প্রেমহীন

প্রেমহীন

চারপাশে সোডিয়াম লাইটের রহস্যময় হলদেটে আলোর ছড়াছড়ি। মালিবাগের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সাইফের মনে হয় রাত অনেক হয়েছে, এখন তার বাসায় ফেরা উচিত। পরক্ষণেই মনে হয়, নাহ, রাত বোধহয় বেশি হয়নি। তা বেশি রাত না হওয়ারইতো কথা, তিথিকে বাসে তুলে দিয়ে এসেছে বেশিক্ষণতো হয়নি। নাকি রাত বেড়েছে ঠিকই, সাইফ বুঝতে পারছে না? অবশ্য ও তিথিকে বাসে তুলে দিয়েছে বললে ঠিক হয় না। তিথি নিজেই উঠেছিল বাসে এবং এর আগেই বাসা থেকে আসার পথে রিকশায় বলেছিল, ও সাইফকে ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছে। কুমিল্লায় যাবে বলেছে শুধু, কার কাছে যাবে বলেনি।

হাঁটতে হাঁটতে দেখে সাইফ ফুটপাত জুড়ে শেকড়হীন মানুষের সংসার। তাদের ঘরকন্না দেখে, বাস গাড়ির দ্রুত ছুটে চলা দেখে, আর ওর মনে হয়, আজ যেন রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা। সোডিয়াম লাইটের ম্লান আলোতে রাতের রাস্তাটা কেমন ধূসর, তার মনের মত। রাস্তাটাকে কেমন রহস্যময় লাগে সাইফের কাছে, ঠিক যেমন লাগত সাত বছর আগে, ঢাকা আসার প্রথম প্রথম সময়টাতে। তখন প্রায় রাতেই একা একা হাঁটত সাইফ, কখনো কখনো সারারাত ধরে, পুরনো ঢাকার অলিগলিতেই বেশি হাঁটত। তখন ফ্যাকাসে হলুদ আলোতে ঢাকাকে যেমন লাগত, এখন যেন তার কাছে চারপাশ তেমনই লাগছে।

সাবধানে যেও। ভাল থেকো। তিথি বাসে উঠলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাইফ বলেছিল।

ভালই থাকব আমি, তোমাকে ছাড়া! তুমিও জান তা। খামোখা কথা বলা। …তিথি তার বড় কালো ব্যাগটা নিজেই বয়ে নিয়ে বাসে উঠে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসেছিল ততক্ষণে। বসে উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল।

সাইফকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তিথি। সাইফ ঠিক জানে না কুমিল্লায় কার কাছে যাচ্ছে তিথি। জিজ্ঞেস করেনি। আসলে ইচ্ছেই করেনি জিজ্ঞেস করতে। আজকাল দু’জনে বলতে গেলে প্রয়োজনেও কথাবার্তা বিশেষ বলে না।

বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সাইফ অপেক্ষা করেছিল। তিথি উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়েই ছিল। সাইফের দিকে একবারও তাকায়নি। তা তাকালেই কী। হৃদয় ভুলে গেলে চোখের দেখা না দেখা সমান কথা! বাস ছাড়লে, সাইফ একবার এদিক ওদিক দেখে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল।

ওর বাসা রামপুরা।

সাইফ ঠিক করেছিল সায়েদাবাদ থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরবে। তাড়াতো নেই কোন।

শেষ বিকালের আকাশটা খুব সুন্দর লাগছিল। যদিও পুরো আকাশটাকে একবারে দেখা যাচ্ছিল না, টুকরো টুকরো আকাশ মাঝে মাঝে দালান কোঠার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল।…রোদের তেজ মরে আসছিল। বাস গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছিল গন্তব্যের দিকে। ফুটপাথ ধরে লোকজনও দৌড়াচ্ছিল যেন। হয়ত সবারই তাড়া ছিল গন্ত্যেবে ফেরার। কেউ হয়তো তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিল, কখন তার প্রিয়জন ফিরবে। সাইফের তাড়া ছিল না। একসময় গেলেই হয় বাসায়। কেউতো আর অপেক্ষায় নেই তার জন্য। ছোট বাসাটায় থাকত ওরা দুজনেই । তিথি আর সাইফ।

তিথি সাইফকে ছেড়ে চলে গেলো আজ। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল সাইফের কাছে আর ফিরবে না। অনেক দিন ধরেই বলছিল অবশ্য। চলে যাবে, চলে যাবে। তা সত্যিই যে চলে যাবে ভাবেনি সাইফ। ঝগড়াঝাটি হয় না কোন সংসারে। সংসার মানেই মনোমালিন্য, রাগ অনুরাগ, কথাবন্ধ, না খেয়ে থাকা। হোক লাভ ম্যারেজ কী এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, দু’দিন যেতে না যেতেই ঠোকাঠুকি হবেই। হয়ই সব সংসারে। তাদেরই না হয় দেখে শুনে বিয়ে বলে কিছু মিলে না। তাই বলে প্রেমের বিয়েতে কি মন কষাকষি হয় না? দেখছেতো চারপাশে। …মাহমুদ পড়ত সাইফের সাথেই। ওর বউ মায়াও তাদের ক্লাসমেট ছিল। দু’জনের কী মিল! পাঁচ বছরের প্রেম ওদের। কোনদিন সাইফরা দেখেনি কিছু নিয়ে ওদের ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া কী, এক মুহূর্তও দু’জনকে আলাদা দেখেনি। ক্লাসে বারান্দায় লাইব্রেরীতে সব জায়গায় দু’জনে একসাথে। বিয়েও হল খুব ধুমধাম করে। দু’বছর না যেতেই কী ফুটফুটে মেয়ে। অথচ, পাঁচ বছর পার না হতেই ডিভোর্স। কেউ ভাবতে পেরেছিল!

তাদের এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দু’জনের মিলে না কিছুই। সাইফ ঘুরতে পছন্দ করে খুব। তিথি বাসা ছেড়ে নড়বে না। সাইফের শুতে না শুতেই ঘুম। তিথি রাত জেগে বই পড়বে। কোন কোন দিন রাত সকাল করে দেয় বই চোখের সামনে নিয়ে। তিথি খাওয়া দাওয়ায় খুব সৌখিন, সাইফ যা পায় তা খায়। সাইফ মশারি টাঙ্গালে ঘুমাতে পারে না, তিথির মশারি ছাড়া ঘুম আসে না।… আরও কত রকম অমিল। বলে শেষ করা যায় নাকি!…তাই বলে তারা যে খুব দুঃখে ছিল তা না। যাচ্ছিল দিন চলে। কখনো ভাল কখনো মন্দ। কখনো খুশিতে কখনো অভিমানে। সাইফ মাঝারি একটা বেসরকারি চাকরি করে, বেতন পায় মোটামুটি। তিথি বাসায় থাকে, সংসার সামলায়। প্রেম নেই আবার আছেও যেন। হঠাৎ হঠাৎ অবশ্য লেগে যেত তাদের। আবার মাঝে মাঝে মনে হত, ভালও যেন বাসত দু’জন দু’জনকে।

সাইফের সাথে তিথির বিয়ের সম্বন্ধটা এনেছিল সাইফের কলিগ হাসান। নাকি তিথি সাইফের আগেই তাদের অফিসে চাকুরির এ্যাপ্লিকেশন করেছিল। চাকুরি অবশ্য হয়নি। সে সময় তিথির সাথে হাসানের আলাপ সালাপ হয়েছিল। মোবাইল নম্বর ছিল হাসানের কাছে। সাইফের উৎসাহ দেখে কথা বলেছিল হাসান, তিথির সাথে। দেখা করেছিল।… বিয়েটা হতে বেশি সময় লাগেনি। বিয়ের পরপরই সাইফ আর তিথি রামপুরার দু’রুমের বাসাটায় উঠেছিল। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল প্রায়।

কেন যেন দু‘জনের মনের মিল হয়নি। তেমন কোন জোরাল কারণ দেখে না সাইফ। তা হলেও কোথাও কিছু ছিল হয়তো। অদৃশ্য। যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, দেখা যায় না। হয়তো দু’জন দু’জনকে নিয়ে ভাবেনি কখনো। বুঝার চেষ্টা করেনি কখনো। হয়তো যতটুকু সময় দেওয়ার ততটুকু সময় কেউ কাউকে দেয়নি। যাহোক, ছিল হয়তো কোন কারণ। যে কারণে দু’জন দু’জনের মনের ভেতর পৌঁছতে পারেনি। এমনকি কেউ তার কারণ খোঁজার চেষ্টাও করেনি তেমন করে। তবে এখন আর এসব নিয়ে ভাবে না সাইফ। তিথি যদি তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে সুখী হয় তো হোক। আর সত্যিইতো, এই যে তিথি চলে গেল তাকে ছেড়ে, কই সাইফেরওতো তেমন খারাপ লাগছে না। বরং মুক্ত মুক্ত লাগছে।

বাতাসটা হঠাৎ কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। বৃষ্টি টৃষ্টি আসবে কিনা কে জানে। ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খাওয়া দরকার। দুপুরে খাওয়া হয়নি ভালমত। ভাল খাবার ছিল। ক্ষুধাও ছিল। তা হলেও খাওয়াটা হয়নি। এক বন্ধুর বিয়েতে দাওয়াত ছিল দুপুরে। কথা ছিল সাইফ আর তিথি দু‘জনে মিলেই যাবে। সকালের নাস্তা খেয়ে তৈরি হওয়ার কথা ওদের। অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরীতেই নাস্তা খায় দু‘জনে। বন্ধের দিন। অফিস নেই যে নাকে-মুখে গুঁজে দৌড়াতে হবে। একটু ঢিলেমিই ছিল সাইফের মধ্যে। তিথি তৈরি হতে হতে সাইফ বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয়। শুয়ে শুয়ে ও দেখছিল তিথির শাড়ি পরা। তিথি একবার আঙ্গুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ির কুচি করে আবার ছেড়ে দিচ্ছিল। আবার কুচি করছিল। শাড়ি পরা শেষ হলে চুল নিয়ে বসবে তিথি। তারপর চোখ। ঠোঁট। …জানা কথাই তৈরি হতে সময় লাগবে তিথির। তাই সাইফ একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল। আর দেখছিল তিথির সাজগোজ। দেখতে দেখতে আলাগাভাবে মন্তব্য করে সাইফ। শাড়িটা কেমন যেন। রং জ্বলা জ্বলা। বিয়েতে যাচ্ছ, একটা ভাল শাড়ি পরবে না! ব্রাইট কোন শাড়ি পর।

বিয়েতে যাওয়ার মত ভাল শাড়ি কিনে দিয়েছো কয়টা?

ঠিক যে সাইফ তেমন দামী শাড়ি বেশি কিনে দেয়নি তিথিকে। আসলে পারেনি দিতে। সংসারের খরচ শেষে হাতে তো থাকে না কিছুই। তাই বলে বন্ধুর বিয়েতে তিথিকে রং জ্বলা শাড়ি পরে যেতে হবে!

তোমারতো এর চেয়ে ভাল শাড়ি আছে, হয়তো তেমন দামি না, কিন্তু নতুনতো। সেগুলোর একটা পর। ওই যে লাল একটা জামদানি আছে না তোমার? গত ঈদে কিনেছিলে। সেটাতে তোমাকে সুন্দর লাগে।

ওই এক শাড়ি পরেত সব জায়গায়ই যাই। দেখে দেখে সবার চোখ পচে গেছে। যেতে হলে এই শাড়ি পরেই যাব।

যেখানে যাচ্ছ, সেখানেতো কেউ দেখেনি।… আসলে আমার সম্মান নষ্ট হয় এমন কাজ করতেই তোমার ভাল লাগে।

আমাকে সাথে নিয়ে গেলে যদি তোমার সম্মান নষ্ট হয় তো থাক, আমি না-ই গেলাম। যাও, তুমি একাই যাও। কোনদিন কোথাও নিয়ে যাও না, আজ গেলেই কী না গেলেই কী!

সাইফ কথা বাড়ায় না। আর কিছু বললে কাজও হবে না। একবার যখন বলেছে তিথি যাবে না, শত অনুরোধেও যাবে না। তিথির স্বভাবতো আর অজানা নয়। আজ নতুন কিছু নয়। তিথির অভ্যাস এমনই। এই পর্যন্ত কোথাও যেতে পারিনি ওকে নিয়ে। শেষ মূহুর্তে তুচ্ছ কোন অজুহাতে ঝগড়া বাধাবেই। এবং যাবে না। তা হলেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সাইফ। যদি মত পাল্টায় তিথি। নাহ, তিথি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ডাকলে মেলা কথা শুনাবে। ভেবে টেবে শেষে একাই বের হয় সাইফ।

দুপুরে দাওয়াত খেয়ে ফিরে সাইফ দেখে গোছগাছ করছে তিথি। সাইফ কিছু জিজ্ঞেস করল না। তিথিও কিছু বলল না। গোছগাছ শেষে তাকে বলল, সায়দাবাদ পৌঁছে দিতে।… রিকশায় যেতে যেতে বলেছিল তিথি, সবকিছু সহ্য করা যায়।…ঘৃণা…রাগ। কিন্তু উপেক্ষা! এরচেয়ে চলে যাওয়াই ভাল। তোমার মত তুমি থাকলে। আমি আমার মত থাকলাম। সাইফ কোন জবাব দেয়নি। আসলে বলার কিছু ছিল না ওর।

বলতে বাধলেও, সাইফের এখন স্বাধীন স্বাধীন লাগছে কেমন। এখন সাইফ যতক্ষণ ইচ্ছা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে পারে। কেউ কিছু বলার নেই। কারো কাছে কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। দেরী করে ফিরলে কেউ জেরা করবে না। …অনেকদিন হোটেলে খাওয়া হয় না। আজ খাওয়া যাবে।

রাস্তার পাশেই একটা ঝুপড়িমতো হোটেলে ভাত খাচ্ছে কিছু লোক। ইট পেতে বসে হাতে প্লেট নিয়ে। রিকশাওয়ালা কী মজুর শ্রেণীর লোকই যেন সবাই। …একটু ইতস্তত করে সাইফ একটা খালি ইট দেখে বসে। এক মহিলা ভাত বিক্রি করছে। সাইফ বসলে আলু ভর্তা আর ডিমভুনা দিয়ে এক প্লেট ভাত এগিয়ে দেয়। বলে ডাইল আছে, ফিরি। শক্ত মোটা চালের ভাত ঝাল ঝাল আলু ভর্তা দিয়ে মেখে মুখে পোরে সাইফ। অসম্ভব ঝাল ভর্তার স্বাদটা ভালই লাগে জিভে। তবে ঝালের কারণে জিব জ্বলছেও খুব। খেতে খেতে ভাত বিক্রেতাকে দেখে সাইফ। মহিলা কোথায়! বাইশ তেইশ বছরের একটা মেয়ে। স্বাস্থ্য ভাল মেয়েটার। নাক চোখ মুখও ভালই দেখতে। একারণেই বোধহয় মেয়েটার ভাতের খদ্দের বেশি। দু তিনজন দাঁড়িয়ে আছে, কখন ইটের আসন খালি হবে। ডিম ভেঙ্গে কুসুম খেতে খেতে হঠাৎই রিয়ার কথা মনে হয় সাইফের। …রিয়া আর সাইফ একবার এভাবে রাস্তায় বসে ভাত খেয়েছিল।

খাওয়া শেষে ফুটপাথের ধারে হাত ধুতে ধুতে সাইফের মনে হয় বাসায় বোধহয় রাতের খাবার রান্না করা আছে। তিথি সাধারণত দু’বেলার খাবার একসাথেই রাঁধে। থাকগে, রান্না যদি করা থাকেতো থাক। ফ্রিজ নেই তাদের। খাবারটা হয়তো নষ্ট হবে। কী আর করা, হলে হবে।…জীবনে কত কিছুইতো নষ্ট হয়ে যায়। সময়…সুযোগ…সম্পর্ক।

ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে সোডিয়াম লাইটের নরম আলোয় রাতটা কেমন মোহময় লাগে। হলদেটে আলোয় বাস ট্রাক ছুটছে। তবে যানের ভিড় একটু যেন কম। নাহ, খাওয়াটা বেশি হয়েছে। আইঢাই লাগছে। ধীরে ধীরে হাঁটে সাইফ।…হাঁটছিল। হঠাৎ কেন যে মনে পড়ে গেল। মাঝে মাঝে এমন হয় সাইফের। হঠাৎ মনে পড়ে যায় রিয়ার কথা। অনার্সে পড়ার সময় রিয়া নামের মেয়েটাকে কী পছন্দ করত সাইফ।…দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল। কতদিন দেখে না রিয়াকে। রিয়া এখন কোথায় কে জানে! যোগাযোগও নেই ওর সাথে।

জীবনে রিয়ার মত সুন্দর মেয়ে দেখেনি সাইফ। বাকি জীবনে দেখবেও না, এই ব্যাপারে ও নিশ্চিত। জীবনে যদি কোন মেয়েকে ভালবাসে থাকে সাইফ, তো সে রিয়া। রিয়া যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে কোন মেয়ে ছিল তা নয়। তার মতই অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। মেধায়ও মাঝারি। তা হলেও রিয়াকে ছুঁতে পারেনি সাইফ। ক্লাসমেট ছিল ওরা। দেখা হত রোজই। কথা গল্প দুষ্টুমি সবই হত। ক্লাসের সবাইও ওদের নিয়ে দুষ্টুমি করত। অবশ্য প্রথম প্রথম। শেষের দিকে সবাই ধরেই নিয়েছিল, রিয়া আর সাইফ দু’জন দু’জনকে ভালবাসে। তাদের নিয়ে আর মাথা ঘামাত না কেউ। সুন্দরী কোন মেয়েকে দেখলে অনেকেই হয়তো পেছনে লাগে। তবে সে মেয়ে যদি নিয়মিত কাউকে সাথে নিয়ে ঘুরে তখন উৎসাহীরা আর সে মেয়ের পেছনের ঘোরার উৎসাহ পায় না।

তা ভালতো বাসতই সাইফ। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে রিয়াকে ভালবাসত। কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলেনি। বলতেই পারেনি সাইফ। কেন যে! কতদিন ভেবেছে বলবে। কতদিন! কিন্তু রিয়া কাছে এলে কী যে হত! বলার সাহস হারিয়ে ফেলত। এটা সেটা নানান কিছু নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত দু’জনে। এমন হতে হতে এক সময় সাইফের মনে হয়েছে, রিয়া যেন না বললেও বুঝতে পারে ঠিকই। রিয়ার আচরণে তা প্রকাশও পায়। সাইফ জানত যে ভালবাসা কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে না। যতই পাতার আড়ালে থাকুক, ফুল কখনো গন্ধ লুকিয়ে রাখতে পারে? সাইফের ভাললাগা নিশ্চয়ই রিয়া টের পেয়েছে। যেমন সাইফ বুঝে, রিয়াও সাইফকে ভালবাসে।

গ্রামের বাড়িতে গেলে রিয়া খুব একটা ফোন টোন করে না সাইফকে। আসলে রিয়া চায় না গ্রামে গেলে কোন ছেলে ওকে ফোন করুক। ওর পরিবারের লোকজন নাকি সেটা পছন্দ করেন না। ক্লাসের অনেকেই ব্যাপারটা জানে। তাই পারতপক্ষে গ্রামে গেলে কেউ ওকে ফোন করে না।…হঠাৎ খবর পেয়ে গ্রামে গিয়ে প্রায় মাসখানেক পরেও যখন ফোন করল না রিয়া, সাইফই নিজে থেকে ফোন করল। ফোন বন্ধ। আবার করল। বন্ধ।…বিকালে আবার করল। বন্ধ।…সন্ধ্যায় করল। রাতে করল। বন্ধ।…পরদিন সকালে আবার। নাহ, বন্ধই রিয়ার মোবাইল।…সাইফ ভাবল, হয়তো নেটওয়ার্কের কোন সমস্যা। হয়তো মোবাইলই নষ্ট। যে কোন সময় চলে আসবে রিয়া। না এসে উপায় আছে। সপ্তাহ খানেক পরেইতো ক্লাস টেষ্ট শুরু হবে।

না, গ্রাম থেকে আর ফিরল না রিয়া। আর কোন পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করল না। সাতমাস পরে একদিন সাইফের মোবাইরে কল এল অচেনা এক নম্বর থেকে। রিসিভ করতেই খুশি খুশি গলা, এই সাইফ, আমি রিয়া। জাপান থেকে বলছি। এখানে জামাইর সাথে আছি। রিয়ার কন্ঠে কী উচ্ছ্বাস! কথা বলছে না, যেন গান গাইছে।

সাইফ ঠিক বুঝতে পারল না তার দোষ কোথায়। ও কি বুঝতে ভুল করেছিল? রিয়াকে কি সাইফ একাই ভালবেসে ছিল? সে কথা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল রিয়াকে।…আমি কি ভুল করেছিলাম রিয়া? তোমার আচরণতো বলতো তুমি আমাকে ভালবাসতে। তাহলে কেন এমন করলে?

দেখো সাইফ, হয়তো আমি তোমাকে ভালবাসতাম। কিন্তু তুমি আমার সমবয়সী। চাকুরি পেতে… স্বাবলম্বী হতে, বিয়ে করতে …কত সময় লাগত বল? তাছাড়া তোমার কাঁধে তোমার মা বাবা। …আমি এখন জাপান থাকি। আমার হাসবেন্ডের এখানে ভাল ব্যবসা। টাকা পয়সা অনেক। খুব সুখে আছি আমি। তুমি আমাকে এত সুখ দিতে পারতে?…আরও আগেই তোমাকে ফোন করতাম। কিন্তু বিশ্বাস কর সময় করতে পরিনি। বিয়ের পরপরই জাপান চলে এসেছি। জানো, এ ক’দিন জাপানের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছি। যা সুন্দর দেশটা! ছবির মত। তুমি যদি দেখতে! …আরও কী সব বলছিল রিয়া, সাইফ শুনেনি। মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়েছিল।

বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়। গলি নির্জন। একটু ভয় ভয় লাগে সাইফের। ক’দিন আগে এ গলিতে সাইফের প্রতিবেশি এক ভদ্রলোক ছিনতাইকারির কবলে পড়ে সব খুইয়েছিল। অবশ্য সাইফ প্রায় নিঃস্ব। প্রাণ ছাড়া হারানোর কিছু নেই। শরীরটা ভার ভার লাগে সাইফের। ঘুম ঘুম পাচ্ছে । নাহ, খাওয়াটা বেশিই হয়েছে।

সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে উঠতে থাকে সাইফ। বাসাটা সাত তলায়। প্রথমে হয়তো বাসা ছিল না। সাত তলাটা হওয়ার পর ছাদের অর্ধেক অংশে দু’টা রুম করা হয়েছে। বাকি অংশ খালি। ছাদ। দু’রুমের বাসাটায় সাইফ আর তিথি থাকত। কতদিন ছিল একসাথে। আজ থেকে একাই থাকবে সাইফ। ভাবতে কেমন যেন লাগে!

উঠতে সময় লেগে যায় অনেক। দরজার কাছে রেলিংএ আবছা আঁধারে কে যেন দাঁড়িয়ে। এত রাতে কে আবার। অন্য ভাড়াটিয়াদের কেউ কি ছাদে এল? অবয়বে মনে হচ্ছে মেয়ে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা চেনা চেনা লাগে যেন।…কে? ইতস্তত করে সাইফ জিজ্ঞেস করে।

ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়।

শব্দে বুঝে সাইফ। তিথি তুমি! তুমি কুমিল্লা যাওনি।

রাগ করে চলে যেতে চাইলাম বলে চলে যেতে দিলে। কতক্ষণ ধরে বসে মশার কামড় খাচ্ছি।

তোমার কোন কিছুতেইতো বাঁধা দেই না আমি। ভাবলাম…।

আপদ গেছে তাইতো। ভালবাসলে ঠিকই বাঁধা দিতে। ধরে রাখতে চাইতে। অধিকার খাটাতে। আমি তোমাকে ছাড়া বিয়ের পর থেকেছি কোনদিন?

আমি জানতান তুমি ফিরে আসবে। তবে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে ভাবিনি!

আমার বাবা মা নেই। এক ভাই আছে নামে মাত্র, সে বিয়ের পর একদিনও খোঁজ নেয়নি। আমি যাব কোথায় বল? তাই ফিরে এসেছি। ভালবাসার টানে নয়, উপায় নেই তাই।

তুমিতো জান, আমার ভালবাসার ক্ষমতাই নেই। …আচ্ছা, রিয়ার সাথে তিথির চেহারার কোথাও কি মিল আছে? হঠাৎ মনে হয় সাইফের। ভালভাবে তাকায় সাইফ তিথির মুখের দিকে। তিথির মুখের একপাশে চাঁদের ক্ষীণ আলো এসে মিশেছে। দেখতে দেখতে মিলটা ধরতে পারে সাইফ। আচমকা। হটাৎ-ই মনে হয় সাইফের, তিথির মুখের সাথে চিবুকের কাছটায় মিল আছে রিয়ার সাথে। প্রথম দেখে একারণেই কি তিথিকে পছন্দ করেছিল সাইফ? এতদিন মিলটা চোখেই পড়ল না! আসলে কোনদিন বোধহয় খেয়াল করে দেখেইনি সাইফ তিথিকে।

একদৃষ্টিতেই বুঝি তাকিয়ে ছিল সাইফ। আবছা আঁধারেও বুঝতে পারে তিথি। অবাক গলায় বলে, কী দেখছ?

সাইফ হাসে, এতদিন একটা কথা বলিনি তোমাকে, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।

কী! তিথি অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকে।

দেখো, আর কখনো তোমার সাথে রাগারাগি করব না। এখন থেকে তোমাকে খুব ভালবাসব।

পারবে ভালবাসতে? আমিতো রিয়া নই!

রিয়া! রিয়ার কথা তুমি জান কেমন করে!

জেনেছি। এমন কোন গোপন কথা না যে জানা যাবে না। তোমার দু একজন বন্ধু বান্ধবতো আসে মাঝে মধ্যে। ধর না তাদেরই কেউ…।

কিছু বলে না সাইফ। মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে ক্ষয়াটে চাঁদ। তা হলেও আবছা আলোটা আছেই। সাইফ জানে, ক্ষয়াটে চাঁদটা একসময় পূর্ণ হবে, আবছা আলোটা হবে জোরাল। …রিয়া রেলিংএ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আবছা আঁধারে দেখে সাইফ, তিথির দু’চোখ ছলছল করছে।

ক্ষয়াটে চাঁদের রহস্যময় আলোতে সাইফ তিথির দিকে তাকিয়ে বলে, চল ঘরে চল।

তিথি শক্ত করে সাইফকে আঁকড়ে ধরে। সাইফও তিথির হাত ধরে।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত