পার্মানেন্ট স্বামী

পার্মানেন্ট স্বামী

“শাড়ির কুচিটা ঠিক করে দিয়ে যাও তো।
.
ছুটির দিনে আমার কাজ নেই এইটা বলা যাবে না। আসলে অফিসে সপ্তাহে একটা ছুটি পাই। ছুটি পাওয়া মানে , বড় একটা ঘুম দেওয়া, কোথাও ঘুরতে যাওয়া, বেশি বেশি খাওয়া। কিন্তু আমার বেলা তা হয় না। সপ্তাহে একটা ছুটির মধ্যেও আমার ঘাড়ে অনেক কাজ জমে থাকে। যেই বলবো আসতেছি তার আগেই তিয়ানা আবার বলে উঠলো…
.
“আরে কি হলো শাড়ির কুচিটা ঠিক করে দিয়ে যেতে বললাম না?
.
আমি কোন মত হাতটা ধুয়ে ওর কাছে যেতেই ও বললো…
“এতক্ষন লাগে আসতে? সেই কখন থেকে ডাকতেছি।
“ডিম ভাজি করতেছিলাম তো। হাত না ধুয়ে আসি কিভাবে?
.
ও কিছু বললো না, আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার তাকানোর মাঝে কি যেন একটা ছিল। তিয়ানাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি যখন ওর দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলাম ও গলায় এহেম করে কাশি দিয়ে বললো…
.
“দাড়িঁয়ে থাকবা নাকি?
“দিচ্ছি। তা শাড়ি পড়ে কোথায় যাচ্ছো?
“জাহান্নামে যাচ্ছি। তোমাকে না বলছি আমি কোথায় যাই কি করি কিছু আস্ক করবা না।
“তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু কোথায় যাবা বলে গেলে ভালো হয়।
“কেন আমার জন্য টেনশন হয়?
.
আমি কিছু বললাম না। ওর শাড়ির কুচিটা ঠিক করতে লাগলাম। আমার চুপ থাকা দেখে ও বললো…
.
“আমি চাই না আমার জন্য কেউ টেনশন করুক।
.
আমি শাড়ির কুচিটা ঠিক করে সোজা হয়ে দাড়াঁলাম তারপর বললাম…
.
“নাস্তা খেয়ে যেও।
.
তিয়ানা এই কথার কোন উওর দিল না। আয়নার সামনে গিয়ে কপালে একটা লাল টিপ পড়লো। আমি বললাম…
.
“কালো শাড়ির সাথে কালো টিপ টা পড়লে মানাবে।
“আমার সামনে থেকে যাও।
.
আমি বেশ ভালো করেই জানি তিয়ানা আমার প্রতি রেগে আছে। ও আমার সাথে এখন যেভাবে আচরণ করছে সব সময় তাই করে। প্রথম প্রথম আমাকে একদম দেখতে পারতো না। তবে আমি বেশ ভালো করেই উপলবদ্ধি করেছি ও আস্তে আস্তে আমার প্রেমে পড়েছে। যেটা ও প্রকাশ করে না। আমি কিছু না বলে রান্না ঘরের দিকে আসলাম। ডিম দুইটা ভাজি করে নাস্তার টেবিলে রাখলাম। ওর প্লেটে চার পিছ পাউরুটি দিলাম। ওকে ডাক দিলাম…
.
“আরে কই আসো নাস্তা তৈরি।
.
দশ মিনিট পর ও নাস্তার টেবিলের সামনে এসে আমার দিকে একটা তাকালো তারপর চুপচাপ খেতে বসে গেল। আমি ওর সামনের চেয়ারটায় বসে রইলাম। আমি খেয়াল করলাম ও আমার কথায় কালো টিপ পড়েছে।
.
“কোথায় যাচ্ছো? আম্মার সাথে দেখা করতে?
.
ও চুপচাপ খেতেই লাগলো। আমি আবার বললাম…
.
“আমাকে বললে আমি না হয় দিয়ে আসলাম।
.
ভ্রু কুচকে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর তাকানে দেখে বললাম…
.
“না মানে তুমি যদি চাও আর কি।
“আব্বুর বাড়ি যাচ্ছি না।
“তাহলে কোথায় যাচ্ছো?
“এই তোমাকে না বলছি আমাকে কিছু আস্ক করবে না।
“হ্যা বলেছো সেটা তো ঘর জামাই থাকাকালীন শর্তের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমি তো এখন ঘর জামাই না। স্বামী হিসেবে তো আস্ক করতে পারি তাই না?
.
তিয়ানা আমার কথায় যেন একটু হাসলো।
.
“তুমি খাচ্ছো না কেন?
“তোমার সাথে তো কখনো একসাথে খাই নি। তাছাড়া তোমার সাথে তো খেতে নিষেধ করেছো।
“এখন তো তুমি ঘর জামাই না। ঘর জামাই থাকার সময় বলেছিলাম।
.
আমি হাসলাম। কি বলবো বুঝতেছিনা। তিয়ানা আবার বললো…
.
“শুনো এবার থেকে আর তোমাকে রান্না করতে হবে না।
“কেন? তুমি রান্না করবা?
“একজন বুয়া ঠিক করেছি। এবার থেকে বুয়াই রান্না করবে।
“কিন্তু…
“কিন্তু কি? কোন প্রবলেম?
“না মানে একটু আমার দিকটা বিবেচনা করো।
.
তিয়ানা চুপ করে রইলো। আমি কি বলতে চেয়েছি তিয়ানা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে। আমি যা বেতন পাই তা দিয়ে ঘর ভাড়া, সংসারের খরচ করা অনেকটা হিমসিম খেতে হবে যা আমি চার পাঁচ দিনের হিসেব দেখেই বুঝেছি। তারউপর বুয়ার খরচ। এই বাসাটায় উঠেছি সবে মাত্র ছয় দিন হলো। দুই তিন দিনের খরচ দেখলেই বুঝা যায় মাসে কত টাকা খরচ হতে পারে। তিয়ানা গ্লাসের পানি টুকু খেয়ে উঠে বললো…
.
“আচ্ছা থাক বুয়া লাগবে না। আমি বুয়াকে নিষেধ করে দিব।
.
আমি হাসলাম। সত্যি বলতে কি তিয়ানা আমার মনের কথা গুলা ঠিক কিভাবে যেন বুঝে ফেলে। আচ্ছা আমি যে ওকে পছন্দ করি সেটা কি ও বুঝে?
.
“যাক ভালোই হলো তুমি বুঝতে পেরেছো।
“কিন্তু রান্না তুমি করবে না। আমিই করবো।
.
আমি একটু অবাক হলাম। বলে কি এই মেয়ে?
.
“তুমি রান্না করবে? তুমি?
“কেন অবাক হচ্ছো নাকি? আমি পারি বা না পারি আমার রান্না খেতে তোমার অসুবিধা হবে নাকি? হ্যাঁ যদি অসুবিধা হয় তাহলে হোটেলে খাবা তবু বাসায় রান্না করা তোমার বন্ধ।
“আরে না কি বলো। নিজের বউ এর হাতের রান্না না খেয়ে হোটেলের খাবার খাব কেন? আমার বউ যাই রান্না করুক যেমন স্বাধই হোক আমার কোন অসুবিধা হবে না।
.
তিয়ানা একটু হাসলো। দরজার কাছে গিয়ে বললো..
.
“দুপুরের আগেই আমি ফিরবো। বাসায় কোন রান্না করবা না।
“তাহলে দুপুরে খাব কি?
“সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। দরজাটা লাগাও। আমি গেলাম।
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। তিয়ানা দরজাটা লাগিয়ে বের হয়ে পড়ে। তিয়ানার সাথে আমার পরিচয় হয় এক অন্য রকম ভাবে। ও যে আমাদের ম্যানেজার আশিকুর রহমানের মেয়ে আমি জানতাম না। সেদিন আমি অফিস থেকে বাসায় যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। অফিস থেকে বের হয়ে একটু হেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ির এত জ্যাম দেখে আমার মাথাটা কেমন যেন করলো। তবে আমার জন্য কোন সমস্যা ছিল না কারন লেইট হলেও বা আর না হলেও বা কি। আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় বা টেনশন করবে না। ব্যাচেলর থাকি। বেশি জোর হলে শফিক ভাই ফোন করতে পারে। একবার ভাবলাম হেটে হেটেই চলে যাই। চিন্তা করতে করতে হাটতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষন হাটার পর ওভারব্রীজের উপর যখন উঠে কিছুটা পথ হাটলাম তখন দেখতে পেলাম হলুদ ল্যাম্পোষ্টের আলোতে ওভার ব্রীজের ফুটপাথের উপর বসে মাথাটা নিচু করে কান্না করতেছে একটা মেয়েটা। আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটার সাথে একটা বড় ব্যাগ। আমার কেমন ঠিকঠাক লাগছিল না। আমি মেয়েটার পাশে গিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িঁয়ে থাকলাম। আচ্ছা আমার কি কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত্? মেয়েটাকে কি আমি ডাক দিব? আমার উপস্হিতি টের পেয়ে ও মাথাটা তুললো।
.
চোখ গুলা কেমন লাল হয়ে আছে। আর কান্নার গোঙরানী। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মানিব্যাগটা বের করে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার দিকে কেমন করে যেন দেখলো। তারপর কিছু না বলে টিস্যুটা নিয়ে নাকের পানির মুছতে লাগলো। আমি ওর এক হাত দুরে বসলাম তারপর বললাম…
.
“কি সমস্যা? বাসায় মা বাবা নিশ্চয় বকেছে তাই না?
.
ও কিছু বললো না। আমি আবার বললাম….
.
“কেউ বকলে বাসা থেকে বের হতে হবে এটা তো কোন কথা না। আপনি কত ভাগ্যবতী আপনার মা অথবা বাবা বকেছে কিন্তু আমাকে বকার মত কেউ নেই। উনারা সেই কবেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে।
.
আমার কথা শুনে মেয়েটা কান্নার শব্দ আরো একটু বাড়িয়ে দিল। তারপর গোঙরানী দিতে দিতেই বললো..
.
“কেউ বকে নি।
“তাহলে এখানে বসে বসে কান্না করছেন কেন?
.
ও কিছু বললো না। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখন ও বলতে লাগলো…
.
“বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই মাসের বিশ তারিখেই আমার বিয়ে।
“বুঝেছি বিয়েতে আপনি রাজি না। তা সেটা মা বাবা কে বললেই হয়।
.
ও আবার কান্না করতে লাগলো। আমি আরো একটা টিস্যু দিলাম। টিস্যুটা নিয়েই ও আবার নাকের পানি মুছতে লাগলো।
.
“চলেন আমি বাসায় পৌছে দিব।
.
এইটা বলেই আমি উঠে দাড়াঁলাম। ও তখনো বসে ছিল।
.
“আমি আদনানকে ভালোবাসি। আদনান ও আমাকে ভালোবাসে।
.
কথাটা শুনেই আমি আবার বসলাম। তারপর বললাম..
.
“তো প্রবলেম কোথায়?
“আমি বাসা থেকে পালিয়েছি। গতকাল রাতে আদনান আমাকে বলেছিল ও আসবে। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার আগেও কল করেছি কিন্তু ওর মোবাইল অফ ছিল। আমি বাসায় নোট লিখে আসছি যে আমি আমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।
.
এইটা বলেই ও থামলো। নাকের পানি আবার মুছলো। এই একটা সমস্যা মেয়েরা কান্না করলে নাকের পানি বের হয়।
.
“তারপর কি হলো?
“আদনান আসে নি। সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করতে করতে বিকেল বেলায় আমাকে বলে ও নাকি বিয়ে করতে পারবে না। ও ওর বাবা মাকে না জানিয়ে আমার সাথে যেতে পারবে না। আমি কি করবো?
.
আমি হাসলাম। কথা গুলা শুনে তানজিনার কথা মনে পড়লো। আমার জীবনেও একজন ছিল। কিন্তু সে পারে নি আমার কাছে আসতে। আমি কতবার বলেছিলাম তোমার বাবা আমাদের বিয়ে মানবে না চলো অন্যকোথাও দুজন চলে যাই। কিন্তু কিছুই হয় নি। ওর বাবা মাকে ও ভীষন ভালোবাসত। ও চাইতো না ওর বাবা মা ওর কারনে সম্মান হারাক। আমি আর কিছু বলতে পারি নি। অসহায় এর মত ছিলাম। ওর বাবার কাছেও গিয়েছিলাম কোন কাজ হয় নি। বরং আমার কাছে হাত জোর করলো আমি যেন ওর জীবন থেকে সরে যাই। ওর বিয়ের এক মাস পরেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে আসি। আমি চাই নি ওর কোন ঝামেলা হোক। আর এই মেয়ে তো দেখি একটা ছেলের জন্য সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে। যে মেয়ে একটা ছেলের জন্য তার সব কিছু ছেড়ে চলে আসতে পারে তাকে ফিরায় কিভাবে? আমি বললাম আপনার নাম কি?
.
“তিয়ানা।
“এখন কি করবেন ভেবেছেন?
.
তিয়ানা মাথা দিয়ে না সূচক ইশারা দিল। আমি বললাম আদনানের নাম্বার দেন। এর একটু পর তিয়ানা আমাকে আদনানের নাম্বার দেয়। আমি আদনানকে ফোন দিলাম। সব কিছু বুঝিয়ে বললাম।তারপর বললাম..
.
“তিয়ানা তো বাসায় চিঠি লিখে আসছে এখন ওর কি করার? আপনি কিছু একটা করেন। বুঝতেই পারছেন মেয়ে মানুষ বাসা থেকে বের হয়েছে। ও কি করবে বুঝতে পারছে না।
.
আদনান ফোনে একটু চুপ করে রইলো। আমি যখন আবার বললাম তখন ও আমাকে বললো…
.
“আপনার এত মায়া লাগলে আপনি হেল্প করছেন না কেন?
“দেখুন আপনার জন্যই কিন্তু ও বাসা থেকে বের হয়েছে।
“তো আমি কি করবো? ও ওর বাবা মাকে বুঝাতে পারে না? আর আপনি যখন হেল্প করতে চাইছেন আপনি ওর বাবা মাকে বুঝিয়ে বলছেন না কেন?
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি এই বিষয়টা খুব লক্ষ্য করেছি ছেলে মেয়েরা চুটিয়ে প্রেম করবে, প্রেম করার এক পর্যায়ে যখন বাসা থেকে মেয়ের বিয়ে ঠিক হয় তখন অনেক মেয়ে নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিয়ে বাবা মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে। এক্ষেত্রে ছেলেটা অন্য রকম হয়ে যায়। আবার মেয়ে ছেলের কাছে আসতে চাইলে অনেক ছেলেই বিয়ে করতে রাজি হয় না। কি করে বিয়ে করবে, বিয়ে করে খাওয়াবে কি? কোথায় রাখবে? ছেলে এখনো স্টুডেন্ট, বাবার টাকায় এখনো চলে। তখন মেয়েটার বিয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। ছেলেটার কিছু করার থাকে না। কিন্তু প্রেম করার আগে ওরা ভেবে দেখে না? আমি কিছু বলতে যাবো তিয়ানা আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলতে লাগলো…
.
“আমি কিন্তু সু সাইড করবো।
.
আমি অবাক হয়ে গেলাম এই মেয়ে বলে কি? তারপর ওপাশ থেকে আদনান কি যেন বললো যার কারনে তিয়ানা রেগে বলতে লাগলো…
.
“তুই আমার সাথে প্রেম করছিস কেন? এটাই তোর ভালোবাসা? তুই আমার ভালোবাসার যোগ্য না। কেমন ছেলে তুই? আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি না।
.
এইটা বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে কান্না করতে থাকে। আমি ভাবলাম আদনান ফোন করবে কিন্তু ও করে নি। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। ওকে বললাম…
.
“উঠেন।
.
তিয়ানা আমার দিকে অসহায় এর মত তাকিয়ে আছে। ওর এই অসহায় টাইপের লুকটা যেন বলছিল কোথায়? ও চুপ করে থাকলেও আমি তা বুঝতে পারছি। আমি আবার বললাম…
.
“চলেন কিছু খেয়ে নিবেন। সারাদিন নিশ্চয় কিছু খান নি। আর একটু পর বাসায় গেলে বাবা মার বকা তো একটু খেতেই হবে তখন পেটে খাবার কিছু জায়গা দিতে পারবেন না।
“আমি বাসায় যাবো না।
“আচ্ছা সেটা পরে দেখা যাবে এখন উঠেন।
.
তিয়ানা তারপরো চুপ করে বসে রইলো। যখন একটা ঝাড়ি দিলাম তখন সোজা উঠে দাড়াঁলো। আর কাদঁতে কাদঁতে বলতে লাগলো…
.
“আপনি আমায় ধমক দিচ্ছেন কেন?
.
আমি শুধু হাসলাম। কি বলবো এই মেয়েকে? তারপর হোটেল থেকে কিছু খাইয়ে ওর বাসায় নিয়ে গেলাম। ওখানে গিয়েই আমাদের অফিসের ম্যানেজার আশিকুর রহমানকে দেখলাম। তারপর বুঝতে পারলাম আমাদের ম্যানেজারের মেয়ে তিয়ানা। আশিকুর রহমান আমাকে দেখেই হয়ত ভাবলো তিয়ানা আমাকে বিয়ে করেছে আর আমরা সরাসরি তিয়ানার বাসায় উঠেছি। দরজার বাহিরে তিয়ানা আমার পিছনে মাথা নিচু করে দাড়িঁয়েছিল। আমি কিছু বলতে যাবো তিয়ানার বলতে লাগলো…
.
“একি করলি হতভাগী?
তোর পছন্দের ছেলে আছে সেটা আমাদের বললেই পারতি।
.
আমি তিয়ানার দিকে তাকালাম। তিয়ানা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর কান্না করতেছে। আমি যেই আবার বলতে যাবো। তিয়ানার বাবা তিয়ানার মাকে বলতে লাগলো..
.
“তোমার মেয়ের তো আমরা কেউ না। মুখে বলতে পারে না চিঠি লিখে দিয়ে যায় পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। মান সম্মান তো আমার শেষ করে দিল। বিয়ে করেছে এখন আমার বাসায় উঠেছে কেন? আরে যতই কিছুই করুক আমার কাছেই আসতে হবে বুঝছো?
“আহা তুমি চুপ করো তো। মেয়ের পছন্দ থাকতে পারে না? তুমিও তো আমাকে নিয়ে পালিয়েছিলে মনে নেই।
.
আমি একটু অবাক হলাম। তিয়ানার বাবা চুপ হয়ে গেল। যেন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তারমানে তিয়ানার বাবা মাও পালিয়ে বিয়ে করেছে। এতো দেখি পুরো পালানো পরিবার। তিয়ানার বাবা পিছনে এক হাতের উপর আর এক হাত রেখে হেটে গিয়ে সোফায় বসলো। তিয়ানার মা আমাদের দুজনকে ঘরের ভিতর ঢুকালো। আমি সোফায় বসলাম। তিয়ানা ওর রুমে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকালো তারপর ইশারা দিল কিছু যেন না বলি। আমি অনেকটা আশ্চর্য হলাম। তিয়ানার মা ভিতরে চলে যায়। তিয়ানার বাবা আমার দিকে কেমন করে যেন দেখলো তারপর বললো..
.
“তুমি আমার মেয়েকে ছাড়া আর কোন মেয়ে পাওনি? সারা দুনিয়াতে কি আমার মেয়েই ছিল?
.
আমি শুধু হাসলাম। তারপর ১৫ বা ১৬ বছরের একটা ছেলে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো আমি নিশ্চিত এটা তিয়ানার ছোট ভাই। তারপর ও ওর রুমে চলে যায়। এর দশ পনেরো মিনিট পর আমি তিয়ানার রুমে গেলাম। ওকে বললাম…
.
“আপনার বাবা মা সব কিছু ভালোভাবেই নিচ্ছে। যেহেতু তারাও প্রেম করে বিয়ে করেছে উনারা ব্যাপারটা বুঝেছে। এখন তাদেরকে সব কিছু বলা দরকার। আদনানের কথা বলুন আপনি। না হয় আমিই বলবো।
.
যেই আমি কথাটা বলে রুম থেকে বের হবো তিয়ানা বলতে লাগলো…
.
“আপনি কিছু বলবেন না। যে ছেলের জন্য আমি বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারি, সেই ছেলে শুধু তার কথাই ভাবলো, আমার কথা ভাবলো না, তাকে নিয়ে আমি আর ভাববো না। তাকে নিয়ে আমি কেন ভাববো?
“কিন্তু
“আপনি কয়েকটা দিন আমার স্বামী হিসেবে অভিনয় করতে পারবেন না?
“মাথা খারাপ?
“প্লিজ এত কিছু করেছেন অন্তত এই টুকু করুন।
.
আমি কি বলবো বুজতে পারছি না। তারপর ওর স্বামী হিসেবে অভিনয় করলাম। ব্যাচেলর থেকে ঘর জামাই হয়ে গেলাম। কিন্তু ও আমায় বললো আমি যেন কোন কিছু আস্ক না করি, মানে ওভার স্মার্ট স্বামীর অভিনয় না করি। আমার জন্য এক হিসেবে ভালো হলো ফ্রি খাওয়া দাওয়া, থাকা। বেশ ভালোই কাটতে লাগল। ওর বাবা মা যেন বুঝতে না পারে সে জন্য তুমি বলা শুরু করলাম। কিভাবে যেন এক মাস কেটে যায়। আর এক মাসে ওর সাথে স্বামীর অভিনয় করতে করতে সত্যিই ওকে আমার ভালো লেগে যায়। ঘর জামাই থাকলেও একি বিছানায় ঘুমাতাম না। মাঝে মাঝে ও শাড়ি পড়ত আর ও আমাকে ডাক দিত শাড়ির কুচি ঠিক করে দিতে। মাঝে মাঝে তিয়ানা ভুলেই যেত আমি ওর অভিনয় করা স্বামী।
.
রাতে তিয়ানা খুব গম্ভীর হয়ে বসে থাকতো। আমি বুঝতাম আদনানকে ভুলতে পারে নি। প্রায় নিশব্দে কান্না করত। আমার কাছে কেমন জানি লাগতো। তারপর ওকে আর গম্ভীর বা কান্না করতে দেখি নি। ভাবলাম সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ঐযে বলে না সময়ের সাথে সাথে মানুষ পুরাতন কে ভুলে নতুন করে বাচঁতে চায়।
.
একদিন অফিস ছুটির দিনে ওকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। যদিও যেতে চাই নি ওর মা বলাতে গিয়েছিলাম। ওর মা আমাদের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল অনেকটা, আমাকে প্রায় বলতো তোমরা কি আসলে স্বামী স্ত্রী? আমি কিছু বলতাম না, শুধু হাসতাম। সমুদ্র দেখে সন্ধ্যার দিকে যখন বাসার সামনে রিকশা থেকে নামলাম তখন একজন মহিলা আরেকজনকে বলতে লাগলো…
.
“এই এই দেখ এই ছেলেটাই ঘর জামাই। ঘর জামাই হয়ে কিভাবে থাকেরে বাপু? লজ্জা শরম কিছু নেই?
.
আমি শুনেও না শুনার ভান করলাম। তিয়ানা আমার দিকে তাকালো তারপর আমার হাতটা ধরে নিয়ে ঐ দুইটা মহিলার সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো…
.
“কি বলেছেন আমার স্বামীকে? দেখি আবার বলেন তো।
.
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম…
.
“বাদ দাও তো।
“কেন বাদ দিব? আমার স্বামীকে কেউ কিছু বলবে আমি চুপ করে থাকবো কেন?
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তিয়ানা কি বলছে? আমার কেন যেন এক অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভূতি তৈরি হলো। এরপর বাসায় এসেই ও আমাকে বললো নতুন ঘর নিতে। আমি কিছু বুঝলাম না। আমাকে কিছু বলার সুযোগ ও দেয় নি। যেখানে আমি তিয়ানাকে শর্ত দিতে পারতাম কিন্তু মনে হচ্ছে তিয়ানাই আমাকে শর্তের পর শর্ত দিয়ে রেখেছে। এমন একটা পরিস্হিতির মধ্যে পড়েছি যেন ও যেটা বলবে সেটাই করতে হবে। আর এই কারনেই এই নতুন বাসাটা নেওয়া। এই বাসাটা নিয়েছি ছয় দিন হলো মাত্র। আর যেহেতু আমি ব্যাচেলর থাকা অভ্যস্ত ছিলাম রান্না বান্না টুকটাক পারতাম। আমি নিজেই রান্না করতাম।
.
ক্রিং ক্রিং ক্রিং
.
দরজার কলিং বেলের শব্দ শুনেই দরজাটা খুললাম। প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। দরজাটা খুলতেই তিয়ানা দরজার ভিতরে ঢুকে বললো…
.
“তাড়াতাড়ি এটা পড়ে নাও তো।
“কি এটা?
“এতো আস্ক করো কেন? পড়তে বলেছি পড়ো।
“আচ্ছা তুমি আমায় স্বামীর অভিনয় করতে বলেছো। যেখানে আমি তোমাকে শর্ত দেওয়ার কথা উল্টো তুমি আমাকে কথায় কথায় হুকুম দাও কেন?
.
ও একটু হাসলো। তারপর বললো কি হলো ধরো।
.
আমি প্যাকেট টা খুলে দেখি একটা কালো পাঞ্জাবী।
.
“কি হলো পড়ো। এটা পড়ে চলো।
“কোথায়?
“গেলেই দেখতে পাবে।
.
দুজনে রিকশা করে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি আমি জানি না। বাসা থেকে যখন নিচে নামলাম তখন দেখলাম রিকশা। তারমানে এই রিকশা করেই তিয়ানা এসেছিল। প্রায় বিশ মিনিট পর একটা কাজি অফিসের সামনে থামায়। আমায় বললো ভাড়াটা দিয়ে দাও। আমি ভাড়াটা দিয়ে দিলাম। ভিতরে নিয়ে গেল। এর একটু পর বিয়ের পড়াতে লাগলো কাজি। আমি বললাম..
.
“কার বিয়ে?
.
কেউ কিছু বললো না। আমি আবার বললাম…
.
“তিয়ানা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
“অভিনয় করতে করতে ভালো লাগছে না। একেবারে পার্মানেন্ট করে নিচ্ছি বুঝছো?
.
আমি একটু অবাক হলাম। বলে কি এই মেয়ে?
.
“সাক্ষী কই?
“এই যে ভাড়া করে এনেছি।
.
আমি হাসলাম। তার মানে ও সকালে বের হয়ে এইগুলার আয়োজন করেছে। আমি ভাবতেও পারছি না ওকে এইভাবে আমি পাবো। বিয়ের পর ও আমায় সালাম করলো। আমার যে কেমন লাগছিল বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আবার রিকশায় উঠলো আর রিকশা ওয়ালাকে বললো…
.
“আগ্রাবাদ যান।
.
আমি একটু আশ্চর্য হলাম। বললাম…
.
“আগ্রাবাদ কেন?
“দরকার আছে।
.
আমি আর কিছু বললাম না। আগ্রাবাদ আসলেই রিকশা থেকে নেমে একটা বাসায় গেল। একজন মহিলা দরজা খুললো। তিয়ানা বললো…
.
“আদনান আছে?
“তোমরা আদনানের কি হও?
“আমরা আদনানের ফ্রেন্ড।
“আচ্ছা ভিতরে এসে বসো।
“না আন্টি বসবো না। ওকে একটু ডাক দিলেই হবে।
.
তারপর মহিলাটা ভিতরে গিয়ে আদনানকে পাঠায়। আমি কিছু বুছতেই পারছিলাম না। আদনান তিয়ানাকে দেখে বললো..
.
“আরে তুমি এখানে?
“কি অবাক হচ্ছেন ভাইয়া?
.
আদনান আমার দিকে একটু কেমন করে দেখলো। তিয়ানা বললো..
.
“ও হ্যাঁ পরিচয় করিয়ে দি আমার স্বামী জাহেদ। আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আসলাম ভাইয়া।
“আমি তোমার ভাইয়া?
.
আমার কেন জানি হাসি পাচ্ছিলো। তিয়ানা আমার হাতটা শক্তা করে ধরে আদনানকে বললো..
.
“ভাইয়া ভালো থাকবেন। নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন কেমন?
.
এইটা বলেই তিয়ানা আমাকে নিয়ে নেমে পড়লো সিড়ি দিয়ে। আমি শুধু অবাক হলাম। রাস্তায় এসে আমি চুপচাপ ওর পাশে হাটছি। ওকে বললাম “এখন কই যাবো” ও একটু চুপ করে থেকে বললো “খাব, তারপর ঘুরবো একদম রাতে বাসায় যাবো” আমি চুপ করে রইলাম। এর একটু পর ও হাটা থামিয়ে বললো.. এই শাড়ির কুচিটা কেমন যেন হয়ে গেছে ঠিক করে দাও তো। আমি হাসলাম, কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। সত্যিই কি আমি ওর পার্মানেন্ট স্বামী হয়ে গেলাম? মনে মনে বললাম মেয়ে তোমার শাড়ির কুচি ঠিক করে দেওয়ার জন্য একজন “তুমি” দরকার। আর সেই তুমিটা হলো তোমার পার্মানেন্ট স্বামী…

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত