ছুঁয়ে দেখা

ছুঁয়ে দেখা
-প্রতিদিন রাতে যে তুমি চুপিচুপি আমার রুমে চলে আসো একবারও কি ভেবে দেখেছ আমাদের কিন্তু এখনও বিয়ে হয়নি।
–স্বপ্নীলের মুখে একথা শুনে নীলাদ্রি খানিকটা চেচিয়ে বলে উঠল বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে ?আর আমি রাতের বেলা তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না তাই চলে আসি।বুঝতে পারছ। গাধা!
–উফ!কথায় আমি তোমার সাথে পারবো না। এই শুনো বলি কি প্রতিদিনই তো তুমি আমার সাথে ঘুমাও..
–আবারও নীলাদ্রি চেচিয়ে বলে উঠল, না আমি তোমার সাথে ঘুমাই না আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্যে প্রতিদিন চলে আসি।তুমি যখন ঘুমিয়ে পর তখন আবছা আলোতে তোমার মুখটা দেখতে আমার প্রচন্ড রকম ভালো লাগে আর সে ভালো লাগার টানেই প্রতিদিন ছুটে আসি..। এবার বল কি বলতে চাও
–না মানে বলছিলাম যে তোমাকে আজকে কেন জানি আদর করতে মন চাচ্ছে প্রতিরাতে ঠিক এই কথাটাতে এসেই তাদের ঝামেলা টা শুরু হয়।
গত এক বছর ধরে প্রতি রাতেই নীলাদ্রি ঠিক রাত বারটায় চুপিচুপি তার রুমে চলে আসে কিন্তু একটাবারের জন্যও তাকে ছুতে দেয় না।এই বয়সে প্রতি রাতে সাথে একটা মেয়ে থাকলে যে কারও তাকে ছুতে ইচ্ছে করবে,আদর করতে ইচ্ছে করবে তাহলে এখানে স্বপ্নীলেরই বা দোষ কোথায়।যদিও সে খুব ভালো করেই জানে কেন নীলাদ্রি তাকে ছুঁতে দেয় না তবুও মনটাতো আর মানতে চায় না। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে বৈশাখের কোনোএক বৃষ্টিবিঘ্নিত দিনে নীলাদ্রির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল স্বপ্নীলের।তারা দুটি ফ্যামিলি একই বিল্ডিং এ থাকে।স্বপ্নীলদের ফ্যামিলি থাকে তৃতীয় তলায় আর নীলাদ্রিরা থাকে দ্বিতীয় তলায়। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি ছিল আর স্বপ্নীল জানালার ধারে বসে থেকে বৃষ্টিটা উপভোগ করছিল হুট করেই তার চোখ নিচে চলে যায় আর দেখে একটি মেয়ে আম গাছটার নিচে দাড়িয়ে মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজতেছে আর আম কুড়াচ্ছে।
হুট করেই যেন তার মনে হল সেও আম কুড়াবে। ফ্ল্যাটে নতুন এসেছে তাই বাসার নিচেই যে একটা আম গাছ আছে আর ঐটায় এত আম তা লক্ষ্যই করা হয়নি স্বপ্নীলের।কিছু না ভেবে ছাতা টা নিয়েই এক দৌড়ে নিচে চলে গেল আম কুড়ানোর জন্যে।স্বপ্নীল শুধু তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে,কতই না সুন্দর মেয়েটার চেহারা,বৃষ্টির প্রতিটা কনা মেয়েটার গা বেয়ে পরছে এটা যেন আরও বাড়তি সৌন্দর্য দিচ্ছিল তাকে।ভেজা কাপড় থাকার কারনে কখন যে তার চোখ মেয়েটার সারা গা বুলিয়ে নিল তা যেন টেরই পেল না সে কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তার চোখ গুলো শুধুমাত্র মেয়েটার মুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তখনই মনে মনে বলে উঠল ছি!ছি! এগুলো আমি কি দেখছি হুট করেই লক্ষ্য করল গাছ থেকে একটা আম পরেছে তা দেখে ছাতা মাথায় করে সাথেসাথে গেট থেকে পা বাড়াল কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা আমটা তার নিজের ঝুলিতে তুলে নিয়েছে। স্বপ্নীলের মলীন মুখটা দেখে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল
–কি আম কুড়াতে এসেছেন?
–হ্যা
–এটা আমার বাবার গাছ এখানে শুধু আমিই আম কুড়াই, আর আম কুড়াতে এসেছেন ছাতা মাথায় দিয়ে হা হা! বলেই তার হাত থেকে ছাতা টা নিয়ে নিল। মুহুর্তের মধ্যেই স্বপ্নীলের সারা গা ভিজে একাকার হয়ে গেল আর বলে উঠল
–আচ্ছা আপনার বাবার গাছ,আপনিই আম খান।আমার লাগবে না। তবে আপনার নাম টা কি জানতে পারি?
–না,নাম বলা যাবে না।
–ও আচ্ছা বলেই চলে আসতে লাগলো স্বপ্নীল।
এমন সময় পেছন থেকে একটি আওয়াজ তার কানে ভেসে আসল। “নীলাদ্রি” ঝুম বৃষ্টির শব্দে নামটা স্পষ্ট ন শুনলেও সে আন্দাজ করে নিয়েছিল নীলাদ্রিই হবে,ভাবতে ভাবতে সে উপরে উঠে আসলো একটু পরেই লক্ষ্য করল কেউ একজন দরজায় নক করতেছে।দরজা খুলেই দেখল ভেজা গায়ে মেয়েটা হাতে কয়েকটা আম নিয়ে দাড়িয়ে আছে।কিছু বলার আগেই সে তার হাতে আম গুলো দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে গেল। সেদিন বৃষ্টিতে প্রথম দেখা হলেও পরে প্রায়ই তাদের দেখা হতো।কখনও সিঁড়িতে কখনও ছাদে কখনওবা রাস্তায়।কিন্তু কোনোসময়ই যেন তাদের লং টাইমের জন্য দেখা হচ্ছে না।স্বপ্নীল দেখা হলেই একটু কথা বলার চেষ্টা করতো কিন্তু নীলাদ্রি দেখা হলেই একটু মুচকি হাসি দিয়ে চলে যেত। একদিন ছাদে নীলাদ্রি তার কৃষ্ণচূড়া গাছে পানি দিচ্ছিল এমন সময় স্বপ্নীল গিয়ে সেখানে উপস্থিত আর সাথে সাথে বলে উঠলো
–কৃষ্ণ মানে কালো কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো হয় রক্তলাল,কালো হলেই মনে হয় আরো বেশি সুন্দর হত,আহারে সেই ছোটবেলা থেকেই কালো রংটা ফেবারিট ছিল।কথাটা সে নীলাদ্রিকে বললেও আকাশের পানে তাকিয়ে এমন ভাবে বলল যেন নিজেই নিজেকে বলছে।
–আরে গাধা!কৃষ্ণচূড়া ফুল লাল জন্যেই এত সুন্দর হয়।
–আমাকে কিছু বললেন? স্বপ্নীলের মুখে একথা শুনে হুড়িশুড়ি খেয়ে নীলাদ্রি বলে উঠলো
–না না আপনাকে কেন বলতে যাব।গাধা! কথাটা বলেই চলে যাবে এমন সময় পেছন থেকে স্বপ্নীল বলে উঠলো
–আপনাদের রুমের সামনে কলিং বেলের কাছে পাঁচটা ডিজিট লিখা আছে বাকি ছয়টা ডিজিট ৩৫৯০৯২। রাতে অপেক্ষায় থাকবো।
অতঃপর রাতে টুং করে স্বপ্নীলের ফোনটা বেজে উঠলো হ্যা এভাবেই শুরু হয়েছিল স্বপ্নীল আর নীলাদ্রির গল্পটা। তাদের বাসা থেকে একটু দূরে অনেক পুরাতন একটা হিজল গাছ ছিল।লোকেমুখে শোনা যায় এটা নাকি অনেক অভিশপ্ত একটা জায়গা তবুও তারা দুজন সবসময় এখানেই গিয়ে গল্প করত। তাদের রিলেশনটা সময়ের সাথে সাথে ডিপ হতে থাকে তবে সেটা শুধুমাত্র একসাথে গল্প করাতেই সীমাবদ্ধ। প্রায় মাস তিনেক হয়ে গেছে তাদের সম্কর্কের এখন পর্যন্ত নীলাদ্রি তার হাতে পর্যন্ত স্বপ্নীলকে ছুঁতে দেয়নি এমনকি সে বলে দিয়েছে বিয়ের আগে তা সম্ভব নয়।স্বপ্নীলও তার সব কথা মেনে নিয়েছে।এভাবেই এগেচ্ছিল তাদের দিন গুলো। আস্তে আস্তে তাদের ফ্যামিলি ব্যাপারটা জানতে পারলো এবং সিদ্ধান্ত নিল তাদের বিয়ে দিয়ে দিবে।এবার আর তাদের খুশি দেখে কে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল নীলাদ্রি এখনও তার হাতে পর্যন্ত স্বপ্নীলকে ছুঁতে দেয়নি। স্বপ্নীল এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সে বলে উঠে
–বাসর রাতের ঐ প্রথম ছোঁয়াতেই মেয়েদের স্বর্গসুখ আর আমি তোমার থেকে সেটাই পেতে চাই।প্লিজ এতদিন পারছ আর একটা সপ্তাহ..। বিয়ের সব আয়োজন প্রায় শেষ কিন্তু হল না,হল না তাদের বিয়ে টা। “লিউকিমিয়া” শব্দটা যেন সবকিছু তছনছ করে দিল।বিয়ের সাজে পুরো বাড়ি যেখানে আলোকিত সেখানে অন্ধকার নেমে এসেছিল প্রত্যেকটা মানুষের মনে আর তখন থেকেই স্বপ্নীল আধোপাগল হয়ে গিয়েছিল সব মানুষের জন্যেই।
আজ প্রায় একবছর হয়ে গেছে কিন্তু আজও সে একা একা কথা বলে,ঐ হিজল গাছের নিচে গিয়ে বসে থেকে কার সাথে যেন কথা বলে। মানুষ তাকে দেখে পাগল বললেও সে যে জানে সে পাগল নয় কারন সে স্পষ্ট নীলাদ্রিকে দেখতে পায়, নীলাদ্রিও তার প্রতিটি কথার উত্তর দেয়,প্রতিদিন রাতে তার রুমে চলে আসে গল্প করার জন্য আর আবছা আলোতে তার ঘুমন্ত মুখটা দেখার জন্য। এভাবেই চলছিল দিনগুলো হয়তবা সারাজীবন এভাবেই চলত কিন্তু সেদিন হিজল গাছের নিচে বসে যখন তারা গল্প করছিল ঠিক তখনি স্বপ্নীলের নীলাদ্রির কাধে মাথা রাখার খুব ইচ্ছে হল আর সে তাকে কিছু না বলেই তার কাধে মাথা টা রেখে দিয়েছিল যদিও শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারে নি। নীলাদ্রি একটু দূরে সরে গিয়ে বলে উঠে
–জানো মৃত্যুর পর শুধুমাত্র তোমার জন্যে ঐ আকাশ থেকে বর নিয়ে আমি ফিরে এসেছিলাম,তারা শুধু বলেছিল তুমি যেন আমাকে না ছুঁতে পারো আর সেটা তুমিও জানতে এমনকি মেনেও চলেছিল আর আজকে হুট করেই..।কথাটা বলেই নীলাদ্রি হাটা শুরু করে দিল একটু পর কোথায় যেন মিলিয়ে গেল পেছন থেকে স্বপ্নীল কাঁদোকন্ঠে শুধু বলে উঠে –“sorry”আমার ভুল হয়ে গেছে,প্লিজ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও প্লিজ তারপর থেকে আর কখনই নীলাদ্রির দেখা পায়নি স্বপ্নীল কিন্তু সে হাল ছেড়ে দেয়নি এখনও প্রতিদিন ঐ হিজল গাছটার নিচে গিয়ে বসে থাকে যদি আবার ঐ আকাশ থেকে নীলাদ্রি ফিরে আসে সেই অপেক্ষায়।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত