দেশের প্রায় সব টিভি চ্যানেল গুলোতেই এখন ঘুরেফিরে একটিই সংবাদ ।
কয়েকদিন ধরে বিভিৎস লাশ পাওয়া যাচ্ছে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় । কারো মস্তক বিহীন দেহ পাওয়া যাচ্ছে, কারো মস্তক থাকলেও চোখ দুটো নেই, কারো বা হাত পা কাটা!
আজও একটি তরুণীর লাশ পাওয়া গিয়েছে । এই কয়েকদিনে প্রায় পাঁচটার বেশি লাশ পাওয়া গেলেও, পুলিশ এর কোনো সুরাহা করতে পারছেনা ।
টিভির সামনে বসে রাত দশটার সংবাদ দেখছেন ফারুক রশিদ ।
নরসিংদী জেলার চিনিশপুরের বাসিন্দা তিনি । স্ত্রী সামিনা ও মেয়ে সাফাকে নিয়ে সাজানো তার ছোট্ট সংসার ।
গভীর মনোযোগে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি । তার স্ত্রী সামিনা রশিদ এসে বললেন-
চারদিকের এই অবস্থার মাঝেও তোমার মেয়ে কি জেদটায় না করছে।
তিনি টিভির পর্দা থেকে নজর সরালেন না বলে সামিনা রশিদ চেঁচিয়ে বললেন-
তোমায় কিছু বলছি আমি ।
একটু নড়েচড়ে বসে ফারুক রশিদ বললেন-
হ্যাঁ বলো ।
-সাফা পিকনিকে যেতে চায়ছে ।
-কার সাথে?
-কলেজ থেকে ওদের বান্দরবান, নাফাখুম নিচ্ছে ।
-ভালো তো! ঘুরে আসুক ।
-ভালো! দেখছোনা চারদিকের কি অবস্থা?
-কি অবস্থা?
-মানুষ খুন হচ্ছে । একটু আগেও লামার এক মেয়ে খুন হলো ।
-উহু কোথার সাথে কি মেলাচ্ছ তুমি? সাফা একা যাবেনা ওখানে । শিক্ষক শিক্ষিকারা, বন্ধুবান্ধব সবাই থাকবে । তাছাড়া খুন তো নাফাখুমে হয়নি ।
রাগে গজগজ করে সামিনা রশিদ বললেন-
কাকে কি বলি আমি!
-এইজন্যই বুঝি মেয়েটা ভাত খায়নি?
-হু রাগ করে ।
-দিলে তো মেয়েটাকে রাগিয়ে?
-ক্ষুধা পেলে এমনিতেই চলে আসবে ।
সাফা রশিদ…..
নরসিংদী সরকারী কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সে ।
উঠতি বয়সের মেয়ে হলেও ছেলেমানুষী একেবারেই কাটেনি তার । চঞ্চল একটি মেয়ে সে । দেখতে সুন্দরী হলে কি হবে! দুষ্টুমিতে ওস্তাদ ।
একমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে তার সব কিছুই সহ্য করতে হয় মা বাবাকে ।
এই বছর তাদের কলেজ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে । একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নেয়া হবে বান্দরবানে । স্কুলের কোনো পিকনিক সে বাদ দেয়নি । কলেজের টা কি করে দিবে!
নরসিংদী থেকে বেশ দূরত্ব রয়েছে বান্দরবানের । তাছাড়া কয়েকদিন ধরেই খুনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে । এসবের জন্য ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে তার মা ।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেল মান-অভিমানের পালা । খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সাফা । জেদ ধরে বসে আছে, বান্দরবানে যাবেই সে!
রাত বারোটা পার হয়ে গেলেও খেতে আসলো না সাফা । তার মা খুব বেশিই চিন্তায় থাকেন মেয়েকে নিয়ে । দুষ্টুমির সাথে সাথে মেয়েটা বড্ড জেদ করে সব কিছুতে ।
একটা প্লেটে রাতের খাবার নিয়ে মেয়ের রুমে আসলেন তিনি । মুখ গোমড়া করে বসে আছে সাফা ।
তার পাশে বসে সামিনা রশিদ বললেন-
স্কুলের কোনো পিকনিকে আমি তোকে যেতে নিষেধ করিনি । বান্দরবান অনেক দূরে । আমার টেনশন হয়না বুঝি?
-অন্য মায়েদের টেনশন হয়না? সব টেনশন শুধু তোমারই ।
-অন্য মেয়েরা তোর মতো দুষ্টু নয়, এত বড় হয়েছিস তবুও দুষ্টুমি কমেনা তোর ।
-আমি কি দুষ্টুমি করব? স্যার ম্যাডামরা থাকবেন আমাদের সাথে ।
-এদিক সেদিক চলে যাবি একা একা । দেখছিস তো? আজও একটা মেয়ে খুন হলো ।
-তাই বলে ঘরে বসে আছে সবাই?
-দেখ মা এসব বাদ দে, আমি আর তোর বাবা নিয়ে যাব তোকে ।
-এসব এমনিতেই বলো । তোমাদের সময় হয়না । তাই বলোনা । এসব বলে তুমি আমাকে ভাত খাওয়াতে পারবেনা । আর রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি খাচ্ছিনা ।
-জেদ করিস না ।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের কথপোকথন শুনছিলেন, ফারুক রশিদ ।
তিনি এগিয়ে এসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-
ঠিক আছে তুই যাবি । এবার খেয়ে নে ।
তার কথা শুনে সামিনা রশিদ অবাক হলেও মুখে হাসি ফুটলো সাফার । কিন্তু পরক্ষণেই সে মুখটা ফ্যাকাসে করে বলল-
আমি ভাত খাওয়ার জন্য মিথ্যে আশা দিচ্ছ আমায় ।
-ফারুক রশিদ কখনো মিথ্যে বলেনা, জানিস না?
-সত্যি?
-হু । কাল কলেজে গিয়ে পিকনিকের জন্য টাকা জমা দিয়ে আসবি ।
বিছানার উপরে প্লেট রেখে হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সামিনা রশিদ । অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো সাফা ।
তিনি বললেন-
আমি সামলে নিচ্ছি । তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড় ।
-তুমি রাজি কেনো হলে?
স্ত্রীর কথা শুনে ফারুক রশিদ বললেন-
এত উত্তেজিত হচ্ছো কেনো তুমি? এর আগেও সাফা পিকনিকে গিয়েছে ।
-সেসব কাছে কোথাও গিয়েছে । এতদূরে নয় ।
-মেয়ে বড় হয়েছে সামিনা ।
-কিন্তু স্বভাব বদলায়নি ।
-তাই বলে ওকে আমরা বন্দী করে রাখতে পারিনা ।
-পিকনিকে যেতে না দেয়াই মানে বন্দী করে রাখা নয় ।
-ও সেটাই ভাবছে । কারণ ওর অন্যান্য সহপাঠিরা যাচ্ছে ।
আপাতত ফারুক রশিদের সাথে তর্কে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার । চুপচাপ শুয়ে পড়েছেন সামিনা রশিদ।
ফারুক রশিদ বললেন-
একাধারে ক্লাস করতে করতে বাচ্চাদের মনে বিরক্তিভাব চলে আসে । বিরক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন কোথাও ঘুরতে যাওয়া ।
-আমরা কি ঘুরতে নিয়ে যাইনা ওকে? আমরাই নিয়ে যেতে পারি বান্দরবান ।
-আমাদের সাথে যাওয়া আর সহপাঠীদের সাথে যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে ।
-এত দূরে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার ছিল?
-সমস্যা টা কি শুধু এখানেই?
-চারদিকের অবস্থা কেমন জানোই । তাও জিজ্ঞাসা করছ এসব?
-সাফা একা যাচ্ছেনা সেখানে । কিছুই হবেনা ।
এত টেনশন করো নাতো । মেয়েটার মন খারাপ করে দিওনা ।
-আমার মন খারাপের মূল্য নেই তোমার কাছে?
কথা বাড়ালেন না ফারুক রশিদ । সামিনা রশিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন । আজ রাতে তার মন আর ভালো করা যাবেনা…
এদিকে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে সাফার । তার বাবা এত সহজে রাজি হয়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি সে ৷ তবে এখনো ভরসা করা যাচ্ছেনা তার বাবাকেও । মা যদি পটিয়ে ফেলে?
নানারকমের চিন্তা এসে ভর করলো তার মনে আবার! শেষ পর্যন্ত যেতে পারবে তো সে?
দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেল । সাফা বাসে বসে আছে তার সহপাঠীদের সাথে । অবশেষে সে সফল হয়েছে । এই সাতদিনে আর কোনো খুনের সংবাদ শুনতে না পাওয়ার কারণে তার মা খুব একটা ঝামেলা করেনি ।
এর আগেও সে বেশ কয়েকবার পিকনিকে গেলেও এবারের টা তার কাছে অনেক বেশিই স্পেশাল । বান্দরবানের সৌন্দর্য্য সম্পর্কে অনেক শুনেছে সে । কিন্তু কখনো যাওয়ার সুযোগ হয়নি । আজ তার বান্দরবান দেখার যাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হবে আর পূরণ
হবে নাফাখুম দেখার ইচ্ছেও…
থানচি এসে পৌঁছালো সাফারা । নাফাখুম যেতে হলে বান্দরবান জেলা সদর থেকে এখানেই আগে আসতে হয় । এটি একটি উপজেলা । সাঙ্গু নদীর পাড়ে অবস্থিত থানচি বাজার । এই সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রীর দিকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয় নৌকা বেঁয়ে । নদীর দুপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় । সবুজে মোড়ানো প্রতিটি পাহাড় যেন মেঘের কোলে শুয়ে আছে অবলিলায় । কোন কোন পাহাড় এতটায় উঁচু যে, তার চূড়া ঢেকে আছে মেঘের আস্তরে ।
গাড়ি, নৌকা সব কিছুর রাস্তা শেষ ।
সকাল আটটায় থানচিতে নাস্তা সেরে হাঁটা শুরু করলো তারা ।
পাহাড়, পাথর ও ঝিরি পথের মধ্য দিয়ে তারা হাঁটতে লাগলো । একসাথে পঞ্চাশ জনের বেশি থাকলেও, সাফার ভালো ভাব রয়েছে তনিমা ও রায়মার সাথে । কলেজের শুরু থেকেই তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তার । বেস্ট ফ্রেন্ডও বলা যায় ।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দুই ঘন্টারও বেশি সময় লাগলো নাফাখুমে আসতে । এত হাঁটার পরেও কারো মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই । সবার মুখেই আনন্দের ঝিলিক ।
নাফাখুম জলপ্রপাতে পৌঁছেই চারদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো সাফা । অসাধারণ সুন্দর একটি স্থান এটি । যেন প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার এই জলপ্রপাত! সূর্যের আলোয় যেখানে নিত্য খেলা করে বর্ণিল রংধনু!
প্রকৃতি এতটা সুন্দর ও নির্মল হতে পারে, এখানে না আসলে জানতোই না সে ।
একে একে সকলে ঝর্ণার দিকে গেলেও সাফা চারদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে লাগলো । এদিকে সব কিছু উপেক্ষা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে তাইফ । আসল নাম তাইফুল ইসলাম । ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই সাফাকে পছন্দ করে সে । তবে মনের কথা মনেই রয়ে গেল । এখনো তাকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেনি তাইফ ।
সাফাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তনিমা এসে বলল-
কিরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? খুব তো ঝর্ণায় গোসল করবি বলে লাফিয়েছিস । চল এবার!
-হু চল ।
ঝর্ণার নিচে আসতেই অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে সাফার মনে । উপর হতে আছড়ে পড়া পানির আঘাতে ঝর্নার চারিদিকে সৃষ্টি হচ্ছে ঘন কুয়াশার । উড়ে যাওয়া জলকনা বাষ্পের সাথে ভেসে ভেসে শরীরে এসে পড়ছে সাফার । এ যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি!
নাফাখুমে প্রায় দুই ঘন্টা ঝর্ণা ও নদীতে সময় কাটানোর পর তাদের শ্রেণি শিক্ষিকা নাদিয়া জান্নাত সবার উদ্দেশ্যে বললেন-
সবাই উঠে এসো । নাফাখুম পাড়াতেই দুপুরের খাবার টা সারতে হবে ।
কাপড় বদলে সবাই দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলো ।
হঠাৎ একজন পুরুষের কাছে জানতে পারলো, ঝর্ণার পাশে একটি ছেলের লাশ পাওয়া গিয়েছে ।
কথাটি শুনেই নাদিয়া জান্নাত সব শিক্ষার্থী আছে কিনা দেখতে লাগলেন । সবাই ঠিকঠাক মতো আছে দেখে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি । এরপর সবাই ঝর্ণার পাশে এসে ভিড় জমালো ।
একটু আগেও তারা এখানে ছিল । এই খুনটা হলো কিভাবে এই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই । অথচ লাশটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে, সদ্য খুন হয়েছে । লাশটি দেখে সবাই ভয়ে আতঙ্কিত হয়েছে । কারণ লাশটি ছিল মস্তক বিহীন । মাথাটি দেহের একপাশে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে ।
অনেক মেয়ে লাশ দেখে বমি করে যা তা অবস্থা, কেউ বা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে ।
এইরকম ভয়ানক পরিস্থিতি দেখে শিক্ষকরা নিজেদের মাঝে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে আসলেন যে, এই মুহুর্তেই এই স্থানটি ত্যাগ করা জরুরী । শুধু এই স্থান নয়, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তাদের বাড়ি ফেরা উচিত । যদিও আজ জিন্না পাড়ায় রাত কাটানোর কথা ছিল ।
নাদিয়া জান্নাত সবাইকে উঠে আসতে বললেন, সাথে জানালেন এখুনি নরসিংদী ফিরবেন তারা ।
একে একে সবাই উঠে আসতে লাগলো ।
উপরে উঠে আসার সময় হঠাৎ সাফার পায়ের সাথে কিছু একটা লেগে সে হোঁচট খেলো । নিজের শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য একটু নিচু হতেই একটি প্রদীপ দেখতে পেলো ।
প্রদীপটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । তাই হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে দেখলো সে ৷ কাদামাখা পুরনো পিতলের প্রদীপটি ছুঁড়ে ফেলতে চাইলে রায়মা
বলল-
এটা কি? দেখে মনেহচ্ছে আলাদীনের চেরাগ!
-এই যুগে আলাদীনের চেরাগ!
-হতেও তো পারে ।
-কি যে বলিস না!
নাদিয়া জান্নাত তাড়া দিতেই হনহনিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো তনিমা ।
সাফার কেনো যেন প্রদীপটি ফেলতে ইচ্ছে করলো না । পানিতে ধুঁয়ে সে নিজের কাঁধে থাকা ব্যাগটিতে ঢুকিয়ে নিলো সেটি ।