সেদিন শুক্রবার ছিল। শুক্রবারে আমি ঘর থেকে বের হতাম না। সেদিন সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি করতাম। মাঝে মাঝে ছাদে উঠে ফুল গাছে পানি দিতাম। সেদিনও আমি ছাদে উঠলাম গাছে পানি দেয়ার জন্য। হঠাৎ আমার মা হন্তদন্ত হয়ে ছাদে উঠলেন।
— কি ব্যাপার মা কি হয়েছে?
— আবির একটু দোকানে যা। আমার স্কুল জীবনের এক বান্ধবী তার মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে। তুই চট করে দোকান থেকে কিছু নিয়ে আয়।
আমি কোন কথা না বলে দোকানে চলে গেলাম। তারপর যথারীতি কিছু নাস্তা জাতীয় জিনিস এনে আম্মুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তখনই আম্মু বলে উঠলো,
— কিরে তুই কি আদব কায়দা সব ভুলে গেছিস?
আম্মুর কথা শুনে আমি যথেষ্ট অবাক হলাম। আদব কায়দার খেলাপ হয় এমন কোন কাজ আমি করেছি কিনা ভাবতে লাগলাম।
— আম্মু আমি আবার কি করলাম?
— ঘরে মেহমান এসেছে। তুই তাদের সাথে গিয়ে দেখা তো করবি।
— মা আমি দেখা করে কি করবো? আমি উনাদেরকে আগে কখনো দেখিনি। গিয়ে কি বলবো?
— কি বলবি মানে? গিয়ে সালাম দিবি। কেমন আছে জিজ্ঞেস করবি। যা গিয়ে সালাম দিয়ে আয়।
আম্মুর কথার উপর আর কোন কথা বলা যাবে না। বললেই এখন আম্মু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন। তাই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও গেলাম বসার ঘরে। ঘরে ঢুকেই আমি সালাম দিলাম। আমার আম্মুর বান্ধবী মানে আন্টি আমার সালামের উত্তর দিলেন। তারপর কিছুক্ষন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
— তুমি আবির না?
— জ্বী আন্টি।
— কত্ত বড় হয়ে গেছো তুমি! কিছুদিন আগেও দেখেছি হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো বসো।
আমি বসে পড়লাম। আমার জানামতে আমি ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলাকে ভয় পাই। একদিন বাবার সাথে বসে ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। ব্যাটিং করছিলেন বোধহয় সৌরভ গাঙ্গুলি। উনি সামনে এগিয়ে এসে ছক্কা হাঁকালেন। বল গিয়ে পড়লো গ্যালারিতে বসে থাকা এক টাক মাথার অধিকারী লোকের মাথায়। সাথে সাথে মাথা ফেটে রক্ত বের হলো। এই দৃশ্য দেখার পর থেকে ক্রিকেট খেলা বা দেখা থেকে দূরে থেকেছি। কিন্তু এই আন্টি বলছেন উনি নাকি আমাকে হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে দেখেছেন।
— তো আবির এবার কিসে পড়ছো?
আমি প্রথমে আন্টির প্রশ্নটা ধরতে পারলাম না। তাই আমি বললাম,
— জ্বী আন্টি?
— কিসে পড়ো এবার?
— এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি আমি।
— কোন গ্রুপ নিয়ে পড়ছো?
— জ্বী আন্টি কমার্স।
আমার মুখে কমার্স শুনে আন্টি চমকে গেলেন বোধহয়। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। এরই মধ্যে আম্মু নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আম্মু নাস্তা সবার সামনে রাখার পরপরই আন্টি আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
— জেএসসিতে কি এসেছিল তোমার?
— জ্বী আন্টি A+।
— তাহলে তুমি কমার্স নিলে কেন? সাইন্স নিলেই তো পারতে। জানো তো সাইন্সের স্টুডেন্টদের ভবিষ্যৎ ব্রাইট হয়।
আমি মাথা চুলকালাম। কমার্সের স্টুডেন্টদের ভবিষ্যৎ তাহলে অন্ধকার? আজকেই প্রথম শুনলাম। আমার নানী বলতো আমার আম্মু নাকি স্কুলের মেধাবী ছাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন। সবসময় প্রথম অথবা দ্বিতীয় হয়েছেন ক্লাসে। আমি যখন জেএসসির রেজাল্ট পাওয়ার পর আম্মুকে বললাম আমার কমার্স নিয়ে পড়ার কথা তখন আম্মু বলেছিল তোর যা ইচ্ছে তা নিয়েই পড়।
তখন কেন আম্মু বললো না যে সাইন্স ছাড়া অন্য গ্রুপের স্টুডেন্টদের ভবিষ্যৎ উজ্জল না। আম্মুর উপর রাগ হচ্ছে খুব।
— কিরে মাফু তোর ছেলে তো ভাল স্টুডেন্ট, তারপরেও সাইন্স না নিয়ে কমার্স কেন নিতে দিলি?
আন্টি প্রশ্নটা আমার আম্মুকে করলেন। আম্মু হাসতে হাসতে বললেন,
— ওর ইচ্ছে হয়েছে তাই নিয়েছে। ও যেটা নিয়ে পড়ে আনন্দ পায় ও সেটা নিয়েই পড়ুক। ও চেয়েছে কমার্স নিয়ে পড়বে তাই আর আমি জোর করিনি।
আম্মুর উত্তরটা হয়তো আন্টির পছন্দ হয়নি। উনি আপেলের একটা টুকরো মুখে পুরে দিয়ে আম্মুকে বললেন,
— এটা কি বললি তুই? তোর সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবি না তুই? জানিস কমার্সের স্টুডেন্টদের জব পাওয়া কতো সমস্যার ব্যাপার? তুই তো নিজ হাতে তোর ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছিস। আমার মেয়ে তো প্রথমে মানবিকে ভর্তি হতে চেয়েছিল। আমিই ওকে জোর করে সায়েন্সে ভর্তি করিয়েছি। নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎটা নিশ্চিত করাটা আমার দ্বায়িত্ব।
আমার আর বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। তাই আমি উঠে চলে আসছিলাম। তখন আম্মু বললো,
— আবির কি ছাদে যাচ্ছিস?
— জ্বি আম্মু।
— তাহলে অরিত্রীকে নিয়ে যা সাথে করে। ওকে তোর ফুলের গাছগুলো দেখিয়ে আন।
অরিত্রী হচ্ছে আন্টির মেয়ের নাম। আম্মুর কথায় আন্টিও সম্মতি দিল। তখন আমি অরিত্রীকে নিয়ে ছাদে আসলাম। আমি গাছে পানি দিচ্ছিলাম আর অরিত্রী দাঁড়িয়ে দেখছিল। তখন আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,
— তুমি কিসে পড়ো?
— ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।
— পড়ালেখা কেমন চলে?
— ভাল না ভাইয়া। সায়েন্স নিয়ে পড়তে আমার মোটেও ভাল লাগে না। শুধুমাত্র আম্মুর ভয়ে সায়েন্স নিয়েছি। আমার ইতিহাস পড়তে অনেক ভাল লাগে। কিন্তু আম্মুর কারনে এই রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, হায়ার ম্যাথ হাবিজাবি পড়তে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আপনার পড়ালেখা কেমন যাচ্ছে?
— ভালই।
এবার আমি বুঝতে পারলাম আমার আম্মু কেন আমাকে সায়েন্স নেয়ার জন্য চাপাচাপি করেননি। আমি এখন কমার্সের সবকিছুই আনন্দ নিয়ে পড়ছি। আমার পড়তে এখন ভাল লাগছে। হিসাব বিজ্ঞানের একেকটা সমস্যার সমাধান করে আমি আনন্দ পাচ্ছি। কিন্তু যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবা মায়ের চাপে পড়ে সায়েন্স নিতাম তখন কি এই আনন্দ পেতাম?
সন্ধ্যার একটু আগে আন্টি অরিত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষন পর পড়তে বসলাম। আধাঘন্টা পরেই আম্মু এলেন আমার ঘরে। আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— কিরে পরীক্ষা শুরু কবে থেকে?
— সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু মা।
— প্রস্তুতি কেমন?
— মোটামুটি মা। পাস করতে পারবো মনে হয়।
— পাস করতে পারলেই হলো। নুডুলস খাবি?
— কতক্ষন লাগবে রান্না হতে?
— আধাঘন্টা লাগবে।
— আরেকটু আগে হবে না?
আম্মু আমার মাথার চুলগুলো অগোছালো করে দিয়ে হাসতে হাসতে উঠে গেলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম ক্যালকুলেটর দিয়ে লাভ ক্ষতির হিসাব মেলাতে।
ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নাকি ঝাঁপসা তা ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে আমি আমার বর্তমানকে উপভোগ করছি। এটাই বা কম কিসের?