ষোলোমনা

ষোলোমনা

বিয়ের আগে শুনেছিলাম পাত্রী হাজারে একখান। সে মেকাপ করে না। সাজুগুজুতে একদম উদাসীন। পানির মতো সরল। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। ফেসবুক একাউন্ট নেই!

দুনিয়ায় সব রান্না তাঁর হাতের তুড়ির ব্যপার মাত্র। একদম সেকেলে। সেলোয়ার-কামিজ শাড়ি আর বোরকার মধ্যেই সে সীমাবদ্ধ।
এসব শুনে তো চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে ফেললাম। এরকম একটা মেয়ে পেলে জীবনে আর কী লাগে? আজকাল এমন মেয়ে পাওয়া মানে হাজার তাঁরার মাঝে একটি মাত্র চাঁদকে নিজের করে পাওয়া।

কিন্তু বিয়ের পরে বুঝলাম হাতে চাঁদ নয়। আরব দেশের তাপবিশিষ্ট সূর্য পেয়েছি! তাঁর এত আগুন, এত গরম!
যা শুনেছিলাম ভদ্র মহিলার ব্যাপারে সব মিথ্যা! সে মেকাপ করায় সোনম কাপুর! সাজুগুজু ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না! সাপের মতো আঁকাবাঁকা। গলায় সাত রাজ্যের জোর! বকবকানিতে বক পক্ষী তাঁর অনেক পিছনে! কয়েক ডজন নিজের ফেসবুক একাউন্ট সহ দশটা ছেলেদের একাউন্ট আছে! এগুলোকে ফেইক একাউন্ট বলে আরকি!
আর রান্নায় সে তো কেকা অবন্তী ফেরদৌসী আপুরও অনেক আগে!

ক্লান্ত হলে সে আপনাকে বিশেষ এক ধরণের শরবত খাওয়াবে! চা পান করার সাথে সাথে আপনার সমস্ত ক্লান্তি ছুটে যাবে। জ্বী, সেটা হলো নুডুলসের চা! প্রথম প্রথম এভাবে চা দিলে তো চোখ বন্ধ করে বলে দিতাম।

“ এটা কী বানিয়েছো তরী? এত ভাল চায়ের শরবতও যে পৃথিবীতে কেউ বানাতে পারে আমার জানা ছিলো না! ”
এই কথার কারণে ছাই রোজ এখন গলার সাথে যুদ্ধ করে গিলে যাই এই বিশেষ ক্লান্তি কাটানোর শরবত! কর্মস্থলে বাঘের মতো চলা লোকটা ঘরে এসে বিড়ালের মতো হয়ে যাই!

সে সকালে গান ধরবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় নাকি বিটিবির এন্টেনা নষ্ট হয়ে গেছে! সিগনাল খুঁজে পাচ্ছে না। তাও বুঝি না! ভদ্র মহিলারা তিন বেলা খায়। উনি তিন বেলা গোসল করেন! প্যারাসিটামলের মতন তিন বেলা খাওয়ার পরে গোসল না করলে যে তাঁর পেটের ভাত হজম হয় না! মেয়ে মানুষ ঠোঁটে লিপস্টিক দিলেও আধঘন্টা সময় নেয় আর সে এমনি এমনি তিনবেলা গোসল করবে? মোটেও না! তার পিছনে একটা কারণ আছে। কারণটা হলো তিন বেলা গোসল করলে নাকি পেটের মেদ বাড়ে না! মোটাতাজা হওয়ার জীবানুগুলো দেহ থেকে পানির সাথে বেড়িয়ে যায়!

এসব ডাক্তারি কথা সে কীভাবে বলে তা আমি জানি না। শুধু জানি ভদ্রমহিলা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন!
ভদ্রমহিলার একটা শখ আছে। বাগান করবেন। তবে ফুলের নয়, খরগোশের! খরগোশ তাঁর খুবই প্রিয়! কিন্তু তাঁর পোশা খরগোশ তেরো দিনের বেশি টিকে না! মারা যায়! এই একটা মাত্র তাঁর দুঃখে আমি দুঃখিত হই!

তাছাড়া ভদ্র মহিলার সব দুঃখ আমাকে আনন্দ দেয়! ভদ্র মহিলার পোশাকের ভাঁজ, স্টাইল আর ফ্যাশন দেখে কেউ দার্শনিক না হয়ে পারবে না! তবে আমি মনে হয় আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবো না।

নাহলে বাংলা আরেকজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের সন্ধান পেয়ে যেত! এটা অবিশ্বাস্য কিছু না। ব্যাখ্যা করছি।
একদিন তাঁর এক বান্ধবীর বিয়েতে যাব। আমাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে। আমি বারোটায় গাড়িতে উঠে বলেছিলাম বাসায় আসতে আমার চার ঘণ্টা লাগবে এর মধ্যে ভেবে রাখতে আমরা কী উপহার নিয়ে যাচ্ছি।

যথারীতি রাস্তায় জ্যাম! সেজন্য বাসায় পৌঁছালাম সন্ধ্যা সাতটায়। ভদ্রমহিলার বোধহয় খেয়ালই নেই এখন কটা বাজে!
আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ানো অবস্থায় গিয়ে বললাম।
“ চলো উঠো, আর কী নেব ঠিক করেছো? ”
“ হুম, একটা দারুণ বুদ্ধি পেয়েছি। বান্ধবীকে গিয়ে বলবো তোর বিয়েতে আমরা কিছু দিব না। তুইও আমার বিয়েতে কিছু দিস না! ”
আমি তাঁর দিকে একটু অকপটে চেয়ে বললাম।
“ আপনি অবিবাহিত? ইশ, আগে জানলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম আপনার বাসায়! ”
সে ভুলেই গেছে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছে! এমন একজন ভদ্র মহিলার সঙ্গে বসবাস করেও কেউ যদি দার্শনিক না হতে পারে তবে সে শরৎচন্দ্র হওয়ার যোগ্যতা তো রাখেই!
যে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজেকে কুমারী ভাবে!
মাঝে মাঝে হতাশ এবং মাঝে মাঝে কৌতূহলবশতই জিজ্ঞেস করি।
“ আচ্ছা, তোমার এত ফেসবুক একাউন্ট কেন? ”
“ একটা আইডি পাহারা দিতে হয়। বিয়ের পরে বরের সব পাহারা দিয়ে রাখার দ্বায়িত্ব বৌয়ের! ”
অথচ আমার একটা মাত্র একাউন্ট! একটা একাউন্ট পাহারা দিতে ডজনখানেক একাউন্ট লাগে! তবুও আমি বেশি শক্তিশালী মানে না!

বিয়ে করলেন মানে ভ্যানগাড়িতে উঠলেন।
ঝাঁকুনিঝুঁকুনি খেয়ে খেয়ে সারাজীবন পার করতে হবে!
মানুষ যে বিয়ে এত মজা মজা বলে। সে মজা অন্যের বিয়েতে। নিজের বিয়েতে শুধু কনেই মজা করে! ঐ ফটু তুলা থেকে শুরু করে বাসর রাত পর্যন্ত। ছেলেদের সেদিন থেকে দেয়া শুরু হয়ে যায়। কনেরা শুধু নিতে থাকে।
আলমারি, শাড়ি চুড়ি ভালবাসা আর মাঝে মাঝে দুঃখ!
এইযে এত কষ্ট পেয়েও ফেসবুকে একটাবার এই বলে পোষ্ট দেই না।
“ কষ্টে আছি প্রচন্ড, প্রচন্ড চাপে আছি! ”
অথচ সে রোজ তাঁর তিনটা আইডিতে চারবার করে পোষ্ট দেয়।
“ বুড়ার খেদমত করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছি! তোমরা বোন কেউ বিয়া করিও না! বিয়ের পর কী যে জ্বালা! রান্না করো, কান্না করো, ধুয়াপালিশ করো অবশেষে মালিশ করো! ”

এসব দেখেও আমি বেঁচে আছি!
আমার, শুধুই আমার। আমার একান্ত ডায়েরিটাও এখন আমার নেই। মন খুলে দুয়েকটা কথা সাদা পাতার সাথেও বলতে পারি না!
ভেবেছিলাম একটা বাবু আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ বাবু আসার পরে তাঁর পাওয়ার, শক্তি, ক্ষমতা আরো বেড়ে গেলো। বাবু হয়ে গেলে ভদ্র মহিলারা তো দলীল করে একটা কথা পেয়ে যায়!
“ ওহ, এখন আমাকে আর ভালো লাগবে কেন? আমি তো বুড়ী হয়ে গেছি। মোটা হয়ে গেছি! ”
সেদিন ঝগড়ায় ঝগড়ায় বললো।
“ তুমি বাইরে সবচেয়ে বেশি কোন মেয়ের সাথে সময় কাটাও? ”
“ শাবনূরের সাথে। ”
“ কেন এতো ওকে পছন্দ করো? ওর সাথে এত কথা বলো? সহকর্মী হলেই কী এত কথা বলতে হবে? ”
“ সে শাড়ি পড়ে, কথা বলে কম! ”

আজ এগারো দিন হয়ে গেলো তরী আমার সাথে কথা বলছে না! বারবার একেরপর এক শাড়ি খুলছে আর পড়ছে!
শাড়ি পড়ার অভ্যাস না থাকলে যা হয় আরকি! কুচির এক প্যাঁচ কুষ্টিয়া আরেক প্যাঁচ কিশোরগঞ্জ! এই বাঁকাবোকা শাড়ির কুচিতেই ভদ্র মহলিটাকে ভালো লাগে! দেখলাম সে নিজের উপর খুব বিরক্ত!
কাছে গিয়ে বললাম।

“ বিমান এয়ারলাইনসের মেয়েরা ভালো করে শাড়ি পড়তে পারে। শাবনূরকে খবর দেই? এসে সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে যাক! ”
এ মেয়ে দেখছি শাড়ি খুলে আমার গলায় প্যাঁচ দিয়েছে! নড়তে পারছি না!
“ কুত্তা, হারামী, তুই এক্ষুনি ঠিক কর শাবনূর না আমি? নাহলে আজকেই তুই শেষ! ”
আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম।
শেষ হয়েই যেতে চাইলাম। বললাম।
“ শাবনূর! ”
মেয়েটা আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। টুপ করে তাঁর দুয়েক ফোঁটা চোখের জল আমার মুখে পড়লো! বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। মনে হলো মেয়েটার আরেকটা খরগোশ মারা গেছে মাত্র!

তাঁর দুঃখে দুঃখ পাওয়া আমার কথা না! তবুও এই দুই ফোটা চোখের জল আমাকে খুব কষ্ট দিলো। অনেক পোড়ালো।
ভেবেছিলাম হয়তো ইচ্ছে করেই গলায় টিপে ধরবে। বকাবাধ্য করবে। বলবে খুন করে ফেলব। তোর ভাত খাব না। অথচ, দুই ফোঁটা চোখের জলেই আমাকে মেরে ফেললো!

খুব ভারী গলায় সে বললো।
“ তাহলে ওকেই বিয়ে করে আনো না। তোমাদের দুজনের বনবে ভালো। তুমি যেমন চাও সে তাই। সে যেমন চায় তুমিও তাই। ”
এই একটা কথার মাঝে এত দুঃখ থাকে! চোখের সামনে কেউ না বললে বুঝতাম না! বাবু হওয়া ছাড়া এই প্রথম তরীর চোখে পানি! ভালো লাগছে। যদিও না নিতে পারছি মানি!

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত