বিবাহিত জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ রাত

বিবাহিত জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ রাত

বাবা-মায়ের পছন্দে পারিবারিকভাবেই খুব সাদামাটাভাবেই আমার বিয়েটা হয়ে গেল। সাদামাটা বলতে কিছুটা ইসলামি শরীয়াহ মান্য করেই। আমার কাছে অসাধারণ হলেও সমাজের কাছে এটা সাদামাটাই বলা চলে।

আমি বাসর ঘরে বসে আছি। সবকিছু সাদামাটা হলেও বাসরঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। এমনিই সারাদিনে শরীরের উপর ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে, কান্না করেছি অনেক, মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। তার উপর আবার ঘর ভর্তি তাজা ফুলের সুগন্ধী ঘ্রাণ। মন চাইছে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু তা কী আর হয়? আমার উনিই তো এখনো এলেন না।

উনার নাম ‘আয়াত’। বিয়ের আগে দু’দিন কথা হয়েছিল তার সাথে। দুদিনের কথায় বেশ ভালো ছেলে হিসেবেই মনে হয়েছে। বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলেন। খুব কেয়ারিং বলে মনে হয়েছে। জানি না, ব্যক্তিটা আসলেই কেমন! ও আচ্ছা, আমার নামই তো বলা হলো না! আমি নিশি। কিছুক্ষণ পরই দরজার ওপাশ থেকে কে যেন কাশি দিয়ে উঠল। আমি চুপ করে রইলাম। কে যেন বললো, “আসতে পারি?”

মনে হচ্ছে আমার উনি। আমি উত্তর দিলাম, “জ্বি আসুন।” রুমে ঢুকার সাথে সাথে উনি সালাম দিলেন, “আসসালামু ওয়ালাইকুম।” শিট! সালামটা আমার আগে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি তো খুব নার্ভাস ফিল করছি, তাই হয়তো ভুলে গেছিলাম। যাই হোক, আমি সালামের উত্তর নিয়ে পূনরায় উনাকে সালাম দিলাম। উনিও সালামের উত্তর দিয়ে বিছানায় বসলেন।

– “কেমন আছো? খারাপ লাগছে কি? বা অস্বস্তি?”

– “না, আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক আছে।”

– “নাহ, ঠিক তো থাকার কথা না। আমার নিজের মাথাটাই তো বেশ ব্যথা করছে। সেখানে তুমি মেয়ে হয়ে এতটা পথ জার্নি করছো, কী কান্নাটাই না কানলা, গাড়িতে বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলে আমার বুকে। আর সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে, অচেনা কিছু মানুষ, অস্বস্তি লাগবেই।”

– “তেমন কিছু না, তবে মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে।” কিছুটা নরম গলায় আমতা আমতা করে বললাম।

– “আমি জানতাম, এজন্যই মাথাব্যথার টেবলেট ও মলম কিনে আনলাম।”

কে যেন টেবিলে এক গ্লাস দুধ রেখে গিয়েছিল। সেই দুধ আর দুটো টেবলেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ওষুধ দুটো খেয়ে গ্লাসের বাকি অর্ধেক দুধ তাকে দিলাম। তিনিও ওষুধ খেয়ে নিলেন।

– “এবার মাথায় মলম লাগিয়ে একটু ম্যাসাজ করে দিই?” উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন। এ কেমন কথা? বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর হাতে মাথা ম্যাসাজ করে নিব? ভাবতেই লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছি আমি।

– “না না, থাক। ওষুধ তো খেলাম। ঠিক হয়ে যাবে৷ প্রয়োজন হলে আমি লাগিয়ে নিব। আপনি আপনার কপালে লাগিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিন মলমটি।”

তারপর উনি কথা বলা শুরু করলেন। নিজের সম্পর্কে টুকিটাকি বললেন। পরিবারের সম্পর্কে বললেন। আমাকেও এটাওটা জিজ্ঞাস করলেন। আমিও যথাযথভাবে উত্তর দিয়েই চুপ ছিলাম। শুধুই শুনে গেছি। নিজ থেকে কিছু বলিনি বা জিজ্ঞাস করিনি। করবো, দু-তিন দিন যাক না। এভাবেই রাত কিছুটা গভীর হয়ে এলো। বাসা ভর্তি মানুষে গুমগুম করতে থাকা বাড়িটা কিছুটা নিরব হয়ে উঠেছে। ওষধ খাওয়ার পর উনার এতো সুন্দর সাজানো-গুছানে কথা, আমাকে ও পরিবারকে নিয়ে তার এতো এতো স্বপ্ন কথনের ভিড়ে আমার ক্লান্তি, অস্বস্তি ও মাথাব্যথা কখন যে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি৷

– “নিশি! চলো, অযু করে আসি। নামাজ তো এখনো পড়া হলো না। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তুমি কাপড়গুলো চেঞ্জ করে নাও।”

কাপড় বদলিয়ে বের হলাম। দেখি উনি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাব্বাহ, চাঁদনি রাত। রাতটা যেন আজ শুধুমাত্র আমাদের জন্যই এতো সুন্দর হয়ে সেজেছে। ওযু করে তিনি আর ঘরে ঢুকলেন না। বললেন, “একটু বাইরে থাকি, আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটার সাক্ষী হয়ে থাকুক ঐ চাঁদটাও।” আরো কিছুক্ষণ থাকলেন। আরো অনেক কিছু বললেন। তবে এবার আমি আর চুপ থাকিনি। তার এতো সুন্দর সুন্দর কথা পৃষ্ঠে আমিও দু-একটা কথা বলেছি। সময়টা খুব ভালো উপভোগ করছিলাম।

ঘরে গিয়ে দুটো জায়নামাজ বের করে ফ্লোরে বিছিয়ে দিলেন তিনি। আমি তার পিছনে দাঁড়ালাম। নামাজ শুরু করে প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের দ্বিতীয় সেজদায় গেলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছেন তিনি৷ আমিও সিজদায় পড়ে রইলাম, তার আল্লাহু আকবার তাকবীরের অপেক্ষায়। নাহ, কোনো সাড়া পাচ্ছি না। বেশ ভয় হচ্ছিল, হঠাৎ কী হলো মানুষটার? কী করবো আমি? তাকে ডাক দিব নাকি তার গায়ে স্পর্শ করবো? বেশ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।

অবশেষে আমি সিজদাহ থেকে মাথা উঠিয়ে তার গায়ে স্পর্শ করলাম। স্পর্শ করে বুঝলাম, উনার শরীর কাঁপছে৷ কিন্তু কেন? অসুস্থতা নাকি কান্না করছেন উনি? তখনি তার কণ্ঠস্বরে “আল্লাহ” আওয়াজ পেলাম। কণ্ঠস্বরটা বেশ ভারি ছিল, যেন কান্না করছিলেন তিনি। মনের অজান্তে আমার চোখ বেয়েও পানি বেড়িয়ে এলো। একটু পরই সিজদা থেকে উঠে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন তিনি। মুনাজাত করে বাইরে গেলেন। ও আচ্ছা, কান্না করেছিলেন, তাই হয়তো ফ্রেশ হতে গেছেন। ঘরে এসে আমার দিকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন, “সরি!” আমি অবাক হয়ে বললাম, “সরি কেন?” উনি বললেন, “না কিছু না, এমনিই।”

তারপর উনি ওয়্যার ড্রব থেকে কী যেন একটা বের করলেন। খুব সুন্দর করে রেপিং করা। আমার হাতে দিয়ে খুলতে বললেন উনি। “এটা আমার দেওয়া তোমাকে জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপহার।” খুলে দেখি, WOOW! পবিত্র আল-কোরআন। এবার তার সামনেই কেঁদে দিলাম। সত্যিই, রাতটা যেন আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটিই যেন অতিবাহিত হতে চলছে। কোরআনটি বুকে জড়িয়ে নিজের অজান্তেই তার বুকে মাথা গুঁজে দিলাম।

‘পাগলি একটা’ বলে সে নিজেও তার বুকে আগলে নিলেন আমাকে। তারপর চোখের পানি মুছে দিয়ে আলতো করে আমার কপালে একটি চুমু এঁকে দিলেন। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করলাম, যেন পৃথিবীর সমস্ত মায়া, মততা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল তার চুমুটিতে। আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখি উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি টুপ করে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছি। খুব বেশি লজ্জা পেয়েছি।

– “হইছে আর লজ্জা পেতে হবে না। এবার একটু কোরআন তিলাওয়াত করে শোনাও আমাকে।” এখন কী করি? এমনিই লজ্জা পাচ্ছি, তার উপর আবার উনার সামনে কোরআন তিলাওয়াত করবো কীভাবে? কিছুটা ভয়ও কাজ করছে আমার মধ্যে। কিন্তু সরাসরি নাও তো করতে পারছি না। তারপরও কোরআন খুলে আমতা আমতা করতে করতে সূরা ফাতিহাটা পড়ে শুনালাম।

– “আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝতে পারছি। এখন আর তিলাওআত করতে হবে না। পরে তিলাওআত করে শুনাইও।”

– “ঠিক আছে।” যাক বাবা, বাঁচা গেলাম, বুকটা যা ধড়পড়াচ্ছিলা না!

– “চলো এবার ঘুমিয়ে পড়ি। রাত তো অনেক হলো। ফজরের সময় আবার উঠতে হবে তো।”

– “ওকে।”

ফোনের এলার্মে ঘুম ভাঙলো আমার। উনার ফোনে এলার্ম বাজছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ০৪:৩০ বাজে। তখনি মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি শুনতে পেলাম। এলার্ম বাজার সাথে সাথেই এলার্ম অফ করাতে উনি হয়তো টের পাননি।

উঠে গিয়ে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। উনি ঘুমাচ্ছেন। কী শান্তির ঘুম। জেগে থাকা উনার চেহারায় যতটা না মায়া অনুভব করা যায়, ঘুমন্ত অবস্থায় যেন আরো হাজার গুণ মায়া লুকিয়ে রয়েছে তার চেহারায়৷ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। খুব ইচ্ছে করছে তার কপালে একটা চুমু এঁকে দিতে। কিন্তু ভয়ও করছে। যদি উনি টের পেয়ে যান তাহলে খুব বেশি লজ্জা পাব। কিন্তু নিজের ইচ্ছাটাকে আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। কিছুটা ভয়, লজ্জা, মায়া-মমতা ও সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমিও চোখ বন্ধ করে তার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলাম।

তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। নাহ, সে টেন পায়নি৷ এবার তাকে ডাকার জন্য তার কপালে হাত রাখলাম, বললাম- “উঠেন, নামাজ পড়তে যাবেন না?” সে উঠে পোষাক ও টুপি পরিধান করে বের হলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। আমিও অযু করে এসে নামাজে দাঁড়ালাম। সেজদায় আল্লাহর নিকট হাজারো শুকরিয়া আদায় করলাম, আমাকে এমন একজন মানুষের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কবুল করার জন্য।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত