— “আচ্ছা শামীম আমি কি দেখতে খুবই সুন্দরী?”
আমি পার্কে সোমার পাশে বসে দুটো শালিক পাখির প্রেম দেখছিলাম আর বাদাম খাচ্ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই শালিক পাখির সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। হটাৎ তার এরকম অদ্ভুত প্রশ্নে আমার বাদাম খাওয়ায় ধ্যান ছুটে যায়। আমি সোমাকে কিছুক্ষন খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি। তারপর তাকে বলি,”নাহ। সেরকম কোনো বৈশিষ্ট্য তো তোমার মাঝে খুজে পাওয়া যায়না। আচ্ছা হটাৎ তোমার এরকমটা মনে হবার কারন কি বলোতো?” সোমা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলে,”বেয়াদব ছেলে,তুমি যে আমাকে খুব সুক্ষ্মভাবে অপমান করলে সেটা আমি বুঝিনি ভেবেছ? আজ থেকে তোমাকে আর কোনোদিন ক্যান্টিনে খাওয়াবোনা।” আমি সোমার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি। তার এই রাগি রাগি চেহারাটা আমার খুব পছন্দ। এইসময় তাকে দেখতে একদম পুতুলের মতো লাগে। আমি মাথা ঝাকিয়ে সোমাকে বলি,”কথা ঠিক বলেছ। তোমার আমাকে খাওয়ানো অনুচিত। তবে তুমি না খাওয়ালে আমি বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবো। তাই তুমি আমাকে খাওয়াবে, কেমন।” কথাটা বলে আমি আবার পা দুলিয়ে বাদাম খাওয়ায় মনোযোগ দেই। সোমার রাগ চরম পর্যায়ে উঠে যায়। সে আমাকে ধাক্কা মেরে বেঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে। আমি পুর্বাপেক্ষা বেশি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই মেয়েটার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি তার প্রেমে পড়ে যাইনি তো! সোমা আমাকে হাত বাড়িয়ে উঠতে সাহায্য করে। তারপর বলে,”তুমি দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছ। এখন থেকে তুমি আরও বেশি করে খাবে কেমন।” আমি তারপর তাকে গত রাতে লেখা কবিতাটা পড়ে শোনাই। সোমা তার গভীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কবিতা শোনে। সোমা আমার কবিতাগুলো খুব বেশি পচ্ছন্দ করে। মাঝেমাঝে বলে আমার কবিতা শুনলে নাকি তার কেমন একটা হাহাকার অনুভব হয়। আমি তখন খুব লজ্জা পেয়ে যাই।
রবিবার ভার্সিটিতে আমি সোমার দেখা পেলামনা। আমার দুপুরের খাওয়া হয়নি এখোনো। পকেটে টাকাও নেই। সোমা না থাকায় বিরাট সমস্যায় পড়ে গেলাম। আমি সোমাকে কল দেই। সে কল কেটে দেয়। মাঝখানে রাফির সাথে দেখা হয়। সে আমাকে দেখেই বলে,”কিরে, সোমা তো আজকে নেই। তোর মন আর পেট দুটাই ক্ষুদার্থ বুঝলাম। মন তো ভরাতে পারবোনা,চল পেটটা ভরিয়ে দেই!” আমি লজ্জা পেয়ে বলি,”ধুর কি যে বলিশ।” এরপর সে আমাকে বড়সড় একটা ভুড়িভোজ করায়। ক্যন্টিন থেকে বের হয়ে রাফিকে আমি ধন্যবাদ জানাই। সে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে একটা ব্লাক সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ” ফইন্নি রাখ তোর ফর্মালিটিজ। নে বিড়ি খা।” আমি তার সিগারেট ফিরিয়ে দিয়ে বলি,” তুই ভালো করেই জানিস আমি সিগারেট খাবোনা। তারপরও আজকে নিয়ে গত চার বছরে তুই একশত তেইশবার এই চেষ্টা করেছিশ। আমি এবারও তোকে কোনো আশা দিতে পারলামনা। দুঃখিত। ওটা পকেটে রাখ।”
আমার রাফি নামের এই বন্ধুর জীবনের গল্পটা অন্যরকম। ১৯৯০ সালের একটি কাকডাকা ভোরে রাফিকে তার পালক পিতা কমলাপুরের আশেপাশের কোনো ডাস্টবিনের পাশে কুড়িয়ে পান। মাত্র দুইদিন বয়সের রাফিকে সেখানে একটি অল্পদামি চাদরে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তার পালক পিতা আফজাল সাহেব নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি রাফিকে নিজের বাসায় নিয়ে এসে তার স্ত্রিকে বলেন, “শায়লা, এই দেখো আমাদের ছেলেকে নিয়ে এসেছি।” এরপর থেকে রাফির পালক মা তাকে নিজের সন্তানের মতোই বড় করেছেন। একটি মুহুর্তের জন্যেও তাকে সত্যিকার মায়ের অভাব বুঝতে দেননি তিনি। সন্তানকে নিজের ভালোবাসার যতটা দেওয়া যায় তার সবটাই নিংড়িয়ে দিয়েছেন তার বাবা-মা। আফজাল সাহেব শহরের অনেক বড় ধন্যাঢ্য ব্যাক্তি। তার নিজের একটা পত্রিকা অফিস আছে। পাশাপাশি কনস্ট্রাকশনের ব্যাবসা। রাফিও তার পালক পিতা মাতাকেই নিজের বাবা-মা বলেই জানতো। রাফি ঠিক ততদিন তাদের সাথে খুশি ছিলো যতদিন না সে তার আসল পরিচয় জানতে পারে। রাফি যখন ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ে তখন আফজাল সাহেব খুব সাহস নিয়ে তাকে সত্যিটা জানান। ঠিক সেদিন থেকেই রাফি সিগারেট খায়। মাঝেমাঝে গভীর রাতে বাসা ছেড়ে হলে এসে আমাকে ডেকে বলে, “সব ফাকা ফাকা লাগে দোস্ত। মনেহয় সবাই আমাকে করুনা করে। আমার খুব ইচ্ছা জানিস আমার জন্মাদাতা মা কে কিছু প্রশ্ন করার। তাকে কোথায় পাই বলতো?” আমি রাফির পশ্চাতদেশে একটা লাথি মেরে বলি,” শোন রাফি,জীবনের গল্পগুলোতে আনন্দ কিংবা প্রাপ্তির অংকটা হয়তো খুবই ছোট হয়। কিন্তু এই ছোট্ট অংকের মাঝেও ভালোবাসার একটা মুল্যবান অংশ লুকিয়ে থাকে। আমাদের উচিত সেটুকুর জন্য হলেও ভালো থাকা। কেউ কেউ এই ছোট্ট অংশটুকু থেকেও বঞ্চিত। তুই কি তাদের চেয়ে ভাগ্যবান না? তুই বাসায় যা। একজন মায়ের ভালোবাসাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব কর।”
তিনদিন পরপর সোমার সাথে আমার কার্জন হলের সামনে দেখা হয়। আমি তাকে বলি,”তুমি কি ইদানিং কোনো কারনে আমাকে খুব অপছন্দ করছো? আমি কল করলে রিসিভ করোনা, মাঝে মাঝে কেটেও দাও। ভার্সিটি আসোনা কেন?” সে আমার চুল টেনে দিয়ে খুব খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলে, “ধুর সেরকম কিছু নয়। শোনো তুমি আমার খুব কাছের বন্ধু। তাই তোমার সাথে শেয়ার করছি, এক সপ্তাহ আগে আশফাক তুহিন নামের আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে তিনবছর আগে পাশ করা এক বড়ভাই আমাকে প্রোপজ করেছে। সে ভার্সিটির পুনর্মিলনি অনুষ্ঠানে এসে আমাকে দেখেছে। সে আমাকে অনেক চায় জানো। আমাকে বলেছে, “এই মেয়ে তুমি এত সুন্দরী কেন? যেন লজ্জাবতী লতা। তোমাকে দেখলেই দুর থেকে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করে। তুমি কি আমার কবিতা হবে?” তারপর থেকেই আমার কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে। সবসময় তাকে মনে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিনা কি করব। আমার কি করা উচিত বলোতো?”
আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। সোমাকে বলি,” তাহলে এ উপলক্ষে কবে খাওয়াচ্ছো?”
সোমা লজ্জায় লাল হয়ে বলে,”ধুর এখোনো তো প্রেমই শুরু করতে পারলামনা। আগে তো সবকিছু ঠিকঠাক হোক!”
সেদিন রাত দেড়টার দিকে আমি ফুটপাতে হাটতে বের হই। নিজের সাথে একটা বোঝাপড়া দরকার। আমার রাতের এই নিস্তব্ধ সময়টাকে খুব ভালোলাগে। নিজেকে খুব গভীর থেকে অনুভব করার জন্য এই সোডিয়ামের আলোই আদর্শ নিয়ামক। খুব ছোটবেলায় আমি একবার বাবার সাথে আমাদের গ্রামের উপজেলার মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। মেলায় গিয়ে পাঁচবছরের ছোট্ট আমি বেলুন দেখতে দেখতে বাবার কাছ থেকে হারিয়ে যাই। বাবা অনেক কষ্টে যখন আমাকে খুজে পান তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। আমি অবাক হয়ে আমার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি।আমার বাবাকে আমি খুব শক্ত মানুষ হিসেবেই চিনতাম। হটাত তার এমন রুপ আমার কাছে নতুন ছিলো। আমার মা আমার জন্মের সময়ই মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার আগে আমার বাবাকে খুব করে ওয়াদা করিয়েছিলেন যেন মা মারা যাওয়ার পর আমাকে বাবা দেখে রাখেন। আমার মা মারা যাওয়ার পর দাদু যখন বাবাকে আবার বিয়ে দিতে চাইতেন তখন আমার বাবা বলেন, “আব্বা সায়রা রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে আসি আপনার নাতির খোজ নেয়। আমার সাধ্যি কি তার এই ভালোবাসা উপেক্ষা করার?” আমার দাদু আর কিছু বলতেননা। তিনি আমার বাবাকে বুঝতেন। কিন্তু আমি আমার বাবার অনুভুতিগুলো বুঝতে পারতামনা, শুধু বুঝতাম আমার এই অর্ধশিক্ষিত বাবা আমার মা কে খুব ভালোবাসেন। আমার বন্ধুরা সবাই যখন সবার মায়ের কথা বলত তখন আমার খুব খারাপ লাগতো। আমি তখন প্রিয় ধরলা নদীর তীরে যেতাম। আমি যখন নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়তাম তখন আমার মনে হত যেন মায়ের কোলে উঠলাম। আমি নদীর তীরের শালিক পাখিগুলোকে নিজের কষ্টের কথা বলতাম। তখন কোথা থেকে বাবা এসে আমাকে কাধে নিয়ে বলত, “বাপজান তোর মন খারাপ? উত্তরপাড়ায় আইজকা বড় বড় মাছ উঠতিছে। চল আমরা বাপ ব্যাটায় ধরি আনি?” আমি মাছ ধরার কথা শুনেই ফিক করে হেসে দিতাম। আমার বাবা একমাত্র মাছ ধরা কাজটা পারতেন না আমি জানতাম। আমার মা ছিলোনা, কিন্তু আমাকে মায়ের মমতাগুলো আমার বাবা দিতেন। আমি যখন রাতে ঘুমানোর আগে বাবাকে প্রশ্ন করতাম, “আব্বা আমার আম্মা কোথায়?” আমি হারিকেনের আলোয় দেখতাম বাবার চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করে উঠত। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে আকাশের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতেন, ” তোর আম্মা ওইখানে বাজান। আমাক রাখি একলা চলি গ্যাছে।” তারপর বাবা আমাকে রাক্ষস খোক্কসের গল্প শোনান। আমি খুব শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরি। বাবা আমাকে বলেন,” শক্ত করি ধরি থাকিস বাজান। তুইও আমাক একলা করি যাসনে।”
প্রিয় পাঠক, আমি আমার বাবাকে কখোনোই একলা করে ছেড়ে যাইনি। তবে বাবার প্রতি আমার অনেক অভিযোগ, শেষমেষ তিনিই আমাকে ছেড়ে গেলেন।
পরেরদিন সোমা আমাকে দুপুরে বড়সড় একটা ট্রিট দেয়। তারপর খুব আনন্দের সাথে বলে,”শেষমেষ তুহিনকে হ্যা বলে দিলাম গতকাল বুঝলে। আমার ফাইনাল পরীক্ষা তো শেষ। আগামী দুইমাস পরেই পারিবারিক ভাবে বিয়ে করব। আর এই দুইমাস জুটিয়ে প্রেম করব। তাই হয়তো তোমার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়ে উঠবেনা।” এবার আমি ভয়ানক লজ্জা পাই। আমি বলি,”তার আর দরকারও হবেনা হয়তো। তোমাকে বলা হয়নি আমার মোটামুটি ভালো একটা চাকরির অফার এসেছে। তারা আমার কিছু কবিতা দেখে আমাকে পছন্দ করেছে। তাই রেজাল্ট বের হবার আগেই হয়তো জয়েন করবো। সিলেটে পোস্টিং। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ক্যাম্পাস ছাড়ছি বোধহয়। সিলেটে চলে যাবো। ভালোবাসার লেখনীর অভ্যাসকে এখন থেকে পেট চালানোর ধান্দায় ব্যবহার করতে হবে ভেবে খারাপ লাগছে।”
সোমা তখন খুব খুশি হয়। সে বলে,”ভালোই হলো। এখন তুমিও অনেক সুখে থাকবে। আর আমিও ভালোই থাকবো। জানো তুহিন ছেলেটা অনেক বোঝে আমাকে। তবে তুমি আমার বিয়েতে থাকতে পারবেনা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। সমস্যা নেই তোমার জন্য আমি খাবার পার্সেল করে পাঠিয়ে দিবো।”
আমি খাওয়া থামিয়ে সোমাকে বলি, “আচ্ছা সোমা সফলতা কিংবা বিত্ত কি সুখের মাপকাঠি হওয়া উচিত? মানুষের জীবনের কিছু সময় থাকে সোমা,যেগুলো থেকে প্রাপ্ত স্মৃতি তার সারাজীবনের সুখে থাকার অন্তরায় হয়ে দাড়ায়।”
সেদিন রাত বারোটা দশমিনিটে কিছু কথা বলার জন্য আমি সোমাকে কল করি। কিন্তু তাকে ওয়েটিং পাই। পনেরো বারের মাথায় সে কল রিসিভ করে বলে,”সরি শামীম। তুহিনের সাথে কথা বলছিলাম। তুমি কি কিছু বলবে?” আমি অনেক সাহস নিয়ে তাকে বলি,”সোমা তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। আচ্ছা আমি যদি তোমাকে ‘ভালোবাসি’ বলি তুমি কি আমাকে খুব বেহায়া ভাববে? আমি জানি তোমাকে ধারন করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আমি এতটুকু বলতে পারি আমি তোমাকে সুখে রাখবো। হোকনা সেটা নিজের সুখের বিনিময়ে। সোমা আমার জীবনটা একটা কবিতার মতো,যে কবিতার নায়িকা শুধু তোমাকেই ভাবতাম। আমি জানি সেটা আমার ভুল হচ্ছিলো। কিন্তু কিছু কিছু ভুল করে খুব আনন্দ পাওয়া যায়। তুমিও সেইরকম একটা ভুল ছিলে। আমার তেইশ বছরের জীবনে আমি খুব কম জিনিসই পেয়েছি। তোমাকে যে আমার পেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ভালোবাসলেই যে ভালোবাসার মানুষটার সাথে ঘর বাধতে হবে সেটা আমি এতটা আশা করতে পারিনা। আমার কাছে ভালোবাসতে পারাটাই মুখ্য। আমার ইচ্ছে ছিলোবা তোমাকে কথাগুলো বলার। কিন্তু তোমাকে আজ কথাটা না বললে হয়তো নিজের প্রতি অবিচার করা হতো তাই বললাম। আমি এভাবে বলার জন্য দুঃখিত। ”
আমি একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে হাপিয়ে যাই। সোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি আমি। সে অর্ধিমিনিট চুপ থেকে বলে,”শামীম আমিও হয়তো তোমাকে ভালোবাসতাম। আমি অনেক অপেক্ষা করেছি তোমার থেকে এই কথাটা শোনার জন্য। কিন্তু একসময় ভেবেছি হয়তো এমনটা কখোনই হবেনা। তুমি কখোনোই হয়তো আমাকে চাইবেনা। কিন্তু জানো এখন আমার সত্যি কিছু করার নেই। তুহিন আসলেই আমাকে অনেক বেশি চায়। আমার তাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই।”
আমি সোমাকে বলি,”শোনো সোমা, ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা পাবার জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়,অপেক্ষা নয়। অপেক্ষার হয়তো সমাপ্তি আছে,কিন্তু প্রতীক্ষার নেই। প্রতিদান আশা করলে তাহলে ভালোবাসার কোনো স্বকীয়তা থাকেনা। তখন সম্পর্কগুলো ফুটপাতে পড়ে থাকা কাগজের মতো মুল্যহীন হয়ে দাড়ায়। তুমি হয়তো খোয়াল করোনি তুমি যখন আমার পাশে বসে বাদাম খেতে তখন আমি গভীর ভালোলাগা নিয়ে সেটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। আমার কাছে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার চেয়ে সেটাকে পুড়িয়ে খাঁটি করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাই তোমাকে সময় করে জানানো হয়নি। কিন্তু তুমি একটা ভুল বলেছ,তুমি আমাকে কখোনোই ভালোবাসনি। যদি ভালোবাসতে তাহলে আজ অন্য কারো হতে না। হয়তো তুমি শুধু আমার কবিতার নায়িকাই ছিলে, জীবনের নায়িকা নও।”
সোমা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। সে আমাকে বলে,”আমি জানিনা আমার কি করা উচিত। তুমি বলো আমি কি করব?”
আমি বলি,”সোমা তোমার সেটাই করা উচিত যেটাতে তোমার মন সায় দেয়। তুহিন ছেলেটা আসলেই ভালো। আমি জানি তুমিও তাকে ভালোবাসো। তোমার ভালোবাসার মানুষকে পছন্দ করা তোমার ব্যাক্তি স্বাধিনতার মধ্যে পড়ে। তোমরা অনেক সুখি হও কেমন।”
সোমা আমাকে বলে,”তুমিও অনেক ভালো থেকো।”
আমি কলটা কেটে দেই। আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে তখন।
আমি সোমাকে তার জন্য লেখা শেষ কবিতাটা মেসেজ করে পাঠিয়ে দেই,
“তুমি আমার ছিলেনা,
তুমি ছিলে রংধনু,আকস্মিক রাঙ্গিয়ে দিয়েছিলে আমাকে,
তুমি আমার ছিলেনা,
তুমি ছিলে কোলাহল,আমার নিস্তবন্ধার বুক চিরে ফুড়ে ওঠা আনন্দ।
তুমি আমার ছিলেনা,
তুমি ছিলে কোকিলা,দাড়কাক আমাকে দিয়েছিলে সাময়িক প্রাপ্তি।
তুমি আমার নায়িকা ছিলেনা,
তুমি ছিলে কবিতা,দিনশেষে রয়ে গেছ অধরা।”
তারপর আমি মোবাইল থেকে সিমটা খুলে ফেলি। সিমটা হলের জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেই। আমি জানি সোমাকে আমার ভালোবাসার কথাগুলো জানানো ঠিক হয়নি। তবুও বলেছি। আসলে কেউ তাকে চাইবে এবং সে চাওয়ার পরিমানটা আমার গত চার বছরের চাওয়ার চেয়ে বেশি হতে পারে সেটা আমি নিতে পারিনি।
পরেরদিন রাফি আমাকে নিতে আসে হল থেকে। সে আমাকে কমলাপুর থেকে ট্রেনে তুলে দিবে। আসলে আমি ইচ্ছে করেই সিলেটে যাওয়ার তারিখ এগিয়ে নিয়েছি। সোমার শহরে আর ভালো লাগেনা আমার। ক্যাম্পাসে হাটলেই চোখের সামনে চারবছরের বহু স্মৃতি ভেসে ওঠে।
আমরা যখন কমলাপুরে আসি রাফি তখন আমাকে বলে,”এই কমলাপুর আমার জীবনের সবচেয়ে অশুভ একটা শহর বুঝলি। আমি ভাবছি এরপর থেকে মাঝে মাঝেই এখানে আসব। আমার আসল মায়ের সাথে দেখা হলে তাকে একটা প্রশ্ন করবো। বলব কেন তিনি আমার সাথে এরকমটা করলেন।” আমি রাফিকে কমলাপুরে নয়বছরের একজন ক্রন্দনরত শিশুকে দেখিয়ে বলি,”এই শিশুটাকে দেখছিশ? সে পাঁচটাকা দামি একটা পরোটার জন্য সারাদিন যুদ্ধ করে। এই শিশুটা যখন বৃষ্টিতে ভিজে, জ্বরে ভোগে তখন কেউ তাকে তোর পালক মায়ের মতো আদর করে ঔষুধ খাইয়ে দেয়না। কিংবা প্রচন্ড শীতের রাতে যখন সে একটামাত্র হাফপ্যান্ট পরে কাঁপতে থাকে তখন কেউ তাকে গভির মমতা নিয়ে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে দেয়না। প্রচন্ড ক্ষুধায় পেটে ব্যাথা নিয়ে এই শিশুটি যখন নোংরা প্লাটফর্মের শক্ত মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি করে, তার মুখে একমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার মতো কেউ থাকেনা রাফি।
এই শিশুটা জানেনা তার মা কে,সে জানেনা তার পরিচয় কি,তবে সে এটুকু জানে তার বেঁচে থাকার জন্য একটু খাবার দরকার। আর তারই জন্য সে সারাটাদিন সংগ্রাম করে। রাফি এই শিশুটা তো তোর চেয়েও অভাগা। তুই তো পাসনি এমন কিছুই নেই। সম্পদ, সাফল্য, পরিবার সবই পেয়েছিশ। মিছেমিছি কেন অতীত ঘেটে নিজের দায় বাড়াচ্ছিস? তোর অতীতে হয়তো একজন অভুক্ত মা আছেন, যিনি একবেলা খাওয়ার পর জানেননা পরেরবেলা কি খেয়ে বাচবেন। তাই হয়তো তিনি তার সন্তানকে উৎসর্গ করতে বাধ্য হয়েছেন। সেই মা-ই হয়তো আফজাল সাহেবের চলার পথে তোকে রেখে দুরে কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। রাফি মা তো মা-ই। মায়েদের ভালোবাসার কোনো কমতি হয়না,সেই ভালোবাসার তুলনা হয়না। আমার জন্মের সময় যখন ডাক্তার এসে বাবাকে বলেছিল,পেশেন্ট এর অবস্থা ভালোনা। হয় রোগিকে বাঁচাতে হবে নাহয় নবজাতককে। আপনারা আরেকটু আগে নিয়ে আসতে পারতেন। এখন এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তখন প্রসব বেদনায় কাতর আমার মা চিতকার করে আমাকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে বলেছিলেন। বাবাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন আমার যেন কোনো কষ্ট না হয়। রাফি আমার মা নিজের জীবন দিয়েছেন শুধু আমাকে পৃথিবীতে আনার জন্য। দশমাস গর্ভে ধারন করা কোনো মা-ই তার সন্তানকে ভালোবাসায় কমতি করেন না। তাই তোর জন্মদাত্রি মা কে কখোনোই ছোট করিশনা। আর তোর পালক মা তো তোকে তেইশবছর ধরে আগলে রেখেছেন। বলতো এই তেইশ বছরে তোর মায়ের জন্য তুই কি করেছিশ? অথচ তিনি তোর জন্য কি না করেছেন! তুই যে তার প্রতি অবিচার করছিস এটা কি তুই জানিস?”
আমার কথা শেষ হলে রাফি ছোট বাচ্চাদের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে কেঁদে দেয়। আমি তার পিঠ চাপড়ে বলি,”বাসায় যা রাফি। আজকে মায়ের হাত ধরে বল, ক্ষমা করে দিও মা। তোমার সীমাহিন মমতা বোঝার ক্ষমতা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ছিলোনা।” রাফি আমার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি মায়ের বুকে ফিরে যাওয়া একজন সন্তানের দিকে।
আমার বিকেল চারটার ট্রেন রাত আটটায় কমলাপুর থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে এই দেশের মানুষের জীবনকে অনুভব করতে থাকি। আমার মনে পড়ে একটি ১২আগস্টের কথা, মনেপড়ে বাংলাদেশের উত্তরের কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার কালুয়া নামক একটি গ্রামের কথা। সেদিন চাদনী রাতে আমি আমার বাবার কোলে শুয়ে রাক্ষস খোক্কসের গল্প শুনছিলাম। ধরলা নদী সেদিন যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। হটাৎ স্রোতের একটি আঘাত সেদিন বাঁধ ভেঙ্গে আমাদের সহ প্রায় দেড়শত বাড়ি নদীর গহ্বরে নিয়ে যায়। আমি আর বাবা পানিতে হাবুডুবু খাই। আমার বাবা তখনও আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে রাখেন। আমি বাবার চোখে আমাকে হারানোর তীব্র ভয় দেখতে পাই। বাবা আমাকে চিতকার করে বলেন,”ভয় পাসনে বাপজান। সব ঠিক হয়ে যাবে। শক্ত করি আমাক ধরি থাক।” চারদিকে সবাই যখন নিজেকে বাচানোর জন্য চিতকার করছে বাবা তখন আমাকে একটা কলাগাছ ধরিয়ে দেন। আমি কোনোরকমে ভেসে থাকি। সাতবছর বয়সের আমি যখন বাবার হাত টেনে কলাগাছকে আকড়ে রাখি বাবা তখন বলেন, “তুই কলাগাছ ধরি রাখ বাপজান। তোর বাচতে হবে। তোর কিছু হলে তোর মায়েরে কি জবাব দিব বল?” আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাই। বাবা সাতরে আমাকে পাড়ের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেন। হটাৎ কোথা থেকে একটা বড় ঢেউ এসে বাবাকে আমার হাত থেকে কেড়ে নেয়। বাবা স্রোতের টানে আমার থেকে অনেক দুরে চলে যান। আরেকটা বড় ঢেউয়ে বাবা পানির তলায় চাপা পড়ার আগে আমাকে শুধু বলেন, “তোর বাচতি হবে বাপজান।” বাবার শেষ কথাটা আজও আমার কানে বাজে। তারপর আমি দুইঘন্টা অনেক চেষ্টার পরে যখন তীরে আসি তখন আমি অনুভুতিহীন একটা মুর্তির মতো। আমি শুধু আমার বাবাকে খুজতে থাকি। আমার দাদু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখেন। তিনি আমাকে বলেন, “দাদুভাই তুই আমার একমাত্র বেটা আর মেয়ের মতো বৌমার জীবনের বিনিময়ে পাওয়া ফসল। তোর বহুত বড় হতি হবে।” আমি পরেরদিন যখন আমার বাবার প্রাণহীন শরীরটা দেখি তখনও তার চোখে আমার জন্য সীমাহিন ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো।
আমি আমার জীবনে আর কোনোদিন ধরলা নদীর তীরে যাইনি। এই নদী আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে। তারপর আমার শৈশবকাল আমার দাদুর সাথেই কাটে। আমার দাদু আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার ঠিক তিনদিন পর আমাকে ছেড়ে বাবার কাছে চলে যান।
আমি সিলেটে পৌছানোর পাঁচবছর সাতমাস তেইশদিন পর আমার কাছে একটা চিঠি আসে। চিঠিতে লেখা “প্রিয় কবি আপনার লেখাগুলো পড়লে কেমন যেন ঝড় ঝড় লাগে। যেন কবিতার প্রতিটা অক্ষরে একেকটা হাহাকার লুকিয়ে আছে। আপনার প্রতিটি কবিতা পড়া শেষে চারপাশে একটা থমথমে ভাব ধরে যায়। এত সুন্দর করে মানুষের ভিতরের সত্তটাকে কিভাবে আপনার কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন বলুনতো?” চিঠির প্রেরিকার নাম সুমাইয়া আহমেদ রিভা। এই প্রশ্নের কি উত্তর লিখবো আমি ভেবে পাইনা। আমি লিখি,” প্রিয় পাঠিকা,সবার জীবনের অধ্যায়গুলো রঙ্গিন হয়না। এই রংহীন অধ্যায়গুলোর কিছু অংশ একেকটা ঝড়ের কারন হয়ে দাড়ায়। আমি অন্যের সত্তাটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারিনা। শুধু নিজের সত্তাটাকে শান্ত রাখতে নিজস্ব অনুভুতিগুলোকে লেখনীতে রুপ দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি কখোনোই চাইনি আমার কবিতাগুলো সবাই জানুক। কবিতাগুলো আমার একান্তই নিজের। আমার রাফি নামের এক বন্ধু আমার অজান্তে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছে। ভালো থাকবেন।”
তিনদিন পরে অফিস থেকে আসার পরে চিঠিটা পোস্ট করে দেই। আমি ভাবিনি এর উত্তরে আবার কোনো চিঠি আসবে। সাতদিন পর আমি আবার একটি চিঠি পাই। চিঠিতে লেখা,” প্রিয় কবি,আমি আপনার তুলনায় খুব অল্পবয়সী। তবুও আমি আপনার ভারী অক্ষরের ভয়ানক কবিতাগুলো নিজের মাঝে ধারন করার চেষ্টা করি। কবি আপনি রাগ করবেন না। আপনার ভিতরটাকেও আমি অনুভব করতে চাই। আপনার জীবনের গল্পটা আমাকে বলবেন?”
আমি বিরক্ত হই। আমার সবার সম্মুখে উপনীত হতে ভালো লাগেনা। আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসি। কিন্তু এই মেয়েটা সেটায় বাধার সৃষ্টি করছে। যেটা আমার ভয়ের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। আমি কি মনে করে তাকে লিখি, ” শুনুন রিভা, আমি আজ থেকে বহু আগেই জীবনের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। ছয়বছর আগে একজনকে আমার জীবনের গল্পটা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো, বলার সুযোগ পাইনি। আমি চাইনা আমার গল্পটা আর কেউ জানুক। আপনি ভালো থাকুন।”
এত এড়িয়ে যাওয়ার পরও রিভা আমার পিছু ছাড়েনা। আমার থেকে পাঁচবছরের ছোট এই মেয়েটির সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। সে মাঝে মাঝেই কল করে আমার কাছে কবিতা শুনতে চায়। আমি তাকে আমার লেখা কবিতা পড়ে শুনাই।
রিভা যেদিন আমাকে কল করে বলে,”কবি আমি আপনার শহরে আছি। আপনার মুল্যবান সময়ের একুখানি অংশ পাওয়া যাবে? আপনার শহরের পাহাড়গুলো ঘুরিয়ে দেখাবেন?” তখন আমি সেদিন খুব অবাক হই। এই মেয়েটা আমাকে দেখার জন্য এতদুর আসতে পারে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলোনা। আমি যখন রিভার সাথে দেখা করি তখন বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। রিভা আমাকে দেখে বলে,”কবি আপনার কবিতার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি দুই বছর ধরে। আজকে আপনাকে দেখে মনে হলো আপনার বুকে জমে থাকা পাড়টার কাছে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।” আমি তাকে বলি,”রিভা আমার ঊনত্রিশ বছরের জীবনে আমি অনেক কিছুই হারিয়েছি। যতটুকু পেয়েছি তার পরিমান নিতান্তই সামান্য। আমি আমার জীবনের একটা প্রাপ্তির সমীকরণ ও মেলাতে পারিনি। তাই আমি কোনো কিছু আর আশাও করিনা।” রিভার সাথে আমি সেদিন চা বাগানে হাটি। তার মায়াভরা হাসি দেখে আমি সেদিন অাশ্চর্য না হয়ে পারিনি। একজন মানুষ যে এত সুন্দর করে হাসতে পারে আমার আগে জানা ছিলোনা। আমি সোমার পর তাকেই প্রথম কবিতা আবৃত্তি করে শোনাই। সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বলে,”কবি আপনি যে কত সুন্দর আবৃত্তি করতে পারেন তা হয়তো আপনি নিজেও জানেন না। আপনি কি জানেন আপনার কন্ঠে কবিতার প্রতিটি অক্ষর জীবন্ত হয়ে ওঠে?” আমি তার কথা শুনে মাথা চুলকিয়ে বলি,”সময় করে ভেবে দেখা হয়নি।”
এরপর থেকে রিভা মাঝে মাঝেই আমার শহরে আসে শুধুমাত্র আমার কবিতা শোনার জন্য। আমি তাকে নিরাশ করতে পারতাম না। আমার প্রতিটা কবিতা সে মুগ্ধ হয়ে শুনতো। কবিতা শেষে সে চোখে অশ্রু নিয়ে আমাকে বলতো,”আপনার কবিতাগুলো এত ভয়ানক কেন কবি? ধিরে ধিরে মানুষের ভিতরটাকে দখল করে নেয়!” আমি তাকে বলি,”রিভা বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে আমার অতীত। সেই ঝরেপড়া রক্তের ফোটাগুলো তোমার চোখের এতটুকু সুখময় অশ্রুর কারন হতেই পারে তাইনা? তুমি কাঁদতে পারো, আমি কিছু মনে করবনা,কেমন।” আমার কথা শুনে রিভা ফিক করে হেসে দেয়। সে বলে,”কবি আপনাকে কে বলল আমার হাসির কারনটা সুখের?” আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়। এই মেয়েটার হাসি এত সুন্দর কেন। আমি মাথা চুলকিয়ে বলি,”শোনো পিচ্চি মেয়ে তোমার চোখকে একবার অনুভব করতে পারলে পুরো তোমাকেই জানতে পারা যায়। বুঝলে।”
রিভা আমাকে বুঝতো। আমার দীর্ঘদিনের ছোট এই মেয়েটি আমাকে বোধহয় পড়তে পারতো। সে অনেক যোগ্য একজন বন্ধু ছিলো। তার তুলনায় আমি একজন জঘন্য কবি।
একদিন রিভা যখন আমাকে খুব করে অনুরোধ করে তখন আমি তাকে আমার জীবনের গল্পটি শোনাই। আমার মায়ের গল্প, বাবার গল্প, সোমার গল্প। রিভা আমার গল্প শুনে কেঁদে দেয়। আমি তাকে বলি,”সব গল্পের হ্যাপি এন্ডিং হয়না রিভা। কিছু গল্পের শুরু এবং সমাপ্তি সবকিছুই হাহাকার দিয়েই সূচিত হয়। আমার জীবনের গল্পটি সেরকমই একটি গল্প। তুমি কষ্ট পেওনা কেমন।” তারপর রিভা তার নিজের শহরে ফিরে যায়। তিনদিন পর সে আমাকে কল করে বলে,”আচ্ছা কবি আমাকে আপনার জীবনের নায়িকা বানাবেন? যদি রাতের আকাশে আপনার চাঁদ দেখার সঙ্গি হতে চাই, যদি আজীবন আপনার কবিতার শ্রোতা হতে চাই আপনি কি খুব রাগ করবেন?”
আমি তাকে বলি,” রিভা মানুষের জীবনের খুব ছোট ছোট কিছু ভুল তার সারাজীবনের কান্নার কারন হয়ে দাড়ায়। আমি তোমার সাথে কখোনোই যোগাযোগ রাখতে চাইনি। আমার ভয় হতো, কখন না তুমি আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ো! শেষমেষ সেটাই হলো। রিভা আমি ভালোবাসতে ভুলে গেছি। আমার কাছ থেকে তুমি হয়তো কিছুই পাবেনা। তোমার জীবনটা তখন তোমার নিজের কাছেই অসহ্য হয়ে উঠবে। আমি সেটা কখোনোই চাইনা। তুমি তোমার মতো থেকো। আর তুমিকি জানো তুমি ভয়ানক সুন্দর করে হাসতে পারো? এভাবে আর হাসবেনা। কেমন। শুভকামনা।”
আমি কল কেটে দেই। আমি জানি রিভার এই সাময়িক আশক্তি কিছুদিনের মধ্যেই কেটে যাবে। আমার মতো অযোগ্য একজন মানুষের কোনো অধিকার নেই তার সুখের অন্তরায় হয়ে থাকার। হয়তো আমার ভুল ছিলো তার সাথে যোগাযোগ করাটাই। আমার কি কিছু করার আছে? ঠিক বাইশ বছর আগেই একটি বাঁধ ভেঙ্গে ধরলা নদী আমার জীবনের সুখগুলো কেড়ে নিয়েছে। আমার কি আছে সাধ্য আছে তাদের ফিরিয়ে আনার? আমি বড়জোর চেষ্টা করতে পারি। তবে ভালোবাসার কখোনোই পরিসমাপ্তি হয়না। যদি রিভার অনুভুতি সত্য হয় তাহলে সে আবারও আমার কাছেই ফিরে আসবে। সে একটু সময় নিক। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুক।
আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি রিভার জন্য। রিভা আমাকে কল করেনা।ধিরে ধিরে সময়ের অনেক নিচে চাপা পড়ে যাই আমি।
গোধুলীর আলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়, মুছে যায় পশ্চিমের হালকা লালিমাটুকূও। নেমে আসে আধার,নিকষ কালো আধার। তারপর ব্যাস্ত সড়কে নেমে আসে নিস্তব্ধতা রংচটা শহরটার কোলাহলও থেমে যায়, যেন নেমে আসে মৃত্যু। নিড়ের পানে ধেয়ে চলে ঘরমুখো মানুষগুলো। একসময় ফুটপাতে সোডিয়ামের হলুদ বাতি জ্বালানো হয়। ঝিঝি পোকার ডাকে থমে যায় জীবণ, শুধু পথচলি আমি। একসময় থমকে দাড়িয়ে গমগমে স্বরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, “একমুঠো প্রেম এনে দিবি?অপ্রাপ্তির এই জীবনে একটুখানি কষ্টবিলাস করি এবার!”
তিনমাস বারোদিন পর হটাৎ আমার মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে ওঠে। আমি দেখি রিভার মেসেজ। সে লিখেছে,”কবি আপনি ভালোবাসতে ভুলে গেছেন তো কি হয়েছে? আমি আপনাকে ভালোবাসতে শেখালে কি আপনার খুব আপত্তি আছে? আমি এখন একটা পান্জ্ঞাবীর দোকানের সামনে দাড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি বলুনতো আপনার প্রিয় রং কি?”
আমার জীবনের বাঁধ আবারও ভেঙ্গে যায়। তবে আমার একটুও খারাপ লাগেনা। মনেহয় এবার আমার জীবনের প্রাপ্তির সমীকরণটা মিলে গেলো।
লেখকের কথা- ২০১৭ সালে ১৩ আগস্ট আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু স্ব-উদ্দ্যোগে সীমিত ত্রান নিয়ে যখন কুড়িগ্রামের কালুয়া গ্রামে ছুটে যাই তখন আমরা নদীর তীব্র গর্জন ছাড়া আর যে জিনিসটা দেখেছি সেটা হল উদ্বাস্তু মানুষদের হাহাকার। আমি গল্পটি লেখার সময় বহুবার সেই মানুষগুলোর স্মৃতি চোখের সামনে এনেছি।
প্রথম আালোর ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ি তখন পর্যন্ত বাধ মেরামতে সরকারি অনীহা দেখা গেছে। আমি জানিনা ২০১৯ সালে আবার প্রশাসনিক দুর্বলার জন্য এমন খারাপ কিছু ঘটবে কি না। তবে আশা করি আমাদের ২য় বার এরকম হাহাকার শুনতে হবেনা।
পাঠকদের শুধু গল্পটি পড়তে বলবোনা। আমি বলবো এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জীবন আপনারা একটাবার হলেও গভীর থেকে অনুভব করার চেষ্টা করুন। আপনার ঘরেই ভালোবাসার নিদর্শন প্রতিনিয়ত দেখিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন মানুষ। চোখ খুলে তাদেরকে একটাবার সেটা দেখুন। পরিশেষে বলি, ভালো থাক রিভা রা, ভালো থাক আমাদের চারপাশের ভালোবাসাগুলো।
উৎসর্গঃ পিতৃ-মাতৃতুল্য দাদু-দাদীমার উদ্দেশ্যে।