১ . খুব মেঘ করে বৃষ্টি নামার আগে রাতের আকাশ যখন অফুরন্ত উল্লাসে নিজেকে লালচে রঙ্গে সাজায়, তখন মাঝেমাঝে আমার মনে অদ্ভুত একটি ইচ্ছে জেগে উঠে । বোকা বোকা একটি ইচ্ছে , কিন্তু আমার কাছে এই ইচ্ছেটি ভীষণ প্রিয় । রাতের মেঘলা আকাশ দেখলে আমার কেন যেন নির্জন একটি দ্বীপ কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে । ইচ্ছেমত সবুজ আর নীলচে রঙ করা সেই দ্বীপটিতে শুধু আমার একলা রাজত্ব হবে । আমার অনেকদিনের ইচ্ছে , মাঝরাতের আকাশ ভেঙ্গে সেখানে যখন ঝুম বৃষ্টি নামবে , সেই বৃষ্টিতে আমি তখন দুরন্ত নদীর মত উল্লাসে মেতে উঠব । সেই বৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে কোন শাসনের জাল আমাকে বাঁধতে আসবেনা । আমার একলা দ্বীপে কেবল আমার মুগ্ধতায় মাখা বৃষ্টি বিলাস হবে । আর আমার সামনে থাকা ছোট্ট সমুদ্রতটে অবিরাম দুলতে থাকবে রঙ্গিন কোন পানসি , হতে পারে সেটি অনেক দুরের কোন দ্বীপাঞ্চল থেকে ভেসে এসেছে , হতে পারে সেটি কোন খেয়ালি রাজপুত্রের বিলাসী ভ্রমণসঙ্গী । হয়ত সেই পানসিতে উদাস নয়নে বসে থাকবে সেই ভীষণ সাহসী বৃষ্টিমুগ্ধ রাজপুত্র । আর উন্মত্ত বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে আমি দেখব সেই রাজপুত্রের চুলের সাথে বাতাসের যুদ্ধ , বৃষ্টির ছিটেতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া তার চশমার কাঁচ । এই যা ! কি ভাবছি , রাজপুত্ররা বুঝি চশমা পরে ? আছে কোন রাজার পুত্র যে কিনা চোখে কম দেখে বলে চশমা পরত ? কি জানি !
নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম । আমার ভাবনা গুলি এত বাউন্ডুলে কেন হয় কে জানে ? ফুটপাথের উপর ধীর পা ফেলে এই ভরসন্ধ্যাবেলায় যখন আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি , তখন আমার এই অদ্ভুত কল্পনাবিলাসীতার কি কোন কারন থাকা উচিত ? না আকাশে কোন মেঘ আছে , না আছে ঝড়ো হাওয়া । তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আজ রাতে বৃষ্টি নামবে , শরৎকাল তো সারপ্রাইজ দিতে ভীষণ পছন্দ করে বলেই জানি । হঠাত লক্ষ্য করলাম , একা একা হাসছি বলে কয়েকজন পথচারি ঘুরে আমার দিকে তাকাচ্ছে , সম্ভবত পাগল ঠাওরেছে আমাকে । সে যাকগে ,যার যা ভাবার তাই ভাবুক । কে কি ভাবল তা নিয়ে ইরা কিন্তু মাথা ঘামায় খুব কম সময়েই , হুম ।
ক্লিনিকটা ছোটখাট , ব্যক্তিমালিকানাধীন । আমাদের ছোট্ট এলাকার মানুষদের ভরসার স্থান । আর আমার মত রোগাপটকা হলে তো কথাই নেই , এই দুইমাসে আমি তৃতীয়বারের মত এখানে হানা দিলাম । এবারের এক্সকিউজ – কি বলা যায় ? আমি দুদিন হল আমার নাকের অস্তিত্ত টের পাচ্ছিনা , বাজে টাইপের বিচ্ছিরি লেভেলের সর্দিতে আমার নাক সম্ভবত বিলীন হয়ে গেছে । এই সমস্যাটি কিন্তু নতুন নয় , দুইমাস পরপরই আমার এই অবস্থা হয় । তবে সমস্যায় পড়তে হয় রুমাল খুঁজে পাওয়া নিয়ে । এত রুমাল কোথায় আর পাব ? বাসার মানুষজনের যাবতীয় পুরানো আধপুরানো জামাকাপড় আমার জন্যে বিশেষভাবে সংরক্ষন করা হয় । আমি এদের সদ্গতি করি নাকি দুর্গতি করি তা ঠিক জানিনা , তবে আমার সর্দি সমস্যার যে একটা গতি হয় তা কিন্তু সত্যি ।
এক ঘন্টা অপেক্ষার পর আমার সিরিয়াল যখন আসল , আমি তখন ঠিক ” পাইছিরে ” টাইপের ইমোতে ছিলাম । কিন্তু আমি দরজা খুলে ঢুকবার পরই আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের ১০০ ওয়াট বাল্বের মত চেহারা ২৫ ওয়াট বাল্বের মত হয়ে গেল । আমি এখানে এত বেশি হানা দেই যে ডাক্তার থেকে শুরু করে কম্পাউন্ডার পর্যন্ত সবাই আমার চেনা হয়ে গেছে ,এই ডাক্তার তো আরো এক কাঠি উপরে । ফিচলা হাসি হেসে ডাক্তার সাহেব বললেন ,” কি খবর তোমার ? আবার রোগ বাঁধিয়েছ ? তুমি বরং কাঁথা বালিশ নিয়ে হসপিটালে এসে পড় , তোমার ইন্টেন্সিভ কেয়ার প্রয়োজন ।” আমি কি বলব বুঝলাম না , সত্যি বলতে কি , এই ডাক্তারের মত বেয়াদব কিসিমের ডাক্তার আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি । আরে বেটা আমার অসুখ হলে আপনার কী ? আপনার তো অসুখি হবার কারন নেই , আপনার আরো টু পাইস ইনকাম হবে । তাও এত প্যাচালের কি মানে আছে ? আমার পুরো ছোটবেলা অবশ্য কেটেছে এই বেয়াদব ডাক্তারের বাবার চিকিৎসা নিয়ে , তিনি এখনও চিকিৎসা পেশাতেই আছেন , তবে অন্য হাসপাতালে বসেন । নিজের এই ক্লিনিকটাতে বসার আর এখন সময় পান না , কেন যেন বুড়ো বয়সেই ডাক্তার গুলি বিখ্যাত হয়ে যায় । এমন ভাল মানুষ ডাক্তারের ছেলে কিভাবে এমন ফিচলা বেয়াদব হল সেটা একটা ভাববার বিষয় । তবে আপাতত সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমি চেয়ারে দুপ করে বসে পড়লাম । মুখ গোমড়া করে সরু নেইমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম , যেখানে লেখা – ডাঃ ফারাবী আহসান ( হ্যান ত্যান ডিগ্রি ) ।
” এবার বল দেখি কি হয়েছে ?” আমি খ্যাসখ্যাসে গলায় বললাম ,” সর্দি জ্বর , গলাব্যাথা , দম নিতে পারিনা ।” আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল , ” তোমাকে ওষুধ হিসেবে আইসক্রিম দিয়ে দেই ?” মেজাজ বয়েলিং পয়েন্টে উঠে গেল , কিন্তু গলা ব্যথার কারনে কিছু বললাম না । ” ইরা ,তোমাকে মাঝেমাঝেই আইসক্রিম হাতে রিকশায় দেখা যায় , তাই বললাম । এখন বরং তুমি একটু সোফায় গিয়ে বস ,আর চারটা রুগী আছে , দেখে নেই । তুমি পুরানা রুগি তো , তোমার সাথে একটু আলাপ করব , ঠিক আছে ?” বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম , এতক্ষন ধরে বসে আছি , আরো বসে থাকতে বলে ? কত বড় সাহস , আরে আমার সময় কি আলুখেতে ধরে নাকি ? তারপরেও আমি হতাশার সাথে আবিষ্কার করলাম , রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমি ঠিক সোফাতে গিয়েই বসেছি । ” কফি আনাই ?” আমি কিছুই বললাম না । বেয়াদব ছেলেদের সব কথার উত্তর দিতে নেই , তবে মিনিট পাঁচেক পরে আমাকে ঠিক গরম কফি হাতেই বসে থাকতে দেখা গেল ।
পাঠক কি ভাবছেন ? গরবল কিনা ? জি, ঠিকই ভাবছেন , এভরিথিং ইজ গরবল ।
গরবল টা যখন শুরু হয়েছিল সেটা অনেক অনেক আগের কথা । আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়তাম । আজকের ডাঃ ফারাবী তখন মেডিকেল প্রথম বর্ষের ছাত্র । এলাকায় মেয়েদের কাছে তিনি সেই লেভেলের হিট । বিশেষ করে কলেজে পড়ুয়া আপুদের কাছে তো তিনি তখন চোখের মনি । চোখে চশমা লাগিয়ে, হাতে বই, কাঁধে ব্যাগ আর গায়ে সাদা এপ্রন জড়িয়ে তিনি যখন বের হতেন আপুদের চেহারা তখন দেখার মতন হত । আপুরা ফারাবী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকত আর আমি আপুদের হা করা চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্কুলে যেতাম । আপুরা বায়োলজি বইয়ের ইম্পরট্যান্ট কোশ্চেন দাগাতে প্রায়ই ফারাবী ভাইয়ের শরনাপন্ন হত বলে আমি শুনতাম । এমন কি আমার বান্ধুবিরাও এই ছুতায় তার সাথে কথা বলত । আমাকে নিয়ে যাবার ও অনেক চেষ্টা করা হয়েছে , কিন্তু কথা হল বায়লোজি জিনিসটা আমার কোন কালেও পছন্দ ছিল না । ইম্পরট্যান্ট প্রশ্ন দাগিয়েও আমার লাভ হবেনা সেটা আমি জানতাম এবং যেহেতু সেই ” সো কল্ড ” ফারাবী ভাইয়ের প্রতি আমার কোন দুর্বলতা নেই তাই আমি কখনই আমার বান্ধুবিদের সাথে যাই নি । ফারাবী ভাইদের বিখ্যাত বাসাটা পর্যন্ত আমি সনাক্ত করিনি , শুধু তাদের গলিটা চিনতাম । ফারাবী ভাইয়ের প্রতি আমার এই অনাকাংখার কারন আমার বান্ধুবিরা প্রায়ই বুঝার চেষ্টা করত । আর এই ঝাউলা চুলের ঘুম ঘুম চেহারার আতেল ছেলের দিকে তাকিয়ে এনাদের এত প্রেম কোথা থেকে উৎপত্তি হত, আমি সেটা বুঝার চেষ্টা করতাম ।
কথা হল , আমি যেটা বুঝার চেষ্টা করতাম, দুই বছর পরে হঠাত করেই সেটা একদিন আমি বুঝে গেলাম ।
এস এস সি এক্সাম দিবার পর আমার তখন বিশাল অবসর । এত এত প্ল্যান , এটা করব ,ওটা করব , এখানে যাবো, ওখানে যাবো । কিন্তু ” হিট ” এরোসলের বিজ্ঞাপনের মতই আমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিল একটা মশা , এক ডজন মশাও হতে পারে । বেশ কয়েকটা মশা না কামড়ালে আমার ওরকম বিচ্ছিরি জ্বর হবার কথা নয় । আমি আক্রান্ত হলাম ডেঙ্গুজ্বরে । অনেক বেশি দুর্বল হয়েছিলাম আমি , আমার ট্রিটমেন্টের জন্যে আব্বু ফারাবী ভাইয়ের বাবাকে বাসায় নিয়ে এসেছিল । চারদিন স্যালাইন দিতে হয়েছিল , আর সেটাই হল কাল । প্রথম দিন স্যালাইন দেবার সময় আমি দেখলাম , সুপারহিট ফারাবী ভাইয়া আমাদের বাসায় এসেছে তার বাবার কথামত । আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি থতমত খেয়ে যখন তার দিকে তাকিয়েছিলাম , সে ফিচলা হাসি দিয়ে বলেছিল , ” কি ইরা ? এইটুক একটা মশাই কাত করে দিল ?” এরপর স্যালাইন লাগাতে লাগাতে একটা প্রান খোলা হাসি । এখন আমি ভাবি , সেদিন সেই হাসি দেখে আমি তো আমি , যেই মেয়ে পাগল হতনা তার হার্ট নির্ঘাত রেইনফোরসড সিমেন্ট দিয়ে বানানো বলে ধরে নেওয়া যেত । অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঐ একটা হাসি দেখেই আমার জ্বর অর্ধেক ভাল হয়ে গেল । আমি দুর্বল গলাতেই জবাব দিলাম , ” ওইটুক মশা আপনাকে কামড় দিলে আপনি শুধু কাত না , উপুড় হয়ে যেতেন ।” আবার সেই হাসি । মানুষ এত সুন্দর করে এরকম বিধ্বংসী হাসি দেয় কেমন করে ? মনে হল, নাহ আর বাচবনা বোধ হয় । আতেল একটা ছেলের হাসি দেখে তাৎক্ষনিক ভাবে পাগল হয়ে গেছি , ভাবা যায়না , কি বাজে অবস্থা !
সিনেমায় দেখতাম, ছেলেরা মেয়েদের হাসি দেখে এভাবে পাগল হয় , কিন্তু একটা মেয়ে হয়ে আমি এমন একটা ফিচলা আতেলের হাসি দেখে এভাবে পাগল হয়ে গেলাম , এইটা কি একটা কথা হল ? এইটা কেন হল ? কিভাবে হল ? এবং অতঃপর কি হবে ? কোনকিছুই আমার জানা ছিল না । আমার শুধু জানা ছিল , আমি শেষ । আমার নীরব পাগলামিতে কেটে গেল অনেকদিন । আমি এসে পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে আর তিনি এখন পুরোদস্তুর ডাক্তার সাহেব । ফারাবী ভাই পাঁচ মাস হল এই হসপিটালে বসে । এই পাঁচমাসে আমি লক্ষ্য করেছি অসুখবিসুখের সময় গুলি আমার বড়ই মধুর হয়ে যায় , এমনকি রোদের মাঝে আইসক্রিম খেয়ে জ্বর বাঁধাবার জন্যে আমি কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে যাই । বাসায় কারো ডাক্তার দেখাবার দরকার হলে টার্ম ফাইনালের আগের রাতেও আমি ধিংধিং করে তার সাথে হসপিটালে চলে যাই । এভাবে কেউ কারো প্রেমে পড়ে ? ” বাহ বাহ তুমি তো কফিমগ নিয়ে ভাল মডেলিং কর , কিন্তু আমি তো মডেলিং করার জন্যে এটা দিই নাই , তোমার গলার জন্যে দিয়েছি ” ফারাবী ভাইয়ার কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম , বললাম ,” আমাকে আর কতক্ষণ বসতে হবে ? ” ” এখানে এসে বস ” , সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল । আমি সোফা ছেড়ে চেয়ারে আসতেই বলল ,” কি গরম দেখেছ ? একটা বৃষ্টি হওয়া উচিত কি বল ? কতদিন হয়না ।” ” কে বলেছে আপনাকে ? গত পরশু মাঝরাতে অসাধারণ একটা বৃষ্টি হয়েছে ” ” তাই নাকি ? আমি তো টের পেলাম না , তুমি মনে হয় স্বপ্নে দেখেছ ।” ” জি না , আমি কাটায় কাটায় সোয়া এক ঘন্টা ভিজলাম , আর আপনি বলেন আমি স্বপ্নে দেখেছি ?” বলতে বলতেই দেখলাম , ফারাবী ভাইয়া চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এইরে ! আমি কি করলাম ,বৃষ্টিতে ভিজার কথা বলে দিলাম ? আমার জ্বর আর গলা ব্যাথার এটাই যে আসল কারন ! আবার তার পুরানো ট্রিক্সে আমি পা রাখলাম , জিভে একটা কামড় দিয়ে মাথা নিচু করলাম । ” তুমি এসব কেন কর ? হাসপাতালে আসতে খুব মজা ? হাসপাতালে চিকেন ফ্রাই পাওয়া যায় ?” আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললাম । আরে মাথামোটা ডাক্তার , হাসপাতালে ইরা ‘কি’ পায় আর ‘ কাকে’ পায় সেইটা তুই জীবনেও বুঝবিনা , তাই এখন বকবক না করে চুপ থাক । ” কি কথা বলনা কেন ?” ফারাবী ভাই একই ভাবে তাকিয়ে আছে । আমি তার মত দৃষ্টি দিয়েই বললাম , ” আপনি জানেন না আমার গলা ব্যথা ? আমার কথা বলতে কষ্ট হয় ?” ” সেইটা তো ডাক্তারের দোষ না , তুমি মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজবা আর সর্দি কাশির সোহাগ সহ্য করবানা , তাই কি হয় ?” আমি বিরক্ত হয়ে চোখ নামালাম , এই মাথামোটার সাথে কথা বলার কোন মানে হয়না ।
প্রেস্ক্রিপশান নিয়ে উঠতে যাবো , তখন মহামান্য বললেন ,” আচ্ছা তুমি প্রাইভেট পড়াও ?” মনে মনে বললাম ,তোমারে পড়াব , রোমান্টিজম ,পড়বা ? এমনিতে মাথা নেড়ে বললাম ,” পড়াই না ।” ” পড়াবা একজনরে ? একটা মেয়ে ? ক্লাস এইটের ।” আমি দাঁত বের করে বললাম ,” আপনার বোন নাকি ?তাইলে পড়াবো ।” সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল ,” আমার বোন সেইটা নিশ্চিত হলে কেমন করে ? গার্লফ্রেন্ডের বোন ও তো হতে পারে ?তাইলে পড়াবা না ?” আমি লম্বা একটা শ্বাস নিতে গেলাম , কাশি চলে আসল । বেশ কিছুক্ষন পর কাশি থামলে তাকে বললাম ,” আপনার গার্ল ফ্রেন্ডের বোন কে আমি পড়াব কেন ?” ফারাবী ভাই মুচকি হেসে বলল ,” কেন ? ইঞ্জিনিয়ারিং এর পোলাপাইনরা কারো গার্ল ফ্রেন্ডের আত্মীয়স্বজন পড়ায় না নাকি ?” ” আমি দূরে গিয়ে পড়াব না , বাসায় কেউ রাজি হবেনা ।” ফারাবী ভাই একটা কাগজে কিছু একটা লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল ,” এই ঠিকানা , আমাদের এরিয়াতেই । পড়াবা না ?” এই ছেলের মত খারাপ ছেলে দুনিয়াতে দুইটা নাই । প্রেম করে , গার্ল ফ্রেন্ড আছে , সেইটা আমাকে শুনাল আবার শালী কে পড়ানোর অফার ও দিল , কি বাজে অবস্থা – ভাবা যায়না ! আমি আড়চোখে তার দিকে তাকালাম , মাথা জ্বলে যাচ্ছিল আমার , তার চোখের চশমাটা গুঁড়া করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল । কিন্তু সে মুখ করুন করে বলল ,” প্লিইজ ?” এরপরেও কি না বলা যায় ? এক মুহূর্ত পর কি যেন ভেবে বলে ফেললাম ,” ঠিক আছে ।” সে তার প্রাণখোলা হাসিতে আমাকে ভাসাতে ভাসাতে বলল ,” কাল বিকেলে গিয়ে তোমার ছাত্রীর সাথে দেখা করে এসো । আমি ওকে বলে দিব ।” ” ওকে ” বলে বের হয়ে আসলাম । ছেমড়া তোর গার্ল ফ্রেন্ডরে ইরা দেখে নেবে ! বের হওয়ার সময় একজন কম্পাউন্ডার আর দুইজন নার্সের সাথে দেখা হল । প্রত্যেকেই ” ম্যাম ভাল থাকবেন” ” শরীরের খেয়াল রাখবেন ” ইত্যাদি উপদেশ দিল । আরে আমি একটু আগে ছ্যাকা খেয়ে সুস্থ হয়ে গেছি । আমার গা থেকে কি ছ্যাকা খাওয়া পোড়া গন্ধ আসছে নাকি যে আমাকে ” খেয়াল রাখবেন ” ” ভাল থাকবেন ” এসব শুনাতে হবে ?
আমি দিব্যি আছি । ফারাবী ভাই আমাকে ছ্যাকা দিবে আমি সেটা জানি । কথা হল , আমি ছ্যাকা খেতে পারি ,তাই বলে ব্যাকা হব নাকি ?
২ . যে গলির সামনে দাঁড়িয়ে আছি , সেই গলিতেই ফারাবী ভাইয়াদের বাসা , কোন টা আমি জানিনা , তবে এই গলিতেই । আমি চাইলেই আমার বান্ধুবিদের কাছ থেকে জানতে পারতাম ফারাবী ভাই কোন বাসায় থাকে । কিন্তু আমি চাইনি , কারন আমি চাইনি কেউ জানুক আমি তাকে পাগলামির এবসলিউট পয়েন্টের কাছাকাছি লেভেলের পছন্দ করি । বড় আপুরা তার পিছনে ঘুরতে ঘুরতে বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছেন , কয়েকজনের বিয়েও হয়ে গেছে , আমার বান্ধুবিদের ও একই দশা । বাকি ছিলাম আমি , সবার অগোচরে , হারাধনের এই শেষজন ও গতকাল ছ্যাকা খেয়েছে । ইহা ব্যক্তি যে নিজের বাসার আশেপাশের মেয়ের সাথে প্রেম করবে সেটা কে জানত ? বেটা মাথামোটা , প্রেম যে কর , ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আমার কাছেই তুমি আসবা , এই আমি বলে দিলাম । তোমার সাথে কোন চিজ প্রেম করে সেইটা দেখতেই আমি পড়াতে আসছি ।
মেয়েটার নাম তিহা । দুই ঝুটি করা বাবু বাবু চেহারার মেয়েটাকে প্রথমেই আমার ভাল লেগে গেল । তিহাও আমাকে ” আপু আপু ” করে অস্থির করে দিল । কিন্তু এভাবে ভাল লাগলে তো হবেনা , এরা হল গিয়ে আমার ভিলেন , ভিলেন দের ভাল লাগলে কি হবে ? বাসায় এদিকে ওদিকে যেদিকেই তাকাই সেদিকেই তিহার আম্মাকেই দেখি । মোটাসোটা আন্টি রা যে কিউট টাইপের ভাল সেটা আরেকবার প্রমান হয়ে গেল । টিচার হিসেবে বাসায় এসেছি , পড়ানোর স্কিল সম্পর্কে আন্টি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেশ করলেন না । বরং গরম গরম সিঙ্গারা সামনে এনে বললেন ,” এই মেয়ে , জলদি একটা খেয়ে বল তো কেমন হয়েছে । ভাল হলে আরও কয়টা বানাব ।” সিঙ্গারা টিঙ্গারা খেয়ে আমি যে ই বলতে যাচ্ছিলাম ,” আন্টি আমি তো তিহা কে পড়ানোর জন্য আসছিলাম , তা …… ” আন্টি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ,” ফারাবী আমাকে বলেছে । তোমার নাম তো ইরা , তাইনা ?”
চিন্তায় পড়ে গেলাম । মা – মেয়ে যেরকম ভয়ংকর লেভেলের ভাল , তাতে আসল ভিলেন ও যে এদের কাছাকাছিই হবে , সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম । কিন্তু তাকে তো দেখছিনা । তিহার সাথেই কথা বলছিলাম । চলে আসব তার কিছুক্ষন আগে তিহা বলল , ” জানেন ইরাপু, ফারাবী ভাইয়া না একটা মিথ্যুক ।” ” তাই ? কেন কেন ?” ” আমাকে বলেছে , আপনি নাকি ভয়ানক রাগী । কত বড় মিথ্যুক , দেখেন ।” আমি দম আটকে বললাম ,” তোমার আপু মনে হয় অনেক শান্তশিষ্ট , তাইনা ?” ” আপু ?” ” হুম , কোথায় তোমার আপু ? দেখলাম না তো ।” ” আমার আপুর কথা জানলেন কিভাবে ?” ” তোমার ফারাবী ভাই ……” তিহা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল ,” বুঝছি ইরাপু ।” ” মানে ?” ” ওনার কথা আর বইলেন না । মিথ্যা কথা বলতে বলতে ঝানু হয়ে গেছে । আমার কোন আপুটাপু নাই ।” হা হয়ে যাওয়া কাকে বলে , আমার সামনে একটা আয়না থাকলেই আমি প্রাক্টিকালি দেখে ফেলতাম । ফারাবী ভাইকে ব্রাশফায়ার করার ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে আটকে কোনমতে বললাম , ” তাহলে কয় ভাইবোন তোমরা ?” ” দুই ভাইবোন । আমি আর ভাইয়া ।ফারাবী ভাইয়া ।” আমি উঠে দাঁড়ালাম । আমার হাঁসফাঁশ অবস্থা হয়ে গেছে । আমি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়াটাকেই ভাল সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করলাম । কারন এই বাসায় আরও দুই চার মিনিট থাকলে আরও কি কি যে শুনতে হবে সেটা ভেবেই আমি ভীত এবং একই সাথে আতংকিত হয়ে গেলাম !
গলির মাথায় যাবার সময় দেখলাম ফারাবী ভাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই রকম ভাব নিয়ে হেটে আসছে । কথা বলব না , কিছুতেই বলব না , হয়ত বলতাম ও না , কিন্তু কেউ ডাকলে কি কথা না বলে থাকা যায় ? ফারাবী ভাই আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল , ” তিহার সাথে কথা হয়েছে তোমার ?” ” হয়েছে ।” ” পড়াচ্ছ তাহলে ?” আমি নাক কান দিয়ে ধোঁয়া বের করতে করতে বললাম ,” আপনি এরকম কেন ? তিহা নাকি আপনার গার্ল ফ্রেন্ডের বোন ? আমাকে এভাবে বোকা বানালেন কেন ?” ফারাবী ভাই গোল গোল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল । ” আচ্ছা আমি কিন্তু একবারও বলি নি আসলেই তুমি আমার গার্ল ফ্রেন্ডের বোনকে …… আচ্ছা ঠিক আছে ধরলাম আমি বলেছি , কিন্তু দেখ আমার বোন মানে আমার তো গার্ল ফ্রেন্ডের ননদ , ননদ আর বোন কি আলাদা ? ” কলার ধরে ঝাঁকাতে ইচ্ছে করছিল খুব । কিন্তু এই ছেলের সাথে কথা বলে আমি আগাতে পারবোনা , তাই বাই বলে চলে আসাটাকেই ফরজ মনে করলাম ।
আর আই পি প্রেম পিরিতি ।
৩ . পিথাগোরাসের বিশাল উপপাদ্যটা বুঝাতে বুঝাতে আমি আবিষ্কার করলাম , তিহার মনটা আজকে বেশ খারাপ । সে পড়ায় মন দিতে পারছে না । খুবই স্বাভাবিক , পড়ায় প্রতিদিন মন বসবে এমন কোন কথা নেই । মনের ও মুড বলে একটা ব্যাপার আছে । আমি পড়া থামিয়ে গালে হাত দিয়ে বললাম , ” উপপাদ্য টা ভীষণ পচা , তাইনা তিহা ? একদম বোরিং ।” তিহা ফিক করে একটু হাসল । ও আমার কাছে কখনো কিছু লুকায় না । এবারো লুকোল না , মলিন গলায় বলল , ” আপু , মন খারাপ থাকলে ভাল পড়াগুলিও বোরিং হয়ে যায় ।” কথা সত্য । কেন মন খারাপ সেটা জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই ও বলল , ” আপু জানেন , ভাইয়া না মাদ্রাজ যাচ্ছে আগামী মাসে , কি ডিগ্রি ফিগ্রি নিবে , আমি তো বুঝিনা । ভাইয়ার জন্যে অনেক খারাপ লাগবে আমার । ঝগড়া করলেও তো আমারই ভাইয়া ।তাই পড়াতেও মন দিতে পারছি না । ” কি বলে তিহা ? ফারাবী ভাই মাদ্রাজ কেন যাবে ? এত ডিগ্রি দরকার কেন তার ? আমার চোখ দুটো পিথাগরাসের উপপাদ্যের মাঝে অযথাই এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে লাগল । এতক্ষন শুধু ছাত্রীর মন খারাপ ছিল , তাও পড়া যা একটু আগাচ্ছিল , কিন্তু যখন আমার ও ভয়াবহ মন খারাপ হতে লাগল তখন আর পড়া কিভাবে আগায় ? ” তোমার মন যেহেতু খারাপ আজ বরং একটু রিল্যাক্স থাকো ,আমি আসি ” বলে আমি পালিয়ে গেলাম । কিন্তু নিজের কাছ থেকে নিজে তো পালানো যায় না ।
আমি জানতাম আমি ফারাবী ভাই কে পাব না , একদিন না একদিন আমাকে অনেক কিছু এই চোখেই দেখতে হবে । কিন্তু আমি তো একদিন একদিন করে বেঁচে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছি , তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনই বেশিদূর ভাবতে পারতাম না । হাসতে হাসতে দিন কাটিয়ে কখন যে তাকে হারাবার দিন এগিয়ে এল সেটা টের ই পেলাম না । এখন সে চোখের আড়াল হবে , দুদিন বাদেই অন্য কারো সম্পদ হবে । আর আমি ফারাবী ভাইকে না পাওয়ার লিস্টে যুক্ত হব সবার চোখের আড়ালে । আমি কিন্তু অল্পতেই কেঁদে চোখ লাল করার মেয়ে , কিন্তু আজ আমি একটুও কাঁদলাম না । আজ আমি ভীষণ পরিনত ।
ছোটবেলা থেকেই রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনা আমি । খুব রাগ হলে চিৎকার করি , কিছুক্ষন পর যখন বুঝতে পারি যে চিৎকার করা ঠিক হয়নি তখন শব্দ না করে কাঁদি । আমার এতদিনের লুকোচুরি ভালবাসাটা হুট করে ভেঙ্গে যাওয়ায় যে কষ্ট আমার হচ্ছিল তা কিভাবে কিভাবে যেন রাগে রুপান্তরিত হয়ে গেল । সেই রাগে আমি না পারলাম চিৎকার করতে , না পারলাম কাঁদতে । ফলস্বরূপ পরদিন প্রচন্ড মাথাব্যাথায় ঘুম থেকে উঠলাম চোখ মুখ লাল করে । মাথাব্যাথায় রাতে এসে গেল সেই লেভেলের জ্বর । আমি প্যারাসিটামল নাপা ইত্যাদি ইত্যাদি সেবন করতে লাগলাম , এতদিনের অভিজ্ঞতা বলে তো একটা কথা আছে । পরের দিন সকালে কোন মাথাব্যাথা নেই , জ্বর নেই , কিন্তু এসিডিটির যন্ত্রণায় সোজা হতে পারলাম না । ভাবতে পারছিলাম না , কি পরিমান রাগটাই না করেছিলাম , মাথাব্যথা আর জ্বর দিয়ে বের হয়ে কুলাতে পারল না , এখন আবার এসিডিটি শুরু হয়েছে ! এরই মাঝে ডজনখানেক বার করে আম্মু আব্বু বলেছে ডাক্তারের কাছে যেতে , আমি ঘাড় বাকা করে বলেছি ,” এমনেই সেরে যাবে ।”
বিকেল বেলায় যখন ১০০ ডিগ্রি জ্বর , হালকা মাথাব্যথা আর এসিডিটি তিনটাই হাজির হল , আম্মু তখন ভয় পেয়ে বলল ,” রেডি হ ।” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম ,” মরার জন্য ?” ” থাবড়ায়া কানের পর্দাটা ফাটায় দিবো ।” ” আচ্ছা দিও ।” ” উঠতেছিস না কেন ? ডাক্তারের কাছে যাব চল ।” ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই লাগল । শেষমেশ উঠলাম , ভাবলাম লাস্ট বারের মত তাকে দেখে আসিগে । আজকের পর আর কক্ষনো তার কথা ভাববনা । আম্মু কে বললাম , আমি একাই যেতে পারব ।
একা একা যেটা শুরু করেছিলাম , আজ কে একা একাই তার শেষ দৃশ্য টা দেখে আসি ।
৪. ফারাবী ভাই গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , ” এই অবস্থা হলে হবে ?” তার কথার টাইপ শুনলে মেজাজ তো আমার এমনি খারাপ ই হয় । অন্যদিন যদিও আড়াল করার চেষ্টা করি , আজ আর করলাম না , বললাম , ” সেটা দিয়ে আপনার কি ? ওষুধ লিখে দেন । চলে যাই ।” ” আচ্ছা ” , প্যাড হাতে নিতে নিতে বলল ,” মাদ্রাজ যাচ্ছি জানো তো ? ” ” নাহ , এলাকায় এই নিয়ে কোন ব্যানার দেখিনি ।” ” ও আচ্ছা তিহা বলেনি তোমাকে তাহলে । আমি মাদ্রাজ যাচ্ছি এই মাসের শেষে । আম্মা তো খুব করে ধরেছে , বিয়ে করে যেতে হবে । তা না হলে নাকি আমি একবার উড়াল দিলে আর ফিরে আসব না ।” আমি চুপ করে থাকলাম । মনে মনে বললাম ,” ছ্যামড়া তোর আসার জন্যে কে মরতেছে ?” হুম আমি ই তো মরতেছি । ” বিয়ে করে দূরে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নাই , বুঝলা ইরা ? এঙ্গেজ করে রাখা যায় । তাতে রাজি হয়েছি । ” এবারো কিছু বললাম না । তবে মনে হতে লাগল , এর কাছে কি আমি সুস্থ হতে আসছি নাকি জলদি মরে যেতে আসছি ? এই ছেলে আমাকে এসব শুনাচ্ছে কেন ? ” দেশে আসার পরে জাঁকজমক অনুষ্ঠান করে বিয়ে করব । বিয়েতে তোমাকে একটা রোল দেওয়ার কথাও আমি ভেবে রেখেছি ।” আমি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালাম ,” তাই , না ?” আমার তাকানোর ভঙ্গীতে ডাক্তার সাহেব ভড়কে গেলেন সেটা আমি বুঝতে পারলাম । কোনরকমে বলল , ” ইরা তোমার কি হয়েছে ? কি সমস্যা ? অসুস্থ লাগছে ?” নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বলতে লাগলাম , ” এত কথা বলেন কেন আপনি ? আমার সমস্যা জানতে চান ? আমার সমস্যা কি সেইটা আপনি বুঝেন না ? মেডিকেল কলেজ থেকে কি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন ?মানুষের সাইকোলজি ধরতে পারেন না ? আমার কি সমস্যা সেটা কোন দিন বুঝবেন না আপনি , তাই প্লিজ জিজ্ঞেশ করবেন না । দয়া করে কোন কথা না বলে জ্বর আর এসিডিটির জন্য প্রেস্ক্রিপশান লিখেন ।” এতগুলি কথা এক নাগাড়ে বলে দেখি , ফারাবী ভাই তখনও নিঃস্পৃহ চোখে তাকিয়ে আছে । আমি কেন এসব বললাম জানিনা , কেন জানি প্রচন্ড কান্না পেতে লাগল । কান্না চেপে রাখতে গিয়েও পারলাম না , চোখের সীমানা ছাড়িয়ে একুয়াস হিউমারদের স্বাধীন আনাগোনা শুরু হয়ে গেল । তাড়াতাড়ি চোখ মুছে তাকিয়ে দেখি সে কলমের ক্যাপ খুলছে , প্রেস্ক্রিপশান লিখবে । লেখা হয়ে গেলে সে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । আমি প্রেস্ক্রিপশানটার দিকে একবার তাকালাম ।
তাকিয়ে থাকলাম এবং তাকিয়েই রইলাম ।
” ইরা , তোমার অসুখের একমাত্র চিকিৎসা টা হল , রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠবার পর এবং রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ডা. ফারাবী আহসানের হাতে দুইটা করে কান মলা খাওয়া । এই ওষুধ লাইফটাইম চালাতে হবে । অন্যথায় রোগির জীবন মরন সমস্যা হবে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ডাক্তার সাহেবেরও জীবনের আশংকা ঘটবে । ”
প্রেস্ক্রিপশানের দিকে আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল , ” কি হল ? ” আমি বোকার মত তাকিয়ে বললাম , ” আপনার লেখা বুঝতে পারছি না ।” ফারাবী ভাই হতাশ হয়ে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলল ,” জীবনে বুড়া বয়সে একটা লাভ লেটার লিখলাম , তাও লেখাটা বোধগম্য হল না । এই দুঃখ কোথায় রাখি ? তবে একান্তই না বুঝলে কি আর করা , ওষুধের দোকানদারকে দেখাইও ।” আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম , ” আমি লেখাটা কোনরকমে পড়তে পেরেছি । কথা হল , এসব ফাজলামির মানে কি ? আমার সাথে সেই কবে থেকে আপনি কেবল ফাজলামিই করছেন ,এমনটা কেন করেন ? আমি একটা মানুষ ,আমার এত সহ্য হয়না । ” সে কয়েক মুহূর্ত একদম চুপ । আমি বললাম ,” কি ? কথা বলেন না কেন ?” ” কি বলব আমি ? এই ক্লিনিকের প্রতিটা স্টাফ , কম্পাউন্ডার , নার্স এমনকি দারোয়ান চাচা পর্যন্ত বুঝে যে আমি তোমার উপর ড্যাম খেয়ে আছি , আর তুমি বুঝলা না ? কি জন্য বুঝলা না , সেটা তো আমি বুঝলাম না । ”
আচ্ছা আসলেই কি আমার বুঝা উচিত ছিল ? আমার সাথে সে অনেক আজাইরা আলাপ করত , এগুলো কি ভালবাসত বলেই করত ? আসলেই মনে হয় আমার বুদ্ধি বয়সের সাথে ব্যাস্তানুপাতে বেড়ে যাচ্ছে ! আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম ,” আমাকে না বিয়েতে কি একটা রোল দিবেন ?” ” কেন ? কনের রোল ? কনে থাকতে হবে না ?”
৫. ফারাবী ভাই কে আমি এখন শুধু ফারাবী বলে ডাকি , যদিও সে আমার থেকে বয়সে ভালই বড় । কিন্তু কি আর করব , বাগদানের পরে তো ” ভাই” বলতে গিয়ে কানমলা খেলাম , সেই রিস্ক কি আবার নেয়া যায় ? যাই হোক , আমি এখন ফারাবীর সাথে বসে আছি । আমাদের মাঝে দূরত্বটাও আপেক্ষিক , হয়ত খুব কাছে আবার হয়ত অনেক দূরে । কারন মাঝখানে দেয়াল হয়ে আছে ল্যাপ্টপের স্বচ্ছ স্ক্রিন টা । ডাক্তার সাহেব বাগদান করেই মাদ্রাজে দৌড় দিয়েছেন কিনা তাই !
” ম্যাডাম খুব খেপে আছেন । কি হয়েছে ?” ” তোমার মস্তিষ্ক হয়েছে ।” ” কেন ? মাদ্রাজ চলে আসছি বলে আবার মেজাজ গরম? ” আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম , ” একবার দেশে আসো , তোমার গায়ে আমি কালাসাবান ছুড়ে মারবো । এপ্রন থাকা অবস্থায় ই ।” ফারাবী করুন মুখে বলল ,” ঠিক আছে , আমি ঐ এপ্রন পরেই বাইরে যাব । সবাই বুঝুক জীবিত এবং বিবাহিতদের মধ্যে পার্থক্য ।” ” চুপপ ! ”
ফারাবী চুপ হয়ে মুচকি হাসতে লাগত । আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম , কালাসাবান আমি ছুড়ে মারবই । সাইজ করা দরকার ওকে । এপ্রন নোংরা হবে হোক । আমি যেহেতু নোংরা করব , আমিই পরিস্কার করব , সমস্যা না ।
কথা হল, বাজারে এখন ভাল ডিটারজেন্ট কোন টা ? সার্ফ এক্সেল ?নাহ যাই , টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখতে হবে !