পেঁয়াজ পাঁচ কেজি, মরিচ তিন কেজি, সয়াবিন পাঁচ লিটার। সব কিছু ঠিক মতো এনেছ কিন্তু আটা আনতে ভুলে গেলে কেনো?? বাসার সবাই কে সকালে কি আমি পান্তা দিবো??
সব সময় তুমি ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে শেষ সময় বাজার করো কেনো?? যাও, বের হও বাসা থেকে, আটা নিয়ে আসো।
=সোনা বউ আমার, মাত্র অফিস করে এতো কষ্ট করে বাজার করে এলাম, এখন আবার বাহিরে পাঠাবে এই রাত
করে সামান্য আটার জন্য?? প্লিজ, বাসায় যে আটা আছে ওটা দিয়েই ম্যানেজ করো আগামীকাল টা।
-বাসায় আটা পুরো শেষ বললাম না??
আটা নেই।
= নেই কে বললো! আছে তো।
– আছে মানে?? কি বলতে চাচ্ছো তুমি??
=আরে, ওই যে, ড্রেসিংটেবিল এর ড্রয়ার গুলো তে কি কি যেনো আটা আছে না ছোট ছোট বক্সে, ওই যে, বাহিরে যাওয়ার সময় যে তুমি আর তোমার মেয়ে মিলে মাখামাখি গালে গলায়, ওগুলোও তো এক প্রকারের আটা। আগামীকাল সেগুলো দিয়ে রুটি বানাও প্লিজ।
একটু সঞ্চয়ী হও জামাইর প্রতি।
ব্যাপার না, রুটি থেকে অনেক সুন্দর ঘ্রাণ আসবে, ডিম, মাংস লাগবেনা, ঘ্রাণে ঘ্রাণেই নাস্তা হয়ে যাবে!!
– কি বললি তুই কুত্তা?? আমি মুখে আটা মাখি?? আজকে এটার বিচার চাই চাইইই, বিচার না হলে ঘড়ের সবার রাতের খাবার বন্ধ আজ। যাচ্ছি বাবা মার রুমে, আজকে বিচার ওনাদের করতেই হবে, দেখিস কুত্তা, শাস্তি তুই পাবিইইইইই…….
হা হা, উপরের কথোপকথন গুলো আমার আর আমার লক্ষি বউ টার। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় হাতে লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো আজ বাসায় ফিরার সময় যেনো বাজার গুলো নিয়ে আসি। মিস যেনো না হয়। অথচ আজকেও ভুলে একটা আইটেম মিস হয়ে গেলো। কেনো মিস হলো সে আরেক রহস্য।
আমার আর রিজার বিয়ের ১১ বছর হয়ে গেলো। বিয়ের আগের ৪বছরের প্রেম। সব মিলিয়ে ১৫ বছর ধরে এই মানুষ টাই আমার সব। জীবনের বাকি টা সময়তেও সব কিছু আমার এই মানুষ টা তেই মিশে থাকবে। বিয়ের দু সাপ্তাহ পর আমি প্রথম যেদিম অফিসে গেলাম সেদিন অফিস থেকে বাসায় এসে দেখি বউ আমার বিশাল এক লিস্ট আমাদের রুমের দরজায় টানিয়ে দিয়েছে। যার মধ্যে সব সময় আমার কি কি করা বাধ্যতামূলক সেগুলো লিখা আছে। আজ পর্যন্ত পুরো ১২ বছর যে প্রতিদিন এই লিস্ট মানা হয়েছে তা কিন্তু না। কোনো দিন হয়তো মানা হয়েছে, কোন দিন হয় নি, কখনো হয়তো এই লিস্ট এর চেয়েও বেশি কিছুও
করেছি। সব মিলিয়ে লুকোচুরি টা ঠিক মতোই করছি। রোমান্স টা অবশ্য এতেও আছে……
রিজার সেই মহাকাব্যিক লিস্টের অন্যতম প্রধান রুলস হলো, ঘড়ের নিত্যদিনের বাজার আমাকেই করতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে করালে সেই বাজার গ্রহণযোগ্য নয়। বাজার করা যে আমি আগে অপছন্দ করতাম সেটা না, কিন্তু বিয়ের পর আমি এখন একজন পূর্ণ বাজার বিশেষজ্ঞ। সিজনের কখন কোন জিনিসের দাম কেমন থাকে আর কোন টাইপ জিনিসের সাথে কেমন দাম করতে হয় সব এখন আমার কাছে চিরাপানি।
আমাদের মাঝে যেসব বিষয় নিয়ে বেশি খুনসুটি হয় তার অন্যতম বিষয় হলো বাজার। প্রায় সব সময় আমি রিজার দেয়া লিস্টের কোনোনা কোন আইটেম মিস করি। আর সেটা নিয়ে খুব লম্বা একটা টাইম বাসায় চলতে থাকে বিচার কার্য। বিচারক হলেন আমার আব্বু আম্মু। কখনো কখনো গেস্ট বিচারক হিসেবে আমার শশুর শাশুড়িও আদালতে যোগ দেন। আদালতের প্রতি
পর্বেই আসামী হিসেবে আমি সাব্যস্ত হই। দোষ আমার থাকুক আর না থাকুক। আমার বিচারক কর্তৃক তিরস্কার দেখে রিজার কি মহা খুশীইইইই…..
তবে ম্যাডাম আমার খুবই ভাল মানুষ। প্রতি বিচারের পর আমার মুমূর্ষু অবস্থা দেখে তার খুবই মায়া লাগে। রাতের বেলা যখন বিচার শেষে মন খারাপ করে রুমে ঢুকি তখন রিজা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ,ঠোট,তুরতুরি,কপালের অসাধারন রুপ রুপান্তর
ঘটিয়ে “চুক চুক” করে কিছু আওয়াজ করে। কেনো জানিনা সেই আওয়াজ আর আওয়াজ দেয়ার সময়ের রিজার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আমি বারবার মুগ্ধ হতে থাকি প্রতি পলকে সাইক্লোন এর বেগে। রিজাকে অবশ্য বুঝতে দেইনা। ভাবখানা এমন করি যে ওর চুকচুকে আমার রাগ আরো বেড়েছে। রিজা তখন চুপ করে নিচে তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় নিজেই অপরাধীর চেহারা করে।
মুহুর্তেই কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসে সাথে আমার কোনো ফেভারিট খাবারের আইটেম নিয়ে, অথবা পছন্দের কোনো কিছু নিয়ে।
আমাদের বিয়ের পর সর্বো প্রথম যেদিন রিজা আমাকে আসামী করে, সেদিন আমি রাগ রাগ ভাব করায় রিজা রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো নিচে তাকিয়ে। আমার মধ্যে তখন অপরাধবোধ কাজ করছিলো। মনে হচ্ছিলো রাগ টা বেশিই হয়ে গেলো, মেয়েটা এতো সুন্দর করে চুক চুক করলো, নিজ থেকে হাসানোর চেষ্টা করলো, আমার মনে হয় নরমাল হওয়া উচিৎ ছিলো। এই ভেবে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে রুম থেকে বের হয়ে দেখি রিজা কোথায়, গিয়ে রাগ ভাঙাই, ঠিক তখন ই রিজা রুমে হাজির, এক হাতে মোম বাতি, আরেক হাতে এক গ্লাস ম্যাংগো জুস। মিটিমিটি হাসতে হাসতে টেবিলের উপর মোম,জুস রেখে লাইট,
ফ্যান অফ করে দিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না রিজা কি করছে, রাগ উঠে যাচ্ছিলো, ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করতে যাবো যে রিজা কি করছে ঠিক সে সময় দেখি রিজা মোমের মাঝে মেচের কাঠি দিয়ে “জিঝ” মতো আওয়াজ করে আগুন জালিয়ে ওর
মুখের কাছে নিয়ে মেলে ধরলো।
মোমের আলোয় রিজার হালকা ঘামে ভিজা চেহারা টা যেনো আমায় মুহুর্তেই খুন করে দিলো। কি করবো যেনো মাথায় কিছুই
দিচ্ছিলোনা। রিজা আমার হাত টা ধরে টেবিলের এক পাশে আমায় বসিয়ে আরেক পাশে নিজে গিয়ে বসলো। মাঝে মোম আর জুসের গ্লাস টা রাখলো। দুটো ছোট পাইপ বের করে জুসের গ্লাসে রেখে অদ্ভুদ সুন্দর চোখের ভাজ দিয়ে আমায় টিপ্পুনি
কেটে গ্লাসের মাঝে থাকা দুটো পাইপের একটা মুখে নিলো। তারপর??
তারপর আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম এক মুহুর্ত। মোমের আলোয় দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক গ্লাসেই দুজন মিলে জুস খাচ্ছিলাম আর চোখের ভাষায় কথা বলছিলাম। সে এক অসাধারন সময়, যা আমায় প্রতিটি ক্ষণে বেচে থাকার প্রেরণা দেয়।
শুধু এমন ই না, রিজার পাগলামী আছে আরো সব জায়গা জুড়ে। আমাদের যখন প্রথম বেবি সামায়রা হয় তারপর হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসার পর মোটামুটি লম্বা এক টা সময় পার হয়। রিজা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে, এরপর থেকে সামায়রার কিছু টা বড় হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতি চাঁদনী রাতে রিজা একেবারে নিয়ম করে আমাদের বাসার ছাদে গিয়ে আমার কোলে রিজা বসে তার কোলে আবার সামায়রা কে নিয়ে চাঁদের আলোয় আমাদের অবলোকন করতো। আমরা সেই মুহুর্তটায় মুখের দিক থেকে
চুপ থাকলেও মনের দিক থেকে দুজন প্রচুর আলাপ করতাম, যার মধ্যে ঝগড়া,ফান, ভালবাসা সব থাকতো। কথায় আছে না?? ভালবাসার কোণ নির্দিষ্ট ভাষা নেই। চাঁদের আলো আমি আর রিজা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে যখন সামায়রার দিকে তাকাতাম তখন সামায়রার চেহারাতে আমাদের দুজনের চেহারা সহো পুরো পৃথিবীটাই যেনো ভেষে উঠতো।
আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ইশান্ত। তাকে বলা হয় দুষ্টামির মহাগুরু। চি চি চেঁচামিচি করে সারাক্ষণ আমাদের পুরো ঘড় ভড়িয়ে রাখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এই বাচ্চাটার। কখনো দাদা দাদুর পিছনে লাগবে তো কখনো বড় বোন কে জালাবে। কখনো আবার তার
মায়ের কোনো বিশাল কাজের মধ্যে আচমকা ঢুলে বিশাল বিশাল ঝামেলা পাকাবে, আর কখনো আবার আমার মাথায় উঠে বান্দরের নাঁচ নাঁচবে। ইশান্ত প্রথম জন্মদিনের সময় টা আমার এখনো মনে পড়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন চলে যায়, আমি আর রিজা কাজ করে করে দুজনেই টায়ার্ড, ভাবছিলাম লম্বা এক ঘুম দিবো। ঠিক এই মোমেন্টে রিজা রুমে ঢুকে দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে ইশান্ত কে এক পাশে শুইয়ে দিয়ে খুব জোড়ের সাথে আমার শার্ট টেনে ধরে বুকে মাথা দিয়ে এক টানা কতো এক ঘন্টা আমার বুকের মাঝে ওর ঠোট দুটোর স্পর্শ দিতে দিতে বার বার শুধু একটা কথাই বলছিলো, “সাজি, আমি তোমাকে ভালবাসি”। কেনো জানিনা আমি রিজাকে একবারো থামাইনি। আমিও খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিজার উত্তর দিতে থাকছিলাম। আর চোখ দুটো কে ভিজিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন ইশান্তর হঠাৎ নড়াচড়া করে উঠা দেখে দুজনেই হেসে দিয়ে বাকি রাত ইশান্ত কে কোলে নিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে দুজনে চোখের ভাষা পড়ছিলাম।
বাহির থেকে আসায় ড্রেস চ্যাঞ্জ করছিলাম আর রিজার পাগলামি গুলো ভাবছিলাম। কখন যে ইশান্ত সামনে দাঁড়িয়ে চকলেট দিয়ে মুখ ভড়িয়ে খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো বুঝতেই পারিনি..
-কিরে ব্যাটা?? হাসছিস কেনো??
=বাবা, তুমি আগে বলো শার্ট মৌজা খুলতে খুলতে তুমি হাসছো কেনো??
কি ভাবছিলে হুম হুম?? আজকেও তুমি ইচ্ছে করে বাজারের আইটেম মিস করেছ না?? সামথিং সামথিং??
– নাথিং, এতো বেশি জানিস কি করে রে?? এই বয়সে এতো বেশি জানতে হবেনা। আর, কেনো রে??
ড্রেস চ্যাঞ্জ করার টাইমে হাসতে মানা আছে নাকি তোর মায়ের??
= নো বাবা, তা নেই, তবে তুমি আমাকে বলো, ড্রেস চ্যাঞ্জ করতে করতে যদি হাসা যায় তাহলে চকলেট খেতে খেতে নিজের বাবা কে হাসতে দেখে নিজেও হাসতে দোষ কি হুম??
– ব্যাটা তুই বড়ই পাঁকনা হয়েছিস রে, তোর শায়েস্তা করতে হবে।
= আরে হয়েছে হয়েছে, আমার শায়েস্তা তুমি পড়ে করো, আগে নিজেকে বাচাও, তোমার বিরুদ্ধে আদালত বসেছে দাদা দাদুর রুমে। আম্মু তোমার নামে বড়ই জবরদস্ত অভিযোগ এনেছে। এবার আর ছাড় নেই তোমার, বিচার শুরু হবে, তোমাকে গ্রেফতার
করার জন্য প্রধান বিচারপতি দাদাজান আমাকে পুলিশ হিসেবে পাঠিয়েছেন। দ্রুত রেডি হয়ে নাও, নতুবা শার্ট ছাড়া অবস্থায় তোমাকে ধরে নিতে বাধ্য হবো।
– আরে বাবা এ কেমন পুলিশ রে হা!!
নিজের বাবা কে নিজেই গ্রেফতার করছিস!! একটু তো স্বজনপ্রীতি কর!!
=হা হা হা হা…….
ইশান্ত হা হা করে হাসছে, আর ওর মায়াবী চকলেট মাখা মুখ টা আমায় আরো দুর্বল করে দিচ্ছে..
হা হা..
কি আর করা..
আদালত রেডি..
পুলিশ ও হাজির..
ধরা তো আমায় দিতেই হবে..
যাই..
আরেকবার না হয় আসামী হয়েই আসি..
কারন জানি তো..
এরপরেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে রিজার অফুরন্ত ভালবাসার পাগলামি..
যার জন্য আমি হাজারবার আসামী
হতেও রাজি………