মিঠু, মিঠু। এই মিঠু। সকালবেলায় এই ডাকাডাকি মিঠুর ঘুম ভাঙিয়ে দিল। কে কে? আমি আমি শ্রাবণী। কি রে কখন থেকে ডাকছি। ওঠার নাম নেই। কি ঘুম রে বাবা। মিঠু উঠে বসে চোখ কচলালো। বাড়ির সবাই এখনও ঘুমে। জানালার বাইরে মিঠুর উৎসুক মুখ। এত সকালে কী ব্যাপার?
–
তুই আয় না, বেরো আগে, তারপর বলছি।
–
মিঠু বেরিয়ে এল। এখনও সূর্যের আগমন হয়নি। সামনের ফুলবাগানে, গাছপালায়, আকাশে, বাইরের মাঠে সর্বত্র একটা ঘুম ঘুম ভাব। শ্রাবণী দাড়িয়ে আছে একটা কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে। সে মিঠুর সঙ্গে একই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে।
–
কি রে কী হয়েছে?
আমার কিছু ফুল লাগবে।
কেন?
আজ আমার নাচের ফাংশান আছে। সাজার জন্য লাগবে।
ঠিক আছে তোর যা দরকার নিয়ে যা।
–
মিঠুদের বাড়ির সামনে খানিকটা জমি। তাতে নানা ধরনের ফুলগাছ, তাতে প্রচুর ফুল। বিশেষ করে গাঁদা ফুলের মেলা লেগে আছে। শ্রাবণী তার কাপড়ের ব্যাগে ফুলগুলো ভরে নিল।
–
কি নাচ নাচবি রে? কোথায় ফাংশান?
ওই তো, ‘বসন্তে ফুল গাঁথল’ ওই গানের সঙ্গে নাচব। আমাদের পাড়ায় ফাংশান। তুই আসবি দেখতে? আয় না।
এখন একটু নেচে দেখা না আমাকে।
না না না, ইস্ কী বলছিস। এখন আমি কিছুতেই নাচতে পারব না।
–
মিঠু আর কিছু বলল না। শ্রাবণী যেতে যেতেও ফিরে দাঁড়াল, সত্যি বলছি রে মিঠু, আমার না এখন নাচের মুড একটুও নেই, বলে সে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
–
মিঠু বুঝল শ্রাবণী নাচতে চায়, কিন্তু একটু সাধাসাধি করুক মিঠু, সেটাও চায়। মিঠু শ্রাবণীর হাত চেপে ধরল, নাচতেই হবে, নইলে যেতে দেব না।
–
এই না না, কী করছিস! ছাড় ছাড় বলছি। উরিই বাবা ছাআআড় না।
আমি তোর কথা শুনিনি? এত ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে ওঠালি আমাকে। আমার কথাও তোকে শুনতে হবে।
উঃ তুই না। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে দাঁড়া নাচছি।
–
শ্রাবণী গুনগুন করে গাইতে লাগল আর তালে তালে মাটিতে পা ফেলতে লাগল। তালে তালে পা ফেলাটাও কি সুন্দর। মিঠু মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল। গুনগুন করতে করতে শ্রাবণী গান শুরু করে দিল, আর নাচও। চমৎকার নাচে ও, সুন্দর ছন্দোময় শরীর। নাচ আর গান চলতে লাগল। শেষের দিকে শ্রাবণী হাঁপিয়ে গেল। গানের থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ বেশি শোনা যেতে লাগল।
–
তখন মিঠু গানে যোগ দিল। মিঠুও মন্দ গায় না। কিন্তু নাচ তার একেবারেই আসে না। নাচ শেষ হল। মিঠু বলল, এত সুন্দর নাচিস তুই।
শ্রাবণীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, যাঃ কি যে বলিস।
–
মিঠু জানে শ্রাবণীর কোনও নাচের টিচার নেই। বন্ধুরা যারা নাচ টাচ করে, তাদের দেখেই শিখে নেয় আর শিখে নিয়ে তাদের থেকেও ভালো নাচে। তাই বলল, সত্যি রে। ভীষণ ভালো লাগল। কার কাছ থেকে শিখলি এই নাচটা?
কারোর থেকে না। আমি নিজে বানিয়েছি।
কী করে বানালি?
বাহ্ রে, গানের কথা শুনলেই তো বানানো যায়। কথার মানে বুঝে ফিগার ঠিক করতে হয়।
তুই এবার কোনও টিচারের কাছে নাচ শেখ, তাহলে আরো ভালো হবে।
শ্রাবণী একটু ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ শিখব।
মিঠু বুঝল। শ্রাবণীর মা এই সব নাচ টাচ করাই পছন্দ করে না, নাচ শেখা তো দূরের কথা।
–
শ্রাবণী বলল, তুইও তো দারুণ গান করিস। তুই আমার নাচের সঙ্গে গাইলে ভালো হত। কিন্তু পুণ্যি পিসি গাইবে ঠিক হয়ে আছে।
ছাড় তো। সবাই তোর নাচ দেখবে। গান কে গাইল সেটা কী এমন ব্যাপার।
–
এখন যাই রে। অনেক কাজ আছে। মালা গাঁথতে হবে তার পর দুপুরে মাথা ঘষে চান করব তারপর ফাইনাল রিহার্সাল, পুণ্যি পিসির বাড়ি যেতে হবে। তারপর সাজগোজও আছে, পুণ্যি পিসি আমাকে সাজিয়ে দেবে। বাব্বা, আজ সারাদিন ব্যস্ত থাকব। এই সব পাকাপাকা কথা বলে শ্রাবণী চলে গেল।
–
সুন্দর লালিত্যে ভরা চেহারা তার, দিও বেশ রোগা। সুন্দর মুখশ্রী। আনন্দে ভরপুর। মিঠুর মন খারাপ হয়ে গেল। একটু ঈর্ষাও হল, অথচ শ্রাবণী তার বন্ধু। ঈর্ষা হওয়া উচিত নয়। ঈর্ষার জন্য মিঠুর নিজের উপরেও রাগ হল। মনে হল সে এত খারাপ। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া যায় না। “আমি মোটেও খারাপ নই” বলে সে অদৃশ্য কাউকে ধমকাল। মিঠু সন্ধের সময় শ্রাবণীর নাচ দেখতে গেল, আরো কজন সঙ্গীসাথী নিয়ে। ‘আমরা তরুণ’ ক্লাবের ক্লাবঘরের সামনে যে ফাঁকা জমি আছে, সেখানেই প্যান্ডেল করা হয়েছে। বেশ ভিড় হয়েছে। কয়েকজনের বক্তৃতা গান ইত্যাদির পর শ্রাবণীর নাম ঘোষণা হল। শ্রাবণী স্টেজে এল। দারুণ সেজেছে, ফুলের গয়না পরে। নাচ শুরু হল। অপূর্ব নাচ, অপূর্ব দেহভঙ্গি। মিঠুরা মুগ্ধ হয়ে দেখল। শ্রাবণী নাচ শেষে স্টেজ থেকে নেমে গেল। কিন্তু আবার তার নাম ঘোষণা হল, তাকে মঞ্চে আসতে বলা হল। এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, স্থানীয় লোক নন। শ্রাবণীর নাচ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি শ্রাবণীকে দশ টাকা পুরস্কার দিতে চেয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
–
শ্রাবণী স্টেজে এল, পুরস্কার গ্রহণ করল। তাঁকে প্রণাম করল। ভদ্রলোক বাধা দিয়েছিলেন প্রণাম করতে, কিন্তু শ্রাবণী কোনও বাধা মানেনি, জোর করেই প্রণাম করল। শ্রাবণী মাইকে বলল, আমাদের বাড়ি আজ চলুন না। পরক্ষণেই সংশোধন করে নিয়ে বলল, একদিন আসবেন কিন্তু আমাদের বাড়ি। সবাই হা হা করে হাসল তার কথা শুনে। কিন্তু মিঠু জানে, শ্রাবণীর মা অত্যন্ত রুক্ষস্বভাবের মহিলা। এই সব নাচ টাচ একেবারেই পছন্দ করে না। শ্রাবণীর বন্ধুরা এলে তাদের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়, তাদের সামনেই মেয়েকে বকাবকি করে। কিংবা শ্রাবণীকে ঘরের কাজে ব্যস্ত রাখে। তাই শ্রাবণীর বাড়ি কেউ যেতে চায় না। শ্রাবণী মাকে খুব ভয় পায়। শ্রাবণী আনন্দের আতিশয্যে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই প্রণাম করছে। আনন্দে হাসিতে তার মুখ উজ্বল হয়ে আছে। মিঠুকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করল, মিঠু যাস কিন্তু আমাদের বাড়ি। বেশ ঢং করে বলল। যাসকে বলল যাশ। আসলে এত প্রশংসা সম্মান ও তার সাথে পুরষ্কার পেয়ে আনন্দের চোটে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
–
মিঠু বাড়ি এসেও শ্রাবণীর নাচ ভুলতে পারল না। মুগ্ধতা তার মনকে ছেয়ে আছে। পরদিন শ্রাবণী স্কুলে এল না। মিঠু স্কুল থেকে ফেরার পথে শ্রাবণীর বাড়ি গেল। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকতে সাহস পেল না। শ্রাবণীর মায়ের চিৎকার সে বাইরে থেকেও শুনতে পাচ্ছে, শ্রাবণীর কান্নাও। শ্রাবণীর মা বলছে, বল, বল কেন টাকা নিয়েছিস? ভিখিরি না কি তুই, অ্যাঁ? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? শ্রাবণীকে মারছেও তার মা, মিঠু বুঝতে পারে।
–
শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ও মা, আর এমন করব না, ছেড়ে দাও।
কিন্তু শ্রাবণীর মা ছাড়ার লোক নয়। মিঠু হাঁটতে লাগল, শ্রাবণীর কান্না আর তার মায়ের চিৎকার ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। এরপর তিন চারদিন শ্রাবণী স্কুলে এল না। মিঠু শ্রাবণীর বাড়ি যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না। কিন্তু তাকে দেখার জন্য ছটফট করে। একদিন শুনল শ্রাবণী মারা গেছে। মিঠুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কী হয়েছে? কী করে এমন হল!
–
পাড়ার লোকেরা বলাবলি করছে, ভোরবেলা না কি শ্রাবণী বিছানা থেকে ওঠার জন্য মশারি তুলতেই সাপ এসে তাকে ছোবল মেরেছে। পাড়ার সবাই দলে দলে তাকে দেখতে গেল। কিন্তু মিঠু গেল না। শ্রাবণীর দেহ সে শায়িত অবস্থায় কিছুতেই দেখতে পারবে না। এরপর পাড়ায় বহুদিন ধরে শুধু শ্রাবণীর কথা, তার মৃত্যুর কথাই আলোচিত হত। সেই সঙ্গে এর আগে কবে কার সাপের ছোবলে মৃত্যু হয়েছে, কে সাপের ছোবলে মারা যাওয়ার পরেও অলৌকিকভাবে আবার জীবন ফিরে পেয়েছে, সে সম্বন্ধেও আলোচনা হত। নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা ঘটনা ঘটলে মানুষ তাকে ছাড়তে চায় না। তার সব রস নিংড়ে উপভোগ করতে চায়।
–
এরপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। সমাজ বদলেছে, মানুষরা বদলেছে। এখন মায়েরা মেয়েদের নাচ শেখায় গান শেখায়, মেয়ের মধ্যে প্রতিভা থাকুক বা নাই থাকুক। মায়েরা পাড়ায় বা মেয়ের স্কুলে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তাদের মেয়েকে গানে, নাচে বা আবৃত্তিতে সুযোগ দেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করে। মেয়ের প্রোগ্রাম থাকলে তাকে সাজায়-গোজায়, অনুষ্ঠানে নাচতে গাইতে নিয়ে যায়, ফটো তুলে রেখে দেয় আত্মীয়বন্ধুদের দেখানোর জন্য। শ্রাবণীর মায়ের মত মহিলারা এখন সম্ভবত বিলুপ্ত প্রজাতি। শ্রাবণীর মত প্রতিভাও আর দেখা যায় না, অন্তত মিঠু দেখেনি।