–এই উঠ বলছি, উঠ! সারারাত জেগে জেগে দুষ্টমি করবি, ভোর হলেই আমায় রান্নাঘরে যেতে হবে, আর তুই নাক
ডেকে ঘুমাবি? এটাতো হতে পারেনা।
উঠ বলছি….
–সোনাপাখি, ঘুমাই না আর একটু!
–একটুও ঘুমাতে পারবিনা, রাতে আমায় ঘুমাতে দিসনা, আমি সকালে তোকে ঘুমাতে দেবনা।
.
আরমান বালিশে মুখ চেপে বলছে—
–কাল থেকে আর দুষ্টমি করবো না। এবার একটু ঘুমাতে দে,
–তুই প্রত্যেক সকালেই এই কথা বলিস, রাত হলেই সব ভুলে যাস!!
–বললামতো কাল থেকে তারাতারি ঘুমিয়ে যাবো,
–কঁচু ঘুমাবি, তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তোর এই কথা আমি এর আগেও অনেক শুনেছি। আর চলবেনা। উঠ, উঠ
বলছি……
(আরমানের কলার ধরে টানতে লাগলো নাবিলা)
–ok, উঠছি….
.আরমান বিছানার উপর উঠে বসলো একটু
নিশ্বাস টেনে বলল—
–এই কি ব্যাপার পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে?
.
নাবিলা অনুভব করার জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।আরমান হঠাৎ করেই বলে উঠলো—
–দৌড় দাও, দৌড় দাও, তোমার তেলাপিয়া মাছ পুরে গেল।
.
নাবিলা কথাটা শুনেই দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। হাজার হলেও নিজের প্রিয় মাছ বলে কথা। এটাকে একটুও কমবেশি
ভাজা যাবেনা। একদম পার্ফেক্ট হতে হবে। আর এদিকে দুষ্ট আরমান কাঁথামুরি দিয়ে আবার গাপ্পি মেরে শুয়ে পরলো।
নাবিলা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো সব ঠিকঠাক আছে। মুহূর্তের মধ্যেই মাথায় ধরলো। আরমান তাকে বোকা বানিয়ে
পাঠিয়ে দিছে। আবার দৌড়ে গিয়ে আরমানের উপরে পরে গেল। কাঁথা শরিয়ে আরমানের উপরে বসে গলা চেপে ধরে বলতে
লাগলো—
–তুই আমায় বোকা বানালি ক্যান, হুম? আমি কি বোকা নাকি? তুই বোকা,
তোর চৌদ্দগোষ্ঠী বোকা! আমি কি বোকা নাকি?
.আরমান চাপা গলায় বলতে লাগলো—
–আচ্ছা আমি বোকা, এইবার গলাটা ছাড়ো।
.
নাবিলা আরমানের গলা ছেড়ে দিলো। আরমান
বলল—
–এভাবে কেউ কারো গলা চেপে ধরে, আর একটু হলেই তো উপরে চলে যেতাম!!
–কিভাবে উপরে যাবি বল? আমিযে তোর উপরে ভার দিয়ে বসে আসি সেটা দেখতে পাচ্ছিস না?
–হুম তা তো পাচ্ছিই, মুটকিটা যে আমার উপরে বসে আছে। সেটা আমার নিশ্বাস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
–তুই কি ছুটকু, আমায় মুটকি বলিস!!
.
আরমান একটু ঘুরান দিয়েই নাবিলা কে পাশে
শুয়িয়ে ফেলল। দিকটা এখন বিপরীত আরমান নাবিলার উপরে শুয়ে আছে। আরমান
বলল—
–এখন কি হবে?
.
আরমান প্রথম থেকেই চোখের পাতাটা টেনে আছে। নাবিলা বলল—
–খরবদার! তুই কিন্তু আমায় পাপ্পি দিবিনা!
–বয়েই গেছে তোকে পাপ্পি দিতে, রাক্ষুসী আমার আরামের ঘুমটা-কে হারাম না করলে বুঝি তোর চুলায় জ্বাল জ্বলেনা?
–হুম ঠিক তাই, আমায় যেতে দাও আমার তেলাপিয়া মাছ পুরে যাবে।
–আহারে, কত সাধের তেলাপিয়া মাছ আমার!! বাজার থেকে আর যদি কোন দিন তেলাপিয়া মাছ নিয়ে আসি, সেদিন বলিস!!
–এখনই বলছি, তেলাপিয়া মাছ বাসায় না আসলে, তোরও বাসায় আসার দরকার নেই।
–মানে?
–খুব সোজা, ভাল করে ভেবে দেখ!
.
আরমানকে ধাক্কাদিয়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেল নাবিলা।আরমান গোসলখানায় ঢুকে পরলো। গোসল সেরে খাবার টেবিলে বসে
রইলো আরমান। নাবিলা ও ফ্রেস হয়ে আরমানের সাথে টেবিলে বসে পরলো। চ্যপা সুটকি আর আলু ভর্তা দিয়ে আরমানকে ভাত বেড়ে
দিলো। আর নাবিলা নিজের প্লেটে মসমসে একটা ভাজা তেলাপিয়া মাছ নিয়ে বসলো। আরমান বলল—
–এইটা কি হলো?
–কি আর হবে! তুই বললি আর তেলাপিয়া মাছ আনবিনা। তাই, আমাকে অল্প অল্প করেই অনেক দিন খেতে
হবে। তাই তুই সুটকি আর আলু ভর্তা দিয়েই খা….
–তারপর, এগুলো খাওয়া শেষ হলে?
–ফ্রিজের গুলা দিয়ে দের মাস চলে যাবে,
.
আরমান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নাবিলার দিকে। এত্তো পাগলামী এই পাগলীটার মাঝে। আরমান আর কোন কিছু
না বলেই খাওয়া শুরু করলো। আরমান খেয়াল করলো নাবিলা না খেয়ে হাত দিয়ে শুধু ভাত মাখিয়েই যাচ্ছে। আরমান জিজ্ঞাস
করলো—
–কি হলো, এতো স্বাদের মাছ দিয়ে ভাত না খেয়ে মাখাচ্ছিস কেন?
–তুমি আমায় খায়িয়ে দে…….
–আমার বয়েই গেছে তোকে খায়িয়ে দিতে!
–ওকে, তাহলে আমি খাবোনা!!
–না খেলে আমাকে দাও, আমি খেয়ে ফেলি।
–না,
–কি না?
–তুই আমায় খায়িয়ে দিবি এখন,
.
নাবিলা আরমানের প্লেটে সব ভাত, ভাজা মাছ ঢেলে দিলো।
–কি হচ্ছে এসব!
–আজ থেকে একটা প্লেটেই দুজনকেই খেতে হবে!
–তুই বললেই হলো নাকি? আমি তোর সাথে খাবোনা, আর খায়িয়েও দিতে পারবোনা।
–একশ বার দিবি, বাসায় আমি যা বলি সেটাই করতে হবে।
–কেন?
–কারণ আমি হচ্ছি ‘হোমমিনিস্টার’
–ও তাই, হোমমিনিস্টার বলেই বুঝি রোজ সকালে রান্নাঘরে দৌউড়াও!!
–হুম, আমার নিজের কর্তব্য গুলো আমিই করি। অন্য কেউ করবে বলে আমি ফেলে রাখতে পারিনা।
–তা, বিয়ের আগে তাহলে এসব মায়ের উপর ফেলে রেখেছেন কেন ম্যাটাম।
–ঐ ম্যাটাম বলিস ক্যান, বল ম্যাডাম, ম্যাডাম,
–ওহ্! sorry ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে। তা এখন এই খাবার গুলো আপনার ‘ফুডমিনিস্টার’ কে খায়িয়ে দিতে বলেন! আমাকে না।
–তুইতো ‘ফুডমিনিস্টার’
–আমার বাপদাদা কেউ কোনদিন মিনিস্টার ছিলোনা। এই দেশে মিনিস্টারের ছেলে-মেয়েই মিনিস্টার
হয়। আর সেটা তুই ভালো করেই জানিস। অতএব, আমি ফুডমিনিস্টার না।
–এই শোন তুই কিন্তু কথায় কথায় একটা করে উপমা বের করবি না।
–উপমা কি, যা সত্য তাই বললাম।
–আমার কিন্তু ক্ষুদা পাইছে,
.
আরমান আর কথা না বাড়িয়ে পাগলীটার মুখে খাবার তুলে দিলো। আরমান নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছে, নাবিলার মুখের
ভিতরের খাবার গুলো চিবাতে চিবাতে আরমানকে চোখটিপ মেরে বলল—
–এইবার কে খায়িয়ে দিলো, হুম!
–রাক্ষুসী, চুপ করে খা… একদম কথা বলবিনা।
.
এভাবেই দুজনের দিনের শুরু। তারপর আরমানের অফিস, আর টুনটুনিটার শ্বাশুরীর সাথে সিরিয়াল দেখে সময় কাটিয়ে
দিনপার। ভালবাসার স্বপ্ন গুলো মানুষ এভাবেই এঁকে রাখে। ঠিক এমনটাই হয় হৃদয় বন্ধনের সব সম্পর্ক। ভালবাসার
প্রতিটি মানুষকে ভালো রাখার জন্য এই শহরে আরমানের মতো শত আরমান আছে যারা জীবিকা অর্জনের জন্য ছুটে বেড়ায়।
আর নাবিলার মতো শত নাবিলা আছে যারা শ্বাশুরীমাটাকে নিয়ে সংসারটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে আলোকিত করে রাখে।
সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে অফিস শেষে যখন আরমান বাসায় ফিরে। পাগলীটার একটুকরো হাঁসি সমস্ত ক্লান্তি দূর
করে দেয়। নতুন কোন প্রান ফিরে পাবার মতোই। আজ বাসার পাশেই বৈশাখী মেলা। মরিচাবাতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মিউসিক্যাল
লাইটিং দিয়ে সাজানো হয়েছে। নাগর দোলার শব্দটা রুমের বাইরে এলেই শোনা যাচ্ছে। বাসার পাশ দিয়েই ছোট ছোট বাচ্চারা বাঁশি বাঁজাতে বাঁজাতে দৌড়ে
চলেছে। আরমান সেসব দেখে নাবিলা-কে
বলল—
–মেলায় যাবি?
–তো যাবো না তো এভাবে সেজে আছি কেন? নাকি আমি সাজলে এখন তোর চোখেই পরে না!!
–হা হা হা
–একদম দাঁত কেলাবি না, তারাতারি খেয়ে নে, ধূর! এমনিই কত দেরি হয়ে গেল।
.
আরমান খাওয়া শেষ করে পাগলীটাকে নিয়ে মেলার উদ্দেশ্য করে রওনা দিলো। নাবিলা আজ লাল ব্লাউজের সাথে
হালকা আকাশী রঙের কাপর পরেছে। পাশে হাটতে হাটতে লুকিয়ে লুকিয়ে নাবিলা কে আরমান দেখে যাচ্ছে। ঘরের
বউটাকেও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার মাঝে অন্যরকম ভাললাগা মিশে থাকে। নাবিলা সেটা ঢের খেয়াল করছে। হঠাৎ
করে আরমানের সামনে এসে নাবিলা দাঁড়িয়ে বলল—
–নে দেখেনে, ভাল করে দেখেনে, তারপর হাট? মনে হয় জীবনে কোনদিন আমায় দেখিস নি!!!
–মানে?
–পাশ থেকে যে তুই বার বার টেরাই চোখে চাচ্ছিস, সেটা মনে করেছিস আমি বুঝতে পারিনা!!
–আহা! মরে যাই, তোকে দেখতে বুঝি আমার রাত দুপুর লাগে?
–তো দেখিস ক্যান?
–আমি হলাম কানের দুলটা দেখলাম,
–তো আমার কানের দুল দেখবি ক্যান?
–ঠিক আছে দেখবো না,
.
আরমান মাথানিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঠছে। আশে পাশের কোন কিছুই আরমান তাকিয়ে দেখছে না। নাবিলা সেটাও
খেয়াল করছে। মেলার সম্মুখি এসে পরেছে দুজন। নাবিলা আরমানের হাতটা বরাবরের মতো আকরে ধরলো। মেলার
মাঝে দুজনে প্রবেশ করলো। মনোহারী হাজার জিনিস দিয়ে ভরা। ঝালমুড়ি, চটপটি, গরম পিঁয়াজু খেতে খেতে সমস্ত
মেলা হাত ধরে ঘুরে বেড়ালো দুজনে। নাবিলার লাল রেশমি চুরি, আর নতুন কনের দুল কেনা এরমধ্যেই শেষ।
নাগরদোলার সামনে দুজন দাঁড়িয়ে রইলো। আরমান উঠতে চাইলেও নাবিলার আর সাহস হয়ে উঠেনি। সেখান থেকেই
বাসায় ফেরা, হয়ে গেলো আরমান-নাবিলার মেলা ঘুরা।
.
ভালবাসা প্রত্যেকটি মানুষকে বাঁচতে শেখায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। স্বপ্নিল কিছু স্বপ্ন নিয়ে সামনে
আগাতে শেখায়। মনে রাখবেন যে মানুষটি ঢোল বাজাতে পারে, সে মানুষটি মাটির কলসিতেও সুর তুলতে পারে।
ভালাবাসাটাও ঠিক এমন। যে ব্যক্তিটি ভালবাসতে জানে সে শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও ভালবাসতে জানে, সুখ-শান্তির
মাঝেও ভালবাসতে জানে। ভালবাসা শুধুই ভালবাসা…
.