তিনদিন হলো কান্তনগর এসেছি, অনিলার মুখোমুখি হবো বলে। কিন্তু আসবার পর উচ্ছ্বাসটা ডুবে গেছে। ভাবতে ভাবতে বিদায়ের সময় হয়ে এলো। সামনে দাাঁড়াবার সাহস হলো না এই কদিনে। পরিশেষে, শেষবারের মতো কৈশরের সেই সোমেশ্বরী ঘাটের পাশে বসে গেলাম, যেখানে অনিলা আসতো, বসতো, আমাদের আড্ডা হতো।
আজ সন্ধ্যেয় আমার ট্রেন, ব্যাগপত্র গুছানো হয়ে গেছে। গতকাল রাতটা আমি কাটিয়েছি রবীন্দ্র বাবুর নাট্যশালায়। রাতভর ওদের নাটকের সংলাপে-সংলাপে নিজেকে খুব করে সাজিয়েছি। কখনো বাদশা, কখনো অনাহারী, কখনো সুপারম্যান, কখনও অন্ধবালক, সব চরিত্রেই নিজেকে তুলে ধরেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটাতেই নিজেকে উপযুক্ত মনে হয়নি।
ভোরবেলায় মনে হলো, আমি শুধু মানুষের জীবনকথা দিয়ে গল্প সাজাই কিন্তু নিজের জীবনের কথা দিয়ে এক লাইনও লিখতে পারি না। কেননা আমি যখনই কিছু লিখতে যাই তখনই মনে হয় নিজের জীবনটা ছকে সাজানো হয়নি। আর ছক বিহীন কোনো গল্প হয় না।
বসে থাকতে থাকতে দুপুর শেষ হয়ে আসছিলো, আমি উঠবো কিন্তু পা ভারি হয়ে যাচ্ছে পুরোনো স্মৃতিতে। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ যেহেতু রোববার, সেহেতু অনিলা একবারের জন্য হলেও ঘাটে আসবে। সেই ছোটবেলার স্মৃতিটাকে মনে করতে কিংবা মন্দিরের ঘাটে অঞ্জলী দিতে অনিলা আসবে। বড় হবার পর সবাই জানতাম আমরা সব বন্ধুরা মিশে আছি ছিমছাং নদীর ঘাটে, রোববারের আড্ডায়। যে যেখানেই থাকি কান্তনগরে থাকলে রোববার আসবে, স্মৃতিটাকে ঝালিয়ে নিতে। সাথে আমরাও জড়ো হবো।
উঠবো বলেও বসেই ছিলাম হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনে পেছনে তাকালাম। আমার চিন্তাকে স্বার্থক করে দিয়ে অনিলা গাড়ি থেকে নেমে এপাশ-ওপাশ চাইলো। হয়তো ও জানেই আমি আজ ঘাটে আসবো। জানা থাকলেও আমাকে খুঁজতে আসবে না সে আমি জানি। ও কিছুক্ষণ ঘাটের পাড়ে দাঁড়ালো। আমি তখন নিজেকে আড়াল করেছি তারপর কী ভেবে গাড়িতে উঠে বসলো আমি ইচ্ছে করেই সামনে গেলাম না। অনেক বছর ধরে রাখা ভালোবাসার কথা আজও বলে উঠতে পারলাম না।
তখন বিকেলের রোদ মরে আসছে সন্ধ্যে হবে। গাড়িটা পাশ কাটতেই উঠে দাঁড়ালাম। পোস্ট অফিসে যাবো। হয়তো খোলা পেয়ে যেতে পারি। যে কথা বলতে পারিনি তা মনে করে কলম নিয়ে চিঠিতে আঁক কষলাম। তারপর ভাবনার চৌকাঠ পেরিয়ে স্মৃতিতে ডুবে লিখলাম।
অনিলা একটা চিঠি তোমার পাওনা ছিলো। তোমাকে দেখে মনে হলো আসলে মুখে তোমার হাসির ছটার আড়ালে একটা দুঃখী বন আছে, যেখানে তুমি নিত্য উত্তাপ ছড়াও। তুমি যে আমাকে ভালোবাসতে সেটা কিন্তু কোনদিন চিঠিতে জানাও নি। হয়তো তুমি কখনই হারতে চাও নি আমার কাছে। এতটাকাল আমি তোমাকে দূর থেকে একটা সুখী রমনী ভাবতাম। হয়তো সে জন্যই তোমাকে নিয়ে কিছু লেখা হয়ে উঠেনি। আমার গল্পের নায়িকারা খুব দুঃখী হয় কিন্তু আজ দেখলাম তোমার দুখের কাছে তারা কিছুই না।
অনি বলতে পারো আমাদের সেই লালরঙা ট্রেনটা কেন জং ধরে স্টেশানে শুয়ে আছে? বলতে পারো কেন আমাদের হাত ধরে ট্রেন লাইনের শেষ আর দেখা হলো না? জানি তোমার মুখে আজ উত্তর নেই এবং আর কখনো এই উত্তর পাওয়া হবে না। নিজের জীবনের গল্প দিয়ে এবার নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করবে, ইচ্ছে শক্তিরা কখনো কখনো উপায়ের হাত ধরেও দুর্বল হয়ে পড়ে। জীবনকে কাগজের নৌকা করে ভাসানো ঠিক নয়। সে নৌকা ডুবে গেলে আশাগুলো ভাসে নদীর জলে সেখানে শুধু কষ্টরা ভেংচি কাটে রোজ দিনরাত্রি। চিঠিটা দীর্ঘ করতে গিয়েও কেন জানি থমকে গেলাম। তাই কলমটা অনেকক্ষণ ধরে রেখে শেষে লিখলাম অনিলা আমি তোমার চোখ দেখেই বলে দিতে পারি আসলে তুমি ভালো নেই।