আমার বয়স যখন ১২ বছর আমি তখন প্রথম বাসা থেকে পালিয়ে যাই। পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার হাতে ছিলো ১৩৮ টাকা এবং একটি স্বর্ণের আংটি। বাসা থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে আমার স্কুলের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর আমার মাথায় প্রথম চিন্তা হয়, আমি বাথরুম করবো কোথায়! দ্বিতীয় চিন্তা, ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু এত এত টাকা দিয়ে কোনটা আগে খাওয়া যায়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, আমার পালানোর কারণ ছিলো ভালোবাসা। আমি আমার পাশের বাড়ির এক মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে তার বয়স ছিলো আমার থেকে তিন বছর বেশি এবং আশির দশকে এই বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো। আমার ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে হয় ২৪শে অগ্রহায়ণ শুক্রবার জুম্মার পর। আমাদেরকে কেউ দাওয়াত করেনি কারণ আমার বাবাকে সবাই খুব ভয় পেতো এবং তিনি অত্যন্ত ধনী ছিলেন। এরশাদ সাহেবের সাথে তার সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিলো যদিও প্রায়ই তিনি রাতে বাসায় এসে মুখ গম্ভীর করে বলতেন, “চামার সরকার”।
যাইহোক আমার প্রথম পালানোর অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলোনা। আমি রাত ৮টা পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এই সেই খেয়ে বুঝতে পারি, আমার ঘুমানোর স্থানও নাই। রাত্রি পৌনে দশটার দিকে আমি বাসায় ফিরে আসি। আমাকে দেখে বাবা কিছুই বললেন না। এই সময়টা বাবার পত্রিকা সময়। আমি আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গেলাম। মা তখন জানালার শিক ধরে বসে মিনমিন করে বলছে, “অন্তু কই, অন্তু”। মা অন্তু কাকে ডাকে আমি জানিনা, আগে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম। মা কিছু বলতো না। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করতো, “অন্তু নাই?”
আমি যখন মার ঘরে যাই, তখন খেয়াল করলাম দরজায় নতুন তালা লাগানো। আমি জানালার শিক দিয়ে মার দিকে একটা চকোলেট বাড়িয়ে দিয়ে বলি, “মা ভালো চকোলেট খাও। আব্বা জানবেনা”।
মা আমার থেকে চকোলেট নিয়ে সুস্থ মানুষের মত চকোলেট খেয়ে আমার দিকে খুব মমতার দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর হাত বের করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমার বয়স বারো হলেও আমি ছেলে মানুষ তো। তাই চোখ ভরা পানি চোখেই আটকে রাখলাম। সমস্যা কি, আমার মা আসলে পাগল ছিলো। আমার যখন চার কি পাচ বছর বয়স তখন থেকে মাকে একটা নির্দিষ্ট ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়। বাবা বলতো মার নাকি মাথা ক্র্যাক হয়ে গেছে। আমাকে দেখলেই মেরে ফেলবে। আমি অবাক হয়ে একবার দাদুর দিকে তাকায় থাকতাম, একবার বাবার দিকে। আমার দাদী পান চিবোতে চিবোতে বলতো, “জ্বিনে ধইরছে। কফিল আমার কথা বিশ্বাস করতেছিসনা ঠিক আছে। কিন্তু একবার হুজুররে ডাক পাড়ি নিয়া আয়”।
আমার সেই সময়টা খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিলো।আমাকে দেখাশোনা করতো আমাদের বাসার কাজের মেয়ে। আশেপাশে যখন কেউ থাকতোনা তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই বলতো, “বাপের মত হারামীর পয়দা হইচে”।
কাজের মেয়ের নাম ছিলো সুফিয়া। সুফিয়া আমাকে মাঝে মাঝে চড় থাপ্পর মারতো। একদিন বাবার সামনেও আমাকে চড় মেরে বসেছিলো। বাবা তাকে কিছুই বলেনি।মাকে তখন চেয়ারে বেধে খাওয়ানো হচ্ছিলো। আমার চড় খাওয়া দেখে মা কি খুশি। চিৎকার করে বলছিলেন, “আরো মার হারামজাদাটারে”।
এমন একটা কঠিন পরিবেশে মানুষ হওয়ার পরও আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। আমি কখনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হতামনা। বাবার কাছে রেজাল্টকার্ড নিয়ে গেলে বাবা আমাকে দশ টাকা পুরস্কার দিতেন। আমি সেই দশ টাকা দিয়ে মায়ের জন্য চকোলেট কিনে আনতাম। মা খুব চকোলেট পছন্দ করে আমি জানতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিলো মা যদি একটু হাত বাড়িয়ে আমাকে আদর করে।বেশিরভাগ দিন আমি মার খেতাম। দুইএকবার অবশ্য মা আমাকে বেশ মমতা দেখাতেন। আমি সেই সামান্য সময়ের মমতার বুভুক্ষু ছিলাম। আমি সেই সময়টার অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ আর কেউ আমাকে ভালোবাসতোনা।
সেদিনের কথায় আবার ফিরে আসি। মা সেদিন চকোলেট খেতে খেতে আমাকে বলছিলেন, “আজকে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলি অন্তু?”
আমি দাত বের করে মাথা নাড়ি। মা আমার গালে হাত দিয়ে বলেন, “আমার সোনামানিক তুই কি জানিস আমি এখন অনেক ক্লান্ত।অনেক অনেক ক্লান্ত।আমার খুব মুক্তি পেতে ইচ্ছা করে”।
আমি মাথা নেড়ে বলি, “আমারও ইচ্ছা করে আম্মু। আমিও অনেক ক্লান্ত”।
মা হেসে বলে, “ধুর ছোট্ট ছেলে তুই এসব বুঝবিনা। তুই একটা কাজ কর। আমার ঘরের দরজাটা খুলে দে। আমি মুক্তি নেই। আমার আর ভালো লাগছেনা”।
সে রাতে আমার কি যেন হয়েছিলো। মার চোখ ভরা যে যাতনা আমি দেখেছিলাম তা সহ্য করার মত ছিলোনা। আমি যখন মায়ের ঘরের দরজাটা খুলে দেই মা খুব আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে। আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলে, “আমার খুব ভুল হয়ে গেছে বাবা। তুই তো আমার অন্তু, আমি বুঝিনি। অনেক মারছি, ক্ষমা করে দিস”।
আমি চোখ মুছতে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার সারা চোখ ভরা শূণ্যতা। এত অল্প বয়সে এমন অনুভূতিটা আমার বোঝার কথা নয়। আমি খুব ভয় পাই এবং চিৎকার করে কাদতে থাকি। সবাই তখন ঘুমিয়ে ছিলো, কেউ আমার চিৎকার শোনেনি বা শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি।রাত্রি তখন একটা। মা আস্তে আস্তে চারতলার ছাদে উঠে যায়। আমি মার পাশে পাশে ছাদে উঠি।মা আমার হাত ধরে একসময় বলে, “আব্বু ভালো মানুষ হবা ঠিক আছে?”
আমি মাথা নেড়ে কাঁদতে থাকি। আম আমার সামনে ছাদ থেকে লাফ দেয়, বাধা দেয়ার মত সামর্থ্য আমার ছিলোনা। আমি চোখ বড় বড় করে দেখি মা কিভাবে আস্তে আস্তে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলো। আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আমার মনে আছে সে রাতে খুব ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হয়েছিলো। এখনো যখন আমার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ে আমি খুব ভয় পেয়ে সামনে তাকিয়ে থাকি। আমি সবসময় সামনে মা আর তার চোখ ভরা শূণ্যতা দেখতে পাই। মা আস্তে আস্তে করে অদৃশ্য হয়ে যায় আর আমি তাকিয়ে থাকি অনন্ত কাল। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তাই না! আমি বৃষ্টিকে ঘৃণা করতাম।
এর চার বছর পর ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি এক নিশুতি রাতে বাবা খুব অসুস্থ হয়ে আমাকে ডাকলেন। আমার সেসময় মেট্রিক পরীক্ষা চলছিলো। বাবা আমাকে ডেকে জীবনে প্রথম মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আবিদ তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। পরে হয়তো সুযোগ পাবোনা। শুনতে চাও?”
আমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ি। আমার আসলে ঠিক শোনার আগ্রহ ছিলোনা।কিন্তু তাকে না বলার মত সাহসটাও আমার ছিলোনা। বাবা আমার হাত ধরলেন, তারপর বললেন, “নাহ যে কথাগুলো তোমাকে বলা দরকার এখন আর বলতে ইচ্ছা হচ্ছেনা”।
বাবা অনেকক্ষণ আমার হাত ধরে থাকলেন, একেবারে তার শেষ নিঃশ্বাসের আগ পর্যন্ত। এই মানুষটাকে কখনো আমার এত আপন লাগেনি সেদিনের মত। কি অদ্ভুত ব্যাপার, মানুষের মৃত্যু তাকে আমাদের কত কাছে এনে দেয়। আমার মনে হচ্ছিলো তাকে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু আমি জানিনা সেই কথাগুলো কি।
বাবা মারা যাওয়ার ঠিক ছয় দিন পর খুব কঠিন দুটো সত্য আমাকে জানতে হয়। প্রথমটি হলো, আমি আমার বাবা মায়ের একজন পালকপুত্র ছিলাম। দ্বিতীয়টি হলো, আমার বাবা তার সমস্ত অর্থ সম্পদ কি অদ্ভুত কারণে যেন আমার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। সেসময়টা আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো। আমার মনে হতো আমাকে সবাই ঘৃণা করে। আমার বাবার ভাইয়েরা আমাদের বাসায় এসে থাকা শুরু করলো। একসময় তারা বাসার বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। আমার ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগতো।কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস আমার ছিলোনা। আমার চাচারা আমাকে প্রায়ই বলতো, “এতিমের বাচ্চা এইভাবে আমার ভাইয়ের জিনিস ভোগ করতেছে। লাথি দিয়া বাইর কইরা দিতে মন চায়”।
আমার সবচেয়ে ভালো সময় আসলো আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।অন্য রকম একটা জগত। নিজের জানা কথাগুলো কাউকে বলতে পারার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ভালো জায়গা কি আর হতে পারে? টি.এস.সির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে আমি হেটে বেড়াতাম। আমার পাশে তখন খুব একটা বন্ধু বান্ধব থাকতোনা। আমার খুব কাছের একটা বন্ধু ছিলো, ওর নাম ছিলো মুনা। মুনা আমাকে খুব মায়া করতো। ও বলতো, ও আমাকে ভালোবাসে। আমি হেসে বলতাম, “আমার চোখ অনেক বড় দেখ। আমি তোর মনের ভিতরে দেখতে পারি। তুই আমাকে ভালোবাসিস না”।
মুনা হেসে ফেলতো আমার কথা শুনে।আমার মাস্টার্স শেষ হয় ৯৫ সালের আগস্টে। মুনার সাথে আমার শেষ ক্লাসে যখন দেখা হয় তখন ও আমাকে হাসিমুখে বললো, “আমার বিয়ে দু মাস পর। আমাকে নিয়ে পালাবি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নাহ। পালাতে ভালো লাগেনা। আমি ছোটকালে অনেকবার পালিয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিবার হতাশ হয়েছি”।
মুনা আবার হাত শক্ত করে ধরে বললো, “এবার হতাশ হবিনা। বিশ্বাস কর।প্রমিজ”।
আমি মুনার মাথায় হাত দিয়ে বলি, “আমি মানুষটা পচে গেছি। সংসার দেখিনি, কারো ভালোবাসা পাইনি। আমার সাথে তুই একদম সুখী হবিনা। প্রমিজ।মাফ করে দে”।
মুনার বিয়েতে আমি যেদিন গেলাম, মুনার আমাকে দেখে সে কি হাসি। ওর সাথে যখন ছবি তুলতে গেলাম মুনা আমাকে কানে কানে বললো, “আবিদ তুই তোর আসল মায়ের কাছে যা। আমার মনে হয় সে তোর জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। বিশ্বাস কর।আর একটা কথা, তুই সত্যি বলছিস। আমি আসলেও তোকে ভালোবাসি না। এখন বুঝতেছি। কিন্তু কি যেন একটা করতাম”।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি?”
মুনা আমাকে কিছু বললো না। ওর চোখে এই জীবনে প্রথমবার অনেক জল দেখলাম। একসময় বললাম, “যাইরে। দেখা হবে”।
মুনা বললো, “অবশ্যই হবে”।
মুনার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। বিয়ের রাতেই ও ওদের তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দেয়। তিনতলা থেকে পড়ে গেলে কি কেউ মারা যায়? কিন্তু ও মারা গিয়েছিলো। আমি সারারাত হাসপাতালে বসেছিলাম। আমার খুব মনে হচ্ছিলো, মুনা ওটির বেড থেকে এখনই উঠে আসবে। আমাকে হাসিমুখে বলবে, চল পালাই।
হেমন্তের এক সন্ধ্যায় আমি খুব মন দিয়ে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা একটা গান শুনছিলাম। কি জাদুকরী সব কথাগুলো, কি অদ্ভূত সুর। গানের দুটো কথা ছিলো এমন,
“তোমাকে ভালোবাসতে, চোখ চোখ রাখতে
আমি আর একটা জনম চাই
যে কথা আর বলা হবেনা প্রিয়, আর কখনোও
হাজার পাতায় তা লিখে রাখতে চাই”
সেসময় আমার প্রথম মনে হলো আমি যেন একজন মানুষ, আবেগে ভালোবাসায় কাতর একজন মানুষ। মৃত্যু, সময় অথবা ব্যস্ততা আমাকে বন্দী করে রেখেছিলো। আজ খোলস খুলে বাহিরে এসে মনের কথা খুব বলতে চাই। আমার খুব মুনার হাত ধরে বলতে ইচ্ছা করে আমি দুঃখিত। তাকে বলতে চাই, আমি তার চোখ খুব ভালোবেসেছিলাম। আফসোস আমি তাকে কথাগুলো বলতে পারবোনা কখনো। আমার খুব ইচ্ছে করলো আমি কথাগুলো লিখে রাখবো। হয়তো কথাগুলো গল্পকার ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের মত শোনাবেনা। কিন্তু কথাগুলো আমার নিজের হবে। ৯৫ সালের সেই হেমন্তে আমার দ্বিতীয় জন্ম হয়। আমি আমার জীবনের প্রথম গল্পটি লিখি অক্টোবরের ২৪ তারিখ, এক পূর্ণ সূর্যগ্রহণের দিন। আমি মুনাকে, তা আকাঙ্খাকে অবজ্ঞা করেছিলাম। কারণ আমার যে অনেক লেখা বাকি ছিলো। আমার কথা, মুনার কথা, আমার প্রথম ভালোবাসতে চাওয়ার কথা।
আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কাকলী প্রকাশনী থেকে। আমার বয়স তখন ২৭ বছর হবে। লেখাটা উপন্যাস টাইপ কিছু একটা হবে হয়তো। নাম দিয়েছিলাম রজনী। আমার বন্ধুবান্ধব সবাইকে আমি আমার বইটি উপহার দিয়েছিলাম। যদিও বইটি কেউ পড়ে দেখেনি। মুনা হয়তো পড়তো। আমি এসব নিয়ে ভাবতাম না। একজন লেখককে লিখতে হয় নিজের জন্য, অন্যের জন্য নয়। যা অন্যের আনন্দের জন্য তা গল্প, আমি গল্প লিখতে চাইতাম না।আমার এক পাঠক একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “আপনার লেখাগুলো আপনি গল্প না বলে আর কি বলতে চান?”
আমি না চিন্তা করেই তাকে বললাম, “জীবন ও অনুভূতি। এটা পড়তে হয়না, ভেতরে ধারণ করতে হয়। যেদিন একজন, শুধু একজন তা ধারণ করতে পারবে সেদিন থেকে আমি লেখক।পরিপূর্ণ লেখক”।
গভীর রাতে একদিন আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি স্বপ্নে দেখলাম, ঠিক আমার আসল মায়ের মত কেউ যেন আমাকে ডাকছে।এই স্বপ্নটা আমি বারবার দেখতে থাকলাম। আমার কখনো কেন যেন তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হয়নি। আসলে ভয় লাগতো। তাকে দেখতে পাবো এই আশা করতে খুব ভয় হতো। আমার অতীত থেকে আমি এমনটাই শিখেছি, জেনেছি। তবুও একদিন হঠাৎ করে ঠিক করলাম, টেকনাফ যাবো। দাদী বলেছিলো যে আমার আসল মা সেখানে কোন এক ছোট্ট গ্রামে বাস করে। মনকে বুঝাতে লাগলাম, আমাকে সমুদ্র নিয়ে কিছু লিখতে হবে। নদী আর সমুদ্রের ভালোবাসা নিয়ে লিখতে হবে। নাফের নীল জল উত্তাল সমুদ্রে যেমন করে ভেসে ভেসে বেড়ায় তা লেখা দরকার, খুব দরকার।
কেমন করে যেন এর সপ্তাহ খানেক পর গভীর রাতে আমি ঠিকই টেকনাফ চলে এলাম। টেকনাফের বাহারছড়া নামক স্থানে আমাদের একটা ছোট্ট বাংলো আছে। আমি অনেক ছোটকালে একবার এখানে এসে থেকেছিলাম। বড় বড় দরজা দিয়ে ঘেরা খুব পুরনো ধাচের নকশায় করা বাংলো। আমি আসার আগ পর্যন্ত বাংলোর নাম ছিলো না। আমি দুদিনের মধ্যেই বাংলোর একটা নাম দিয়ে দিলাম, মৃণ্ময়ী। এই নামটা কেন ভালো লাগলো তা জানিনা, এই নামটার অর্থ কি তাও আমি জানিনা। তবে এমন কারো সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো, নদীর পারে।শান্ত জলের গভীরতায়।
বাংলো দেখাশোনা করে আমার গ্রাম সম্পর্কের এক চাচা। চাচা তার ছোট্ট পরিবার নিয়ে বাংলোর একটা অংশে থাকেন। উনি তখন মাত্র বছরখানেক আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া টেকনাফ কলেজের শিক্ষক, ভূগোল শিক্ষক।উনার স্ত্রী আজ থেকে ১৪ বছর আগে মারা গেছেন। চাচার একটা মাত্র মেয়ে ছিলো, মেয়ের নাম ছিলো মৃন্ময়ী। তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টেকনাফ পৌছানোর একদিন পর।সে আমার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে এসে আমার চেয়ারে বসে বললো, “আপনি খুব ক্লান্ত তাই না?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নাহ তো। আমি তো ভাল একটা ঘুম দিয়েছি রাতে”।
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বললো, “আপনি বুঝেননি”।
এরপর ও চেয়ার থেকে উঠে যেয়ে বললো, “আপনি অনেক ক্লান্ত। বোঝা যায়”।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, “এমন করে কেউ কি আমাকে বুঝেছিলো। কলেজে মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পড়া একটা মেয়ে এমন করে আমাকে কথাটা বলে ফেললো মাত্র একবারের দেখায়।সেদিন দুপুরে আমি যখন বাংলোর পাশ দিয়ে হাটছিলাম তখন আবার তার সাথে দেখা হলো। ও মাথা নিচু করে আমাকে পাশ কাটিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন একবারের জন্য চোখাচোখি হলো। ও মিষ্টি হেসে আমাকে বললো, “আপনি এখনো ক্লান্ত”।
আমি হেসে বললাম, “আচ্ছা”। বাংলোর নামটা ঠিক তখনই আমি ঠিক করলাম। মৃন্ময়ীকে ভালো লেগেছিলো বলেই কি এমন একটা কাজ করলাম।ওকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো।
তৃতীয় দিন সকালে আমি এক দিস্তা কাগজ আর একটা নীল রঙ্গা কলম নিয়ে হাটতে বেরোলাম। উদ্দেশ্য বঙ্গের একমাত্র লবণাক্ত নদের পারে বসে এর স্বচ্ছ জলে নিজেকে খুজতে চাওয়া। নাফের মত এত শান্ত নদী কি কেউ কখনো দেখেছে, এই নদীর গল্পটা কেমন ছিলো জানতে খুব ইচ্ছা করে। কেউ কেউ বলে আরাকান প্রদেশে অনেক আগে এক রাজকুমারী বাস করতো। সে প্রতিরাতে আরাকান পাহাড়ের একদম চূড়ায় বসে কাদতো। একদিন খুব দরিদ্র এক কৃষকের ছেলে তার কাছে এসে বললো, “আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি এখানে এসে এত্ত করে কাদো। আমাকে বলো তোমার কি দুঃখ”।
রাজকুমারী বললো,”আমার বুকে অনেক কষ্ট। আমাকে কেউ ভালোবাসেনা, আমার মা বাবা নেই তো তাই। আমার ভাই, এই রাজ্যের রাজা আমাকে খুব ঘৃণা করে। বলে আমি খুব কালো, আমার জন্য রাজ্যে সব কষ্ট। আমাকে কোথাও যেতে দেয়না, কাউকে দেখতে দেয়না।আমি প্রতিদিন তাই পাহাড়ে উঠে চাঁদের কাছে বলি, যেন আমাকে তার মত রুপালী আভা দেয়”।
কৃষক পুত্র নাউফ এরপর থেকে প্রতিদিন রাজকুমারীর হাত ধরে তাকে ভালোবাসতো আর তার গল্প শুনতো। রাজকুমারীকে সে বলতো, “চাঁদের কাছে আর কখনো প্রার্থনা করবেনা। আমার নয়নে চেয়ে প্রার্থনা করবে। তাহলে দেখতে পাবে, আমার ভালোবাসায় তুমি থাকো রূপের দেবী হয়ে”।
নাউফের একদিন খুব অসুখ হলো। রাজকুমারী যখন তার সাথে দেখা করতে আসলো তখন নাউফ তাকে বললো, “আমি যদি মারাও যাই তবুও তোমাকে ছুঁয়ে থাকবো। তুমি পাহাড় হবে আর আমি তোমাকে ছুয়ে থাকা নদী”।
আজ লক্ষ বছর পর যখন হাত দিয়ে নদীর পানি ছুয়ে দিচ্ছিলাম তখন সেই ছেলেটার ভালোবাসা অনুভব করতে পারছিলাম যেন। হয়তো যা জেনেছি তা শুধুই একটা গল্প, কিন্তু আমার খুব প্রিয় গল্প।আমি যখন আমার অনুভূতিগুলো লিখতে যাবো ঠিক তখন মৃন্ময়ী আমার সামনে এসে বললো, “নদীটা খুব শান্ত তাই না?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নদীর পারের মানুষগুলো আরো শান্ত তাই না?”
মৃন্ময়ী বোধহয় বুঝতে পারলো আমি তার কথা বলতে চেয়েছি। আমাকে বললো, “আমি খুব ছোট্ট মানুষ। অনেক কিছু বুঝতে পারিনা। কিন্তু আমার মনে হয় কি জানেন? আমার মনে হয়, আমরা শ্বাস নিয়ে বেচে থাকি। আমাদের নিঃশ্বাসে শুধু আবেগ থাকে, প্রশ্বাসে তা গাঢ় হয়। আর জীবনটা খুব ক্লান্তিহীন”।
মৃন্ময়ী হাসছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। কি সাধারণ একটা মেয়ে। অথচ কেমন করে যেন শুনতে চাওয়া কথাগুলো বলে ফেললো।
আমি মৃন্ময়ীকে বললাম, “আমি খুব অস্থির একটা সময়ে বাস করেছি, যেখানে কেউ আমার হাত ধরার ছিলোনা।চারদিক এতোটা অশান্ত ছিলো যে আমি একসময় খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাদের এখানে এসে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। আমার ভেতরে খুব অশান্ত একজন মানুষ বাস করতো। সে বোধহয় এখন একটা আবাস খুজে পেয়েছে। নদীর গন্ধ পেয়েছে, স্বাধীনভাবে ঠিক তুমি যেমন করে বললে সেভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে”।
মৃন্ময়ী কিছু না বলে নদীর পানিতে তার হাত ডুবিয়ে রাখলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে।মৃন্ময়ী কি জানে আমার খুব অল্প সময়ে তাকে কেমন যেন লাগে, খুব আপন, অনেক কাছের কেউ। আচ্ছা না জানলে ক্ষতি কি। আমার ওর কথাগুলো শুনতেই খুব ভালো লাগছে।আমি অপেক্ষা করি ও কখন আবার না শোনা কথাগুলো আবার বলবে।
মৃন্ময়ী হঠাৎ করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি লেখালিখি করেন?”
আমি মাথা নাড়লে ও বললো, “আমি অনেক বই পড়ি। আপনার বই বের হলে আমাকে পড়তে দেবেন?”
আমি আবার মাথা নাড়ি। বলি, “আমার একটা বই বের হয়েছে গতবারের এক বইমেলায়। আমার কাছে কোন কপি আপাতত নাই। ঢাকায় গেলে তোমার জন্য পাঠিয়ে দেবো ঠিক আছ?”
মৃণ্ময়ী মাথা নেড়ে বলে, “আপনার চোখ অনেক বড় বড়। আপনি আমার দিকে যেভাবে অপলক তাকিয়ে আছেন আমার একটু ভয় লাগছে।মনে হচ্ছে আপনি আমাকে প্রেম ভালোবাসা টাইপ প্রস্তাব দেবেন”।
মুখ হা করা বলে যে ব্যাপারটা তা আমার সাথে আজ প্রথমবার হলো। আমি ওর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, “না না এমন কোন ব্যাপার না। আমি কেউ কথা বললে তার দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকি”।
মৃণ্ময়ী হেসে বললো, “আমি একটু কেমন যেন। মানুষকে চমকে দিতে ভালো লাগে। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না।আর যা বলেছি তা সত্যি হলে সমস্যা আছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে বাবার কাছে তার একজন প্রাক্তন ছাত্র আসে, হাসনাত নামে। তার সাথে বাবা আমার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছে”।
আমি হাসিমুখে বললাম, “অভিনন্দন। কিন্তু তুমি তো মাত্র কলেজে পড়ো। এত তাড়াতাড়ি কেন?”
মৃণ্ময়ী ভ্রু নাড়িয়ে বলে, “আরে আমি কি বলেছি নাকি যে এখনই বিয়ে হবে। বিয়েটা হবে সময় করে, যখন আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবো, তারও দুই তিন বছর পর”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমি প্রেম ভালোবাসা বিয়ে সম্পর্ক এই ব্যাপারগুলো ইচ্ছে করে কখনো বুঝতে চাইনি। আমি আসলে খুব ভঙ্গুর একটা পরিবারে বড় হয়েছি। সবার থেকে দূরে দূরে। ভেতরে কখনো ইচ্ছা জাগেনি কাউকে ভালোবাসার। কাউকে ভালো লাগার জন্য প্রেরণা পাই নাই। কিন্তু তোমাদের এখানে এসে মনে হচ্ছে, কাউকে ভালোবাসা খুব খারাপ কিছু না। কিন্তু তা নিঃস্বার্থ হতে হবে। তাই না?”
মৃণ্ময়ী বললো, “আপনিও দেখি আমার মত অনেক ভাব গাম্ভীর্যের কথা বলেন। ভালো ভালো। তবে আপনি যাই বলেছেন আমার মনে হয় ঠিক বলেছেন। আপনার মা, মানে আসল মা যেমন আপনার বাবাকে ভালোবাসতো ঠিক সেইরকমভাবে ভালোবাসতে হবে”।
আমি চমকে মৃণ্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।ওকে বললাম, “তুমি আমার আসল মা কে চেনো?”
মৃণ্ময়ী মাথা নেড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, “চেনার কথা ছিলো, কিন্তু চেনা হয়নি। আমার জন্মের আগেই উনি মারা গিয়েছিলেন। উনি আমার ফুপু হোন। আপনাদের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হয়েছিলো ফুপুর জন্যই। আপনার বাবা আমার ফুপুকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো বলতে পারেনি। ফুপুও বলতে পারেনি। যখন বলতে চাইলো দুজনই তখন সময় ছিলোনা। ফুপুর যার সাথে বিয়ে হয়েছিলো সে বছর খানেকের মাথায় আরেকজনকে বিয়ে করে ফুপুকে তালাক দিয়ে যায়। ফুপু নিজেও একসময় মারা যান। আপনার বাবা তখন এসে আপনাকে নিয়ে যায়”।
আমি মাথা নিচু করে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। মৃণ্ময়ী অনেকক্ষণ নীরব থেকে বললো, “আমার বাবা প্রায়ই আপনার কথা বলতো। বলতো আপনি অনেক ভালো আছেন শহরে। ভালো পড়াশোনা করছেন। আমরা আসলে যথেষ্ট অভাবী তো। তাই শহরে যেয়ে আপনাকে দেখার সামর্থ্য ছিলোনা।তবে আমি মনে মনে আপনাকে কল্পনা করতাম। অদ্ভুত ব্যাপার আপনাকে দেখে বুঝলাম যা ভেবেছি আপনি সেরকমই। এজন্যই আপনার সাথে এত এত কথা বলি। বুঝেছেন?”
আমি মৃণ্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “মাকে কোথায় কবর দিয়েছেন?”
মৃণ্ময়ীর চোখ ঝাপাসা হয়ে যায়। আমাকে বলে, “আপনার মা শখ করে মাঝে মাঝে ছবি তুলতেন। ছবিগুলো আমি দেখেছি। আমার ফুপুটা অনেক সুন্দর ছিলো।আপনাদের পরিবার অনেক ধনী ছিলো তো। তাই আমার ফুপুটা কখনো আপনার বাবাকে তার ভালো লাগার কথাটা বলার সাহস করেনি।বিয়ের পরেও তাই হয়তো কখনো সুখী হতে পারেনি। আমরা নদীর পারের মানুষতো, কাউকে চাইলে সব কিছু দিয়ে দেই। কিছু রেখে দেইনা মনে। এই নদীর কথা জানেন তো। এখানে ভালোবাসার কবর দিতে হয়। ফুপু তাকে এবং তার ভালোবাসাকে এখানে নিয়েই হারিয়ে গিয়েছিলো। তার শরীরটাকে খুজে পায়নি কেউ।বাবা এখনো মাঝে মাঝে কাঁদে।আপনি জানেন আপনাকে দেখে বাবা কত খুশি হয়েছেন! আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি অনেকদিন”।
আমি আস্তে আস্তে হেটে চলে যাই। আমার খুব একা থাকা দরকার। একদিনে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে।যখন নদীর পার দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিলো, এই মাটিতে, নদীর ঘ্রাণে আমার মা লুকিয়ে আছেন। তিনি আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছেন বারবার। আমার ভেতরে কেউ একজন যেন অনেক ভালোবাসা দিয়ে গেলো। মৃণ্ময়ী পেছন থেকে এসে আমার হাত ধরলো। আমাকে বললো, “চলুন”।
আজকাল প্রতিদিন সকালে উঠে আমি মৃণ্ময়ীর কাছে জীবনের গল্প শুনি।যখন নদীর ধারে যাই তখন প্রায় না দেখা যাওয়া প্রবাল দ্বীপটা আমি খুব অনুভব করি। আমার খুব ইচ্ছা করে সেই দ্বীপ দেশে হারিয়ে যেতে। শুনেছি সমুদ্র সেখানে বড় শান্ত। আমি মৃণ্ময়ীকে জিজ্ঞাসা করি, “আমাকে নিয়ে যাবে দারুচিনি দ্বীপে?”
মৃণ্ময়ী বলে, “নাহ, সময়ের খুব অভাব বুঝলেন”।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার খুব ভাবতে ইচ্ছা করে মৃণ্ময়ীর পাশে বসে থাকার কথা। আমার মনে হয় আমি ওকে অনেক অনেক বছর ধরে চিনি। আমার ইচ্ছা করে ও আমার সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গল্প করুক। মাঝে মাঝে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকুক।আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়না ওর অন্য কারো সাথে বিয়ে হতে পারে। ও কখনও আমার দিকে তাকায়না। কেন তাকায়না আমি জানিনা। একদিন ভেবেছি জিজ্ঞাসা করবো।
মৃণ্ময়ী আমার চিন্তার মাঝে আমাকে বললো, “একটা মজার কথা জানেন। আপনার সাথে না আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।ফুপু বাবাকে বলতো, যদি বাবার কোন মেয়ে হয় তাহলে তার এই দুষ্টু ছেলের সাথে বিয়ে দেবে”।
আমি হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করি, “আমাকে দুষ্টু কেন বলতো মা?”
মৃণ্ময়ী মাথা নেড়ে বললো, “জানিনা তো। আপনাকে দেখে এখন খুব অবুঝ অবুঝ মনে হয়। আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে আপনি কিভাবে এতগুলো বছর একা একা মানুষ হলেন”।
আমি একটু চিন্তা করলাম, তারপর বললাম, “আমি আমার ওই মাকে খুব ভালোবাসতাম। মা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিন স্বপ্নে আসতো। আমাকে অনেক আদর করতো। আমার তখন মনে হতো মা হয়তো বেহেশতে যেয়ে একদম সুস্থ হয়ে গেছে। এখন সে জানে আমি তার একমাত্র আদরের টুকরা। যখন বেঁচে ছিলো তখন তো আমাকে…
আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা। আমার সেই মা কি জানে, আমাকে এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমার নাম কি। তাহলে আমি বলি আমার নাম অন্তু।আমার খুব প্রিয় এই নামটা। মা আদর করে ডাকতো তো তাই।
আমার টেকনাফে খুব অসাধারণ দিন কেটে যাচ্ছিলো। আমার আর যেতে ইচ্ছা করছিলোনা শহরে। ব্যাপারটা কি নাফ নদীর টান, নাকি মৃন্ময়ীকে আরো কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা তা অবশ্য জানিনা। আমি অবাক হই নিজের জন্য মাঝে মাঝে। আমার মনে হয় এভাবে কেমন করে এত অল্প পরিচয়ে মৃণ্ময়ীকে আমার এতোটা ভালো লাগে। একদিন সন্ধ্যায় ওর সাথে হাটতে হাটতে বলি, “তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার কি সত্যি অন্য কারো সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
মৃন্ময়ী নীরব থাকলো বেশ খানিকটা সময়। তারপর মিনমিন করে বললো, “বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সত্যিই”।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “তাকে বিয়ে করার দরকার নাই। তুমি আমার বন্ধু হও। তুমি শুধু আমার সাথে কথা বলো।আর কারো সাথে কথা বলার, মেশার দরকার নাই”।
মৃণ্ময়ী ফিক করে হেসে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু বিয়েটা করতে হবে যে। উপায় নাই আর”।
আমি আমার থেকে সাইজে প্রায় এক ফিট আর বয়সে ৮ বছর ছোট মেয়েটার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে বলি, “না দরকার নাই প্লীজ। আমার সাথে কথা বলার মত আর কেউ নাই”।
মৃণ্ময়ী, লাস্যময়ীর হাসি আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। আমার মনে হয়না সে কখনো ভেবেছে আমার মত কেউ তাকে এমন করে ভালোবাসার কথা বলতে পারে। আমি তবুও প্রতিদিন তার সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলাম। একদিন আমরা ছোট্ট একটি ট্রলারে চড়ে যখন নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে ছিলাম তখন মৃণ্ময়ী আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “আপনাকে বিয়ে করলে তো সমস্যা। আপনি আপনার বাবার মত ভালোবাসার মানুষকে উপেক্ষা করাবেন। তারপর ভেগে যাবেন”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “কথা সত্য। আমার এমনটা করার সম্ভাবনা আছে। আমি যে কাল ঢাকা চলে যাচ্ছি তোমাকে বলা হয়েছে?”
মৃণ্ময়ী মাথা নেড়ে বললো, “না বলা হয়নি”।
আমি নাফের সবুজ জলে নিজের চেহারা দেখার চেষ্টা করছিলাম তখন। কোণ থেকে দেখলাম মৃণ্ময়ীর চোখ ভরা জল। ঠিক এ সময় আমার বুকে হাহাকার চলছিলো। মনে হচ্ছিলো, আমি কেন ছবি আঁকতে পারিনা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার একটা ছবি আকতে পারতাম যখন তার নয়ন ভরা জল থাকবে। এই জল নাফের জল থেকেও পবিত্র হবে।
আমার রুমে যেয়ে যখন গোছগাছ করছিলাম তখন আমি উপলব্ধি করলাম, আমি হয়তো মৃণ্ময়ীর জন্য এই দূর দেশে এসেছি। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে একজন বিশেষ কেউ থাকে, ঠিক একজন। সেই একজনের জন্য সারাটা জীবন অপেক্ষা করা যায়। তাকে ভালোবাসার জন্য হাজার মাইল পাড়ি দেয়া যায়, একাকী সমুদ্রের বুকে দুঃসাহসী নাবিক হয়ে দিবানিশি প্রার্থনা করা যায়।এমন কারো জন্য ভালোবাসাটা কখনো মরে যায়না, চোখের ভাজে তা লেপ্টে থাকে। তাই কেউ তা দেখতে পায়না। শুধু চোখ বুঝলে আমি বা আমরা দেখতে পাই।
গোছগাছ শেষ হলে যখন বাংলোর পাশে মাঠটায় এসে দাড়ালাম তখন খেয়াল করলাম মৃণ্ময়ী কখন থেকে যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে মাথা নিচু করে বললো, “আপনি না দারুচিনি দ্বীপ দেখতে চেয়েছিলেন”।
আমি মাথা নাড়ি, আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকি। ও মিন মিন করে বললো, “আপনি না বলেছিলেন আমি যেন শুধু আপনার সাথে কথা বলি, কাউকে যেন বিয়ে না করি”।
আমি মুখ গোমড়া করে বলি, “বলে তো ছিলাম।বছর খানেক পরে যখন আসবো আবার তখন না হয় দ্বীপটা দেখে আসবো। সেসময় আবার অনেক কথা হবে”।
মৃণ্ময়ী আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইলো। একটু ইতস্তত করে একসময় বললো, “চলে গেলে কথা বলবো কি করে? আর বিয়ে যদি হয়ে যায়?”
আমি ওর হাত ধরে বলি, “এক কাজ করি তাহলে চলো? তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাই”।
মৃন্ময়ী আমার দিকে আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো, “আমার সাথে এমন করছেন কেন? আপনার সাথে আমি কেন পালিয়ে যাবো?আপনি আমার কে?”
উত্তরগুলো কি দেব খুজে পাচ্ছিলাম না।মৃণ্ময়ী, যার সারাটা দিন হাতটা ধরে থাকতে ইচ্ছা করে কোন ভাষায় বলবো যে তাকে আমার কতটা দরকার। শীতের ছোয়া নেই, তবুও আমার সারা শরীর তখন কাপছে। আমি ওর হাত আরো শক্ত করে ধরে বললাম, “কোথাও যাইওনা। পাশে থাকো। যতদিন বাঁচবো ততদিন থাকো”।
মৃণ্ময়ী হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় না। সেও আমার হাত শক্ত করে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলে। অনেকটা নিস্তব্ধতার পর বলে, “আপনারা শহরের মানুষ ভালো না তো। খুব সহজে ভুলে যান কাউকে। আমার সাথে এমন করবেন না তো?”
আমি ওর চোখে হাত দিয়ে বললাম, “চোখের পাতায় থাকবো।আর কোথাও যাবোনা। শহরটা ভালো লাগেনা। তোমার পাশে বসে ঠিক তোমার মত করে নিঃশ্বাস নেবো। নদের ধারে বসে তোমার পায়ের আলতা দেখবো। তোমার মনের কথাগুলো শুনবো খুব মন দিয়ে যদি আহলাদ করে বলো”।
মৃণ্ময়ী আমার হাত ধরে থাকে। ওর গায়ের পবিত্র মানুষটার গন্ধ আমার ভেতরে একজন মানবের উত্থান ঘটায়, পরিপূর্ণ মানব। মৃণ্ময়ী আমাকে বলে, “এখন একটা গল্প শোনাই?আমাদের গল্প?”
আমি যখন টেকনাফের সবুজ পাহাড়গুলোকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছোট্ট করে রাস্তা দেখা যায়। সাথে ছোট্ট কিছু বাড়ি ঘর। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয় নদীর পারের মানুষগুলোর জীবনটাও কি এমনই শান্ত। এই গল্পটা সেই মানুষগুলোর জন্য যাদের সাথে দেখা হয়নি, হয়তো হবে।