আজ রিয়াজকে দেখতে তার অফিসে কিছু লোক আসবে। সেখানে মেয়ের বাবা, ভাইও থাকবেন।
রিয়াজ প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলোনা, অফিসে কিভাবে দেখাদেখি সম্ভব!
সে শুনেই বিরক্ত, কলিগরা কি ভাব্বেন! তাছাড়া বেশ কয়েকদিন এই নিয়ে অফিস সরগরম থাকবে। তার কাছে এসে জানতে চায়বে,
সুসংবাদ কবে, মেয়ের ঘর কোথায়, কি করে, কি পড়ে, বিয়ের দাওয়াত কবে পাবো ইত্যাদি ইত্যাদি। অ মাই গড অফিসে দেখাদেখি অসম্ভব!
কিন্তু মা তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েই ছেড়েছেন।
পাত্রিপক্ষ এই সুযোগে ছেলের অফিস, অফিসে তার অবস্থান, খুঁটিনাটি সব দেখে নিশ্চিত হতে চান। তাদের মেয়ের সারাজীবনের প্রশ্ন বলে কথা! সেরাটাই তো বেছে নিতে হবে, তাই না?
যথাসময়ে তারা পৌঁছেন, খানিকক্ষণ কথাবার্তা চলে। অফিস সম্পর্কিত প্রশ্নতো আছেই। কোন পদে কতো বেতন, মধ্যবয়সী একজন বেশি চালাকি করে অভদ্রের মতো তাও জেনে নিলেন! সে কতো সালে এস এস সি, এইচ এস সি, কোন ভার্সিটি থেকে অনার্স, এম বি এ, এতোদিন চাকরি করেনি কেনো, এতো এতো জিজ্ঞাসা…
কিছু করার নেই, দিতেই হলো সব জবাব। তারপর শুরু হয় রাজনীতি বিষয়ক কিছু প্রশ্ন। বিয়ের সাথে রাজনৈতিক প্রশ্ন কেনো আসে তা কিছুতেই রিয়াজের বোধগম্য হয়না!
সে তার ভাবনাটাই জানায়। কোনো নির্দিষ্ট দল নিয়ে কিছুই বলেনা। তাতে মনে হয়, হবু শ্বশুর খুব বেশি খুশি হতে পারেননি। তার মতে, বি এন পি ছাড়া দেশে আর কোনো দল নেই, অন্য সব বোগাস!
রিয়াজের ইন্টার্ভিউ চলছে, এই পরীক্ষাতেও পাশ করতেই হবে। তাই সব অত্যাচার সে মাথা পেতে নিয়েছে। ছবি দেখেই রিয়াজের মায়ের মেয়ে পছন্দ। ছবি দেখেই তার মনে হয়েছে, মেয়ে খুব শান্ত, লক্ষি, নরম স্বভাব হবে, তবে বুদ্ধিমতীও!
রিয়াজ জানতে চায়,
মা, বুদ্ধিমতী তা কিভাবে বুঝলে?
আহা, বুদ্ধিমতী না হলে কি অনার্স পর্যন্ত যেতে পারতো!
আজিব জবাব! বোকা হলে কি অনার্স পড়তে পারেনা! রিয়াজ কিছু বলেনা মাকে। তার মেয়ে পছন্দ এটাই বড় কথা।
মেয়ে দেখতে চাওয়ায়, ওরা আগে ছেলে পছন্দ করবে জানিয়েছে।
পছন্দ হলে স্বাগত, নইলে ছবি দেখেছো, এই বেশি!
এই চাকরিটা রিয়াজের প্লাসপয়েন্ট। একবছর আগে পর্যন্ত টিউশনি করে চলতে হয়েছে, বড় কষ্টের দিন ছিলো, তা।
কেউ পড়ালেখার কথা জানতে চাওয়ার পর, কি করছ আজকাল? তার উত্তরে এতো পড়ে টিউশনি করছি…সে জবাবটা দেয়া বহুত কঠিন কাজ ছিলো রিয়াজের কাছে।
হ্যাঁ, সে দুইটি টিউশনি এখনো ছাড়তে পারেনি, এরপরেও এখন তা গর্বের বিষয়। চাকরি করছে, সাথে টিউশনিও, বাহ, খুব ভালোতো, ছেলে বড় করিৎকর্মা!
মেয়েপক্ষ চা নাস্তা খেয়ে বিদায় নিলো। ওরা যেতেই রিয়াজ লম্বা একটা শ্বাস নেয়, এতোক্ষণ সে দম বন্ধ করেই ছিলো মনে হয়। খুব নার্ভাস ছিলো, ফটাফট প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো শুধু।
মেয়ে পক্ষ থেকে পজেটিভ জবাব আসে। ছেলে তাদের পছন্দ হয়েছে, ভদ্রছেলে, দেখতেও খারাপ না, চাকরিও মোটামুটি ভালোই।
মেয়ের পরিবারে, ছেলের চাকরি যতোই ভালো হোক, তা মনে হয়, মোটামুটিই হয়! মাত্র একবছর চাকরির বয়স, পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বেতন, খারাপ কি! দুই এক বছর গেলেইতো পঞ্চাশ হাজারের ঘর ছুঁবে।
কন্যাপক্ষ থেকে খবর আসে, তারা আগামী পরশু মেয়ে দেখাবে, তার আগে, পাত্রের ঘরে গিয়ে একটু চা খেয়ে আসবে। ছেলের মা-বাবার সাথে পরিচিত হতে চান, মেয়ের মামা। তিনি নাকি আগামী সুপ্তাহেই দেশের বাইরে চলে যাবেন, তাই।
অর্থাৎ, অফিসের পর, ঘর দেখার পালা। রিয়াজ এবার রেগে উঠতে চায়, মা এবারো তাদের পক্ষ নেন।
শোন, তোর বোনের বিয়েতেও তো এমনভাবেই খোঁজ নিতে হবে আমাদের, তাইনা? তারাও তো দেখবে, জানতে চাইবে, মেয়েকে কোথায় দিচ্ছেন। তুই চুপ করে থাক, এসব আমরাই সামলাবো।
কি আর করা, মা-বাবা যখন কিছু মনে করছেনা, সে আর কি বলবে..।
তবে রিয়াজ সেদিন বিকেলে আর বাসায় ফিরেনা, রাস্তায় হাঁটতে থাকে, কফি শপে গিয়ে কফি পান করে।
যথাসময়ে তারা রিয়াজদের বাসায় কিছু নাস্তাপানি নিয়ে আসেন। রিয়াজদের একতলা ঘর, চারখানা বেডরুম, ডাইনিং ড্রয়িংরুম, কিচেন সব আলাদা। দুই বেডরুমে এটাচড বাথরুম, আরেকটি কমন বাথরুম।
রিয়াজের বাবার সাথে ঘুরেফিরে ঘর দেখেন মামা আর সাথে আসা ভাগ্নে, মেয়ের ছোটভাই।
ঘর পছন্দ হয়েছে, তাও খুব বেশি না। আরেকটা বেডরুম বা গেস্টরুম যে খুব দরকার, তা মামা সাহেব বারবার মনে করিয়ে দিলেন। অতিথি আসলে কোথায় থাকবেন, এই নিয়ে উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো!
শেষে তিনি বুদ্ধি দিলেন, শিগগির দুইতলা তৈরির কাজ ধরা উচিত।
আর এতোক্ষণ পর্যন্ত রিয়াজ বাসায় ফিরছেনা কেনো, তার কাজ তো বিকেল পাঁচটায় শেষ, তা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করলেন খানিকক্ষণ। এই বয়সী ছেলেদের ঘরের প্রতি টান থাকা খুব জরুরি!
কে তাকে জানাবে, তার ভয়েই রিয়াজ এতোটা সময় বাইরে!
উনারা চা নাস্তা খেয়ে বিদায় নিয়েছেন, এই খবর ফোনে পেয়ে রিয়াজ বাসায় আসে।
পরদিন মেয়ে দেখতে যাবে সবাই, মেয়ের ঘরেই দেখবে, রিয়াজরাও শর্ত দেয়। সেটা ইচ্ছে করে রিয়াজ আর তার ছোটবোন রিনি প্রস্তাব রাখে। ঐ পক্ষ থেকে রেস্টুরেন্টে দেখাবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাই।
“ভাইয়্যা, মেয়ে আমরা বাড়িতেই দেখবো, কি বলো? আমাদের সবকিছু দেখলো, আমরা দেখবো না?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই, অনেক জ্বালিয়েছে আমাদের। এবার আমাদের পালা, হাহাহা। মা, তুমি জানিয়ে দাও।”
রিয়াজের মা, রাহেলা বেগম, স্বামী আমজাদকে তাদের তা জানাতে বলেন।
উনারাও খবর দেন, তাহলে, কাল নয়, আরো একদিন পর, পরশু মেয়ে দেখাবে।
রিনি বলে,
“আমাদের জন্য নাস্তা বানাবার জন্য আর মেয়েকে পার্লার থেকে সাজিয়েও আনবে দেখো হিহিহি।
মা, ভাইয়্যা, মিষ্টি জিনিষ কিছু খেওনা তোমরা।”
“কেনো, কেনো?” রিয়াজ জানতে চায়।
“আমার বান্ধবী বলেছে, তার ভাইয়ের বউ দেখতে গিয়েছে, ওখানে নাকি খাবারের সাথে চিনি পড়া মিক্সড করেছে, তাই সবাই মেয়ে পছন্দ করে এসেছে। মেয়ে নাকি একদম সুন্দর না, তবুও। আর এই নিয়ে তাদের সংসারে নাকি এখন অনেক অশান্তি।”
“ধুর, কি যা তা বলিস, যার সাথে যার জোড়া সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বিয়ে হবেই। চিনি পড়া, পানি পড়া সব ফালতু কথা। হয়তো, তোর বান্ধবীর পরিবার ঠিকমতো যৌতুক পায়নি, তাই মেয়ে অসুন্দর হয়ে গেছে এখন।”
“আজকাল এসব পড়ানো জিনিষ খাবার কথা তো শুনা যায়না। আমাদের সময় খুব শুনতাম। চিরুনি পড়া ব্যবহার করলে, তাবিজ দিলে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। চিনি পড়া খাওয়ালে পছন্দ করে।”
রাহেলা বলেন।
“আম্মু, তুমি ব্যবহার করেছো?”
“নারে, তোর নানা এসব বিশ্বাস করতেননা। মা একবার কারো কাছে শুনে, বাবাকে বলতে এসে ঝাড়ি খেয়েছে খুব। বাবাও রিয়াজের মতো করে বলতেন, যার জোড়া যেখানে, সে কোটি মাইল দূরে থাকলেও খুঁজে ঠিকই চলে আসবে, গলায় তাবিজ না ঝুলালেও আসবে। তখন সুন্দর অসুন্দর বাছ বিচারও করবেনা।”
“কি জানি, সেফু তো তাই বললো!” মন খারাপ করে বলে রিনি।
রিয়াজের রাতে ভালো ঘুম হয়না। পরদিন মেয়ে দেখতে যাবে, খুব অসস্তি লাগছে। না জানি, ঐ মেয়ের কি অবস্থা! সেও নিশ্চয় নার্ভাস! সেও তো ইন্টার্ভিউতেই বসবে তার মতো!
নাহ, রিয়াজ অতো জটিল করবেনা এসব, রিনিকেও বারণ করতে হবে। সোজাসুজি দুই একটা কথা বলবে।
এখন থেকেই বেচারি মেয়েটার জন্য রিয়াজের মনে কোমল একটা জায়গা তৈরি হয়েছে!
সায়মা মোটেও চিন্তিত নয়, তবে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত এবং রেগেও আছে আব্বু আম্মু’র উপর।
আব্বু’র মাথার ভেতর ঢুকে গেছে, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেননা। তার বিশাল রোগ হয়েছে, আর তা হলো, ডায়াবেটিস!
ডায়াবেটিস কি একটা অসুখ হলো!? প্রতি ঘরে একজনেরও বেশি মানুষের এই রোগ আছে। একটু খাবার দাবার কন্ট্রোল করলে, হাঁটা চলা করলে এটা কিছুই নয়। কিন্তু তা না ভেবে, তিনি ডায়াবেটিস এর পরবর্তী কিডনি অসুখ, তারপর ক্যান্সার সব নিজে নিজে ভেবে এখনই আধমরা। আশ্চর্য!!
তাই ঘাটের মরা, শব্দটা কি ঠিক আছে? রাগে ওর সঠিক শব্দ কি হবে তা মাথায় আসছেনা। তো ঘাটের মরা বা যাই হোক সায়মাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। বোঝা হালকা হবার জন্য, দায়িত্ব পালন করতে চান। মৃত্যুর পর দামি একখানা বেহেশত পাবার লোভে সায়মাকে নরকে নিক্ষেপ করতে তার একটুও বুক কাঁপছেনা বাপ হয়েও।
বিয়ে মানে নরকই তো। তার বান্ধবী মায়মুনা’র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হতেই দুই বছর আগে বিয়ে হলো, শ্বশুরঘর থেকে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে দেবে কথা দিয়েও কি করিয়েছে!? উল্টো বছর না ঘুরতেই এক বেবি’র মা হয়ে যায় সে। মায়মুনা বেবি চায়নি, পড়তে চেয়েছে বলেই বেবি উপহার দিয়েছে!
কি হারামী তারা!
আব্বু আম্মু তো সব জানে। মায়মুনা কাঁদতে কাঁদতে আম্মু’র সামনেই তো বলেছিলো সব!
এরপরেও কিভাবে তার বিয়ের কথা ভাবছেন, তারা! সায়মা’র বয়স হয়ে যাচ্ছে, এমন হলেও কথা ছিলো, মাত্র কুড়ি বছর হলো।
অবশ্য, সমস্যা নেই, সায়মা কিছু ভেবে রেখেছে। সে বিয়ে ভেঙে দেবে। গাধা মার্কা এক পাত্রকে নাকি আব্বু’র পছন্দ হয়েছে। ঐটা আবার কাল সায়মাকে দেখতে আসবে। ঐ বেটাকে বিয়ের স্বাদ মিটিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করতে হবে। অনেক চিন্তা ভাবনার ব্যাপার, সারারাত এই নিয়ে ভাবতে হবে! বড়ই বিরক্তিকর কাজ!
রিয়াজ খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, কি রংয়ের শার্ট পরা যায়। বোনকে জিজ্ঞেস করেছে। সে হাসতে হাসতে বলে গেছে,
“শুধু লাল পরোনা, পাত্রী যদি রাগী হয়, লাল দেখলে ষাঁড়ের মতো শিঙ বাড়িয়ে পেট ফুটো করে দিতে আসবে, হিহিহি।”
ধুর, মেয়েটা কোনো কাজের না। রিয়াজ যাই পরুক তাকে চমৎকার লাগবে কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। শেষে চার পাঁচটা শার্ট এর ইস্ত্রি ভাঙিয়ে চকলেট রংয়ের একটা শার্ট বেছে নিয়ে পরে। এটাও তাকে বেশ ভালোই মানিয়েছে।
গায়ে একটু পারফিউম দেয়।
বোন এসে আবার বলে,
“ভাইয়্যা, পাঞ্জাবি পরে গেলে ভালো হতো।”
“কেনো!”
“বিয়ে পড়িয়ে একেবারে বউ নিয়ে চলে আসতাম, হিহিহি।”
!হিহি থামা। শোন, এমন কোনো প্রশ্ন করবিনা,, যা জবাব দেয়া কষ্টকর হয় তার জন্য, বুঝলি?”
“কি! বিয়ে না করতেই এতো দরদ…
আম্মু, তোমার ছেলে কি বলে শুনে যাও।”
“চুপ করতো। দুইদিন পর তোকে কেউ প্রশ্ন করে নার্ভাস করে দিলে, তোর কেমন লাগবে, ভাবতো রিনি।”
“হুম, আচ্ছা যাও, তোমার বউকে বিরক্ত করবোনা, খুশি?”
“বউ! কি বলিস! মাত্র প্রথম একটি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। শুনেছি, কেউ একশো পাত্রী দেখেও পছন্দ করতে পারেনা, আর তুই আমাকে একটাতেই বিয়ে করিয়ে দিচ্ছিস!”
“তার প্রতি তোমার এতো টান, আগ্রহ দেখেই না বললাম। আর তাতে কি, আমরা করবো জয়, আমরা করবো রেকর্ড…”
“যা ভাগ!”
মেয়ে ছবির মতোই সুন্দরী। গায়ের উজ্জ্বল শ্যাম রঙটাই যেন এই মেয়েকে মানায়, ফরসা হলে মানাতোনা। তবে মায়ের কল্পনার, শান্ত শিষ্ট, লক্ষি মেয়ে মোটেও মনে হচ্ছেনা। যথেষ্ট চটপটে দেখাচ্ছে। মুরুব্বিরা যখন বললেন, এদের ছাদে কিছুক্ষণ গল্প করতে পাঠাও। মেয়ে এক লাফে উঠে, বলে,
“ছাদে চলুন!”
মেয়েটা রিয়াজকে এমনভাবে অর্ডার করলো, সেতো পুরাই হতবাক!
হঠাৎ, বোনের ঐ কথাটি মনে পড়ে হাসিও পেলো তার, লাল জামা পরে আসলে নির্ঘাত শিঙ ফুঁড়িয়ে দিতো!
ছাদে গেলো তারা, লজ্জা সায়মা নয়, রিয়াজই পাচ্ছে। ভাবছে, কি বলে কথা শুরু করবে।
ভাবার আগেই মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“ছাদটা খুব সুন্দর!”
“এখানে সুন্দরের কি দেখলেন!”
“সুন্দর না?”
“অবশ্যই না। একটা ফুলের টব আছে নাকি পরিষ্কার ঝকঝকে… কোনটাই তো নয়!”
“অ আচ্ছা।
আমাকে মনে হয় আপনার পছন্দ হয়নি, তাই না?”
“বিয়ে করলেই না পছন্দ করার প্রশ্ন আসে। আমি তো আপনাকে বিয়ে করছিনা।”
“কেনো! আপনার পছন্দের কেউ কি আছেন?”
“পছন্দের কেউ থাকতে হবে কেনো? আশ্চর্য, সেকেলে মেন্টালিটি নিয়ে বসে আছেন! আমি পড়ালেখা করবো, তাই বিয়ে করতে চাইনা।”
“সেটা আপনার পেরেন্টসকে বললেই তো হতো। আমাদের আর কষ্ট করে এখানে আসতে হতোনা।” রিয়াজ বলে।
“বলেছি, কাজ হয়নি। আব্বু’র ডায়াবেটিক তো, মারা যাবেন শিগগির, তাই আমাকে বিয়ে দিয়ে আজাব মুক্ত হতে চান।”
“তো, বিয়ে করুন, পড়ালেখা বিয়ের পরে করবেন।”
“এসব আজাইরা কথাবার্তা আমার সামনে বলবেন না। বিয়ের পরে, কেমন পড়তে দিবেন, আমার জানা আছে!”
“কেনো দেবোনা, আমি চাইবো, আমার বউ উচ্চশিক্ষিতা হোক।”
“হুম, জানি জানি, আমার বান্ধবী’র শ্বশুরঘর থেকেও পড়াবে বলেছিলো, পড়ায়নি।”
কথার মাঝখানে রিনি এসে পড়ে।
“ভাইয়্যা, কথা এখনো শেষ হয়নি? আর কিছু সারাজীবনের জন্য রাখো, হিহিহি।
আব্বু আম্মু ডাকছেন তোমাদের।”
সায়মা রিনি’র দিকে কটমটে চোখে চেয়ে নেমে পড়ে একসাথে।
রিয়াজ মা বাবাকে আড়ালে ডেকে চার পাঁচমিনিট কথা বলে।
তারপর সবাই হাসিমুখে বসারঘরে আসে।
রিয়াজের বাবা কথা তুলেন,
“মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে, রিয়াজেরও। তবে একটা কথা বলতে চায়, যদি কিছু মনে না করেন।”
সায়মা’র আব্বু চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকেন এবং যৌতুক সংক্রান্ত কিছু হলে, কি কি গালি দেয়া যায় তা মনে মনে ভেবে মুখে বলেন,
“জ্বি, বলুন।”
ঐদিকে সায়মা রাগে পরবর্তী কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছে। তার কান দিয়ে গরম গরম ধোয়া বের হচ্ছে, কপালের রগ দপদপ করছে।
“আমাদের ছেলে আপনাদের পছন্দ হয়েছে তো?”
“হুম, না হলে কি আপনারা এখানে আসতেন আজ?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তা, আমরা আপনাদের সুবিধামতো এনগেইজমেন্ট আর আকদের ব্যবস্থা করতে চাই। তবে…”
“তবে আবার কি!”
“মেয়ের পড়ালেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা মেয়ে ঘরে তুলতে চায়না, এতে মেয়ের পড়ালেখার অসুবিধা হতে পারে। ততোদিন পর্যন্ত মেয়ের সব খরচাদি আমরা দিবো। মেয়ে আরো কিছুদিন আপনাদের সাথে থাকলো, আরেকটু ম্যাচিউরড হলো, কি বলেন…”
“এতো খুব ভালো প্রস্তাব!”
“হ্যাঁ, ছেলেমেয়েও দুইজন দুইজনকে সংসার শুরু করার আগে চিনুক, জানুক, আসা যাওয়া করুক, কি বলেন?”
“জ্বি জ্বি, খুব ভালো কথা।”
সায়মা’র আব্বু খুশিতে আটখানা হয়ে যান। একটু আগে মনে মনে গালি দেবার জন্য আফসোস করে তওবা কাটেন। সায়মাকে তো জোর করেই বিয়েতে রাজি করাচ্ছিলেন তিনি, মাথায় মৃত্যুভয় ঢুকে গেছে, তাই। নইলে কলিজার টুকরো মেয়েকে কে এতো জলদি বিয়ে দিতে চায়!
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো মানুষ কিছু পৃথিবীতে এখনো আছে!
সায়মা বুঝতে পারছেনা, খুশি হবে নাকি নাখোশ! বিয়ের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত নয়। তবে এটাতো ঠিক বিয়ে নয়, নিজের ঘরেই থাকবে সে। সংসার করতে হবেনা। ছেলেও খারাপ না। দেখতে শুনতে বা ভদ্রতায়, আচার আচরণ সব ঠিকঠাক।
এখন? সে না চাইলেও তাই হবে, আব্বু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন।
অনেকটা বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ, গমগম অতিথি, সুন্দরভাবেই এনগেইজমেন্ট আকদ একসাথেই হয়। ক্লাবে অনুষ্ঠানের পর যে যার বাসায়।
রিয়াজের মন পড়ে আছে সায়মা’র কাছে আর আকদের পর সায়মা’র মনটাও একেবারে তুলো’র মতো নরম হয়ে ভাসতে থাকে। রাত হতেই সে চায়, রিয়াজ তাকে ফোন করুক। আর রিয়াজের কেমন অভিমান হয়, করবে কি করবেনা, করলে সায়মা কি রাগ করবে…এত্তো ভেবে সে কল দিয়েই দেয়!
“হ্যালো সায়মা, বিজি?”
“এতোক্ষণ পর ফোন করলে কেনো? কখন থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি!”
“বারে, আমি কি জানতাম! আমি তো ভয়ে ভয়ে কল দিলাম, তুমি না আবার রাগ করে বসো।”
“হুম, আমাকে তোমার রাগি মনে হয় তাহলে, না?
এদিকে সবাই বলাবলি করছে, বর আসেনি কেনো? আমি লজ্জায় মরছি।”
“কোথায় আসিনি?”
“আমাদের বাসায়।”
“হাহাহা, আমার বন্ধুরাও বলছিলো, যাইনি কেনো! কি লজ্জা’র কথা, তাইনা?”
“হুম।”
“চলো, কাল কোথাও দেখা করি।”
“কাল নয়, আজ।”
“আজ!”
“হুম, আমরা এখন লুকিয়ে প্রেম করবো।”
“আজ নয়, অনেক রাত হয়ে গেছে, রাতে বের হওয়া নিরাপদ নয়, আবার শ্বশুরঘর দেখার আগেই বিধবা হয়ে যাবে।”
“পঁচা কথা একদম বলবেনা।
ঠিক আছে, কাল দেখা হবে। শুভ রাত্রি।”
পরদিন দেখা হয়, কাঁপাকাঁপা হাতে দু’জনের হাত ধরাধরিও হয়। এতো ভালো লাগছিলো তাদের। কি সুন্দর অনুভূতি! বৈধ ছোঁয়া অথচ এরপরেও লজ্জা, লুকোচুরি!
এভাবে দুইমাস যায়। সায়মা’র পড়ালেখা’র চাইতেও রিয়াজের ফোনের, তার সাথে দেখা করার প্রতি আগ্রহই বেশি আজকাল। রিয়াজ ওকে কোচিং এ ভর্তি করে দেয়। পড়ায় মনোযোগী হতে উৎসাহ দেয়। কখনো তাদের ঘরে এসে সায়মাকে নিয়ে ছাদে আড্ডা দেয়। লজ্জা সংকোচ একটু কমেছে আগেরচেয়ে। সায়মাও মাঝেমধ্যে দুই তিন ঘণ্টা শ্বশুরঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। রিনি’র সাথে দারুণ বন্ধুত্ব তার। শ্বাশুড়িও তাকে কন্যা ভাবেন।
৩য় মাসে, সায়মা তার আব্বু আম্মুকে বলে,
“আমি শ্বশুরঘর চলে যাবো”
“কেনো? রিয়াজ কি তোকে জোর করছে, বাধ্য করছে?”
“না আব্বু, তা হবে কেনো!
আমার এখানে আর ভালো লাগছেনা। একদিন তো যেতেই হবে, তাইনা? ওদের সাথে কথা বলো।”
! আর পড়ালেখা?”
“ওখানে করবো।”
“ঠিক তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই ঠিক।”
আবার বিয়ের আয়োজন। তারপর?
তারপর আর কি, তারা হাসিখুশি সুন্দর জীবন পার করছে😊।
ইশশ, সবার জীবন যদি এমন হতো!!