অনুপমা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, “তাহলে এই তোমার শেষ কথা?” রাফি বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো, “হ্যাঁ।” হঠাৎ অনুপমার মনে হলো তার দু’চোখ জলে টলমল করছে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল সে।তারপর জিজ্ঞেস করলো, “এতদিন তাহলে ভালোবাসার অভিনয় করেছো তুমি?” রাফি এই প্রশ্ন আশা করে নি।উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ কোথায় যেন সে থমকে গেল।তারপর কিছু সময় নিয়ে সে শুরু করলো, “দেখো,অনু।কোনো রাফিকে থামিয়ে অনুপমা হঠাৎ বলে উঠলো, “আমার নাম অনুপমা,অনু নয়।” রাফি মুচকি হেসে আবার শুরু করলো – ” কোনো একটি জিনিশের প্রতি তোমার ততক্ষণই ঝোঁক থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি সেটিকে অর্জন করে নিচ্ছো!একবার অর্জন করা হয়ে গেলেই সেই জিনিশটির উপর থেকে তোমার সব ঝোঁক চলে যেতে বাধ্য।”
অনুপমা এবার উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে আমার প্রতি তোমার একটা ঝোঁক ছিল,ভালোবাসা নয়?” রাফি তার মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে বললো, ” ঝোঁক বা ভালোবাসা না বলে এটাকে আমি মুগ্ধতা বলি,অনু…ও সরি,অনুপমা।তোমার সব কিছুর প্রতি আমার একটা মুগ্ধতা ছিল।” অনুপমা আরও ব্যাকুল কন্ঠে বললো, “তাহলে কেন বারবার বলতে তুমি আমায় ভালোবাসো?” রাফি সহজ গলায় বললো, “কারণ মুগ্ধতা থেকে ভালোবাসার সৃষ্টি!” অনুপমা আর কোনো প্রশ্ন করলো না।রাফির চোখে চোখ রেখে শুধু বললো, “একবার আমার চোখে চোখ রেখে ‘ভালোবাসি’ বলবে কি?” রাফি একটু ইতস্তত করতে লাগলো।
অনুপমা এবার তার ডান হাতটা দিয়ে রাফির বাম হাতটা ধরে মুচকি হাসলো।তারপর বললো, “মিথ্যে করে হলেও একবার বলে দাও।” রাফি একবার কফির মগে চুমুক দিলো।তারপর বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পরিষ্কার গলায় বললো, “ভালোবাসি তোমায় কথাটা বলার সাথে সাথে রাফি স্পষ্ট লক্ষ্য করলো অনুপমার লোম গুলো যেন সহসা খাড়া হয়ে যাচ্ছে। অনুপমা নিজের হাতটা রাফির হাত থেকে সরালো না।তারপর দু’চোখ বন্ধ করে মৃদ্যু গলায় বললো, “আমার মৃত্যুর পরেও যেন আমাকে তোমার এই হাতের স্পর্শ না পেতে হয় – এটাই ঈশ্বরের কাছে আমি প্রার্থনা করছি।”পাঁচ দিন পর- সন্ধ্যায় নিজের অন্ধকার রুমে বসে ফেইসবুকে নিউজফিড স্ক্রলিং করছিল অনুপমা।
১৩ মিনিট আগে পোস্ট করা রাফির একটা স্টেটাসে চোখ আটকে গেল তার। রাফি লিখেছে- ‘হঠাৎ হঠাৎ দেখছি তার ছায়া, কেন যেন কাটছে না তার মায়া!’ অনুপমা লাইন দু’টিকে বেশ কয়েকবার পড়লো।তারপর মোবাইল অফ করে মুগ্ধ কন্ঠে বারবার লাইন দু’টিকে উচ্চারণ করতে থাকলো। ছেলেটার কাছে যে অনুভূতিটা ছিল কেবলই মুগ্ধতা,মেয়েটা সেই অনুভূতিকেই হয়তো ভালোবাসা বলে পুষে রাখবে অন্তরের গহীনে।হয়তো জীবনের বাকি পথটুকু চলার রসদ হিসেবে পই-পই করে খরচ হবে পুষে রাখা ভালোবাসাটুকু।কে জানে..
পাঁচ বছর পর-
রাফি এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সৈনিক।বাংলাদেশের উপর কোনো সমস্যা আসলেই বাংলাদেশের ঢাল হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।সারা বিশ্বসহ বাংলাদেশও এখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।তাই করোনা ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।তাই রাফির এখন বেশ ব্যস্ততায় দিন কাটছে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে হ্যান্ড-মাইক দিয়ে মাইকিং করা,ঘর থেক বেরিয়ে আসা জনগণদের সাথে কথা বলে তাদের সচেতন করা,নাগরিকদের বাসায় গিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার-মাস্ক-গ্লাভস বিতরণ করা।তাছাড়া আছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তাদেরকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে গিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় এবং অবশ্যই সম্পূর্ণ ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন বা দাহ করা। উপরের নির্দেশ অনুযায়ী আজকে ২০ জনের একটি সেনাদলকে ১০ জন করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে কবর দিতে হবে আর ১ জন মহিলা ডাক্তারকে করতে হবে দাহ।সেই ২০ জন সেনাদলের একজন রাফি।
হাসপাতাল থেকে লাশগুলো উঠিয়েই প্রথমে কবরস্থানে কবর খুঁড়ে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে কবর দেওয়া হলো ১০ টি লাশ। মহিলা ডাক্তারের লাশটি থেকে যাওয়ায় বাকি ১৮ জন সেনাকে পাঠিয়ে দিয়ে রাফি আর এক নারী সেনা অফিসার শশ্মানের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। শ্মশানে পৌছেই একটি চন্ডাল ও ওই সেনা অফিসার মিলে ডাক্তারের লাশটিকে সকল ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করে লাকড়ির চুল্লিতে উঠিয়ে দিল। এদিকে শ্মশানের বাইরে দাঁড়িয়ে রাফি অপেক্ষা করছে।
সেনা অফিসারটি ফিরে এসে বললেন, “জানো রাফি,মিস অনুপমার মতো ডাক্তারদের আমাদের দেশে খুব প্রয়োজন। পি.পি.ই ছাড়া যখন কোনো ডাক্তারই করোনা রোগীদের কাছে যেতে চাইছিলেন না তখন ইনিই ওই রোগীদের চিকিৎসা করেন।আর তিন দিন পরে তার দেহে ধরা পড়ে করোনা ভাইরাস।আর শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান তিনি!” অনুপমার সাথে রাফির যখন শেষ দেখা হয় অনুপমা তখন ডাক্তারি পড়ছিল।তাই মহিলা অফিসারের কাছে অনুপমার নাম শুনেই রাফি চমকে ওঠে।সে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডাম,ডাক্তারটির পুরো নাম কি?”
অফিসারটি বললেন, ” অনুপমা চৌধুরী।” নামটা শুনেই রাফি দৌড়ে শ্মশানে ঢুকল।ঢুকেই দেখতে পেল সদ্য আগুন দেওয়া লাকড়ির চুল্লিটি দাউ-দাউ করে জ্বলছে।আস্তে আস্তে আগুনের গ্রাসে চলে যাচ্ছে দেহটি।রাফির হঠাৎ মনে পড়লো অনুপমার সেই শেষ কথাটি- ‘আমার মৃত্যুর পরেও যেন আমাকে তোমার এই হাতের স্পর্শ না পেতে হয় – এটাই ঈশ্বরের কাছে আমি প্রার্থনা করছি।’
হঠাৎ রাফির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো – ‘তোমার প্রার্থনা গ্রহণ করেছে সে।মৃত্যুর পরেও আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি নি।’ কিন্তু রাফির মুখ দিয়ে দুইটি শব্দ ফুটলো মাত্র- ‘ভালোবাসি তোমায় রাফির খুব জানতে ইচ্ছা করলো চিতার আগুনে জ্বলতে থাকা দেহটির গাঁয়ের লোমগুলো কি সেদিনের মতো খাঁড়া হয়েছে?নাকি দেহটির হৃদয়ে যাওয়ার আগেই চিতার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে ভালোবাসার স্পর্শটুকুও! রাফি যখন এসব কথা ভাবছে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারটি হ্যান্ড মাইক দিয়ে বলছে- “ঘরে থেকে থাকুন সুস্থ,দেশকে রাখুন করোনা মুক্ত।