জনম জনম

জনম জনম

—রিফাত ভাই, রিফাত ভাই। হৃদয় পাগলা আবার রিপা আপার কবরের কাছে আসছে।
— কী? দাড়া আমি এখনই আসছি।
হাতের কাছে কোনো কিছু না পেয়ে মাছ ধরার ট্যাটা নিয়ে বের হলাম। ট্যাটায় নয়টি লোহার কাঠি সূচালো করা। আজ হৃদয় পাগলার কপালে শনি অাছে। মাস খানেক আগেও এই ট্যাটা দিয়ে সাড়ে নয় কেজি ওজনের এক মাগুর মাছ ধরেছি। আজ হৃদয়কে মাগুর মাছ মনে করেই ট্যাটা বিঁধিয়ে দিব। ওর কত বড় সাহস সে এখনো রিপার কবরের কাছে আসে।

আশে পাশে কাউকে পাইনি। হৃদয় পাগলা মনে হয় পালাইছে। রিপার মারা যাওয়ার জন্য হৃদয় দায়ী। আর ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে পাগলের অভিনয় করে বেড়ায়।
এলাকার পঞ্চায়েত আরো বেশি অবিচার করেছে আমাদের প্রতি। হৃদয়কে কিছু করলনা। হৃদয়ের বাবা বলল হৃদয় পাগল হয়ে গেছে, অার পঞ্চায়েত সেটাই মেনে নিয়ে উল্টো বিচার করে দিল। হৃদয় নাকি এই বিষয়ে কিছু জানেনা। অথচ এলাকার ছোট বড় সবাই জানে হৃদয় আর রিপার কথা। আর এখন পাগল সেজে হঠাৎ হঠাৎ রিপার কবরের কাছে এসে ঠোট নেড়ে কি যেন বলে। চাচির অনুরোধে রিপার লাশ এখানে কবর দেয়া হয়েছে। একটি মাত্র মেয়ে চাচার। আর তাইতো চাচি আমগাছের সাথে মাথা হেলান দিয়ে রিপার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটা দিন শুধু বজ্জাত হৃদয়টারে পেয়ে নেই। ওর কপালে সত্যি সত্যি খারাপ আছে।

রিপা অামার অাপন চাচাত বোন। ভালবাসত খাঁন বাড়ির পোলা হৃদয়কে। অবশ্য রিপাকে হৃদয়ই প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল।
আমি মনে মনে রিপাকে পছন্দ করতাম। খেয়াল রাখতাম যেন অন্য কোনো ছেলে রিপার ভালোবাসায় না জড়ায়। কিন্তু খাঁন বাড়ির হৃদয় রিপার পিছু নিত।
শাকিল এসে একদিন বলল, “রিফাত ভাই, আপনার রিপার দিকে খাঁন বাড়ির হৃদয় হাত বাড়াইছে। ”
কথাটা শোনার পর মাথায় রক্ত উঠে গেল। তাড়াতাড়ি করে চার বন্ধু নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি হৃদয় রিপার সাথে হেটে হেটে কথা বলছে। রিপা তখন প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিল। আমি গিয়ে পথ আগলে দাড়ালাম। “এই রিপা, হৃদয় তোরে পথে ঘাটে বিরক্ত করে। তাইনা? ”
— না, বিরক্ত করবে কেন? ওতো এমনিতেই আমার সাথে কথা বলছে।
— এমনিতে তোর সাথে তার কিসের কথা? এই হৃদয় এদিকে আয়, তোর সাথে কথা আছে।
বলেই হৃদয়ের কাঁধে ধরে রিপার কাছ থেকে নিয়ে আসতে লাগলাম। রিপা সম্ভবত দাড়িয়ে আছে। হৃদয়কে বলছি, “কাল থেকে রিপার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করবিনা।”
— কেন রিফাত? আমি রিপাকে ভালোবাসি, যোগাযোগ করবনা কেন?
শুনেই মাথায় রক্ত উঠে গেছে। জোরে চড় বসিয়ে দিলাম গালে।
— কী বললি তুই?
— তুমি রিপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করো, সেওতো আমাকে ভালোবাসে।
কথা শুনে এবার মনটাই ভেঙ্গে যাচ্ছে। ডেকে এনে প্রশ্ন করলাম রিপাকে,
— তুই হৃদয়কে ভালোবাসিস?
রিপা একবার অামার দিকে আরেকবার হৃদয়ের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।
ছেলে খারাপ হতে পারি তবে বিবেকহীন না। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। সেখানে আমার একতরফা ভালোবাসা অবশ্যই মূল্যহীন।

চাচা রিপার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। রিপা আর হৃদয়কে এলাকার মানুষ এখানে সেখানে কথা বলতে দেখে।
একটা মেয়ের জন্য বিষয়টা মোটেই ভালো নয়। রিপাকে শাসন করার লক্ষে হৃদয়ের সাথে মিশতে বারণ করেছিল। হৃদয় বাড়ি অবদি চলে এসেছে রিপাকে না পেয়ে। চাচা আর চাচাত ভাই সুমন আর অামি ছিলাম উপস্থিত। সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলে দিছি, রাস্তা ঘাটে এভাবে কথা বলা যাবেনা। তুমি তোমার পরিবার থেকে প্রস্তাব পাঠাও, আমরা কথা বলব তোমার বাবা মায়ের সাথে।
এর এক সপ্তাহ পর রিপাকে যখন ঘরে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। তখন জানতে চেয়েছি, কি হয়েছে তোর?
তখন বলল, হৃদয়ের বাবা বলেছে রিপাকে খাঁন বাড়ির পুত্র বধূ করতে পারবেনা।
এই খবর শুনেই চাচা জিদ করে দুদিনের ভিতর রিপার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। চাচা প্রচন্ড রাগী মানুষ। অামিতো ঘাড় সোজা করে চাচার সামনে কথাই বলতে পারিনা। তবুও আমাকে চাচা বলল, হৃদয়কে এই বাড়ির অাশেপাশে দেখলেই যেন তার হাত পা ভেঙ্গে দেই।

রিপা অামার হাত ধরে কান্নাকাটি করছে।
“রিফাত ভাই, তুমি অামার হৃদয়কে এনে দাও। তাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। অামি হৃদয়কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবনা। ”
পাগলিটারে আমিওতো ভালোবাসি। তাই তার চোখের পানি সহ্য করার মতো শক্তি পাচ্ছিনা। শেষে বলেই দিলাম, অাচ্ছা ঠিক আছে। তোর হৃদয় যদি তোকে ভালোবাসে তাহলে সে অাসবেই। আমি হৃদয়কে অাসতে বলব। রাতের অন্ধকারে তোরা অনেক দূরে চলে যাবি। যেখানে কেউ তোদের ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাড়াবেনা।

হৃদয়কে খবর দিয়ে তেতুলতলা নিয়ে এসেছি। যখন বলেছি, “আমি তোমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করব”
হৃদয় আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। অবশ্য হৃদয়ের জায়গায় অামি থাকলেও একই কাজ করতাম।
নতুন করে অারেকটা চিন্তা যোগ হল। চাচা যদি কোনোভাবে জানতে পারে যে অামি রিপাকে পালাতে সাহায্য করেছি, তাহলে আমাকে জবাই দিবে।

হৃদয়কে বলে এসেছি তেতুল তলায় রাত বারোটার পর চলে আসতে। আমি রিপাকে সাথে করে তেতুল তলা নিয়ে যাব। সবাই কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর আমি টিউবয়েলের পাশ দিয়ে বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে রিপাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। মোটামোটি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছি, শুধু চাচার কথা মনে হলেই বুকের ভিতর মোচড় মারে।

সেই রাতে আর হৃদয় অাসেনি। আমি রিপাকে নিয়ে গভীর রাতে তেতুল তলা বহু সময় অপেক্ষা করেছি। হৃদয় আর রিপাকে নিতে আসেনি। শেষে আমিই রিপাকে বুঝালাম, “হৃদয়তো আসেনি, এখানে আর দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। তাহলে ঐ বিয়েটাও আর হবেনা।”
রিপা আচলে চোখ মুছতে মুছতে আমার আগেই বাড়িতে রওনা দিল। আমিও হাটছি আর ভাবছি, হৃদয় কাজটা ঠিক করেনি। রিপা এখন কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজাবে। অন্যের বউ হয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু মনটা পড়ে থাকবে হৃদয়ের কাছে।

সকালে অশ্রুভেজা চোখে রিপার লাশ বের করেছি ঘর থেকে। গতরাতে রিপা বাড়িতে এসে ওর রুমে গিয়েছিল। রাতেই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়েছে। কেউ খবর পায়নি, সকালে চাচি অনেক ডাকাডাকি করেছিল রিপাকে। সাড়া শব্দ না পেয়ে আমরা কাঠের দরজাটি ভেঙ্গে ফেলি। নির্বাক নয়নে জল ফেলা ছাড়া কোনো করার ছিলনা।
রিপা তার ভালোবাসার মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেনা বলে চলে গেছে দুনিয়া ছেড়ে।
হৃদয় বজ্জাদটা পাগলের ভান ধরে অাছে। ওকে যদি আরেকবার রিপার কবরের কাছে আসতে শুনি তাহলে ওকে অামি খাইছি।

হৃদয় পাগলারে দৌড়াইচ্ছি। বহুদিন পর তারে পাইছি। আমার হাতে নয় কাঠির ট্যাটা। আজ হৃদয়ের পাগলামি বের করে ছাড়ব।
হৃদয়ের দেড় বছরের ছোট ভাইটা আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে থামাইছে। তারপর পায়ে ধরে বসে আছে।
—রিফাত ভাই, আপনি হৃদয় ভাইয়ের কিছু করবেন না। হৃদয় ভাইয়ের কোনো দোষ নেই।
— কোনো দোষ নেই মানে? তুই কী জানোস?
— আমি সব জানি ভাই। হৃদয় ভাই যে রিপা অাপাকে নিয়ে পালানোর কথা ছিল সেটা অামি জানতাম।
— তাহলে হৃদয় সেই রাতে যায় নি কেন?
— “আপনি হৃদয় ভাইকে যখন তেতুল তলা দাড়িয়ে বলেছিলেন আপনি ওদের পালাতে সাহায্য করবেন। তখন বড় চাচা সেদিক দিয়ে আসতেছিল। বড় চাচা এসে বাবাকে সব বলে দেয়। হৃদয় ভাই যখন বাড়িতে আসছে তখন বাবা তাকে স্টোর রুমে তালা মেরে রেখেছে। তাই হৃদয় ভাই সে রাতে তেতুল তলা যেতে পারেনি”
কথাগুলো শুনে হাতের ট্যাটা নিচু করলাম। আবার জানতে চাইলাম, “তোর ভাই পাগলের ভান ধরল কেন?
— রিফাত ভাই আপনি বিশ্বাস করেন, হৃদয় ভাই সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। পরদিন বিকেলে যখন স্টোর রুম খুলল, হৃদয় ভাই দৌড়ে আপনাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। যখন দেখল রিপা আপার লাশ নিয়ে আপনাদের বাড়ি থেকে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে আর মানুষজন বলাবলি করছে রিপাটা হৃদয়েই জন্যই মরে গেল। তখন থেকেই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ি ফিরল হৃদয় ভাই। এর পর থেকেই হৃদয় ভাই পাগল।

ট্যাটা হাতে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি। আমি নাকি রিপাকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসা কি সেটা হৃদয় আর রিপা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। কিছু কিছু ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করা যায়না। আলাদা করতে গেলে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই ঘটে। ভালো থাকুক ভালোবাসাগুলো।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত