পাগলু

পাগলু

১.

চোখে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে ত্রিনা । কলকাতার সুপারহিট হিরো দেবের একটা মুভি চলছে স্টার জলসা মুভিজে । ত্রিনা টেলিভিশন খুবই কম দেখে , তবে কিছুদিন হল বাসায় এসে ত্রিনা লক্ষ্য করেছে সেও তার বাসার মানুষজনের সাথে কিভাবে কিভাবে যেন কলকাতার বাংলা মুভির মুগ্ধ দর্শক হয়ে গিয়েছে । ত্রিনার ধারনা পুরো কৃতিত্বটাই রাহেলা বুয়ার । ত্রিনা হাসি আটকে রাহেলাকে জিজ্ঞেস করল ,” এইটা কি মুভি দেখ , রাহেলাপু ?” রাহেলা টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিল ,” এইটাতো ” ফাগলু ” , কেন আপনে দেখেন নাই ?আমি এই নিয়া ছয়বার দেখলাম । জলসা ” মফিজে” প্রায়ই দেয় । ” ত্রিনার গলা ফাটানো হাসি শুনে রান্নাঘর থেকে প্রায় তেড়ে আসলেন রেবেকা সুলতানা । মেয়েটা বাসায় এসেছে প্রায় একমাস হতে চলল ,এই কয়দিনে একবারো সে এভাবে প্রান খুলে হাসেনি । রেবেকা উৎকণ্ঠা চেপে মেয়েকে বললেন ,” কি হয়েছে ত্রিনা ? এভাবে হাসছিস যে ?” ত্রিনা কোনমতে হাসি চাপতে চাপতে বলল ,” কই আম্মু ? হাসতেছি না তো , আমি জলসা ” মফিজে” দেবের ”ফাগলু” দেখতেছি । হিহিহি ।” রেবেকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে রাহেলার দিকে মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বললেন ,” তোর ব্যাপারটা কি রাহেলা ? রাতের রান্না না করে সিনেমা দেখতে বসছিস ? রান্নাঘরে যা ! আমি বেগুন ভেজে রাখছি , তুই মাছটা রেধে ফেল ।” রাহেলা খোপা বাঁধতে বাঁধতে উঠে গেল ,তার চোখে মুখে আফসোসের ছাপটা টিভির পর্দায় দেবের মুখে রিফ্লেক্ট হচ্ছে । ত্রিনা হাসি থামিয়ে চুপচাপ অনুভুতিহীন চোখে টিভির পর্দায় চোখ রাখল । মুভিটা বেশ উন্নতমানের অবান্তর ,এখানে নায়িকা কোয়েলের জন্যে এমন কোন মারামারি নেই যা দেব করছে না । এই অবান্তর জিনিস গুলি আবার দর্শক খুব মজা নিয়ে দেখে , আর এই একই জিনিস ত্রিনার আত্মাটাকে কুচি কুচি করে কাটে । নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে তার – সিনেমার ভিতরের জগতটায় ভালবাসার এত পাগলামি , বাইরের জগতটায় একজনের জন্যে আরেকজনের মনে এইটুক ভালবাসা সারাজীবন বেঁচে থাকলে কি এমন ক্ষতি হত ? হঠাত করেই ত্রিনার চোখের সামনে দেব আর কোয়েলের মুখটা ঝাপসা হয়ে আসে ।

রেবেকা সুলতানা সোফায় বসে টিভির সাউন্ড ভলিউম কমিয়ে নিলেন । তারপর ত্রিনাকে বললেন , ” সাব্বির ফোন করেছিল ?” ত্রিনা মাথা নাড়িয়ে বলল , ” আম্মু , ওর কি ফোন করার কথা ? চাইলেও তো পারবেনা , আমার মোবাইল নাম্বার চেঞ্জ করেছি ।” ” বাসার টি এন টি নাম্বার তো আর বদলায় নি ।” ত্রিনা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল , ” কোন নাম্বারেই ফোন আসেনি আম্মু ।”

টিভির পর্দায় আর মন থাকে না ত্রিনার । ভালবাসা তাকে হঠাত করেই সব দিয়ে আবার সব কেড়ে নিয়েছে । ভীষণ ভালবাসত সে সাব্বিরকে । অগোছালো চুলের মোটা চশমা পরা এই ছেলেটা ত্রিনার সমস্ত শিরা উপশিরাকে ভালবাসার আত্মিক বাধনে বেঁধে রেখেছিল । বিয়ের পাঁচ ছয়মাস পরে এই সাব্বিরের ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়াটা ত্রিনার কাছে অনেকটা শিরা ধমনী ছিড়ে যাওয়ার মতই হয়েছে । সাব্বির কিভাবে যেন মেঘের মত রঙ পালটে ফেলেছিল । অফিস , মিটিং , ক্যারিয়ার আর সারাক্ষন বসের তোষামোদ করা , যে বস কিনা একজন সুন্দরী আধুনিকা …… আর ভাবতে পারেনা ত্রিনা । গলার কাছে কি যেন একটা আটকে থাকে তার , সেটা না নামে , না উঠে আসে , কেবলই দম বন্ধ করে দিতে চায় । তবুও কি যেন বেঁধে রাখত ত্রিনাকে , এত অবহেলার পরেও সাব্বিরকে যে ভীষণ ভালবাসত সে । কিন্তু শেষরক্ষা হল কই ? সাব্বির যেদিন নিজের মুখে বলল ,” তুমি , তোমার ভালবাসার চাইতে ক্যারিয়ার আমার কাছে অনেক বড় , বুঝেছ ?” , ত্রিনা সেদিন তাল হারিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়েছিল । মেঝের ওপর কাঁচের মতন তার হৃদয় টা ভেঙ্গে গেছে , সাব্বিরের কানে সেই শব্দ কোন দিন পৌঁছাবার নয় । ক্যারিয়ার কি ত্রিনার ছিল না ? কই সে তো পারল না ক্যারিয়ারের সাথে সাব্বিরকে একই স্কেলে দেখতে । তাই অনেক কিছু ভেবে নীরবে সরে এসেছে সে সাব্বিরের জীবন থেকে । তবুও ভাল থাকুক সাব্বির ।

” এই ডিসিশান টা না নিলেই হত না তোর , তাইনা ?” মায়ের ডাকে চমকে ওঠে ত্রিনা । কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে , ” না আম্মু , হত না ।” ” খুব বেশি বুঝিস তোরা । আর মেয়েরা তো ঘর করেনা ।” ” আম্মু আমি তো বলেছি , যেখানে ভালবাসার লেশমাত্র নেই সেখানে …” ” চুপ থাক । ভালবাসা ,না ? বাংলাদেশের কয়টা ঘরে ভালবাসা আছে বলে মেয়েরা সংসার করছে ? অবহেলা ছাড়া কিচ্ছু নেই ওদের ।” ত্রিনা উঠে দাড়াল , এই প্রশ্নের জবাব সে জানে , কিন্তু দিতে ইচ্ছে হচ্ছেনা । ত্রিনা কিভাবে বুঝাবে সবাইকে যে সাব্বিরকে সে এখনও ভালবাসে । কিন্তু ওর সাথে ঐভাবে থাকতে গেলে এই ভালবাসাটুকু টিকবে না । ত্রিনা চায়না সাব্বিরের জন্যে তার ভালবাসাটুকু মরে যাক । কিন্তু এসব আম্মু কে শুনিয়ে তো লাভ নেই , তাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল ,” আমি ঘুমাবো আম্মু , সকাল সাতটায় ট্রেন আমার, রাতে খেতে ডেকো না ।”

২.

চিটাগঙ্গের উদ্দেশ্যে একটু পরেই যাত্রা শুরু করবে ট্রেন । ত্রিনা একটা নিঃশ্বাস আটকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল , আগে কখনও চিটাগং যায়নি সে , সাব্বির বলেছিল নিয়ে যাবে । সব স্বপ্নই মরে গেছে । কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গার দুঃখ কান্না দিয়ে কমানো যায়না , তাই এক ঠোঙ্গা বাদাম হাতে নিয়ে সে হাসি মুখে বসে রইল । চাকরির একটা ইন্টারভিউ আছে কাল ,চাকরিটা হয়ে গেলেই আর চিন্তা নেই ,একাই জীবন টা পার করে দেবে সে । ত্রিনার পাশের সিটে কেউ নেই , পুরো কম্পারটমেন্টে হাতে গোনা মানুষ । ভিড় ছাড়া যাত্রা টা ভালই হবে মনে হচ্ছে । এক বৃদ্ধাকে পানি খেতে দেখে ত্রিনার হঠাত মনে পড়ল , পানির বোতল টা বাসায় ফেলে এসেছে সে । অথচ এখনই তার পিপাসা পেয়ে গেছে , কি আর করা , ট্রেনের জানালায় মাথা বাড়িয়ে দেখতে লাগল কোন পানি বিক্রেতা পাওয়া যায় কিনা ।

একদম ভুত দেখার মত চমকানো বোধ হয় এটাকেই বলে । পেস্ট কালারের শার্ট আর ব্লু জিন্সে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসা এইটা কাকে দেখছে ত্রিনা ? ভার্সিটি লাইফের সেই অগোছালো সাব্বির এতদিন পর কোত্থেকে ? ত্রিনা জলদি করে জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ফেলল । নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে সে । বর্তমানের ক্যারিয়ার সচেতন ধোপদুরস্ত সাব্বির কে সেই পুরনো রুপে দেখতে পাওয়াটা পাগলামির লক্ষন ই । এরকম পাগলা মাথা নিয়ে সে ব্যাংকে চাকরি করবে ? কিন্তু এসব কি ? সাব্বির তো দেখছি সত্যি সত্যি এসেছে । ত্রিনা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করল , সাব্বির ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকে ডেকে বলছে ,” এই এই , পানি আছে তোমার কাছে ? পাউরুটি ? এই ?” ত্রিনা বিস্ফারিত চোখে মাথা নাড়িয়ে বলল , ” পানি নেই । পাউরুটি আর ডিমের স্যান্ডউইচ …” ” হোয়াট দ্যা হেল … ট্রেন তো আমারে ছাইড়াই যাবে দেখতেছি । ওয়েট , পানি কিনে আনি !! ”

” তোমাকে আসতে বলছে কে ?” জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে বলল ত্রিনা । ঢাকা থেকে চলা শুরু করেছে ট্রেন টা । ” তুমি ” , সাব্বিরের সোজাসাপটা জবাব । ত্রিনা গম্ভীর গলায় বলে ,” মানে ?” ” মানে তুমি স্বপ্নের মাঝে আমাকে চারবছর আগের মত বলেছ ,’ আমার সাথে যাবি না ?’ আমি বলেছি ,’ যাব না মানে ? তুই দুই মিনিট দাঁড়া আমি দশ মিনিটের মাঝে আসতেছি ‘ ” ত্রিনা কান্না আটকে বলল ,” সাব্বির , লাইফটা গেইম না ……” সাব্বির ত্রিনার হাত ধরে তাকে থামিয়ে বলল ,” ঠিক এই কথাটাই আমি এই এক মাসে রিয়েলাইজ করেছি,ত্রিনা । আমাকে মাফ করা যায়না ? আর এমন হবেনা , প্রমিস । ” ত্রিনা হা করে তাকিয়ে আছে । এটা সেই সাব্বির ? সাব্বির বলছেই ,” আমার শালাটা ভাল, আমাকে সব ইনফরমেশন ও ই দিয়েছে । তুমি যে পানি ফেলে আসছ সেটাও … ” ত্রিনা বুঝল , তার গলায় কোন আওয়াজ আসছে না । অনেক কষ্টে বলল , ” সাব্বির আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা… ”

সাব্বির ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মুখ খুলতে লাগল । ত্রিনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল , ” পানি খাও, বিশ্বাস হবে । তারপর আমরা পাউরুটি আর ডিমের স্যান্ডউইচ খাবো ।” ত্রিনা সাব্বিরের পেটে গুতা মেরে বলল ,” এখনই সব খাবা , না ? তাইলে দুপুরে কি খাবো ?” সাব্বির মাথা চুলকে বলল ,” ইয়ে মানে দুপুরে ভাত খাবা ? আমি না ডিম ভুনা করে আনছি , যদিও ভাল হয়নাই ……”

ত্রিনা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল সাব্বিরের দিকে । অনেক দিনের পুরানো সেই সাব্বির , একদম জলসা মুভিজের সেই পাগলু ।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত