বাইরে শুক্লপক্ষের জোছনা। একা ঘরে পায়চারী করছে অনিন্দিতা। ঘর অন্ধকার নয় পুরোপুরি। জানালা গলে
চাঁদের আলো ঘরে লুকোচুরি খেলছে। অনিন্দিতার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। ও বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালো। বারান্দার চেয়ার টেনে বসে তাকালো জোছনার দিকে। ওর খুব মারা যেতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ করে। নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘেন্না এলো।রাগ হলো।আচমকা ওর শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। গত কয়েকমাসের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাবতে লাগলো।
সুদর্শনের সাথে অনিন্দিতার দেখা হতোই।ক্লাসে। কিন্তু ক্লাসের আগেই সুদর্শন সাদের সাথে ওর দেখা হয়ে গেল।অনিদের ক্লাস একেবারে দোতলার পুবের দিকের রুমে হয়।বরাবরের মতই লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙছিল অনি।তক্ষুনি বাঁক ঘুরতে যেয়ে এক্সিডেন্টটা ঘটে গেল।চশমা চোখে এলোচুলের গম্ভীর মুখের ছেলেটার সাথে ধাক্কা লেগে গেল।দোষটা ওরই।বড় সড় এক্সিডেন্ট ঘটার আগেই ফিল্মী কায়দায় ওকে ধরে ফেললো ছেলেটা। অবাক চোখে তাকিয়ে। যেন ল্যাবরেটরির জটিল সমীকরণ মিলে যাওয়ায় অতি মুগ্ধ বিজ্ঞানী।মুগ্ধ হয়ে তাকানোর কারণ অনির চুল।লালচে দীঘল চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে খুলে গেছে। এক সমুদ্র গভীরতা চোখে নিয়ে অনি তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। ছেলেটি সেই চোখে তাকিয়ে সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।কী গভীর!কী মায়াময় দুটি চোখ!
অনিন্দিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।গজ গজ করতে করতে চলে গেল। ছেলেটি সব ভুলে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ক্লাসে যেয়েও অনির মন ভাল হলো না। ক্লাসে নতুন স্যার আসবে। জুনায়েদকে বললো,
-দোস্ত, প্রক্সি দিয়ে দিস প্লিজ।
-ক্যান?তুই ক্লাস করবি না?
-না।
-আজকে তো নতুন স্যার আসবে।
-আসুক।
-কি হইছে রে তোর?
-কিছু না
বলে পেছন দরজা দিয়ে ও বের হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনের দরজা দিয়ে নতুন স্যার ক্লাসে আসলো।
একটুর জন্য উপরওয়ালা সাসপেন্স রেখে দিল।
বেশ কয়েকদিন ক্লাসে যায়নি অনি।অনিন্দিতা রুহানি হোসেন। বন্ধুরা ডাকে অনি।ফিলসফি ফার্স্ট ইয়ার সবে। বাবা মা ছোটবেলাতেই মুক্তি নিয়েছে বন্ধন থেকে।দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাসায় পরগাছার মত
বড় হয়েছে। কিন্তু আদতে অনিন্দিতা পুরোটাই একটা ভালবাসার নাম।ওর কথা বলা, হাসি, গান, উচ্ছলতা শুধু ওকে ভালবাসতে বলে। সারাক্ষন আড্ডা, হুল্লোড়ে ওকে পাওয়া যাবে।শত কষ্টেও ঠোঁটের নীচে ভাঁজ ফেলা হাসিটি আছেই।যখন বন্ধুরা রিলেশনে ব্যস্ত তখন ও ব্যস্ত বইয়ের মাঝে। যখন রাত জেগে বন্ধুরা ফোনালাপে চোখের নীচে কালি ফেলতে ব্যস্ত, তখন তিতলী ব্যস্ত হোস্টেল পালিয়ে রাতের শহর দেখতে।
হায়! কে জানতো এই মেয়েটি একদিন কাউকে ভালবাসবে! একদিন নির্ঘুম রাত কাটাবে কাউকে ভেবে! কে জানতো?
দর্শন স্যার নাকি দুর্দান্ত পড়ায়।এগুলো শুনতে শুনতে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিল।তখনি শুনতে পেল কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে।
-অনি
অনিন্দিতা থমকে দাঁড়ালো।পেছনে তাকিয়ে দেখে সেদিনের ধাক্কা খাওয়া ব্যক্তিটি। বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ও ।
-কি অবস্থা? ক্লাসে আসো নাই যে!
-আমি ক্লাসে আসি নাই কেনো সেই কারণ কি আপনাকে দেখাতে হবে?
-হ্যা
-কেন?আপনি কি এমন খাঞ্জা খাঁয়ের নাতি?
হেসে ফেললো।
-সবাই বলছিল তোমার খুব মেজাজ।আমাকে বলবা কারণ আমি তোমার টিচার।
অনি জিভে কামড় দিয়ে কপালে হাত তুলে বললো,
-স্যার আসসালামু আলাইকুম
ভঙ্গী দেখে আবার হেসে ফেললো।
-আমি সু..
কথা শেষ হবার আগেই অনি বলে ফেললো,
-কুধর্ষণ
হা করে ওর দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সুদর্শন ।
-তুমি তো খুব মজা করে কথা বলো।
–
-কোথায় যাচ্ছিলে?
-ক্যান্টিনে
-চলো যাই।এক কাপ কফি খাওয়া যাবে।
– চলুন।
ক্যান্টিনে স্যারের সাথে অনিকে ঢুকতে দেখে হাসি, আড্ডা সব থমকে গেল।স্যার হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দিল।জানালার পাশে বসে দুকাপ কফির অর্ডার দিতেই অনি বললো,
-এক কাপ স্যার
-কেন!
-আপনি আসার সময় বললেন যে ‘চলো এককাপ কফি খাওয়া যাক। ‘
সুদর্শন হেসে ফেললো।
-ওটা কথায় হয়ে যায়।ওকে। দুকাপ।কেমন?
-আচ্ছা।
-এখন বলোতো, দর্শনের মত একটা খটমটে সাবজেক্ট কেন বেছে নিলে?
– আমি কোথাও স্থির নই।কি ভালবাসি পড়তে সেটা বুঝে না উঠতেই অল্প পছন্দের দর্শন নিয়েছি।আসলে আমার মনে হয় আমি একসাথে অনেকগুলা সাবজেক্ট কেন পড়তে পারিনা ।দর্শন, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান আমার কাছে কখনো বোরিং হয় না। দর্শনের শুরু যেখানে জিজ্ঞাসা থেমে যায় সেখান থেকে। ইতিহাসের গায়ে একটা প্রাচীন গন্ধ আছে। আর মনোবিজ্ঞান মানেই হাজার হাজার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আবেগ, অনুভূতি ।
এটুকু বলে থামলো অনিন্দিতা।ওদিকে সুদর্শন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একফোঁটা মেয়ে অথচ কি অবলীলায় কত কথা বলে যাচ্ছে। কি সুন্দর হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে। যদি মেয়েটির সাথে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যেত!
ক্লাস, আড্ডা, লাইব্রেরীতে এখন প্রায়ই অনিন্দিতা সুদর্শনকে একসাথে দেখা যায়। সুদর্শনের ক্লাস না থাকলেই অনির সাথে গল্প করে। রোজকার মত অনি সুদর্শনের ক্লাস শেষের জন্য অপেক্ষা করছিল।সুদর্শন বের হয়ে আসতেই ওকে দেখলো।সাধারণত পাঁচটা পর্যন্ত অনি অপেক্ষা করে না।
-কি ব্যাপার!
-স্যার আজকে আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব।
-সে কি! কেন??
-চলুন না
বলে অনি সুদর্শনের হাত ধরে টানলো,
-স্যার চলুন
সুদর্শন ‘মেরী হ্যাভ এ লিটল ল্যাম্ব ‘এর মত পেছন পেছন চললো।
ওদের বাসায় পৌঁছতে সন্ধ্যা লেগে গেল।অনি রুমে ঢুকে জানালা খুলে লাইট জ্বেলে দিল।তারপর ধূপ জ্বেলে একপাশে রেখে বললো,
-স্যার আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি নানুভাইকে খাবার দিতে বলি।
অনি চলে যাওয়ার পর রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সুদর্শন।কি সুন্দর করে গোছানো। সুদর্শনের চোখ আটকে গেল বইয়ের মাঝে। দেয়াল র্যাক জুড়ে থরে থরে সাজানো বই।সবই সাহিত্য। ইংলিশ, বাংলা, রুশ, জার্মান। বইগুলো হাতে নিয়ে দেখলো। কোথাও ভাঁজ নেই, দাগ নেই।সুদর্শন বুঝলো বইগুলোর যত্ন করে অনিন্দিতা। শীর্ষেন্দুর যাও পাখি বইটা বের করতেই পেছনে বয়স্কা কারো কথা শুনলো,
-কই বাবা
-জ্বি
-আসো তো। খেয়ে নাও দুটি।
-আপনি অনির নানীভাই?
-হ্যা বাবা। বসো। ও কি! বই কেন এখন!রাখো। ফ্রেশও হওনি।যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
আমি অনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-না না । আপনি থাকুন।আপনার কথা শুনেছি ওর কাছে।
-আর বলো না। পাগলি একটা। কখন যে কি করে।তা বাবা! শুনেছি তুমি টিচার্স কোয়ার্টারে থাকো।খাওয়া দাওয়া তো ঠিকমতো হয় না। আবার পাগলিও সব সময় তোমার কথা বলে।তুমি আমাদের বাসায় এসে থাকলেই পারো।
-আপনাদের বাসায়!
-হ্যা। চিলেকোঠার রুমটা ফাঁকা পড়ে থাকে। আমি কালই লোক পাঠিয়ে দেব।জিনিসপত্র নিয়ে আসবে । মেয়েটা সবসময় বলো ‘স্যার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ‘।বন্ধু তো বন্ধুর বাড়িতে আসতেই পারে ।
পরেরদিন থেকেই সুদর্শন হয়ে গেল হোসেন বাড়ির বাসিন্দা।
.
অনিন্দিতা বাসায় ফিরেই চলে যায় সুদর্শনের রুমে। সেগুলো গুছিয়ে ছাদের গাছ গুলোতে পানি দেয়।এরপর সুদর্শন ফিরলে দোলনায় বসে দুজন কফি খায় একসাথে।আজকে সুদর্শন ফিরলো খুব উত্তেজিত হয়ে।
-অনি
-জি স্যার
– আজকে সুপার মুন দেখা যাবে। নানীভাইকে বলবা এগারোটার মধ্যে ছাদে চলে আসতে।
অনি শুনেই দৌড়ুলো। বাসার
সবাইকে বললো। কেউ তেমন গা করলো না।সুপার মুনের চেয়ে সিরিয়াল তাদের কাছে বেশি আনন্দের। নানীভাই এগারোটার দিকে ছাদে গেল বটে কিন্তু মিনিট দশেক থেকে বিরক্ত হয়ে বললো,
-চাঁদরে নিয়া অত লাফালাফির কি। তোরা দ্যাখ।আমার ঘুম পায়। সকাল সকাল উঠতে হবে। আমি যাই।
বলে নানীভাই চলে গেল।
সুদর্শন আর অনি রয়ে গেল।গল্পে গল্পে রাত বাড়ে। গ্রহণ লাগতেই ওকে ডাকলো সুদর্শন।ও সুদর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে সুপারমুন দেখছে।কেউই বোঝেনি দুজনের মাঝখানের দুরত্ব বিপদজনক ভাবে কমে গেছে। সুদর্শনের তপ্ত শ্বাস পড়ছে অনিন্দিতার ঘাড়ে। অনির শ্যাম্পুর ঘ্রাণ সুদর্শনকে উত্তাল করে তুলছে। আচমকা কোমর চেপে নিজের দিকে ওকে ঘুরিয়ে দিতেই চমকে উঠলো অনি।চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট দেখা গেল কেঁপে গেল অনির ঠোঁট। ততক্ষনে কোমর চেপে ওকে আরো কাছে টেনে নিয়েছে সুদর্শন।অনির শীতল ঠোঁটে সুদর্শনের নির্দয় ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া লাগতেই জেগে উঠলো প্রথম নারীত্ব। দুহাতে সুদর্শনের গলা জড়িয়ে ধরে আরো নিবিড় হলো অনিন্দিতা। আচমকা
সুদর্শনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল ও।
.
ইদানীং সুদর্শনকে এড়িয়ে যায় অনিন্দিতা ।বিকেলে রোজকার মত ঘর গুছিয়ে দেয়ার সময় দরজায় ছায়া পড়তেই বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো অনির।দরজা আগলে
দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন।অনি মাথা নিচু করে চলে যেতে চাইলেও আটকালো সুদর্শন। হাত শক্ত করে ধরে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে আসলো।বিছানায় অনিকে বসিয়ে হাঁটুগেঁড়ে বসলো । দুহাতে ওর মুখ উঁচু করে ধরে আলতো চুমু দিল কপালে।
-অনি, আমি কি কিছু অন্যায় করেছি?
–
-আমি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি সেদিনই আমার ভীষণ ভাল লেগে যায় তোমাকে। ভীষণ। যত দিন গেছে আমি তোমাকে ভালবেসেছি একটু একটু করে। তোমাতে মুগ্ধ হয়েছি একটু একটু করে। আমার দিকে তাকাও। দেখো কটা দিন তুমি কথা বলোনি আমার কষ্ট হয়েছে। আমি তোমাকে ভালবাসি অনি।
অনিন্দিতা তাকালো সুদর্শনের দিকে। মায়াময় চোখে এক রাজ্য ভালবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে । অনি দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো সুদর্শনকে। কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ভালবাসি, ভালবাসি এবং ভালবাসি। ‘
তারপর পালিয়ে গেল।
দুজনের দিন গুলো যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছিল। শহরের গুঞ্জন, কানাকানিতে ওরা কান দিত না।
-অনি
-উ
-আমার বয়স কত?
-কত?
-তেত্রিশ
-তো?
-তোমার কত?
-বাইশ
-তুমি আমার চেয়ে এগারো বছরের ছোট।
-তো?
-অথচ তোমার সাথে থাকলে মনে হয় আমার বয়স দশ বছর বছর কমে গেছে।
-তোমাকে দেখে কে বলবে তোমার বয়স এত!একটা চুল পাকে নি, দাঁড়ি পাকে নি।
বলেই হাসিতে গড়িয়ে পড়তো অনি।যোগ দিত সুদর্শন।
.
একদিন বাসায় ফেরার পথে দেখলো গেট থেকে একটি ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক বের হয়ে যাচ্ছে। আমলে না দিয়ে বাসায় ফিরে দেখে সুদর্শন গম্ভীর মুখে বসে আছে। অনি গলা জড়িয়ে ধরতেই গলা ছাড়িয়ে নিল সুদর্শন।ও অবাক হলো।
-কি হয়েছে?
-আমাদের সম্পর্কটা আর আগানো উচিত হবে না অনি।
অনিন্দিতা হতভম্ভ হয়ে গেল।
-কেন?
-আমার বউ এসেছিল
-তোমার বউ?
-হ্যা। অনি..
-তুমি বিবাহিত?
-হ্যা। অনি প্লিজ কথা শোনো।
আচমকা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল অনিন্দিতা।
-বলো।
-আমাদের একটা ভুল হতে যাচ্ছিল। সেটা হওয়ার আগেই আমরা যার যার ভুল শুধরে নেই।
-ভুল ছিল?তোমার ভালবাসা একটা আবেগ হতে পারে। কিন্তু আমার নয়।তোমার স্পর্শ, তোমার গায়ের গন্ধ, বৃষ্টিতে ভেজা, রাত জেগে গল্প করা তোমার কাছে ভুল হতে পারে। আমার কাছে নয়।
কান্নায় ভেঙে পড়লো অনি। পেছনে হিলের খটখট শুনে ফিরে তাকালো। যে দুজনকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল তারাই।
ভদ্রমহিলাটি বললো,
-এই তাহলে তোমার বালিকা প্রেমিকা! নায়িকা তো।
অনিন্দিতা আর দাঁড়ালো না।ছুটে চলে গেল। এক দৌড়ে নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
তখনি ওর মনে হচ্ছিল মারা যাওয়া দরকার।
.
তের বছর পরের এক বিকেল। ঢাকা এয়ারপোর্ট ভীড়ে ভীড়াক্কার। প্রাইম মিনিস্টার নাকি আসবে সফর শেষে। ভীড় ঠেলে বের হতে বিরক্ত লেগে গেল মহিলাটির। মনে মনে বিরক্ত। তের বছরেও দেশটা পালটে নি। উবার ডেকে চললো ধানমন্ডী। একটা প্রাচীন বাড়ির সামনে এসে গাড়ি ছেড়ে দিল।বাড়িটির রঙ জ্বলে গেছে, শ্যাওলা ধরেছে। দেয়ালে গাছ গজিয়ে উঠেছে। নক করতেই দাড়োয়ান বললো,
-কাকে চান?
-জ্বি,আশরাফ হোসেন আছে?
-না। উনি মারা গেছেন বছর পাঁচেক।
মহিলাটি ধাক্কা খেল একটা।
-রেবেকা হোসেন?
-বড়মা আছেন।বয়স হয়েছে। বাতের জন্য নড়াচড়া করেন না।
-আমি উনার সাথে দেখা করবো।
-আপনার নাম?
-অনিন্দিতা রুহানি হো..
গেটম্যান উল্কার বেগে ছুটলো,
-ওরে! আপামনি আইছে রে! অনি আপামনি।
অনিন্দিতা হতভম্ভ হয়ে গেল।লাগেজটা হাতে নিতেই কে একজন নিয়ে বললো,
-আপামনি চলেন।
.
বহুদিন পর নানীভাইয়ের রুমে ঢুকতেই একটা সোঁদা ঘ্রাণ পেল । বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ডাকলো অনি
-নানীভাই
-দূরে কেন রে মুখপুড়ী। কাছে আয়। অনি এগিয়ে গেল।বৃদ্ধা ওর হাত চেপে ধরলো বুকের সাথে।
-কেমন আছ?
-ভাল আছি।তুই কত্ত বড় হয়ে গেছিস রে!
-বাহ! বয়স হয়নি? পঁয়ত্রিশ প্লাস।
-তাহলে আমাদের কি হবে রে!
হেসে ফেললো দুজনেই।
সেদিনের পর অনিন্দিতা দেশ ছেড়ে যায়।প্যারিস। ওখানেই পড়া শেষ করে সেটেল হয়ে যায়।আর এই সাপোর্ট টুকু দিয়েছিল নানীভাই।কাউকে না জানিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিল।এর মাঝে অনি আর খোঁজ নেয় নি।কিছুটা ব্যস্ততায়।, কিছুটা অলসতায়।
-অনি সোনা
-বলো নানীভাই
-চিলেকোঠায় যা
-কেন?
-সে অপেক্ষা করে আছে।
কেঁপে উঠলো তিতলী।
-আর কেন নানীভাই! যা গেছে গেছেই।কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
-না রে! বউটা ছেড়ে গেছে তাকে। সদু কখনোই তোকে ভোলেনি।গত বছরগুলো এই বাড়িতে থেকে আমার মতই মিশে গেছে বাড়ির সাথে। তোর নানাভাই খুব আফসোস করেছিল।
-আর হয় না নানীভাই।
-কেন?তুই কি ওদেশে বিয়ে করেছিস?
-তা নয়
-তাহলে!
-এত বছর পরে!
-ওরে! সে যে তোকে সত্যিই চায় রে। যা । দেখা করে আয়।
.
অনিন্দিতা ধীর পায়ে চিলেকোঠায় এসে দাঁড়ালো।ভেতর থেকে গান বাজছিল,
‘সে ছিল তখন উনিশ, আর আমি ছত্রিশ,
প্রেমে পড়তে লাগে না বয়স,
লাগে না উনিশ বিশ,
মন মন মন মনতো চাইলো,
বিবাহিত আমি তাতে কি হলো…’
অনিন্দিতা দরজা নক করলো।
-ইয়েস ডু প্লিজ
রুমে ঢুকে থমকে গেল অনি।রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে । নীল পাঞ্জাবি পরা।মুখে দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল আর চোখে চশমা ছাড়া যেন আগের মতই আছে মানুষটি।’কে? ‘বলে চোখ খুলেই চমকে গেল সুদর্শন।
-অনি। অনিন্দিতা!
-হ্যা
-দাঁড়িয়ে কেন। বসো।
-বাইরে যেতে পারবেন?
-আপনি! হ্যা পারবো।
ছাদে এসে দাঁড়ালো দুজন।চশমা ঠিক করে তাকালো অনির দিকে। চোখে ভারী গ্লাসের চশমা, আগের মতই সুন্টনী মুন্টনী আছে।অনি সুদর্শনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-কি দেখো?
-তোমাকে?
-নতুন তো নই।
-নতুনই
-কেন?
-ভালবাসি যে।
-তাহলে সেদিন কেন ছাড়তে বলেছিলে?
-চেয়েছিলাম না তোমাকে কেউ অন্যায় দোষ দিক।কোর্টে তুলুক তোমাকে।সেটা আমার ভাল লাগতো না।
-অথচ সেই জন্য কতগুলো বছর বৃথা কষ্ট পেলাম।
-কষ্ট পাওয়া ভাল।কষ্ট পুড়ে ভালবাসা খাঁটি হয়।
-তোমার দর্শনের খ্যাতাপুড়ি।
বলে পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরলো অনিন্দিতা।
-তাহলে খোঁজো নি কেন এতদিন?
-জানতাম ফিরে আসবে।
-কচু জানতে।
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মেয়েটি।।
বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে
সুদর্শন অনিন্দিতার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-বহুদিন আগে তুমি বলেছিলে।আজ আমি বলি শোনো।ভালবাসি, ভালবাসি এবং ভালবাসি অনিন্দিতা।
অনিন্দিতা আর সুদর্শন হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নারকেল গাছের পাতার ওপাশ দিয়ে সুর্যাস্তের কিরণ দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর দুজন মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাই।।