ক্লাস করে বের হবো মাত্র এমন সময়ে ঝুম বৃষ্টি নামলো । সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি আকাশ প্রচণ্ড কালো । মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে ।আবার থেমে যাচ্ছে ।এমন দিনে সকাল আটটা বাজে সজীব স্যার এর ক্লাস ।
সামান্য দেরী হলেই পারসেন্টিস দেয় না । তাই তাড়াহুড়ো করে ছাতিটা আনতেই ভুলে গেছি । আমরা যারা ছাতি আনিনি তাদের মধ্যে দু গ্রুপ তৈরি হলো । দাঁড়িয়ে থাকা গ্রুপ আর স্বেচ্ছায় বৃষ্টির হাতে আত্মসমর্পণ গ্রুপ । পরের গ্রুপটিতে দু তিনজন ছাড়া আর কেউ আগ্রহ দেখালোনা । অনেকে মাথার উপরে ব্যাগ দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে । আমি ধীরে ধীরে বৃষ্টির মধ্যেই হাটা শুরু করলাম । সরাসরি হলে যাবো নাকি ক্যাফেটেরিয়ায় যাব ভাবছি । অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাফেটেরিয়া থেকে এক কাপ গরম কফি খেয়ে যাবো । ক্যাফেটেরিয়ায় তেমন মানুষ জন নেই । পিছনের দিকে এক জোড়া কাপল ল্যাপটপে সম্ভবত কিছু দেখছে । আর একজন জানালার
পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে শিঙাড়ার শেষ অংশটুকু হাতে ধরে । আমি কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছি । পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফেইসবুকে লগইন করলাম । না কেউ ম্যাসেজ দেয় নি । দুই একটা নোটিফিকেশন চেক করলাম ।
হোম পেইজে নতুন একটা ভালোবাসার গল্প দেখলাম । হায়রে ভালোবাসা ! মাঝে মাঝে একটা হাতের এতো প্রয়োজন অনুভব করি কিন্তু সেই হাত বাড়ানোর কোনো মানুষ নেই । এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেছি ।
কফি খাচ্ছি আর গল্প পড়ছি তাই আশেপাশের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম । হঠাৎ পানির ছিটায় আবার বাস্তব জগতে ফিরে আসলাম । আমার খুব কাছে দাঁড়িয়েই দুইটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো । কোন কারনে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে গ্লাস থেকে পানি ছিটিয়ে মারতে গিয়ে আমার গায়ে মিস টার্গেট করলো । কখন আসলো এরা ? আমার গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়ার পর পুরো গ্রুপটা চুপ হয়ে গেলো ।
যে মেয়েটি পানি ছিটিয়েছিল ,বসে ছিলাম বলে তাকে এতক্ষন ঠিক মতো দেখতে পারছিলাম না । মেয়েটি আমার সামনে এসেই খুব অনুনয় করে সরি জানালো । মেয়েটাকে দেখে আমি অনুভূতি শুন্য হয়ে গেলাম ।
মানুষ এতো কিউট হয় কিভাবে !লাল ফ্রেমের চশমা পরা ।কার্ভ চুল । ফ্যানের বাতাসে চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বারবার ওর মুখের উপর আছড়ে পড়ছে । মেয়েটি আমার কাছে শুনতে চাচ্ছে
” ওকে । ঠিক আছে ।সমস্যা নেই ” এমন কিছু । কিন্তু আমি কিছুই না বলে হা হয়ে তাকিয়ে আছি ।কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর যখন ওরা বুঝলো যে আমি কিছুই বলবনা তখন ওরা নিজেরাই লজ্জায় ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়ে গেলো । আমি কি খুব অদ্ভুত একটা কাজ করে ফেললাম । মিনিমাম ” ইটস ওকে ” টাইপ একটা ছোট রিস্পন্স দিলে কি হতো !
আমি একা একা হাঁটতে অনেক পছন্দ করি । আগে কোন উদ্দেশ্য থাকতো না । এখন সেই কার্ভ চুল ,লাল ফ্রেমের চশমা পরা মেয়েটিকে দেখার জন্য হাঁটি । ভার্সিটি ডে তে হল থেকে গেঞ্জি দিলো । সব হল থেকে র্যালী বের হলো । মেয়েদের হল থেকে যখন র্যালী এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো তখন
ছেলেদের উল্লাস ধ্বনি আরও বেড়ে গেলো । আমি খুঁজছি সেই লাল ফ্রেমের চশমা পরা কার্ভ চুল ওয়ালী মেয়েটিকে । কিছুক্ষন খোঁজার পর না দেখে হতাশ হয়ে পড়লাম । বিকেলে কনসার্টে গেলাম অডিটরিয়ামে ।
হঠাৎ অন্য পাশের দরজা দিয়ে একসাথে চার পাঁচটা মেয়ে ঢুকল । ঐ পাঁচ জনের মধ্যে ঐ মেয়েটিও ছিল। মেয়েটি আকাশী নীল একটা শাড়ি পড়েছে । আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে । পুরো কনসার্ট জুড়ে আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়েই রইলাম । মেয়েটির একবার আনমনে এপাশ ওপাশ তাকাতে গিয়ে আমার সাথে চোখে চোখ পড়লো । এরপর থেকে মেয়েটিও মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে যে আমি ওকে দেখছি কিনা । রাত আটটা বাজলে মেয়েদের হল বন্ধ হয়ে যায় । তাই মেয়েরা আটটার দিকে বের হয়ে গেলো কনসার্ট থেকে । মেয়েটি অডিটরিয়াম থেকে বের হবার সময় আমার দিকে একবার আড় চোখে তাকালো । কোনো অদৃশ্য টানের বলে আমিও সাথে সাথে সীট থেকে উঠে ওর পিছু নেয়া শুরু করলাম । কিছুদিন যাবৎ এক টানা বৃষ্টি হচ্ছে । আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়নি তবে এখন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে । মেয়েটির হাতে কোন ছাতা নেই । সবচেয়ে অবাক হবার ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটার সাথে কোন বান্ধবী নেই । এখন অডিটোরিয়াম এর সামনে কোন রিকশাও নেই । আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারলাম না ।দ্রুত মেয়েটির সামনে গেলাম
-ক্যামন আছো ? আমাকে চিনতে পারছো ?
-হম চিনছি ! আপনি সেই হা বাবা ! আজ সারাক্ষন ও হা করে ছিলেন আমার দিকে তাকিয়ে আমি না শোনার ভান করলাম
-তোমার বান্ধবীরা কোথায় ?
-ওরা তো আসেনি
-দেখলাম যে একসাথে ঢুকলে চার পাঁচ জন ?
-আমি ওদের সাথে আসিনি ।
-তুমি কোন ইয়ার ?
-ফার্স্ট ইয়ার ।আপনি?
-ফোর্থ ইয়ার
-অনেক বড় ভাই !
-হুম ! তুমি কোন ডিপার্টমেন্ট ?
-আই পি ই । আপনি ?
-আমি ট্রিপল ই
-ভাইয়া ! একটা রিকশা ঠিক করে দিতে পারবেন ? আমার হল বন্ধ হয়ে যাবে এখনি
-ওকে দাঁড়াও; বৃষ্টির মাঝে আমি রিক্সা খুঁজতে নামলাম । জীবনে রিক্সা খোঁজার মাঝে এতো আনন্দ কোনদিন পাই নি ।
মেয়েটি রিক্সায় চলে যাবার সময় আমাকে থ্যাঙ্কস জানালো । আমি রিপ্লাই দিতে ভুলে গেলাম । সত্যিকারের হা বাবার মতো আবার তাকিয়ে রইলাম । আকাশী নীল শাড়ী, নীল টিপ ,লাল ফ্রেমের চশমা , কার্ভ চুল সব কিছু আমার মাথা একেবারে গোব্লেট করে দিচ্ছিলো ।
মেয়েটি চলে যাবার পর আমি জিভে কামড় দিলাম । কারন মেয়েটার নামটাই জানা হয়নি । এরপর নিয়মিত ওদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করতে লাগলাম । কোন লাল ফ্রেমের চশমা পরা মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকি । মেয়েটিকে একদিন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেখলাম । আমি সাথে সাথে কোন কিছু কেনার ভাব করে ঢুকলাম ।
-মামা ! এক হাজার টাকার ভাঙতি হবে ?
-না মামা !
দেখি ও একা দাঁড়িয়ে কিছু চানাচুর , বিস্কুট ,চিপস কিনছে । এখন যদি কথা না বলতে পারি তবে কিছুই হবে না । ও আমাকে খেয়ালই করলো না ।
ও টাকা দিয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বের হয়ে গেলো ।সাথে সাথে আমিও বের হলাম । আমাদের ইলেকট্রিকাল ডিপার্টমেন্ট ভবনের সামনে চলে আসতেই ওর পাশে গিয়ে বললাম ,
-তোমার নামটাই তো জানা হল না ও কিছুটা চমকে গেলো ।পরক্ষনেই নিজেকে সামলে বলল ,
-জিনিয়া
-খুব সুন্দর নাম তো
ও হাসি দিয়ে বলল , হুম !
-তোমার ফেইসবুক আইডি আছে ?
-নাহ
-ওহ ! এই যুগের একটা মেয়ের ফেইসবুক আইডি নেই ? খুব অবাক হলাম !
-ভাইয়া ! এসব আমার ভালো লাগে না
-হুম ! ফেইসবুক আসলেই ভালো না । আমিও ছাড়তে চাচ্ছি । একবারে চীরদিনের জন্য ছাড়বো । কিন্তু আমার একজন ভালো বন্ধু দরকার । মনে করো বাস্তব জগতের বন্ধু । তুমি কি আমার বন্ধু হবে ?
-আমার লাভ কি ?
-বন্ধুত্তের মোড়কে বিশ্বাস উপহার দেবো তোমাকে । আর বিশ্বাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় । প্রতিটা মানুষের একজন বিশ্বাসী বন্ধুর প্রয়োজন হয় । আমি সেই মানুষটি হতে চাই
-আপনাকে বিশ্বাস করবো কি করে ?
-নিজেকে বিশ্বাস করো ?
-সব সময় না ।
-তাহলে কি করে বুঝাবো ?
-আপনি যদি অন্য ছেলেদের চেয়ে ভিন্য না হন তাহলে ওদেরকে বিশ্বাস না করে আপনাকে বিশ্বাস করবো ক্যান ?
এমন কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম । আসলেই কিভাবে বুঝাবো ওকে আমি অন্যদের থেকে ভিন্য । যে কখনো বিশ্বাস ভাঙবেনা । যে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বিশ্বাস এর জন্য পথ তৈরি করবে । এমন কি করা যায় হঠাৎ যাতে সে বিশ্বাস করে আমি সবচেয়ে বিশ্বাসী ।আমি সবচেয়ে ভিন্য ।আমি সবচেয়ে যোগ্য তার জন্য ।
-তুমি বলো আমি কি করবো ?
-আমি কেন বলবো ? আপনি এমন কিছু বলেন যাতে আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি ।তবে প্লীজ ! আমি কোন ভায়োলেন্স চাই না । সিনেমার মতো হাত কেটে আমাকে লাভ লেটার দেয়া কিম্বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করতে যাবেন না ।আমি এসব প্রচণ্ড অপছন্দ করি ।
-আগে বন্ধু হবার তো সুযোগ দাও । তাহলেই বুঝবে আমি ক্যামন !
-আপনাকে আমি বন্ধু করলে তো হলই । কিন্তু আপনাকে আমি কেন বন্ধু করবো সেটা আমাকে বলবেন না ?
-কারন তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকেই সব সময় এখন তোমাকে নিয়ে চিন্তা করি
-আমি যদি বলি অন্য কেউ ও আমাকে নিয়ে চিন্তা করে ? এখন সেই অন্য কেউ কে বাদ দিয়ে ক্যান আপনাকে বন্ধু বানাবো ?
মেয়ের তো দেখি কার্ভ চুলের মতো মাথায় ভীষণ প্যাঁচ । আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । সত্যিই নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো । আমি চুপ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম । মনে হচ্ছে খুব বড় অপরাধ করে ওর সামনে অপরাধ স্বীকার করছি । আমি বললাম , আমি কখনো ওভাবে চিন্তা করিনি । আমাকে ভাবতে হবে । মেয়েটি ঠোটের কোনে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল , আপনি ভাবতে থাকেন । আর যেদিন প্রমান করতে পারবেন আপনি সবার থেকে ভিন্য , সবার থেকে বিশ্বাসী । সেদিন আমরা বন্ধু হবো । ক্যামন ? ভালো থাকবেন । আমাকে যেতে হবে । এই কথা গুলো বলে মেয়েটি চলে গেলো । আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম ।
আমি রুমে এসে বিশাল টেনশনে পড়লাম । কি করবো কিছুই মাথায় আসছেনা । ছোট ক্যাম্পাস । এক মেয়ের পিছনে কয়েকদিন ঘুরলেই জানাজানি হতে টাইম লাগবেনা । প্রেসটিজ পুরা পান্তা ভাত হয়ে যাবে ।
পরের দিন ক্লাস করে আনমনেই ওদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । ওর ক্লাস কখন শেষ হবে অথবা শেষ হয়ে গেছে কিছুই জানিনা । ক্লাস টাইমে ওদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে আর বিকেলে ওদের হল থেকে একটু দূরে পদ্ম পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বদ অভ্যাসে পরিনত হল ।
তবে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কিছুদিন এর মধ্যে ওর ক্লাস এর সময় সূচীর একটা আনুমানিক ধারনা পেলাম । রবিবার ল্যাব আছে বিকেলে । সোমবার আর মঙ্গলবার সকাল দশটা ত্রিশ এ ক্লাস শেষ হয় ……।
শুধু ক্লাস না ও বিকেলে কবে কখন হাঁটতে কিম্বা ঘুরতে বের হয় তার ও একটা আনুমানিক ধারণা পেলাম । দুই সপ্তাহে অন্তত একবার খুলনা ঘুরতে যায় বান্ধবীদের নিয়ে। তবে অবশ্যই বৃহস্পতি বার । পছন্দের রেস্তোরাঁ কাউন্ট্রি লাউঞ্জ । ক্যাম্পাসে ঘুরলে সন্ধ্যার পর বের হয় । চালাক মেয়ে । সাথে দুজন বডী গার্ড বান্ধবী থাকে । আর কিছু কষ্টকর তথ্য পেলাম । ডিপার্টমেন্ট এর অনেক ছেলেই ওর উপর ক্রাশ । স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে কারো প্রতি ওর কোনো আগ্রহ নেই ।
আজ আমাদের মাত্র একটি ক্লাস হল । আমি ক্লাস শেষে ওদের ডিপার্টমেন্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি । আকাশ টা আজও খুব কালো । যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে । মাঝে মাঝেই অনেক দূরে বিজলী চমকাচ্ছে । ও যখন ক্লাস শেষ করে ডিপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হল তখন বৃষ্টির মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে । ও আমাকে দেখে নিচে তাকিয়ে হালকা একটা হাসি দিয়ে ওদের হলের দিকে হাটা শুরু করলো । আমিও একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ওর পিছে আপন মনে হাঁটতে লাগলাম । ওর হাতে খুব সুন্দর একটা রঙিন ছাতা । মাঝে মাঝে ছাতাটা একটু নিচু করে পিছনে ফিরে আমাকে দেখছে । বৃষ্টির পানিতে আমার শার্ট প্যান্ট ভিজে একাকার
অবস্থা । আমার চুল থেকে পানি আমার গাল বেয়ে বেয়ে নিচে পড়ছে । মাঝে মাঝে পানির প্রবল গতিবেগ এর কারনে সামনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । ওর হলের কিছু দূরে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । ও হলের গেট দিয়ে ঢোকার সময় ও একবার আমাকে দেখে নিলো । আজ ও অনেক বার তাকিয়েছে । এটা কি প্রশ্রয় ? নাকি পরে তোকে দেখে নেবো টাইপ লুক ছিল ?
মেয়েটি আজ বাসে তিন নম্বর সারিতে বসা । বাসে প্রচণ্ড ভীর । শ্বাস করার ও জায়গা নেই ।
আর আমি পিছনের গেটে বাঁদরের ন্যায় ঝুলে আছি । বাস এর গেটে ঝোলার অভ্যাসটা ঢাকা কলেজ থেকে পাওয়া । বাস চলছে আমি গেটে দাঁড়িয়ে বাতাস খাচ্ছি । মেয়েটি খুলনা নিউমার্কেটে নামলো । সাথে দুজন বান্ধবী ।
( আর ঐ ছেলে দুটি । আমি ও নেমে গেলাম । ওরা একটা ফাস্ট ফুড এর দোকানে ঢুকে গেলো ।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম একটু দূরে । হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে মেয়েটি বেরিয়ে এলো । পিছনে আরেকটি মেয়ে ওকে ডাকছে , জিনিয়া ! এই জিনিয়া ! আমি বোঝার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে । এখন ওরা সবাই বের হয়ে এসেছে ।আমি ওদের খুব কাছেই হাঁটতে লাগলাম ।একটা মেয়ে ওদের মধ্যে একটা ছেলেকে বলছে, এতো দ্রুত প্রপস করতে গেলি ক্যান গাধা ? এই কথা শুনেই আমার বুকে প্রচণ্ড আঘাত লাগলো । আমি আর ওদের পিছু নেয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম । এতো খারাপ লাগছে আমার কি করবো বুঝতে পারছিনা । আমি হাইওয়ে রোড ধরে একা একা হাঁটতে লাগলাম ।
খুলনার রাস্তা গুলো এম্নিতেই ফাকা ফাকা ।আজ যেন আমার কষ্টের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে একদম যানবাহন শুন্য অবস্থা । আমি একটা ছোট রাস্তার মধ্যে সামান্য ভীর দেখে ঢুকলাম । দেখলাম একজন অন্ধ লোক গলা ছেড়ে লালন গীতি গাইছে ” মিলন হবে কত দিনে ? আমার মনের মানুষের ও সনে ? ”
এতো সুন্দর কণ্ঠ আমি কখনো টিভি কিম্বা রেডিওতে শুনিনি । একেই বলে প্রকৃতি প্রদত্ত কণ্ঠ । সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ওনার কাছে গান শিখতে পারতাম ! আর এভাবে রাস্তায় গলা ছেড়ে গাইতে পারতাম ! গান শুনছি আর আমার মাথায় অনেক ভার অনুভব করছি ।শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে আর খুব শীত শীত লাগছে । এখানেই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে । কিভাবে অতদুর যাবো ? প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে তবুও কিভাবে কিভাবে যেন অটো রিক্সায় চলে আসলাম ক্যাম্পাসে । রাতে ধুম জ্বর উঠলো । তবুও মাথার মধ্যে সেই লোকটার গান ” মিলন হবে কত দিনে ? আমার মনের মানুষের ও সনে ? ” বাজছে । আমি হারিয়ে গেলাম গভীর অচেতনে । রাতে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন
দেখলাম । দেখলাম জিনিয়াকে নিয়ে আমি নদীর পাশে হাঁটছি । পাশে বড় বড় সাদা কাশ ফুলের বাগান ।একটু পর পর সেই কাশফুল গুলো বাতাসের তালে তালে মাথা নুয়ে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে । জিনিয়া একটু পর পর রাগ করে আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ।আমি ওর পিছে হাঁটছি ওকে ধরার জন্য । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি ক্যাম্পাসে হাঁটছি ওর পিছু পিছু । কিন্তু সেই গানটি এখনো শুনছি আমি । মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে ।
একসপ্তাহ জ্বরের ঘোরে একদম বেহুশ ছিলাম । দুইটা ক্লাস টেস্ট , তিনটা প্র্যাকটিকাল ক্লাস মিস করেছি । এতো দুর্বল ছিলাম যে বন্ধুরা রিক্সায় করে
( আমার হল থেকে মাত্র দুই মিনিটের রাস্তা ) মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনলো । ডাক্তার বলেছে ভাইরাস জ্বর । বুঝলাম না ! জিনিয়াকে ঐ ছেলের প্রপস করার সাথে আমার ভাইরাস জ্বরের কি সম্পর্ক ।
এক সপ্তাহ পর জ্বর কমে গেলো ।কিন্তু শরীর প্রচণ্ড দুর্বল । জিনিয়াকে দেখা হয়নি কতদিন ! ওহ ! আমি আজ শেষ বার এর মতো দাঁড়িয়ে আছি । আমি জিনিয়াকে বলবো ,” আমি আসলে নিজেকে তোমার বিশ্বাসী প্রমান করতে ব্যর্থ হয়েছি । এতদিন যা করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও ” ।আজ এতো রোদ ! মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম ব্যথা শুরু হয়েছে । মাথার দু সাইডে টিকটিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি । আমার কি আবার জ্বর উঠবে নাকি ?
জিনিয়া ওদের ভবন থেকে বের হয়ে আসার পর আমি ওর পিছু নিলাম । জিনিয়া অবশ্য আমাকে দেখেনি ।কিন্তু হাঁটার সময় অনুভব করলাম আমার প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে ।পা আর আগাচ্ছেনা ।আমি মাতালের মতো এলোমেলো পা ফেলছি । উফফ ! সব কিছু আঁধার হয়ে আসছে ক্যান ? জিনিয়াকে এখনই ডাকতে হবে ।ঐ তো সামান্য সামনে আছে । আমি সর্বশক্তি দিয়ে জিনিয়া বলে চিৎকার করে ডাকলাম । মেয়েটা শুনতে পেলো কিনা জানিনা এরপর আমার আর কিছু মনে নেই ।
চোখ মেলে দেখি আমি মেডিকেল সেন্টারে শুয়ে আছি । আমার হাতে স্যালাইন লাগানো । আমার আশে পাশে যে অনেক উৎসুক জনতার ভীর সেটা আমি না দেখেই বুঝতে পারছি । ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন ” এখন ক্যামন লাগছে ? ”
-এইতো ভালো !
-রোদের মধ্যে সম্পূর্ণ হাটা নিষেধ । ছাতা নিয়ে হাঁটবে । মনে থাকবে ?
-হুম ।
ডাক্তার এর রুম থেকে বের হয়ে হয়ে দেখলাম জিনিয়া বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ।
-তুমি এখানে ?
-আমাকে ডাক দিয়ে অজ্ঞান হলে আমি কি করবো ?
জিনিয়ার মুখে লাজুক হাসি ।
এই প্রথম ক্যাম্পাসে জিনিয়ার পাশাপাশি হাঁটছি । মাঝে মাঝে ওর ডান হাতের আঙুল ছুঁতে চাচ্ছি কিন্তু ও আঙুল সরিয়ে নিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে । পদ্ম পাড়ে আসার সাথে সাথে আবার অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল ।
জিনিয়া ওর বিশাল হ্যান্ড ব্যাগ থেকে টিপ ছাতাটা বের করে দুজনের মাথার উপর ধরলো । কিন্তু আমার মাথার সাথে একটু পর পর বাড়ি লাগছে ছাতার সাথে ।
” দাও ! আমি ধরি ছাতাটা ”
-নাহ আমি ধরবো
-আমি যে বাড়ি খাচ্ছি একটু পর পর ।
-এতো লম্বা ক্যান তুমি ?
-মানুষ লম্বা বি এফ এর জন্য পাগল ।আর মেয়ে কি বলে এসব ?
-হুম তোমাকে বলসে ?
আচ্ছা দাও দুজন মিলে ধরি ।আমি ছাতি ধরার ছলে ওর হাত শক্ত করে ধরলাম । জানিনা ও কি অনুভব করছে এখন ! শুধু কি আমার হাতের উষ্মতা নাকি প্রবল বিশ্বাস ?