পূর্ণতা

পূর্ণতা

কিছুক্ষণ আগে সামনে ব্যস্ত হয়ে বসে থাকা লোকটাকে বিয়ে করেছি।আধঘোমটা মাথায় টেনে অনবরত ঘোমটার আড়ালে তাকিয়ে লোকটাকে দেখছি।এক অজানা ভালো লাগা কাজ করছিলো । মনে হচ্ছে,এইতো লোকটা এবার মনে হয় আমার পাশে এসে বসবে,হাতে হাত রাখবে,চোখে চোখ রাখবে।

কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলো।সেদিন লোকটা আমার হাতে হাত রাখাতো দূরের কথা, একটি কথা পর্যন্ত বলেনি।আমি অবাক হয়ে কেবল সময় অতিবাহিত করছিলাম।

লোকটার নীরব থাকা, দূরে দূরে থাকা তাছাড়া আমাকে ভালো না বাসার কারণ খুঁজতে লাগলাম।অবশেষে অনেকগুলো কারণ পেলাম।অথচ, এই কারণগুলোকে কখনো ভালবাসা না পাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাবিনি।

সেদিন খাট গুঁছিয়ে রাখতে গিয়ে লোকটার বালিশের নিচে একটা সিগারেটের প্যাকেট পেলাম।প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কি মনে করে জানি প্যাকেটটা খুললাম।কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এখানে একটা সিগারেটও নেই।প্যাকেটের অন্দরমহলে ছোট্ট দুটো চিরকুট ছিলো।চিরকুট দুটো পড়ে থমকে গেলাম।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলাম।পায়ের হিল জুতাটা খুলে দাঁড়ালাম।বারবার একটাই প্রশ্ন মনে আসছে,
আচ্ছা, বেটে, নাক বোঁচা মেয়েদেরকে কি ভালবাসা যায় না ?

হঠাৎ খেয়াল করলাম, লোকটা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।চেহারায় প্রচুর বিরক্তি ! আয়নার এক পাশে গিয়ে উনাকে জায়গা দিলাম।উনি আয়নার সামনে দাঁড়াতে আরেকবার নিজের আর উনার দিকে তাকালাম।সত্যি তো , উনি আমাকে ডিজার্ভ করে না।আমার থেকে হয়তো অনেক ভালো কেউ উনার ভাগ্যে জুটতো !

রুম থেকে বেরিয়ে বেলকোণিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।দূরে একটা অলকানন্দা ফুল চোখে পড়লো।হলুদ ফুলটা কেমন ফ্যাকাশে রঙ ধারন করলো মানুষের পায়ের নিচে পড়ে।জানিনা, লোকটাকে ক্রমশ এত ভালবেসে ফেলছি কেন ? ভালবাসাগুলো যখন পূর্ণতা পায় না তখন সেটা বিষ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে।ক্রমশে অস্তিত্বকে ফ্যাকাশে করে তুলে।ঐ অলকানন্দা ফুলটার মতই ফ্যাকাশে !

আমাদের বিয়ের বয়স মাত্র ছয়মাস।এই ছয়মাসে ১৮০টি চিরকুট পেয়েছি উনার কাছ থেকে।সবগুলো চিরকুট সিগারেটের প্যাকেট মোড়ানো ছিলো।

সবগুলাতে কেবল আমাকে ভালো না বাসার কারণ দেখিয়ে গেলেন উনি।আর আমিও রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কারণগুলো পর্যবেক্ষণ করতাম।আয়নার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কখন যে কারণগুলো খুঁজতে গিয়ে নিজেকেও খুব ভালবাসতে শুরু করলাম,জানিনা।

অর্ধবৎসর উনার সাথে সংসার করলাম ঠিকই কিন্তু সম্পূর্ণ সংসার না করার মতই।ভাবছি, সম্পর্কের শেষ কি এখানেই ? কালকের চিরকুটে হয়তো উনি ডিভোর্সের কথা উল্লেখ করবেন।কিন্তু না , আমি ভেঙে পড়বো না।কখনোই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবো না।কেন জানি, শক্ত হয়ে থাকতে পারিনা।আচ্ছা,প্রকৃত ভালবাসাগুলোকে এভাবেই হারিয়ে যেতে হয়?

সারারাত ঘুম হয় নি।উনার বিপরীতে শুয়ে খুব কেঁদেছি।আমি উনাকে পেয়েও পাইনি। তারপরেও আমার অনুভূতিতে, আমার ভালবাসায় উনি লেপ্টে আছেন বিরতিহীনভাবে।

পরেরদিন আর উনার বালিশটা উঠায় নি।চিরকুটে ডিভোর্স লিখাটা পাওয়ার এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে।
বালিশটা না উঠিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।প্রতিদিনের মত আজও উনি এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।আমি আয়নার সামনে থেকে সরে আসলাম।বেলকণিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।হঠাৎ দেখলাম, উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।হাতে একটা অলকানন্দা ফুলের গাছ।তার সাথে একটা সিগারেটের প্যাকেট।আমি ঝাপসা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।

–কি ব্যাপার ? আজ চিরকুট পড়লেন না ?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অসম্ভব মায়াঘেরা চোখদুটো আমায় দেখছে।

–আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন ?
ক্রমাগত চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে।আর আটকাতে পারিনি।অবশেষে উনার সামনে কাঁন্না করতে শুরু করলাম।

— উহু , আমরা প্রায় সময় যা দেখি তা কিন্তু হয় না।আপনি আজকের চিরকুটটা পড়লে আর এত কষ্ট পেতেন না।

–মানে ?
অবাক হয়ে উনাকে প্রশ্ন করলাম।

–আচ্ছা, কাল রাতে ভিজে যাওয়া বালিশটাতে ঘুমাতে কষ্ট হয় নি?আর অত দূরের অলকানন্দা গাছটা দেখতে কষ্ট হয়তো ? এই নিন, আমাদের বেলকোণিতে এই অলকানন্দা গাছটা লাগিয়ে দিন।তাহলে বাকি জীবন কষ্ট করে দূরের জিনিস দেখতে হবে না।

–দূরের জিনিস দেখি ! আপনি কিভাবে বুঝলেন ?
শাড়ির আঁচল টেনে চোখের পানি মুছেই রহস্যভেদ করার জন্য উনাকে বলছি।

–এই যে, আমিই তো জ্যান্ত উদাহরণ ! দূরে রাখতে রাখতে এখন দূরেই ঠেলে দিচ্ছেন,আর দূরের মানুষটাকে দেখছেন ? নতুবা আপনাকে ছেড়ে যাবার কথা আসলো কেন,হু ? কাছে এসে আপনার সাথে অদৃশ্যভাবে লেপ্টে থাকা মানুষটাকে একবারও অনুভব করেছেন?

–তাহলে ঐ চিরকুটগুলো ?

–বোকা মেয়ে । এমন উঁচু জুতা পরে হাঁটতে আপনার কষ্ট হয়।তাই অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও জুতা খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ান।যেটা আপনার অজান্তে আমার ভালো লাগতে শুরু করে।আপনি জানেন, আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করি, কখন আপনি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন,আর কখন আমি আপনাকে দেখবো ! হিল জুতা ছাড়া !

আমি কিছুই বললাম না।দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে।এই যেন, এক পরম পাওয়া !ভালবাসা পাওয়ার তৃপ্তি অন্য কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না।হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে অগ্রসর হলাম উনার শহরে।উনার ভালবাসার শহরে।যেখানে ছোট্ট একটা ঘর থাকবে, ঘরজুড়ে একটা বাতি, একটা খাট,একটা বালিশ আর একটা আমি আর উনি।ছোট্ট ঘরজুড়ে থাকবে আমাদের অসীম ভালবাসা।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত