নো ইংলিশ অনলি তামিল

নো ইংলিশ অনলি তামিল

বেশ কিছুদিন যাবৎ চেন্নাই আছি। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের এক শহর। বেশ কয়েকটি বড় হাসপাতাল থাকার কারণে, শহরটির নাম এখন ছড়িয়ে গেছে। আমিও চেন্নাই শহরে সপরিবারে এসেছি চিকিৎসা সেবা নিতে।

এখানকার কিছু অদ্ভুত নিয়ম হচ্ছে। সন্ধ্যার পরেই সব কিছুর দাম বা ভাড়া তিনগুণ হয়ে যায়। কারণ জিজ্ঞেস করলে এরা মজা করে উত্তর দেয়। “চান্নি আ, আ আনদাইমাপুরম, না ইনকে আমা ” আমি এর অর্থ জানিনা। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও একই উত্তর। ইংরেজি হিন্দি দুটোতেই এরা আমার চেয়েও কাঁচা। অনেকে হেসে বলে – নো ইংলিশ অনলি তামিল।
নাও ঠেলা। এটুকু ইংরেজিতে বললে বাকিটুকুতে সমস্যা কি?

যাকগে আমার বাবা চা পাগল মানুষ। তাকে আম্মা বা আমরা যতই চা বানিয়ে দেই উনি রেষ্টুরেন্ট এর চা খাবেনই। বলে বলে আমরা হয়রান হয়েছি। কোনো ফায়দা হয়নি। আমরা যে বাসাটায় আছি, এলাকার নাম “থাউজেণ্ড স্ট্রিট ”
“গোলাম আব্বাস আলি” রোড। মসজিদের পেছনে ১৯০০ স্কয়ার ফিটের খোলামেলা এক বাসা। চমৎকার দুটো ব্যালকনি আছে। আর সব’চে ভালো বিষয়, আমাদের বাসা থেকে “এ্যাপোলো হসপিটাল ” ও ” শঙ্কর নেত্রালয় ” মাত্র চল্লিশ রুপি সিএনজি ভাড়া। উবার ৬০ থেকে ৭০ রুপি।

তিনচারদিন আগে ৪০ রুপি ভাড়া দিয়ে হসপিটালে গেলাম। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেলো। সিএনজি ডাকলাম। সানন্দে তিন চারজন ড্রাইভার এগিয়ে এলেন। ভাড়া ১২০ রুপি। আমরা বললাম ছয়টায় এসেছি ৪০ রুপি দিয়ে, এখন এতো বেশি কেনো?
তারা সবাই হাসতে হাসতে বলে – ইয়ে রুলস হ্যায় ভেইয়া। রাত আট বাজনে পার সাব কুছ কে লিয়ে যাদা প্যায়সা লাগেগা। সিকিউরিটি গার্ড কে বললাম উনিও সায় দিলো। কি আর করা ১২০ রুপিই সই।

আমাদের বাসার পাশেই এক রেষ্টুরেন্ট। আমার বাবা এই ক’দিনে এখানকার রেগুলার কাস্টমার হয়ে গেছেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, আব্বু চা খাচ্ছেন। কাগজের ছোট কাপে এক কাপ চা – দাম দশ রুপি। আব্বু মানিব্যাগ হাতড়ে খুচরো না পেয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ব্যাগ থেকে ১০ রুপির একটা কয়েন বের করে দিলাম।
ম্যানেজার হেসে বললেন -” আন্নি ৩০ রুপেয়া “।

আমি বললাম – আব্বুনেতো এককাপ চা পিয়া । ফির ইতনা রুপেয়া ক্যায়সে হোগা সার্দারজী?

– বাহেন, রাত আট বাজ গায়া। ৩০ রুপেয়া আহি দেনা ভি পারেগা।

আমি ৩০ রুপি দিয়ে, আব্বুর দিকে চেয়ে বললাম – আরো খাবে ৩০ রুপেয়ার চা!
আব্বু উদাস নয়নে চাঁদ দেখতে দেখতে বললেন
– যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। দাঁড়া ৩০ রুপেয়ার “চা”য়ে নিশ্চয়ই এক্সট্রা কিছু আছে। আয় খেয়ে দেখি। এই গরমে চা! আমি আৎকে উঠলাম।
আব্বুকে ৩০ রুপেয়া দিয়ে আরো চা খাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে আমি বাসায় চলে আসলাম।

বাড়ির মালিক চাচা সব সময় নিচে বসে থাকেন।
রিটায়ার্ড ব্যাংকার, হজ্জ করে এসেছেন। সফেদ দাঁড়িতে পাঞ্জাবি পরা উনাকে দেখলে, নিজের চাচা, ফুফাদের মতোই লাগে।

পার্কিং লটটাই উনার অফিস। উনার ডেস্কের সামনে সোফা পাতা আছে। আমি সেখানে বসলাম। হাসিমুখে সালাম দিয়ে বললাম –

চাচাজি ম্যায় কুছ পুঁছু?

– জরুর, জরুর।

এরপরে বাদ বাকি আধা ইংলিশ আধা হিন্দিতে চাচাজিকে বললাম – আমি খুব অবাক হচ্ছি, এখানে এমন নিয়ম কেনো? তোমরা সন্ধ্যার পরে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দাও! উনি খুব হাসলেন
তারপরে দরাজ গলায় বললেন – বিটিয়া, যাদা কুছ বেশি তো নেহি লিয়া! উস প্যায়সা উনকা হাক হ্যায়।

– কিন্তু কেনো?

– দেখো বেটি, সন্ধ্যার পর তুমি রেষ্টুরেন্ট এ চা পান করছো। ভাত বা রোটি না। তার মানে ভুখ নেহি, ইয়ে তুমহারা আগলা খায়েশ হ্যায়। কিন্তু ভেবে দেখো যে তোমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছে, তার এখন তার পরিবারকে সময় দেয়ার কথা। সে নিজের পরিবার কে সময় না দিয়ে নিজেকে রেষ্ট না দিয়ে তোমায় চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে । তার মানে তার পয়সার খুব দরকার। তাই শ্রমিকের মূল্য এখানে তিনগুণ বেড়ে যায়। তুমি শুধু তোমার দিকটা দেখবে? চা ওয়ালা বা ড্রাইভার এদের ত্যাগ স্বীকার টা দেখবেনা?

আমিতো পুরো হতভম্ব। এভাবে তো ভাবিনি!

কাল ছিলো “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস “। আজ ডাঃ আম্মা ও আব্বুর প্রেসক্রিপশন করবেন। সময় বিকেল ৪:০৫ মিনিট ও ৫:২০ মিনিট। এখানে ৪:০৫ মিনিট মানে চারটা পাঁচ মিনিটই। স্ক্রিনে ডাঃ ও রোগীর নাম্বার ভেসে উঠবে। তখনই ঢুকতে হবে। আমরা তাই ৩:৩০ মিনিটেই বাসা থেকে বের হয়ে যাই। হঠাৎ মনে পরে, আজ তো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আজ সিএনজি পাবো কি? আব্বু বললেন দাঁড়াও Uber ডাকি। ঠিক সেই মুহুর্তে সামনে দু’টি সিএনজি চলে এলো। পরনে ড্রাইভারদের মতোই পোশাক তবে নীল । তবে কোথায় জানি একটু ঝামেলা আছে। আমরা উঠতে একটু ইতস্তত করছি। ড্রাইভার পরিস্কার ইংরেজিতে বললেন – কোথায় যাবেন বলুন। আমি নামিয়ে দিচ্ছি।

বাসা থেকে হসপিটাল ৫/৭ মিনিটের দূরত্ব। উনি খুব সাবধানে দশ মিনিটে আমাদের হসপিটালে নিয়ে এলেন। এবং আমরা কখন ফিরবো বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম – সিক্স পি এম।

উনি মাথা ঝাঁকিয়ে, সিএনজি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। আমরা হতভম্ব। আব্বু বললেন – আমাদের বাসার আশেপাশেই হয়তো আসাযাওয়া আছে, বাসায় এসে ভাড়া নিয়ে যাবে।

এদিকে চারটা বাজার আর দশ মিনিট বাকি বিশাল লবি পেরিয়ে। তারপর লিফটে তিনতালায় উঠতে হবে। আমরা দ্রুত হসপিটালে ঢুকে পরি।

কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। ঠিক ছ’টায় নিচে নেমে দেখি ড্রাইভার সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা দ্রুত সিএনজিতে উঠে বসি, কারণ এখানে একটু পরপর গাড়ি ঢুকছে।

বাসার সামনে যখন গাড়ি থামলো। আব্বু উনাকে ২০০ রুপির একটা নোট দিলেন। উনি হাসিমুখে টাকা টা আব্বুকে ফিরিয়ে দিলেন। আমরা সবাই তখন বলছি – আপনি কেনো টাকা নিচ্ছেন না! আমরা কি আপনার সাথে কোনো Misbehave করেছি?

উনি উত্তরে যা বললেন,সেটা শোনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

” আমি এখানকার “মন্নিপুরাম” স্কুলের একজন শিক্ষক। আমরা শিক্ষকেরা ও একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরা আজ শহরের সব সিএনজি ও Uber চালাচ্ছি। আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আজ আমাদের “চেন্নাই” এর সব শ্রমিকদের আমরা ছুটি দিয়েছি। তারা আজ বাড়িতে সময় কাটাবে। যারা থাউজেণ্ড স্ট্রিট বা হাসপাতালের আশেপাশে থাকেন। আমরা জানি তারা সবাই চিকিৎসার জন্য এসেছেন। তারা যেনো কোনো অসুবিধায় না পড়েন তাই আমরা নিজেরাই এমন উদ্যোগ নিয়েছি। আপনি কোন দেশের বা কোন জাতির আমার কাছে সেটা মূল্যবান না। আমার কাছে এটাই মূল্যবান আপনারা এই মুহুর্তে সিএনজি না পেলে সমস্যায় পড়তেন। আমিতো একেবারে দুই কাজ করলাম।

আমার শ্রমিক ভাই ও আজ বিশ্রাম পেলো আপনারাও প্রয়োজনে অটো পেলেন। আসছি এবার। নমস্কার দাদা নমস্কার দিদি। বলে হাসিমুখে অটো স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন।

আমি অবাক হয়ে একজন মহান মানুষের চলে যাওয়া দেখলাম। কতোটুকু শিক্ষা মানুষের মনে থাকলে শ্রমিকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে এমন উদ্যোগ নেয়া যায়। স্যালুট আপনাকে মহান শিক্ষক।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত