিতিরের পছন্দের রঙ নীল। নীল পাঞ্জাবিই পড়া উচিৎ, আর এই নীল পাঞ্জাবিটা অনেক সুন্দরও। হাতের কাছে যে জিন্স পেল সেটাই পড়লো। পাঞ্জাবিটাও পড়লো, তারপর সাদা একটা কোটি পড়ে বোতাম লাগাতে লাগাতেই ঘর থেকে বের হলো। মা জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে মুগ্ধ, কোথায় যাচ্ছিস?”
-“ফ্রেন্ডরা এসেছে মা।”
-“ওহ, নাস্তাটাও করে যাবিনা?”
-“না, মা আমি খেয়ে নেব। ওদেরকে তো ট্রিট দিতেই হবে। তখন তো খাবই। তুমি খেয়েছো?”
-“হ্যা, স্নিগ্ধ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় নাস্তা করে গিয়েছে, ওর সাথে আমিও খেয়ে নিয়েছি।”
-“আচ্ছা মা, আসছি তাহলে।”
-“দাড়া। এত তাড়া কিসের?”
একথা বলে মা এগিয়ে গেল। মুগ্ধকে টেনে নিচু করে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“আমার সোনার ছেলের জীবনে এই দিনটা বারবার আসুক, হ্যাপি বার্থডে।”
মুগ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“লাভ ইউ মা।”
-“হয়েছে এবার যা।”
-“হুম, শোনো রাত্রে মজা করে কিছু রান্না করো কিন্তু। পিউকেও আসতে বলো। একা জামাইয়ের হাত ধরে যেন চলে না আসে আবার, শশুরবাড়ির সবাইকে নিয়ে আসতে বলবে।”
-“আচ্ছা।”
-“আর প্লিজ অন্য কাউকেই বলবে না। আমি বার্থডে পার্টি করছিনা যে আত্মীয়স্বজন দিয়ে ঘর ভরে ফেলবে। আমার ভাল লাগে না।”
-“তোর ফুপীকেও বলবো না? পাশাপাশি বাড়িতে থেকে না বলে পারে কেউ?”
-“ফুপীকে বললে ইকরা আসবে।”
-“হ্যা, তাতে সমস্যা কি? ইকরাকে তুই সবসময় এত ভুল বুঝিস কেন বলতো?”
-“মা মা প্লিজ ওর কথা বলোনা, আমি গেলাম। সন্ধ্যার পর ফিরবো, এসে যদি ইকরাকে দেখি বাসা থেকে বের হয়ে যাব বলে দিলাম, টাটা।”
মা আর কথা বলল না। মুগ্ধ যেতে যেতে বলল,
-“পারলে ছানার মিষ্টি বানিও।”
১৫ মিনিটের একটু বেশি সময়ই লাগলো মুগ্ধর। ব্রিজের সামনে গাড়ি থামিয়ে নামলো। তিতিরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। ফোন দিচ্ছে কিন্তু তিতির ধরছে না। আবার ডায়াল করলো। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে(টোকাই) এসে মুগ্ধর সামনে ২/৩ টা গোলাপ ধরলো। বলল,
-“হেপি বাড্ডে।”
মুগ্ধ হাসলো, তিতিরের কাজ। কিন্তু গেলটা কোথায় মেয়েটা। এরপর আরেকটা বাচ্চা ফুলহাতে এল। একই ভাবে ওকে গোলাপ দিল। সেটা নিতে না নিতেই আরেকটা বাচ্চা এল, ফুল দিল। সেই ফুল নিতে না নিতেই আরো দুটো বাচ্চা এসে ফুল দিল। সবাই ফুল দিয়ে দিয়ে বলছে, “হেপি বাড্ডে।” মুগ্ধ হাসতে হাসতে সেই ফুল নিচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি দেখছে তিতির। মুগ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে তিতিরকে খুঁজছে। কিন্তু বাচ্চাগুলোর হইচইয়ের কারনে অন্য কোন দিকে তাকাবার জো নেই। এরা একে একে আসছে আর ফুল দিয়ে উইশ করছে।
সবার ফুল দেয়া শেষ হতেই তিতির মিষ্টি একটা হাসি মুখে নিয়ে মুগ্ধর সামনে গেল। তিতিরকে দেখে মুগ্ধ হা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোন স্বর্গচূড়া থেকে দেবী নেমে এসেছে। তিতিরও নীল পড়েছে, কিভাবে মিলে গেল! ফুল দিয়ে সব বাচ্চারা হইহই করতে করতে চলে গেল। ওরা যখন যাচ্ছিল তখন মুগ্ধ খেয়াল করলো সবার হাতে একটা করে বিরিয়ানির প্যাকেট। তিতির মুগ্ধকে একটা গোলাপ দিয়ে বলল,
-“হ্যাপি বার্থডে, এটা ৩৪ তম ফুল।”
মুগ্ধ হেসে ফুলটা নিল। বলল,
-“ওহ, বাচ্চাগুলো সবাই মিলে কি আমাকে ৩৩ টা ফুল দিয়েছে?”
-“হ্যা।”
-“হায়রে! বুড়া হয়ে গেলাম। কেন তুমি আমাকে মনে করিয়ে দিলে যে এটা আমার ৩৪ তম বার্থডে?”
-“চিন্তা করোনা তুমি স্টিল অনেক ইয়াং আর হ্যান্ডসাম আছো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“বাই দ্যা ওয়ে, ওদের হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখলাম। তুমি কিনে দিয়েছো?”
-“হ্যা।”
-“আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে! আমি খাওয়াতাম।”
-“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি খাওয়াও গিয়ে, আমি ধরে রেখেছি নাকি? পথশিশুদের তো অভাব নেই। আমি অনেক কষ্টে ওদের জোগাড় করেছি, আমি প্ল্যান করেছি, আমি খাইয়েছি, তাতে তোমার কি?”
-“তাও ঠিক।”
-“থ্যাংকস ফর দ্যা সারপ্রাইজ।”
-“আমার সারপ্রাইজ তুমি নষ্ট করেছো আজ অফিসে না গিয়ে।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা, সরি।”
-“কিন্তু তোমাকে নীল পাঞ্জাবিতে দেখে আমিও সারপ্রাইজড হয়েছি।”
-“ওটা তো আমিও হয়েছি। তুমি নীল পড়ে আসেছো ভাবিওনি।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? চলো কোথাও যাওয়া যাক।”
গাড়িতে উঠেই মুগ্ধ বলল,
-“কোথায় যাবে?”
-“তুমি কতক্ষণ টাইম দিতে পারবে? আফটার অল টুডে ইউ আর দ্যা বার্থডে বয়। আজ সবাইকে টাইম দিতে হবে তোমার।”
-“রাতে বাসায় টাইম দিতে হবে। সারাদিন, সারা সন্ধ্যা ফ্রি।”
-“তাহলে পদ্মার পাড়ে যাব। নৌকায় চড়বো, পদ্মার ইলিশ আর শুকনো মরিচ ভাজা দিয়ে ভাত খাব।”
-“ইটস আ গ্রেট আইডিয়া কিন্তু নৌকায় চড়বে? ওদিকের নদীতে অনেক গ্যাঞ্জাম। ভাল লাগবে কি?”
-“যেদিকে গ্যাঞ্জাম নেই সেদিকে নিয়ে যাবে।”
-“আচ্ছা। কিন্তু তার আগে পেটে কিছু দিতে হবে। কিচ্ছু খাইনি। ঘুম থেকে উঠেই আসলাম। তুমি ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়েছো তো?”
-“হ্যা।”
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে মুগ্ধ বলল,
-“ভাল করেছো। কিন্তু আমার সাথে আবার খেতে হবে চলো।”
-“না না। আমি খাব না, আর তুমি খাবার নিয়ে গাড়িতে চলে আসো। রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আহ, আচ্ছা ঠিকাছে।”
মুগ্ধ দুজনের জন্যই খাবার পার্সেল করে নিল। তারপর গাড়িতে উঠেই আরেকটা সারপ্রাইজ পেল। ওর প্রিয় রেড ভেলভেট চিজ কেক নিয়ে বসে আছে তিতির। মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“রেড ভেলভেট চিজ কেক! ওহ মাই গড। কোথায় পেয়েছো? বানিয়েছো নাকি?”
-“হ্যা।”
-“মানে কি কিভাবে বানিয়েছো?”
-“যেভাবে বানায় সেভাবেই বানিয়েছি।”
-“সেটা তো বুঝলাম কিন্তু বাসায় কেউ দেখেনি? কি বলেছো?”
-“অনেক ভোরে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে বানিয়েছি।”
-“সত্যি তিতির, এরকম সিচুয়েশনে আমার খুব বেশি আফসোস লাগে তোমাকে সারাজীবনের জন্য পাবনা বলে। তুমি সবার থেকে আলাদা তিতির। তুমি অনেক লক্ষী, অনেক পাগলী। এই শীতের মধ্যে ভোর রাতে উঠে কয়টা মেয়ে পারে এসব করতে? পাগল না হলে পারা যায় না।”
খুশি মুগ্ধর চোখমুখে ঝিলিক দিচ্ছিল। তিতির বলল,
-“ভালবাসলেই পারা যায়। এখন কি একটু খেয়ে দেখবে কেমন হয়েছে?”
-“হ্যা অবশ্যই।”
হঠাৎ মনে পড়তেই তিতির বলে উঠলো,
-“হায় হায়। আমি তো ছুরি আনিনি। এখন কি হবে? কাটবে কিভাবে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“নো প্রব্লেম। তুমি আছো না?”
একথা বলেই মুগ্ধ তিতিরের হাতটা টেনে নিয়ে তিতিরের আঙুল দিয়ে কেকটা কাটলো। যদিও কেকটা ছড়িয়ে গেল। কাটার বদলে ভাঙা হলো। তবুও ব্যাপারটা তিতিরের এত ভাল লাগলো যা বলার মত না। তিতির মুগ্ধকে কেক খাইয়ে দিল। মুগ্ধও তিতিরকে খাইয়ে দিল। মুগ্ধ কেক খেতে খেতে বলল,
-“উম্মম্মম্মম্মম্ম… বেস্ট রেড ভেলভেট চিজ কেক এভার।”
একবারেই মুগ্ধ অর্ধেকটা কেক খেয়ে ফেলল। তিতিরের তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ও জানতো, মুগ্ধ এমনই করবে। এই কেকটা মুগ্ধর খুব প্রিয়। কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে পেস্ট্রি থাকলেই ও খুঁজত রেড ভেলভেট চিজ কেক আছে কিনা। ভোর রাতে উঠে চোরের মত আতঙ্ক নিয়ে কেক বানানোটা সার্থক।
দুপুরবেলা মাওয়া ঘাটে গিয়ে একটা স্পিডবোট রিজার্ভ করলো মুগ্ধ। উঠতে উঠতে বলল,
-“তিতির, আমরা ওপাড়ে গিয়ে ভাত খাব। এপাড়ে গ্যাঞ্জাম বেশি।”
-“আচ্ছা।”
স্পীডবোট চলতে শুরু করলে তিতির অকারনেই বারবার হাসছিল। ভাল লাগছিল মুগ্ধর। ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ওপাড়ে। ওপাড়ে গিয়েই ইলিশ মাছ ভাজা, শুকনো মরিচ ভাজা আর ভর্তা দিয়ে ভাত খেল ওরা। তারপর একটা ভ্যান ভাড়া করে গ্রামের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরলো। তারপর কিছুক্ষণ নৌকায়ও ঘুরলো। অনেক অনেক গল্প করলো ওরা কিন্তু খুব স্বাভাবিক সব গল্প। যেন ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক। যেন অনেকদিন পর দেখা হয়নি ওদের, প্রায়ই দেখা হয়।
ওপাড় থেকে ফিরতে ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখন তো ৫ টার সময়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুদূর যেতেই জ্যামে পড়লো। মুগ্ধ বলল,
-“তোমার বাসায় ফিরতে হবে কখন?”
-“দেরী হলেও প্রব্লেম নেই। বাসায় বলেছি আজ অফিসের পিকনিক।”
-“আচ্ছা। কি দুষ্টু মেয়ে রে বাবা।
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“কিন্তু এই জ্যাম ছাড়তে তো মনে হচ্ছে অনেক দেরী লাগবে।”
আরো কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ গাড়ি ঘুড়িয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে লাগলো।
-“গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো কেন?”
-“মেইনরোডের যে অবস্থা দেখলাম রাত ১০/১১ টায়ও পৌঁছতে পারবো না। ৮/৯ টার দিকে আবার পিউরা আসবে। আমি বাসায় না থাকলে কেমন দেখায় না?”
-“হ্যা তা তো ঠিকই। কিন্তু তুমি এসব রাস্তা চেন তো?”
-“হ্যা, আগে সাইক্লিং করতাম না? এখানে অসংখ্যবার এসেছি।”
-“ও।”
এরপর হঠাৎ মনে পড়ায় মুগ্ধ বলল,
-“ওহো ভাল কথা তিতির, খুব ভাল একটা খবর আছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে।”
-“কি কথা?”
-“পিউয়ের বেবি হবে।”
-“ওয়াও। এই কথাটা তুমি আজ আমাকে বলছ?”
-“আরে আমাকে বলেনি তো এতদিন। পিউ অনেকদিন আসেনা তাই মাকে জিজ্ঞেস করলাম পিউ আসেনা কেন? তখন মা বলল পিউ অসুস্থ, চিন্তা করো তখনো বলছিল না। পরে আমি তো টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম যে কি হলো আবার। তখন মা আমার অস্থিরতা দেখে বলল।”
তিতির বলল,
-“এসব কথা কাউকে বলতে হয়না। যত কম মানুষ জানবে তত ভাল।”
-“বাহ রে তা বলে আমিও জানবো না?”
-“পিউ বোধহয় লজ্জায় বলতে পারেনি।”
-“আরে বাবা লজ্জা কিসের? এটা তো ন্যাচারাল ব্যাপার।”
-“তুমি বুঝবে না।”
-“ইশ এমনভাবে বলছো যেন তোমার কতবার বেবি হয়েছে!”
তিতিরের মন খারাপ হয়ে গেল। সেদিন যদি ওদের বিয়ে হতো। প্ল্যানমতো আজ তিতিরেরও বেবি হতো। মুগ্ধ ব্যাপারটা খেয়াল করলো। ধ্যাত, কি বলতে কি বললো! মজা করতে গিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেলল। এখন সরি বলা মানে খুঁচিয়ে ঘা বাড়ানো। অন্যভাবে তিতিরের মনটা ভাল করে দিতে হবে। কি বলা যায় ভাবতে লাগলো।
তিতির অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“আজ ড্রাইভ করতে ভাল লাগছে না।”
-“কেন?”
-“তোমাকে দেখতে পারছি না যে তাই।”
তিতির হেসে বলল,
-“সারাদিন তো দেখলে!”
-“আজ তোমাকে এতই সুন্দর লাগছে যে সারাদিন দেখেও আশ মেটেনি।”
-“সিলেটের সেই রাতের থেকেও বেশি সুন্দর?”
মুগ্ধ আচমকা ব্রেক করলো। সিটবেল্ট বেধে না রাখলে এক্ষুনি মাথায় ব্যাথা পেত তিতির। মুগ্ধ গাড়ি থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। তিতির লজ্জায় ব্লাশ করছিল, খুব ভালও লাগছে বোধহয় ওর। মেয়েরা বোধহয় এমনই, প্রিয় মানুষের এটেনশান পেলে খুশিতে ফুটতে থাকে। তিতির বলল,
-“এখানে গাড়ি থামালে কেন? কেমন জঙ্গল জঙ্গল! আমার ভয় করছে।”
মুগ্ধ বলল,
-“জঙ্গল না এটা একটা গ্রাম। আশেপাশে বাড়িঘর নেই এই যা।”
-“যাই হোক, একটু ভুতুরে টাইপ। চালাও তো। গাড়ি চললে ভয় করে না। না চললে মনে হয় এক্ষুনি গ্লাস ভেঙে ভুত ঢুকে পড়বে।”
-“তুমি মোটেও ভয় পাচ্ছো না তিতির, ভাব ধরো না। তুমি ভয় পাবার মত মেয়ে না। আর যা খুশি তা হোক কিন্তু আগে বলো, তুমি এটা কি বললে? কি মনে করালে?”
-“কই কিছু না তো।”
-“তুমি আসলে বুচ্ছো খুব দুষ্টু একটা মেয়ে। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না। আসলে তলে তলে বহুত…”
-“কি? থামলে কেন? বলো..”
-“বলছি।”
একথা বলেই মুগ্ধ গাড়ির লাইটটা বন্ধ করে তিতিরের কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তিতির নিচু স্বরে বলল,
-“লাইট জ্বালাও ভয় করছে।”
অন্ধকারের যে নিজস্ব একটা আলো আছে সেই আলোতেই মুগ্ধ দেখলো তিতির তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। মুগ্ধর দৃষ্টিও তিতিরের চোখে। দুজন দুজনের খুব কাছে, একজনের নিঃশ্বাস আরেকজনের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। তিতির মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো, মুগ্ধ যেন এটুকু কাছে এসে সরে না যায়। ওর বিবেক যেন এতটা নিষ্ঠুর আজ না হয়। এতদিনের অপূর্ণতা যেন একবার হলেও ভরিয়ে দেয় ও। মুগ্ধর দৃষ্টিটা চোখ থেকে নেমে তিতিরের ঠোঁটে চলে গেল। তিতির চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তিতির ভেসে গেল।
এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে বের হয়ে ধানমন্ডি ৩ নাম্বার দিয়ে ঢুকলো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“আমাকে ৮ নাম্বারে নামিয়ে দিও। ওখান থেকে রিক্সা নিয়ে নেব।”
-“আচ্ছা।”
৮ নাম্বারে গিয়ে গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“আজকে তোমার বার্থডে সেলিব্রেট করার জন্যই আমি দেখা করেছি। কাল থেকে আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে।”
মুগ্ধ একটা প্লাস্টিক হাসি দিয়ে বলল,
-“হুম, আমি জানি। কিন্তু আর এভাবে এসোনা তিতির। এবছরই তো তোমার বিয়ে! তারপর এরকম হুটহাট দেখা আর হবে না আমাদের। এখন থেকে অভ্যাস করাই ভাল। তুমি এখন একজনের বাগদত্তা। তবু কাছে এসেছ যখন মনে হয়েছে তুমি আমারই। তাই কাছে না আসাটাই ভাল।”
তিতিরের চোখে পানি এল। কিন্তু মুগ্ধর সামনে ও ভুলেও কাঁদবে না, আজকের দিনে তো নয়ই। হেসে বলল,
-“আচ্ছা ঠিকাছে। ভাল থেকো।”
-“হুম, টেক কেয়ার অফ ইওরসেল্ফ। চলো তোমাকে রিক্সা ঠিক করে দিচ্ছি।”
তিতির হাত ধরে থামালো মুগ্ধকে। বলল,
-“দাঁড়াও, একটু পর।”
-“কি?”
তিতির হেসে মুগ্ধর গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“হ্যাপি বার্থডে এগেইন।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আই লাভ ইউ মাই রসগোল্লা।”
তিতির একটু মোটা হবার পর থেকে মুগ্ধ মাঝে মাঝে ওকে রসগোল্লা বলে ডাকতো। অনেকদিন পর ডাকটা আবার শুনে ভাল লাগলো তিতিরের। হেসে বলল,
-“আই লাভ ইউ টু।”
মুগ্ধ বাসায় ফিরতেই দেখলো পিউরা মাত্রই এসেছে, যাক বেশি দেরী হয়নি তাহলে। সবার সাথে গল্পগুজব, হইচই, খাওয়াদাওয়ার পর রাত ১২ টার দিকে পিউরা চলে গেল। মুগ্ধ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে কেবল। এমনসময় মা এসে দরজায় নক করলো,
-“ঘুমিয়ে পড়েছিস বাবা?”
-“না, মা.. খুলছি দাঁড়াও।”
দরজা খুলতেই মা বলল,
-“ঢুকবো না, একটা কথা বলতে এসেছি। ভুলে গিয়েছিলাম।”
-“হ্যা বলো।”
-“মুগ্ধ, তোর একটা পার্সেল এসেছে।”
-“কোত্থেকে এসেছে? কে পাঠইয়েছে?”
-“মতিঝিল থেকে পাঠিয়েছে কিন্তু কে পাঠিয়েছে তা তো লেখা নেই। হয়তো তোর বার্থডের জন্য কেউ গিফট পাঠিয়েছে।”
-“কে আবার গিফট পাঠাবে! যাই হোক, কোথায় সেটা?”
-“তোর আলমারিতে ডান পাশের লকারে রেখেছি।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
মা চলে যেতেই আলমারি খুলে জিনিসটা বের করলো মুগ্ধ।
বেশ বড় একটা বক্স র্যাপিং করা। কে পাঠালো! তিতিরের অফিস মতিঝিলে কিন্তু তিতিরের সাথে তো দেখাই হলো! ও দিলে তো হাতে হাতেই দিতে পারতো। তমালের বাসা মতিঝিল, মানে আরামবাগ আর কি! ও কি পাঠালো? যাই হোক খুললেই বোঝা যাবে। র্যাপিং খুলতেই একটা বড় কাগজের বক্স দেখতে পেল মুগ্ধ। বক্সটা খুলতেই দেখলো একটা হালকা আকাশী রঙের ফরমাল শার্ট, একটা নেভি ব্লু টাই, মুগ্ধর প্রিয় ব্র্যান্ডের একটা পারফিউম, একটা সানগ্লাস আর একটা কালো ডায়েরি। এ কাজ তিতির ছাড়া আর কারো নয়। সবার আগে ডায়েরিটা হাতে নিল। ডায়েরি হাতে নিতেই একটা চারভাজ করা কাগজ পড়লো নিচে। কাগজের উপরে লেখা “Open me first” তিতিরের হাতের লেখা। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওর। ডায়েরিটা রেখে কাগজটা খুলল। ইয়া বড় একটা কাগজে মাত্র দু’লাইন লেখা,
“পন্ডিতি করে আবার ডায়েরির শেষের পাতাগুলো আগে পড়োনা প্লিজ। প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করো, সিরিয়ালি পড়বে।”
মুগ্ধ গিফটগুলোকে বিছানার একপাশে রেখে ডায়েরিটা নিয়ে শুয়ে পড়লো। আরাম করে পড়বে। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় দেখলো একদম পুরোনো দিনের মত স্টাইল করে লেখা চিঠি। পড়তে শুরু করলো মুগ্ধ,
এই,
তোমাকে কোনদিনও নাম ধরে ডাকিনি। কখনো তোমাকে নাম ধরে ডাকার ইচ্ছেও করেনি, চেষ্টাও করিনি। তাই চিঠিতেও নাম সম্বোধন করলাম না।
এটা পেয়ে কি ভাবছো রঙঢঙ করে চিঠি লিখছি কেন? কেন জানি ইচ্ছে হলো লিখতে।
তুমি এমন একটা সময়ে আমার জীবনে এসেছিলে যখন আমি প্রেম বুঝতাম কিন্তু জানতাম না ভালবাসা কি? তুমি এসে ভালবাসার সাথে পরিচয় করালে। এমনভাবে, বোঝালে দেখালে ভাল কত রকম ভাবে বাসা যায়। আমি নিজের অবচেতন মনেই সবকিছু তোমার মত করে ভাবতে শুরু করি। তোমার আইডিওলজি গুলো ফলো করতে শুরু করি। আমার মনে হয় তুমি যেটা করো সেটাই ঠিক, মনে হয় একটা আদর্শ পুরুষ হতে হলে তোমার মত হতে হবে। সুহাস খুব ভাল ছেলে কিন্তু তোমার মত নয়। ও খুব ভদ্র, কখনো দুষ্ট কথা বলে না। কিন্তু আমার মনে হয় পুরুষ মানুষদের দুষ্টুই হওয়া উচিৎ।
ও আমার সাথে লাঞ্চ করতে আসে প্রায়ই, বলে আসেনা সারপ্রাইজ দিতে চায়। কিন্তু যদি আমি অলরেডি লাঞ্চ করে ফেলি ও মন খারাপ করে আর খায়না। তুমি হলে বলতে,”খেয়েছো ভাল করেছো। এখন আমার সাথে আবার খাবে।” পুরুষ মানুষদের তো এমনই হওয়া উচিৎ তাইনা বলো?
সুহাস ঠিক তোমার মত করেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। সেটা বুঝতে পেরে যদি আমি ওর দিকে তাকাই ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তুমি তো তাকিয়ে থাকতে, তোমার ওই দৃষ্টি দিয়ে মেরে ফেলতে আমাকে। আর কেউ পারবে না আমাকে তোমার মত করে মারতে। এ মরণ সুখের মরণ। আমি আর কোনদিনও এভাবে মরতে পারবো না। তবু আমি সুহাসকেই বিয়ে করতে চলেছি। আমি জানি আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কতটা কষ্ট হয়। কত স্বপ্ন দেখেছিলে তুমি আমাকে নিয়ে। আর আমি? তোমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে চলে আসি। আমার আর কোন উপায় নেই। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অসহায় লাগে। জানো, বাবা সারাদিন বাসায় থাকে। সামনের মসজিদে নামাজ পড়তে যায় শুধু। নামাজ পড়ে এসেই হাপাতে থাকে। তিনবেলা মুঠো ভরতি করে ওষুধ খায়। আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। আমার বাবা আর কোনদিনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না এটা আমি মানতেই পারিনা। আবার তোমাকে ছাড়া সারাটা জীবন অন্য একজনের সাথে সংসার করতে হবে এটাও ভাবতে পারি না। যাই হোক, পারলে আমাকে ক্ষমা করো, তোমার ভালবাসার মান রাখতে পারিনি আমি। অথচ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সব মুহূর্তগুলো তোমার দেয়া। কি জানো? নীলগিরিতে পাহাড় দেখানো, পথে ডাকাতদের হাত থেকে বুকে আগলে আমাকে বাঁচানো, থানচিতে আমার কানে কাজলের কালি লাগিয়ে দেয়া, কথায় কথায় আমাকে গান শোনানো, রেমাক্রি ফলসে আমার পাগলামিগুলো হাসিমুখে সহ্য করা, রেমাক্রিতে আমাকে মেঘ ছোঁয়ানো, নফাখুমের পথে হুট করে সবার মধ্যে থেকে আমাকে কোলে তুলে নেয়া, নাফাখুম জলপ্রপাতের পানিতে আমাকে নিয়ে ভাসা, তোমার সাথে চিটাগাং যাওয়া, বান্দরবানের সেই রাত! তোমার আমার প্রথম চুমু, একসাথে মহুয়া খাওয়া, টিওবির প্রত্যেকটা ট্যুরে দুজনের একসাথে যাওয়া পাগলামি করা, আমার প্রত্যেকটা জন্মদিনকে স্পেশাল করা, বিছনাকান্দির পানিতে তোমার বুকের উপর আমার ভেসে বেড়ানো! এই সবকিছু! স্পেশালি সিলেটের সেই রাত। আমার সারাটা শরীর মন সেদিন চাইছিল তোমাকে, আমি লজ্জায় বলতে পারিনি। যতটুকু পেয়েছি তাও অবশ্য কম না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে আদর করো। আরো কতরকম পাগলামি ভরা আদর তুমি করতে পারো জানার ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যে হলো না। এসব নিয়ে সরাসরি কখনো আলোচনা করোনা প্লিজ, খুব লজ্জা পাব।
ভাল থেকো।
-তোমার রসগোল্লা তিতিরপাখি।
চিঠি শেষ। পৃষ্ঠা ওলটালো মুগ্ধ। ওদের বান্দরবান যাওয়ার টিকেট, সিলেট আর বান্দরবানের হোটেলের ভাউচার স্কচটেপ দিয়ে ডায়েরিতে আটকানো। এখন বুঝতে পারলো তিতির কেন ওগুলো নিয়ে যেত। আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা ওলটাতেই ডায়েরিতে একটা খাম আটকানো দেখলো। খামের উপর লেখা “Miss me? open it” খামটা খুলতেই টিস্যুতে পেঁচানো একটা শক্ত, মোটা কাগজ পেল। টিস্যু সরাতেই দেখলো কাগজে অসংখ্য ঠোঁটের ছাপ। এ ঠোঁট মুগ্ধর চিরচেনা। তিতির ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে কাগজে ছাপ দিয়েছে। মুগ্ধ ঠোঁটের ছাপগুলোর উপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর কাগজটাতে চুমু দিল। ওর চোখ ভরে উঠেছে জলে।
চার মাস পর বেলা ১১ টার দিকে মুগ্ধর ফোন এল তিতিরের কাছে। তিতির একটু অবাক হলো মুগ্ধ ফোন করলে রাতে করে, অফিসে থাকতে কখনোই ফোন করে না। কোন অঘটন কি ঘটলো? তিতিরের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। ফোন ধরে বলল,
-“হ্যালো..”
-“তিতির?”
-“হ্যা।”
-“কেমন আছো?”
মুগ্ধর কন্ঠটা একটু অন্যরকম লাগলো। কি হয়েছে কে জানে! বলল,
-“ভাল, তুমি কেমন আছো?”
-“অনেক ভাল, আরো ভাল থাকার ব্যবস্থা করছি।”
-“কি?”
-“আমি বিয়ে করছি, ইকরাকে।”
তিতিরের মনে হলো ওর বুকের মধ্যে কেউ ১০০ ছুরির কোপ বসিয়েছে। মুগ্ধ ইকরাকে বিয়ে করছে কেন? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব? স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-“ও, কংগ্রাচুলেশনস! কবে বিয়ে?”
-“এই শুক্রবার।”
-“তাহলে তো আর ৪ দিন পরই।”
-“হ্যা।”
-“এত তাড়াতাড়ি সব এরেঞ্জমেন্ট কি করে করবে?”
-“কোন এরেঞ্জমেন্ট নেই। আমরা ইকরাদের বাসায় যাব, কাজী আসবে বিয়ে পড়াবে শেষ। ইকরাকে নিয়ে চলে আসব। কোন অনুষ্ঠান হবে না, কেউ ইনভাইটেড থাকবে না, শুধু ফুপীরা আর আমরা।”
-“ওহ, এটাও ভাল।”
-“ঠিকাছে তিতির রাখছি, আমি অফিসে তো।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ ফোনটা রেখে দিল। তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল, কি এমন হয়েছে যে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হচ্ছে মুগ্ধর? আর যে ইকরাকে ও সহ্যই করতে পারেনা সেই ইকরাকেই বিয়ে করছে! ভাবতে থাকলো তিতির, কিন্তু কোন কূলকিনারা পেল না।
ফোনটা এল দুপুরবেলা। মুগ্ধর মায়ের নাম্বার দেখে তিতিরের বুক কেঁপে উঠলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল,
-“হ্যালো তিতির?”
-“জ্বী আন্টি। আসসালামু ওয়ালাইকুম।”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা?”
-“ভাল, আন্টি আপনি ভাল আছেন?”
-“আছি বাবা, ভালই আছি। তোমার সাথে একটু কথা ছিল।”
-“হ্যা আন্টি বলুন।”
-“মুগ্ধ তোমাকে আজ ফোন করেছিল?”
-“হ্যা করেছিল।”
-“তাহলে তো জানোই বোধহয় বিয়ের ব্যাপারটা।”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তিতির বলল,
-“ও বলেছে আমাকে।”
-“এই শুক্রবারই ওদের বিয়েটা ঠিক করেছি। মাগো তোমার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট.. যেহেতু তুমি মুগ্ধকে বিয়ে করতে পারবে না, তুমি ওর জীবন থেকে পার্মানেন্টলি সরে যাও।”
-“আন্টি ওর সাথে এখন আর আমার সম্পর্ক নেই।”
-“জানি মা, কিন্তু এর মধ্যে ও হয়তো তোমার সাথে দেখা করতে চাইতে পারে। তুমি দেখা করোনা মা। অনেক কষ্টে, অনেক কিছুর পর আমি ওকে এই বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছি। প্লিজ এখন তুমি এমন কিছু করোনা বা এমন কিছু বলোনা যাতে আবার মুগ্ধ ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলে। এভাবে তো চলতে পারেনা, তাইনা? আমি আজ আছি কাল নেই। আমি মরার পর কে দেখবে ওকে? এভাবে একা একা সারাজীবন কাটাবে এটা আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি বলো? ইকরা ওকে পাগলের মত ভালবাসে, সেই ছোটবেলা থেকে। তুমি মুগ্ধর সাথে থাকলে আমি যতটা নিশ্চিন্ত থাকতাম, ইকরা ওর সাথে থাকলেও আমি ঠিক ততটাই নিশ্চিন্ত থাকব।”
-“আমি ওদের বিয়েতে বাধা দেবনা আন্টি। আমিও চাই মুগ্ধর একাকিত্ব ঘুচুক।”
-“লক্ষী মা আমার। নিশ্চিন্ত করলে আমাকে। ঠিকাছে রাখছি।”
ফোন রেখে তিতির কান্নায় ভেঙে পড়লো।
মুগ্ধর মা ফোন রাখার কিছুক্ষণ পরই মুগ্ধ ফোন করলো।
-“তিতির, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। একটু সময় দিতে পারবে?”
কি করবে তিতির? মাত্রই ওর মা ফোন করে বলল যাতে দেখা না করে আর এক্ষুনি ও দেখা করতে চাইছে! আল্লাহ কেন এমন পরিস্থিতিতে ফেলে? তিতির বলল,
-“কবে?”
-“আজ। সন্ধ্যার পর।”
মনে মনে অনেক যুদ্ধ করেও তিতির না করতে পারলো না। বলল,
-“আচ্ছা, কোথায়?”
-“তোমাকে আসতে হবে না, আমি ধানমন্ডি আসবো কিন্তু অফিসের পর। পারবে তো?”
-“হ্যা পারবো।”
-“রওনা দিয়ে ফোন দিব, এখন রাখছি।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধর মাকে কথা দিয়েছে আবার মুগ্ধকেও না করতে পারলো না, কাজটা কি ঠিক হলো? ও তো আর বাধা দিচ্ছে না বিয়েতে তাহলে দেখা করতে দোষ কি! এই ভেবে নিজেকে শান্তনা দিল তিতির। ইকরাকে কেন মুগ্ধ বিয়ে করছে? আর এত তাড়াহুড়োই বা কিসের? তিতিরকে নিয়ে যাওয়ার আরেকটা ট্রিক কি এটা? ছিঃ ছিঃ তা কেন হবে? মুগ্ধর ব্যপারে অন্তত এসব চিন্তা করা যায়না। মনে মনে এরকম অজস্র চিন্তা করতে করতে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির।
রেস্টুরেন্টে দুজন দুজনার মুখোমুখি বসে কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। মুগ্ধর মুখটা অনেক শুকনো লাগছে। তিতির কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলে যদি মুগ্ধ এমন কিছু বলে যা ও মানতে পারবে না! ওয়েটার এল অর্ডার নিতে। মুগ্ধ অর্ডার দিয়েও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অবশেষে মুগ্ধই প্রথম কথা বলল,
-“তিতির, তোমার কিছু বলার নেই?”
-“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মুগ্ধ ম্লান হেসে বলল,
-“এটা বলার ছিল তোমার?
তিতির এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু কি হয়েছে?”
-“কিছু বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?”
-“না মানে, এরকম হুট করে তুমি বিয়ে করছো, তাও আবার ইকরাকে। তাই ভাবছি কোন অঘটন কি ঘটলো নাকি!”
-“নাহ, কোন অঘটন ঘটেনি।”
-“ও।”
একটু অভিমান হলো তিতিরের। কিছু তো নিশ্চই ঘটেছে যা মুগ্ধ বলতে চাচ্ছে না। আজ তিতির এতই দূরের হয়ে গেল যে সবটা খুলে বলাও যায়না। ঠিকই আছে, তিতিরের তো এটাই প্রাপ্য ছিল। কি করতে পেরেছে ও মুগ্ধর জন্য? কিছুই না। আর কিছুই বলল না। চুপ করেই রইলো। মুগ্ধও চুপ। এই প্রথম বোধহয় ঘন্টার পর ঘন্টা দুজন একসাথে বসে আছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। খাবার এল। মুগ্ধ বলল,
-“খাও।”
তিতির না বলল না, আবার খেতেও পারলো না। ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। মুগ্ধ খেয়াল করলো ব্যাপারটা কিন্তু কিছু বলল না। মুগ্ধ খেতে শুরু করলো। তিতিরও খেয়াল করলো যে মুগ্ধ অস্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে, রাগ দেখাচ্ছে? কার উপর? মুগ্ধ আসলে কি চাইছে? এই প্রথম তিতির মুগ্ধকে বুঝতে পারলো না। দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হলো না সেদিন, মুগ্ধ একবার তিতিরের হাতটাও ধরলো না। তারপর আরেকবার ফোনও দিল না।
ইকরা সত্যিই মুগ্ধকে ভালবাসতো তাই ও মুগ্ধকে পেতে চলেছে তাহলে কি তিতিরের ভালবাসায় কোন খাদ ছিল? নাকি তিতিরের ভালবাসার চেয়ে ইকরার ভালবাসার জোড় বেশি? এটা হতেই পারে, ইকরা তো কখনোই মুগ্ধর চেয়ে নিজের ফ্যামিলিকে বেশি ইম্পরট্যান্স দেয়নি। কি কি না করেছে মুগ্ধকে পাওয়ার জন্য, ফ্যামিলি বা নিজের মান সম্মানের কথাটাও তো একবার ভাবেনি মেয়েটা। অন্ধের মত পাগলামি করেছে মুগ্ধকে পাওয়ার জন্য। আর তিতির? ও তো নিজের ফ্যামিলিকেই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্স দিয়েছে। নিজের ফ্যামিলির জন্য মুগ্ধকে কত কষ্ট দিয়েছে! ঠিকই আছে আল্লাহ ন্যায় বিচারক। কিন্তু ফ্যামিলিকে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্স দেয়াটা কি ভুল? এই বাবা-মায়ের জন্যই তো ও আজ পৃথিবীতে এসেছে, এতবড় হয়েছে। সব তো এই বাবা-মায়ের জন্যই। মুগ্ধকে কষ্ট দিয়ে তিতিরও তো কম কষ্ট পায়নি। এসব এলোমেলো চিন্তা মাথায় নিয়েই রোজ অফিসে যেতে হচ্ছে তিতিরের। অফিসে কাজের এত চাপ, ছুটি চেয়েও পেলনা। আবার কাজ করতেও পারছিল না ঠিকভাবে, কিন্তু করতে হচ্ছিল। খুব প্রেশার ফিল করলো তিতির।
এভাবেই দেখতে দেখতে চলে গেল ৪ দিন। মুগ্ধ এ কদিনে একবারও ফোন করেনি। তিতির আর থাকতে না পেরে বৃহস্পতিবারের বিকালে ফোন করলো মুগ্ধকে। মুগ্ধ ফোন ধরলো না। খুব কষ্ট পেল তিতির, মুগ্ধ ফোনটা ধরলোই না! অবশ্য বিয়ের আগের দিন ব্যস্ত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাত ৮ টার দিকে কলব্যাক করলো মুগ্ধ।
-“তিতির, ফোন দিয়েছিলে? সরি আমি অফিসে ব্যাস্ত ছিলাম। আর ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিল। মাত্রই দেখলাম। তুমি আমার অফিসের নাম্বারে ফোন দিতে।”
-“না না প্রব্লেম নেই, আমি এমনিই কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম।”
-“ওহ! বলো।”
-“কাল তোমার বিয়ে আর আজও তুমি অফিস করছো?”
-“হ্যা, তো? বিয়ে দেখে কি হাত পা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকবো নাকি? কাজ না করলে খাব কি?”
-“ও, তাহলে কি বিয়ের পরদিনও অফিস করবে নাকি?”
-“নাহ, বিয়ের পরদিন তো শনিবার। সেদিন আমার এমনি অফ ডে। রবিবার থেকে অফিসে যাব।”
-“ওহ, হানিমুনে কবে যাবে? আর কাশ্মীরই কি যাবে?”
-“কিসের হানিমুন? ইকরাকে যে বিয়ে করছি এটা ওর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য আবার হানিমুন!”
-“এভাবে বলছো কেন? তুমি তো বলেছিলে আজও কাশ্মীর যাওনি, হানিমুনেই প্রথমবার যাবে বলে।”
-“গাধার হাড্ডি।”
-“কে?”
-“তুমি।”
-“কেন?”
-“আমি বলতে বাধ্য নই, এই গালিটাই দিতে মন চাইলো তাই দিলাম। তুমিও পাল্টা গালি দিতে পারো কিন্তু কেন তোমাকে গালিটা দিলাম সেটা জিজ্ঞেস করতে পারো না।”
-“আচ্ছা বেশ কিন্তু হানিমুনে কেন যাবে না?”
-“টাকা কি মাগনা আসে?”
-“কিপটামি করছো কেন? কাশ্মীর যেতে কয় টাকাই লাগবে?”
-“তুমি আমাকে কিপটা বলতে পারলে? জীবনেও তোমার সাথে কিপটামি করেছি আমি?”
-“না তা করোনি।”
-“হ্যা, যে যেরকম তার সাথে সেরকম করতে হয়। ইকরা তো গলায় পারা দিয়ে বলবে টাকাপয়সা দিবি কিনা বল! ও তো এই টাইপ মেয়েই। বিউটি পার্লার আর শপিং ছাড়া কিছু বুঝে? বিয়ের পর থেকে ওর বেহিসাবি খরচগুলো তো আমার টাকাতেই করবে তাই ওকে নিয়ে হানিমুনে গিয়ে আমি টাকা নষ্ট করবো না।”
-“নষ্ট কেন হবে? ঘোরাই তো হবে।”
মুগ্ধ হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল,
-“এই তুমি ফোন রাখো তো, অসহ্য।”
তিতির কিছু বলল না, ফোনও রাখলো না। চোখ বেয়ে গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা জল পড়লো বুকের উপর। মুগ্ধ কান্নাটা টের পেল না। আবার ঝারি দিয়ে বলল,
-“আজব তো, কি বললাম কানে যায়নি? ফোন রাখো না কেন? ফোন রাখোহ।”
তিতির চুপচাপ ফোনটা নামিয়ে লাইনটা কেটে দিল।
তারপর ৯ টা বাজলো, ১০ টা বাজলো, ১১ টা বাজলো। তারপর একসময় ১২ টাও বেজে গেল.. একটা মেসেজ এল মুগ্ধর। লিখেছে, “Sorry.. ajke shondhar rough behave er jonno.” তিতির রিপ্লাই দিল না। রিপ্লাই দিয়ে কিইবা হবে! ঘড়ির কাটায় আজ শুক্রবার। আজ ইকরা-মুগ্ধর বিয়ে। আজ থেকে ইকরা মুগ্ধর বউ! আজ থেকে ওরা এক ঘরে থাকবে, এক বিছানায় শোবে। আজ থেকে ইকরার শরীরেও ঘুরে বেড়াবে মুগ্ধর দুষ্টু হাত। আজ থেকে মুগ্ধর ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে ইকরাও শিহরিত হবে। আজ থেকে ইকরাও জানবে কখন মুগ্ধর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যায়, কখন বেড়ে যায় ওর নিঃশ্বাসের ওঠানামা। আজ থেকে ইকরাও জানবে মুগ্ধর বুকের ধুকধুকানির শব্দ কেমন হয়! আজকের পর এরকম আরো অনেক কিছুই ইকরা জানবে যা একমাত্র তিতির জানতো। এসব ভাবতে ভাবতে তিতির কাঁদছিল। কষ্টে বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছিল না ওর। বিছানার উপর হাটু ভাজ করে বসে কাঁদছিল, ঘরের মধ্যে হেটে হেটেও কাঁদছিল, ফ্লোরে বসেও কাঁদছিল। কাঁদতে কাঁদতে নিজের গায়ে নিজেই নখ বসিয়ে টেনে টেনে খামচি দিচ্ছিল, হাত কামড়াচ্ছিল, চুল ছিঁড়ছিল। গায়ের ওড়না দাত দিয়ে ছিঁড়ে কুচিকুচি করছিল। কোনভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না তিতির। সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে? কিচ্ছু করতে পারবে না ও? যাদের ভালবাসার মানুষের বিয়ে হয়ে যায় তাদের প্রেমটা বুঝি এভাবেই শেষ হয়ে যায়। মানুষের মুখ থেকে শোনা, দেখা ফিল করা আর নিজের জীবনে ফেস করার মাধ্যে এতটাই ফারাক আগে জানতো না তিতির।
সারারাত এভাবে পাগলের মত কান্নাকাটি করলো তিতির। এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকালে নাস্তা খেতে যায়নি দেখে মা এল ডাকতে। দরজার বাইরে থেকেই ডাকলো,
-“তিতির, এই তিতির.. আর কতক্ষণ ঘুমাবি? এবার উঠে খেয়ে নে মা। খেয়ে নাহয় আবার ঘুমাস।”
তিতির উত্তর দিল না। মা গিয়ে চাবি নিয়ে এল, চাবি দিয়ে লক খুলে ঘরে ঢুকতেই মা দেখলো তিতির ফ্লোরে কাত হয়ে শুয়ে কাঁদছে। চুলগুলো এলোমেলো, বিদ্ধস্ত চেহারা। ওড়নাটা কুটিকুটি করে ছেঁড়া। মা ওর পাশে বসে বলল,
-“কি রে কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? হায়হায় চোখ দুটো একদম ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। হাতে কিসের আঁচর লেগেছে? কি হয়েছে মা?”
তিতির মায়ের হাত ধরে বলল,
-“মা, আজকে মুগ্ধর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মা। মিথ্যে ইগো, রাগ পুষে রেখে আমার জীবনটা নষ্ট করো না মা। ও ছাড়া আমি সুখী হবো না। কিছু একটা করো মা। এখনো তোমরা মেনে নিলে ও বিয়েটা করবে না।”
মা তিতিরের গালে একটা চড় বসালো। বলল,
-“তুই এত নির্লজ্জ কেন? তোকে আমি জন্ম দিয়েছি ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছে। মুগ্ধ যদি তোকে এতই ভালবাসতো তাহলে বিয়ে করছে কেন? আর যেখানে ও বিয়ে কিরছে সেখানে তুই এখনো ওর কথা বলিস কোন মুখে? সুহাসের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে, কদিন পর বিয়ে আর তুই এখনো ওই ছেলের কথা বলছিস? এমন মেয়ে কেন জন্ম দিলাম? পাপ তো আমার। রাস্তার গুন্ডাদের মত তোর ভাইকে রাস্তায় ফেলে মেরেছিল সব ভুলে গেলি? কেমন বোন তুই? বাপটারে তো মারতে গেছিলি! কোনমতে বেচে ফিরেছে। আবার সেই ছেলের কথা? কেমন মেয়ে তুই? এত মানুষ দুনিয়াতে মরে তুই মরতে পারিস না? আল্লাহর ওয়াস্তে মর এবার। আমার একটু হাড় জুড়াক, আর পারছিনা।”
মা ঘর থেকে চলে গেল। তিতির একইভাবে পড়ে রইলো ফ্লোরে। সারাদিন কাঁদলো। কাল রাত থেকে কিচ্ছু খায়নি তিতির। সারাদিনেও কিছু খেল না। সন্ধ্যা নাগাদ ফোন এল মুগ্ধর। মুগ্ধর নাম্বারটা স্ক্রিনে দেখেই তিতিরের বুক কেপে উঠলো। হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিছু কি মিরাকল ঘটবে? মুগ্ধর বিয়েটা কি হবে না? এটা জানানোর জন্যই কি মুগ্ধ ফোন করেছে? চোখ মুছে ফোন ধরে তিতির বলল,
-“হ্যালো।”
মুগ্ধ তিতিরের গলা শুনেই বুঝতে পারলো যে, তিতির কাঁদছিল। এখন আর শান্তনা দিয়ে কি হবে? তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি বলল,
-“তিতির, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
তিতির হাসার চেষ্টা করে বলল,
-“ওয়াও কংগ্রাচুলেশনস!”
-“হুম.. মা, স্নিগ্ধ রেডি হয়ে অপেক্ষা করছে। পিউয়ের তো এই বিয়েতে মত নেই তাই ও আসবে না। আমি রুম থেকে বের হলেই আমরা ইকরাদের বাসায় যাব।”
-“ও। গাড়ি সাজিয়েছো?”
-“নাহ, ধুর।”
-“মা কি বাসর ঘর সাজিয়েছে?”
-“নাহ।”
-“প্রথমে নিশ্চই মা বলেছিল তারপর তুমি ঝাড়ি দিয়ে থামিয়েছো?”
-“হ্যা।”
-“হুম, জানতাম।”
-“মায়ের বিয়ের বেনারসিটা ইকরা চেয়েছিল। মাও দিয়ে দিচ্ছিল। আমি দিতে দিইনি। আমার কাছে রেখে দিয়েছি, ওটা তোমার বিয়েতে গিফট করবো। ওটার ওপর শুধু তোমারই হক আছে। পড়বে তো?”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা, অবশ্যই পড়বো।”
একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তিতিরের গাল বেয়ে। মুগ্ধ বলল,
-“এই জানো আমি আজকে সাদা পাঞ্জাবি পড়েছি। মা গতকাল কিনে এনেছে। আমাকে তো পুরা হিরো হিরো লাগছে।”
কথা শেষ করেই মুগ্ধ হাসলো। তিতিরও হেসে বলল,
-“ওয়াও। ছবি তুলে রেখো। পরে ফেসবুকে ইনবক্স করে দিও, দেখবো।”
-“ফেসবুক যে ইউজ করিনা তাতো জানোই, আইডি ডিএক্টিভ।”
-“আইডি তো আছে, এক্টিভ করে ছবি পাঠিয়ে আবার ডিএক্টিভ করে দিও, অথবা হোয়াটস এ্যাপে।”
-“এখন আর এসব কিছুই ইউজ করিনা। ভাল লাগেনা। আমার ছবি তুলতেও ভাল লাগেনা জানোইতো। স্নিগ্ধ যদি তোলে তো ওকে বলবোনে তোমাকে পাঠাতে।”
-“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলো। তারপর হঠাৎ মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, যেদিন আমার বিয়ে ফিক্সড হয়েছে সেদিনই আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম। ৪ দিন সময় হাতে ছিল।”
এটুকু বলার পর হঠৎ করেই মুগ্ধ কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“আমার মনের কোথাও একটা ছোট্ট আশা ছিল যে তুমি এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘ফ্যামিলি, সোসাইটি, দুনিয়া ভেসে যাক, তুমি ইকরাকে বিয়ে করোনা। আজ, এক্ষুনি আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”
মুগ্ধ চিৎকার করে কাঁদছিল। তিতির সহ্য করতে পারছিল না। মুগ্ধ কখনো এভাবে কাঁদেনি, কক্ষোনো না। যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে স্ট্রং থাকাটা মুগ্ধর সবচেয়ে বড় গুন। কখনো কিছুতে ভেঙে পড়েনি। সবকিছু হাসিমুখে সামলেছে। আর আজ ও নিজেই কিনা ওকে কাঁদালো। তিতিরও এতক্ষণের লুকিয়ে রাখা কান্নাটা আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। দুজনেই একসাথে কাঁদতে লাগলো। তিতির ফোনের ভেতর দিয়েই শুনতে পেল মা মুগ্ধর দরজায় নক করে ডাকছে ওকে। মুগ্ধ সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না। কাঁদতে কাঁদতেই আবার বলল,
-“আমি জানি তিতির, তোমার ফ্যামিলি তোমার কাছে অনেক ইম্পরট্যান্ট। ছোটবেলা থেকেই তারা তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার ব্যাপারটা বাদ দিলে তোমার ফ্যামিলির মত ফ্যামিলি খুব কম মেয়েরই আছে। কিন্তু তিতির আমি যদি সুযোগ পেতাম আমিও তোমাকে তাদের চেয়ে কম যত্নে রাখতাম না। তারা তোমাকে দুনিয়াতে নিয়ে এসেছে তাই আমি তোমাকে পেয়েছি, এজন্য আমি তাদের প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। হ্যা আমি পেয়েছি তোমাকে। বিয়ে করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তোমাকে আমি এতটাই পেয়েছি যতটা অনেকেই বিয়ে করেও পায়না। কিন্তু তোমার ফ্যামিলি তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছে তিতির। যদি তারা তা না করে আমার হাতে তুলে দিত আমি তোমার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল মাটিতে পড়তে দিতাম না। সারাজীবনে একটা সেকেন্ডের জন্যও না।”
তিতির কোন উত্তর দিতে পারলো না। মুগ্ধ উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলো ন। আবার বলতে শুরু করলো,
-“অনেক অনেক বছর আগে তুমি যখন আমার জীবনে এসেছিলে তখন যে আমি কি পেয়েছিলাম তিতির আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তুমি একটা ছেলে হলে বুঝতে পারতে একটা অবুঝ বাচ্চা মেয়েকে ভালবাসা, জীবন, প্রব্লেম, সেক্স সব কিছু বোঝানোর ফিলিংস কেমন হয়। তুমি এমন একটা মেয়ে ছিলে যাকে যেমন ইচ্ছা তেমন করে গড়ে নেয়া যায়। আর আমার উপর অন্ধ বিশ্বাস দেখে তো আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। কিভাবে সম্ভব আজকের যুগে একটা ছেলেকে এতটা বিশ্বাস করা?”
তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“প্লিজ তুমি কেঁদোনা, তোমার কান্নাটা আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমি অভ্যস্ত নই।”
মুগ্ধ সেকথার কোন জবাব না দিয়ে নিজের মত করেই বলতে লাগলো,
-“তোমার হাসি, তোমার তাকানো, তোমার স্পর্শ, তোমার লজ্জা পাওয়া সব কিছুতে আমার নেশা হয়ে গেল। তোমার মতই আমার জীবনের সব শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোও তোমার দান। তোমার জ্বরের ঘোরের সেই পাগলামি আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না, সেদিন তুমি যে কি বলেছিলে আর কি করেছিলে তিতির আজও সব আমার চোখের সামনে ভাসছে। তুমি যে কি পাগলী একটা তা সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। আজও তোমার সেই রেকর্ডিং টা আমি শুনি। ভবিষ্যতেও শুনবো, যতদিন বেঁচে থাকবো শুনবো। তুমি যদি ওটা ডিলিট করে দিতে বলো তবুও আমি ডিলিট করবো না। আমি তো কখনোই ছবি তুলিনা, ছবি তোলার কথা মনেও থাকে না কিন্তু তোমার আমার যে দুএকটা আনসেন্সরড ছবি তুমি জোর করে তুলেছিলে তা আমি যত্ন করে রেখেছিলাম। দেখতে ভাল লাগতো। আজীবন দেখবো ওগুলো। তুমি বললেও ডিলিট করবো না।”
বাচ্চাদের মত করে কাঁদছিল মুগ্ধ। তিতির বার বার বারণ করছিল। কিন্তু আজ মুগ্ধ কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিল না। তিতিরেও কান্না থামছিলই না। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“সব তো শেষই হয়ে যাচ্ছে আজ একটা সত্যি কথা বলবে আমাকে?”
মুগ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“না পারবো না।”
-“প্লিজ।”
-“কি কথা?”
-“তুমি ইকরাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করছো না?”
-“বাধ্য যদি নাই হতাম তাহলে কি ইকরাকে বিয়ে করতাম? মেয়ের কি অভাব নাকি?”
-“কে বাধ্য করেছে? কি হয়েছে?”
-“বাদ দাও, এসব বলে লাভ নেই আর। তাছাড়া মানুষ চাইলেই সব কথা সবাইকে বলতে পারেনা, বাধা থাকে অনেক।”
তিতির আর কিছু বলল না। মুগ্ধ তখনো কাঁদছিল। আবার বলল,
-“জানো আজ বাবাকে খুব মিস করছি। মা কিছু হলেই বলে তোর বাবা বেঁচে থাকলে এরকম হতো না, ওরকম হতো না। তোর বাবা বেঁচে থাকলে আজ আমাকে বুঝতো। তখন আমারও বলতে ইচ্ছে করে, ইয়েস বাবা থাকলে আমাকেও বুঝতো। আমার জীবনের সব প্রব্লেম বাবা ম্যাজিকের মত সলভ করে দিত। কিন্তু বলতে পারিনা। মা যে কষ্ট পাবে।”
-“আমাদের কপালটাই বোধহয় এমন। বাবা মাকে কষ্ট দেবনা বলেই কত ত্যাগ করলাম তবু তারা কষ্টই পেল।”
-“কপালের কথা আর বলোনা। শালার আমার কপালের মত খারাপ কপাল দুনিয়ার আরো কারোর নেই। পৃথিবীতে শুধু একটা মেয়েকেই আমি স্ল্যাং ওয়ার্ডে গালি দিয়েছি, সে ইকরা। যে মেয়েকে সারাজীবন আমি কথায় কথায় ইনসাল্ট করেছি, প্রস্টিটিউটের সাথে যার তুলনা করেছি সবসময়, কপালের ফেরে তাকেই বিয়ে করতে হচ্ছে আজ। সেই হবে আমার ঘরের বউ, তাকে নিয়েই সংসার করতে হবে বাকী জীবন। এর চেয়ে মৃত্যু বেশি সম্মানের।”
-“ইকরার উপর তোমার অনেক রাগ তাই এসব বলছো। রাগ একদিন শেষ হবে, আমরা যাই বলিনা কেন ইকরা মেয়ে হিসেবে তো ভালই, তোমার সাথে যা করেছে তা তো তোমাকে পাওয়ার জন্যই করেছে। আর ইকরা দেখতেও অনেক সুন্দর।”
মুগ্ধ অট্টহাসি দিয়ে বলল,
-“সুন্দর তো সানি লিওনও।”
তিতির কি বলবে! কান্নাটাও থামাতে পারছে না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
-“সরি, আমার কাছ থেকে তুমি কষ্ট ছাড়া আর কিছু পেলে না। আমি আসলে তোমার জীবনে একটা বড় অভিশাপ হয়ে এসেছিলাম।”
মুগ্ধ চোখ মুছে নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করলো। তারপর বলল,
-“না তিতির, তুমি আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলে। আমার জীবনে ভাল যা কিছু হয়েছে তা তুমি আসার পরই হয়েছে। তুমি যত ভালবাসা আর মধুর স্মৃতি আমাকে দিয়েছো তা দিয়ে অনায়াসে একটা জীবন পাড় করে দেয়া যায়। ডোন্ট ওরি আমি ভাল থাকবো, আই প্রমিস। আর তুমিও ভাল থেকো।”
-“হ্যা, আমি তো ভালই আছি।”
-“রাখছি তাহলে.. মা, অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।”
-“হুম, যাও। যেতে তো হবেই।”
-“এই শোনো..”
-“শুনছি বলো।”
-“আজ থেকে আমি একটা জিনিস খুব ইম্পরট্যান্টলি চাইবো আল্লাহর কাছে। তোমার ভাইয়ের মত ভাই তিনি যেন ঘরে ঘরে দেন। আর সেই ভাইদের বোনদের ভালবেসে দুনিয়ার সব প্রেমিকদের পরিণতি যেন আমার মতই হয়। আমি একা কেন কষ্টে থাকবো? দুনিয়ার সব শালা একই কষ্টে থাকুক। আর ওই নিষ্পাপ মেয়েগুলো তোমার মতই ধুকে ধুকে মরুক।”
কথাটা বলতে বলতে মুগ্ধ আবার কেঁদে ফেলল। তিতিরও কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করুক।”
-“আমীন।”
-“আমীন।”
ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তিতির দেখলো বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। তিতির বাবার সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসলো। বাবা কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
-“কিছু বলবি মা?”
তিতির কখনো এভাবে একা বাবার সামনে বসে সরাসরি মুগ্ধর ব্যাপারে কথা বলেনি। কিভাবে বলবে? লজ্জা লাগছে, আর ভয়ও করছে। ডাক্তার বলেছিল বাবাকে সাবধানে রাখতে হবে। ওনার হার্ট অনেক দূর্বল। ওর অনেক আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই বাবা ওর দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
তিতির অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে বলেই ফেলল,
-“বাবা, আজকে মুগ্ধর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।”
বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। বাবা কিছু বলার আগেই তিতির কেঁদে ফেলল। বলল,
-“বাবা, প্লিজ কিছু একটা করো। আজও তোমরা মেনে নিলে ও বিয়েটা করবে না। শুধু আমাকে পাবার মিথ্যে আশায় ও এতবছর অপেক্ষা করেছে। কিন্তু এখন ওর মায়ের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে রাজী হয়েছে। আমি ও ছাড়া আর কারো সাথে সুখী হবো না বাবা। ওর কিছু দিক হয়তো খারাপ কিন্তু অনেক দিক দিয়েই আবার ভাল। সব মানুষ তো সব দিক দিয়ে ভাল হয়না বাবা। খারাপ-ভাল মিলিয়েই তো মানুষ। ও খারাপ হোক কি ভাল ও ম্যজিক জানে বাবা। যতদিন আমার ওর সাথে সম্পর্ক ছিল ও সেই ম্যাজিক দিয়েই আমাকে ভাল রেখেছে। আজ পর্যন্ত কোনদিন ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।”
বাবা চুপ। তিতির কাঁদতে কাঁদতেই আবার বলল,
-“ওর অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমি সহ্য করতে পারবো না বাবা। মাকে আমি সকালবেলাই বলেছিলাম। মা বুঝলোই না। তোমরা আমাকে বোঝ না কেন বাবা? আমার যে খুব কষ্ট হয় বাবা। ও ছাড়া আমার জীবনটা অন্ধকার। বাবা প্লিজ কিছু একটা করো। ছোটবেলা থেকে কোনদিন তোমার অবাধ্য হইনি বাবা, আজও পারবো না। তুমিই কিছু করো বাবা প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তুমি আমাকে পারমিশন দাও ওর কাছে যাওয়ার। দুনিয়ার আর কারোর পারমিশনের দরকার নেই আমার।”
তিতির বাবার পা জড়িয়ে ধরলো। বাবা তিয়িরকে উঠিয়ে পাশে বসিয়ে বলল,
-“দেখ মা, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু ব্যাপারটা এতই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে যে তোর সাথে মুগ্ধর সম্পর্কটা আর সম্ভবই না। তান্নার সাথে মুগ্ধর যেটা হয়েছে সে ইস্যুটা ছোট ছিল কিন্তু খুব খারাপ একটা ইন্সিডেন্ট ছিল। ওরা কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবে না। অনেকবার ভেবেছি তোর মুখ চেয়ে মেনে নেব কিন্তু তোর মা এবং আমিও মুগ্ধকে মন থেকে মানতে পারি না। বিয়ে তো শুধু দুটো মানুষের না। দুটো ফ্যামিলিরও। এই বিয়ে নামক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়েই দুটি অপরিচিত ফ্যামিলি ঘনিষ্ঠ হয়। মুগ্ধর সাথে বিয়ে হলে তোর সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে। কারন, আমাদের দুই ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠ হওয়াটা অসম্ভব। সুহাস অনেক ভাল ছেলে মা, আর তোকে খুব ভালওবাসে। তুই সুখী হবি দেখিস, ও তোকে এত সুখে রাখবে যে আজকের কথা ভেবে তুই তখন হাসবি আর ভাববি কত ছেলেমানুষিই না করেছি! সময় সব ঠিক করে দেয় মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতির শেষ আশাটাও ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকলো।
ভাবী ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-“বাবা আসব?”
-“আমরা একটু ইম্পরট্যান্ট কথা বলছি। তুমি পরে আসো মা।”
-“বাবা আমার মুগ্ধ ভাইয়া আর তিতিরের ব্যাপারেই কিছু বলার ছিল।”
বাবা, তিতির দুজনেই চমকে তাকালো। বাবা বলল,
-“এসো।”
ভাবী বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“বাবা এতদিন আমি ভয়ে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আজও যদি চুপ করে থাকি তাহলে তো আমি মানুষের কাতারেই পড়বো না।”
বাবা বলল,
-“কি বলতে চাচ্ছো বলো।”
-“বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আপনি, মা আর তিতির কখনো আমাকে বুঝতে দেননি আমি শ্বশুরবাড়িতে আছি। আপনাদের আদরে আদরে এতটা বছর কাটিয়েছি, যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাও করি আপনাদেরকে। সেই শ্রদ্ধা বজায় রেখেই কথাগুলো বলছি, বেয়াদবি হলে ক্ষমা করবেন।”
-“আহা বলবে তো কি কথা?”
-“তিতিরের যায়গায় যদি আমি থাকতাম তাহলে ফ্যামিলিকে রাজী করানোর জন্য আমি আরো অনেক আগেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতাম, সুইসাইড এটেম্পট নিতাম নাহলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। শুধু আমি না বাবা, আজকালকার যেকোন মেয়ে হলে এটাই করতো। কিন্তু বাবা তিতির এসব লেইম উপায় বেছে নেয়নি। কেন জানেন? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে আপনারা কষ্ট পেতেন। সুইসাইড এটেম্পট নিলে আরো বেশি কষ্ট পেতেন, সাথে মুগ্ধ ভাইয়াও কষ্ট পেত। তাই ও এসব না করে নিজে শত কষ্ট সহ্য করে ৩/৪ বছর ধরে শুধু আপনাদেরকে রাজী করানোর চেষ্টাই করছে। হ্যা, একবার চলে গিয়েছিল, অন্য কোন মেয়ে হলে আরো অনেক আগে যেত। তারপরও সেটা তো পালিয়ে যাওয়া না বাবা। ও বলেই গিয়েছে আর জ্বরের ঘোরে গিয়েছিল। সুস্থ্য থাকলে ও কখনোই যেত না। আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে তো ঠিকই সব ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাবা আপনারা কি একটা বারও গভীর রাতে তিতিরের ঘরে গিয়ে খোঁজ করেছেন মেয়েটা কি করছে? গত ৩/৪ বছর ধরে তো আমি ওকে একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমাতে দেখিনি। রাত ৪/৫ টায় ঘুমিয়েছে আবার ৯ টায় অফিসে গিয়েছে। এসব কিছুই কি এক্টাবারের জন্যও আপনাদের চোখে পড়েনি? জানি বাবা ওর সুখের জন্যই সব করছেন কিন্তু ও তো সুখে নেই বাবা। সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে সত্যি, কিন্তু যেটা আজই ঠিক করা যাবে সেটা কোন অজানা একদিনের জন্য কেন ফেলে রাখবেন? জানি তিতির আজও সব মেনে নেবে চুপচাপ। কিন্তু একবার ভাবুন তো বাবা সুহাস ভাইয়ের সাথে বিয়ের দিন যদি ও সুইসাইড করে? কি করবেন মেয়ের লাশটা নিয়ে?”
বাবা চিৎকার করে উঠলো,
-“থামো। আর বলোনা।”
তারপর তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমার মেয়ে এসব করবে না।”
তিতির কেঁদে চলেছে। ভাবী বলল,
-“হ্যা বাবা, ও এসব করবে না আপনি সেটা জানেন। কারন ও অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই আপনারা ওর ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিয়ে আপনাদের ইচ্ছেটাকে ওর উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। কেন বাবা? স্ট্রং মানুষদের কি কষ্ট হয়না? হয় বাবা হয়, দূর্বলদের যতটা কষ্ট হয় স্ট্রং মানুষদেরও ঠিক একই কষ্ট হয়। মানুষ বুঝতে পারে না কারন, দূর্বলরা কষ্টটা দেখাতে পারে.. স্ট্রং রা পারে না। একটু আগে ওর লাশের কথা শুনে আপনি আঁৎকে উঠলেন কিন্তু বাবা ও তো অলরেডি লাশ হয়েই আছে, জীবিত লাশ। সেটা কি আপনাদের চোখে পড়ছে না? আমি প্রথম থেকেই এসব দেখছি বাবা, কিন্তু আপনার ছেলের ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।”
-“তিতিরের কষ্টটা আমি বুঝতে পারি মা। ও মুগ্ধকে অন্ধভাবে ভালবাসে কিন্তু মুগ্ধর মধ্যে ভেজাল আছে। ওর এই কষ্ট আমি সহ্য করতেও পারবো কিন্তু সারাজীবনের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না। সারাজীবন আমি থাকবো না তাই ভাল একটা ছেলের সাথে ওর জীবনটা বেধে রেখে যেতে চাই। তাহলে নিশ্চিন্তে মরতে পারবো।”
ভাবী তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
-“বাবা, একটা কথা না বলেই আপনাকে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি বলতেই হচ্ছে। হয়তো আমার ঘর ভাঙবে। কি আছে কপালে কে জানে কিন্তু আজ আমি বলবো। আপনার সোনার টুকরো ছেলেকে আপনি যা দেখেন সে আদৌ তা না। তার অনেকগুলো রূপ আছে বাবা। ফ্রেন্ডদের সাথে তার এক রূপ, আপনাদের সামনে আরেকরূপ, আমার সাথে আবার আরেক রূপ। অনেকগুলো মুখোশ তার, যখন যেটা দরকার চুপটি করে পালটে নেয়। বোঝা যায়না কারন, সবগুলো মুখোশের তো একই চেহারা।”
বাবা গর্জে উঠলো,
-“বৌমা, কি বলছ তুমি এসব?”
-“আমি ঠিক বলছি বাবা। শুরু যখন করেছি সব বলব আজ। আপনার ছেলে যা বলল আপনি বিশ্বাস করে নিলেন। একবার নিজে মুগ্ধ ভাইয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে কি পারতেন না বাবা? নেননি কারন, আপনার ছেলের উপর আপনার অগাধ বিশ্বাস। আপনার ছেলে আপনার বিশ্বাসের মান রাখেনি। সে মুগ্ধ ভাইয়ার সম্পর্কে যত আজেবাজে কথা এসে বলেছে সব বিশ্বাস করেছেন, তিতিরের কাছেও জানতে চাননি। মুগ্ধ ভাইয়া আপনার ছেলেকে মেরেছে, গালি দিয়েছে.. কিন্তু বাবা আপনার ছেলেকে মুগ্ধ ভাইয়া কেন মারলো? আপনার ছেলে আপনাকে পুরো ঘটনাটা বলেছে নিজের আকামের অংশটা হাইড করে। শুধু শুধু কেউ কাউকে এতটা মারে না বাবা। আপনার ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা উচিৎ ছিল। আমি জানি আপনার ছেলে আপনাকে ভাইয়ার ব্যাপারে আরো অনেক কথাই বানিয়ে বলেছে। সেসব কথা তিতিরের সামনে আমি আর বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু আপনি তো জানেন বাবা, আপনি যা জানেন তার সব মিথ্যে। ভাবছেন এতকিছু আমি কিভাবে জানি? আপনার ছেলে নিজেই কলার ঝুলিয়ে আমাকে বলেছে, ‘দেখেছো বাবা মা আমকে কতটা বিশ্বাস করে? এবার দেখবো শালা মুগ্ধ কিভাবে জেতে।’ সে মুগ্ধ ভাইয়াকে নিজের শত্রু ভাবে। নিজের ইগো বাঁচাতে সে মুগ্ধ ভাইয়াকে আপনার কাছে খারাপ করেছে। মুগ্ধ ভাইয়া আজ এত উপরে উঠেছে, এত উন্নতি করেছে এটাও আপনার ছেলের চক্ষুশূল। তিতিরকে বিয়ে করতে পারলে নাকি মুগ্ধ ভাইয়ার কাছে ও হেরে যাবে। কিন্তু বাবা এটা কোন ধরণের একতরফা প্রতিযোগিতায় নেমেছে আপনার ছেলে? এতদিন আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি বাবা আমার সংসার বাঁচানোর জন্য। আজ আর এই সংসারের প্রতি আমার কোন টান নেই। আপনার ছেলের মত নরপশুর সাথে থাকতে এখন আমার গা ঘিনঘিন করে। কেন নরপশু বললাম জানেন বাবা? কারন আমার তিন তিনটা সন্তান সে পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলেছে। বাবা না হওয়ার পেছনে কি সব অদ্ভুত যুক্তি তার আমি আপনাকে তা বলতেও পারবো না।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ভাবী কেঁদে ফেলল। বাবা ভেঙে পড়লেন। বললেন,
-“তুমি আমাকে আগে এসব কেন বলোনি?”
ভাবী বলল,
-“এসব কথা আজ থাক বাবা, যারা শেষ তারা শেষ কিন্তু যে আছে তাকে বাঁচান। প্লিজ বাবা তিতিরকে মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিন। অনুমতি দিন বাবা ও ফোন করে মুগ্ধ ভাইয়ার বিয়েটা বন্ধ করুক।”
-“কিন্তু ওর তো সুহাসের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সুহাসের ফ্যামিলি কে কি বলবো এখন?”
-“বাবা সেটা ইম্পরট্যান্ট না। এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। তাছাড়া তিতিরের সুখটা এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট। অনেকগুলো ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা, আর কোন ভুল হতে দিয়েন না। হাতজোর করছি আমি মুগ্ধ ভাইয়ার সাথে তিতিরের বিয়ে দিন।”
ভাবীর কথা শেষ হতে না হতেই তান্না ঘরে ঢুকলো। শুধু শেষের কথটাই শুনেছে ও। ওইটুকু শুনেই ভাবীর গালে আচমকা একটা চড় মেরে চুলের গোছা ধরে বলল,
-“ঘরের শত্রু বিভীষণ না? আজকে তোর খবর আছে তোর।”
বাবা তান্নাকে বলল,
-“তান্না, ওকে ছাড়ো।”
-“না বাবা, ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনের ব্যাপারে কথা বলার?”
-“কে তোমার বোন?”
তান্না অবাক হয়ে বউকে ছেরে বাবার সামনে এসে বলল,
-“কি বলছো বাবা? আর কে তিতির আমার বোন।”
-“নাহ, তিতির তোমার বোন না। তিতির আমার মেয়ে। আর তুমি আজ থেকে আমাকে আর বাবা বলে ডাকবে না।”
তান্না বলল,
-“বাবা! কি হলো তোমার?”
বাবা তান্নার কথার উত্তর না দিয়ে তিতিরকে বলল,
-“মা, তাড়াতাড়ি মুগ্ধকে ফোন করে বিয়েটা আটকা।”
তিতিরের খুশি হওয়ারও সময় নেই। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফোন তুলে কল করলো। একি মুগ্ধর ফোন বন্ধ কেন? আবার ডায়াল করলো, বন্ধ। আবার ডায়াল করলো, এবারও বন্ধ। এভাবে ৫ বার ফোন করেও মুগ্ধকে না পেয়ে তিতির দৌড়ে ড্রইং রুমে গিয়ে কেঁদে ফেলল,
-“বাবা, মুগ্ধর ফোন বন্ধ। প্লিজ তুমি অনুমতি দাও, আমি ওর কাছে যাই। ওর কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, ফুপাতো বোন। বিয়ে বাসাতেই হবে। ফুপীর বাসাও আমি চিনি। যাই বাবা?”
-“চল, আমিও যাব।”
তারপর চিৎকার কিরে বলল,
-“চম্পা, কই আছিস আমার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট টা ঘর থেকে নিয়ে আয় তো।”
তান্না বলল,
-“বাবা তুমি এতদূর যাবে? হার্ট এ্যাটাকের পর তো তুমি কোথাও যাও না।”
-“আমার ভুলের মাশুল দিতে আর আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে আজ আমাকে যেতে হবে। আর হ্যা, তুমি ভেবোনা তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। তোমার সাথে বোঝাপড়াটা আমি এসে করবো। চল তিতির।”
তান্না বলল,
-“বাবা পাগলামি করোনা। আচ্ছা ঠিকাছে আমি তিতিরকে নিয়ে যাচ্ছি।”
বাবা বলল,
-“আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা।”
চম্পা বাবার পাঞ্জাবি আর ওয়ালেট নিয়ে হাজির। বাবা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে তিতিরের হাত ধরে মেইন দরজার দিকে গেল। তিতির বলল,
-“বাবা, ভাইয়া ভাবীকে যদি কিছু করে। ভাবীকে নিয়ে চলো।”
বাবা ডাকলো,
-“বৌমা, বৌমা..”
ভাবী এসে বলল,
-“জ্বী বাবা?”
-“তুমি আমাদের সাথে চলো।”
-“আমি যাব! কিন্তু কেন?”
-“আগে চলো। এত কথা বলার সময় নেই এখন।”
ততক্ষণে মা বেড়িয়ে এল ঘর থেকে। বলল,
-“কি ব্যাপার? এত হইচই কিসের? চম্পা পাঞ্জাবি আনলো দেখলাম, কোথায় যাচ্ছো?”
বাবা বলল,
-“ফিরে এসে সব বলব।”
তান্নাও ড্রইং রুম থেকে বেড়িয়ে এল। বলল,
-“বাবা, তুমি যদি ওই হারামজাদার সাথে তিতিরের বিয়ে দাও তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
বাবা বলল,
-“আমি ফিরে এসে নিজেই তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
ট্যাক্সি খুব দ্রুত চলছে। তিতির অনবরত কাঁদছে আর ড্রাইভারকে আরো জোরে চালাতে বলছে। ভয়ে ওর আত্মা শুকিয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পর বাবাকে রাজী করাতে পেরেছে এখন যদি যাওয়ার আগেই মুগ্ধ-ইকরার বিয়ে হয়ে যায়? উফফ মরেই যাবে তিতির। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বাবা, যদি বিয়ে হয়ে যায়?”
-“কাঁদেনা মা, ও যদি তোর ভাগ্যে থাকে তাহলে বিয়ে হবে না। ধৈর্য ধর, আর আল্লাহকে ডাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বাবার চোখেও জল দেখলো তিতির। খুব মায়া হলো বাবার জন্য। এতদিন ভাইয়া এইভাবে বাবাকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে! ভাবীও কাঁদছে। তিতির মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
ইকরাদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই তিতির দৌড় দিল। বাবা ভাড়া মিটিয়ে পেছন পেছন এল। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। কে একজন এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকতেই ড্রইং রুমে অনেক লোকজন দেখতে পেল তিতির। এত লোকজনের মধ্যে চেনা মানুষটি ওকে দেখেই চমকে উঠে দাঁড়াল। দূর থেকেই বলে উঠলো,
-“তিতির! তুমি?”
তিতির কোন কথা বলতে পারলো না। মুগ্ধ তিতিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তিতির কাঁদতে কাঁদতে কোনরকমে জিজ্ঞেস করলো,
-“বিয়ে কি হয়ে গেছে?”
খুশিতে মুগ্ধর চোখে জল এল। হেসে জবাব দিল,
-“নাহ। কনে এখনো পার্লারে।”
তিতির-মুগ্ধ দুজনেই একসাথে হেসে উঠল। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“ফোন বন্ধ কেন? জানো কতবার ফোন করেছি?”
-“ফোন তো রাগের চোটে ভেঙে ফেলেছি।”
ততক্ষণে তিতিরের বাবা আর ভাবীও চলে এল। তিতিরের বাবাকে দেখে মুগ্ধ অবাক হয়ে বলে উঠলো,
-“আঙ্কেল আপনি?”
বাবা বলল,
-“আমি তিতিরকে তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি।”
মুগ্ধ যে কি করে কৃতজ্ঞতা জানাবে বুঝতে পারলো না। মাথা কাজ করছে না এখন।
তিতিরকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধর মা কাছে এল। অবাক হয়ে বলল,
-“তিতির তুমি কখন এলে? কি করে এলে? আর একি অবস্থা হয়েছে তোমার চেহারার?”
সাথে সাথেই তিতিরের বাবাকেও দেখতে পেল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল,
-“ভাই আপনি এখানে!”
বাবা হাতজোড় করে বললেন,
-“আপা, আমি নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত। ছেলের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে আমি আমার মেয়েকেও কষ্ট দিয়েছি, আপনার ছেলেকেও। এই ভুলের শাস্তি আমার মেয়েটাকে দিয়েন না। দয়া করে আমার মেয়েকে আপনার ঘরের বউ করে নিন।”
মা হেসে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ ভাই কি বলছেন এসব! যা হয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছিল আপনারা ওদের সম্পর্কটা কখনোই মানবেন না। তাই আমি ছেলের বিয়ে দিচ্ছিলাম। ও সারাজীবন একা থাকবে এটা মানতে পারছিলাম না। যাই হোক, তিতির যখন এসেছে, তখন তো আর মুগ্ধর সাথে অন্য কারো সাথে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু তার জন্য হয়তো আমার ননদের সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য নষ্ট হবে। হলে হোক, আমার ছেলের সুখ আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট।”
ইকরা বউ সেজে এসে এই অবস্থা দেখে অনেক চিল্লাপাল্লা করলো। তাই তিতির-মুগ্ধর বিয়ের বাকীসব কথাবার্তা মুগ্ধদের বাসায় গিয়ে হলো। ঠিক হলো যেহেতু পিউ আর তিতিরের মা উপস্থিত নেই সেহেতু বিয়ে আজ হবে না। তবে দেরীও করতে চাচ্ছে না কেউ। তাই বিয়ে হবে পরশুদিন। তাছাড়া সময় কম তবু একমাত্র মেয়ের বিয়ে উনি চুপিচুপি দিতে চান না। তিরিরের মায়েরও একই ইচ্ছা। তাই কাল সব আয়োজন করবে, পরশুদিন বিয়ে। রাত ১০ টার দিকে মুগ্ধ ওদেরকে পৌঁছে দিল। মুগ্ধর মা খুব জোরাজুরি করলো ডিনার করার জন্য। কিন্তু তিতিরের বাবার এক কথা, ‘মেয়ে বিয়ে দিয়েই এঘরে খাব। তার আগে না।’ মুগ্ধ পৌঁছে দিতে গেলে তিতিরের বাবা রিকোয়েস্ট করে ভেতরে যেতে। মুগ্ধ হেসে বলে,
-“নাহ, পরশু একেবারে জামাই হয়েই ঢুকবো।”
বাবা হেসে বলল,
-“আমার কথা আমাকেই ফেরত দেয়া হচ্ছে? আচ্ছা বাবা, তাই হবে।”
মুগ্ধ হাসলো। বাবা ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভাবী ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় মুগ্ধ ডাকলো,
-“ভাবী..”
ভাবী ঘুরে তাকালো। মুগ্ধ বলল,
-“থ্যাংকস।”
-“কেন?”
-“বাবাকে রাজী করানোর জন্য।”
-“আপনি কি করে জানলেন?”
-“তোমার ননদ বলেছে।”
-“কখন বলল? সারাক্ষণ তো একসাথেই ছিলাম। ও তো আপনার সাথে কোন কথাই বলেনি।”
-“অনেক কথাই বলেছে। আমরা সবার সামনে দিয়েও কথা বলতে পারি যা সবাই শুনতে পায়না।”
-“বাহ, তা ভাল কিন্তু শুকনো থ্যাংকস দিলে হবে না। তোমাদের হানিমুনে আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”
-“ওহ, এই ব্যাপার! অবশ্যই নিয়ে যাব। তখন কিন্তু না করলে শুনছি না। আর হানিমুনে গেলে কিন্তু বউয়ের চাকরী করতে হবে। তখনও না বললে মানবো না।”
তিতির হেসে ফেলল। ভাবী বলল,
-“এমা, আপনি কি অসভ্য।”
-“বারে! তাহলে তুমি বড় অসভ্য। তুমিই প্রথম যেতে চেয়েছো।”
-“না বাবা আমার যাওয়া লাগবে না, তাই বলে শুকনো থ্যাংকস ও নিচ্ছি না। পরে অন্যকিছু চেয়ে নেব।”
এই বলে ভাবী চলে গেল। মুগ্ধ চিৎকার করে বলল,
-“আইএম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।”
ভাবী চলে গেলেও তিতির গেল না। বলল,
-“শেষপর্যন্ত তোমাকে সাদা পাঞ্জাবিতে লাইভ দেখতে পারলাম। সত্যিই হিরো লাগছে।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির আবার বলল,
-“সত্যিই কি আমাদের বিয়ে হচ্ছে?”
-“হুম, বেঁচে থাকলে আর আল্লাহ কপালে রাখলে হবে।”
-“তুমি আর কোনদিনও এভাবে কাঁদবে না প্লিজ।”
-“আরে, ছিঃ তুমি আবার সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো? লজ্জা লাগছে।”
-“লজ্জা ফজ্জা জানিনা। তোমার ওই কান্না আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। যদি আর ওভাবে কাঁদো, তোমাকে আমি এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক দিয়ে তালাক দিয়ে দেব।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের হাত ধরে বলল,
-“হাতে এত আঁচড়ের দাগ কিসের?”
-“আমি রাগের মাথায় খামচি দিয়েছিলাম।”
-“কেন? তোমাকে না বলেছিলাম যাই হয়ে যাক, কখনো নিজের শরীরের ওপর রাগ দেখাবে না?”
-“সরি।”
-“পরশু রাতে সারা শরীরে দাগ বসাব দাঁড়াও।”
-“উফ, অসভ্য কোথাকার। আমি গেলাম।”
-“শোনো, আমার ফোন ভাঙা। যদিও কাল সকালে একটা ফোন কিনে নিব কিন্তু আজ রাতে আর কথা হবে না।”
-“প্রব্লেম নেই, পরশু থেকে তো আর ফোন লাগবে না, লাইভ কথা বলবো সারাক্ষণ।”
-“না রসগোল্লা। সারাক্ষণ পারবো না কারন সারাদিন আমার অফিস থাকবে।”
-“জানি। সারাক্ষণ বলতে রাতে।”
-“রাতে তো অন্য কাজ থাকবে। কত যুদ্ধের পর তোমাকে পেতে যাচ্ছি, কথার চেয়ে কাজই বেশি হবে।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“গেলাম, টাটা।”
রাতের বেলা মুগ্ধ খুব আফসোস করতে লাগলো ফোনটা ভাঙার জন্য। মুগ্ধ বাসায় ফিরতে ফিরতে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন যা ধকল গেল! আর স্নিগ্ধর কাছেও ফোন চাওয়া যাবে না। কারন, মরে গেলেও ও এই রাতের বেলা ফোন দেবে না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে কেটে গেল মুগ্ধর সারাটা রাত। ওদিকে আজ বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়ে গেল তিতির। এত নিশ্চিন্তে বহুদিন ঘুমায়নি তিতির।
বিয়ের দিন সকাল সকাল মুগ্ধর বাসা থেকে লোকজন এল তিতিরকে হলুদ দিতে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো পিউ ৮ মাসের বেবি পেটে নিয়ে চলে এসেছে হলুদ দিতে। পিউ এসেই তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“উফ, ভাবী কি যে শান্তি লাগছে। ইকরাপুর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা আমি মানতেই পারছিলাম না, তাই যাইনি। শেষপর্যন্ত তোমার সাথে বিয়ে হচ্ছে শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না।”
-“তুমি এসেছো, কি যে ভাল লাগছে আমার।”
তারপর তিতির পিউয়ের পেটে হাত রেখে বলল,
-“ইশ রে, আমার পিউ বাবুটার আবার একটা বাবু হবে।”
পিউ হেসে বলল,
-“কয়েকদিন পর তোমারও হবে।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। পিউ বলল,
-“কেমন জানি ফিলিংস ভাবী। একদম ডিফ্রেন্ট।”
সন্ধ্যাবেলায় মুগ্ধ-তিতিরের বিয়ে হয়ে গেল। কবুল বলতে বলার সাথে সাথে মুগ্ধ এক নিশ্বাসে কবুল কবুল কবুল বলে নিজেই হেসে দিল। আশেপাশের সবাইও হাসলো। ওদিকে তিতিরকে কবুল বলতে বললেও প্রায় কাছাকাছি অবস্থা হলো। যতই প্রেমের বিয়ে হোক, সাধারণত মেয়েরা তো চুপ করেই থাকে.. মুরুব্বিরা অনেক বার কবুল বলতে বলার পর কনে কবুল বলে। কিন্তু তিতিরকে কাজী কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই বলল, ‘কবুল’ কাজী আবার বলল, ‘আরেকবার বলুন মা’
তিতির সাথে সাথেই আবার বলল, ‘কবুল’। তৃতীয়বারও একই ঘটনা ঘটলো।
তান্না অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হাসিমুখে করছে। বাবার কথা না মানলে তো ত্যাজ্যপুত্র করবে। গাড়িতে ওঠার সময় তিতির আর ওর মা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদছিল যেন ওকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে, আর জীবনেও ওদের সাথে দেখা হবে না। বাবাও কাঁদছিল, তান্না আর ভাবীও কাঁদছিল। গাড়িতে উঠে মুগ্ধ তিতিরের কানে ফিসফিস করে বলল,
-“এমনভাবে কাঁদছিলে যেন আমি তোমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার অপরাধবোধ হচ্ছিল খুব।”
-“তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো। আমি তো এই দিনটার জন্যই কত কি করলাম। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই আমি এত কান্নাকাটি করলাম!”
-“কি বললে? বিয়ে হয়ে গিয়েছে? বাহ আসলেই তো আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। খেয়ালই ছিলনা আমার।”
তিতির হাসলো। স্নিগ্ধ, মুগ্ধ আর তিতির বসেছে পেছনের সিটে। সামনে পিউ, ড্রাইভ করছে ওর বর। স্নিগ্ধ সিওসিতে এ্যাটাক দিতে ব্যস্ত। মুগ্ধ চুপিচুপি তিতিরের কোমরে হাত দিয়ে হালকা একটু চাপ দিয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এল। কানে কানে বলল,
-“ও বউ, আজকে থেকে তো তুমি আমার সত্যি সত্যি বউ। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।”
তিতির তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধরও পলক পড়ছে না। তিতিরকে এই প্রথম এত সাজে দেখছে, ব্রাইডাল সাজ যেমন হয় তেমনই। লিপস্টিক ও আজ ভাল লাগছে মুগ্ধর। আবার কানে কানে বলল,
-“আজ তো তুমি শেষ।”
তিতিরও ফিসফিস করে বলল,
-“পাশে ভাইবোনরা আছে, একটু তো সামলে কথা বলো।”
-“ধুর এত সামলাসামলির কি আছে? আজ থেকে আমার সবকিছু বেসামাল।”
-“উফফ থামো তো।”
-“আচ্ছ রাতে দেখছি ব্যাপারটা, আপাতত থামলাম।”
বাসায় ফিরে যখন সবাই লিফটে উঠতে যাচ্ছিল তখন তিতিরকে টেনে ধরলো মুগ্ধ। তারপর আচমকাই তিতিরকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। সব কাজিনরা হাততালি আর সিটি বাজিয়ে মুগ্ধকে উৎসাহ দিচ্ছিল। তিতির বলল,
-“তুমি আমাকে কোলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠছো কেন?”
মুগ্ধ উঠতে উঠতে বলল,
-“যেদিন আমাদের সম্পর্ক হয়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে তোমাকে কোলে নিইনি বলে তোমার মন খারাপ হয়েছিল তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যত উপর তলাতেই থাকিনা কেন বিয়ের দিন আমি তোমাকে কোলে করে সিড়ি দিয়ে ওঠাব।”
-“তুমি কি পাগল? ওটা কোন সিরিয়াস কথ ছিল নাকি? আমি এমনি ঘুমের তালে বলেছিলাম”
-“হুম সব সময়ের সব কথাই আমার কাছে সিরিয়াস ছিল, আছে, থাকবেও। আর তোমাকে উঠানো কোন ব্যাপার না।”
-“আগে ব্যাপার ছিল না, কারন আমি শুকনা ছিলাম, এখন তো মোটা হয়ে গেছি তোমার কষ্ট হচ্ছে।”
-“চুপ থাকোনা বাবা। চলেই তো আসছি।”
তিতির খুব খুব খুশি হলো, সাথে অবাকও হলো মুগ্ধ এতবছর আগের কথা এখনো মনে রেখে সেই মত কাজ করছে? ও এত ভাল কেন!
সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। পিউ তিতিরকে নিয়ে মুগ্ধর ঘরে ঢুকলো। তিতিরের চুল খুলতে, মেকাপ উঠাতে হেল্প করলো। তারপর বলল,
-“যাও যাও ভাবী, গোসল করে আসো। নাহলে যেই মেকাপ এখনো আছে তাতে আমার ভাইয়ের পেট খারাপ হবার সম্ভাবনা প্রবল।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“ছিঃ পিউ কি বলছ এসব?”
পিউ হেসে বলল,
-“আমার আগে যদি তোমার বিয়ে হতো তখন আমার বিয়ের সময়ও তুমি এরকম দুষ্টু দুষ্টু কথা বলতে। এটাই তো নিয়ম।”
তিতির বলল,
-“ইশ, কি ভালই না হতো। তোমার বিয়ের আগেই যদি আমি তোমার ভাবী হতে পারতাম।”
-“আচ্ছা যাই হোক, এখনো যা হয়েছে ভালই হয়েছে।”
-“হুম।”
-“আর হ্যা, আমি কিন্তু দুষ্টুমি করলেও সত্যি গোসল করতে বলেছি। এত মেকাপ নিয়ে ঘুমালে তোমারই স্কিনে প্রব্লেম হবে যদিও কে জানে আজ ঘুমাবে কিনা!”
তিতির খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
-“এই পিউ, তোমরা ঘুমিয়েছিলে বাসর রাতে?”
পিউ হেসে বলল,
-“হুম, ভোর ৫ টায়।”
-“হায় হায়, উঠেছো কখন?”
-“৮ টায়, তারপর তো সারাদিন আমি শুধু ঢুলি, হি হি। পরের রাতে তো টাচই করতে দিইনি, সারারাত ঘুমিয়েছি।”
তিতির হাসলো। পিউ বলল,
-“এরেঞ্জ ম্যারেজে যদিও বা বাসর রাতে হাসবেন্ড ছাড় দেয়, লাভ ম্যারেজে কখনো ছাড়বে না।”
-“স্বাভাবিক, বেচারা! কত অপেক্ষা করে তারা তাই না?”
-“উউউউউউ, আচ্ছা আমার ভাইয়ের তো তাহলে চাঁদ কপাল। বউ তার স্বামীর এত বছরের অপেক্ষার কথা ভেবে বাসর ঘরে রেডি হয়ে বসে আছে। উফফফ, ভাইয়ারই দিন।”
-“ধ্যাত, তুমি যে কি বলো না! আমি তো ওভারঅল বললাম।”
-“আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমরাও তো বাসর রাতের জন্য অনেক এক্সইটেড ছিলাম। সেই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ওর সাথে প্রেম হয়েছিল, তখন থেকে আমরা দুজন বাসর রাতের জন্য অপেক্ষা করতাম।”
-“কি? এত পাক্না ছিলে?”
পিউ হেসে বলল,
-“হ্যা। যাই হোক, ভাবী এখন আমি যাই। আবার কাল গল্প হবে। কদিন তো আছি আমি। ভাইয়া নিশ্চই বাইরে উসখুস করছে।”
তিতির মুগ্ধকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য রেডি হয়ে বাথরুমে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মুগ্ধ ঘরে আসছে না কেন? মুগ্ধ ঘরে না এলে তো তিতির বাথরুম থেকে বেরও হতে পারছে না। আরো কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ ঘরে এল। পাজামা, পাঞ্জাবি খুলে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার বের করে পড়ে নিল। টি-শার্ট পড়তে নিয়েও পড়লো না কারন, তিতির বুকের লোমগুলো পছন্দ করে! সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। ঘরের দুপাশে ৩ টা ৩ টা বড় ৬ টা মোম জালিয়ে রাখা হয়েছে।
তিতির দরজা খুলে বের হলো। মুগ্ধ বেখায়ালিভাবে তাকাতেই দেখতে পেল তিতিরকে। তিতিরকে দেখামাত্রই মুগ্ধর চোখ আটকে গেল। হাতের টি-শার্টটা হাত থেকে পড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতরটায় কোন এক সমুদ্রের উত্তাল স্রোত বয়ে গেল। করেছে কি তিতির! ব্লাউজ ছাড়া শুধু শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পড়েছে। সেই যে ওদের প্রেমের ৪ মাসের সময় যখন ওরা বান্দরবান গিয়েছিল তখন ও তিতিরকে বলেছিল যে ও এভাবে শাড়ি পড়া খুব পছন্দ করে। সেটা মনে রেখে আজ পড়েছে। ইশ, না জানি ওর কতদিনের প্ল্যান এটা। বিয়ে না হলে তো জানতেই পারতো না। মুগ্ধ কয়েক পা এগিয়ে গেল তিতিরের কাছে। তিতিরের শরীর কাঁপছে, লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। কোন সাজ নেই মুখে, তাকাচ্ছে না মুগ্ধর দিকে। চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। মুগ্ধ আস্তে আস্তে একদম ওর কাছে চলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“তিতির কি করেছো তুমি! মাথাটায় আগুন ধরিয়ে দিলে যে। বলেছিলাম আজ রাতে তুমি শেষ, এখন তো মনে হচ্ছে আমিই শেষ।”
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। মুগ্ধ আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। তিতিরকে ও আজ ভালবাসার নতুন এক পর্ব দেখাবে। তিতিরকে পাগল করে তারপর ওর পাগলামি দেখার বেস্ট সময় আজ! আজ কোন ভয় নেই, দুঃখ নেই, হতাশা নেই, নেই কোন বাধা! আজকের রাত যেন শেষ না হয়, আজকের রাত ভালবাসার রাত।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত