ঘরটা স্যাতস্যাতে। পা দিতেই হালকা পায়ের পাতা ভিজে গেলো। একটা মুশরি টাঙ্গানো ছোট খাঁটটাতে। লক্ষ করলাম কয়েকটা ছোট ছোট ফুটা।
দেওয়াল টা টিনের। অন্ধকার দুর করতে নীলু একটা বাতি ধরালো। মাথার উপরে তাকাতেই লক্ষ করলাম টিনের বুকে কয়েকটা ফুটো। পানি ধরার জন্য ছোট ছোট পাত্র রাখা আছে মেঝেতে। নীলু তারাতারি আমাকে বসার জন্য কাঠের একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। কোন কথা না বলেই বসলাম।
জানি নীলু কিছু না ছোট মনে করছে নিজেকে।
– বাহ্ খুব সুন্দর তো ঘরটা আসলে শহরে থাকে কখনো গ্রামের এই পরিবেশে আসাই হয় নি। আচ্ছা আগে কেন আনো নি আমাকে?
নীলু আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকালো আর আমি একটা হাসি দিলাম।
– আপনার ভালো লাগেছে আমার ঘর?
– ভালো মানে খুব ভালো তবে একটু আলো হলে আরও বেশি ভালো করে দেখতে পেতাম।
– আচ্ছা আমি পাশের বাসা থেকে বড় লাইট আনছি।
– আর না না ঘর না আমার বউয়ের মুখটা আরও ভালো করে দেখতে পেতাম।
নীলু আমার মুখে বউ শব্দটা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে যা অন্ধকারেও বুঝতে বাকি রইলো না।
আমি কিছু বলতে যাবো তখনি বাতিটা মুখের কাছে ধরে নিচের দিকে তাকালো সম্ভবত লজ্জায়।
– এটা কি হলো? আমি আমার বউয়ের মুখ দেখতে চাইছি কিন্তু বউটা মাটির দিকে তাকিয়ে কেন? আমার দিকে তাকাও।
আমার কথা শুনে আস্তে আস্তে আমার মুখের দিকে তাকালো।
– বাহ্ আগে তো এমন সুন্দর মুখটার দিকে তাকানোই হয় নি।
– কেন আগে বুঝি দেখেন নি?
– নাহ্ দেখেছি কিন্তু এই বাতির আলোতে তো দেখিনি।
– আপনি থাকেন আমি আসছি। বলেই দৌড়ে পালালো।
এই হলো নীলু।
আমাদের বাসাতে করিম চাচা নিয়ে গিয়েছিলো একটা কাজের জন্য।
করিম চাচা আমাদের পুরোনো কাজের লোক।
নীলুকে দেখেই মা বলেছিলো,
– কি রে এটা কে?
– এটা আমার বোনের মেয়ে একটা কাজ যদি দিতেন খুব ভালো হতো।
– এতো সুন্দর একটা মেয়ে কাজ করবে?
– কি করবো বলেন গরীবের মেয়ে কাজ না করলে খাবে কি?
– হুমমমম আমাদের বাসাতেই রেখে দে। কিন্তু বাবা মা কি করে?
– মা গ্রামে মানুষের বাসাতে কাজ করে আর বাবা আগেই মারা গেছি।
– বিয়ে হয়েছে মেয়েটার?
– নাহ্ বিয়ে হয় নি তবে অনেকেই ঘর আনতো টাকার জন্য দিতে পারে নি।
– কি বলিস এতো সুন্দর মেয়েকে বিয়ে দিতেও টাকা লাগবে?
– কি করবো বলেন গরীবের ঘরে কে বিয়ে দিবে?
– লেখাপড়া জানে?
– হুমমমম মায়ে মানুষের বাসায় কাজ করে স্কুলটা পাশ করিয়েছে কিন্তু কলেজে আর পড়া হলো না।
মা করিম চাচার কথা শুনে নীলুর কাছে গেলো।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– মা, তোমার পড়তে মন চায় না?
– কি বলেন ওরে কে পড়াবে তার চেয়ে একটা কাজ দেন (করিম চাচা)
– তুই বেশি কথা বলবি না
করিম চাচার দিকে তাকিয়ে বললো। তারপর আবার নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি মা পড়তে মন চায় না?
নীলু মাথা নাড়িয়ে হ্যা সুচক উওর দিলো।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– নীল শোন তোমাদের কলেজের ভর্তির শেষ তারিখ কবে রে?
– মা ৮ তারিখ কেন?
– হুমমমম এখানো সময় আছে কালকে ওকে ভর্তি করিয়ে দিবি।
– আচ্ছা।
– আমার তো মেয়ে নেই একে খুব মনে ভরেছে রেখে দিবো আমার কাছে।
– কিন্তু লোকে কি বলবে? (করিম চাচা)
– দরকার হলে লোকের মুখ বন্ধ করতে চা করতে হয় তাই করবো।
– মানে? (করিম চাচা)
– তোর এতো বুঝতে হবে না।
কলেজে নিয়ে যাওয়ার আগে ওকে কিছু জামা কাপড় কিনে দিলাম।
মেয়েটা এক কাপড়ে এসেছে।
কলেজে নিয়ে যেতেই বন্ধুরা ঘিরে ধরলো।
– কিরে এটা কে? তোর বউ নাকি? (সামি)
সামির মুখে বউ শব্দটা শুনে নীলু মাথা নিচু করলো।
– কেন বউ হলে সমস্যা? (রিমু)
– নাহ্ কিন্তু আমাদের না জানিয়ে এটা করলো? (সজীব)
– ধুর থামবি তোরা? একে ভর্তি করাতে হবে তারাতারি চল।(আমি)
– ধুর এটা কোন ব্যাপার প্রিন্সিপালকে আমি দেখবো চল আমার সাথে (সেতু)
ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
– হুমমম তুই তো সবই দেখিস বিশেষ করে মেয়েদের বিষয়ে। (রিমু)
– ভাই হাত জোর করছি আগে কাজটা তো করি নাকি?
– হুমমমম কিন্তু কাগজ পত্র আনছে? (সেতু)
– নাহ্ এখন ভর্তি করাই পরে দেখবো বাকিটা না হয় পরে সব দিয়ে দিবো তোর মামাকে কেন কেরানি বানালাম এই কাজ যদি না করতে পারে তো?
সামির উদ্দেশ্য করে কথাটা বললাম।
ভর্তি হলো।
ক্লাশ করছে প্রতিদিন ওকে নিয়ে কলেজে যাওয়া থেকে শুরু করে সব দ্বায়িত্ব পড়লো আমার উপর।
নীলুর একটা স্বভাব লক্ষ করতাম সেটা হলো বেশি কথা বলা।
কিন্তু সাহস পেতো না।
– একি এই দিকে তো কলেজ না একদিকে যাচ্ছেন কেন?
– আজকে ক্লাশ করবো না তো আজকে তোমাকে একটা জায়গাই নিয়ে যাবো।
শুনে বেশ খুশি হলো।
– জানেন আগে যখন গ্রামে পড়তাম তখন যে কত ক্লাশ ফাকি দিয়ে………..
চলছে ননস্টপ কথা মনে হয় একবছরের কথা একদিনে বলছে।
ছোট থেকে আজ পযর্ন্ত যা যা হইছে বাইকের পিছনে বসে সব বলতে শুরু করলো।
– জানেন একটা ছেলে না প্রতিদিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
– প্রেম করছিলে?
– নাহ্ বেটা লুইচ্চা ছিলো। সবার সাথেই এমন করতো।
– কখনো প্রেম করেছো?
– আরে না না মা জানতে পারলে পাশের পাড়ার ওই গুন্ডা ছেলেটা সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো।
– কেন করতে বিয়ে।
– নাহ্ নাহ্ ওই পোলা তো আগে দুইটা বউ ছাড়ছে।
– ও তো বিয়ে দিতো কেন?
– ওই যে মা যে ওদের কাছ থেকে টাকা ধার আনতো। তাই তো পোলাডা আমার মা কে বলেছিলো টাকা শোধ দিতে হবে না আমাকে যেন দিয়ে দেয়। তাই কোন ভুল করলে মা আমাকে বয় দেখাতো।
ওর কথা শুনে হাসতে লাগলাম।
সারাদিন বকবক করতে করতেই কাটিয়ে দিলো।
সন্ধ্যায় বাসায় আসতেই মা তার রুমে ডেকে পাঠালো।
– মা কিছু বলবে?
বুঝলাম মায়ের মুখটা খুব গম্ভীর।
– মা কিছু হইছে?
– শোন বাবা গ্রাম থেকে নীলুর মা এসেছিলো পাশের পাড়ার মোড়ল নাকি টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে আর টাকা না দিতে পারলে বলছে নীলুকে যেন তাদের কে দিয়ে দেয়।
– তুমি কিছু টাকা দিতে।
– হুমমমমম দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিবে না সে নাকি মোড়লের কথায় রাজি হবে।
– তুমি কি করবে?
– দেখ বাবা মেয়েটাকে আমার খুব মনে ধরেছে যদি তুই ওকে বিয়ে করিস সেই সুযোগে যদি ওর মাকে টাকা দিয়ে মোড়লের টাকাটা শোধ করতে পারি তাইলে খুব ভালো হয়।
– মা…….
কথা শেষ না করতেই মা বললো।
– দেখ বাবা তোকে জোর করবো না এমনি জানতে চাইছি।
– নাহ্ মা তুমি যদি তাই মনে করো তাইলে আমার আপত্তি নেই।
-আর আমি জানি তোদের খুব ভাব হয়েছে ক্লাশ ফাকিও তো দিস।
এই রে মা জানলো কেমনে? সেতুর কাজ এটা।
– তুমি নীলুর সাথে কথা বলো যদি রাজি হয়।
– সে আমি শুনে নিয়েছি ওর কোন আপত্তি নেই।
তোর মত জানার বাকি ছিলো।আর লোকে তো নানান কথা বলেই তাই এটাই করা ঠিক বলে মনে করি মেয়েটাও আমার ঘরে থাকবে।
বিয়েটা হয়ে গেলো।
আজ এসেছি মোড়লের টাকা দিতে।
একটু পড়েই নীলু আসলো সাথে আমার শাশুরি মাও।
উঠেই সালাম করলাম।
খেয়ে দেয়ে নীলুকে বললাম,
– আমাকে তোমার গ্রাম ঘুরে দেখাবে?
– আপনি যাবেন?
– হুমমমম যাবো তবে…..
– তবে কি?
– পুরোটা গ্রাম আমার হাত ধরে হাটতে হবে।
– সে দেখা যাবে চলেন।
হাটছি ওর হাত ধরা সাহস হচ্ছিলো না বার বার ওর দিকে তাকাতেই হয় তো বুঝে নিয়েছিলো।
আমার হাতটা ধরলো। আমিও কম কিসে? শক্ত করে ধরলাম। ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম খুব লজ্জা পাচ্ছে।
সে পাক হাত ছাড়ছি না হু।
সামনেই চোখে পড়লো একটা গাছ।
গাছে কিছু ফল ঝুলছে।
– নীলু ওই গুলো কি ফল?
– হি হি হি এই গুলো চিনেন না? এইগুলো তো গাব। খান নি কোন দিন?
– না তো।
– দাড়ান
বলেই হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কাঠবিড়ালির মত গাছে উঠে গেলো।
– এই কি করছো পড়ে যাবে তো।
– হি হি আমি পড়বো? আমার এইসবে অভ্যাস আছে আমার মত গাছে কেউ উঠতে পারে না হি হি হি হি।
বেশ কিছু ফল নিয়ে আসলো।
– এরে বাবা এতো গুলো কে খাবে?
– কেন মা খাবে সেও তো খাই নি কোন দিন।
– ও তাই তো কিন্তু মাকে কি বলবো যে তোমার বউমা কাঠবিড়ালি? হি হি হি
– মেরে দাত ফেলে দিবো এই কথা বললে।
যতই হাটছি ওর চন্ঞলতা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বুঝলাম সত্যিই একটা পাগলি।
– তোমার গ্রাম খুব ভালো লাগে?
– খুব ভালো লাগে।
– তাইলে প্রতিমাসে একবার করে নিয়ে আসবো।
বুঝলাম খুশি না
– আচ্ছা মাসে না প্রতিশুক্রবার নিয়ে আসবো তবে এই কথা মাকে বলবে না কিন্তু।
শোনেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে উম্মম্মম্ম্মমমা।
একটু পর ছাড়িয়ে নিলো বুঝলাম খুব লজ্জ পাইছে।
ওর লজ্জা মাখা মুখ দেখে আরও হাসি পেলো।
গ্রামের পুকুরে এসেই বললো,
– চলেন নামবো।
– এই কি বলো আমি তো সাতার জানি না।
– হি হি হি আমি টেনে তুলবো।
বলেই হাত ধরে টেনে নামালো। ভাগ্য ভালো সাথে কিছু নেই তাইলে সব গুলো গোসল হয়ে যেতো।
বাড়ি আসলাম ভিজা কাপড়ে।
– নীলু তোরা ভিজা কেন?
– হি হি হি তোমার জামাইকে পানিতে চুবাইছি।
– এখন যদি জ্বর হয়?
– আমি আছি কেন হু? হি হি হি।
হাছছো এই রে ধরে গেলো।
নীলু পাশে বসে আছে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে।
বুঝলাম ওর মনটা খারাপ।
– কি মন খারাপ?
– হবে না আবার তো নাচবো হু? আমার জন্যই তো আপনার এমন হলো।
– আমার বউ থাকতে তো কিছুই হবে নি জানি।
পট্টি দেওয়া বাদে আমাকে বুকে মাথা রাখলো।
ফুফাচ্ছে মনে হলো কাদছে।
– কি কাঠবিড়ালি কাদছো কেন?
– আমার কাঠবিড়াল টা যে অসুস্থ তাই।
কাদার মাঝেও হেসে দিলো।
– এই আমি কাঠবিড়াল? চলো শহরে।
-কেন কি করবেন?
– মাকে বলে দিবো।
– ও তাই না চলেন আবার পানিতে চুবামু। হি হি
ওকে শক্ত করে ধরলাম।
নীলুর কম না বেশ শক্ত করে ধরলো।
– এই এই এতো জোরে কেন দম আটকে মরবো তো।
– মেরে দাত ফেলবো এমন কথা বললে।
বলেই আরও খানিকটা জোরে ধরলো।
থাকনা পাগলিটা আমার বুকে ভালোই তো লাগছে।
রাতের চাঁদের আলোটা টিনের ফুটো দিয়ে আসছে। ভালোবাসার নীড়টা বেশ আলোময় হয়ে আছে চাঁদ আর বাতির আলোতে আর বুকে আমার পাগলিটা।
ভালোবাসতে এর থেকে বেশি কিছুই চাই না।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক