আমি যে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সে স্কুলের নাম আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। মিরপুর সাত নম্বরের এই স্কুলটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছি আমি
আজহারুল হক। প্রধান শিক্ষক হয়েও এই স্কুল প্রাঙ্গনে আমার কদম রাখতে বড্ড ভয় হচ্ছে। কখনো ভাবিনি আমার জীবন চিত্রনাট্য এভাবেই লেখা হয়েছিলো বিধাতার
কলমে। এই যে আমার সামনে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তিনতলা ভবন। যার নাম আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় । এই ভবনটি থেকে অনেক বছর আগেই,
আমি চলে গিয়েছিলাম বিশাল অভিমানের পাহাড় বুকেতে জমিয়ে। যেখান থেকে জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলাম, জীবন আজ আমাকে অনেকটা পথ ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে সেই শুরুর স্থানে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবী খুবই ছোট, যত দুরেই পালাতে চাইনা কেন, ঘুরে ফিরে আবার আসতেই হবে, স্মৃতির শহরে। সেই শহরেই
নিয়ে আসবে যে শহর থেকে মানুষ পালাতে চায় বড্ড বেশি নিজেকে আড়াল করতে চায়।
খুব ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি স্কুলের ভেতরে। স্কুল মাঠের মধ্যেই স্টেজ বানানো হয়েছে। আজ এস.এস.সি পরীক্ষার্থীদের বিদায় দেওয়া হবে। আর আমাকে স্কুল কমিটি সকল ছাত্রছাত্রী এবং কর্মরত শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আজহারুল হক কে। আমি মাঠের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখছিলাম।
১৯৯০ সালে যখন আমি স্কুল ছেড়ে চলে যাই তখন স্কুলটি একটি টিনের ঘর দিয়ে বানানো ছিলো। আজ ২০১৫ সাল টিনের ঘর গুলো নেই, পুরো স্কুলটাই দাঁড়িয়ে আছে ইট পাথর আর সিমেন্টের ঢালীতে। আগে স্কুলের দক্ষিন পাশে ফুলের গাছগুলো লাগানো ছিলো গোলাপ, জবা, আর শিউলি গাছ ছিলো। আজ দক্ষিন পাশের গাছ গুলো উত্তর পাশে চলে এসেছে। গোলাপ, আর জবা ফুলের গাছ থাকলেও শিউলি ফুলের গাছটা নেই। কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দের গাছটাই ছিলো শিউলি, আর পছন্দের নারীর নামটাও ছিলো শিউলি। আমার এই স্কুলের সবচেয়ে পছন্দের যে ম্যাম ছিলো কাকতালীয় ভাবে তার নামটাও ছিলো শিউলী রহমান।
আমি স্কুলের আশপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছি আর বার বার অতিতে হারিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে পেছন থেকে ভারী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, আরে আজহারুল সাহেব যে, কেমন আছেন? আসলেন কখন?” পেছনে তাকিয়ে স্কুল কমিটির প্রধান সারোয়ার সাহেবকে দেখতে পেলাম, ছোট করে “কিছুক্ষন আগেই এসেছি” বলে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে গালভর্তি হাসি মুখে নিয়ে বললো, “তাহলে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন চলুন অফিস রুমে গিয়ে আলাপ করি”।
— নাহ তার দরকার হবেনা, কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়ত অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। তাছাড়া আজ প্রথম এসেছি স্কুলে একটু ঘুরে দেখি।
— প্রথম কেন হবে, আপনি তো এই স্কুলের এই ছাত্র ছিলেন আপনার সার্টিফিকেট এ তো তাই দেখলাম।
— হ্যা ছিলাম, কিন্তু সেই সময়টা পেড়িয়ে আজ অনেক বছর হলো। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ হয়ে আসতে পুরো পঁচিশ বছর লেগেছে।
অনেক কিছুই তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। একটু স্মৃতিচারণ করতে খারাপ লাগছে না।
— তাও ঠিক বলেছেন, আচ্ছা তাহলে ঘুরে দেখুন আপনি ১১ টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে হাতে বেশী সময়ও নেই। আমি ওদিক টা একটু দেখে আসি।
আমি কোন কথা বললাম না। শুধু মাথানাড়িয়ে গেলাম।
কিছুক্ষন পরেই মাইকের শব্দ ভেসে আসতে লাগলো হ্যালো মাইক টেস্টিং ১,২,৩ বলে কেউ আওয়াজ ঠিক করছে। ইতিমধ্যে ফাকামাঠ ভরে উঠতে লাগলো ছাত্রছাত্রীর চলে আসাতে।
ছাত্র ছাত্রীদের সাথে তাদের অনেক অভিভাবক ও আসতে শুরু করেছে। স্টেজে বেশ কিছু ফুলের মালা, মিষ্টির বাক্স আর কিছু ফাইল সাজানো রাখা আছে। এই ফাইলগুলোর মধ্যে সকলের এডমিট কার্ড, আর রেজিষ্ট্রেশন কার্ড রয়েছে। আমি স্টেজের আশেপাশে ঘুরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলাম। ইতিমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের
হৈহুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। চারজন পাঁচজন করে দল বেধে তারা বৈঠক করছে। কতজনের কত কথা, স্কুল জীবনে দশটি বছর তারা শেষ করে চলে যাচ্ছে স্কুল ছেড়ে। আর কবে কার সাথে দেখা হবে কেউ জানেনা। হয়ত এই দেখাই শেষ দেখা। পরীক্ষার পরে কে কোন কলেজে থাকবে সেটাইবা কে জানে। অনেকের হয়ত পড়ালেখার
গন্ডি এখানেই ইতিটেনে কর্মযোগে নেমে যাবে। হয়ত অনেক বছর পর কোন ট্রাফিকজ্যাম এ, কিংবা ফুটপাতের চায়ের দোকানে কারো সাথে দেখা হয়ে যাবে, চিনতেও হয়ত কষ্ট হবে। যদি চিনে ফেলে সর্বপ্রথম তারা মনে করবে স্কুল জীবনের কথা। আচ্ছা আমার সাথে কি রোজকার দৌড়ঝাঁপ এ কারো সাথে দেখা হয়েছিলো? না হয়নি
কিন্তু ভেবেছিলাম কোন পুরানো সখা মিলে যাক এই ব্যস্ত শহরে। গরম চায়ের লেপটে চুমুতে মজে উঠুক পুরোনো স্মৃতির এলবাম।
এরই মধ্যে স্টেজে বক্তা উঠে গেছে। কমিটির প্রধান সরোয়ার সাহেব আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। নিজের নামের শব্দ কানে আসতেই আমি রের ভুবন থেকে বাস্তব ভুবনে চলে এলাম। তড়িঘড়ি করে স্টেজের দিকে পা বাড়ালাম। এতক্ষন ছাত্রদের মাঝেই ছিলাম। তারা সাধারন অভিভাবক ভেবে তেমন ভাবে নজর দেয়নি, তারা তাদের মত দুষ্টামি করে যাচ্ছিলো। যেই আমার নাম ডাকতেই আমি হেটে যেতে লাগলাম, সবাই “আসসালামু আলাইকুম স্যার” বলে পরম শ্রদ্ধাভক্তি জানাতে লাগলো। মুখেয়ে চিলতে হাসির আবরণ খেলে গেলো আমার।
আমি স্টেজে উঠে একটি চেয়ার এ বসে রইলাম। সরোয়ার সাহেব নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে নানারকম উপদেশমূলক ভাষণ দিতে লাগলেন। এরই মধ্যে সে বলতে লাগলো “আমাদের স্কুলের নতুন প্রিন্সিপাল জনাব আজহারুল হক এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। আজকের এই শুভ সময়ে আমি আজহারুল সাহেবকে অনুরোধ করছি
ছাত্রছাত্রীদের সুন্দর একটি জীবন তৈরির শুভকামনা এবং অনুপ্রেরণার জন্য, তার জীবন সংগ্রাম এবং সাফল্যের শীর্ষে আসার কিছু কথা জানাতে।” আমি সরোয়ার সাহেবের এমন বক্তৃতা মোটেও আশা করিনি। কোন উপায় না দেখে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সকল অভিবাবক, এবং ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলাম।
খুবই ছোট ছিলাম তখন যখন আমি এই স্কুলে প্রথম আসি। ক্লাস ফাইভের ছাত্র হয়ে এই স্কুলে আমার পদার্পণ ঘটে। তখনো জীবনের মানে বুঝতাম না, এই স্কুলের সকল শিক্ষক শিক্ষিকা হাতে কলমে জীবনের অর্থ বুঝিয়েছিলেন। প্রতিটি মানুষের জীবনে এক উজ্জ্বল হাসিখেলার ইতিহাস থাকে, থাকে কিছু বেদনার ইতিহাস, কিছু থাকে
আক্ষেপের, আর সব কিছুর পরেও যে চাওয়াটা থাকে সেটা হচ্ছে অনেক বড় হওয়া। আজ এখানে যত ছাত্রছাত্রী উপস্থিত রয়েছে, সবাই এক সময় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হবে। কিন্তু জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বড়ই বিচিত্রময়, অধ্যায়গুলো কিভাবে সেজে উঠবে তা কেউ জানেনা। কিন্তু বয়স যত বাড়তে থাকবে, জীবনের অধ্যায়গুলো
এগিয়ে যেতে থাকবে, আর স্মৃতিরপাতা ভরতে থাকবে।
একটা সময় আসবে যখন মানুষের বেচে থাকার অস্তিত্ব কিছু স্মৃতি আর কিছু স্বপ্ন নিয়েই থাকে। মানুষ স্বপ্নহীন ভাবে বাচতে পারেনা, তেমনি ভাবে ভালো থাকতে পারেনা স্মৃতি ছাড়া। আজ আমি সকলকে একটি গল্প শোনাতে চাই, এই গল্পে পাঁচজন অভিনেতা ছিলো। শিউলী, নুরমোহাম্মদ, নাদিম, প্রান্ত আর আমি। আমাদের গল্পটি শুরুই হয়েছিলো এই স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে।
২
আমি যখন এই স্কুলে আসি, তখন থেকে নুরমোহাম্মাদ আমার খুব ভালো বন্ধু হয়। আর নাদিম প্রান্তর বন্ধু। চারজনের দুই দল। আমি আর নুরমোহাম্মদ, নাদিম প্রান্তকে সহ্য করতে পারতাম না। তারাও আমাদের সহ্য করতে পারতো না। আমাদের মধ্যে সব সময় কিছুনা কিছু নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকতো। আমরা যা করতাম তারাও তাই
করতো কিন্তু অবশ্যই আমাদের থেকে ভালো করতে চাইতো। আবার তারা যা করতো তা আমরা ভালো করার চেষ্টা করতাম, এ নিয়ে আমাদের দ্বন্দ্ব যেন কখনোই কমতো না। ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমাদের শত্রুতা লেগেই ছিলো। নুর মোহাম্মদ সর্বদা ক্লাসে প্রথম আসতো আর প্রান্ত দ্বিতীয় এই নিয়েই আসলে দ্বন্দ শুরু হয়। পড়ালেখার দিক দিয়ে নুরমোহাম্মদ সর্বদা এগিয়েই ছিলো এটাই যেন তারা মানতে পারতো না। কখনো হাসি, অভিমান নিয়েই এতগুলো বছর কেটে গেছে। যারা স্কুল জীবন পাড় করে আজ চলে যাচ্ছে তারা বলতে পারবে স্কুল জীবন কতটা আনন্দের আর এই আনন্দ ত্যাগ করে যাওয়া কতটা কষ্টের। স্কুল দেয়াল ডেংগিয়ে পালিয়ে যায়নি এমন ছাত্র পাওয়া যাবেনা। মিথ্যে জ্বরের বাহানা দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকে এমন ছাত্রের অভাব নেই। আমরাও স্কুল ফাকি দিতাম। এর জন্য স্যারদের হাতে বেথের মার কম খাইনি।
তারপরেও যেন সুখ ছিলো এতে আনন্দ ছিলো। নাদিম আর প্রান্ত এর সাথে আমাদের শত্রুতামি মিটে যায় ক্লাস নাইন এ এসে। তার কারন আমাদের মাঝে নতুন একটি মানুষ আসে যার নাম শিউলি। আমরা সবাই টিউশন নিতে মিঠুন মন্ডল স্যারের বাসায় যেতাম। সেখানেই টিউশন নিতে আসতো শিউলি, প্রচন্ড ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে ছিলো।
শিউলি ও অনেক বছর ধরেই আমাদের স্কুলে আছে কিন্তু মেয়েদের ক্লাস সকালে আর আমাদের ক্লাস বিকেলে হবার কারনে কখনো কথাবার্তা হয়নি মিঠুন স্যারের বাসাতে গিয়েও আমরা একজনের পিছনে আরেকজন লেগে থাকতাম, কথার উলট পালট হলে কলম ছুড়ে মারতাম একে অপর কে। আমাদের সাথে আরো অনেক ছেলেমেয়ে পড়তো কিন্তু আমরা চারজন সর্বদা চারজনের পিছনে এমন ভাবেই লেগে থাকতাম অন্য সবার দিকে নজর দেওয়ার সময় পেতাম না। একদিন কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো আমি একটি কলম ছুড়ে মারলাম নাদিমের গায়ে কিন্তু নাদিম সরে যাওয়াতে তা গিয়ে লাগলো অপর ব্যাঞ্চে বসে থাকা শিউলির গায়ে। তার গায়ে কলম লাগতেই সে রেগে গেলো, ব্যাঞ্চ থেকে বের হয়ে সে আমাদের সামনে এসে কড়া গলায় বলতে লাগলো, “তোদের চারজনকে প্রতিদিন দেখি ঝগড়া করতে তোদের সমস্যা কি বলতো? আজকের পর থেকে যদি দেখি এখানে বসে ঝগড়া করেছিস তবে একটাকেও ছাড়বো না বলে দিলাম” আমিও থেমে যাইনি পালটা জবাব দিলাম- “কি করবি তুই? আমরা ঝগড়া করবো, যা খুশি কর গ্যা।”
আমার কথা শুনে শিউলি আরো রেগে গেলো, বুঝছি তোরা এইভাবে মানবি না। এতটুকু কথাবলেই সে আর থামলো না আমাদের চারজনের ব্যাগ নিয়ে বাহিরে ছুড়ে মারলো, তা দেখে মেজাজ যেন সবার বিগরে গেলো, প্রান্ত রেগে গিয়ে বললো “শুধু মেয়ে দেখে বেচে গেলি, তানা হলে আজ তোকে দেখিয়ে দিতাম।”
শিউলি কোমরে ওড়না গুঝতে গুঝতে বললো, “কি করবি হ্যা কি করবি তোরা”। আমরা সবাই ভড়কে গেলাম ভাবতে লাগলাম এইটা মেয়ে নাকি দজ্জাল। এতদিন
তো ভেবেছিলাম শান্ত মেয়ে এতো আস্ত একটা রাক্ষুসী। আমরা আর পান কে তাল বানালাম না, ও যেভাবে রেগে উঠতেছে কখন কাকে চড় বসিয়ে দেয় ঠিক নেই, তাই চুপ হয়ে গেলাম। আর যত কিছুই হোক মেয়েদের হাতে আমরা মার খেতে রাজীনা।
সেদিনের পর থেকে শিউলির সামনে আমরা কখনো ঝগড়া করতাম না। কিন্তু এতগুলো বছর ঝগড়া হোক আর যাইহোক আমরা একজন আরেকজনের সাথে কথা না বলে থাকিনি। প্রান্ত নাদিমের সাথে কথা না বললে যেন দিনটাই বৃথা যায়। ধীরে ধীরে আমরা স্বাভাবিক কথা বলতে লাগলাম, হাসি উল্লাস করতে লাগলাম। তা দেখে শিউলি ও খুব খুশি হলো এবং আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলো। আজকাল আমরা যেই কাজই করিনা কেন পাঁচজন এক সাথে করি। আমাদের কোন কাজ শিউলিকে ছাড়া হয়না। হোক সেটা আড্ডাবাজি কিংবা পড়ালেখা শিউলিকেই চাই। শিউলিও আমাদেরকে পরম বন্ধুত্বের আবেশে এতটাই আপন করে নিয়েছিলো যে, আমাদের চারজনকে ছাড়া তার সব আয়োজন যেন বিফল হয়ে যেত। হাসি আনন্দ আর বন্ধুত্বের ভালোবাসাতে সময় ঘোড়ার মত দৌড়ে ছুটে চললো । আমাদেরও একদিন সময় আসলো বিদায়ের। শেষের বছরটা কিভাবে যে কেটে গিয়েছিলো তা বলতে পারবো না। আমার সবচেয়ে বেশী ভয় হচ্ছিলো শিউলী আর নুর মোহাম্মদ কে হারানোর, মনে মনে প্রতিজ্ঞা
করেছিলাম নুরমোহাম্মদ আর শিউলিকে হারিয়ে যেতে দিবো না কোনভাবেই। তাছাড়া শিউলির জন্য আলাদা এক অনুভুতি হতো সেই অনুভুতিকে মানুষ প্রেম ভালোবাসা
বলে। বিদায়ের অনুষ্ঠানের দিন আমি শিউলিকে একটি চিঠি দিবো ঠিক করলাম। নুরমোহাম্মাদ কে নিয়ে চিঠিও লিখেছি। বিদায় অনুষ্ঠানের পর আমি শিউলিকে ডাক দিয়ে তাকে চিঠি দিতে যাবো কিন্তু এর মধ্যে যা ঘটলো তা আসলেই কল্পনার বাহিরে। আমি চিঠি এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, শিউলি এখনো হাতে তুলে নেয়নি, সেই চিঠিটা নাদিম আমার হাত থেকে কেড়ে নিলো। তা খুলে পড়তে শুরু করলো, আমি নাদিমকে তীব্রভাবে বললাম “তুই ঐটা নিলি কেন” নাদিম আরো রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,
“ভালোই প্রতিশোধ নিছোস আমার উপর আমি শিউলিকে চিঠি দিবো জেনেই তুই আজ তাকে চিঠি দিতে এসেছিস।” আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, নাদিম আর প্রান্ত দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে শিউলি মাঝখানে। আমি তাদেরকে বললাম আমি এটা জানতাম না, তারা বিশ্বাস করলো না, বন্ধুত্ব ভেংগে দিয়ে চলে গেলো তারা, শিউলিও মাদের কথা শুনিয়ে চলে গেলো।
আমি আর নুরমোহাম্মদ ও চলে আসলাম। তারপর যেদিন এস এস সি পরীক্ষার পর নাদিমের সাথে দেখা হয়েছিলো এই স্কুল মাঠে। সে পরীক্ষায় ফেইল করেছিলো বলে সেদিনে সে আত্মহত্যা করেছিলো, আর তার আত্মহত্যার পুরো দোষ প্রান্ত দিয়েছিলো আমার কাধে। না আমি সেদিন শিউলিকে চিঠি দিতাম, না নাদিম ফেইল করতো না সে আত্মহত্যা করতো। সেদিন শিউলিও আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে চলে গেলো।
আমিও স্কুল থেকে চোখের পানির চোখে রেখেই বের হয়ে আসলাম।
৩।
জীবনের অধ্যায় সবে মাত্র শুরু হয়েছিলো। এস এস.সি এর পর বাবা কোন রকম কিছু না জানিয়েই পরপারে পারি জমান। বাবা চলে যাবার পর আমাদের পরিবারের বিকট আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হলো। পেটের দায়ে মা বাসা বাড়ির কাজ করতেও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার আরো দুই বোন ছিলো তারা দুজনেই আমার ছোট।
ভাড়াটে বাড়িতে কতদিন বিনা টাকাতে রাখবে, ঘর থেকে বের করে দিলেই যেন তারা হাফ ছেড়ে বাচে। শেষমেষ উপায় না পেয়ে মাকে বললাম, “মা আমাদের গ্রামে কি কিছুই নেই যা দিয়ে কাজ বেচে থাকা যাবে” তখন মা জানালো আমাদের কিছু সংখ্যক আবাদি জমিজমা রয়েছে কিন্তু আমি তো আর ক্ষেতখামার এর কাজ জানিনা কিভাবে কি করবো। আমি মাকে বললাম যা হবে দেখা যাবে আমি তো আছি চলো আমরা গ্রামের বাড়ি চলে যাই। হয়েছে ঢাকায় অনেক থাকা। মা কেন জানি আমার
কথায় ভরসা পেলেন আমরা লক্ষীপুর চলে আসলাম। কিভাবে কি কাজ করবো জানা নেই, ইতিমধ্যে পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার দুরসম্পর্কের এক মামা ছিলো যে
ক্ষেতিখামার করতো। তারকাছে গিয়ে তার সাথে কাজ করতে লাগলাম। তপ্ত রৌদ্রে লাঙ্গল টানা, বিছলা বোনা, ধান কাটা, ধান মাড়ানো, ইত্যাদি কাজ শিখতে লাগলাম। তারপর নিজেদের জমি জমাতে একাই সারাদিন রাত পরিশ্রম করে ফসল ফলাতে শুরু করলাম। আমাদের মোটামুটি উঠে দাড়াতে বছর দুই লেগে গেলো।
সারা বছরের চাল জমি থেকেই পেয়ে যাই, বাকি চাল বিক্রি করে বাজার সদাই করে ভালোই দিনকাল কাটছে। হাজার পরিশ্রমের মধ্যেও এই স্কুলের কথাই মনে পড়ে যেত। মনে যেত ঝগড়ার দিন মনে পড়ে যেত নাদিমের আত্মহত্যার কথা শিউলির ভুল বোঝা, নুরমোহাম্মাদ এর বন্ধুত্বের কথা। আমার মনেতে আবার পড়ালেখা করার
ইচ্ছা জেগে উঠলো। আর সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন করে শুরু করবো সব। আমাদের গ্রামের কলেজে ভর্তি হলাম, প্রতিদিন কলেজ করতাও হতোনা তাই জমিজমার কাজ
করতেও তেমন ঝামেলা হয়নি। সারাদিন জমির কাজ করে রাতে বিশ্রাম নেবার সময়টুকু পড়ালেখা করতাম। আমার মাও বসে থাকেনি, গৃহপালিত পশু, গরু, হাস মুরগী জুটিয়ে ভালো আয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। মোটামুটি ভাবে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছি আমরা। কলেজ শেষ করে আমি আমাদের গ্রামের প্রাইমারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান
পেলাম। জমিজমার কাজ এখন বদলা দিয়ে করাই, শিক্ষকতার পাশাপাশি ভার্সিটি তে অনার্স করতে লাগলাম। অনার্স শেষ করার পর লক্ষীপুর সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করলাম ১৫ বছর। এই শিক্ষকতা করেই বোনদের বিয়ে দিলাম, আর আমাকে মা বিয়ে করালো তার ভাইয়ের মেয়ের সাথে তার নাম রোকেয়া। অনেকবার ঢাকায় এসেছিলাম আমার সেই পুরোনো বন্ধুদের খুজে বের করতে কিন্তু যাকে খুজে পেয়েছিলাম তার সাথে কথা হয়নি কারন আমি আসার আগেই সে চলে গিয়েছিলো ভুবন
ছেড়ে।
নুর মোহাম্মাদ এর কথা বলছি, তাকে খুজে পাবার পর জানতে পারলাম সে এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। যখনি ঢাকায় আসতাম এই স্কুলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে চলে যেতাম। আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্তগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে স্কুল জীবন নিয়ে।
জীবন কখনো গল্পের মত সহজ হয়না। মানুষের জীবনে অভাব আসবেই বিপদ আসবেই কিন্তু তা মোকাবেলা করতে হবে। আমি যদি সেদিন অভাবের কাছে হার মেনে যেতাম তবে আজ এখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে পারতাম না।
অনেক বন্ধু পাবে জীবনে কিন্তু স্কুল জীবনে যে বন্ধু পাবে তাদের মত বন্ধু আর কোনদিন পাওয়া যাবেনা। শত বছর বেচে থাকলেও অবুঝ মন খুজে বেড়াবে স্কুল জীবনের বন্ধু বাল্যকালের ঝগড়াটে বন্ধু। জীবনে কখনো হার মানতে নেই, নাদিম যেমন ছোট একটি কারনেই হার মেনে নিয়েছিলো এমন ভুল কোনদিন কেউ করবে না। চলে যাবার মাঝে কোন বীরত্ব নেই। বেচে থেকে লড়াই করে জয়ী হবার নাম বীরত্ব। আমি আজো ভাবি হঠাৎ একদিন প্রান্ত এর সাথে দেখা হয়ে যাক, কারন ছাড়াই আরেকবার ঝগড়া হয়ে যাক। হঠাৎ কোথায় আমার ভালো লাগার প্রথম নারীর সাথে দেখা হয়ে যাক কারন ছাড়াই আর একবার অভিমান করুক। এ সব স্মৃতি থাকা প্রয়োজন জীবনে। তানা হলে জীবনটা এক ঘেয়োমি হয়ে যায়। জীবনে সব থাকা চাই, ব্যর্থতা, স্বপ্ন, বন্ধু, ছেড়ে যাবার কষ্ট। প্রতিটি জীবন অধ্যায় হয়ে থাকবে এক একটি স্মৃতিময় ইতিহাস। এসব কথা বলতে বলতে চোখের কোনে জল জমে গেছে আমার। বাম পকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখ মুছে বলতে লাগলাম, “আজ
তোমরা যারা বিদায় নিয়ে যাচ্ছো তাদের জন্য একটিই কথা জীবনে যতই ঝড় আসুক না কেন, নাদিমের মত ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না। প্রতিটি ঝরের মোকাবেলা করবে নিজ স্বপ্ন পুরনের জন্য।
অভাব আসুসুক বিপদ আসুক শুধু এগিয়েয়ে যাবে নিজ আত্মবিশ্বাস এর উপর ভিত্তি করে দেখবে জয় তোমারি হবে। কথাগুলো বলে আমি ষ্টেজ থেকে নেমে গেলাম। নেমে যাবার সময় লক্ষ করলাম সবার চোখেই জলফোটা ঝলঝল করছে।
ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার স্টেজে এসে বসলাম। এক সময় বিদায় অনুষ্ঠান শেষ হলো। আমি সবার সাথে হাত মিলিয়ে বাহিরে চলে আসলাম। পেছন থেকে একটি মহিলা ডাকদিলো “এই আজহার শোন না” একটু অবাক হলাম এই ভেবে আমাকে কে তুই করে ডাকলো পেছনে ফিরে তাকালাম। মাথায় আধপাকা চুল, চোখে বড় চশমা, চিনতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে।
আমি তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম “আমাকে বলছেন” সে মুচকি হাসি হাসলো কিন্তু চোখেতে বেদনার ছাপ চোখ ঝলঝল করছে চশমার ফাক দিয়ে কোন সময় পানি গড়িয়ে পড়বে মাটিতে। সে আবার বলতে লাগলো “তোকে নয়ত কাকে বলবো, তুই তো দেখছি কিছুই ভুলিস নাই। স্টেজে তো সেই ভাষণ দিয়ে গেলি,
বন্ধুত্বের প্রেমের, জীবন সংগ্রামের।” আমি অবাক হয়ে তাকালাম, চশমা খুলে ফেললে চুলে কালো রঙ করলেই তাকে শিউলির মত লাগবে, আমি চিনেই উল্লাসে বলতে লাগলাম “আরে শিউলি তুই” কণ্ঠস্বর একটু বেশী জোর হবার কারনে চারিদিক তাকিয়ে নিচু সরে বললাম “বুড়ি হয়ে গেছিস রে”
— আমি তো বুড়ি হইছি তুই তো ২০ বছরের জোয়ান তাইনা। গালভর্তি হাসি নিয়ে না না তা কেন হবে।
— চল তোকে প্রান্তর সাথে দেখা করাবো,
— প্রান্ত কই থাকে এখন।
— আমার সাথে
— মানে তুই প্রান্ত কে বিয়ে করেছিস।
— হ্যা। আমাদের দুইটা মেয়ে আছে বড়
মেয়ে অনার্স করতেছে আর ছোট মেয়ে এই স্কুলেই পরে। তাকেই স্কুলে দিতে এসে তোর ভাষণ শুনছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চল এখন বাসায় প্রান্ত বাসাতসি আছে থাগুলো শেষ করতেই শিউলি চোখের পানি আর
রাখতে পারেনি ধরে। গড়গড় করে ঝরে
পড়লো, চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে লাগলো “আরে আজহার ২৫ বছর কম সময় না রে, মন জানে কত বেদনা, কত স্মৃতি বুকের মধ্যে পালন করছি ২৫ বছর ধরে । আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি রে, আবার জীবন একটি সুযোগ দিবে মনের কথা প্রানখুলে বলার জন্য কল্পনাও করিনি।”
আমি দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ছেড়ে শিউলীর পাশে হাটতে লাগলাম আর মৃদু শব্দে বললাম “হ্যা রে ২৫ বছর কম সময় না” ।