লাজুক বর

লাজুক বর

বাসর রাতে হাত ধরার সাথে সাথে কারেন্টের শক খাওয়ার মত লাফিয়ে দূরে সরে গেলো আমার বর। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম তাকে,কি হয়েছে?ওমন করে লাফিয়ে দূরে সরে গেলে কেন? আমার শরীরে কারেন্ট নাকি যে শক খেলে?

-না মানে,তুমি ঘুমিয়ে যাও।সকালে আমার অফিস আছে।অফিসে যেতে হবে।

এ কথা বলে সে আমাদের দুজনের মাঝে একটা কোল বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লো। আমিও আমার মত ঘুমিয়ে গেলাম। আমাদের সম্পর্কটা ফেসবুক থেকে হয়েছে।চ্যাটিং এ চ্যাটিং এ প্রেম।তারপর বিয়ে।বিয়ের দিনই আমাদের প্রথম সাক্ষাত। বাসর রাতের এমন অদ্ভুত আচরণে একটু অবাকই হয়েছি আমি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ফাইজান ডাকছে।চারপাশ তাকিয়ে দেখি বাথরুম থেকে ডাক টা আসছে।কাছে গিয়ে বললাম কি হয়েছে?

-আমার শার্ট টা আলমারিতে রাখা আছে।একটু দিবা?আমি ভুল করে রেখে এসেছি।
-আমিতো চিনিনা কোনটা পরবে এসে বের করে, রুমে এসেই পরো।

আমার জীবনে আমি কাউকে দেখিনি বাথরুমে অফিসিয়াল ড্রেস পরে বা বেড়াতে যাওয়ার জন্য রেডী হয়।
টিভিতে সব সময় দেখি ছেলেরা তোয়ালে পেঁচিয়ে এসে রুমেই ড্রেস পরে। কিন্তু উনি এমন করছে কেন বুঝতে পারছিনা।

-না না তুমিই দাও,ওইযে আকাশী রঙের শার্ট টা।
-আচ্ছা দিচ্ছি।

সে রেডি হয়ে অফিসে চলে যাচ্ছে। কত স্বপ্ন দেখেছি,আমার বর অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিন আমার কপালে চুমু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে যাবে সাবধানে থেকো। অথচ উনি কিছু না বলেই চলে গেলো? আমি বাসর রাতেই বুঝেছি কোন না কোন প্রবলেম তো অবশ্যই আছে,নইলে সারারাত চুপ করে বসে থাকার পর আমি ভোর চার টায় হাত ধরার পর লাফিয়ে সরে যেতোনা। ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সারাদিন চলে যাচ্ছে তার খবর নেই।অন্তত একটা ফোন তো দিবে নতুন বউ বাসায় রেখে গেছে।অথচ নাহ্।সে হয়তো ভুলেই গেছে আমার কথা।আর বিয়ের ২য় দিনই কেউ অফিসে যায়,আমি আমার জন্মে দেখিনি। যাইহোক,অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে রাতে তিনি বাসায় ফিরলেন। কত স্বপ্ন ছিলো,আমার বর চকোলেট,ফুল কিছু এনে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। অথচ সে খালি হাতে ঢনঢন করে চলে এসেছেন। তাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললাম,বললাম আমি খাবার রেডি করছি। সে আমাকে যা বল্লো শুনে আমি এবার শক খেলাম।

-বের হও।
-বের হবো মানে?
-রুম থেকে বের হও।
-কেন বের হবো?
-আমি ড্রেস চেঞ্জ করবো।

প্রথমে তো ভয় পেয়ে গেছি,ভাবলাম এমন করছে কেন।পরে বুঝলাম ড্রেস চেঞ্জ করবে বলে বের হতে বলছে রুম থেকে। ভাবতে ভাবতে বের হয়ে গেলাম,আবার এ ও ভাবছি আমার সামনে ড্রেস চেঞ্জ করতে কি সমস্যা? যাকগে,ডিনার করলাম। জিজ্ঞেস করলো সারাদিন কেমন কাটলো, বললাম আপনি যেমন রেখে গেছেন তেমনই। সে বল্লো,আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো। এ কথা বলে কোল বালিশ টা আবারো মাঝ খানে রেখে ঘুমিয়ে গেলো। আমি মন মরা হয়ে বসে রইলাম। একটু কথা তো অন্তত বলবে,সেই সময় টুকুও নাই।ঘুমানো এত দরকার।প্রেমের সময়ও সকালে ডিউটি আছে বলে ঘুমিয়ে যেতো।এখনো ঠিক তাই। এভাবেই চলছে। আজ বিয়ের ১০ দিন। ফাইজান ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো, আমার বান্ধবী দিতির কল।

-কিরে?কেমন কাটছে বিবাহিত জীবন?দুলাভাই কি খুব দুষ্টুমি করে?আমি কি ডিস্টার্ব করে ফেললাম নাকি?
-আরে নাহ্।ঠিক আছে।
-ঠিক আছে মানে?বলবিনা কিছু তাইতো?ওকে,বিয়ে আমরাও করবো,বর আমাদেরও হবে হুহ।
-আরে কি যে বলিস।কি বলবো?তেমন কিছুই হয়নি আমাদের।সে ঘুমাচ্ছে।
-বলিস কি?নতুন বউকে জাগিয়ে রেখে ঘুমাচ্ছে?বাসর রাতে কি করেছিস?
-কি আবার করবো,ঘুমিয়েছি।
-মানে কি?
-মানে আবার কি?সারারাত দুজনি চুপ করে ছিলাম।পরে ভোর চার টার দিকে আমি যেই ওর হাত ধরলাম।সেই সে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেলো।ঘুমিয়ে গেলো মাঝ খানে একটা কোল বালিশ রেখে।এটা আমাদের বাউন্ডারি।আজও সেইম।এভাবেই চলছে।

-হায় আল্লাহ্‌ বলিস কি?দুলাভাই এর আবার কোন প্রবলেম নাই তো?না মানে ইয়ে।
-কি বলিস?
-হ্যাঁ থাকতেও পারে,তাই হয়তো তোকে এভয়েড করে।
-তাহলে বিয়ের কি দরকার ছিলো?
-শোন,তুই এখনি তোদের ওই কোলবালিশ টা সরিয়ে দুলাভাই এর কাছে যাবি।বুকে হাত রাখবি।জাস্ট এতটুকুই।যদি সে তোকে বুকে জরিয়ে নেয় তাহলেতো সমস্যা সমাধান।আর যদি না নেয় তবে সকালেই তুই একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি তাকে।ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছিস।কি আর করার।

-আচ্ছা ।
-রাখি তাহলে কাঁদিস না।যা বলেছি তাই কর।

আমি আমাদের মাঝে রাখা কোল বালিশটা একটা আছাড় দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম।এই ভেবে যে এটাই ফাইজান,মানে আমার বর।সব রাগ আমার ওর উপর আজ। তারপর রাগ টাকে কন্ট্রোল করে ফাইজানের কাছে গিয়ে ওর বুকে হাত রাখলাম। আর ও এক লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে গেলো.

-কি করছো তুমি?ঘুমাও ঘুমাও। সকালে জব আছেনা আমার।অফিসে যেতে হবে। এই বলে সে বালিশ নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো। তাহলে কি দিতির ধারণাই ঠিক?কাঁদতে কাঁদতে সারারাত কেটে গেলো। সারারাত জেগেই কাটলো আমার। সকালে তার ঘুম ভাঙতেই তাকে বললাম,

-আজ আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো।রেডি হয়ে নাও।
-কেন?তোমার কি শরীর খারাপ?
-না আপনার শরীর খারাপ(রেগে) রেডি হোন তাড়াতাড়ি।

-না আমার আর্জেন্ট কাজ আছে আমি যেতে পারবোনা।তুমি চলে যেও।
-তুই যাবিনা তোর ১৪ গুষ্টি যাবে।আমার জীবন টা নষ্ট করার অধিকার কে দিলো তোকে?বিয়ে করলি কেন আমাকে তাহলে?তোর যখন সমস্যাই।বিয়ে টা না করলেই পারতি। ও এত ক্ষণে বুঝতে পেরেছে।আমি ওর প্রব্লেমের কথা টা বুঝে গেছি। তাই ও বলছে,

-আসলে কি করবো বলো?ভেবেছিলাম ধীরেধীরে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু হচ্ছেনাতো।
-হচ্ছেনা মানে?আগে বোঝা উচিৎ ছিলো আপনার।আমার জীবন টা কেন নষ্ট করলেন?
-নষ্ট করলাম মানে?
-চুপ একটা কথা না।তুই আমার সাথে এক্ষণ ডাক্তারের কাছে যাবি।
-ডাক্তার কি করবে?
-ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করবে।

-ডাক্তার এ সমস্যার ট্রিটমেন্ট করবে কি করে?এ সমস্যা তো আমার ছোট বেলা থেকে।
-কিইই?এ সমস্যা ছোট বেলা থেকে মানে? হায় আল্লাহ্‌ আমার কপালে তুমি এমন একটা মানুষ রে রাখলা।
-তুমি কাঁদছো কেন?
-চুপ,কথা বলবিনা তুই।
-দেখো,তুমি কাঁদবে না।আমি ছোট বেলা থেকেই এমন।ভেবেছিলাম বিয়ের পর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে আর তোমায় আমি ভালবাসি,তাই বিয়ে করা।
-তুই যদি আগেই জানতি তোর সমস্যা আছে,বিয়েটা না করলেই পারতি।আমার জীবনটা এমন তছনছ হয়ে যেতোনা।
-আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা,আমার লজ্জা পাওয়ার সাথে তোমার জীবন তছনছ হবার সম্পর্ক কি?
-মানে?

-আমি ছোট বেলা থেকেই এমন লাজুক।এত লজ্জা যে কই থেকে আমার মধ্যে আসলো আমি জানিনা।আজো কোন মেয়ের দিকে তাকাইনি।আমরা যখন চ্যাটিং করতাম দেখতেনা আমি তোমায় উম্মাহ্ লিখেও লজ্জার ইমুজি দিতাম।কি যে লজ্জা পেতাম আমি।তুমি যখন বাসর রাতে আমার হাত ধরলে আমি লজ্জায় সরে গেছি,তুমি টাচ করার সাথে সাথে আমার শরীরে যেন কারেন্ট লেগে গেছে।আবার গতকাল রাতে যখন বুকে হাত রেখেছো,আমার যা সুড়সুড়ি লেগেছে।আর লজ্জা তো আছেই,তাই সরে গেছি।এই সমস্যা যে আমার কবে যাবে।তুমি কোন চিন্তা করবে না হ্যাঁ?আমি দেখছি কি করা যায়।লজ্জা টা তো আমার এবার যে করেই হোক ভাঙাতে হবে। নইলে আমার বউকে আদর করবো কি করে? আমি চুপ করে ফাইজানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি অবাক দৃষ্টিতে।

-তুমি জানো আমার যখন তিন বছর বয়স তখন থেকে আমি কোন দিন কারো সামনে হিসুও করিনি।
তাহলে বুঝো।

আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা,আমার বরের অন্য কোন সমস্যা না।তার লজ্জাই তার মেইন সমস্যা।এই জন্যই আজো আমি তাকে খালি গায়ে দেখিনি।প্রচন্ড গরমেও সে গেঞ্জি পরে ঘুমায়।প্রেম চলাকালীন তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম,তোমার বুকে লোম আছে?শুনেছি বুকে লোম থাকলে সে নাকি বউকে খুব আদর করে।ইশ!সে কি লজ্জা।সে এই কথা শুনে লজ্জায় কথাই বলতে পারছিলোনা।পরে টপিক চেঞ্জ করেছিলো। তার কথা শেষ হতেই তার গেঞ্জি ধরে টান দিয়ে আমার কাছে আনলাম,আর বললাম।

-আজ থেকে আমার লাজুক বরের লজ্জা ভাঙানোর দায়িত্ব আমার ঠিকাছে?
-বউউউউ!
-কিইইইই।
-লাইট তো অফ করো।

যাক বাবা,শেষমেস আমার লাজুক বরটা জড়িয়ে ধরেছে আমায়। আর আমি তার হার্টবিটের শব্দ পাচ্ছি। হায়রে লাজুক বর আমার।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত