আমার পড়া হচ্ছে না। মোটেই হচ্ছে না। মশা আর বউর জ্বালা যে অসহ্যময় জ্বালা, আমি এইটুকুন বয়সে ঠিকঠাক টের পাচ্ছি। পাশের রুমে ঝগড়া চলছে। নতুন ভাড়াটে। তার উপর নব বিবাহিত। এই দুমাসে এতটুকু বুঝতে পেরেছি, ঝগড়া ছাড়া আর এঁদের খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই। সকালে ঝগড়া, সন্ধ্যায় ঝগড়া, ঘুমোতে ঝগড়া। আর দেয়ালের আড়ালে এসব ঝগড়ার প্রত্যক্ষ সাক্ষী একমাত্র আমি। শুনতে মজা লাগে। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার দরকার আছে বলেই তাঁদের ঝগড়া প্রতিদিন কান পেতে শুনি। প্রতিদিন নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। আমি নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে বলতে পারি, এসব ঝগড়ার অহেতুক মূল ইস্যু তৈরি করেন ফাহিম সাহেবের অতি আহ্লাদের বউ সানজু আক্তার। আজকে কী নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধছে, তা একটু কান পেতে শুনি___ – তোমাকে কতবার বলছি, সংসার এখন দুজনের। আমার বলতে কিছু নেই। এখন থেকে আমাদের সবকিছু। তাই আমার না বলে সবসময় আমাদের বলবে, মনে থাকবে? – আচ্ছা ঠিকাছে, এখন আমার টাওয়ালটা দাও তো। গোসল সেরে আসি। – আবার আমার বলছো! কথা কি কান দিয়ে ঢুকে না? সেই অফিস থেকে এসে শুরু করছো আমার আমার! বলতে পারো না, আমাদের টাওয়ালটা দাওতো? সবকিছুতে শুধু নিজের অধিকার ফলাও কেন? সংসার কি একা তোমার? বোঝা গেলো ফাহিম সাহেব নীরব হয়ে গেছেন। কিছু বলছেন না। এসব ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে তিনি মোটেই ইচ্ছুক না। তিনি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন__ ‘আমার ভুল হয়ে গেছে! তোমার দুখান পা ধরি বউ। এবার আল্লার ওয়াস্তে থামো। দয়া করে আমাদের টাওয়াল আর আমাদের লুঙ্গিটা নিয়ে এসো। গোসলটা সেরে আসি।’ ফাহিম সাহেবের এ কথা শোনার পর মনে হলো, পাশের রুমে তাৎক্ষণিক ভূমিকম্প শুরুহয়ে গেছে। কাঁচের জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ সেই সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কান্নার শব্দ আসছে। ফাহিম সাহেবের স্ত্রী কী বলতেছেন আর কী ভাঙতেছেন কিছুই বুঝতেছি না। ঘটনাটি বোঝার জন্য আমি দেয়ালে পুরো কান ঠেকে ধরেছি। এখন কাঁচের জিনিসপত্র বোধহয় ভাঙা শেষ। তাই অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁর স্ত্রী বলছেন__ . ‘ফাইজলামি করো আমার সঙ্গে! আমি কি লুঙ্গি পরি? হু, লুঙ্গি পরি? আমাদের লুঙ্গি বলে তুমি কী বোঝাতে চাও, আমি বুঝি না? হু, বুঝি না? আর থাকবো না তোমার সংসারে। কালই বাপের বাড়ি চলে যাবো।’ লক্ষ্মী সোনা, হীরা, মুক্তা, তামা এসব বলে এখন ফাহিম সাহেব তাঁর স্ত্রীকে তেল মালিশ করছেন। এটা ঝগড়ার শেষাংশে তিনি প্রতিদিনই প্রয়োগ করে থাকেন। শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। বউতো নয়, যেন পিরিতের হালুয়া। যতটা না হজম হয়, তারচেয়ে বেশি ঢেঁকুর আসে। প্রেম করে বিয়ে করলে যা হয় আরকি। আমি এখন এসবে কান না দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু মশার জ্বালায় পেরে ওঠছি না। কাল আবার পরীক্ষা। কী পরীক্ষা দেবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছি। কী অদ্ভুত ব্যাপার, বাঘের ভয়ে আমরা বাঘকে খাঁচায় বন্দি করলেও মশার ভয়ে আমরা নিজেরাই খাঁচায় বন্দি হই! বইয়ের প্রতিটা পাতা মশার শরীরের অবৈধ রক্তে লাল হয়ে আছে। কিছুদিন যাবৎ একটা বিষয় মাথায় খেলা করছে, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। যদি আমি এক কেজি মশা মারতে পারি, তাহলে নির্দ্বিধায় এই রেকর্ডের মালিক হবো আমি। কিন্তু এক মাস যাবৎ কয়েক লক্ষ মশা মেরেও পাঁচ গ্রাম ওজন করতে পারিনি। তাহলে মশা হত্যায় বিশ্ব রেকর্ড করবো কেমনে? আচ্ছা, মশার কঙ্কালের চেয়ে জগতে আর কোনো প্রাণীর কঙ্কাল এতোটা হালকা হয়? রাত ন’টা বাজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। জানি আজ আর পড়া হবে না। পরীক্ষায় গোল্লা ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মশার জ্বালা আজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কয়েল, স্প্রে কিছুই মানছে না। কিছু সন্ত্রাসী মশা এতোটাই সাহসী যে, মশার কয়েলের উপর আরামসে বসে ফাইভস্টারের স্বাদ নিচ্ছে। আর কিছু বজ্জাত মশা উরাধুরা কামড়াতে কামড়াতে আমার হাত পা লাল করে দিচ্ছে। বুঝি না, আমাকে আর আমার আব্বুকে মশা এতোটা কামড়ায় কেন? আমাদের রক্তে কি স্বাদ বেশি? কই, আমাদের মতো আম্মু বা আমার বোনদেরকে তো মশায় এতোটা কামড়ায় না! এ বিষয়টা ভাবতে ভাবতে গুগোলে সার্চ দিলাম। সার্চের প্রথমেই মশা সম্পর্কিত একটা বাণী বেরিয়ে এলো। ডক্টর কবজ এ হুদা নামক একজন বিশ্ববিখ্যাত নারী গবেষক বলেছেন__ “স্ত্রীমশা সবচেয়ে বেশি পুরুষদের কামড়ায়। যে মশাগুলো বেহায়ার মতো চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকে, সেগুলোকে স্ত্রীমশা বলে।” . এই বাণী পড়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এক থাপ্পড়ে পাঁচটা স্ত্রীমশা মেরে ফেললাম। তারমানে এতোদিন আমাকে আর আব্বুকে তথা পুরুষ জাতিকে স্ত্রীমশা কামড়াতো? তবে কি স্ত্রী প্রজাতিই শুধু শান্তি না, আমাদের অশান্তিরও কারণ? মন বললো, ‘হ্যাঁ, মার শালিদের মার। ভুলেও কামড়াতে দিস না।’ ঠাসঠাস শব্দ হচ্ছে। মশারির ভেতর পুরাই রণক্ষেত্র। থাপ্পড়ের আওয়াজ শুনে পাশের রুম থেকে আম্মু বলছেন, ‘চুপচাপ পড়তো বাবা, আওয়াজ করিস না। তোর বাবা ঘুমোচ্ছে।’ রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ বিটিভিতে শুরুহয়েছে। মশাকে নিয়ে আজকে একটা বিশেষ প্রতিবেদন আছে। মশার উপদ্রব বাড়লে এই রকম প্রতিবেদন প্রতিবছরই তৈরি হয়, কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বের হয় না। আচ্ছা, চায়নিজরা কুত্তা, বিলাই, সাপ, বিচ্ছু, তেলাপোকা সব খায়। কিন্তু মশা খায় না কেন? যদি তারা এই বজ্জাত প্রাণীটাকে খাদ্যতালিকায় যোগ করতো, তাহলে মশা রপ্তানিতে বিশ্বের প্রথম তালিকায় ওঠে আসতো বাংলাদেশের নাম। এখনি ইংরেজি সংবাদ শেষ হলো। এবার শুরুহবে উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান ‘মালঞ্চ’। বিটিভির যত অনুষ্ঠান আছে, তারমধ্যে আমার সবচেয়ে জঘন্য প্রিয় অনুষ্ঠান হলো এটি। এই সঙ্গীতের চেঁচামেচি এতোটাই সাংঘাতিক যে, ঘুমের বড়ি খেয়ে আধমরা হয়ে থাকা ঘুমন্ত ব্যক্তিও বিছানা থেকে লাফ মেরে দাঁড়াতে বাধ্য। আমার আব্বুর কড়া নিষেধ, এই অনুষ্ঠানের কোনো চেঁচামেচি যেন তাঁর কানে না পৌঁছায়। কারণ, ওনি হার্টের রোগী। প্রথমবার যখন ওনি হার্ট এটাক করেছিলেন, তখন বিটিভিতে এই অনুষ্ঠান চলছিল। আমি কিছুটা লক্ষ্য করছি, এই অনুষ্ঠানটি শুরু হবার পর টিভির ওপরে বসে থাকা কিংবা আশেপাশে থাকা মশা গুলো একটাও নেই। সব গুলো দরজার চিপায় অবস্থান করছে। আমার শরীরে বসে থাকা স্ত্রীমশা গুলোও কেমন বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যাচ্ছে। তবে কি উচ্চাঙ্গসংগীত মশার ক্ষেত্রে বিষের মতো কাজ করে? যদি তাই হয়, তাহলে তো এই ঘটনা হবে বিষ দিয়ে বিষ তোলার মতো। মশা সংগীত আর উচ্চাঙ্গসংগীত যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তো মশার যন্ত্রণা থেকে একটা দেশ বেঁচে যাবে। আর বিটিভির এই অনুষ্ঠানটি সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠবে। তবে দেশে তুলার দাম রাতারাতি বেড়ে যেতে পারে। শব্দদূষণ আর চেঁচামেচি থেকে বাঁচতে দুকান তালাবন্ধ রাখা যে বাঞ্ছনীয়। ওস্তাদ রুবজালাল খান সেতার হাতে নিয়ে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশন করছেন। আমার রুম এবং আমার বুকের ভেতরে ভয়াবহ থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ওনি কী গাচ্ছেন, কিছুই বুঝতেছি না। তবে বিকট চেঁচামেচিতে কান পুরাই ঝালাপালা। কিছুটা বোঝার জন্য টিভির ভলিয়েম বাড়িয়ে দিলাম। ওস্তাদ রুবজালাল সেতার হাতে পুরাই উত্তেজিত। আমার জানামতে, উচ্চাঙ্গসংগীতে রাগ বলে কিছু একটা আছে। তাই তিনি সেতারের সঙ্গে রাগ দেখাচ্ছেন আর গাইছেন__ ‘আ….আ….আ….আ মা….মা….মা…..মা রে….রে….রে….রে, মারেমারেমারেমারে আ….আ….আ…..আ মারেমারেমারেমারে ব…ব….ব…বউ…এ মারেমারেমারেমারে।’ উচ্চাঙ্গসংগীতের অসহ্য শব্দদূষণময় আক্রমণে স্ত্রীমশাগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। যে যেদিকে সুযোগ পাচ্ছে, সেদিকে পালাচ্ছে। আমিও স্ত্রীমশার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে ওস্তাদ রুবজালালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেঁচামেচি করে গাচ্ছি___ ‘গে……গে……গেলি, শা……শা…….শালি, ম…….ম…….মশা গু…….গু…….গুলি।’
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক