ভালবাসার স্পর্শ

ভালবাসার স্পর্শ

আমি লাইব্রেরীতে যাবো। মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। আচ্ছা আমিও আসছি তোমার সাথে। হাসে ছেলেটি। ওদিকেই যাবো, চলো এগিয়ে দেই। মেয়েটির পড়নে শার্টের কাট দেয়া কামিজ,নীল কামিজে হালকা সাদা ফুল, আকাশী ওড়নায় মেয়েটিকে জল কন্যার মতো লাগে।

ওরা দুজনেই হাঁটছে, ওদের দুজনের চোখ ভরা আগামীর স্বপ্ন। মেয়েটির নাম অনন্যা, ছেলেটি আদর করে ডাকে অনু পরমাণু। ছেলেটির গায়ে মুখে এসে মেয়েটির ওড়নার আঁচল লাগে। মেয়েটি ওড়না সামলাতে গিয়ে লাজুক হয়। ঘড়িতে একটা বাজে। ছেলেটির নাম শাহেদ। রাজনীতি করতে গিয়ে ঘর ছাড়া। শাহেদ বলে ” অনু একটু দাঁড়াবে। একটা বাজে। আসো এক কাপ চা খাই। ” এই ভর দুপুরে বুঝি কেউ চা খায়! আসো বাসায় ভাত খাবে। নাহ থাক অন্য একদিন, খালুজানের সাথে গল্প করতে যাবো। রাজনীতি করতে গিয়ে ঘরছাড়া এই যুবকটিকে অনুর বাবা মা খুব ভালবাসেন। ছেলেটি বহুবছর তার এক হিন্দু বন্ধু মলয়ের বাড়িতে থাকে। ছেলেটিও খুব ভাল গান গায়। অনুর বাবার শরীরটা ভাল নেই প্রায়ই জ্বরজারি লেগে থাকে। উনি প্রায়ই বলেন। এবার অনুর একটা বিয়ে দেই। কি বলো! ও মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছে। অনার্সটা অন্তত পাশ করুক। অনুর বোন “পরমা ” অনুর বাবা শখ করে রেখেছেন। পরমা খুব ঝগড়াটে। ছোট ভাই দীপ্তর সাথে সারাদিন লেগেই আছে।

অনুর বাবার এক বোন শহরের মেয়েদের স্কুল শিক্ষিকা। উনি প্রায়ই অনুদের বাসায় বেড়াতে আসেন। অনুর মায়ের হাতের শৈল মাছ ভুনা আর দেশি মুরগির রান খেতে খেতে অনুর মাকে প্রায়ই একগাদা উপদেশ দেন। এই বয়সটা মেয়েদের বিয়ের জন্য ভাল। অনুর বয়স কতো! বিশ না অনুর মা ভয়ে ভয়ে বলেন, ” ঊনিশ শেষ হয়ে বিশে পড়লো। ” উনি আর একটু ভাত আর বড় একটা মাংস নিতে নিতে বলেন ” ওইতো ঠিক ধরেছি বিশ। বিশে পা মানেই বিশ। আর পড়াশোনা? সে বিয়ের পরেও করা যায়। ”

অনুর পড়ার টেবিলে স্যুট পড়া এক ছেলের ছবি দেখা যায়। অনু কাঁদে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। সন্ধ্যায় শাহেদ আসে। সেদিন রাতে খুব জোস্না হয়েছে। দীপ্ত বারেবারে বলে, ” শাহেদ ভাই একটা গান গেয়ে শোনান প্লিজ।” শাহেদ গায় ” চরণ ধরিতে দিওগো আমারে নিওনা নিওনা সরায়ে। ” দীপ্ত হেসে বলে শাহেদ ভাই আপনাকে হিংসে হয় এতো সুন্দর গাইতে পারেন। শাহেদ হেসে বলে তোমাকেও আমার হিংসে হয়। কি সুন্দর প্রতিদিন স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলে যাও। এই সুন্দর দিনগুলি কি করে জানি হারিয়ে গেলো।

শাহেদের এক বন্ধু এসে ডাকে ” শাহেদ ভাই, শাহেদ ভাই! একটু আসবেন! ” শাহেদ দ্রুত বের হয়ে যায়। “পুলিশ এলাকা রেড দিয়েছে। দ্রুত শহরের বাইরে চলে যান। আসুন ঢাকার বাসে তুলে দেই আপনাকে। শাহেদ বলে ” না থাক তুমি আমাকে লক্ষ্মীবাজার মোড়ে নামিয়ে দাও। আমি দিলিপদের বাড়ি যাচ্ছি। ” দিলিপ পালিয়েছে শাহেদ ভাই। ওর বাড়িতে কিছু পোষ্টার আছে। আপনি তালাইমাড়ি চলে যান। ” বায়ের রাস্তায় একটা পুরানো হলুদ বাড়ি আছে। আমার নাম বললে আপনাকে রাতে থাকতে দেবে।” আজ দুইদিন একটা বাসায় বন্দী, কতক্ষণ আর ভাল লাগে। বারান্দায় বিকেল পরে এসেছে। দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। খুব আস্তে ভয়ে ভয়ে। খুলবে কি খুলবে না। শেষে চুপচাপ ঘরে বসে থাকাটাই ভাল মনে করে শাহেদ। তবে কৌতুহলটা যায় না। কেউ দরজা খুলে দিয়েছেঘরে ঢুকছে শার্ট কাটের জামা পড়া একটি মেয়ে।

” তুমি! তুমি এখানে কেন? কে দিয়েছে ঠিকানা! “যোগাড় করেছি। তুমি ভাত খেয়েছো? ” মেয়েটি লাজুক গলায় বলে। ” না, এখানে খাওয়ার কোন টাইম টেবিল নেই। আমি লুকিয়ে আছি, কেউ জানে না। দিনে একবার খাই, রাতে। “আসুন ভাত খাই। আমি ভাত এনেছি। ভুল বললাম। ভাত না ভুনা খিঁচুড়ি আর হাঁসের মাংস। একটা বড় বক্সে করে ব্যাগে ভরে এনেছি। ” তুমি খেয়েছো?” – না খাইনি, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি খান। আসো দুজনেই খাই। একটাই বাটি তুমি একদিক থেকে খাও আমি আর এক দিক থেকে। অনু চুপচাপ খেতে থাকে। শাহেদ বড় বড় লোকমা তুলে খাচ্ছে বাচ্চাদের মতো। খাবার নিতে গিয়ে বারেবারে অনুর সাথে আঙুলের ছোঁয়া লাগে।

শাহেদ দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। একসময় অনু বলে আমি আর খাবো না। আপনি না খেলে বাকিটা থাক। রাতে খাবেন। আমি এখন উঠবো। ঘরের জগেই পানি ছিল অনু জানালা দিয়ে হাত ধোয় ওর গোলাপি আঙুলে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে । কি সুন্দর লাগছে দেখতে। শাহেদ বলে “অনু পরমাণু এবার তোমার ফেরা উচিৎ। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমায় এগিয়ে দিয়ে আসুন। নাকি তাও বারণ? না বারণ না, তবে যারা আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের বিপদে ফেলতে চাই না। মতিন সেদিন রাতেই আসে। ” শাহেদ ভাই, অনু এসেছিল? ” হুম কেন? ” কথাটা চাউড় হয়ে গেছে। আপনি ঢাকা চলে যান। এস এম হলে থাকবেন। এই নিন ২০০০ টাকা। আর আমি নাইট কোচের টিকিট নিয়ে এসেছি।

সেদিন সন্ধ্যায় অনু বাড়ি ফিরে দেখে ওদের বাসায় ড্রইং রুমে অনেক লোক। একজন এসে ওকে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। মা, চাপা গলায় বকতে থাকেন। চোখের জল আর নতুন শাড়ির গন্ধে অনু যখন দিশেহারা। তখন অনু খেয়াল করে ফর্সা রোগা চশমা পড়া শুভ্র টাইপ এক ছেলে তার হাতে আংটি পড়িয়ে দিচ্ছে। এক সময় সব কিছু থেকে মুক্তি মেলে। সব মেহমান বিদায় হয়। কিন্তু একটা আঙুলের একটা আংটি বলে দিচ্ছে, অনুর জীবনটা বদলে যাচ্ছে।
ধুমসে কেনাকাটা চলছে । এ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে। সময় খুব কম। মাত্র পনেরোদিন। অনুর মা অনুকে অনেক গহনা কিনে দিয়েছেন। ” পরমা” কেউ এলেই বের করে দেখায়। ” পরমা ” ঘুরে ঘুরে শাড়ি কেনে আর ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট বানায়। আজকাল রাতে ঘুম আসেনা অনন্যার। একসাথে হাঁটা, রিক্সায় তুলে দেবার সময় রিক্সাওয়ালাকে অনুরোধ।”সাবধানে নিয়ে যাবেন” কথাগুলো বারবার মনে পরে।

আজ অনুর গায়ে হলুদ। অনু যতোবার বলে বিয়ে করবো না মা। ওর মা অসহায় হয়ে তাকান। ওর বাবা বলে ভেবোনা বিয়ে হলে ঠিক হয়ে যাবে। ওর মা বলেন, ফুপু বলে এতো আয়োজন কি তবে পানিতে ফেলা যাবে! আমি এতো আয়োজন চাইনি মা। কাঁদতে কাঁদতে বলে অনন্যা। হলুদ শাড়িতে অনু সেজেছে। কি সুন্দর লাগছে ওকে। সবাই গায়ে হলুদ দিচ্ছে আর মিষ্টি খাইয়ে টাকা দিচ্ছে। “পরমাও আজ শাড়ি পড়েছে। একটু পরপর বলছে, “ফুলের গয়নায় আপাকে পরীদের মত লাগছে। ”

কি মনে করে আজ বিকেলের বাসে উঠে বসেছে শাহেদ। ঢাকায় আর ভাল লাগছে না। যা হবার হবে ও আজ রাজশাহী যাবেই যাবে। বাস এসে থামে রাত দশটায়। একবার অনুদের বাসায় গেলে হয় না? ও সেদিন বাসায় ঠিকমতো পৌঁছেছিল তো! কি মনে করে রিক্সাওয়ালাকে প্রফেসর পাড়ার দিকে যেতে বলে। অনুদের বাসায় এতো
আলো কিসের? আম গাছের নিচে বেশ কয়েকটি মেয়ে জটলা করে হাসাহাসি করছে। ছেলেদের সবার পরনে পাঞ্জাবী। আজ কি “পরমার জন্মদিন!” পরমা অনেকক্ষণ হলো একটা জিনিস খেয়াল করছে। আম গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। সেই বুক ফাঁটা জল সে লুকোবার চেষ্টা করছে না মোটেও।

অনু পরমাণু এ শহরে আমি আর ফিরবো না। সুখে থেকো তুমি। কোথায় একটা ব্যাথার ঢেউ বারবার বুকে আছড়ে পড়ছে। সেই আঙুল আজ মেহেদি রঙে রাঙানো। কখনো ভাল করে ছুঁয়েও দেখা হয়নি। ভালবাসা কি এমনই হয় ভীষণ বোকাবোকা, লাজুক একটু স্বার্থপর। কিছুই জানে না শাহেদ। শুধু জানে এরপরে আর কখনো কেউ খিদের বিষন্ন বিকেলে প্রিয় খাবার নিয়ে উপস্থিত হবে না। কেউ একটুও অভিযোগ করবে না, ” একটাই তো বাটি, আমি খাবো কি করে! ” লোকজনের ভিড় এখন কম। পরমা, অনন্যাকে হাত ধরে টানে। আপা উঠে আয় তো। অনেক বসে থেকেছিস। অনন্যা উঠে আসে ঠিক যেন কলের পুতুল। হাত ধরে প্রায় গেটের কাছে নিয়ে আসে পরমা, বোন কে। “কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে! ” ভূত দেখার মত চমকে ওঠে অনন্যা। শাহেদ বলে “অনু তুমি? ”

এই নিন রুমালটা রাখুন, আর রিক্সায় আপার স্যুটকেস তুলে দিয়েছি। আপনারা সোজা নাইট কোচ ধরে ঢাকা চলে যান। তারপরে কি করবেন আপনারা জানেন। এক নিশ্বাসে বলে যায় পরমা। রিক্সা চলছে । শাহেদের এতো ভাল লাগছে, একটা ফুলপরীর পাশে বসে রিক্সায় যেতে। অনুর হাতের আঙুল হঠাৎ শাহেদের হাতে লেগে যায়। লাজুক শাহেদ সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয়। ওর কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে আবার ভালোও লাগে। অনন্যা শাহদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। বাতাসে ওর শাড়ির আঁচল উড়ে শাহেদের গালে এসে লাগছে। শাহেদের মনে হচ্ছে যেন অনন্যাই আঙুল দিয়ে শাহেদের গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। প্রেমে পড়া বারণ, আঙুলে আঙুল লাগলেও হাত ধরা বারণ।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত