(১)
“এই যে, নাও!” বলেই অণামি অর্কের হাতে একটুকরা কাগজ ধরিয়ে দিল। অর্ক বরাবরই মাঝারী স্বভাবের ছেলে।
খুব বেশী সাহসী যেমন নয়, তেমনি ভীতু ও নয়।
তবু অণামি নামক এই অদ্ভুত সুন্দরী,ঝাড়িবাজ মেয়েটার সামনে আসলে ওর হাঁটুদ্বয় জোর পায়না।
নিয়ণ্ত্রনহীন ঐচ্ছিক পেশী বনে যায়। আর বারবার পেছন ফিরে দৌড় প্রতিযোগীতায় নামার ইচ্ছে পোষণ করে!
“এটা… কী?” প্রশ্নটা শুনে, অণামি ভ্রু একটা তুলে তাকায়। আর অর্ক আরও বেশী কুঁকড়ে যায়।
“খুলে পড়ে দেখো, কী! জোরে জোরে পড়বা কিন্তু! নইলে….”
“নইলে….?” অর্ক প্রায় শোনা যায়না, এভাবে জানতে চাইল।
“হাঁটুর মালাই চাকতি দুটোই খুলে গলায় ঝুলিয়ে দিব। কই পড়ো!” অর্ক ধমক খেয়ে কাগজটা মেলে ধরল।
সুপারস্টোরগুলোতে কেনাকাটা করতে গেলে, বিলটা যেমন লম্বাটে কাগজে দেয়া হয়, এই কাগজটা ঠিক তেমনই।
পার্থক্য এটুকুই, এটা ওগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ লম্বা।
“আমার হবু স্বামীর প্রতি, বিবাহ পরবর্তী দায়িত্বসমূহঃ ….” অর্ক অণামির কথামত শব্দ করে পড়তে লাগল।
“দায়িত্ব নং ১ – সকালে নয়টার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার অভ্যেস নেই আমার।
আর ওঠা মাত্রই বেড টীর গন্ধ নেয়ার অভ্যেস। তার ব্যবস্থা যেন থাকে।
দায়িত্ব নং ২- আমি অতিঅবশ্যই কাজ করব, কিন্তু আমি একটা কাজ করলে স্বামী মহোদয়ের করতে হবে তিনটা কাজ…”
অর্ক আরও পড়তে যাচ্ছিল। অণামি ই তাকে থামালো। “হয়েছে, থামেন। বুঝছি, আপনি যে পড়তে পারেন।
বাকিটুকু বাসায় গিয়ে পড়লেই চলবে। পরশুর আগে যাতে এগুলো ঠোঁটস্থ হয়। নইলে দ্য প্রবলেম হ্যাজ।
আর এই লিস্টটা পরশু রাতে এইভাবেই আমাকে ফেরত দিতে হবে। নইলে…”
“নইলে….?” অর্কের গলারস্বর আগের চেয়েও মৃদু। জবাবে অণামি আঙ্গুল দিয়ে গলার নীচে পোঁচ দেয়ার ইশারা করল।
(২)
অণামির একগাদা রাগ হচ্ছে।সেই কখন থেকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে সং সেজে বসে আছে ও! অর্কের দেখা নেই।
মনে মনে নিজেকে একশ একটা লাথি কষায় সে। এরকম একটা বুদ্ধুকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল বলে।
বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে একটা আপেল আর ফ্রুট কাটার ছুরিটা তুলে নেয় অণামি। সময় কাটাতে আপেলের গায়ে নকশা আঁকতে থাকে।
(৩)
অর্ক অনেক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। অণামি যে ঘরে বসে আছে, তার দরজায়।
হাতে স্বামীর দায়িত্বসমূহ সম্বলিত কাগজ।
এটা অণামির দেয়া লিস্টটার নকল।
অর্ক কোন ঝুঁকিতে যেতে চায়নি।
সেদিনই বাসায় ফিরে লিস্টটায় নকল বের করে নিয়েছিল। মূলকপি আছে ঘরের ভেতর, সযত্নে ভাঁজ করে রাখা।
অর্ক কিছুক্ষণ সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিল।
তারপর কাগজটা পকেটে রেখে, লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিল।
দরজা আলতো করে ঠেলে ভেতরে পা বাড়াল। মাথার ভেতর তখন জানা-অজানা সূরা, দোআ-দরুদ আর দায়িত্বসমূহ আওড়ানো চলছে।
(৪)
অর্ককে দেখে অণামি হাতের ছুরি নাচিয়ে বসতে ইশারা করল। অর্কের পা-জোড়া আবার অনৈচ্ছিক পেশীর রুপ নিতে লাগল, নববধূর ভঙ্গীমায়।
“দায়িত্ব প্রথমটা বল।”
“দায়িত্ব নং ১- সকালে নয়টার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠার অভ্যেস নেই….” অণামিকে ভ্রু তুলে তাকাতে দেখে, অর্ক ভড়কে থেমে যায়।
“মিথ্যা বলতেছো কেন? আমি এত ফালতু কথা লিখতে পারি? লিস্ট আমার দেয়াটা খুলে দেখো!”
অর্ক সাইড টেবিল থেকে ভাঁজ করা কাগজটা তুলে নিল। মাথার ভেতর সূরা, দোআ-দরুদ আর কর্তব্য সব ততক্ষণে জট পাকিয়ে একাকার।
অর্ক কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে লাগল।
“আমার স্বামীর প্রতি, বিবাহ পরবর্তী দায়িত্বসমূহঃ
দায়িত্ব নং ১- আমার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস।
সূর্যের প্রথম আলো ছুঁয়ে দিয়ে বিড়বিড় করি, “বিয়ের পর বুদ্ধু বালকটার কাঁধে মাথা রেখে প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখব আমি। ”
তার ব্যবস্থা যেন থাকে!”
অর্ক অবাক চোখে অণামির দিকে তাকাল। মেয়েটাকে কেমন যেন আদুরে লাগছে। কিছুক্ষণ আগের সেই খুনে ভঙ্গীমা নেই এখন।
অণামি ছোটখাটো একটা হাই তুলে বলল, “পনেরো নংটা আওড়াওতো একবার!”
“দায়িত্ব নং ১৫- আমার জ্যোছনা অসম্ভব ভাল লাগে। কিন্তু কখনও জ্যোছনা পোহানো হয়নি।
ঠিক করে রেখেছি, বুদ্ধু বালকের সাথে প্রথম জ্যোছনা পোহাব। বুদ্ধুটা আমাকে “চন্দ্রমানবী” ডাকবে। অবশ্য মনে মনে।
আর তা টের পেয়ে আমি বলব, “এ্যাই ভীতুর ডিম, এত্ত ভয় পাও কেন? আবেগ কখনও লুকিয়ে রাখতে নেই।
কী হয়, ভালবাসি- বলে ফেললে?”” অর্ক কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অণামি তখন উদাস ভঙ্গীতে জানালার বাইরে তাকিয়ে।
(৫)
আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চারপাশ চাঁদের আলোয় যেন ভেসে যাচ্ছে।
অণামি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে, আর দু’হাত দিয়ে জ্যোছনা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। পেছন থেকে অর্ক তাকে জড়িয়ে ধরল।
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “ভীষণ ভালবাসি, চন্দ্রমানবী!”
অণামির চোখে জল জমছে। বুদ্ধু বালক এত্ত সাহসী হলো কী করে হঠাৎ???