ভেজা বিকেল

ভেজা বিকেল

দুপুর থেকেই আকাশটা মেঘলা। সূর্য এই হাসে এই আবার লুকিয়ে যায় লজ্জাবতী নতুন রাঙ্গা বউয়ের মতো। একটি বৃষ্টির জন্যে গত পাঁচ দিন আগেও অনেকের প্রত্যাশার শেষ ছিল না। সেই প্রত্যাশার বৃষ্টি হয়ে গেছে তাও আবার কোনো অগ্রিম সংকেত না দিয়ে।

অথচ সকাল থেকে সংকেত থাকা সত্ত্বেও দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির কোনো খবর নেই। আকাশকে গম্ভীর হতে দেখলেই মৌমিতা দৌড়ে রুমে যায়, জানালাগুলো হালকা ভাবে টেনে দেয়; এরপর যায় বারান্দায়, ভালোবাসার আবেশ জড়ানো সাদা পোশাকগুলো তুলে নিয়ে আসে। আবার রোদ্রের ঝলকানি দেখে কাপড়গুলো নেড়ে দেয়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে এই মুহুর্তে যদি বিপুল কল করতো, ওকে ওর পছন্দের গানটা শুনিয়ে দিতো। এমন মেঘে ঢাকা আলো আধারের লুকোচুরি খেলার সময়ে বিপুল গানটি বারবার শোনে। গত সাত বছরে দুজন দুজনকে অনেক কাছ থেকে দেখেছে, বুঝেছে। বিপুল কখন কোন গানের আবদার করবে তা মৌমিতা বুঝেই যায়। প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে চলে বিপুলের মন। আর সে কারণে বুঝতে দেরি হয় না ওকে।

খামার বাড়ির এক প্রোগ্রামে মঞ্চ কাঁপিয়ে গান করছে মৌমিতা। ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীরা একের পর এক গানের অনুরোধ করে। সেই দিনের সময়টাও ছিল এমন ভেজা বিকেলের। কথা ছিল পাঁচটি গান করবে মৌমিতা। সেখানে আটটি গান করার পরও ভক্তদের আরো অনুরোধ আসতে থাকে, বাধ্য হয়ে সঞ্চালক ঘোষণা করেন– এখন আপাতত মৌমিতা স্টেইজ থেকে নেমে যাবেন, তবে ঘন্টা খানেক পর তিনি আবার আপনাদের গান শুনাবেন, শুনাবেন আপনার পছন্দের তালিকা থেকে।

সবার সাথে সেদিন সেখানে ছিল বিপুলও। এতো অনুরোধের মাঝে ওর অনুরোধ হয়তো পাত্তাই পাবে না। তাই অন্য পথ বেছে নিলো।

ছোট একটা কাগজে নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে সাথে একটা গানের লাইন লিখে দেয়, গানটি হল– “সাগরের পাড়ে দাড়িয়ে কারো হাত বাড়িয়ে …”

লোক মারফতে চিরকুটটি চলে আসে মৌমিতার হাতে। মৌমিতা চিরকুটটি দেখেই রেখে দেয় নিজের কাছে। স্টেইজে উঠে ২য় গানটি করে চিরকুটের গান, গান শেষ হবার পর হাততালি পড়ে। মঞ্চ থেকে আবছা আলোয় মৌমিতা দেখছে হালকা আড়ালে কেউ একজন হাত তালি দিয়েই যাচ্ছে। তবে তাকে চেনার কোনো উপায় নেই।

প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে রাত সাড়ে এগারটা। স্টেইজ থেকে নামার পর অমনি চারপাশ থেকে সবাই ঘিরে ধরে মৌমিতাকে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারটা। কলের পর কল আসে ম্যাসেজ এর পর ম্যাসেজ। নিজের রুমে ঢুকেই দেখে ওর জন্য অপেক্ষা করছে পছন্দের কেকটা। আজ মৌমিতার জন্মদিন। জীবন থেকে দুই যুগ বয়স চলে গেছে। এক সময় বলা হতো কুড়িতে বুড়ি, এখন শহরে সেসব কে বলবে?

সে হিসাবে ওর বয়স তো হয়েছেই, পরিবার থেকে বিয়ের কথা বললেও কানে নেয়নি, শুধু বলেছে সময় হলে ঠিক বিয়ে করবে। এই পুরোদিন কেটে যায় মৌমিতার একেবারেই অন্যভাবে। দুদিন পর মনে পড়ে সেই চিরকুটের কথা। নাম্বার বের করে একটা খুদেবার্তা পাঠায়– “আমি মৌমিতা, সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে…”

সাথে সাথে রিপ্লাই আসে– গানের লাইন না লিখেলেও হতো, আপনি ফ্রি থাকলে কল দিতে পারি।

– অবশ্যই দিতে পারেন।

কথা হয় দুজনার। দুমাস আগের প্রোগ্রাম অনুযায়ী তিন দিনের মাথায় মৌমিতা তাদের দলের সাথে চলে যায় বাইরে। কাজ সেরে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে কিছু দিন। এই ভাবে পুরো দুই মাস পর ফিরে দেশে। এর মাঝে বিপুলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই, দেশে ফিরে আবার কথা। বিপুল অনেক অভিমান করে আছে, মৌমিতা কথার ধরন শুনে বুঝলেও কারণ খুঁজে পায় না। তবুও ভক্তের মান ভাঙ্গাতে একটা গান শুনাবে বলে– আচ্ছা বিপুল আপনার কোনো পছন্দের গান আছে, থাকলে বলেন, আমি শুনাবো।

– সত্যি শুনাবেন।

– হ্যাঁ সত্যিই শুনাবো।

– তাহলে ইনবক্সে লিখে দিচ্ছি।

“চাইনা কিছুই তো জীবনে আর… তোমার মুখটা যদি দেখি একবার…”

মৌমিতা কল করে, বিপুল নিজে কল কেটে দিয়ে কল করে। মৌমিতা কল ধরেই গানটা করে। খুব খুশি হয় বিপুল।

এভাবেই ওদের মাঝে ভালো লাগার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে দেখা করার ব্যাপারে কেউ কারো কাছে মুখ খোলে না। দুজন আলাদা ভাবে নিজেদের জগৎ তৈরী করে নেয়।

মৌমিতারা কয়েক বন্ধু মিলে প্রায় আড্ডা দেয় বেইলী রোডের একটা ফাস্টফুডের দোকানে। খুব মনোরম পরিবেশ। ওদের দুই তিনটি গ্রুপ আছে। একেকদিন একেক গ্রুপের সাথে আড্ডা হয়। এই কফি হাউজে অনেক প্রেমিক প্রেমিকারা হাত ধরে আসে। ওদের জন্য আলাদা জায়গা আছে। সেখানে শুধু জোড়ায় জোড়ায় চেয়ার আর ছোট্ট টেবিল।

গ্রুপের সাথে বসলেও মৌমিতার মন ছুটে যায় সেই জোড়া চেয়ারগুলোতে। ইচ্ছে করে পছন্দের মানুষের হাত ধরে এখানে আসতে, চুপি চুপি চোখে চোখ রেখে হাতে হাত রেখে স্বপ্ন বুনতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুরুষকে সে খুঁজে পায় না। পেলেও যেনো আপন করে নিতে পারে না। বিপুল মৌমিতাকে এত পছন্দ করে কিন্তু দেখা করার কথা কখনো বলে না কেনো। মৌমিতা নিজে যদি ওকে এখানে নিয়ে আসে তাহলেও কি খুশি হবে নাকি অন কিছু ভাববে।

দুজন দুজনের অনেক বিষয় শেয়ার করে, কে কবে কোথায় যাবে। কারো কাজে কখনো কেউ বাধা দিতে চায় না। মৌমিতা একদিন কথা বলার সময় কফি হাউজের কথা বলে– জানো বিপুল আমার পরিচিত একটা কফি হাউজ আছে। আমরা অনেক সময় সেখানে বসি, আড্ডা দিই। তবে একটা চেয়ারে কখনো আমার বসা হয়নি, ভাবছি নতুন কাউকে নিয়ে ওখানে বসবো।

– ভালোতো, সময় করে নতুন কাউকে নিয়ে বসে যাও।

– কথাটা সরাসরি বলি, জবাব দিবে।

– অবশ্যই দিব, তুমি বলেই দেখো।

– আমি যদি ওই চেয়ারে তোমাকে নিয়ে বসতে চাই তুমি আসবে।

– তুমি না বললে নতুন কাউকে নিয়ে বসতে মন চায়। আমি কি নতুন কেউ? আমি তো পুরানো হয়ে গেছি।

– তাই, কবে পুরানো হলে। আমিতো তোমায় এখনো দেখিইনি।

– মৌমিতা আমি কিন্তু তোমায় প্রতিদিন দেখি।

– কোথায় দেখো?

– কেনো, ক্যান্টেনমেন্টের সেনাকুঞ্জে, বই মেলায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পার্লারে, আরো বলবো।

– মানে?

– ধুর… মজা করলাম, কিচ্ছু না, ঠিক আছে আমি সময় করে ঠিক আসবো। তুমি কবে আসতে চাও আমায় জানিও।

রাত ১২টার পর মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমায় মৌমিতা। সকালে উঠতে আজ একটু দেরিই হয়েছে। ওইদিকে সারা রাতের ঘুম হারাম হয়ে আছে বিপুলের। সারারাত বসে একের পর এক ম্যাসেজ পাঠায় মৌমিতাকে। কিন্তু কোন জবাব পায় না, কোন কলও আসে না। আরামের ঘুম দিয়ে উঠে সকাল দশটায়। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে পনেরটা ম্যাসেজ। একটার পর একটা পড়ছে আর অবাক হচ্ছে। এই কায়েক মাসে মৌমিতা কোথায় কোথায় গেছে কেমন পোশাক পরেছে কেনো গেছে সব লেখা। অবাক হওয়ার চেয়ে সে দিন মৌমিতা খুশি হয়েছে অনেক। খুব লজ্জাও লাগছে, বিপুল ওকে এতটা ভালোবাসে বুঝতে পারেনি। তবে এও ঠিক মৌমিতাও অনেক ভালোবাসে বিপুলকে। কল করে রাঙ্গা গলায় কথা বলে– বিপুল আর দেরি নয় সামনের সোমবার আমরা দেখা করব কফি হাউজে।

– ওকে, আজতো মাত্র বৃহস্পতিবার, আমি ঠিক চলে আসবো।

শনিবার সবার সাথে কফি হাউজে যায় মৌমিতা। খুব মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে। গত কাল কপি হাউজটা ভেঙ্গে দিয়েছে। এখানে বিশাল শপিং মল গড়ে উঠবে। এতটাই খারাপ হলো বিপুলকে জানাতেই পারলো না। রবিবার সন্ধায় বিপুল নিজেই কল করে মৌমিতা কিছু বলতে চায়। কিন্তু বিপুল কিছুই বলতে দেয়নি। কফি হাউজ বন্ধের কথাও জানাতে পারেনি। সোমবার ঠিক সময়ে দুজন একই জায়গায় আসে, মৌমিতার মন খারাপ। বিপুল খুব স্বাভাবিক করে নেয়, বলে চলো আমরা রিকসায় ঘুরি। পুরো বিকেল সন্ধ্যার জন্য একটা রিকসা নেয় ওরা। বেইলী রোড থেকে টিএসসি, নীলক্ষেত হয়ে ধানমন্ডি, শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। বাতাসে মৌমিতার উড়া চুল বিপুলের কাঁধে এসে আলতো ভাবে ছুয়ে যায়। হাতে হাত রেখে স্বপ্ন বুনে। কখন যে রিকসা কোন পথে যায় বুঝতেই পারে না। এক ফাঁকে মৌমিতা বাসায় জানিয়ে দেয় বাসায় ফিরতে রাত এগারটা হবে। ও বাইরে খেয়ে আসবে।

এই ভাবে এই স্বপ্নের শহর কখনো দেখেনি মৌমিতা। ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে চেনা পথে অচেনা স্বপ্ন বুনতে বুনতে খুব কাছের হয়ে যায়। এই প্রথম মৌমিতার পাশে বসা কেউ ওর রিকসার পেছনে হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার ছোঁয়া এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠে।

ছোটবেলা থেকেই ডানপিঠের স্বভাবের ছিল। কেউ কাছে আসতে চাইলেও সাহস পায়নি। দুজনে মিলে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরে। মৌমিতা যেন আজ অন্য কেউ। ওর মাঝে জমে থাকা সব ভালোবাসা যেনো আজ ওকে জানান দিচ্ছে ও একজন পরিপূর্ণ নারী। সারারাত মোবাইল কথা বলে দুজন।

পনেরো দিনের মাঝে চার দিন এই ভাবে ওরা ঘুরতে বের হয়। এতদিনের স্বপ্নগুলোকে পরিপূর্ণ করার জন্য তৈরী হয় দুজন। মৌমিতা পরিবারকে জানায় বিপুলের কথা। সব শুনে সবাই রাজি থাকে।

দুজনেই বিয়ের শপিং করবে একসাথে। দিন তারিখ ঠিক হয়। তবে খুব আয়োজন করে কিছু করবে না। গুরুত্বপূর্ণ কিছু আগের দিন কিনে নিয়ে আসে। আজ বাকী জিনিসগুলো কিনবে বলেই বের হয়। বিপুলের খুব পছন্দ মেহেদী রাঙ্গা হাত। তাই বিয়েতে যাই হোক মেহেদী ঠিক পরতে হবে। বিপুল নিজেই কিনে দেয় মেহেদী। আজ সকাল থেকেই আকাশ অনেক ভালো। বিকেলের আগেই অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ। এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক। বৈশাখ চলে এসেছে। ক্ষণে ক্ষণেই বৃষ্টি নামে। রাফা প্লাজার সামনে মৌমিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে বিপুল পাশেই কোথাও যায় কিছু কেনার জন্যে। বৃষ্টি না পড়লেও আকাশে বর্জপাত হচ্ছে। ফেরার পথেই বিপুলের মোটরবাইকে বর্জপাত পড়ে। মুহূর্তেই বিপুল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দূর থেকে মৌমিতা সব দেখছে। দৌড়ে আসে বিপুলের পাশে, আকাশ ভেঙ্গে যেনো বৃষ্টি পড়ছে। মৌমিতার চোখে জল নেই। আকাশের জলে ওকে কাঁদতে দেয় না। ও বিপুলকে সামনে করে বসে আছে। চারপাশে অনেক লোকজন, কারো কথা ওর মাথায় যায়না।

পুরো দুদিন পর মৌমিতার স্মৃতিশক্তি ফিরে এলেও স্বাভাবিক নয় সে। কারো সাথে কথা বলে না। গান গায় না, আড্ডা দেয় না। বৃষ্টি এলেই বারান্দায় যায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে আর বিপুলের পছন্দের গানটা গায়। আর কোনো গান ওর মুখে আসে না। গলায় সুর উঠে না। একাকীত্বের জীবনের সাথী শুধুই বৃষ্টি ভেজার গানটা।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত