আমার ছোট মেয়েটা ডাক্তার একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। কিন্তু দুনিয়ার সবকিছুই নিজের মতো ব্যাখ্যা করা শিখে গেছে। ওকে কিছু বলে করানো যায় না। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয় কেন ওকে সেটা করতে বলা হচ্ছে। যুক্তি পছন্দ হলে করবে। না হলে উলটো যুক্তি দিয়ে কিসব ভুলভাল বুঝিয়ে দেয় নিজের ভাষায়। আমি সেই ভাষাটা বুঝি কম। ওর মা বুঝে। মা মেয়ে মাঝে মাঝেই সেই সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে আর মিটিমিটি হাসে। আমি অসহায়ের মতো ওদের মুখের দিকে তাকাই থাকি।
গত দুইদিন ধরে মেয়েটার জ্বর। ডাক্তারের কাছে এক প্রকার জোড় করেই আনতে হয়েছে। তাই আমার ধারেকাছেও আসছেনা। ও মায়ের কোলে চুপটি করে খরগোশের বাচ্চার মতো বসে আছে। ডাক্তারকে দেখে আরো কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। এতোক্ষণ মায়ের সাথে বিড়াল ছানার মতো মিউ মিউ করে দুনিয়ার কথা বলছিলো। ডাক্তার এসে ওর গালে আলতো করে আদর করে দিতেই ও ঝাপটা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো।
” মামনি কেমন আছো?”
” তুমি আমার সাতে কথা বব্বে লা।”
” কেন। আমি কি দোষ করেছি?”
” তুমি ডাক্তাল। তুমি খালি তিতা তিতা উষুদ খাওয়াও।”
” আচ্ছা এবার থেকে মিষ্টি মিষ্টি ওষুধ দিবো তোমাকে।”
“তুমি মিত্তা কতা বলো। তুমি ডাক্তাল, তুমি পতা।”
ডাক্তারের সাথে সাথে আমরাও হেসে উঠি। ওর আদো আদো বোলের কথা গুলো উচ্চারণ অস্পষ্ট হলেও বুঝা যায় কি বলছে। ও ডাক্তারকে ভয়ের পিছনে ওর মায়েরও অনেক ভূমিকা আছে। ও বেশি দুষ্টামি করলে বা না খেলেই ওর মা ভয় দেখায় ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ডাক্তার ওকে তেতো তেতো ওষুধ খাওয়াবে, ইনজেকশন দিবে।
ডাক্তার দেখে বলল ভাইরাস জ্বর। সিরাপ দিলো। আমি এইসব বুঝি কম। বউ বুঝে নিলো। মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম। আসার সময় জিজ্ঞাস করলাম কিছু খাবে কিনা। আমার কথা পাত্তাও দিলো না। কতোবার কাছে টানতে চাইলাম। প্রচণ্ড রেগে আছে তাই এলো না একবারও।
রাতে ঘুমানোর সময় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ওর মা রান্নাঘরে গোছগাছ করে নিচ্ছিলো। তাকিয়ে ছিলাম ফুটফুটে নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখের দিকে। সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে আছে। মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো আমার মামনিটা। খুব কষ্ট হচ্ছিলো দেখে। ওর তুলতুলে গালে নিজের গালটা ছুঁইয়ে দিলাম। আমার গালে ওর গরম নিঃশ্বাস পরছে। মুখে ওষুধের গন্ধ। মেয়ে দুই হাত মুঠো করে ঘুমায়। ওর একটা হাতের মুঠোয় একটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলাম। ও একটু নড়ে উঠে আমার আঙ্গুল শক্ত করে ধরলো। জানিনা স্বর্গে মানুষের জন্য কেমন সুখ রাখা আছে। আমার কাছে আমার এই ছোট্ট মামনিই আমার স্বর্গ। ও যখন ঘুমায় মাঝে মাঝে হাসে। সেই হাসি আরেকবার দেখার জন্য আমার যুগের পর যুগ প্রতীক্ষা করতে ইচ্ছে করে। আমার এইসব কান্ড দেখে বউ হাসে।
দুই দিন পরেই মেয়ে সুস্থ হয়ে গেল। যদিও দুর্বলতা কাটেনি পুরোপুরি। আর এদিকে আমি অসুস্থ হয়ে পরলাম। মেয়ে সারাক্ষণ ওর মায়ের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে।
” মা, বাবাইকে ডাক্তালেল কাতে নি যাও। তিতা তিতা উষুধ খাওয়াও। ইন্দেকতন দিবে হবে।”
” না নিবো না।”
” নিতে হব্বে। নিতে হব্বে। আমি বলতিনা নিতে হব্বে।”
এটা হলো ওর চূড়ান্ত হুমকি। এরপরে না নিলে দুনিয়া তছনছ করে ফেলবে। আমার মাথা ভারি হয়ে আছে। বাইরে যাওয়া সম্ভব না। বউ হাজার চেষ্টা করেও মেয়েকে বুঝাতে পারলোনা। আসলে এটা হলো প্রতিশোধ। মেয়েকে ডাক্তারের কাছে জোড় করে নিয়ে গেছি তাই আমাকেও নিয়ে যাবে। তেতো তেতো ওষুধ খেয়ে আমি চোখ মুখ বিকৃত করবো তবেই ওর শান্তি। অন্য ওষুধ খেয়ে যতোই চোখ মুখ বিকৃত করি লাভ নেই। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে।
বউকে বললাম রেডি হতে। ও জানে মেয়ের জন্য দুনিয়ার শেষ প্রান্তে যেতেও আমি রাজি। কিছু করার নেই। দুই জনে রেডি হয়ে তারপর মেয়েকে রেডি করানো হলো। ওকে আগে রেডি করানো মানে আর একটা সেকেন্ডও সময় পাওয়া যায় না। বাইরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকে। দরজার সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করে।
ডাক্তারের রুমে যেতেই মেয়ে আগে আগে ডাক্তারের কাছে চলে গেলো। মনে হচ্ছে আমি ওর অবাধ্য ছেলে। আর ও আমার মা। ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলছে আমার কি সমস্যা।
” ডাক্তাল আংকেল। বাবাইকে উষুধ দাও। বাবাইর জর হইতে। কিতু খাইতে পালেলা। বাবাইকে ইন্দেকতন দাও।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আগে তোমার আব্বুকে দেখি।”
” দেখতে হবেলা। তিতা তিতা উষুধ দাও।”
” আচ্ছা মা। এক্ষুনি দিচ্ছি।”
মেয়ের কান্ড দেখে সবাই হাসি। ডাক্তার চেক করে বললো সেই একই কথা। ভাইরাস জ্বর। কিন্তু মেয়েকে তো শান্ত করতে হবে। তাই একটা এন্টাসিড মুখে দিয়ে চোখ মুখ বিকৃত করে খেয়ে ফেললাম। মেয়ে তো মহা খুশি। চরম প্রতিশোধ নিতে পারছে। এরপরে আমাকে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য শুরু করলো চিল্লাচিল্লি। ডাক্তারও নিরুপায় এই বাচ্চা মেয়ের কাছে। সুই না লাগিয়ে লুকিয়ে গ্লাস থেকে পানি নিয়ে দেখালো যে আমাকে ইনজেকশন দিচ্ছে।
মেয়ে তো এবার যেন খুশিতে ফেটে পরবে। কিন্তু আমি কোন চিৎকার বা কান্নাকাটি করছি না দেখে মেয়ে হতাশ। ওর মাকে বলল আমি কান্না করছিনা কেন। বউ ঈশারা করলো কান্না করতে। মহা ঝামেলায় পরে গেলাম। এই বুড়ো বয়সে কি এইসব ছেলে মানুষী ভাল লাগে। ডাক্তারও ঈশারা করলেন।
উপায় নাই। কান্নার অভিনয় শুরু করলাম। খুব ব্যাথা পাচ্ছি এমন ভাবে শরীর কাঁপাতে লাগলাম। মেয়ে প্রথম প্রথম হাসছিলো। হঠাৎ দেখি ওর মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে। নিচের ঠোঁটা উলটে যাচ্ছে। দৌড়ে এসে কান্না করতে করতে ডাক্তারকে এলোপাথাড়ি মারা শুরু করলো।
“তুমি আমার বাবাইকে কত্তো দিতো কেন তয়তান ডাক্তাল। তুমি পতা। আমার বাবাইকে চারো চারো।”
ডাক্তার হাসতে হাসতে সরে যেতেই মেয়ে আমার বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পরলো। দুই হাতে আমার গলা ধরে সেই কি কান্না। কিছুই বলছেনা। শুধু কান্না। মেয়ের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ওর ছোট্ট শরীর আঁকড়ে ধরে ওর মাথায় নাক ডুবিয়ে চুমু খেলাম। কেউ জানেনা আমার চোখে কয়েক ফোঁটা জল গড়ালো। এই ভালবাসার কোন ভাষা হয়না। প্রকাশ করা যায় না। সবার আড়ালে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলাম। বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি মিটিমিটি হাসছে। ওর চোখেও ছলছল করছে পানি। মেয়ে আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে এসে বাবার কষ্ট আর সহ্য করতে পারেনি। ছোট্ট অবুঝ মনটা আমাদের বড়দের মতো কখনো ভালবাসা গোপন রাখে না। এমন প্রতিশোধ হাজার বার নিলেও আমি খুশি।
সিএনজি করে বাসায় আসার সময় মেয়ে আমার কোলে বসলো। আরেক হাতে বউকে ধরে আছি। জীবনে এই সুখটুকুর কোন তুলনা আর কিছু দিয়েই হয়না। মেয়ে বারবার জানতে চাইছে আমি কিছু খাবো কিনা। আমার কি খেতে ইচ্ছে করছে। আমার ছোট্ট মেয়েটা সত্যি সত্যি আমার মা হয়ে গেল। যতোই বলি কিচ্ছু খাবোনা সে মানবেনা। বললাম, “তোমার চুমু খাবো মামনি।” বলতেই দেরি শুধু। ও সাথে সাথে আমার দিকে ফিরে ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত আমার মুখে বুলিয়ে দিয়ে সারা মুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলো। ওর মা পাশ থেকে বলল, “আমাকে দিবে না সোনা!”
ও এমনভাবে ওর মায়ের দিকে তাকালো যেন ওর মা বিরাট কোন ভুল কাজ করে ফেলেছে। খুব গম্ভীর হয়ে বলল, “দেকতেতোনা বাবাইর উষুক হইতে।” আবার আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে সারা মুখ ভরিয়ে দিলো। বউ হাসতে হাসতে আমার হাত জোরে করে চেপে ধরে রাখলো। আমার বুকে আর হাতে দুই দুইটা স্বর্গ নিয়ে বাসার কাছাকাছি এসে সিএনজি থেকে নামলাম।