কফিনে বন্দী ভালোবাসা

কফিনে বন্দী ভালোবাসা

পুর্বদিকের আকাশে বিশাল একটা চাদ, আচ্ছা আজ কি
পূর্ণিমা ! কি জানি, হবে হয়তো । এইসব চাদ-তারার
হিসাব করা হয়নি বহুদিন । পেছন দরজাটা খুলে
ব্যালকনিটায় এসে দাড়াতেই কামিনী ফুলের একটা কড়া
গন্ধ এসে নাকে ঝামটা দিলো । কি মনে করে
ইজিচেয়ারটা টেনে নিলাম, অনেকদিন বসা হয়নি বলেই
হয়তো ধুলার একটা পুরু আস্তরণ জমেছে ওখানে ।
ধুলোটা ঝেড়ে বসলাম । বাইরের চাদটা নিজের সবটা
আলো ঢেলে দিয়েছে যেন !
অজান্তেই বাড়ীর পেছন দিকটায় চোখ চলে গেল , ইস! কি
সুন্দর রঙ নিয়ে কয়েকটা গোলাপ ফুটেছে ওদিকটায় ।
বাগানটাতে কয়েকটা ফুলের গাছ, তার একটু এপাশে
এলেই বড় বড় ঘাসগুলোর নিচে একটা কবর! আমার কবর! ও
না ওটা আমার কবর নয়, আমার ভালোবাসার কবর, যার
নিচে ঢাকা পড়ে গেছে আমার ভালোবাসা, , কফিনে
বন্দী ভালোবাসা ।
কাধের উপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। কফির মগ
হাতে দাড়িয়ে আছে অনু। আমার মুখের দিকে কয়েক
সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। তারপর ধপ করে পাশে বসে
পড়লো।
এখন আমার হাতে ওর হাতটা ধরা। কারো মুখেই কোন কথা
নেই, দুজনেই চুপচাপ জোছনা দেখছি আর একে অপরকে
অনুভব করছি।
হঠাতই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো ও,
.
“- বাবুসাহেবের মন কি খুব খারাপ?
– না, এখন আর এত সহজে আমার মন খারাপ হয় না।
– তাই বুঝি! তাহলে এমন উদাস হয়ে জোছনা দেখছেন যে,
আপনার গিটার কই?
– আমার গিটারে আর সুর আসে না অনু, আঙুলগুলো অনেক
বেঈমান হয়ে গেছে
ইদানীং।আমার হাতে আর সুর আসেনা অনু, আমার সব সুর
এখন পরিণত হয়েছে
অসুরে।
-তাই। আচ্ছা বাবুসাহেব, আপনি কেন এমন বলেন তো! এত
কেয়ারলেস হলে কি জীবন চলে।
-জীবন ওটা তো কবে থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। যেদিন
তোমাকে সবাই ওখানটায় শুইয়ে দিচ্ছিল, আমার জীবনের
তো তখনই পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে।
আমি মৃত হয়ে গেছি তখন থেকেই। শুধু যা অবশিষ্ট আছে
আমার আবরণ টা। অর্ধমৃত আমার আবরণ।
জানো অনু, আমার না এখনো মনে হয় তুমি ফিরে আসবে।
ওই তারাদের দেশ ছেড়ে আবার তুমি ফিরে আসবে।
আমার গিটারে আবার উঠবে সুর। তোমায় গান শোনানো
হবে অথই সুমুদ্দুর।
-তাই বুঝি! আরে আমিতো সবসময়ই তোমার কাছেই আছি।
এই যে তোমার অনুভবে, আবেগে সবখানে মিশে আছি
আমি।
-তাই!
-হুম।

ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, আমার প্রখর
কল্পনাশক্তি আর আটকে রাখতে পারছে না ওকে। জানি
ও হারাবেই তাই আমার ব্যার্থ চেষ্টায় ক্ষান্ত দিলাম
এবার।
.
ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসা চাদটা একটা সময় মেঘের
আড়ালে ঢেকে গেলো। দুরের আকাশে তারার খসে পড়া,
কেউ একজন একবার আমায় বলেছিল, তারাদের খসে
পড়ার সময় নাকি স্রষ্টার কাছে যা চাওয়া হয় তাই
পাওয়া যায়।
.
কিন্তু আমার সব চাওয়া পাওয়ার খাতাটায় আজ যে
ধুলোর আস্তরণ জমেছে। সেটা নাহয় তাই বন্ধই রেখে
দিলাম।
.
একটা ছেড়া ডায়রির পাতায় জমাটবদ্ধ গল্পটায় গল্পটা
ঢাকা পড়ার আগে আরেকটা গল্প ছিলো।
আট বছরে তিলে তিলে গড়া একটা স্বপ্নের শহর ছিলো,
নির্জন একটা রাস্তা ছিলো, রাস্তাটায় উজ্জলতা
হারিয়ে ফেলা হলুদ বাতির ল্যাম্পপোস্ট ছিলো। সময়ে
বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয়ার একটা রোমান্টিক দৃশ্য
ছিলো।
.
আট বছরের একটা স্বপ্নময় সম্পর্কের পর, সম্পর্কটাকে
সফল একটা পরিণয় দেয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় ইতি
ঘটেছিল মাত্র কয়েকটা মিনিটেই। আইসিইউর বেডে
চোখগুলো বন্ধ করেই আমার কাছ থেকে স্বার্থপরের মত
চলে গিয়েছিল মেয়েটা!
.
আমি ভেবেছিলাম ও থাকবে আমার জন্যই ও বেচে
থাকবে, কিন্তু না! থাকেনি আমায় একা করে ওর স্মৃতি
নিয়েই সারাজীবন বেচে থাকার প্রতিজ্ঞা করিয়েই
চলে গিয়েছিল না ছুতে পারার সীমানায়।
.
তবে ওর চলে যাওয়ার সময় ওর চোখে জল ছিলো! হেরে
যাওয়ার একটা অব্যক্ত কষ্ট ছিলো! অনেকগুলো স্বপ্ন
ভাঙার যন্ত্রণা ছিলো। হেরে গিয়েছিলো ও। সাথে
হেরে গিয়েছিলাম আমিও। লিউকেমিয়া নামের
মরণঘাতী জল্লাদটা আমাদের দুজনকেই হারিয়ে জিতে
গিয়েছিল।
.
মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতো-দেখাতো মেয়েটা।
নীলচে প্রহরের খরতাপে ছেয়ে আসা ক্লান্তিতে আমায়
নিয়ে কাশের ফুল কুড়াতে যাওয়ার সে স্বপ্নটা পুর্ণতা
পায়নি কখনোই।
.
আমার এখনো মনে হয় এই বুঝি ও ফোন করবে, আবার
আমায় বলবে

-আচ্ছা তুমি কি এখনো খুব ভোরে ঊঠে সবুজ শাড়িপড়া
কোন নারীর সাথে হাটার স্বপ্ন দেখো?
-তোমার কি মনে হয়!
-না আমার কিছু মনে হয়না।সময় বদলেছে অনেকটা, তুমিও
বদলেছো।।। তাই বললাম আর কি!!!..
-হুম।আমি খোলস টা বদলেছি,তার প্রভাবে ভেতরটাও
কিছুটা বদলে গেছে।কিন্তু মনের ইচ্ছে গুলো পুষে
রেখেছি কোনো একজনের জন্য।
-তাই বুঝি!!! তো আমি কি কিছুটা জানতে পারি??
-জানতে চাও কেন বলোতো?
-জানতে চাই কারণ আমার ইচ্ছে হয়,খুব ভোরে ধুসর
কুয়াশায় সবুজ শাড়ি পড়া কোনো নারী হতে।
-পাহাড়ের ঝর্নার জলে ভিজে চুপচুপে হয়ে কারো ঘাড়ে
মাথা নোয়াতে ইচ্ছে হয় না?
-হুম্মম্মম্ম।খুউউউউউব হয়।স্বপ্নে দেখছিলাম কোন
একজনের হাত ধরে গাঢ় সবুজ বনের ভেতরে কোনো এক
খালের পাশ ধরে হেটে যাচ্ছি।
-সেই একজন কি আমি?
-তুমি কেন??দুজনের গড়া স্বপ্নের বৃত্তে এখন আমার
অংশটুকু ধুসর হয়ে গেছে।। নতুন করে স্বপ্ন দেখো।
-ধুসর কুয়াশার ভোরে প্রথম হাত ধরে ছিলে,,, সে স্মৃতি কি
করে আর ধুসর হবে বলো?হবে না বোকা মেয়ে।
-তাই!!!জানতাম না তো।
-তুমি কি করে জানবে!উকি দিয়েছো কখনো আমার মনের
ভেতরে?
-না দিলে কি করে বলেছিলাম “আমি তোমাকে ভীষন
ভালবাসি”???
– তাই ওটা তো একসময়ের ভাললাগার তাড়না ছিল,,,,,
-তাই! হতে পারে, তবে কি জানো তো আজো সেই
ভালোলাগার আবেশে জড়িয়েই বাচিয়ে রেখেছি
নিজেকে। মোহিত করে বাচিয়ে রেখেছি এতদিনের
পথচলা।
-তাই না! তোমার এটাকেও বুঝি জীবন বলে! বেচে
থাকাটাই বুঝি জীবন! বলেই হাসতে শুরু করলো ও..

হেসেই যাচ্ছে মেয়েটা ধীরে ধীরে ওর হাসিতে স্পষ্ট
হচ্ছে দুরের আকাশের লালচে আভা,
প্রস্ফুটিত হচ্ছে আরেকটা নতুন প্রহরের।
.
হঠাতই আবার ঘাসে ছেয়ে যাওয়া কবরটায় চোখ পড়লো
আমার,,,,,
যেখানে আমার বন্দী হয়ে আছে আমার ভালোবাসা,
আমার কফিনে বন্দী ভালোবাসা।।।।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত