শামসুন্নাহার আজ মেয়ের পড়ার টেবিল গোছানোর সময় একটা চিঠি উদ্ধার করেছেন। অমিত নামের এক ছেলে তার মেয়ে নাদিয়াকে চিঠিটা লিখেছে। শামসুন্নাহারের চোখে, চিঠির ভাষা খুবই ভয়ংকর। চিঠিটা শুরু হয়েছে এভাবে- “প্রিয়তমা সুহাসিনী, কেমন আছো? আমি ভালো নেই। তোমার হাত ধরে মধ্যরাতের মাদকতায় ভরা বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। বকুল ফুলের মালা গেথে পরিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তোমার খোপায়.. … … …”
শামসুন্নাহার রাগে কাপতে শুরু করলেন। চিঠিটা নিয়ে সোজা স্বামীর কাছে চলে গেলেন।
চিঠিটা স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, “পড়ো।”
এনামুল হক প্রশ্নভরা চোখে চিঠিটা হাতে নিলেন। পড়া শেষে বললেন, “বাহ ভালো লিখেছে তো! সাহিত্যমান সম্পন্ন চিঠি!”
শামসুন্নাহার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন, “এটা তোমার মেয়ের উদ্দেশ্যে লেখা।”
-তা তো বুঝতেই পারছি। ভালোই তো।
=ভালোই তো মানে?? আশ্চর্য!!
-মেয়ে বড় হইছে। প্রেম ভালোবাসা হতেই পারে।
=তুমি নাদিয়ার বাবা। কথা ঠিক ভাবে বলো। হতেই পারে মানে? কোথাকার কোন চোর বাটপার ছেলে… ছি ছি!
-চোর বাটপার হবে কেন? ছেলে সাহিত্য বোঝে। এই যুগে কেউ চিঠি লেখে না। কিন্তু এই ছেলে লিখেছে! মেয়ে তোমার ভাগ্যবতী!
=আশ্চর্য তো! কোনো দায়িত্ব নাই মেয়ের প্রতি?
-হাহাহা! রাগছো কেন? আমি যখন তোমাকে চিঠি দিতাম, তখন তো আনন্দে আটখানা হয়ে যেতে!
শামসুন্নাহার হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেলেন। তবে লজ্জাকে রাগে পরিনত করতে সময় লাগলো না। এই কাজটা নারী জাতি খুব ভালো পারে।
=কিসের মধ্যে কি বলো তুমি? মাথা ঠিক আছে?
-হাহাহা! নাদিয়া বাসায় ফিরলে সরাসরি কথা বলো ওর সাথে।
=হ্যা সেটাই করবো। তবু তোমার সাথে কথা বলা বৃথা। যত্তসব।
নাদিয়া ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পর মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু বুঝতে পারলো না সমস্যাটা কোথায়। অবশ্য বেশিক্ষন কৌতুহল ধরে রাখতে হলো না। শামসুন্নাহার নিজেই মেয়ের ঘরে এসে বললেন, “অমিত কে?”
নাদিয়া বিস্ফোরিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শামসুন্নাহার আবারো বললেন,
-কী বললাম শুনিস নাই?
=কোন অমিত?
-চিঠি লেখে যে।
একজন তরুনীর কাছে তার ‘গোপনীয়তা’ অনেক বড় একটা সম্পদ। সেই গোপনীয়তায় আঘাত লাগলে লাজুক তরুনীও দুঃসাহসিনী হয়ে ওঠে। নাদিয়ার ভয়টাও তাই হঠাৎ ক্ষোভের আকার ধারন করলো।
=আম্মু, তুমি আমার টেবিলে হাত দিছো কেন? অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেয়া ঠিক না।
-এইটুকু মেয়ের আবার ব্যক্তিগত জিনিস কিসের? থাপ্পোড় লাগাবো।
=এইটুকু না। অলরেডি পাঁচ ছয়টা বিয়ের প্রোপোজাল আসছে, ভুলে গেছো?
-দ্যাখ, এত কথা আমি বুঝতে চাই না। আমি এসব এলাও করবো না, ব্যস।
=আম্মু, অমিত অনেক ভালো ছেলে। বিশ্বাস করো প্লিজ…
-এই সব চিঠি লেখা ছেলে কত ভালো, তা আমার জানা আছে! ফালতু সব।
নাদিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
=আব্বুও ফালতু?
মেয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন শামসুন্নাহার। খানিকটা দুর্বল স্বরে বললেন, “মানে কী??”
মায়ের কন্ঠস্বরের এই পরিবর্তন দেখে হাসি চলে আসলো নাদিয়ার। তবে যেটুকু সম্ভব মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে বললো, “আব্বুর কাছে আমি সব গল্প শুনেছি!”
শামসুন্নাহার এবার খুব বেশি বিব্রত হলেন। বিব্রতবোধটা ঢাকতে পারলেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
,
রান্নাঘরে এসে দাড়িয়ে রইলেন শামসুন্নাহার। স্বামী আর মেয়ের কথায় তিনি অতিমাত্রায় লজ্জিত ও বিব্রত। আবেগটা লুকোতে পারছেন না। আবেগ লুকোতে না পারলে নারীরা অসহায়ের মত আচরন করে। উল্টাপাল্টা কাজও করে। এই যেমন তিনি তরকারীতে লবন না দিয়ে চিনি দিয়ে ফেললেন। ভুলটা করার পর অবশ্য মনে মনে খুশীই হলেন। ভাবলেন, বাপ মেয়ে আজ মিষ্টি তরকারীই খাক। উচিত শিক্ষা হবে।
ভাবতে ভাবতে তার মনটাও হঠাৎ খানিকটা মিষ্টি হয়ে উঠলো।
বেডরুমে যেয়ে আলমারীটা খুললেন।
আলমারীর এক গোপন জায়গা থেকে শামসুন্নাহার বের করে আনলেন একগুচ্ছ চিঠি। এনামুল নামের এক যুবক তাকে চিঠিগুলো লিখেছিলো… ব্যক্তিগত এই জিনিসগুলো কখনো কাউকে দেখতে দেননি। পরম ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন আলমারী আর হৃদয়ের গোপন কক্ষে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো শামসুন্নাহারের… চুমু খেলেন ধুসর কাগজগুলোতে…
কখন যে এনামুল হক পেছনে এসে দাড়িয়েছেন টের পাননি শামসুন্নাহার। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে এনামুল হক বললেন, “আমাদের মেয়েটা বোকা, তাই না? তোমার মত চিঠিগুলো লুকিয়ে রাখতে পারলো না। হাহাহা! খোঁজ খবর নাও। ছেলেটা ভালোই হবে মনে হয়। চিঠি লেখা ছেলেরা ভালো হয়।”
শামসুন্নাহার ভেবে দেখলেন, কথা সত্যি। চিঠি লেখা ছেলেরা আসলেই ভালো হয়। ভালো হয় বলেই তো তিনি এখন স্বামীর বাহুডোরে সুখের কান্না কাঁদছেন। এমন ভাগ্য কজনার হয়?