কথকতা

কথকতা

তনিমা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে সানভির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সানভির সামনে দাঁড়ানোটা কোনো সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা। ওদের দুজনের দেখা করার জায়গাটা হচ্ছে জেলখানা। কারণ সানভি একজন আসামী। যে সে আসামী নয়, খুনের আসামী। তবে এটা যে মিথ্যা তা তনিমা ভাল করেই জানে। শুধু জানেনা কেন সানভি নিজে এই দায়টা নিল। অবশ্য সে জানতেও চায়না। সানভি পাড়ার সবচেয়ে বড় বখাটে, গুন্ডা। এই খুনটা সে করেনি কিন্তু অন্যদিন হয়তো করত। এটা অবশ্য তনিমা মুখের কথা। আসলে সে জানে সানভি যতই গুন্ডামি করুক; খুন সে করতে পারবে না। এতটা সাহস তার নেই। তনিমা অবশ্য আরো একটা কথা প্রায়ই সানভিকে মনে করিয়ে দিত যে সে সানভিকে সহ্য করতে পারেনা। বলাই বাহুল্য যে এটাও তনিমার মুখের কথা। অবশ্য সে যে সানভিকে খুব পছন্দ করে তাও নয়। তনিমা শুধু ভাবে যে এরকম একটা মানুষকে যদি সারাজীবনের জন্য পেতাম। যে সারাদিন বাইরে ঘুরাঘুরি করবে আর রাতে আসলে রাগ করে থাকা তনিমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে। তনিমা যতই তার সাথে চেঁচামেচি করবে ততই সে হাসবে। আর এক সময় পকেট থেকে একটা বেলী ফুলের মালা বের করে তনিমার খোঁপায় পড়িয়ে দেবে। তবে এসব ভেবেই একেকবার নিজের ওপরই খেঁপে যায় তনিমা। কেননা সে যা যা ভাবে তার সবই আছে সানভির মাঝে। সানভিও তাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু ওকে দেখলেই কেমন যেন খেঁপে যায় তনিমা। তবে মাঝে মাঝে সানভিকে দেখে মনে হয় যাকে খুঁজছে সে হয়তো সানভিই। এই কথা মনে পরার সাথে সাথে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় ওর। সানভিই যদি সেই ছেলে হবে তাহলে ও আফনানকে ভালবাসে কেন। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তনিমা আফনানকে ভালোবাসে না। এটা শুধুই ভাললাগা। নয়তো সানভির প্রতি এই টান কিসের। শুধুই পরিচিত তাই। শুধুই কি ঘৃণা তার সানভির প্রতি। যদি তাই হবে, তাহলে সে আজ এখানে কেন? যেই জায়গাটাকে সে এত অপচ্ছন্দ করে আজ সানভির জন্য সেখানে কেন দাঁড়িয়েছে? কি কারণে, কি আকর্ষণে? আফনানের সাথে ঝগড়া হওয়ার পর থেকে তনিমার মন খারাপ। কেন বার বার মনে হচ্ছে সানভির কাছে গেলেই তার সমস্ত মন খারাপের অবসান হবে? আজ তিনদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করার  পর সে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে; সানভির সামনে। কিন্তু কি বলবে সানভিকে? ও শুধু চেয়ে দেখে সানভিকে।

-“কি শেষবারের মত দেখে নিচ্ছ?” সানভির কথায় বাস্তবে ফিরে আসে তনিমা। সানভির কথাটা বুঝতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগে ওর। তাও বুঝতে না পেরে শেষটায় প্রশ্ন করে,

– “মানে?”

– “না জানার ভান করছ কেন তনিমা? বলল সানভি।”

– “আপনার সাথে ভান করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।  আর আমি তা করছিও না। আপনি সেটা ভাল করেই জানেন।”

-“তুমি সত্যিই কিছু জানোনা?”

– “আমি আপনাকে মিথ্যা কেন বলব? কি হয়েছে সেটা বলুন।”

– “কি হবে শুনে?”

– “তাহলে বলার দরকার নেই। কেমন আছেন বলুন?”

– “আছি কোনোরকম, জেলে থাকলে মানুষ কেমন থাকে জানোনা?”

– “কি করে জানব আমি তো কখনো আপনার মতো কাউকে খুন করিনি, আর তাই জেলেও থাকিনি।”

– “তাও অবশ্য ঠিক। হঠাৎ এখানে আসলে যে?”

– “কেন আবার আপনাকে দেখতে। মামা খুব করে আসতে বলছিল তাই।”

– “তোমার ইচ্ছা ছিলনা? তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কখনও কোন কাজ করো না।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তনিমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল,

– “আপনার সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। শুধু মামা বলেছে বলে আমি এসেছি।”

সানভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– “কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে দেখার।”

– “কেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইল তনিমা।

– “এটার উত্তর কিন্তু তুমি ভাল করেই জান।”

– “হুম জানি।” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল তনিমা। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগল, “কিন্তু যে কারণে আপনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন, আমাদের সম্পর্ক তার পুরো উল্টো। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু আমি আপনাকে ঘৃণা করি।”

– “কারণটা কি তা জানতে পারি? যদিও আমি জানি কি কারণ, তাও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

– “কারণটা হচ্ছে আপনি একজন গুন্ডা। এলাকার শীর্ষ বখাটে। নষ্ট ছেলেদের লীডার। এবং সবশেষে আপনি একজন খুনি।” বেশ জোরের সঙ্গেই বলে তনিমা।

– “তাহলে এই খুনিটাকে দেখতে এসেছ কেন?”

– “কারণটা আপনাকে আমি আগেই বলেছি।”

– “আমি সত্যিটা জানতে চাই তনিমা। আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। আর আমি কারণটাও জানি।”

– “যদি জানেন তাহলে আবার প্রশ্ন করছেন কেন?” রেগে গিয়ে বলে তনিমা।

– “ঠিক আছে বলা লাগবে না। শুধু এটা বল আফনান কেমন আছে। ঝগড়ার রেশ কেটেছে দুজনের?”

তনিমা অবাক হয়ে সানভির দিকে তাকিয়ে রইল। ঝগড়ার কথা ও জানল কেমন করে? অবাক না হওয়ার ভাব করে বলল- “আফনান কবে এসেছিল এখানে? কি বলেছে?”

– “কাল এসেছিল। আর সে যাই বলুক না কেন তা জেনে তোমার কি?”

– “আমার অনেক কিছু কারণ সে যা বলেছে তা নিশ্চয়ই আমাকে নিয়েই বলেছে।”

– “তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ?”

– “সে জেনে আপনার কি লাভ?”

– “লাভ কিছুই নেই, তবে কথাগুলো আমাকে বলেছিল কিনা, তাই কারণ জানতে চাচ্ছি।”

– “আমি ওর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছি। তাই।”

– “কেন? তুমি না ওকে ভালবাসো?”

– “না আমি ওকে ভালবাসি না।”

– “তাই ! তাহলে এত দিনের সম্পর্ক?”

– “সেটা একটা ভুল ছিল। আমি আপনাকে এই সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাইনা। শুধু এটুকু বলে রাখি আমি ওকে ভালবাসি না। ও আমার সাথে এমন কিছু করেছে যার জন্য আমি সারাজীবন ওকে ঘৃণা করব আর অভিশাপ দিব।”

– “বাদ দাও ওসব কথা। দিনকাল কেমন চলছে তোমার?”

– “ভালোই। কারণ কোনো রাস্তা আটকে রাখার মতো লোক আর নেই। নেই অযথা যন্ত্রণা করার মতো কেউ।”

সানভি প্রশ্ন করল- “আমার কথা বলছ?”

তনিমা কোনো উত্তর দিলনা।

সানভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটা তাকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই করেনি। অথচ এই মেয়েটাকেই ও কত ভালবাসে।

তনিমা বলল, “সানভি আমি যাচ্ছি, কাল আবার আসব।”

– “আমি জানি তুমি আসবে।”

-“কিভাবে?”

– “সেটা কালকেই জানতে পারবে। শুধু একটা কথা রাখবে”

– “কি?”

– “চেষ্টা করো আর না আসার।”

তনিমা সানভির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বের হয়ে যায়।

**** তনিমা শেষ পর্যন্ত সানভির কথা রেখেছে। আর কোনোদিন জেলখানায় যায়নি ও। বলা যায়, যাওয়ার দরকারও হয়নি। কেননা যেদিন তনিমা প্রথম বা শেষবারের মতো জেলখানায় যায় সানভিকে দেখার জন্য সেদিন রাতেই সানভির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সানভির মৃতুত্যে কারো তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। তনিমারও না। তবে প্রতিবছর এই দিনটিকে তনিমা একাকী কাটায়। কেন তা কেউ জানে না।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত