“এত তারাতারি বিয়ে করার কোন ইচ্ছায় ছিল না। সবে মাত্র মাষ্টার্স ১ম বর্ষে পড়াশোনা করছি। ভার্সিটি, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরি বিন্দাস চলছিল। হঠাৎ কেন জানিনা বাবা-মায়ের তোড়জোর শুরু হয়ে গেল। আমাকে বিয়ে করাবে। ছেলের বউ, নাতি-নাতনীর মুখ দেখবে। ব্যাস! কি আর করার……
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে তাদের এই আশা-স্বপ্ন পূরণ করা আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য হিসেবে রাজি হয়ে গেলাম। না হলে, এত তারাতারি বিয়ে করে খোয়াড়ে ঢোকার কোন ইচ্ছায় ছিল না আমার।
আজ আমার বিয়ের রাত। অর্থাৎ বাসর রাত। বিয়ে করে বউ এনে ঘরে তুলেছি। বিয়েটা তেমন জাকজমক করে হয়নি। কারণ জাকজমক আমার পছন্দ না। পারিবারিক কিছু আত্বীয় আর দু-একজন বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করা হয়েছিল। মেয়ে আগে থেকেই বাবা-মায়ের দেখা ছিল। সুধু কথা পাকা করে তারপরে বিয়েটা হয়ে যাওয়া বাকি ছিল, সেটাও হয়ে গেল……
যাই হোক, প্রতিটা গল্পের মত আমিও বাসর ঘরে ঢুকলাম অনেক রাত করে। তখন ঠিক রাত ১২:৩০ টা বাজে। ঘরে ঢুকে দড়জা দেয়ার পরে কি করব? বুঝতে পারছিলাম না। খাটে বউয়ের পাশেই বসব, নাকি সোফায় বসব সেটাই ভাবছিলাম। হঠাৎ মেয়েটা (বউ) বলে উঠল……
—-দেখুন, আপনাকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছায় আমার ছিল না। মূলত আমার এখন বিয়ে করারই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু, বাবা-মায়ের তোড়জোরে মানা করতে পারি নি তাই রাজি হয়েছি। কিন্তু আপনি মোটেও আমার সাথে স্বামী গিরি দেখাতে আসবেন না……
মেয়েটি একদমে এতগুলো কথা বলল! আমি বাস, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যেন কিছুই বুঝতে পারি নি……
সে আমার দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে বলল……
—-এই মিঃ, কি হল?
আমি হাসি মুখে বললাম,
—-যাক, বাচা গেল!
—-মানে?
—-মানে হল গিয়ে আমিও এখন বিয়ে করতে চাইছিলাম না। ভালোই হল আপনার মত কারো সাথে বিয়ে হয়ে।
—-ওহ্! আসলে আমার একটা স্বপ্ন আছে। সেটা হল অনার্স শেষ করার পরে আমি বিদেশ গিয়ে ডিগ্রি নেব। সেখানে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। ওর সাথে সেখানেই থাকব!
—-ওকে, আমি আপনাকে হেল্প করব! তবে, আপনারও কিছুটা অভিনয় করতে হবে, যেন বাইরের কেউ এটা না বুঝতে পারে……
—-ওকে, বাই দা ওয়ে আমরা নতুন করে পরিচিত হয়ে বন্ধু হতে পারি?
—-অবশ্যই, আমি রাজ। মাষ্টার্স ১ম বর্ষ, সাথে ছোট একটা জব করি……
—-আমি রিফা, অনার্স ৩য় বর্ষ।
মেয়েটা ওর হাত মুঠো পাকিয়ে ঘুসির মত করে এগিয়ে দিল। আমিও দিলাম, হাতে হাতে টুকা লাগল। দুজনে ছোট করে মুচকি হাসি দিলাম।
আমরা একই বেডে ঘুমালাম। কিন্তু মধ্যো কোলবালিস রেখ………
ভালোই চলতে লাগল আমাদের স্বামী-স্ত্রী নামক বন্ধত্বের সম্পর্ক। খুব ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাইরে থেকে কারো কোন কিছু বোঝার উপায় নেই। বাবা-মা তো দূরে থাক, আমি নিজেই মাঝেমধ্যো ভুল করতাম! আসলেই ও আমার স্ত্রী? নাকি সুধুই বন্ধু? দারুণ কনফিউশন!!
ওর বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে জানতে চাইলে কেমন আমতা আমতা করত! ঠিক ভাবে কিছু বলত না। সুধু বলত আছে, মাঝেমধ্যো নাকি কথা হয়! কিন্তু আমার চোখে কখনো কথা বলতে শুনি নি। আমি ধীরে ধীরে ওর প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। ভালবাসতে শুরু করি। কিন্তু ওকে বুঝতে দেইনি।
একদিনের ঘটনা। আমি বাথরুমে ফ্রেশ হচ্ছিলাম। হঠাৎ এক মেয়ে কলিগের ফোন। বলা বাহুল্য, সেই মেয়েটা আমার প্রতি দুর্বল ছিল। ফোনটা রিফা রিসিভ করে। জানিনা কি কথা হয়েছিল, যখন রুমে আসলাম……
—-মেয়েটা কে?
—-কোন মেয়েটা?
—-ফোন দিয়েছিল, নাদিয়া না কে যেন?
—-ওহ্! নাদিয়া। আমার অফিসের কলিগ……
—-সুধুই কলিগ? নাকি অন্য কিছু?
রিফা প্রশ্নগুলো এমন ভাবে করছিল, যেন কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে জবাব চাইছে……
—-না, সত্যিই সুধু কলিগ……
রিফা হঠাৎ হেসে বলল,
—-মেয়েটার কণ্ঠটা কিন্তু ভালোই! অন্য কিছু হলে আরো ভালো হত……
আমি মূহুর্তেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম………
এর কিছুদিন পরে, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি রিফা বাথরুম থেকে গোসল করে চুলগুলো মুছতে মুছতে মন ভার করে আমার দিকে অাসছে………
আমি ঘুম ঘুম চোখে চোখ কসলাতে কসলাতে বললাম……
—-গুড মর্নিং……
রিফা একটু সিরিয়াস হয়ে বলল……
—-আসলে কি জানেন? আপনাদের ছেলেদের কখনো বিশ্বাষ করতে হয় না। আপনাকে বন্ধু ভেবে বিশ্বাষ করে, একই বেডে ঘুুমাতাম, আর আপনি কিনা……
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম…
—-মানে?
—-মানে বুঝেন না? তাইনা?
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ্ তেমন কিছু মনে পড়ছে না……
হঠাৎ রিফা হাসতে হাসতে বলল,
—-কি ভয় পেয়ে গেলেন? আসলে তেমন কিছুই না! আপনি তো আমার লক্ষী বিশ্বাষী একটা বন্ধু, আসলে আজকে একটু বাইরে যাবো তো! তাই……
রিফা ওর দুহাত দিয়ে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে মুছকি হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। আমি তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম……
দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় কেটে গেছে, বুঝতেই পারিনি। ওর অনার্সের এর রেজাল্ট দিয়েছে। ও ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে। এখন ওর স্বপ্নপূরণের জন্য বিদেশ যাবে। আজকে সেই দিন। বাবা-মাকে বুঝিয়ে, নিজের কষ্ট লুকিয়ে ওকে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল। এর ভিতরে ওকে এতটা ভালবাসব? বুঝতে পারিনি। আবার এখন কিছুতেই বলতে পারছি না। যাবার পখে ও বার বার বলছিল,
—-আমাকে তোমার কিছু বলার আছে কি? থাকলে বলে ফেল, আর সুযোগ পাবে না।
আমি বারবার বলছিলাম………
—-নিজের খেয়াল রেখ, পড়াশোনা শেষ হলে তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে একবার বেরুতে এসো। আমাকে নিয়ে ভেব না। বাবা-মাকে ঠিক মানিয়ে নেব।
কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কেউ একজন যেন গলা চেপে ধরছিল। তবুও বলছিলাম। ও আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি ওর দিকে তাকায় নি। যদি বুঝে ফেলে?
ওকে ছেড়ে এসে খুব কান্না পাচ্ছিল। দড়জা জানালা বন্ধ করে খুব চিৎকার করে কাদলাম। সন্ধ্যার পরে বাসার ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাদছিলাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছিল।
কতক্ষণ কেটে গেছে, জানিনা। হঠাৎ পিছন থেকে কাউকে জড়িয়ে ধরাটা টের পেলাম। সে যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে! আমি ঘুরেই বুঝতে পারলাম রিফা। ঘুরতেই ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাদছিল, আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছিল, আমি টের পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম……
—-এই পাগলি মেয়ে, কি হয়েছে? ফ্লাইট মিস?
ও বুকের ভিতরেই মাথা নাড়ল?
আমি বললাম……
—-তাহলে?
—-আমার মনকে মিস করছিলাম। কোথাও খুজে পাচ্ছিলাম না।
—-মানে?
—-বুদ্ধ, নিজে কষ্ট পাবে, আমাকেও কষ্ট দিবে, তাইনা? ভালবাসি বলতে পার না?
—-তোমার বয়ফ্রেন্ড? বিদেশী ডিগ্রি?
—-আমার তো কোন বয়ফ্রেন্ডই নেই! সেদিন এমনি বলেছিলাম। আর এখন বিদেশী ডিগ্রীর প্রয়োজন নেই। তোমাকে পেলেই হবে। বিদেশ তো যাবো! তবে ডিগ্রির জন্য না, হানিমুনের জন্য……
আমি ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এবার সুখে কেদে ফেললাম। রিফাও কাদছিল, তখন আকাশে বাকা চাদ আর অসংখ্য তারারা যেন হাসছিল………