স্বপ্ন পূরণের খুশি

স্বপ্ন পূরণের খুশি

সদ্য গ্রাজুয়েট হওয়া কোন ছেলের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মতো বিড়ম্বনা আর নাই। কানের চারপাশে রেকর্ড বাজতে থাকে। পড়ালেখা তো শেষ। চাকরির আর কতদিন? কিছু বুঝুক না বুঝুক, সবার ওই একই প্রশ্ন, চাকরির আর কতদিন। চতুর্থ বর্ষ থেকে সজল বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ভার্সিটির আবাসিক হলে থাকে। মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠায়।

অনেকদিন পর সজল বাড়িতে এসেছে। তাঁর মাস্টার্স শেষ প্রায় বছরখানেক হলো। চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে কয়েকটা। কোনোটাতে প্রিলি টপকাতে পারে নাই। এতদিন বাবা চাকরির ব্যাপারে কিছু বলে নি। ছেলে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। নিশ্চয়ই বড় কোন চাকরির জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ছেলের এ ব্যাপারে কোন কথা নেই। এবার ছেলেকে দুইবার জিজ্ঞেস করেছে। সজল কেমনজানি বিষয়টা এড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করা মাত্র খাওয়া ছেড়ে উঠে চলে যায়।

আজ সজলের বাবা একটু জোরাজুরি করলো। সজল রাতে খেতে বসেছে। সজল, বাবা, তোর কিছু হয়েছে? পড়ালেখা শেষ করলি অনেকদিন। কোন চাকরিবাকরির খোঁজ নাই। কিছু হইছে বাবা? হইলে বল।

সজল চুপ। মাথা নিচু করে প্লেটে ভাত মেখে যাচ্ছে। সজলের মা মুখ খুললেন। সজল, বাবা আমার, কিছু হইছে? বল আমাদেরকে। মা-বাবাকে না বললে কাকে বলবি বল।

সজলের বাবা-মা বুঝতে পারে নাই ছেলেটা ভেতরে ভেতরে এভাবে পুড়ছে। কী বলব তোমাদের বল। কী বলবো? এটা বলবো যে তোমাদের ছেলে লাস্ট তিনটা বছর কোন পড়ালেখা করে নাই? একটা মেয়ের পেছন পেছন কুত্তার মতো দৌড়াইছে। কী করব বল আমাকে। এই মেয়ের জন্য কেন আমার এতো ভালোবাসা আমি নিজেই বুঝি না। লাস্ট তিনটা বছর আমি ওর পেছনেই দৌড়াইছি। স্কুল-কলেজে ফার্স্ট হওয়া, তোমাদের গ্রামের গর্ব ছেলেটা একজন মেয়ের জন্য বাউণ্ডুলে হয়ে গেছে শুনতে ভালো লাগবে তোমাদের? মা, তোমাদের এই গরিবি সংসার আমার আর ভালো লাগে না। সহ্য হয় না কিছু। সবকিছু বিষ বিষ লাগে আমার। চলে যাও আমার সামনে থেকে।

পরিস্থিতির কিছুই যেন মাথায় ঢোকে না সজলের বাবা-মার। ঢাকায় থেকে কল দিলে ছেলেটা কত হেসে হেসে কথা বলে। টিউশনি করে নিয়মিত টাকা পাঠায়। ছোট ভাইটাকে পড়ালেখা নিয়ে কত বুদ্ধি পরামর্শ দেয়। সেই ছেলেটার মনে এতো কষ্ট আর ক্ষোভ? কোনদিন তাঁরা জানতেও পারলো না? এ কেমন অভিনয় তাদের সজলের!

(২)
কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো সজলের। সকাল হয়েছে কি না বুঝতে পারলো না। দরজা খুলে বাইরে তাকাল। না। সকাল হয় নি এখনো। আবছা অন্ধকার। কান্নার শব্দ আসছে বাড়ির পেছন থেকে। তাঁর মা বড় সন্তানের শ্মশানে মাথা ঠুকে কান্না করছে। সজলকে দেখে তাকে জড়িয়ে মরা কান্না জুড়ে দিল। আর যাই করিস বাপ, তোর বড় ভাই, আমার বড় বাপধনটার মতো আত্মহত্যা করিস না বাপ। লাগবে না আমাদের চাকরি। যতদিন লাগে বসে থাক। তারপর চাকরি করিস। তোর দাদার মতো কিছু করিস না বাপ। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সর্বকনিষ্ঠ সন্তান কাজল কিছুই বুঝতে পারে না।

শুধু কাজল না। প্রথমে সজলও কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। তারা এতদিন জানতো তাদের দাদা বুয়েটে পড়তো। বাড়িতে আসার পথে বাস দূর্ঘটনায় মারা যায়। অথচ আজ মা বলছে সে আত্মহত্যা করেছিল!

বিষয়গুলো ধীরে ধীরে পরিস্কার হয় সজলের কাছে। পাশের বাড়ির সোমা বৌদির কাহিনি তাহলে এই। এই কারণে তিনি আমাদের দুই ভাইকে নিজের ভাইয়ের মতো আদর করে? মায়ের জ্বর দূরে থাক, কপাল একটুখানি গরম হলে ডাক্তার-বৈদ্য নিয়ে সোমা বৌদির হইচই ফেলে দেওয়ার রহস্য তাহলে এই? বিকালবেলা আমগাছের তলে মায়ের মাথায় তেল দিতে দিতে বৌদি যে ছেলের প্রেমের গল্প পাড়ে, সে-ই কি তাহলে তাদের দাদা? হায়! এতকিছু তাদের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। অথচ তারা কিছুই বুঝতে পারে নি।

ভার্সিটির রুপসী তরুণী এই সোমা বৌদির প্রেমে পড়ে সজলের দাদা। সোমা সসম্মানে প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। আবার প্রস্তাব আসে। আবার বাতিল। এভাবে চলতে থাকল। একদিন আবেগি ছেলেটা আত্মহত্যা করে বসে! সোমা পরিবারের ঠিক করা কানাডার ছেলের বিয়ে প্রস্তাবে রাজি হলেও বিয়ে করলো সজলদের পাশের বাড়ির মা-বাবাহীন শংকরকে!

(৩)
এক সপ্তাহ বাড়িতে থাকা হলো। আজ ঢাকায় চলে যাবে সজল। পরিবেশ থমথমে। সোমা বৌদির সাথে বিদায় পর্ব সারতে গেল। বৌদি। এক ডাক দিয়ে থেমে গেল। আজ গলাটা কেমন করছে যেন। বৌদি ঘরের বাইরে বের হলো। ‘ভালোমতো যাও সজল’ বলে কিছুটা থামলো। ‘আই হেইট ইউর দাদা, সজল!’ বলেই কান্না করতে করতে ঘরে ঢুকে গেল। হায় জীবন! ঘৃণায় ভালোবাসার এই জীবন!

বাবা আর ছোট ভাই সজলকে বাসে তুলে দিতে এসেছে। সেই রাতের ঘটনার পর বাবা চুপচাপ। সজল বাবার পা ছুঁয়ে নমস্কার করে বাসে উঠলো। সাথে সাথে বাবাও উঠলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো, বাবা রে, আমি অশিক্ষিত মানুষ। অতো কিছু বুঝি না। তবে ‘মেয়ের পেছন পেছন দৌড়াইছি’ বলে নিজেকে ছোট ভাবিস নারে বাপ। যেখানে বেশি ভালোবাসা, সেখানে বেশি কষ্ট রে বাপ। তুই আরেকবার মেয়েটার কাছে যা।

(৪)
ঢাকায় এসে ফের রুটিনবাঁধা জীবন শুরু। শুক্রবার চাকরির পরীক্ষা থাকে। দেয়। কোন কাজ হয় না। এভাবে চলে যেতে থাকে প্রতিটি শুক্রবার।

একদিন লাজ-লজ্জা, মান-সম্মানের তোয়াক্কা না করে সজল আবার গেল লাবণ্যের কাছে। টিএসসির সবুজ মাঠে পাশাপাশি দুজন। সজল মুখোমুখি হয়ে লাবণ্যের হাত ধরলো। লাবণ্য, শুনতে বাচ্চামি লাগবে। তবু বলছি। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তোর হাত দুটো লাগবে আমার। অনেক তো হলো। তিন তিনটা বছর। এর মাঝে আমি অন্য রিলেশনে জড়াইতে চাইছি। পারি নাই। সবার মাঝে আমি তোর ছায়া খুঁজি। আমি জানি না কিছু লাবণ্য। আমি প্রতিদিন সকালে উঠে তোর মুখটা দেখতে চাই। সকালে তোর ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখলে আমার আর কিছু লাগবে না। মাঝরাতে অসহায় লাগলে আমি শুধু তোকে জড়িয়ে ধরতে চাই। আচ্ছা, শোন, দরকার হলে আমার বউ হওয়ার পর তুই অন্য কারও সাথে প্রেম করিস। যা ইচ্ছা করিস। তবু প্রতিদিন সকালে উঠে আমি তোর মুখটা দেখতে চাই লাবণ্য।

শেষ কথায় হেসে ওঠে লাবণ্য।
তারপর সজলের দিকে না তাকিয়ে বলে, আমি শাড়ি খুব প্রিয়।
তো?
প্রতি মাসে একটা করে শাড়ি চাই।
ও মাই গড! তার মানে তুই রাজি? ও খোদা, আমি এখন কী করি। খুশিতে দেখছি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে! ও মোর খোদা! আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ!

আক্ষরিক অর্থেই টিএসসির ভরা মজলিশে নাচানাচি শুরু করে সজল। যে কারণে তার নাচ থামে, সেটা আরও বেশি নাচানাচির কারণ। মোবাইল ভাইব্রেট করছে। কল রিসিভ করে জানতে পারলো, তার চাকরি হয়ে গেছে। সজল নিজেও ভাবতে পারছে না বিষয়টা। এত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান তার মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত সিজিপিএ ধারীকে কেমনে চাকরি দিল কে জানে!

আজকের মতো খুশি মন নিয়ে কখনো বাড়িতে যায় নি সজল। ট্রেনের এসি কামড়ায় সিট নিয়েছে। একসাথে কত স্বপ্ন পূরণের আনন্দ! হঠাৎ বিকট আওয়াজ। মুখোমুখি ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত ২০। তার মাঝে সজল ছিল।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত