“অধিকার”

“অধিকার”

গত রাতে মিলি আমাকে বলল কাল ৯ অক্টোবর। আমি বোকার মত হাসি দিয়ে বললাম , জানি। এরপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম ।সকালে উঠে খেয়াল করলাম আমরা যেভাবে শুয়েছিলাম সেভাবেই এখনো শুয়ে আছি। এটাকে প্রতীকী বলা যেতে পারে। গত ২৫ টা বছর আমরা দুজন এভাবেই একজন আরেকজনের সাথে ছিলাম । একটি মুহূর্তের জন্যও কেউ কাউকে ছেড়ে যাই নি। কখনো হয়তো ছেড়ে গিয়েছি কিন্তু কেউ কখনো সেটা বুঝতে চাই নি কিংবা বুঝতে দেই নি।

আমাদের কোন কিছুতে বাড়াবাড়ি নাই। মিলি জানে কাল যেকোন সময় তার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। আর আমিও জানি মিলি আমার জন্য এমন কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছে যার কথা আমি ভাবিই নি কখনো। মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ থেকে ২৫ বছর আগে। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী।বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের কোন আয়োজন নাই। ইদানীং তো সব কিছুতে সবাই কিছু না করুক একটা কেক হলেও কাটে । যেন কেকেই নিহিত আছে সব মঙ্গল !

মিলি আমার অফিসের কলিগ ছিল । মাত্র ১ বছরের পরিচয়ের মাথায় আমরা বিয়ে করেছি। যদিও মিলির সিদ্ধান্ত ছিল সে জীবনে কোনদিন বিয়েই করবে না । এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার যুক্তি ছিল। শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য আর বিয়ে করতে হবে এজন্য বিয়ে করতে হলে সে জীবনেও বিয়ে করবে না।

আমি বললাম, সমাজে বসবাস করতে হলে সমাজ মানতে হয় । মিলি আমাকে বলেছিল, আমার জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমার কথা আমাকে শুনতে হবে । আমার জীবনে আমার গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। আই এম দ্যা ডিকটেটর অব মাই ওন লাইফ।

মেয়েটার সাথে কখনোই কথা বলে পারা যায় না। ভীষণ রকম জেদী আর একটু অন্যরকম। তবে ওর কথাগুলোকে মিথ্যা বলা যায় না।ওর আচরণের একটা নমুনা দেয়া যাক।

একবার মিলির এক চাচা একটা পাত্র খুঁজে আনল। ছেলে লন্ডনে ব্যারিস্টারি শেষ করে এসেছে। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক।ঢাকায় ছেলের বাবার বিরাট ব্যাবসা। কয়েকটা বাড়িও আছে ঢাকায়। বিয়ের পর মিলিকে সে লন্ডনে নিয়ে যাবে।
তখন মিলিকে তার বাবা বলল , মা , এবার বিয়েটা কর। তোর জমির চাচা ভালো একটা পাত্র নিয়ে এসেছে।
মিলি তার বাবাকে বলল , বাবা, সে তোমার মতে ভালো পাত্র হতে পারে কিন্তু ভালো মানুষ কিনা সেটা খুঁজে দেখেছো? ছেলেদের টাকা দেখলে তোমাদের কি আর কোন হুঁশ থাকে না?
মিলির বাবা মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল , দেখ , বেঁচে থাকতে হলে টাকা পয়সার দরকার আছে।
মিলি বাবাকে বলল , বাবা, আমার টাকা পয়সার দরকার নাই ।
মিলির বাবা বলল , তুই আসলে কি চাস?
মিলি বলল , বাবা আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই যে আমাকে কিনতে আসবে না । তুমি যখন মাছ বাজারে যাও একটা জিনিস খেয়াল করেছো ?
মিলির বাবা বললেন , কি ?
মিলি বলল, সব মাছ দোকানদার তোমার অপেক্ষায় থাকে। কারণ তুমি বেশি দাম দিয়ে সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে নিবে। দেখবে বলছে , স্যার , আপনার জন্যই এই মাছটা রাইখা দিসি । মনে হয় তুমি তাদের কত আপনের আপন। সব টাকা পয়সার খেলা।যার টাকা আছে সেই সব।

বাবা বললেন, কি যা তা বলছিস! এসব নিয়ে এত ভাবার কি আছে ?
মিলি বলল, শুনো বাবা, আমি একটা ব্যাংকে চাকুরী করি , আমি আমার মত কাউকেই বিয়ে করব ।লেভেল প্লেইয়িং ফিল্ড বলে একটা জিনিস আছে , বাবা। আমি বিল গেটসের ছেলে চাই না ।

মিলির বাবা নাকি এর পর হাল ছেড়ে দেন।মেয়েকে বলেন তোর যাকে ভালো লাগে বিয়ে করিস।
এক অফিসে চলতে চলতে আর মেন্টালিটি এক রকম হওয়াতে আমরা প্রায় আড্ডা দিতাম । আস্তে আস্তে মিলির সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক হয়ে যায় ।একদিন মিলির বাবা আমাকে আর মিলিকে এক সাথে একটা রেস্টুরেন্টে দেখে ফেলেন। তিনি বাসায় গিয়ে মিলিকে বলেন , ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে। মিলি আমাকে ব্যাপারটা জানায় কোন ভণিতা না করেই। আমি বললাম, আমার আপত্তির কি আছে। আমি অনেক আগে থেকেই রাজি এটা তুমিও জানো। হৃদয় বিষয়ক কোন কিছু মেয়েরা খুব দ্রুত ধরে ফেলতে পারে।

মিলি সেদিন অনেক সুন্দর করে একটা হাসি দিয়েছিল। তখন স্মার্টফোন ছিলই না। আমার বাসায় একটা ফিল্মের ক্যামেরা ছিল। আগে জানলে ক্যামেরাটা নিয়ে আসতাম । এই হাসিটার একটা ছবি তুলে রেখে দিতাম আমি। অবশ্য সব কিছু ছবি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ছবি দিয়ে মনেও রাখা যায় না। মনের ভেতর যে ছবিটা আঁকা হয় সেটা কখনো নষ্ট হয় না। এখন অনেক ছবি তোলা হয় আর তার সবই জমা থাকে স্মার্টফোনের গ্যালারিতে। মনের গ্যালারিতে এত রাখার এত সময় কই ? মনের গ্যালারি থেকে ডিলিট করার সুযোগ থাকে না। এখন তো সবাই ডিলিট আর ইডিটের নেশায় মত্ত।

আমাদের বিয়ের সময় প্রথম ঝামেলা বাঁধল দেনমোহর নিয়ে । মিলির পরিবার জানালো ৫ লক্ষ টাকা দেনমোহর ।কারণ তাদের যত আত্মীয় স্বজনের বিয়ে হয়েছে কারো দেনমোহরই ৫ লক্ষের নীচে নামে নাই । ঝামেলাটা বাঁধাল মিলি।
সে তার বাবাকে ডাক দিয়ে বলল, আচ্ছা বাবা দেনমোহরটা জানি কিসের জন্য ?

মিলির বাবা বলল , কিসের জন্য মানে এটা একটা মেয়ের সিকিউরিটি । মিলি বলল , মানে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলে আমার জামাই এই টাকা দিবে যাতে আমি খেয়ে পরে বাঁচতে পারি ? তুমি এত খারাপ কেন বাবা ? নিজের মেয়ের ডিভোর্স এর চিন্তা করে রাখো আগে আগেই!

মিলির বাবা ধমক দিয়ে বলল , তুই সব কিছু এত বাজে ভাবে চিন্তা করিস কেন?
মিলি তার বাবাকে বলল , দেখ বাবা , যদি কোনদিন আমার বা আমার স্বামীর মনে হয় যে নাহ আর সংসার করা সম্ভব না তাহলে সেদিনই সব শেষ। এখানে টাকা পয়সা দিকে তাকে বেঁধে রাখতে হবে কেন? আর আমার সিকিউরিটি আমি নিজেই । দেনমোহরের বিধান জানো ? সেটা হচ্ছে একটা ছেলের সামর্থ্যের উপর। যে ছেলে ১৫- ২০ হাজার টাকার চাকুরী করে সে কিভাবে ৫ লাখ টাকা দিবে ? আমি কোন টাকা চাই না বাবা। তুমি কয়েক হাজার টাকার বেশি কাবিন করবে না । যদি করো তাহলে আমি এই বিয়ে করছি না । আমি বিয়েও করব না তোমার ঘরেও থাকব না । তুমি আবার আমাকে তোমার বোঝা মনে করো না ।

যাক সব কিছুর পরও আমাদের বিয়ে হয়েছিল এবং খুব অল্প টাকা দেনমোহরে । অফিস শেষ করে আমি বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাত মনে পড়ল মিলির জন্য কি কেনা যায়? ওর হুইলচেয়ারটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। কয়েকবার বলতে চেয়েও বলে নি আমাকে। একাই সংসার চালাতে হয় আমাকে। মিলির এখন অফিস করার মত অবস্থা নাই।ভাবলাম এবার ওকে সুন্দর আর দামী দেখে একটা হুইল চেয়ার কিনে দিব। ওহ! বলতে ভুলে গেছি আমাদের বিয়ের ১ বছর পর থেকে মিলি হুইলচেয়ারের বাসিন্দা। বাসা থেকে আমাকে কতবার বলল আর একটা বিয়ে করতে। এই ল্যাংড়া বউ নিয়ে কি আমি সারাজীবন কাটাবো নাকি ? আমি বলেছিলাম, এটা কোন পণ্য না যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে তাকে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। ওয়ারেন্টি শেষ তো খেলা শেষ। ওর ওয়ারেন্টি গ্যারান্টি আজীবনের।

কেউ একজন বসে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করে , আমি তাকে উপেক্ষা করি কিভাবে? এটা ওর প্রতি করুণা নয় এটা আমার দায়িত্ব, এটা ওর অধিকার।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত