এ জার্নি বাই বাস

এ জার্নি বাই বাস

–হ্যালো শুনছেন?
–আঁরে কইতাছেন?
–হ্যাঁ,আপনাকেই।আপনি আমার সিটে বসেছেন কেন?জানালার পাশের সিট টা আমার।ওঠেন।
–আন্নে কিয়া কন?এইডা আঁর সিট। আন্নে আঁর টিকেট চাই লন।এই লন টিকেট।
——————-
——————-
আসলেই তাই। এই ঈদ আসলেই পরিবহণ bমালিক ও কর্মচারীদের এই একটা বাণিজ্য। একই টিকেট একাধিক বার বিক্রি করা। গতকাল কণিকা কয়েকটা কাউন্টার ঘুরে একটা সিট পেয়েছে।কিন্তু তাও অন্যকারো কাছে বিক্রি করা।
———————
———————-
কণিকা পাশের সিটে বসে পড়ল। এই ভেবে যে, কেউ আসলে সে এই সিট ছাড়বে না।আর জানালার পাশের সিটে বসতে না পারায় পাশে বসা ছেলেটার গুষ্টি উদ্ধার করছে।
———————–
———————–
অনেক্ষন পর সুপারভাইজার এলে কণিকা তাকে জানালার পাশের সিট এ বসার কথা বলল। লোকটা যেই না পাশের
ভদ্রলোককে বলল অমনি তিনি বলে উঠলেন
—এই মিয়া আন্নের কিয়া অইছে?আই কি হাডা বাঁশ নি কুনো।আরে হচন্দ অয়না?মাইয়া মানুষের কতার এত দাম ক্যারে?
————————-
————————-
সুপারভাইজার চুপ। কণিকা তার আগের অবস্থানেই রইল। গাড়িতে ঊঠলেই ওর কেমন যেন গা গুলায়।গাড়ির এই বিচ্ছিরী গন্ধটা ওর একদমই ভাল লাগে না। কোথাও যাওয়ার দিন নির্ধারিত হলেই তিন দিন আগে থেকেই গাড়ির ভিতরকার ওই বিচ্ছিরী গন্ধটা পায়।
তা ও যেখানেই থাকুক না কেন? এই তো সেই দিন সোনালী আন্টির বাসায় গেছিলো সেখানে দেখেছিল আন্টি ফার্নিচার পালিশ করাচ্ছেন। ব্যাস হয়ে গেলো। এরপরের সাতদিন ধরে যেখানেই গেছে সেখানেই পালিশ এর গন্ধ।
————————-
————————-
লোকটার উপর ওর ভারি রাগ হচ্ছে। দেখতে শুনতে আপাদমস্তক ভদ্রলোক কিন্তু ব্যবহারের কি ছিরি? ড্রেসি আপ টা দেখলেই
যে কারো হাসি পেয়ে যাবে। একখানা লাল কটকটে শার্ট আর লাল একটা প্যান্ট। চাইনিজ স্টাইল না বাংলা স্টাইল বুঝতে কস্ট
হচ্ছে কণিকার। হেয়ার স্টাইল টাও মেয়েলী ধাচের।পুরো আজব চিড়িয়া। একে চিড়িয়াখানাতেই ভাল মানায়।
——————————
——————————
এই ছেলে মানুষটার সাথে ঘন্টা চারেকের দীর্ঘ পথ যেতে হবে তাভেবেই কণিকার মেজাজ চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। পাশে বসে থাকাও কস্টকর কোন ব্যান্ডের বডি স্প্রে ব্যবহার করেছে কে জানে এত বিশ্রী ঘ্রাণ।
————————-
————————-
কোথাও যেতে গেলে সহযাত্রী পছন্দ না হলে কি যে বিরক্তি লাগে তা কেবল এই পরিস্থিতিতে যারা পড়েছেন তারাই ভাল বলতে পারবেন।এইজন্যই কণিকার বাড়িতে যেতে ভালোই লাগেনা।কিন্তু যেহেতু দুদিন পর ঈদ তাই না গিয়ে উপায় নেই। বাড়ি গেলেই আরেক বিপদ।বাবা – মা ওর জন্য পাত্র দেখছেন। যে বারই বাড়িতে যায় কোন না কোন পাত্র পক্ষ ওকে ভিজিট করতে আসবেই। এটা ওর কাছে বেশ যন্ত্রণাদায়ক।শেষ যে বার গিয়েছিল সেবার যে ছেলেটা দেখতে আসছিল একদমই ক্যাবলাকান্ত।ছেলেটার মা কণিকা কে কত রকম প্রশ্ন করল।
—-তোমার নাম কি বেটি?
—-কণিকা।
—-তুমি কোটে থাক?
—-ঢাকা।
—-ওটে কি কর?
—-পড়াশোনা।
—-আচ্ছা বেটি তোমার পায়ের তালু দেখিতো।তোমার মাথার ঘোমটাখানা সরাও দেখি চুল কত বড়।
((কণিকা তাই করল।))
—ওমা,কি রে বেটি চুল এত ছোট কেনো?কাটি ফেলো নাকি?
—-হম।চুল বড় হলে অনেক তদারকি করতে হয়। কিন্তু সময় পাইনা।
—ওহ, বেটি তুমি গান গাইবার পারো?
—কেনো আপনাদের
বাড়িতে কি সংগীত করতে হবে।
—-না না বেটি। যারা গান গাইতে পারে তাদের মন ভাল হয়। কণিকার ইচ্ছে করল একটা ছাম্মাকছাল্লো স্টাইল গান শোনাতে কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনাল।

কণিকা মনে মনে ভাবছিল এর পর হয়ত নাচতে বলবে। যত্তসব, এই দেখাদেখি কণিকার একদমই ভাল লাগে না।ও অনেকবার বাবা কে বলেছে যে ও এখন বিয়ে করবে না।কিন্তু কে শোনে কার বাণী। এবারো নাকি একটা ঠিক করে রেখেছে। কেউ দেখতে আসলে নিজেকে কোরবানীর হাটের গরু মনে হয় ওর কাছে।
————————-
————————-
আর ভাবতে ভাল লাগছে না ওর। পাশের লোকটাকে অসহ্য লাগছে। পাশের লোকটা বার বার ওর দিকে সরে সরে বসছে।কিছু পুরুষ মানুষের এই একটা স্বভাব যুবতি মেয়ে দেখলেই খালি ছুক ছুক করে। সে হোক বিবাহিত অথবা অবিবাহিত। অনেক্ষন সহ্য করার পর কণিকা স্ট্রেট বলে দিল
—এই মিস্টার আপনি ঠিক করে বসেন আর নড়াচড়া কম করেন।
—আইচ্ছা আফা। কিছুক্ষণ পর লোকটা বলে উঠল
—আফা আন্নে কোনাই যাইবেন?
—কেন?
—না,আন্নের বেশি ফ্রবলেম অইলে আন্নে এই সিটে বইতো হারেন।
কণিকা সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলো। তারপর আবার যন্ত্রণা। লোকটা ভাব দেখানোর জন্য উচ্চ শব্দে পেপার পড়ছে। মনে হচ্ছে উনি পেপারের হেডলাইন মুখস্ত করছে।আশেপাশের সব লোক ও বিরক্তিকর চোখে তাকাচ্ছে। অবশেষে কণিকা বলেই ফেলল
—ভাই একটু আস্তে পড়েন।সবার সমস্যা হচ্ছে।
—ও আইচ্ছা আইচ্ছা। কিছুক্ষণ পর একটা সান গ্লাস পড়ল।ভাব নিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করল। কণিকা অবশ্য আগে থেকেই গান শুনছিল।কিছুক্ষণপর উনি বলে ঊঠলেন
—-আইচ্ছা আফা আন্নে কি গা হুনেন।
—কেন?রবীন্দ্রসংগীত।
—-এইডা কি কইলেন?আপনার মতো মরডান মাইয়া বুঝি এই গান হুনে?
—কেনো?শুনলে কি প্রব্লেম? না কোনো প্রবলেম নাই। রাস্তায় গাড়ি একবার যাত্রা বিরতি দিল। কণিকা নেমে গিয়ে রেষ্টুরেন্টের একটা কোণের টেবিলে গিয়ে বসল। সাথে সাথে লোকটা গিয়ে হাজির।
—আপা আন্নে কিতা খাইবেন?
—পাস্তা।
—এইডা আবার কি খাওনের নাম? কিতা হানি ভাত নি?
—না, এটা একটা চাইনিজ খাবার।
–ও আইচ্ছা। আই মনে কইরলাম হানি ভাত।
————————-
———————–
খেয়ে কণিকা বাসে উঠল।লোকটা কি কি যেন খেল।এরপর লোকটা একটা সিগারেট ধরাল। বাসের জানালা দিয়ে কণিকা দেখছে লোকটা সিগারেট টানছে।ওর রাগ হচ্ছে খুব।সিগারেট খাওয়া শেষ করে ওর পাশেই এসে বসবে।সিগারেট খাওয়া লোকজন ওর একদম অপছন্দ। ক্লাসের বন্ধুরা সিগারেট খেত বলে ও সবসময় ওদের এড়িয়ে চলত।তাই ওরা উপহাস করে বলত দেখিস তোর বর মদ তারি খাবে। যত্তসব আজগুবি কথা।
————————
————————
লোকটা এসে পাশে বসেছে।ওহ কি অসহ্য লাগছে।চুইংগাম খেতে খেতে এসেছে।এসেই কণিকা কে বলল
—আফা চুইংগাম খাইবেন্নি?
—না,আপনি খান।
—আরে খাই চান বালা খাইতে।
—বলেছি না আপনি খান।আপ্নি এত  কথা বলেন কেন?
—ওহ, এতে রাগ হওনের কি হইল।আন্নের তো দেহি ৪৪০ ভোলটেজের মেজাজ।
—আপনি থামবেন? লোকটা কিছুক্ষণ চুপ।এরপর আবার শুরু
—আফা আন্নে কোনাই নাইম্বেন?
—কেন?
—না তাইলে জানতে পাইরতাম আন্নে আঁর আগে নাইমবেন না পরে।
—আগে নামলে কি অসুবিধা হবে?
—হ্যাঁ,
মানে কতাবারতা কইতে কইতে তো আইলাম বাকি পথটাও ভালোই কাডি যাইত। কণিকা মনে মনে ভাবছে আমি তো নামতে পারলেই বাঁচি।মুখে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর লোকটা আবার বলে ঊঠল
—আফা আন্নের কাছে হানির বোতল আছেনি?
—কেন?
—হানির তিয়াস লাগি গেছে। কণিকা পানির বোতল দিল। লোকটা পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে। দেখলে গা জ্বলে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার
—আফা আন্নে কাউরে বালবাসেন না?আন্নে বিয়া কইরতেন্না?
—আপনি আমায় এগুলা কি কথা বলেন?
—-আসলে আইঁতো মাইয়া চাইবার লাই ইয়ানো আইছি।আর আন্নেও দেখতে শুনতে মাশাল্লা।
—আপনি কার জন্য মেয়ে দেখতে আসছেন?
—কার আবার আমার। কণিকা হাসল।এই লোকটা কে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?কত বাচাল লোকটা। সারাটা রাস্তা জ্বালাইলো। কণিকার স্টেশন আসতে আর পাচঁ মিনিট।ও নেমে যাবে।তাই ব্যাগপত্র ঠিক করছে।লোকটা বুঝে গেছে ও নেমে পড়বে।তাই বলে ফেলল
–আফা আপনের মোবাইল নাম্বার টা দিবেন্নি।
—কেন?
—ফোন কইরতাম।আন্নের লগে এত  কতা অইল।বালা লাইগছে।
—সরি দেওয়া যাবে না লোকটা চুপ করে বসে ছিল।মন খারাপ হয়ে গেছিল হয়ত। কণিকা নেমে পড়ল। লোকটা নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে দেখছে ওকে। কণিকা একবার তাকলো
———————–
———————–
কিন্তু বিপত্তি ঘটল ঈদের তিনদিন পর যখন ওকে দেখতে পাত্রপক্ষ এলো। পাত্র দেখে কণিকার চোখ ছানাবড়া। এই তো সেই আজব চিড়িয়াটা।গাড়িতে যে চার ঘন্টা জ্বালাইছে।চার ঘন্টায় জীবন জাহান্নাম হয়ে গেছিল। একে সারা জীবন সহ্য করার তো প্রশ্নই আসেনা।
কণিকা মনে মনে একেও টা টা বলে দিল। কিন্তু এসেছে যখন সামনে তো যেতেই হবে।গেল। লোকটার সাথে তার বোন আর দুলাভাই এসেছে।বোনটা এত সাজগোজ করেছে মনে হচ্ছে মডেলিং করতে এসেছে। যাওয়ার সাথে সাথেই ওকে দেখে লোকটা চমকে উঠল
—আরে আপনি?
—এটা তো আমাদের বাড়ি শুনেই বোন দুলাভাই কে বলল আমি ওকে চিনি।আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই। সবাই ওদের একা ছেড়ে দিল। এরপর লোকটা বলতে শুরু করল
—তুমি আমাকে অপছন্দ কর তাই না? কণিকা অবাক হয়ে শুনছে লোকটা এখন শুদ্ধ বাংলায় কথাবলছে।কোন জড়তা নেই।আর দেখতেও ভাল লাগছে।বাবা বলেছিল এই লোকটা নাকি ইঞ্জিনিয়ার। অথচ বাসে কি ব্যবহার করল। কণিকা বুঝে ঊঠতে পারল না কি বলবে। লোকটা কে আজ কেন জানি খুব ভাল লাগছে। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি জানি তুমি কি ভাবছ। আমি তোমাকে আগে থেকেই চিনতাম। তোমার ছবি দেখেছিলাম। আমি জানতাম তুমি সেদিন বাড়ি আসবে কিন্তু একই বাসে যে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। তোমার সাথে সেদিন খুব মজা করতে মন চাইছিল তাই ইচ্ছে করেই বিরক্ত করেছি।কণিকা ওর দিকে তাকিয়েই আছে। কথা গুলো মন্ত্রমুগ্ধার মতো শুনছে। বিয়েটা তাহলে এবার করেই ফেলবে ও।এমন পাগল বরের পাগলামো মন্দ হবে না।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত