ঠিক এই মূহুর্তে অন্ধকারময় পরিবেশে বাসার ছাদে বসে আছি। ভেবে উঠতে পারছিনা ভূল কিছু করে ফেললাম কিনা? বাবা বারবার ফোন দিচ্ছে ভেতরে যাওয়ার জন্য।
.
দু’বছর আগের কথা।
নীলান্তি। ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে। প্রতিদিন আমার সাথে দেখা হত স্কুলে যাওয়ার পথে। আমি সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আড্ডাও হত সেখানে। মেয়েটা আমাকে দেখলেই তাকিয়ে থাকত আরচোখে। বারবার দোকানে আসত কিছুনা কিছু নিতে। আর হাসিমুখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। মাঝে মাঝে আমার চোখের দৃষ্টিটাও পড়ত ওর গভীর নয়নাতে। তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। সেই তাকিয়ে থাকার রহস্যটা কি? বোকা ছিলাম কিনা তাই।
.
প্রতিদিনই মেয়েটা স্কুলে যাওয়ার সময় এমন লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। চোখের ভাষায় অনেক কিছুই বুঝাতে চায়-‘চোখ যে মনের কথা বলে’। কিন্তু আমি তো অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র আর মেয়েটা মাত্র ক্লাস নাইন। ওসব কিছু ভাবার কোন যুক্তিই ছিলনা আমার। যুবতী মেয়েদের আবেগী মন, কখন কি চায় ওরা নিজেরাই জানেনা। বয়স সেখানে মূল্যহীন।
.
একদিন স্কুল গেইটের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ক্লাস চলছিল। হঠাৎ পেছন থেকে মেয়ে কন্ঠে আওয়াজ দিল…
–এই যে শুনোন? একটু কথা ছিল আপনার সাথে। (নীলান্তি)
পিছনে ফিরে দেখি সেই মেয়েটি। আমাকে দেখে মুচকি হাসতে লাগল আর খানিকটা ভয়ে ভীত হল। বুঝতে অসুবিধা হল না মেয়েটা আমাকেই ডাকছে। কারন ওর মুখ বলে দিচ্ছে। নীলান্তির কাছে যেতেই ও কেমন জানি থমকে গেল। আমতা আমতা করছে। আমি বললাম,
—জ্বী, বলেন!
–মানে না…. মানে….আপনাকে একটা কথা বলব।
—হুমমমমম বলুন……
আমার একটা অভ্যেস ছিল, অচেনা কাউকে বিশেষ করে মেয়েদের ছোট বা বড় হোক আপনি বলে সম্বোধন করা।
–আচ্ছা, আপনি কি কিছুই বুঝতে পারেন না? আমি কি চাই, কি বলব আপনাকে? এসব কিছুই বুঝতে পারেন না? বোকা আপনি?
এই মেয়ের পাকা পাকা কথা শুনে তো দেখি পুরোই হতবাক আমি। ভয় পাচ্ছে আবার লজ্জাও পাচ্ছে, আবার ঠাস ঠাস কথাও বলছে। কেমন জানি বেহায়াপনা!!
—আজব তো! আপনি কি বলতে চান, কি বলবেন তা আমি কি করে জানব? কি বলতে চান আপনি?
–আমি আপনাকে ভালবাসি। বিশ্বাস করেন আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবনা। আপনার জন্য আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা। ঠিকমত খেতে পারিনা, পড়াশোনা করতে পারছিনা। সত্যি বলছি আপনাকে ভালবাসি।
সত্যিই আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। এটাই বাকি ছিল। এমন ভাবে কারও মুখ থেকে কখনো প্রপোজ পাই নি। কিন্তু এই পিচ্চি মেয়ের সাহস দেখে আমি একদম হতবাক! সরাসরি প্রপোজ!! ও মাই গড!! নীলান্তি ওর মনের ভেতরের আবেগটা আর লুকিয়ে রাখতে পারল না। কি বলব ঠিক বুঝতে পারছিনা।
—আপনার নাম কি? কোন ক্লাসে পড়েন?
–নীলান্তি। ক্লাস নাইন। আপনার?
—বাহ্ আপনার না তুমিই বলি। তোমার নামটা তো অনেক সুন্দর! কে রেখেছে নামটা?
–জ্বী, আমার বাবা। আমার মায়ের নাম নীলা ছিল। আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যায়। বাবা মায়ের নামের সাথে মিল রেখে নামটা রেখেছে।
—ও আচ্ছা দুঃখিত। বুঝতে পারিনি তোমার মা নেই। ও হ্যাঁ আমি বিপ্লব, অনার্সে পড়ি। দেখো, তুমি মাত্র ক্লাস নাইনে পড়। আমি তোমার অনেক বড় হব। সো তোমার সাথে আমার এমন চিন্তা-ভাবনা নিতান্তই ভূল। আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু এই আবেগ ভূলবশত কোন খারাপ কাজ করা যাবেনা। এতএব মাথা থেকে এমন ভাবনা বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মন দেও।।
–আমি তো আপনাকে ভালবাসি।
—বললামই তো, এটা তোমার সম্পূর্ণ আবেগ। তুমি এখন সম্পূর্ণ আবেগ বশবর্তী। আর এ সময়েই মেয়েরা ভূল করে যা সারাটা জীবন তাদের ভূগতে হয়। আশা করি তুমি এই ভূলটা করবেনা। অনেক ভালো কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে শুধু সময়ের ব্যাপার। একটু ধৈর্য্য ধারন করো!!
এই কথাগুলো বলার পর নীলান্তির মায়াবী মুখখানা মূহুর্তেই মলিন হয়ে গেল। সে আশা করেছিল কোন ছেলেকে যদি মেয়েরা প্রপোজ করে তাহলে সাধারনত ফিরিয়ে দেয় না। কিন্তু এখানে তো উল্টোটা ঘটেছে। কারন ওর প্রতি আমার কোন লোভনীয় আকাঙ্খা ছিল না।
.
এরপর থেকে নীলান্তির সাথে যখনি দেখা হয় সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বলে, সে এখনো আমার মুখের দিকে তাকিয় আছে। আমি শুধু একবার বলব অমনিই ছুটে চলে আসবে। সেই দোকানের সামনে আড্ডাটা কমিয়ে দিলাম। একেবারেই নিশ্চুপ একান্ত মনের মাঝে লুকিয়ে গেলাম।
.
দেখতে দেখতে অনার্সটা শেষ করে ফেললাম। ভালো একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম। মাস্টার্স চলছে।
হঠাৎ খবর এলো নীলান্তি নামের সেই মেয়েটা বিষপানে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। বারবার আমার নাম মুখে নিচ্ছে। আমাকে না পেলে নাকি বাঁচবেনা। টেনশনে পড়ে দ্রুত মেডিকেল চলে গেলাম। আমাকে দেখার সাথে সাথেই নীলান্তির বাবা চিৎকার দিয়ে বলে ‘বাবা তুমি আমার মা মরা একমাত্র মেয়েকে বাঁচাও! আমার একমাত্র সন্তান।’
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম নীলান্তির মায়াভরা মলিন মুখখানার দিকে। নীলান্তি ঘুমাচ্ছে। সম্পূর্ণ বিষ বের করা হয়েছে। কিন্তু নীলান্তির বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে মায়াকান্না করতে লাগল। কি করব ঠিক বুঝতে পারছিনা।
.
রাত ১১টা…….
নীলান্তি একা একা বসে আছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভয় পাচ্ছে কিনা কে জানে? আর দেরি না করে ওর কাছে যাওয়াই ভালো। তার উপর বাবা বারবার ফোন দিচ্ছে….
রুমে ঢুকতেই দেখা গেল চুপিসারি হয়ে শুয়ে আছে নীলান্তি। বিয়ের শাড়িটা এখনো খুলেনি। শরীর ভর্তি গহনা, ওগুলোর ওজন বইতে পারছে কিনা? আমার আসার আওয়াজটা শুনেই উঠে বসে পড়ল। বাহ্ আজ তো অনেক সুন্দর লাগছে ওকে। নীলান্তি ঠিক ওর স্বপ্নটা পূরণ করেই নিল। আমিই তো হেরে গেলাম। সেদিন খুব উপদেশ দিয়েছিলাম তাকে। আজ কোনটাই কাজে দিবেনা। না জানি আমারই কেমন লজ্জা লাগছে!
–আপনি কি খুশি হননি? (নীলান্তি)
—কেন? খুশি হব না কেন? (বিপ্লব)
–আচ্ছা, আমি কি আপনাকে বাধ্য করেছি বিয়েটা করতে?
—হুমমমম কিছুটা। তবে আমার অনিচ্ছাসত্ত্বে হয়নি। রাজি ছিলাম বলেই হয়েছে।
–আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে অনেক বেশি ভালবাসি। তাই যতবার আপনাকে ভূলার চেষ্টা করেছি ঠিক ততবারই বেশি বেশি মনে পড়ে যায়। কি করব বলুন, বাধ্য হয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনাকে না পেলে আর কাউকে দরকার নেই।
—তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলে? সবার স্বপ্নই কি পূরণ হয়? সবাই তো সবার ভালবাসা পায় না। তাহলে তুমি কেন এমন পাগলামী করতে চেয়েছিলে?
–আচ্ছা বলুন তো, আমি যদি এই পাগলামীটা না করতাম তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করতেন??
—আর যদি তুমি মরে যেতে তো কাকে বিয়ে করতাম?
–আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম। আপনাকে না পেলে মরে যাওয়াই ভালো।।
—ধুরররররর, পাগলী। আমার পিচ্চি পাগলী। আসো আমার বুকে আসো!!!
.
একদম হাসিমুখে নির্ধিধায় ঝাপটিয়ে জড়িয়ে ধরল নীলান্তি। ও যেন এক নতুন জীবন পেল। এখানে আমার কিচ্ছু করার নেই। মেরে ফেলার চেয়ে বিয়ে করে একজন মানুষকে বাঁচাতে পারলাম তো।।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক