অচেনা আপন

অচেনা আপন

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম….

মোবাইল ফোনটা বের করে সময়টা দেখে নিলাম। ৬.২০ মিনিট বাজে। অফিসের প্রয়োজনে আজ নতুন এক শহরে এসেছি। সারাদিনের ক্লান্তি দূর ও ইফতার করার নিমিত্তে একটা দোকানের বেঞ্চে বসে আছি।

অবলোকন করছি নানান মানুষের চলাফেরা, নানান প্রকৃতির চরম বাস্তব দৃশ্যপট। বছরের ১১ টা মাসের চেয়ে এই মাসটা অনেক ভিন্ন। কোরআন ও হাদীসে কিছু পড়েছিলাম এই মাস সম্পর্কে। তাতে মনে হয়েছে অনেক পূন্য ও সম্মানীত এই মাস। বাপ-দাদাদের নিকট থেকে পাওয়া মুসলিম ব্যক্তিরা কিছুটা হলেও সংযমী হবার চেষ্টায় রত থাকে এই মাসে।

চোখ স্থির কয়েক মিনিট ধরে। হোটেলের সামনে ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। কত রকম মানুষ ইফতারি কিনছে। হয়তো একটু পর আমাকেও ইফতারি কিনে রোযা পূর্ণ করতে হবে। এমনিতে বাড়িতে থাকাকালীন গরম ভাত বা পান্তা দিয়ে ইফতারি করতাম। এই অচেনা শহরে কে দিবে পান্তা!

ছেলেটাকে দূরে ফেলে দিলো। এমন একটা দৃশ্য দেখে চোখ ছানাবড়া। মাটিতে লুটিয়ে পড়া ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দোকানদারের দিকে। চোখ ছলছল। কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্রের স্রোত হয়তো বয়ে যাবে দু’চোখ বেয়ে।

সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। ছেলেটার বয়স ১০ থেকে ১২ হবে। ছেলেটা এখনো ইফতার বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার ঘাড়ে হাত রাখলাম। ‘কে ‘ কথাটি উচ্চারণ করে পেছনে ফিরে তাকালো।

– আপনেও বুঝি আমাকে মাটিতে ফেলে দিবেন?
এমন কথার প্রেক্ষিতে কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। ছেলেটা বিষণ্ণবদন চিত্তে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের নিরবতা ভেঙে বললাম,
– দোকানদার তোমাকে ফেলে দিলো কেন?
– ইফতারি বাকিতে চাইছি, তাই।
– বাকিতে কেন?
– আজ সব টাকা শ্যাষ। দাদির ওষুধ কিনছি।

– কেন? তোমার বাবা- মা?
– নাই, বাবারে তো দেখিই নাই। মা ছোটবেলায় মইরা গেছে। দাদিই একমাত্র বাঁইচা আছে। বিছানায় পড়ে কাতরায়। ডাক্তার কইছে ওষুধ আনতে। রোযা আছি, কী খামু রোযা খুলে! ঘরে কিছুই নাই।
– ওষুধ নিয়েছো?
– হ্যাঁ ভাই নিছি। সারাদিন বেঁচা বিক্রি কম হইছে। রমজান মাস, পার্কে লোকজন কম আসে।
– তুমি কাজ করো?
– হ্যাঁ, ফুল বিক্রি করি।

ছেলেটার কথা শুনে মাথা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতুটুকু ছেলে যার কিনা স্কুলে যাবার বয়স,সে পার্কে পার্কে ফুল বিক্রি করে! আর সুশীল সমাজ এমন ছেলে-মেয়েদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় ময়লার মতো ডাস্টবিনে। আমার বিবেক আজ হাহাহাহাহা করে হাসছে।

ছেলেটা কথাটুকু বলে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আমি শুধু অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছি। পরে ঘোর কাটলো, নাহ ছেলেটি চলে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা হাদীস মনে পড়ে গেল, ‘যদি কেউ কোন রোযাদারকে ইফতারি করায় তাহলে সে তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’

– এই ছেলে শোন।
ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
– কিছু বলবেন?
– চলো, তোমাকে ইফতারি কিনে দেই।’ কথাটা শুনে মুখে হাসি ফুটে উঠলো,
– সত্যিই আপনি আমাকে ইফতারি কিনে দিবেন?
– হুম দিবো।

ছেলেটার মুখে হাসি দেখে বেশ ভালো লাগলো। খুশি মনে ইফতারি নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছে। আমিও মনে মনে শান্তি অনুভব করলাম। এদিকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। হোটেলে ঢুকলাম ইফতারি করার জন্য।

কিছুদিনপর আবারো সেই শহরে আসলাম অফিসের কাজে। ততদিনে রমযান মাস শেষ হয়ে গেছে। বেশ গরম অনুভব করছিলাম। শরীরটা জুড়ানো দরকার। একাকি থাকতে বেশ অনুভব করি। ছোট থেকেই একা থাকতে ভালো লাগে।

বসে আছি।
চারদিকে অনেক কপোত-কপোতীরা বেশ রোমান্টিক দৃশ্য সৃষ্টি করছে। নাহ! সেদিকে তাকানো ঠিক নয়।আনমনে মোবাইলে “বাবলস” গেমটা খেলতে শুরু করেছি।
“ভাই”……
ভাই ডাক শুনে মাথা তুলে উপরে তাকালাম। দেখলাম সেই ছেলেটা।
– কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি?
– দিনে আনি, দিনে খাই। বেশ আছি ভাই।
‘এই নেন’ বলে ৫০ টাকা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি আশ্চার্য হলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের টাকা?’
– সেদিন ইফতারি কিনে দিলেন সেই টাকা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাগে মুখটা কালো করলাম।
– টাকা নিয়ে আমি কি করবো?
ছেলেটা বুঝতে পারলো আমি ভীষণ রাগ করেছি। টাকাগুলো আবার পকেটে রাখলো।

অতঃপর দুইটা ফুলের মালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তাহলে এগুলো নেন। ভাবীর খোঁপায় পরিয়ে দিবেন। আর বলবেন আমি দিছি।’
মুচকি হাসলাম।
ছেলেটা আবার তার কাজে মনোযোগ দেয়ার উপক্রম।
আমি ডাকলাম, ‘তোমার নাম কি?’
পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললো, “‘আপন,আমার নাম আপন।’

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত