সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, এই প্রবাদটার একটা ব্যাখ্যা করে গেছে আমার একটা হাতুড়ে দাদু। ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, কোনো ছেলে যদি বিয়ে করার জন্য লাফালাফি করে তাহলে বুঝে নিতে হবে তাকে ভূতে কিলাচ্ছে। তার সুখে থাকার দিন শেষ। আবার, কোনো মেয়ে যদি বিয়ে করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে কোনো ছেলেকে কিলানোর শখ উঠেছে তার। তো, আমার জন্য মোরাল অফ দিস ব্যাখ্যা হলো, মেয়েদের থেকে যতদিন দূরে আছি, ততদিন সুখে আছি। সেই হিসেবে চিন্তা করে নিয়েছিলাম বিয়ে-শাদি এতো তাড়াতাড়ি করছি না। বয়স ২৫ পার হয়ে গেলেও প্রেম পিরিতি থেকে নিরাপদ দূরত্ব অবলম্বন করে চলেছি।
কিন্তু কিছুদিন থেকে আমার সুখে থাকার দিন কমতে শুরু করেছে।
আমাদের পাড়ায় একটা মেয়ে আছে, নূপুর। বয়স পনেরো বছর। বেশ কিছুদিন থেকে নূপুর যখনি আমাকে দেখে, মুচকি মুচকি হাসে। আমি ভেবেছিলাম, এমনি হয়ত হাসে। কিন্তু কিছুদিন আগে আমার এই ধারণা পাল্টে গেছে।
আমি একদিন রাস্তার পাশের বটগাছটার নিচে বসে আছি। স্কুল থেকে ছেলে মেয়েরা বাড়ি ফিরছে। তাদের সাথে নূপুরও আছে।
নূপুর সবাইকে চলে যেতে বলে আমার সামনে এসে বলল, আবির, কেমন আছো?
নূপুরের মুখে এই কথা শুনে একটু ধমক দিয়ে বললাম,
এই, তোর বড় ভাই আমাকে ‘আপনি’ করে ভাইয়া বলে ডাকে। আর তুই পিচ্চি একটা মেয়ে আমাকে তুমি করে বলছিস, তাও আবার আমার নাম ধরে!
বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?
-হুম, বরের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় আমি খুব ভালোভাবেই জানি।
-তোর বর কে?
-তুমিই আমার বর, আমিতো তোমাকেই বিয়ে করব।
-আমাকে বিয়ে করবি মানে? তুই বিয়ে শাদির কি বুঝিস? আর তোর মত একটা পিচ্চিকে আমি বিয়ে করব?
-দেখো, বেশি ভাব নিবা না। আমার পিছে এমনিতেই অনেকে সিরিয়াল নিয়ে আছে। চাইলে এখনি পাঁচ সাতটা প্রেম করতে পারব। তোমাকে অনেকদিন থেকে বলতে চেয়েও বলা হয়নি।
-তুই প্রেম পিরিতিও বুঝিস!
-হুম, আমি সব বুঝি। আচ্ছা শোনো, কাল থেকে প্রতিদিন দুপুর বেলা ঠিক এই সময় এখানে এসে বসে থাকবা। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে তুমি আমার হাসি মুখটা দেখবা, আর আমি তোমার খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখটা দেখব। এভাবে প্রেম বাড়বে। বুঝছো? হি হি হি..।
নূপুর হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুকে থু থু দিয়ে স্বস্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি।
সেদিন আমি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, হয়ত দুষ্টামি করছে।
পরেরদিন দুপুর বেলা আমি শুয়ে আছি। হঠাত নূপুরের আওয়াজ আসলো ‘কই গো, তোমাকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে বলেছিলাম, বসে ছিলে না কেন?
আমি বেরিয়ে এসে বলি, তুই আমার বাসায় কেনো এসেছিস? আর তুই কে যে তোর কথায় আমি বসে থাকবো?
-দেখো তুমি যদি কাল থেকে বসে না থাকো, তাহলে আমি সবাইকে বলে দিব তুমি আমার সাথে ইয়ে ইয়ে করেছ।
-ইয়ে ইয়ে মানে?
-ইয়ে ইয়ে মানে ইয়ে ইয়ে। কাল থেকে ওখানে বসে না থাকলে বুঝবা ইয়ে ইয়ে মানে কি। একথা বলেই নূপুর চলে গেল। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলাম বাসায় ভাবি নাই। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাবী থাকলে এতক্ষণ ঝড় শুরু হয়ে যেত।
আমরা দুই ভাই। বড় ভাই বিয়ে করেছে বছর দুয়েক হলো। ভাইয়ার বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা মা একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। এরপর ভাইয়া শুধুমাত্র নামের মালিক, কিন্তু আসল মালিক হয়ে গেছে বড় ভাবী। বড় ভাবীর নাম নার্গিস। তার নামের সাথে কাজের অসাধারন মিল আছে। রেগে গেলে একদম নার্গিস ঝড়ের মত শুরু হয়ে যাবে। যা বলবে তাই। ভাইয়ার মুখ খুলে কিছু বলার সাহস নাই। পাড়ার মানুষজনও সাহস করে কিছু বলতে পারে না।
এদিকে, ভাবি আবার ঠিক করে রেখেছে তার ছোট বোনের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দুই বোন আমাদের দুই ভাইয়ের উপর রাজত্ব করবে। সেই হিসেবে ভাবির কড়া আদেশ, কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, কারো দিকে যেন ঘুরেও না তাকাই।
পরের দিন দুপুর বেলা আমি শুয়ে আছি। বাসায় ভাবি আছে দেখে আমি মোটামুটি নিশ্চিত, নুপুর আজকে বাসায় আসবে না। সত্যি সত্যি নুপুর বাসায় আসেনি। একটা লম্বা ঘুম দিয়ে বিকেলে উঠে পাড়ার মোড়ে যেতেই একজন বলল, কিরে তুই নাকি নূপুরকে যাদু করেছিস? পাড়ার অনেকেই বলাবলি করছে। নুপুর শুধু তোকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।
এই কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বুঝে গেলাম এই মেয়ে এত সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। এই মেয়ে ভুত সেজেছে, আর কিলানোর মানুষ হিসেবে আমাকে বাছাই করেছে। সুতরাং আমার আর রেহাই নাই। আমার সুখে থাকার দিন শেষ। এরপর থেকে আমি বাধ্য ছেলের মতো প্রতিদিন দুপুরে বটগাছ তলায় বসে থাকি।
নূপুর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় কোনদিন মুচকি হাসি দিয়ে দূর দিয়ে চলে যেত। কখনো কাছে এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দিত। কখনো কানের কাছে মুখ এনে বলত, বড্ড ভালোবাসি। এইসব কিছু বিরক্ত লাগলেও মনের মধ্যে এক ধরনের ভালোলাগা অনুভব করতে শুরু করি।
কিন্তু, মায়ায় পড়িনি। মনে মনে ভেবে রাখি, আরেকটু বড় হলে ওর এই পাগলামিগুলো কেটে যাবে। তখন এমনিতেই পিছু ছেড়ে দিবে। এখন কিছু বললে, আমার মানসম্মান কিছু রাখবে না।
একদিন দুপুর বেলা আমি বসে আছি। নূপুর স্কুল থেকে আসছে। তাকিয়ে দেখি নূপুর মুখ ভার করে আছে। আমার পাশে এসে বসে। আমি জিজ্ঞাসা করি,
কিরে আজকে মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?
– আজকে হাসতে ইচ্ছে করছে না।
– কেনো?
-বিকেল বেলা হাসব।
-বিকেলে হাসলে দুপুরে হাসা যাবে না, এমন কোন থিওরি আছে নাকি?
-উঁহু, এমন কোন থিওরি নাই। তবে একটা কারণ আছে।
– কি কারণ?
-আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। এ টাকা দিয়ে আজকে দুইটা আংটি কিনব। একটা তুমি আমাকে পরিয়ে দিবে, আরেকটা আমি তোমাকে পরিয়ে দিব।
-আমাদের কি এনগেইজমেন্ট নাকি?
-মোটামুটি সেরকমই।
আমি কিছুটা শান্ত হয়ে বসে বলি, দেখ নুপুর, তুই এখনো অনেক ছোট। তোর অনেক কিছু জানার বুঝার বাকি আছে। তাছাড়া তোর সাথে আমার বিয়ে হবে না। ভাবীর ছোট বোনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমি চাইলেও ভাবিকে না করতে পারবো না।
-অত কিছু বুঝি না। বিকেল ৪টায় এখানে চলে আসবা।
এটুকু বলেই উঠে চলে গেলো।
আমি বললাম, আমি আসবো না।
-না আসলে আমি তোমার বাড়ি যাব।
এই মেয়ে নাছোড়বান্দা। বিকেলে না আসলে নিশ্চিত বাড়ি চলে আসবে। আমি বুঝে উঠতে পারি না, আমার কি করা উচিত। বিকেলে যদি যাওয়া হয়, নুপুর সত্যিই আংটি কিনে হাতে পড়িয়ে দিবে। না গিয়েও উপায় নাই।
আমি বিকেল চার টায় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে উঠে দেখি সাড়ে চারটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হচ্ছি, এমন সময় নুপুরের গলা শুনতে পেলাম, কই গো? কোথায় তুমি? তোমার চারটায় আসার কথা ছিল, আসোনি কেন?
আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে দেখি ভাবী ভাইয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সামনে নুপুর। ভাবী চোখ বড় করে নুপুরের দিকে তাকিয়ে বলে, এই মেয়ে, আবিরের কি দরকার তোমার?
– আমার আবির কে নিয়ে একটু বাজারে যাব।
-তোমার আবির মানে?
– আমার আবির মানে আমার আবির।
ভাবি এবার আরো বেশি রেগে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে এই আবির, একধাপ যাবি না। গেলে তোকে পিটিয়ে সোজা করে ফেলব।
ভাবীর মুখে এই কথা শুনা মাত্র নূপুর কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলে, আপনি আমার আবিরকে বকা দিচ্ছেন কেনো?
-আবির আমার দেবর, আমার বকা দেওয়ার অধিকার আছে।
-আপনার দেবর কয়েকদিন পর আমার বর হবে। আমার বরকে আপনি কিছু বলবেন না। আপনি আপনারটাকে সামলান।
নূপুর আর ভাবির মধ্যে এক প্রকারের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভাবির সাথে এভাবে ঝগড়া করতে দেখে ইচ্ছে হচ্ছিলো, নূপুরকে একটা কষে থাপ্পড় মারি। কিন্তু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, উনি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মিটি মিটি হাসছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ভাইয়ার হাসার কারণটা চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না। তবে, ভাইয়া যেহেতু কিছু বলছে না, তাই আমিও ভাইয়ার মতো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে থাকলাম।
কিছুক্ষণ ঝগড়া চলার ভাবি যখন দেখল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন ভাবি নূপুরকে বলল, তুমি খুব পেকে গেছো। এখানে দাঁড়াও, আমি তোমার বাবাকে ডেকে আনছি। এই বলে ভাবি বেরিয়ে গেল নূপুরের বাবাকে ডাকতে।
ভাবিকে বের হতে দেখেই ভাইয়া আমার কাছে এসে বলল, তাড়াতাড়ি যা। দুজন মিলে ঘুরাঘুরি করবি।
-ভাইয়া, তুমি আমাকে যেতে বলছো? ভাবি জানলে তোমার কি হবে জানো?
-আরে গাধা শোন, নূপুরকে তুই যদি বিয়ে করিস, তাহলে নূপুরকে দিয়ে তোর ভাবিকে একটু টাইট দেওয়া যাবে। নাহলে দুই ভাইকে সারাজীবন গাধা সেজে থাকতে হবে।
ভাইয়ার এই কথা শুনে বুঝলাম তখন ভাইয়া হাসছিলো কেনো?
হঠাত নূপুর আমার হাত ধরে বলছে, চলো আমরা যাই। তোমার ভাবি কি বলবে আমি দেখব।
আমি যেতে চাইছি না, কিন্তু ভাইয়া আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো।
আমি আর নূপুর অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। পুরোটা সময় নূপুর আমার হাতটা ধরে রেখেছিলো খুব শক্ত করে। আমার বিরক্ত লাগেনি, বরং ভালো লেগেছে। কিন্তু, খুব অস্বস্তিবোধ করেছি। ভাবি আমার অনেক খেয়াল রাখে। সেই মানুষটার কথা অমান্য করা আমার উচিত নয়। তাছাড়া, নূপুর এখনো ছোট। ওর সাথে রিলেশন মানাবে না। কিন্তু, ছোট হলেও মেয়েটা আমাকে বড্ড ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই।
আমি নূপুরের সাথে হাঁটলেও চিন্তায় মগ্ন, কি করব? কোনটা করা উচিত হবে আমার?
নূপুর বারবার আমার দিকে তাকিয়ে আমার অস্বস্তি ভাবটা বুঝে ফেলেছে।
হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি আর নূপুর বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে। দুজনেই নিরব হয়ে বসে আছি। আমি নূপুরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি, মেয়েটা কিছু একটা বলবে। কিন্তু বলছে না। অপেক্ষা করাচ্ছে, অপেক্ষা করার একটা ভালো গুণ আছে, ‘আগ্রহ বাড়ে’। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে। আমি শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছি।
অপেক্ষার প্রহর ভেঙে বলে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
আমি তোমাকে খুব জালাই, তাই না?
-হুম, কিছুটা।
-তুমি কি খুব বেশি রাগ করো?
-না, আমি রাগ করি না।
-আমি জানি, তুমি বিরক্ত হও, রাগ করো। আমি তোমাকে খুব জ্বালাই, কারণ তোমাকে খুব ভালো লাগে আমার। খুব ভালোবাসি আমি।
তুমি কেনো বুঝতে চাওনা। এই যে এতক্ষণ থেকে হাঁটছি, তুমি আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলছ না। কেনো কথা বলছ না? আমি কি ভালো নই?
ও.., আমি ছোট, তাই না?
তো কি হয়েছে? ছোটরা ভালোবাসতে জানে না?
হয়ত বড়দের মতো পারি না, কিন্তু একদিন বড় হব তো। তখন বড়দের মতো বাসবো। আর, যদি তোমার এখনো মনে হয়, আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না, তাহলে চলে যাও, আর জ্বালাবো না। নূপুর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
অভিমানে নূপুরের চোখের কোণা টলমল করছে। এটা সহজ কোনো অভিমান নয়। এটার তীব্রতা ধারণাতীত।
কোনো নারীকে যখন তার প্রিয় পুরুষ বুঝতে চেষ্টা করে না, কিংবা চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না, তখন সেই নারীর মাঝে যে কষ্টটা আসে, সেটা অভিমানের রূপ নিয়ে আসে। এটা অহেতুক মনের সাথে কানাঘুষা করে কষ্ট বাড়াবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা নারীকে বুঝার ক্ষমতা কোনো পুরুষকে দেয়নি। তবুও নারীরা অভিমান করবে।
নারীর অভিমানী চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে পড়তে প্রত্যেকটা পুরুষ বাধ্য। আমিও তাকিয়ে আছি, প্রেমেও পড়ছি। একটু একটু করে অভিমানী চোখ দু’টোকে আমার চোখের খুব কাছে আনার ইচ্ছাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমি আস্তে করে হাতটা ধরে নূপুরের কানে কানে বলি,
আচ্ছা, তুই যদিও ছোট, বাট আজ থেকে তুমি করে বলব। চলবে?
নূপুরের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো হাসিতে পরিণত হয়। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে, কিছু একটা বলতে চাইছে…………।