হ্যাঁ, তোমার ঝর্ণা আপার সঙ্গে দেখা হলো। আগের চেয়ে অনেক ভাল দেখলাম তাকে। বিশ্বাস করবে, গত এক মাস ধরে চশমাটাও আর তাকে পরতে হচ্ছে না। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
ইস, কি ভাল যে লাগছে আমার! অন্তর থেকে বলল শান্তা।
হাসানের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হলো। কিন্তু তোমার কি হয়েছে বলো তো? এমন ম্লান দেখাচ্ছে কেন?
কাল রাতে ঘুম হয়নি ভাল, বলল শান্তা। বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছে। কাল সন্ধের দিকে মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছিলাম, কিন্তু ভাল করে চুল শুকানো হয়নি। ইসমত আপা এমন একটা খবর শোনালেন। না! সে যাকগে, আপনি আমাকে আপার কথা বলুন।
বললাম তো, খুব ভাল আছে সে। তার কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে কাল রাতে, কোলকাতা রওনা হয়ে গেছে। এখনও পৌছোয়নি, কার নিয়ে গেছে। বলল, মাসদেড়েক থাকতে পারে।
তারপর ফিরে আসবে এখানে? আমার অন্তত তাই আশা। তবে এই জায়গা তার একেবারেই পছন্দ নয়। বলল, এখানে আর ফিরতে না হলেই খুশি হয় সে। ঠিক কোন প্ল্যান করা হয়নি, তবে আমাকে বোধহয় ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হবে। তোমার আপা বলছে বটে ভাড়াটে তুলে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠতে চায়…।
তারমানে এবার সত্যি সত্যি এখান থেকে আপনারা চলে পাবেন?
শান্তার দিকে একটু ঝুঁকল হাসান। তুমি দেখছি খুব ভেঙে পড়ছ!
মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল শান্তা, নিচু গলায় বিড়বিড় করল, কই, না।
দূর বোকা, বলল হাসান। এখনও তো কিছু ঠিক হয়নি। আমার তো একেবারেই ইচ্ছে নয় এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাই।
টাইপরাইটারের দিকে ঘুরে বসল শান্তা। আজ কি আপনি ডিকটেট করবেন? না করলে বাকি লেখাগুলো টাইপ করে ফেলি : আমি।
না, ডিকটেট করার আগে চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। গল্পটা আরও জমজমাট হওয়া দরকার।
এমনিতেও গল্পটা দারুণ ইন্টারেস্টিং হচ্ছে এখন, মন্তব্য করল শান্তা।
তা যদি হয়, তাতে তোমারও খানিকটা অবদান আছে। বলা যায় না, তোমার সাহায্য নিয়ে আমি হয়তো এবার একটা বেস্ট সেলারই লিখে ফেলছি।
আবার সেই কথা! শান্তার চেহারায় কৃত্রিম রাগ। আপনি কি এখনও এই বলে নিজেকে ধোকা দিচ্ছেন যে তমার সঙ্গে আমার চরিত্রের মিল আছে?
শান্তার কাছ থেকে সরে গেল হাসান, লাইব্রেরির মেঝেতে পায়চারি শুরু করল। ভেবে দেখো ব্যাপারটা, বলল সে। বইটার শুরুতে তমা আর মামুন যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, আমাদের পরিস্থিতি তারচেয়ে খুব একটা আলাদা কি? মামুনের স্ত্রী মারা গেছে, এবং সবাই জানে বিবাহিত জীবনে তারা কেউ সুখী ছিল না। লোকে তাদের ঝগড়াঝাটি, স্ত্রীর রগচটা স্বভাব নিয়ে ফিসফাস করে। আর যেহেতু তার স্ত্রী অল্পবয়েসে হঠাৎ মারা গেছে, পাড়া-প্রতিবেশীরা মামুনের বিরুদ্ধে একটা কেস দাঁড় করাতে চাইছে। মামুনের অন্ধ ভক্ত বলা যায় তমাকে, তার বিশ্বাস মামুনের দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হতে পারে না, যদিও ঘটনা আর পরিস্থিতি দিনে দিনে মামুনের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তমার অন্ধ ভক্তি ক্রমশ অন্ধ প্রেমে রূপ নিল। যখন এমনকি স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে মামুনের পিছনে পুলিশ লাগল, তখনও মামুনকে অবিশ্বাস করতে রাজি নয় তমা।
দুটো পরিস্থিতির মধ্যে আমি তো কোন মিল দেখতে পাচ্ছি না। কেন আপনি একথা বলছেন?।
না, এক অর্থে অমিলটাই বেশি। যেমন, শান্তা, তুমি আমার ততটা অন্ধ ভক্ত নও, তমা যতটা মামুনের। আর ঝর্ণাও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে—তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে, তুমিও কথা বলেছ ফোনে। তবে স্যাডিস্টিক ধরনের একটা কৌতূহল আমার আছে বটে, জানতে ইচ্ছে করে কুৎসাপ্রিয় প্রতিবেশীরা গোপন ও মর্মান্তিক কোন ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িত করছে কিনা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তা, হাত-পা কাঁপছে তার। এসব কথা আমার ভাল লাগছে না, বলল সে।
হাসান হাসল, সেটাকে মজা পেয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসি বলা যায়। খুব খুশি হতাম, বুঝলে শান্তা, যদি দেখতে পেতাম আমার জন্যে খানিকটা দরদ আছে তোমার।
হাসানের চোখে এমন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল শান্তা, ওগুলো যেন সম্মােহিত করে রেখেছে তাকে। হাসান যখন এগিয়ে এসে তার হাত ধরল, সে কোন কথা বলতে পারল না, এমনকি বাধা দেয়ারও কোন ইচ্ছে হলো না। গায়ে হাত পড়লে মেয়েরা নাকি নেতিয়ে পড়ে, কথাটা যে সত্যি আজ তার প্রমাণ পেল হাসান। হাতটা খুব জোরে চেপে ধরায় কজিতে ব্যথা অনুভব করছে শান্তা, কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার কোন চেষ্টা করছে না। তার শরীর ঝিমঝিম করছে, ব্যথা পাবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে শিরায় শিরায়। শুধু অসহ্য লাগছে বুকের ব্যথাটা, মনে হচ্ছে খাচার ভেতর ফেটে যাবে হৃৎপিণ্ড। একবার মনে হচ্ছে তার নারীত্বকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে চাইছে একজন পুরুষ, পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে অপমানিত করা হচ্ছে তাকে। শরীর ও মন, দুটো আলাদা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, দুটোর কোনটারই নিয়ন্ত্রণ শান্তার হাতে নেই। আশ্চর্য! ভাবছে সে। এই মানুষটাকে আমি চিনি না! কোনদিনই চিনতে পারিনি!
শান্তাকে নিজের বুকে টেনে নিল হাসান। চুমো খাবার জন্যে ঝুঁকছে সে। জানতাম, আমি জানতাম! আমার প্রতি তোমার মায়া আছে, আমাকে তুমি ভালবাসো! একজন বিজয়ীর সুরে কথা বলছে সে।
এরপর দশ-পনেরো সেকেণ্ড যা ঘটল, সে-কথা ভাবলেই কেঁপে উঠবে শান্তার শরীর, ভুলে থাকতে চাইবে সব।
তারপর কথা বলার শক্তি ফিরে পেল শান্তা। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল সে, বলল, কি জানি…একেই কি মায়া করা বলে? কিংবা ভালবাসা?
আমি তোমাকে কাছে ধরে রাখায় তোমার ভাল লাগছে না?
তোমাকে আমি কত ভালবাসি বোঝার পর নিজেকে তোমার সুখী লাগছে না? কিছুই কি তুমি অনুভব করছ না?
শরীরের কথা বাদ দিন, তার অন্যরকম চাহিদাও থাকতে পারে, নিচু, তবে স্পষ্ট সুরে বলল শান্তা। কিন্তু অলসা তো মনের ব্যাপার, হাসান ভাই। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল সে। আপনি আমাকে মায়া করায় আমি বাধা দিতে পারিনি, তার মানেই কি আপনাকে আমি ভালবাসি?
হঠাৎ যেন আগুনের ছ্যাকা খেয়েছে, প্রায় ছিটকে শান্তার কাছ থেকে সরে এল হাসান। তারমানে তুমি…!
আমাকে ভাল লাগা আপনার উচিত নয়, হাসান ভাই, বিড়বিড় করে বলল শান্তা।
কিন্তু কার কি ক্ষতি করছি আমরা? ঝর্ণা আমাকে এক ফোঁটা ভালবাসে না। তুমি মুক্ত, সময় হলে আমিও নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারি। আমার দিকে ফেরো, শান্তা, তাকাও। স্বীকার করো, তোমার সম্পর্কে আমি যা বিশ্বাস করি সব সত্যি। পরিস্থিতি যা-ই। হোক, তুমি কি আমার পাশে দাঁড়াবে না? গোটা দুনিয়া যদি আমার বিরুদ্ধে চলে যায়, তুমিও কি আমার ওপর বিশ্বাস হারাবে?
না, বলল শান্তা। আমি আপনার সঙ্গে থাকব।
জানতাম এ-কথাই বলবে তুমি! আবার এগিয়ে আসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল হাসান। জানি, অন্যায় সুযোগ নিতে খাচ্ছিলাম। তুমি অত্যন্ত নরম আর মিষ্টি মেয়ে, তোমাকে সাংঘাতিক কঠিন একটা পরীক্ষায় ফেলে দিচ্ছি। আমরা কেউ তো জানি না আমাদের জন্যে কি আছে ভবিষ্যতে। তারপর নিজেকে আর ধরে শাখতে পারল না সে। এগিয়ে এসে আবার শান্তার একটা হাত গল। চুমো খাবার জন্যে আবার ঝুঁকল।
হাসান ভাই, প্লীজ, আমাকে যেতে দিন, কোন রকমে বলল শতা, মনে হলো কেঁদে ফেলবে।
শান্তাকে বরং অবাক করে দিয়ে আবারও হাতটা ছেড়ে দিল হাসান। ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়ল শান্তা, মুখ ঢাকল দুহাতে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। আমার…আমার অসুস্থ লাগছে!
এখন আমি তোমার সম্পর্কে নিশ্চিত, শান্তা, বলল হাসান, তার মাথায় একটা হাত রাখল। কথা দিচ্ছি, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। শুধু একটা কথা মনে রাখতে বলব, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। প্রয়োজনে বিশ্বাস করে নিজের জীবনটাও আমি তোমার হাতে তুলে দিতে পারি। কোনদিন ভুলো না কথাটা।
শান্তা ভাবছে, কি অদ্ভুত সব কথা বলছেন হাসান ভাই! দিশেহারা ভাবটা এখনও অস্থির করে রেখেছে তাকে।
আজ কোন কাজ করবে না তুমি, আবার বলল হাসান। তুমি একা বিশ্রাম নাও, আমি একটু ঘুরে আসি। একা থাকলে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে।
হাসান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার খানিক পর রান্নাঘরে চলে এল শান্তা। আয়েশা বেগম চুলোয় তরকারি বসিয়ে, হাসানের স্যুটটা টেবিলে ফেলে ইস্ত্রি করছেন। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েই চমকে উঠলেন। কি হয়েছে, শান্তা? তোকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
একটা মোড়া টেনে চুলোর কাছে বসল শান্তা, তার শীত করছে। ঠাণ্ডা লেগেছে, আন্টি। মাথাটাও ধরেছে। আজ আর কাজ করব না, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। হাসান ভাই বাইরে গেছেন, উনি ফিরলে আপনি যাবেন, কেমন? আপনার কাছে এলাম এক কাপ চা খাব বলে।
তরকারির পাতিল নামিয়ে চা চড়ালেন আয়েশা বেগম। হ্যাঁ চালিয়ে কাজ করছেন তিনি, ট্রাউজারটা ইস্ত্রি করা হয়ে গেল শান্তাকে চা দিয়ে টেবিলের ওপর কোটটা ফেললেন, বললেন, কোটের একটা বোম দেখছি নেই।
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে শান্তা, তাকিয়ে আছে সাদা দেয়ালের দিকে। টেবিল থেকে কোটটা তুলে একবার ঝাড়া দিলেন আয়েশা বেগম। কি পড়ল!
তার কথা শুনে তাকাল শান্তা, দেখল কোট ঝাড়া দেয়ায় একটা কাগজ পড়ে গেছে মেঝেতে। হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিলেন আয়েশা বেগম। কাগজের ওপর লেখাটা পড়লেন তিনি, সালাম রোড ট্রান্সপোর্ট, আরমানিটোলা, ঢাকা। মুখ তুলে শান্তার দিকে তাকালেন। ব্যাপার কি বল তো? তোর দুলাভাই আমাকে বলল, স্যুটকেসটা দিয়ে এসেছে ঝর্ণাকে, অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে সেটা জমা রাখা হয়েছে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর অফিসে। এর মানে কি?
মানে যা-ই হোক, আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার কি।
তা ঠিক। কিন্তু অত সুন্দর ঘাগরা, শাল, কোট, সবই যদি ট্রান্সপোর্ট অফিসে পড়ে থাকবে, তাহলে ওগুলো ঢাকায় নিয়ে যাবার কি দরকার ছিল? এই রসিদ ছাড়া তো স্যুটকেসটা ওদের কাছ থেকে চাইতে পারবে না ঝর্ণা।
আন্টি, এ-সবের নিশ্চয়ই কোন ব্যাখ্যা আছে।
কি, শোনা আমাকে। গত এক মাস ধরে ভাল-মন্দ কত চিন্তা আসা-যাওয়া করছে আমার মাথায়। মেয়েটা এভাবে চলে গেল, তারপর তার আর কোন খবর নেই। এর ভেতর কিছু একটা রহস্য অবশ্যই আছে। চারদিকে মেয়েদের বিরুদ্ধে যা শুরু হয়েছে…।
আয়েশা বেগমের হাত থেকে রসিদটা তুলে নিল শান্তা। তুমি থামো, তো। থাক এটা আমার কাছে, দেখা হলে হাসান ভাইকে দেব।
জানতেও চাইবি, আসলে কি ঘটেছে। ব্যাপারটাকে এখন আর হালকা করে দেখার উপায় নেই। চারপাশে লোকজন কি বলে বেড়াচ্ছে শুনবি?
না, আমার শোনার দরকার নেই, বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল শান্তা।
পরদিন ঠাণ্ডাটা আরও পেয়ে বসল শান্তাকে, ফারুনী ইসলাম মেয়েকে বিছানা থেকে উঠতেই দিলেন না। কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে সাইফুল, কোর্ট থেকে ফেরার পথে এক ঝুড়ি ফল, কয়েকটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন আর রজনীগন্ধার কয়েকটা উঁটা নিয়ে হাজির হলো সন্ধের দিকে। সে আসতেই ওদের দুজনকে একা রেখে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন ফাল্গুনী ইসলাম, তারপর আর বেরুবার নাম নেই। স্বভাবতই শান্তার মনে হলো সাইফুলকে একটা সুযোগ দিচ্ছেন তার মা। সাইফুলও সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল।
অসুস্থ শান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সাইফুল, হাতে হাত রাখল, তারপর ফিসফিস করে বলল, হাসান সাহেবের চাকরিটা তোমার ছাড়া উচিত। বড় বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
জানি, এরপর আপনি আমাকে আপনার অফিসে ফিরে যেতে বলবেন,মান হেসে বলল শান্তা।
আরও বলব, তুমি আমাকে বিয়ে করো, তোমাকে সুখী করার একটা সুযোগ দাও আমাকে।
চাদরটা বুকের ওপর টেনে কাত হলো শান্তা, সরাসরি সাইফুলের দিকে তাকাল। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আমার মধ্যে কি দেখেছেন আপনি? আমি তো খুব সাধারণ একটা মেয়ে। আর আপনার যে পসার, যে গুণ, যে-কোন বড়লোকের সুন্দরী একটা মেয়েকে অনায়াসে স্ত্রী হিসেবে পেতে পারেন। আমাকে বিয়ে করলে আপনি তো কিছুই পাবেন না। তারচেয়ে ধনী কোন পরিবারে বিয়ে করলে…।
আমি চাইও ঠিক তাই, শিক্ষিত পরিবারের অতি সাধারণ একটা মেয়ে। কেন তা চাই শুনলে তুমি হয়তো অবাক হবে। তুমি জানো, আমি খুব গরীব পরিবারের ছেলে, লেখাপড়া শিখে অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। তবে বড় বা ধনী লোকদের ওপর আমার কোন রাগ নেই, কারণ ধনী হওয়া এমন একটা অপরাধ যা আমরা সবাই করতে চাই। এ এমন একটা অপরাধ, যে যত বেশি করতে পারে, সমাজ তাকে তত বেশি সম্মান দেয়। আইনের প্যাচ কষে আমিও প্রচুর কামাব বলে আশা রাখি, শান্তা। সমাজ যে অনিশ্চয়তা উপহার দিচ্ছে, তা থেকে বাচার জন্যেই এই পাপ আমাকে করতে হবে। সেজন্যেই খুব সাধারণ, শিক্ষিত পরিবারের একটা মেয়ে চাই আমার, ঠিক তোমার মত, যে আমার ছেলেমেয়েকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
ভারি অদ্ভুত কথা শোনালেন তো। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন নিজের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করার জন্যে। তারমানে ধরে নিচ্ছেন নিজে আপনি বিপথগামী হবেনই, কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না?
তা তো জানি না, তোমার অত শক্তি আছে কিনা। আমারও যদি লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারো তুমি, সেটাকে উপরি পাওনা বলে মনে করব। তবে এ-কথা ঠিক যে নিজের ব্যাপারে অতটা উদ্বিগ্ন আমি নই যতটা ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে। শুনলে তুমি লজ্জা পাবে, তবু কথাটা বলতেই হবে আমাকে। যাকে বিয়ে করতে চাইছি তার সঙ্গে সত্যি যদি আমার বিয়ে হয়, আমি চাইব আমাদের ছেলেমেয়ে হবে কম করেও এক ডজন-বারোটা। কেন জানো? কারণ, আমার বিশ্বাস, এই মেয়েটির হাতে পড়লে বাচ্চাগুলো মানুষের মত মানুষ হবে। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর পেলে? বুঝতে পারছ, কেন আমি ধনী কোন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়ে তোমাকে বউ করতে চাইছি?
আপনি অনেক বদলে গেছেন, সাইফুল ভাই, সে থামার পর বলল শান্তা। আপনার এ-সব কথা শোনার পর আপনাকে বিয়ে না করতে পারাটা আমার জন্যে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিয়ের কথা আমি ভাবছি না। সাইফুল ভাই, আমাকে আরও সময় দিতে হবে।
চেহারা মান হয়ে গেলেও, জোর করে হাসল সাইফুল। আমাকে তুমি এড়িয়ে যেতে পারবে না। সাধারণ মেয়েরাও যে দুর্লভ হয়, আমি জানি। আমি ধৈর্য ধরতে রাজি আছি।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত শান্তাদের বাড়িতে থাকল সাইফুল, ফাল্গুনী ইসলাম তাকে না খাইয়ে ছাড়লেন না।
কাজে বুয়া আসেনি, তার ছেলের হাম না কি যেন হয়েছে, কাজেই খবর দিয়ে আয়েশা বেগমকে আনিয়েছেন ইসমত আরা। বুড়ি মানুষ, অন্তত হালকা কয়েকটা কাজ করে দিয়ে যাবেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন আসলে ইসমত আরা। ঝর্ণা আর তার স্বামীর ভেতরের খবর পেতে হলে আয়েশা বেগমকেই দরকার তাঁর।
প্রসঙ্গটা তুলতেই আয়েশা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন, আমাদের ঝর্ণা সত্যি বেঁচে আছে কিনা সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। জামাই বলছে বটে টেলিফোনে কথা হয়েছে তার সঙ্গে, ঢাকায় গিয়ে দেখাও করে এসেছে, কিন্তু কে প্রমাণ করবে? তারপর তিনি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদ পাবার ঘটনাও সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।
ইসমত আরা বললেন, কি সাংঘাতিক! তা খালা, রসিদটার। কথা ঝর্ণার স্বামীকে তুমি জিজ্ঞেস করোনি?
রসিদটা তো শান্তার কাছে, আমাকে বলল সে-ই তার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু দেখা হলে তো জিজ্ঞেস করবে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
শান্তা হঠাৎ অসুস্থই বা হলো কেন? আশপাশে কেউ নেই, তবু ফিসফিস করে কথা বলছেন ইসমত আরা। খালা, এর মধ্যে অন্য কিছু নেই তো আবার? খালি বাড়িতে একটা পুরুষ আর একটা যুবতী মেয়ে সারাদিন একা থাকে, কত কিছুই তো ঘটতে পারে, তাই না?
আমিও তো সে কথা বলি, পুরুষরা হলো কাল সাপ! ওদেরকে বিশ্বাস করেছ কি মরেছ। যখনই দেখি, দুজন শুধু ফিসফিস করছে।
আর কি দেখেছ, খালা? মানে, ভয় পাবার মত কিছু চোখে, পড়েছে তোমার? বললে কিনা ঝর্ণা বেঁচে নেই বলে সন্দেহ হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করছি।
দেখব না কেন, অবশ্যই দেখেছি। ওদের সব ষড়যন্ত্র আমার কাছে ফাঁস হয়ে যায়।
কি দেখেছ খালা?
বলা হচ্ছে ঝর্ণা ঢাকায় গেছে শুক্রবারে। শনিবার সকালে আশা ভিলায় কাজ করতে গিয়ে দেখি বারান্দায় জামাইয়ের কাদা মাখা বুট পড়ে রয়েছে। তারমানে ঝর্ণাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল জামাই, ফিরে এসে বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করে, তারপর সিলেটে চলে যায়।
ঝর্ণাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে সরাসরি কেন সিলেটে যায়নি? স্বগতোক্তি করছেন ইসমত আরা। আমি তাকে গাড়ি চালিয়ে স্টেশনের দিক থেকে বাড়ি ফিরতে দেখেছি, একা…।
তা হয়তো ফিরছিল লোককে এ-কথা বোঝাবার জন্যে যে ঝর্ণাকে সে ট্রেনে তুলে দিয়ে এল।
তারমানে তুমি ভাবছ বাগানে ঝর্ণাকে…? চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে ইসমত আরার। কী সাংঘাতিক! এ তো আর গোপন রাখা উচিত নয়। আজই তোমাদের জামাইকে বলব আমি। আমরা প্রতিবেশী, ঝর্ণা আমাদের পাড়ার মেয়ে, আমাদের একটা দায়িত্ব আছে…।
এক সময় দরজায় কয়েকজন প্রতিবেশীর সাড়া পাওয়া গেল, ইসমত আরার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে তারা। আয়েশা বেগমকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে মেহমানদের নিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন তিনি। শুরু হলো গল্প, বিষয় ঝর্ণার নিখোঁজ রহস্য।
সোমবারে সুস্থ বোধ করায় সকালেই আশা ভিলায় চলে এল শান্তা। ভেতরে ঢুকে রান্নাঘরে উঁকি দিল সে, দেখল আপনমনে কাজ করছেন আয়েশা বেগম। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই ডেস্ক থেকে মুখ তুলে তাকাল হাসান, শান্তাকে দেখে হাসল। ভেব না তুমি না আসায় আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি। নতুন একটা পরিচ্ছেদ শুরু করেছি, বুঝলে! তোমার সর্দি কেমন আছে?
প্রায় সেরে গেছে। বিছানায় পড়ে থাকা কি যে কষ্ট আর একঘেয়ে। হাসান ভাই, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব…।
জানি, সেদিন তোমাকে ধরেছিলাম বলে আমার ওপর সাংঘাতিক খেপে আছ তুমি…।
প্লীজ, হাসান ভাই, ব্যাপারটা ভুলে যান! আমি আপনাকে অন্য প্রসঙ্গে…।
বুঝতে পারছি, আমার কাজটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চাকরি নেবে তুমি, এই তো?
আমার বোধহয় তা-ই করা উচিত, তবে এখনও কিছু ঠিক করিনি। আমি জানতে চাইছি…, হাতব্যাগ খুলে ভেতর থেকে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদটা বের করল শান্তা। আপনার কোটের পকেট থেকে আয়েশা আন্টি পেয়েছেন এটা।
ও। তো? হাসানের গলার সুর একদম স্বাভাবিক।
রসিদটা আপনার কাছে থাকলে ঝর্ণা আপা স্যুটকেসটা পাবেন কিভাবে?
গাড়ি করে কোলকাতা যাচ্ছে, অত বড় স্যুটকেস নেবে কিভাবে? ওটা খুলে যা যা দরকার ছিল বের করে নিল, তারপর রসিদটা আমার কাছে রেখে দিতে বলল, তার কাছে থাকলে নাকি হারিয়ে ফেলবে।
ব্যাখ্যাটা এত সহজ আর বিশ্বাসযোগ্য, স্বস্তিতে হেসে ফেলল শান্তা। উফ, আমি যা ভয় পেয়েছিলাম না!
হাসানের চোখে কৌতূহল। ভয় পেয়েছিলে? কিসের ভয়?
না, মানে, ভেবেছিলাম আসলে বোধহয় ঝর্ণা আপার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। আপনি মুখ রক্ষার জন্যে বানিয়ে বলেছেন। শান্তা উপলব্ধি করল, এর বেশি কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দেখা হয়েছে, সে ভালও আছে, বলল হাসান। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ বা দরকার নেই তোমার।
দরকারও নেই?
সে এখানে ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ আছে আমার। একসঙ্গে বাস করতে হলে, তার কথামত আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকায় আমি থাকব কিনা তা এখনও ঠিক করিনি। যদি থাকি, তুমিও কি আমাদের সঙ্গে ওখানে থাকবে, শান্তা? তখনও তো আমার একজন টাইপিস্ট দরকার হবে, তাই না?
এটা একটা প্রশ্ন হলো? মা আমাকে ছাড়বে? আমিই বা কেন আপনাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হব?
হ্যাঁ, তাই তো। তবে, এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। ঝর্ণার সঙ্গে ঢাকায় আমি থাকতে রাজি না-ও হতে পারি। তা যদি না থাকি, এই বাড়িটাও আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, কারণ এটাও তো তোমার আপারই বাড়ি। সেক্ষেত্রে আশপাশে ভাল কোন বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে।
আপাকে ছেড়ে আপনি থাকতে পারবেন? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল শান্তা।
শান্তা, তোমার আপা আমাকে ছেড়ে থাকছে, আমি নই। যদি ছাড়াছাড়ি হয়েই যায়, দায়ী থাকবে সে একা। আমি তো ভয় পাচ্ছি। ঝর্ণা আমাকে হঠাৎ ডিভোর্সও করতে পারে।
কি বলছেন?
চেয়ার ছেড়ে উঠল হাসান, শান্তার সামনে এসে দাঁড়াল। তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে, শান্তা? ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত? সত্যি যদি আমাকে ভালবাস তুমি, অপেক্ষা করতে বলাটা অন্যায় কোন দাবি নয়।
হাসান ভাই, প্রথম কথা আপনাকে ভালবাসা আমার উচিত নয়, গলাটা কেমন ভেঙে ভেঙে গেল শান্তার। তাছাড়া আমি জানিও না আপনাকে ভালবাসি কিনা।
সেদিন যখন তোমাকে আমি আদর করলাম, তখন বোঝানি?
সেটা কি ভালবাসা ছিল? উচ্চারণ তো করলই, প্রশ্নটা শান্তার মনকেও অস্থির করে তুলেছে। এই সময় তার একটা হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল হাসান। না, হাসান ভাই…প্লীজ। পিছিয়ে এল শান্তা। আপনার কাছে এলেই আমার সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে চিন্তা করতে হবে। আমাদের মধ্যে যে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেছে, সেটা যথেষ্ট নয়, হাসান ভাই। তার সঙ্গে বিশ্বাস, নিশ্চয়তা আর শ্রদ্ধাবোধও থাকতে হবে।
আমি তোমাকে বলেছি, তোমার ওপর আমার পুরোপুরি। বিশ্বাস আছে। যা কিছু ভাল, সুন্দর আর মিষ্টি, তোমাকে আমার সে-সবের আধার মনে হয়। কসম খেয়ে বলছি, শান্তা, আমার ওপর তুমি ভরসা রাখতে পারো। তোমাকে ছুঁয়ে অন্যায় করেছি আমি, তবে নিশ্চিত হওয়াটা জরুরী ছিল আমার জন্যে।
কি বলতে চান বুঝলাম না।
তোমাকে যখন ছুঁলাম তখন যদি আমাকে তুমি ঘৃণা করতে, আমাদের সম্পর্কটা ওখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তা তুমি করোনি। তুমি সাড়া দিয়েছ। আমি চাই, ওই মুহূর্তগুলো চিরকাল মনে রাখবে তুমি। ঝর্ণার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে আমি যখন তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, উত্তর দেয়ার সময় আমি চাই ওই মুহূর্তগুলোর কথা মনে থাকবে তোমার। ওই স্মৃতি আসলে জাদুর একটা কাঠির মত, শান্তা। পরস্পরকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। যতদিন ঘটনাটা মনে থাকবে, অন্য কোন পুরুষের হাতে নিজেকে তুমি তুলে দিতে পারবে না। বলতে পারো, তোমার ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখা হয়েছে।
হাসানের চোখ দুটো শান্তাকে যেন সম্মােহিত করে রেখেছে। বেশ কয়েক সেকেণ্ড কোন কথা বলতে পারল না সে, শুধু অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, কোন মেয়ে কি এভাবে সব কিছু দান করতে পারে? প্রশ্নটা যেন একা হাসানকে নয়, নিজেকেও করছে সে। তার গোটা জীবন, সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ-কোন নিরাপত্তা ছাড়াই?
শান্তা, ভালবাসায় নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে কি?
কিছু কিছু লোকের বেলায় থাকে বলেই আমার ধারণা, কিন্তু আপনার আর আমার বেলায়…নাহ্, হাসান ভাই, জিনিসটা আমরা চোরাবালির ওপর দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি। এ-ধরনের কিছু করার অধিকার আমরা রাখি না। আপনি ঝর্ণা আপার, ঝর্ণা আপা আপনার।
ঝর্ণা আমাকে ত্যাগ করবে। কি আশ্চর্য, আমিই কি প্রথম লোক নাকি যে অত্যাচারী স্ত্রীর কাছ থেকে ডিভোর্স পেয়ে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাইছে? শান্তা, আমার অন্তত এই কথাটা বোঝার চেষ্টা করো—তোমার কাছে আমি শান্তি পাব।
আচ্ছা ধরুন ব্যাপারটা ঘটল, ঝর্ণা আপা ডিভোর্স দেয়ার পর আপনি আমাকে বিয়ে করলেন, কিন্তু আপনার কাছে কি পাব আমি?
বিশ্বস্ত একজন স্বামী পাবে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসতে পারো এমন একজন মানুষ পাবে। তার সাফল্যেরও ভাগ পাবে তুমি, কারণ তার জন্যে তুমি একটা প্রেরণা। শোনো, এ-সব কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি তা প্রমাণ করার জন্যে খোদার কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে আর আমি ভুলেও স্পর্শ করব না, যতদিন না সে অধিকার আমি পাই। ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটাকে তুমি অন্যায় বলে মনে করছ, তোমার এই নীতিবোধ আমি শ্রদ্ধা করি। আমি শুধু তোমাকে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলছি, অনুরোধ করছি আমার ওপর বিশ্বাস না হারাতে। খুব বেশি কিছু চাওয়া হয়ে যাচ্ছে?
বুঝতে পারছি না, হাসান ভাই…শুধু বুঝতে পারছি, আপনার কাজ আমার ছেড়ে দেয়া উচিত। যা ঘটে গেছে তারপর আর এবাড়িতে কাজ করা আমার উচিত নয়।
আমি প্রতিজ্ঞা করছি আর কখনও তোমাকে ছোঁব না, তারপরও? কথা দিচ্ছি, তোমাকে দাদী-নানীদের মত সম্মান করব, তারপরও…!
না, কারণ নিজেকে আমি আপনার দাদী-নানী বলে মনে করতে পারছি না।
হেসে ফেলল হাসান। বলা উচিত ছিল, আমার মেয়ের মত। ঠিক আছে, শান্তা, যেতেই যখন চাও, ঈদের পর চলে যেয়ো। উপন্যাসটা মাঝপথে রয়েছে, এখন তুমি চলে গেলে বিপদে পড়ে যাব। লেখাটা শেষ করার জন্যে তোমাকে আমার দরকার।
এ আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন, বলল শান্তা, তার দুই ভুরুর মাঝখানটা কুঁচকে উঠল।
অদ্ভুত বলছ কেন? তোমাকে বলিনি, তুমি আমার প্রেরণা? তোমার উপস্থিতি আমাকে অনুপ্রাণিত করে? তমার সঙ্গে তোমার এত মিল, লেখার সময় ভুলে যাই তোমাদের দুজনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা।
এর কোন মানে হয় না। ব্যাপারটা শুধুই আপনার কল্পনা। হাসান ভাই; আজ আমি বুঝতে পারছি, আপনার লেখার ব্যাপারে নাক গলানো উচিত হয়নি আমার, উচিত হয়নি তমা চরিত্রটিকে আরও বাস্তব করার কথা বলা।
কেন বলছ এ-কথা? তুমি নিজেই স্বীকার করেছ, লেখাটা দারুণ ভাল হচ্ছে। আমারও আশা, বইটা বেস্ট-সেলার হতেও পারে। শান্তা চুপ করে আছে দেখে আবার বলল হাসান, তোমার বোধহয় ধারণা, তোমার আত্মা আর হৃদয়ের খানিকটা চুরি করে তমাকে আমি দিয়ে দিয়েছি।
এ-সব বন্ধ করুন, প্লীজ। এসব ফ্যান্টাসী আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। আমাদের আগের সম্পর্কটাই ঠিক ছিল…আপনি শুধুই আমার প্রিয় লেখক ছিলেন, আপনার কাজ করে তৃপ্তি পেতাম আমি …।
কিন্তু সময়ের কাঁটা তো ঘুরিয়ে দেয়া যায় না, খানিকটা হতাশ সুরে বলল হাসান, ম্লান হয়ে উঠল তার চেহারা। তোমার কিন্তু অনেক কাজ জমে গেছে, যদি চাও তো এখুনি শুরু করতে পারি আমরা।
অনুগত ভঙ্গিতে টাইপরাইটারের সামনে চেয়ারটায় বসল শান্তা, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টাতে শুরু করল। হাসান হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেলায়, তার ঠাণ্ডা ও নির্লিপ্ত গলা শুনে, মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আবার একই সঙ্গে খানিকটা স্বস্তিবোধও করছে।