–কি বলছ তুমি এসব?
–আমি ঠিকই বলছি।
–তুমি আমাকে দেখে বিয়ে করনি?
পছন্দ করে বিয়ে করনি?তাহলে এখন কেন এসব বলছ?
–আসলে বাবাই তোমাকে পছন্দ করে এনেছে,আমার আর মার এ বিয়েতে কোনো মতই ছিল না।
–তুমি তখন না করতে পারলে না?বাবাকে কিছু বলতে না পার,আমাকে তো বলতে পারতে!আমি অন্তত বিয়েটা ভেঙে দিতাম!
বিয়ের দিন বাসররাতেই এমন একটা কথা শুনতে হবে,এটা কল্পনাও করতে পারেনি জয়ীতা। আফনানের কথাগুলো নিজের কানে শুনেও কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কেমন ছেলে রে বাবা! নিজের মুখে নিজের বাবাকে সত্যি বলার সৎ সাহসটুকুও এই ছেলের নাই। আর এখন বিয়ের পর কিনা সে বলছে,এ বিয়েতে তার বা তার মায়ের কোনো মতই ছিল না!
–আমার সামনে আর আসবে না।
রাগে গজগজ করতে করতে বলল জয়ীতা।
–আমার বাসা,আমার রুম,আর আমি থাকব না! আমি এখানেই থাকব। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি নিচে ঘুমাও।
আফনানের কথা শুনে রাগে যেন সত্যিই ফেটে পড়বে জয়ীতা।এমনিতেও অনেক রাগী আর জেদি মেয়ে সে।যখন যেটা সঠিক মনে করে সেটাই করে।যদিও এ বিয়েটা সে আটকাতে পারেনি।
প্রথম যখন মেয়ে দেখতে আফনান আর তার বাবা-মা এসেছিল,তখন আফনানকে দেখেই বিয়েতে রাজি হতে চায়নি জয়ীতা।দেবদূতের মত সুন্দর আর স্মার্ট হওয়ার পরেও আফনানকে কেন জয়ীতার পছন্দ না,এটা তার বাবা-মা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না!জয়ীতার যুক্তিতে,যেহেতু আফনানের সবই আছে,সেহেতু নিশ্চয়ই ছেলেটার চরিত্রে কোনো দোষ আছে।নাহয় ওর মত এমন অসুন্দর কালো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেই বা কেন?
কিন্তু এত ভাল একটা ছেলেকে হাতে পেয়ে জয়ীতার বাবা-মা কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না।মেয়েকে বিয়ে দিলেনই।আর বিয়ের রাতেই জয়ীতার সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে আফনান জয়ীতাকে বিয়ে করার কারণটা বলে দিল।রাগে এখন জয়ীতার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে!
চোখে রাগ নিয়েই বলল জয়ীতা,
–আচ্ছা,আমিও উপরে ঘুমাব,তুমিও উপরেই ঘুমাবে।কিন্তু মাঝখানে থাকবে একটা কোলবালিশ।রাজি?
–হুম রাজি।
মুখ ভার করে বলল আফনান।
২.
অনেকদিন পর তাসফির সাথে দেখা হল জয়ীতার।তাসফি জয়ীতার কলেজ ফ্রেন্ড।কি একটা গোপন কথা বলার জন্য জয়ীতাকে ডেকেছিল তাসফি!
বাসায় ফেরার কিছুক্ষণের মাঝেই আফনান এসে হাজির।
–কোথায় গিয়েছিলে?
–তোমাকে বলব কেন?আমি তো তোমার কেউ নই।
–এই ফ্যামিলিতে আছ,তাই তোমাকে বলতে হবে!
–আচ্ছা,তাই?কিন্তু তবুও আমি বলব না!
কথাটা শুনে রাগে গজগজ করতে থাকে আফনান।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
–তুমি যেখানেই যাও,আমার সমস্যা নেই।কিন্তু বোরকা পড়ে যাওনি কেন?
জয়ীতা বোরকা পড়েই গিয়েছিল।কিন্তু এসেই খুলে ফেলায় আফনান সেটা দেখতে পায় নি।
আফনান আবার বলল,
–মা আমাকে পাঠিয়েছেন এটা বলতে যে,এরপর থেকে তুমি যেখানেই যাও,বোরকা পড়ে যাবে।
জয়ীতা হঠাৎ বলে উঠল,
–হাহ্,প্রেম করার সময় তো স্মার্ট সুন্দর ওয়েস্টার্ন স্টাইলের মেয়ের সাথে প্রেম কর,কিন্তু বিয়ে করার সময় বোরকাওয়ালী মেয়ে খোঁজ কেন?
জয়ীতার কথা শুনে আফনানের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠে।অবাক হয়ে জয়ীতার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।তারপর আমতা আমতা করে বলল,
–কে..ক্কে ববলল তোমাকে?আ..আমি তো..
–তুমি প্রেম করনি মাইশার সাথে?
–কি..ক্কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?
–মাইশার কাজিন তাসফি বলেছে আমাকে!
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আফনান আস্তে আস্তে বলল,
–আমি এখনো ভালবাসি মাইশাকে!
বলে চলে গেল সে।আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জয়ীতা।রাগে-ক্ষোভে মনে মনে বলল,’তোমরা ছেলেরা সব এক।প্রেম করার জন্য খোঁজো সুন্দরী ওয়েস্টার্ন ড্রেস আপ করা মেয়ে,আর বিয়ে করার সময় খোঁজো নম্র ভদ্র মেয়ে,যে তোমাদের কথামত নাচবে!বোরকাওয়ালী মেয়ে বিয়ে করলে কি ওয়েস্টার্ন মেয়ের সাথে প্রেম করে যে পাপ করেছ,তা ঘুচে যাবে?’
৩.
–শোন বাবা,আমারও ওই মাইশা মেয়েটাকেই পছন্দ!কি স্মার্ট,দেখেছিস?এই কালো মেয়েটাকে তো এক বছরের আগে কোনোমতেই বিদায় করতে পারবি না,তোর বাবার কথা মতে।
–হুম।
–তুই বরং এই একটা বছর কষ্ট করে মেয়েটাকে সহ্য কর,আর কোনোরকম পাত্তা দিবি না মেয়েটাকে।তোর কাছেও আসতে দিবি না।এই এক বছর পর তোকে আবার মাইশার সাথে বিয়ে দিব।
–কিন্তু এক বছরও তো অনেক সময়!
–তুই যদি তাড়াতাড়ি মেয়েটা বিদায় করতে চাস,তাহলে এই কয়দিন যেমনে পারিস মেয়েটাকে জ্বালাবি বা কোনো একটা খুঁত বের করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবি!
–ঠিক আছে মা।
ডাইনিং টেবিল থেকে পানি খেতে যাচ্ছিল জয়ীতা।কিন্তু মাঝপথে মা আর ছেলের হিন্দি সিরিয়ালমার্কা কথাগুলো শুনে সে পুরাই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কয়েকদিন পর।একদিন হঠাৎ আফনানের বাবা ডেকে পাঠালেন জয়ীতাকে।
–বাবা আসব?
–হ্যা মা,আসো।তোমাকে অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম একটা কথা বলব।
–কি কথা বাবা?
–তুমি তো আমার ছেলে আর তার মাকে দেখেছই।তাদেরকে কি তোমার কাছে একটু অস্বাভাবিক লেগেছে?
জয়ীতা মনে মনে বলল,’একটু কেন?পুরাই অস্বাভাবিক লেগেছে!’
কিন্তু মুখে কিছু বলল না।বাবা বললেন,
–আমার স্ত্রী কিন্তু আগে এমনটা ছিল না। কিন্তু যেদিন থেকে সে কি সব হিন্দি সিরিয়াল আর হিন্দি সিনেমা দেখতে শুরু করেছে,সেদিন থেকেই তার এই অবস্থা!এমনকি সে মাঝে মাঝে বাংলা ভাষায় কথা না বলে হিন্দিতে কথা বলে,আর মনে করে এটা ইদানীংকার ফ্যাশন।আর আমার ছেলে হচ্ছে তার মা-পাগল!
–সন্তানরা বাবা-মা পাগল হতেই পারে,কিন্তু বাবা-মাও তো মানুষ।তারা ভুল করতেই পারেন,আর সেই ভুল শুধরানোর দায়িত্ব তো সন্তানেরই।
–তুমি যেটা বোঝো,আমার ছেলে তো সেটা বোঝেনা!আমি পারিনি,এখন এদের দুজনের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।আমার ছেলে যদি অনুপম হয়,পারবে না তুমি কল্যাণী হয়ে দেখাতে?
–ইনশাল্লাহ বাবা।আমাকে যে পারতেই হবে!
৪.
–এই,তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
–কেন?ছাদে।
–ছাদে কি করতে?
আফনানের এই আজব টাইপের প্রশ্ন শুনেও জয়ীতা রাগল না।বরং কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই উল্টো প্রশ্ন করল,
–তোমার কি মনে হয়?আমি কি করতে গিয়েছিলাম?
–পাশের বাড়ির রনিও এই সময়েই ছাদে আসে না ঘুড়ি উড়াতে?
আফনানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে জয়ীতা হাসতে হাসতে বলল,
–আমি কি জানি?আমার থেকে তো মনে হচ্ছে তুমিই বেশি জানো।ওই ছেলেটা সম্পর্কে দেখছি তোমার ভাল ধারণা আছে!
–কি যা তা বলছ!আ..আমার কে..ক্কেন ভাল ধারণা থাকবে?
আফনানকে তোতলাতে দেখে জয়ীতা হাসতে হাসতেই চলে গেল,আর আফনান জয়ীতাকে রাগাতে না পেরে নিজেই রাগে গজগজ করতে থাকল।
–এই,একটু দেখে যাও তো।
–কি দেখব?
আফনান জয়ীতার কাছে এসে দেখে,সে ল্যাপটপ দিয়ে কি যেন দেখছে!
–এই নাটকটা দেখো,অনেক সুন্দর।অপূর্ব আর মমর নাটক।
–এরা আবার কে?ওমা,এটা বাংলাদেশি নাটক?এহ্,এইটা দেখব না।
–আরে একটু দেখই না!ভাল না লাগলে চলে যেও।
এই প্রথম আফনান বাংলা নাটক দেখতে বসল,আর এখান থেকেই তার বাংলা নাটক দেখার নেশা হয়ে গেল।এরপর থেকে আর চাইলেও তাকে হিন্দি নাটক বা সিরিয়াল দেখানো যেত না!আর এভাবেই জয়ীতা আফনানের মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন আনতে শুরু করল।এরপর বাংলা গল্পের বই,বাংলা গান সবকিছু আফনানের মধ্যে খুব সহজেই ঢুকে গেল।জয়ীতার আর আলাদা করে কিছু করা লাগল না।
৫.
একদিন সকালে আফনান অফিসে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে পানি খাচ্ছে,এমন সময় হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল।তাড়াতাড়ি বুয়াকে জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলে অফিসে চলে গেল সে।
দুপুরবেলা হঠাৎ করে বাবার ফোন আসল,
–হ্যালো,জয়ীতা তো হাসপাতালে।তুই একটু তাড়াতাড়ি আসবি বাবা?
চমকে উঠল আফনান।হঠাৎ করে কেন যেন তার খুব ভয় ভয় হতে লাগল!এই প্রথম কেউ অসুস্থ শোনার পর তাকে হারানোর ভয়ে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল।কিন্তু কেন এমন হচ্ছে,সেটা সে বুঝতে পারল না!
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে গিয়ে দেখে,জয়ীতা কেবিনে শুয়ে আছে।কাছে গিয়ে আফনান তার বাবাকে বলল,
–বাবা,কিভাবে কি হয়েছে?
–আজকে সকালে ফ্লোরে ভাঙা কাঁচ আর পানি পড়ে ছিল,জয়ীতা স্লিপ খেয়ে পড়ে গেছে!ডাক্তার বলেছে,তেমন কিছু হয়নি।সামান্য মচকে গেছে।
–কিন্তু তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন?
–তোর মা না করছিল!আর তাছাড়া তোর অফিসের এত কাজ,তুই যদি বিরক্ত হোস..
আফনান বুঝতে পারল,অফিসের কাজটাজ কিছুনা।মা না করেছে দেখেই বাবা জানাতে পারেনি।
আফনান সেদিনই জয়ীতাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসে।হাসপাতালে ওকে দেখে রাখার কেউ নেই।আর জয়ীতা মানা করেছে দেখে ওর মা-বাবাকেও কিছু জানানো হয়নি।
সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আফনানের।উঠে দেখে,জয়ীতা ঘুমের মাঝেই ব্যাথায় কাতরাচ্ছে।আফনান তাকে কয়েকবার ডাকল,জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে,কিন্তু জয়ীতা কিছুই বলল না।আফনান সেদিন সারারাত জেগে জয়ীতার পায়ে ওষুধ দিল,মালিশ করে দিল,ওকে পেইনকিলার খাওয়াল।শেষ রাতের দিকে যখন জয়ীতা একটু আরাম করে ঘুমাল,তখন আফনানও ঘুমিয়ে পড়ল।
এরপরের এক সপ্তাহ আফনান জয়ীতার কাছে পড়ে রইল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে।যদিও আফনানের মা অনেকবার বলেছিল এমন একটা অলক্ষুণে মেয়ের জন্য অফিসের কাজ বাদ না দিতে!কিন্তু এই প্রথম আফনান মায়ের কথার অবাধ্য হয়েছে।তবে মাকে কষ্ট দিয়ে নয়,অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে।এখন সে বুঝতে পারে,মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের কথার বিপরীত দিকেও হাটতে হয়,কিন্তু তাদেরকে কষ্ট দিয়ে নয়,যুক্তি দিয়ে তাদেরকে রাজি করিয়ে।অবশ্য সে জয়ীতার কথাও শোনেনি!
অসুস্থ বলে জয়ীতার খাওয়ার রুচি কমে গেছে।কিন্তু আফনান প্রতিদিন জোর করে জয়ীতাকে খাইয়ে দেয়।কোনো কাজ করতে দেয় না।বিছানা থেকে নামতেও দেয় না।যদি নেমে হাটার প্রয়োজনই হয়,তাহলে আফনানই হাত ধরে হাটতে সাহায্য করে।আর এর মাঝেই সারাদিন তারা মিষ্টি ঝগড়া করে।এভাবে ওদের দিনগুলো ভালই কাটছিল।
৬.
–তুমি কি আসলেই মাইশাকে খুব ভালবাসো?
অনেকদিন থেকে আফনানকে গম্ভীর আর চুপচাপ দেখে আসছে জয়ীতা।হঠাৎ কি মনে করে সে তাসফিকে মাইশার খবর জিজ্ঞেস করে।তারপর যখন শোনে যে মাইশার বিয়ের কথাবার্তা চলছে,তখন যেন সবকিছু তার কাছে পানির মত পরিষ্কার হয়ে যায়।তাই সে এই রাতে আফনানকে ছাদে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে।
–তুমি তো এখন আমার বন্ধুর মতই।তোমাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই।আমি সত্যিই মাইশাকে অনেক ভালবাসি!আসলে প্রথম প্রেমকে কেউ সহজে ভুলতে পারেনা।
–তাহলে?উম..আমি একটা কাজ করতে পারি।
–কি?
–আমি তোমাকে মাইশার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারি।
–সত্যিই?
আনন্দে চকচক করে উঠল আফনানের চোখ।চোখের পানি সাবধানে গোপন করে জয়ীতা বলল,
–হুম।
জয়ীতার মা একবার তাকে বলেছিল,’মা,মনে রাখিস,স্বামী হচ্ছে পোষা প্রিয় পাখির মত,কেউ যদি তাকে কেড়ে নিতে চায়,দিবি না।এমনকি সে যদি নিজে থেকেই চলে যেতে চায়,তারপরেও ছাড়বি না।দেখবি,একদিন সে ঠিকই তোর হবে।’
কিন্তু জয়ীতা আজ তার মায়ের কথা অমান্য করছে।কারণ যে চলে যেতে চায়,তাকে জোর করে ধরে রাখায় জয়ীতার মন সায় দিচ্ছে না!আফনান তো আর নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে জয়ীতাকে ভালবাসতে পারবে না!
–হ্যালো জয়ীতা।
অফিস থেকে বিকালে ফোন করেছে আফনান।তার কন্ঠে আনন্দের আভাষ।
–কি?মাইশার সাথে দেখা হয়েছে?
–হুম,আরও মজার ঘটনা ঘটেছে।আমি সন্ধ্যায় আমার বন্ধুর বাসা থেকে ফিরে তোমাকে সব বলব।
–আচ্ছা,রাখি,সাবধানে থেকো।
বলে রেখে দিল জয়ীতা।
কিন্তু সেদিন আফনান অনেক রাত করে ফিরল।এসে বলল,
–আজকে অনেক টায়ার্ড লাগছে।আজকে বলতে পারব না কি হয়েছে।বললেও তুমি মজা পাবে না শুনে!কালকে তো বন্ধ।কালকে বলব।
কিন্তু আফনান না বললেও জয়ীতা জানে,হয়ত সে মাইশার কাছেই ফিরে যাবে।
এরপরের দিন খুব সকালে উঠে জয়ীতা দেখে,আফনান একেবারে বাচ্চা ছেলের মত কুঁকড়ে ঘুমাচ্ছে।সযত্নে গায়ে কম্বলটা টেনে দিয়ে তার মাথার কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকে জয়ীতা।কি মায়াভরা চেহারা ছেলেটার!ঘুমের মাঝেও মনে হচ্ছে মৃদু হাসছে।তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয়ীতার চোখে পানি চলে আসল।নিচু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল সে!
৭.
সকালে উঠে জয়ীতাকে না পেয়ে সারাবাড়ি খুঁজলো আফনান।কিন্তু কোথাও পেল না।আবার রুমে যখন ফিরে এসেছে,তখন দেখে টেবিলের উপর একটা ছোট কাগজ পড়ে আছে!
কাগজে লেখা,’আমাকে আর খুঁজো না।আমি তোমার কাছ থেকে চলে গেলাম।এতদিন হয়ত তোমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছি,তোমার সাথে ক্ষণে ক্ষণে ঝগড়া করেছি।আর তোমার কাছে দুঃখ হয়ে থাকতে চাই না।মা-বাবার দিকে খেয়াল রেখো।আর মাইশাকে বিয়ে করে সুখে থেকো।নিজের যত্ন নিও।’
চিঠিটা পড়েও আফনান বিশ্বাস করতে পারল না যে সত্যিই জয়ীতা চলে গেছে।সে তো তার সেদিনের মজার ঘটনাটা জয়ীতাকে বলতেই পারল না!
জয়ীতা তার এক নিঃসন্তান খালার বাসায় উঠেছে।একটু বড় হওয়ার পর থেকেই মা-বাবার সাথে অভিমান হলেই সে এই খালার বাসায় উঠত।বাবা-মা টেরও পেতেন না।আবার মান-অভিমান ভেঙে গেলেই বাসায় চলে আসত।এই খালা তাকে অনেক আদর করে।
কিন্তু এইবারের পরিস্থিতি পুরাই ভিন্ন।তাই খালা যতই জানতে চান,জয়ীতা ততই এড়িয়ে যায়।বলে,
–তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছিল,তাই চলে এলাম।তুমি কি আমাকে থাকতে দিবে না?
–তা দিব না কেন?তুই তো আমার মেয়েই।তুই যত ইচ্ছা থাকবি।কিন্তু কারও সাথে কোনো ঝামেলা বাধিয়ে আসিস নি তো?
–আরে না।সত্যিই আমি তোমার সাথে একটু স্বাধীনভাবে থাকতে এসেছি।
–তুই ভাল আছিস তো মা?
–হ্যা,কেন?দেখে মনে হচ্ছে না?
বলে মিষ্টি করে হাসে জয়ীতা।কিন্তু বাইরে যতই হাসুক,ভিতরে যে তার কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে!
প্রতিদিনই সে সন্ধ্যার সময় ছাদে বসে একা একা কাঁদে।নিঃসঙ্গতা যে কি,তা জয়ীতা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।
৮.
একসপ্তাহ পর।একদিন রাতে জয়ীতা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল।ভয় পেয়ে যায় জয়ীতা।সে যতই পিছনে ঘুরতে চায়,পিছন থেকে কেউ তাকে ততই আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে।
–কে আপনি?
–এতদিন যার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছ!
আফনানের কন্ঠ শুনে অবাক হয় জয়ীতা।ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
–তুমি?কিভাবে জানলে যে এখানে আমি থাকব?
–ভালবাসা হারিয়ে যাওয়া মানুষকেও খুঁজে দেয়,জানো না?
–কিন্তু তুমি তো মাইশাকে ভালবাসো!
–আমি তো এটাই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম সেদিন।ঐদিন আমি মাইশার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।কিন্তু আমার আর মাইশার কথাবার্তা,আচার-আচরণ ভাল লাগছিল না।ওর সামনে বসে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছিল।ঐ প্রথম আমি বুঝতে পারছিলাম,তুমি আমার মধ্যে যে পরিবর্তন এনেছ,এখন তোমাকে ছাড়া আমি চলতেই পারব না।তুমি শুধু আমার বন্ধুই না,এর চেয়েও বেশি কিছু!
–কিন্তু তোমার চেহারার এ কি অবস্থা হয়েছে?শুকিয়ে একেবারে এতটুকু হয়ে গেছ!
–এই এক সপ্তাহে আমি যে তোমাকে কত মিস করেছি,তুমি সেটা জানো না।প্রত্যেকদিন ঘুম থেকে উঠে ভেবেছি তুমি এসেছ,কিন্তু তুমি আসনি।প্রতিদিন অফিস থেকে এসে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত প্রতিঘন্টায় তোমার জন্য চিরকুট লিখে আমি আমার নিঃসঙ্গ সময় পার করেছি।তুমি যে আমার কাছে কত মূল্যবান,এই কয়দিনে আমি তা হারে হারে টের পেয়েছি!
–আমিও প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে অনেক মিস করেছি!
–তাহলে ফিরে চল।
–কিন্তু মা তো মনে হয় এখনো আমার উপর রাগ করে আছেন।
–মা ই তো আমাকে পাঠালেন তোমাকে নিয়ে যেতে।এই কয়দিনে তিনিও বুঝেছেন তুমি আমাদের সংসারে কি!তুমি ছাড়া যে আমাদের সংসার অপূর্ণ মনে হয়,এটা তিনিও উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
–সত্যিই?
–হুম।চল যাই।
মা জয়ীতাকে মেনে নিয়েছেন শুনে খুশিতে তার চোখ চকচক করে উঠল।সে বলল,
–আচ্ছা,চল।
–শোনো।
–কি?
–তুমি কিন্তু আমাদের মাঝখানে এখন থেকে ঐ ভুঁড়িওয়ালা কোলবালিশটা দিতে পারবে না!আর..
–আর?
–তুমি কিন্তু আমাকে প্রতিদিন সকালে তুমি চলে আসার দিনটার মত ঘুম ভাঙাবা।
–কিভাবে?
–আমার কপালে চুমু দিয়ে!
–তুমি ঐদিন জেগে ছিলে?
–হুম।
–দাঁড়াও,তোমার একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে!
–আবার শুরু হল ঝগড়াঝাটি?
–হুম,ঝগড়া দিয়ে শুরু,ঝগড়া দিয়েই শেষ!
বলে আফনানকে জড়িয়ে ধরল জয়ীতা। আর এভাবেই তাদের প্রত্যাবর্তন ঘটল ভালবাসার রঙিন জগতে।।











