মে কাব্য তারারা লিখে

মে কাব্য তারারা লিখে

রাত দুইটা ষোল মিনিট। ভাঙ্গা থালার মতো চাঁদটা দক্ষিণ পূর্ব কোণে হেলে আছে।আর একটা পাতাঝরা মেহগনি গাছের নিচে বসে আমি সাত নাম্বার সিগারেট শেষ করার পরিকল্পনা করছি।শেষ সিগারেটটা ধরাবো কিনা এটা নিয়ে গভীর ধ্যান করতে করতে অবশেষে ধরিয়েই ফেললাম।

সাজি একটু পর পর জানালার পর্দা সরিয়ে আমাকে দেখছে আর রাগে কটমট করছে। আমি ধৈর্যের পরীক্ষায় নেপোলিয়নকে হার মানিয়ে টানা সাড়ে চার ঘন্টা যাবত বসে আছি।

সাজি রেগে থাকলেও আমার আচরণে হতবাক।সপ্তাহ খানেক আগে থেকে মেয়েটা আমাকে দেখা করতে বললেও আমি একদিনও দেখা করিনি। প্রাচীন যুগ এবং আধুনিক যুগের যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম ব্যবহার করেও আমার সাথে যোগাযোগ করতে সে ব্যর্থ হয়েছে।সাড়ে চার ঘন্টা ধরে বসে থাকার ছেলে আমি না এটা সাজি ভালো করেই জানে। তাই সে উৎসুক চোখে একটু পর পর দেখছে দুতালার বেলকনিত থেকে।আর তার বাসার গেটের কুকুরটা দিগুন উৎসুক চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি সিগারেটটা কুকুরের পায়ের কাছে ঢেল দিলাম। কুকুর টা ভয় পেয়ে ঘেও করে উঠল। হঠাৎ করে আমাকে দেখে দারোয়ান চমকে উঠলো। কিন্তু ভড়কিলো না।

-এই ছেলে এখানে কী?
-কোনখানে?
-এই যে এই বাসার সামনে?
-বাসার সামনে তো অনেক কিছুই আছে কয়ডা কমু।আমগাছ, ভাঙ্গা কিছু ইট আছে;মনে হয় এগুলা দুই নাম্বার ইট, তারপর আছে…
-ঐ চুপ বেয়াদব আমি এইডা জিগায়ছি?
রেগে গিয়ে দারোয়ান এর মুখটা দেখার মতো হয়ছে।একে আরেকটু রাগিয়ে দেখি কী হয়
-তো কোনডা জিগায়ছেন চাচা?
-তোমার এত রাতে এইখানে কী কাজ?
-আপনার কী কাজ?
-আমি এই বাসার দারোয়ান।
-আমিও এই বাসার নতুন দারোয়ান।

দারোয়ান আমার উত্তর শুনে এবার সত্যিই ভড়কে গেল।যাক ব্যাটাকে ভড়কাতে পেরেছি।

দারোয়ান আর কিছু না বলে চলে গেল।
সাজি এতক্ষণ ধরে আমার কথা শুনছিল। পারলে সে দুতালার বেলকনি থেকেই আমাকে ছিড়ে খাবে।যাক এক ঢিলে দুই পাখি মরেছে। সাজি এখন নিচে নামবে এবং আমার সাথে কথা বলবে এটা নিশ্চিত।

সাজি প্রায় দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নামছে। রাতের গভীরতার সাথে মেয়েদের সৌন্দর্য সমানুপাতিক হারে বেড়ে যায়। সাজির ক্ষেত্রে এটা বর্গের সমানুপাতিক । বসন্তের দমকা হাওয়ায় সাজির চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে কিছু চুল মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। মেয়েটা আজও নোলক পরেছে। হালকা সবুজ রঙের শাড়িতে ঠিক অপ্সরার মতো লাগছে। আধো আলো আধো অন্ধকারের মাঝেও তার রাগে লাল গালটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। আমার মন চাইছে .. হঠাৎ প্রশ্নে ভাবনায় ছেদ পড়ল
-তর সমস্যা কী কুত্তা?
-আমি দুই পায়ে হাঁটি।
-তো?
-আমি খাবার হাত দিয়ে তুলে খাই।
-তো?
-সুতরাং আমি কুত্তা না। তুমি এটা বলতে পারো না।
-তুই কুত্তার চাইতে কোন অংশে কম না।
তুই আমার বাসার সামনে দাঁড়ায় আছিস কেন?
-সরকারি রাস্তায় আমি দাঁড়ায় আছি।এখন রাস্তার সামনে কার বাড়ি সেটা তো আমি জানি না।
-তুই জানস কোন টা?
-তোমার প্রেমে আমি আবার নতুন করে পড়লাম এটা জানলাম এই মাত্র।
-শুয়োর..
-আমার সামনে যে বসন্তকন্যা দাঁড়িয়ে আছে তাকে ছাড়া সম্ভব না এটা জানি।
-আর?
-এইমাত্র তোমার রাগ ভেঙে গেল এটা জানলাম। সাজি হেসে ফেললো। রাগের সূত্রপাত কিভাবে হলো সেটাই তো বলিনি।

টানা তিন ধরে সাজি বলছে শপিং এ নিয়ে যেতে। এদিকে আমার কাছে একটা ছেড়া বিশ টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। এদিকে রুমমেট কাওসার ভাই টাকা চাচ্ছেন রুমভাড়া দেওয়ার জন্য। টাকার কথা উঠলে ওনাকে ফজল ভাইয়ের দোকানে নিয়ে আমি গল্প শুরু করি।শেষে একচাপ রঙ চা আর সিগারেট নিয়ে ভাইকে বলি ভাই বিলটা দিয়েন। বেচারা তখন এমন ভাবে তাকায় আর মনে মনে হয়তো আমার চৌদ্দ পুরুষকে গালিগালাজ করে। আমি আমার বিখ্যাত হাসি দিয়ে তখন কেটে পড়ি।তাই আজকাল ওনি আমাকে ঘাটেন না।আর আমি এই মেস থেকে ঐ মেসে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর গেস্ট মিল খাচ্ছি।দিনে একবার খেতে পারলেই যথেষ্ট যদি সেটা ফ্রি হয়।এটাও বেশি দিন চলবে না কারণ সব মেস ম্যানেজার অলরেডি আমাকে চিনে ফেলেছে।এখন গেটের দরজায় দেখলেই সন্দেহের চোখে তাকায় ।এই বুঝি গেস্ট মিল খেতে এসেছি।

এই অবস্থায় কাউকে শপিং এ নিয়ে যাওয়ার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। কিন্তু সাজি বারবার বলছে যেতেই হবে। আমি পকেটে ছেড়া বিশটাকা নিয়েই
তাদের সঙ্গী হলাম। তাদের বলছি কারণ গিয়ে দেখি সাজির ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া ছোটবোন টাও আছে। আমি রিল্যাক্স মুডে তাদের সাথে ইনফিনিটি মেগা মলে ঢুকলাম।সাড়ে তিনঘন্টার শপিং শেষে দুই জন সারারা,গাউন,ফ্রক,ওয়ানপিস,ফ্লোরটাস নিছে।
আর তারপরেও আবার কুর্তি দেখতেছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি বের হয়ে আসার চিন্তা করলাম। কারণ এতগুলা শপিংয়ের প্রাইস দিতে গেলে আমার জমি বিক্রি করা লাগবে। সাজিকে বললাম আমি ওয়াশরুম থেকে আসতেছি।

বলেই ধীরে ধীরে জাস্ট শপিং মলের গেটটা ক্রস করছি। তারপর দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার বেগে এক দৌড়ে লাপাত্তা। মোবাইল ফোন অফ‌। তারপর দশ বারো দিন পর আজ সাজির সাথে দেখা করতে আসছি।
-তুমি আমারে বলতে পারতা যে তুমার কাছে টাকা নাই?
-বলছি তো
-মিথ্যা কথা বলবি না। কবে বলছস?
-সব বলতে হয় নাকি?পরে ঐ দিন কী করছিলা?
-কী আর করবো বাবাকে ফোন দিয়ে টাকা পাঠাতে বলছি।
রাতে খাইছিস?
-তুমি করে বললে কিন্তু অনেক সুন্দর শোনা যায়….
-তুমি শোনার যোগ্যতা তর নাই
-হতে পারে
-অমন করে তাকায় আছিস কেন আমারে দেখিস নাই জীবনে?
-ক্ষুধা লাগছে
-হোটেলে যাহ
-হোটেলে গেলে এই ক্ষুধা মিটবে না মেয়ে।
-শয়তান
সাজি আবারো হেসে ফেললো । তারমানে গ্রীন সিগন্যাল। আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরেই ঠোঁট চারটা এক করে দিলাম। সাজি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। আমি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলাম।
তার সুগন্ধি চলের গন্ধ আর ফাগুনের বাতাস মিলে এক অপার্থিব অনুভুতিতে হারিয়ে গেলাম।
দুই মিনিট পর সাজি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
-কী ছিল এটা?
-ভালবাসা
-হারামী
-শুধু তুমিই বলো
-শুধু আমিই বলতে চাই।
-অনুমতি দেওয়া হলো
-না দিলেও আদায় করে নিব।

আমি আবার সাজির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। আমি জানি এখন আমি যা চাইবো তাই পাবো। শেষ রাতে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া কোন তরুণীর আবেদনময়ী সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য সবার হয়না ।এ সৌন্দর্য স্পর্শ না করে উপভোগ করতে হয়। কিন্তু আমার উপভোগ গেটের সামনে থাকা কুকুরটার সহ্য হচ্ছে না মনে হলো।

শেয়ালের বাচ্চা কুত্তা ঘেউ ঘেউ শুরু করলো।
উপর থেকে হঠাৎ সাজির বাবার গলা শুনা গেল।
-এইইইই দেখতো নিচে কেএএএ??
সাজি তার সবুজ শাড়ীর আঁচল গুটিয়ে এক দৌড়ে উপরে উঠে গেল।যেন চোখের সামনে কোন রাতপরীর দৌড় দেখলাম।
আমিও দৌড়ে বাড়ির আড়ালে চলে এলাম।
কিছু দৌড় ভালবাসার। কিছু সময় দুদিকে যাওয়া একদিকে যাওয়ার প্রস্তুতি।
এটা শুধু শেষ রাতের তারারা বুঝতে পারে। অন্য কেউ পারে না। চেষ্টাও করে না।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত