“একজন মেডিকেল কলেজ এর ছাত্রীকে বার বার এতোদুর থেকে দেখতে আসা এই ব্যাপারটার মাঝে আমি অনেক বিরক্ত হই এটা কি কখনো আপনি বুঝতে পেরেছেন?” মিলির এই কথার কি প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় আমি মাথা নিচু করে ভাবতে থাকি। আসলে ওকে আমি দেখতে আসি কেন? এই দেখার মাঝে আমার নিজের কাছে যখন একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে সেটা কি মিলি জানে? মিলির সাথে আমার পরিচয় রাঙ্গামাটিতে। এই সবুজে ঘেরা পাহাড়ী শহরে গত বছরের শেষের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কয়েকজন মিলে ওদের একটা টিম এই পাহাড়ী মানুষদের সেবা প্রদানের জন্য এসেছিল। কিন্তু আপাতত এখন আমি ভাবছি মিলিকে হুট করে দেখতে আসার অধিকার কি আমি রাখি? আমার মনে হলো ওকে একটা স্যরি বলা দরকার। এটাও বলা দরকার আপনাকে আমি আর দেখতে আসবো না। এভাবে হুট করে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করা আমার মোটেও উচিৎ না। বিশেষ করে আমার মত একজন ছেলে আপনাকে বিরক্ত করার কোন অধিকার রাখে না।
আমার এমন চুপ করে নিচে তাকিয়ে থাকা দেখে মিলি বললো “কথা বলছেন না কেন? আপনার এসব ছাগলামীর জন্য আমারই দোষ। আপনাকে আমি অনেক প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। আরও আগে আপনাকে খুব করে কিছু বলার উচিৎ ছিল।” আমি ওর দিকে গম্ভীর মুখ নিয়ে তাকাই। সাদামাটা আমার এই জীবনে কোন কবিতার ছাপ নেই। চোখ বন্ধ করলেই যে কবিতা আমাদের ভিতরের আত্মাকে জানান দেয় সেই কবিতা। প্রিয় মিলি আপনি কি জানেন আপনাকে প্রথম দেখেই আমার কেমন লেগেছিল? আমার সেদিন সারা শরীর জুড়ে প্রচন্ড জ্বর।মনে হয়েছিল আমি মারা যাবো। আমি চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না। তারপরও আপানার সামনে বসে আমি নিভো চোখে প্রথম যখন আপনাকে দেখলাম মনে হলো আমার কিছু হয় নাই। বিশ্বাস করুন কিছু হয় নাই। সেদিন রাতেই এই জ্বর নিয়ে আপনাদের ক্যাম্প এ আমি গিয়েছিলাম। দুর থেকে রাতের রুপালি জোৎস্না আলোয় আপনারা গল্প করছিলেন। বিশ্বাস করেন আপনাদের এই গল্পের দিকে আমার একটুও মনোযোগ ছিল না। আমি শুধু আপনার কাজলে আাঁকা চোখ গুলোকে দেখছিলাম। তখন আমি বার বার মনে মনে বলেছি পৃথিবীটা অনেক সুন্দর অনেক। এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখার জন্য আমি বহুকাল বাঁচতে চাই। কিন্তু আমি জানি না আমাকে কেন এইরকম একটা অদ্ভুত মায়া আচ্ছন্ন করেছিল। এরপর আপনি কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। এই কবিতাটা আমি আরও অনেকবার অনেকের মুখে শুনেছি। কিন্তু আপনার মত এতো সুন্দর করে কেউ বলতে পারেনি। ঠিক আমার প্রিয় মানুষটার মত আপনার চোখ দুইটা। এতো মিল কি করে হতে পারে? এখনো আপনার কন্ঠে সে কবিতাটা আমার কানে বাজে…
আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে…
আমি অনেক ইতস্তত হয়ে মিলিকে বললাম “রাঙ্গামাটিতে খুব ভালো কাঁঠাল, আনারস হয়। কিন্তু আমাদের কাঁঠাল গাছ নেই। তার জন্য আমি দুঃখিত। মা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চয় কাঁঠাল গাছ থাকতো। তবে কয়েকটা আম গাছ আছে। যদিও এই গাছগুলো আমার চাচার। আমি চাচা চাচীর সাথেই থাকি। গাছে অনেক আম ধরেছে। বিশ্বাস করেন আম গুলো অনেক মিষ্টি। তাই আপনার জন্য আমি নিয়ে আসছি। কথা দিচ্ছি আপনার সামনে আমি আর আসবো না। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য অনেক দুঃখিত।” মিলি আমার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারপর অবাক দৃষ্টিতে বললো “আপনি এই আম দেওয়ার জন্য রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকায় আসছেন?” আমি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললাম “না আরও একটা কারণ আছে। যদিও বলাটা আমার ঠিক না। তারপরও বলছি কিছু মনে করবেন না। আপনার কাজলে আঁকা চোখ দুটোকে দেখতে আসছি।আপনার এই চোখ গুলোকে দেখলে আমার অনেক শান্তি লাগে। পড়ানটা জুড়ায় যায়। মানুষটার কথা মনে পড়ে। ঠিক আপনার মত ওর চোখ গুলো ছিল। ওকে আমি হারিয়ে ফেলছি। আমি যাই ভালো থাকবেন।” এটা বলেই মিলির সামনে থেকে উঠে গেলাম। ও ঢাকা মেডিকেলে এমবিবিএস শেষ করে ইন্টার্নী করছে। আর কয়েক মাস পরেই ও একজন পাক্কা ডাক্তার হয়ে যাবে।
ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে রেলিং ধরে সন্ধ্যা হওয়ার লালচে সূর্যটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই সন্ধ্যার আকাশে উড়ে যাওয়া কাক আর পাখি দেখা যায়। সন্ধ্যা হলেই সবাই নিজ বাড়ির দিকে ছুটে যায়। মানুষের মতও কাক পাখিরা এই জিনিসটা খুব ভালো করেই বুঝে যে দিনের আলো ফুড়িয়ে গেলে নিজ বাসায় যেতে হবে। আমাকেও এখন যেতে হবে। মিলির সামনে থেকে চলে আসার পর বাকি সময়টা আমি ধানমন্ডি লেকে বসে বসে ঝিমিয়েছি। ছোট বেলাও দিনের আলো শেষে যখন সন্ধ্যা নামতো মা আমাকে ধরে নিয়ে বাসায় নিয়ে যেতেন। আমি স্কুল শেষ করে সারাদিন এই পাহাড় ঐ পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। খেলতাম। আমার যখন তিন বছর আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন পাহাড়ী বন্য হাতির পারা খেয়ে। বাবার আদর কেমন আমার জানা নেই। মা আমাকে প্রতিবার বাসায় নিয়ে এসে বলতেন “বাজান তুমি ছাড়া আমার কেও নাই। তুমি হারায় গেলে আমি কি নিয়া বাঁচমু? কারে নিয়ে সকাল দেখমু? আমার কলিজা আমার সোনাটা। তুমি আমার থেইকা হারায় যাইও না আব্বা। পাহাড় থেইকা পইরা যদি তোমার কিছু হয়ে যায়?” কিন্তু একটা সময় আমার মা নিজেই হারিয়ে গেলো। সেদিনের কথা মনে পড়লে আমি কেন যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ওখানেরই একজন প্রভাবশালী, টাকা পয়সা ছিল নাম সাকের আলী। কিছুদিন পর পর বাড়িতে এসে মাকে কি যেন বলতো। এই সাকের আলীরে আমি অনেক ভয় পেতাম। তার চোখ দুটো অনেক বড় বড় ছিল।আমি মায়ের মুখটা ঠিক এত্তটুকু ছোট হয়ে যেতে দেখতাম। মা অনেক রাগী হয়ে উনার সাথে কথা বলতো। মা আমাকে বলতো আব্বা এসব কিছু না। ক্ষুধা লাগছে? কলা দিয়ে মুড়ি দিয়ে দেই?” আমি মাথা দিয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। আমি আমার মায়ের চোখে পানি দেখতাম। একদিন এই সাকের আলী রাত্রের সময় বাড়িতে আসলো। আমি তখন পড়ছিলাম। আমি যখন পড়ি তখন মা আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকতো। বলতো আব্বা তুমি অনেক বড় হবা হ্যাঁ? তোমার বাবার ইচ্ছা আছিলো তোমারে অনেক অনেক পড়ালেখা করাইবো।” গরম লাগছিল বলে মাকে বলেছিলাম দরজা খোলা রাখো। তখন বিদুৎ ছিল না। চেরাগ দিয়ে পড়তাম। আমার এখনো মনে আছে। আহসান হাবীব এর কবিতা পড়ছিলাম…
এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে…
ঘরের ভিতরেই সাকের আলী আর একটা লোক ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করেই মাকে প্রথম এই কথাটাই বলেছিল “মাগী তোর অনেক দেমাগ না? ভালোই ভালোই বুঝাইছিলাম তুইও সুখে থাক, আমাগোও সুখে রাখ। কথা তো হুনলি না। আইজ বুঝবি।” মা সাথেই সাথেই মাছ কাটার বটিটা নিয়ে বললো “আমার ঘর থেইকা অহনি বাহির হ হারামীর বাচ্চারা। একবারে শেষ কইরা দেমু কইলাম। বাইর হ কইতাছি।” আমার খুব ভয় লাগছিল। সাকের আলীর সাথে যে লোকটা আসলো সে আমাকে ধরে মাকে বললো “কুবাবি? পারলে কুবা।” আমি অনেক কান্না করতে থাকি। আমি ছোট ছিলাম তো আমার মনে অনেক ভয় ছিল। মা আমাকে বলতে লাগলো “বাজান ভয় পাইও না। কিচ্ছু হইবো না তোমার। আমি থাকতে তোমারে কিছু হইতে দিমু না।” মা যখন আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো এসব কথা তখন সাকের আলী মায়ের হাতের বটি টা নিয়ে চুলের মুঠোয় ধরে ফেলে। আমি ঐ লোকটার হাতে কামড় দিয়েছিলাম। লোকটাকে আমি চিনতাম না। তবে ওর চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কামড় খেয়ে উনি রেগে গিয়ে আমাকে অনেক অনেক মারলো। আমি চিৎকার দিলাম। পৃথিবীর ভয়ংকর চিৎকার। সেই চিৎকার বা সেই শব্দ, পৃথিবীর যে কোন মানুষই ব্যাথা পেলে মন থেকে একটা শব্দ বের হয়ে আসে। সেই শব্দটা হলো “মা” আমার চিৎকার শুনে মা ও চিৎকার করতে লাগলো। এরপর আমার কি যেন হয়েছিল। আমার কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমার পাশে দেখেছিলাম চাচীকে। চাচা আর চাচীর বাড়ি ছিল আমাদের থেকে ৪০০ ফুটের মত দুরে। মায়ের শরীরটা কেমন যেন মাটিতে পরে ছিল। জিবটা বের হয়েছিল। চুলগুলো এলোমেলো। মুখে খামছির দাগ, রক্ত। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মায়ের এমন চেহারা দেখে। আমি অনেক কাঁদলাম। ভয়ংকর ভাবে কাঁদলাম। আমার মা হয়তো মাটিতে পরে থাকা অবস্থায় তখনো বলছিলো “আব্বা কাঁদবানা, আমার কিছু হয় নাই তো। তুমি কাঁদলে আমার অনেক কষ্ট লাগে আব্বা।” আমি আরও চিৎকার দিয়ে কাঁদি। সেদিনের এই কান্নার শব্দটা আকাশকে ছুয়ে দিতে পেরেছিল কি? আমার জানা নেই।আমি আদনান সেদিনই আমার মাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিনের পর থেকেই সাকরে আলী, আর সে লোকটাকে আর দেখিনি। এই শহর ছেড়ে চলে গেছে। চাচীর কাছ থেকে শুনেছিলাম তারা আমাকে সহ ঘরে আগুন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি হঠাৎ করে এসে দেখাতে পালিয়ে গেছে। কোথায় আছে ওরা আমি এখনো ওদের খুঁজে বের করতে পারিনি।
সাতদিন হলো আমার বন্ধু রাসেল ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসছে বিয়ে করতে। সে চট্টগ্রাম কাস্টমে জব করে। এইচএসসি পাশ করেই শহরে চলে গিয়েছিল। তার কোন এক বড় মামার মাধ্যমে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে চাকরি নেয়। আর আমি এমবিএ শেষ করেও কোন চাকরি পেলাম না। অবশ্য চাকরির প্রতি আমার এতো আগ্রহ নেই। এই তো বেশ আছি এই লেক, পাহাড়রে বুকে। পাহাড়ের বুক ধরে লেকের পানি যখন বয়ে যায় আমার ভিতরে তখন কেমন যেন লাগে। মনে হয় এই পানি শুধু পানি না। এইগুলা পাহাড়ের কান্না। আচ্ছা পাহাড় কি মানুষের মত কান্না করতে পারে? তিয়ানাও বলতো পাহাড় কান্না করতে পারে। রাসেল টঙ্গে বসে চা খেতে খেতে আমাকে বললো “দোস্ত যে মেয়েরেই দেখি সে মেয়েই কালা। হয় নাক বোচা, হয় চোখ ট্যারা আর মাঝে মাঝে তো খাটো মেয়ে পরে। আর যে দু একটা মেয়ে পছন্দ হইছে এগুলো বেশি স্মার্ট। আমার জীবন আর জীবন রাখবে না। আমার সাথে এগুলো যায় না। বহুত কষ্টে একজনরে পাইছি। নাম ফারিয়া। মেয়ের পরিবারের সবাই রাজি। মেয়েও রাজি। কিন্তু মেয়ে কেন রাজি হইলো সেটা আমি বুঝি নাই। মেয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। ওরা একটু গরিব টাইপের। ফারিয়া আমাকে গতকাল কাল রাতে ফোন দিয়ে বলছিলো “আমি ফারিয়া।আপনার সাথে কিছু কথা আছে।” আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম। বললাম “তার আগে আমি আপনাকে বলতে চাই আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন? আপনি তো আমার থেকে বেশি পড়ালেখা করছেন। ভালো ছেলে পেতেন।” সে অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বললো “আমরা অনেক গরীব। কিন্তু আমার গরীব বাবা মায়ের আমি রাজকন্যা।ছোট একটা ভাই আছে। আমার বাবা মা হয়তো ভাবছে আপনার সাথে বিয়ে হলে আমি সুখে থাকবো ভালো থাকবো।ছোট পোস্ট হলেও ভালো একটা জায়গায় চাকরি করেন। আপনি নিশ্চয় ভাববেন আপনাদের অনেক টাকা পয়সা আছে বলেই আপনার কাছে গছিয়ে দিচ্ছে বাবা মা। এই ভাবাটা স্বাভাবিক। বিশ্বাস করেন আমার টাকা পয়সার প্রতি কোন লোভ নেই। আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই মনে করি। মানুষকে ভাবতে, চিনতে, বা অনুভব করতে মানুষ হিসেবেই প্রথমে ভাবা দরকার। আপনাকে আমি অন্যকারণে ফোন করেছি।কথাটা কি বলবো?” বিশ্বাস কর আমি ভাবছিলাম মেয়ের সাথে অন্যজনের লাইন আছে। সেকথা আমাকে জানাতে ফোন দিছে। আমি হুম করে শব্দ উচ্চারন করলাম বুঝলি আদনান। তারপর সে বললো “আমি পড়ালেখাটা শেষ করতে চাই। বিয়ের পর আমার পড়ালেখাটা বন্ধ করিয়েন না। এই একটা কথা বলার জন্য আমি আপনাকে ফোন দিয়েছি।” আমি অনেকক্ষন ভাবছিলাম।কোন উত্তর দেই নাই।কথাটা শোনার পর আমার ভিতরে কি যেন হচ্ছিল। একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল আমার শরীরটা। বললাম “আপনাকে আমি পরে জানাবো কেমন?” তারপর ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম।” আমি রাসেল এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম “শালা এই মেয়েরে ভুলেও হাতছাড়া করিস না।এমন মেয়ে পাওয়া সহজ কথা না। ভাবীরে জানিয়ে দিস আপনাকে আমি পড়াবো এক শর্তে। আপনি পড়বেন বই, আর আমি পড়বো আপনাকে। ভালোবাসা দিয়ে পড়বো। আপনি হবেন আমার ভালোবাসার বই।সারাজীবন এই ভালোবাসার বইটা আমার কাছে রাখবো। যদি আমার ভালোবাসার বই হতে চান তাহলে আপনি যত ইচ্ছা পড়েন আমি পড়াবো সমস্যা নেই।” রাসেল আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো আমার কথায় ও একটু অবাক হয়েছে। আমি বললাম “যাইরে পরে কথা হবে।” যখন উঠে গেলাম রাসেল বলতে লাগলো “তোরে আমার এইজন্য ভাল্লাগেরে বন্ধু। তুই আমার মনের কথা বলছিস।” আমি আর কিছু বলি না ওকে।
পাহাড়ের আঁকাবাকা পথে হাটতে হাটতে আমি ভাবি ঠিক এমন করেও একজন আমাকে চেয়েছিল। আমাকে তার সমস্ত কিছু দিয়ে ভালোবেসেছিল। কিন্তু আমি তার ভালোবাসার কোন মর্যাদা রাখতে পারিনি। তাকে আমার কাছে বেধে রাখতে পারিনি। বেধে রাখার রশি বা শক্তিটা কি আমার কাছে ছিল? তার নাম ছিল তিয়ানা চাকমা। সে চাকমা হলেও খুব ভালো বাংলা বলতে পারতো।সে যে চাকমা একেবারে বুঝা যেত না। আমি তখন ইন্টার পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রশ্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সে সময়ে একটা টিউশনি পাই। টিউশনিটা আমার খুব দরকার ছিল।তিয়ানা তখন নিউ টেন এ। আমি যখন ওকে পড়াতাম ও শুধু বই এর দিকে চোখ রেখে পড়তো। আমার সাথে কথা বলার সময়ও নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। মাঝে মাঝে আমি ওকে ভাবতাম ও একটা প্রজাপতি। লাজুক প্রজাপতি। আর এই লাজুক প্রজাপতিটা হঠাৎ করে মাস কয়েক পরে একদিন ইতস্তত হয়ে বললো “কয়েকদিন পর তো বিঝু উৎসব।আমার সাথে রাতের পাহাড় দেখবেন?” আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। এই কথাটাও বলার সময় নিচে তাকিয়ে ছিল। ওদের প্রধান উৎসব বিঝু। বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখেই এই উৎসব পালন করে থাকে। দিনটাতে নতুন জামা কাপড় পড়ে। ঘরবাড়ি ফুলে ফুলে সাজায়। বিভিন্ন রকমের সবজি একত্র করে রান্না করে।আমার চুপ থাকা দেখে ও আবার বললো “আমার ইচ্ছে হয়েছে এই রাতে আপনার সাথে পাহাড় দেখবো। রাতের পাহাড় চাঁদের রুপালি আলোয় কেমন করে সাজে, কেমন করে ডাকে, কেমন কের কান্না করে তা দেখবো। এই সবুজের শহরে প্রকৃতির মায়াময় রুপ, কিংবা এই পাহাড়ের নীল জল আর বিস্তৃত মুগ্ধতা আমাদের ভিতরের জমে থাকা ক্লান্তি হতাশাকে মুছে দিয়ে গভীর মমতায় কেমন করে আচ্ছন্ন করে তা অনুভব করবো। দেখবেন না আমার সাথে রাতের পাহাড়?” আমি কিছু বলি নাই। এর প্রত্যুত্তর আমার কাছে ছিল না। এই মেয়েটা যে এতো চমৎকার করে কথা বলতে পারতো আমার জানা ছিল না। তারপর সে আমার দিকে তার নয়নজোড়া নিয়ে তাকালো। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা আমার তখন কি যেন হয়েছিল। এমন সুন্দর কাজলে আঁকা চোখ জোড়া নিয়ে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল এই পৃথিবীর অদ্ভুত অর্ধেক সৌন্দর্য এই চোখেই। রাতের পাহাড় দেখার প্রয়োজন কি আছে আর? এই তাকানোর মাঝে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।বিঝু উৎসবের সেই দিনটাই আমার জীবনের সব চেয়ে ভালো দিন ছিল।সারাটা দিন আমি ওর সাথে ছিলাম। রাতের বাধ ভাঙ্গা জোৎস্না আলোয় জীবনের আর একটা আলো খুঁজে পেয়েছিলাম।সে আলোর মাঝে আমি সাদা মেঘ দেখতে পাই।
ঠিক দু্ বছর পর আমি তখন চট্টগ্রাম ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসেছিলাম। এর কিছুক্ষনপর আমার কাছে একটা চিঠি আসে। তিয়ানার চিঠি। ও তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আমি ওকে আর পড়াতাম না। কিন্তু যখনই বাড়ি যেতাম ও আমার সাথে দেখা করতো। কথা বলতো। বলতো “এই কাজলে আঁকা চোখ না দেখে আপনি কি করে ওখানে পরে থাকেন? কষ্ট লাগে না?” আমি কিছু বলতাম না। তিয়ানার চিঠিতে কয়েকটা লাইন মাত্রই ছিল “আমার ভিতরে যে শহরটা দেখেছি সে শহরটার আলো বাতাস রোদ বৃষ্টি সবকটার মাঝেই আপনি আছেন। আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যান দোহাই লাগে আপনার।আমার এই কাজলে আঁকা চোখ দুটোর মায়া শুধু আপনিই বুঝতে পারেন আমি জানি। এই চোখ দুটো ছোয়ার অধিকার শুধু আমি আপনাকে দিব আর কাউকে দিব না। এই চোখ দুটো অন্যজনের হতে দিয়েন না।কিছু একটা করেন। যদি আপনাকে না পাই বিশ্বাস করেন এই চোখ দুটো কাউকে ছুতে দিব না, কাউকে না।” আমি কিছুই করতে পারিনি। কিছু করার মত আমার অবস্থা ছিল না। সেই বয়সে বা সে সময়ে আমার কিবা করার ছিল? দুজন দু ধর্মের। এই সমাজ, সমাজের মানুষ তা কি মেনে নিত? বিয়ের আগের দিন রাতেই সে পাহাড় থেকে পরে আত্মহত্যা করে। আমি জীবনের যে আলোটা বিঝু উৎসবের রাতে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই আলোটা এমন করে হারিয়ে ফেলবো তা বুঝতে পারিনি।আমি ভিতরে ভিতরে কাঁদতাম। অনেক পাপবোধ হয় নিজের ভিতরে। আমি এই একটা মানুষের জন্য আর একটা মানুষ এই ভাবে হারিয়ে যাবে তা কতটা ভয়াবহ।এরপর একটা বছর আমি ভালো ছিলাম না। ভালোছিলাম না বলতে আমি একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই আমাকে দেখে চিনতো পারতো না আমি সেই আদনান। মা প্রায় রাতে ঘুমের মাঝে বলতো “আব্বা তোমার কি অনেক কষ্ট? বেবাগ কষ্ট তুমি আমারে দিয়া দাও আব্বা। তোমার কষ্ট আমার ভালা লাগে না। তুমি আর কাঁইদোনা আব্বা।” প্রিয় তিয়ানা আমি দুঃখিত, অনেক দুঃখিত তোমাকে ঠিকমত বুঝতে পারিনি।
আর এতো বছর পর এই কাজলে আঁকা চোখ দুটোকে হঠাৎ করে দেখতে পারবো আমি আশা করিনি। মিলির চোখ দুটোর মাঝেই তিয়ানাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। গত বছরের শেষের দিকে আমার কি জ্বর। চাচা আমাকে ঢাকা থেকে আগত ডাক্তারদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। জ্বরের ঘোরে চারপাশে কি হচ্ছে বা আামকে কোথায় নিয়ে আসছে আমি কিছুই বুঝিনি। প্রথম যখন মিলি আমার কপালে হাত দিয়ে দেখলো আমি তখন কেমন করে যেন কেপে উঠেছিলাম।ঠিক তখন চোখ দুটো মেলে ভালো করে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম আমার সামনে সেই কাজলে আঁকা চোখ।আমার ভিতরটা একদম কেপে উঠেছিল।যতদিন মিলি ছিল ঠিক ততদিন আমি তাদের পিছন ঘুরঘুর করেছি। দু একবার ওর সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আমাকে শুধু একটা কথাই বলতো “এখন ভালো আছেন?” আমি মাথা নেড়ে শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ঢাকায় ওরা চলে যাওয়ার কয়েকমাস পর আমি ঢাকায় গেলাম।সিরিয়াল নিয়ে দেখা করলাম। আমাকে সে চিনতে পেরেছিল। বললো “আপনি এখানে?” আমি কিছুটা সময় নিয়ে বললাম “কয়েকদিন ধরে ঘুম হয় না। ঘুম যেতে পারি না। অস্বস্তি লাগে।মনে জ্বালা পোড়া হয়।” ও বেশ অবাক হয়েছিল।একটু হেসে বলেছিল “তো এখানে কেন আসলেন? ওখানে ডাক্তার ছিল না? এমন বোকামি কেউ করে?” এর কয়েক মাস পর মিলির সাথে আমি আবার দেখা করি। যথারীতি তার সামনে গেলে সে পুনরায় অবাক হয়। আমাকে বলে “কি সমস্যা?” আমি বললাম “হাটতে গিয়ে পা মচকে গিয়েছে।যদিও অতটা ব্যাথা পাইনি।তবে কিছুক্ষন হাটলে পা টনটন করে। ভর দিতে পারি না। আপনি কিছু একটা করেন।” সে অনেকক্ষন চুপ করে ছিল। তারপর বললো “আমাকে কি সব রোগের ডাক্তার মনে হয়? আর পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন এতো দুর আসার কি দরকার ছিল?” তারপর সে আমাকে অন্য আরেকজনের কাছে রেফার করে।পরপর আমি আরো দুই বার ওর সাথে দেখা করি। আচ্ছা এই ব্যাপারটা তিয়ানা কি জানে? ও কি ওখান থেকে দেখছে? ও আমার উপর রাগ করে আছে? আমার যে তিয়ানার কাজলে আঁকা চোখ দেখতে ইচ্ছে করে।এই চোখ দুটো যে আমি অন্যজনের মাঝে দেখেছি।মিলির মাঝে।
ইদানিং শহর জুরে প্রচন্ড গরম।একটু বাতাসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। আমি ভাবি প্রকৃতি কি আমাদের উপর কোন কিছু নিয়ে নারাজ? শুক্রবার দিনটা আসলেই আমার কাছে ঈদ ঈদ লাগে। প্রত্যেক শুক্রবার মা আমার জন্য পায়েশ রান্না করতো। আজ হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়েছে। তিনটা মাস কেমন করে চলে গেলো বুঝতে পারলাম না। মিলির সাথে দেখা করার জন্য আমার আর ঢাকায় যাওয়া হয় না।বিকেল বেলার এই পরিবেশে আমি রাঙ্গামাটির চাকমা রাজার রাজবাড়ি বা রাজবনবিহার এর কিছুটা কাছেই মানে শহরেই বসে বসে সময় কাটাচ্ছি। কত মানুষ এখানে আসে। এখানে ধ্যানমগ্ন হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা বসে থাকে।মাঝে মাঝে ভাবি এই মগ্নের মাঝে ভিতরের আত্মাটাকে কিভাবে জানান দেয় ওরা? এসব ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ গেলো একটা পেপারের দিকে। একজন পেপারটা হাতে করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি নড়ে চড়ে উঠলাম। বুকটা ধরফর করে উঠলো। সাথে সাথেই আমি লোকটার কাছে গিয়ে বললাম “ভাই পেপারটা একটু দেখি। ও ভাই একটু দেখি দেন না।” উনি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে পেপারটা দিলেন। আমি পেপারটা ভালো করে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলাম।পেপারের নাম আর তারিখটা দেখে উনাকে পেপারটা দিয়ে দেই। উনি আমাকে কি ভাবলেন আমি জানি না। কিছুক্ষন পর আমি পেপারটা কিনে পড়তে লাগলাম। পেপারে কয়েকজন মানুষের ছবি দিয়ে সোনাতলা গ্রাম নিয়ে লিখেছিল। ভালো করে যখন পড়লাম তখন জানতে পারলাম সোনাতলা সিলেটে অবস্থিত।এখানে একটা মসজিদ আছে সোনাতলা পুরাতন জামে মসজিদ। ১৯৪৮ সালে আবদুর রহমান নামে একজন এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। যাক সেসব কথা আমার পরে জানলেও হবে।কিন্তু এতোবছর ধরে যাকে আমি খুঁজছি হঠাৎ করে তাকে খুঁজে পাবো আমি আশা করিনি। তার সামনে যে আমাকে যেতে হবে। কত হিসেব বাকি ওর সাথে আমার।
তিনদিন পর আমি মুখে খোচা খোচা দাড়ি নিয়ে পৌছালাম সিলেটের সোনাতলা গ্রামে। আসছি সেই ফজরের সময়। আর এখন রাত নয়টার মত বাজে। একটা পিলারের সাথে বাধা বশিরের যখন হুশ আসলো আমি ওর দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে থাকলাম। সে আমাকে বললো “আমাকে বেধেছো কেন? কে তুমি?” আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “স্যার আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে শিখেছেন। আমার খুব ভালো লাগছে আপনার মুখে এমন শুদ্ধ ভাষা শুনে।তবে আপনাকে চিনলেও আপনার নামটা আমার জানা ছিল না।কিছুদিন আগে পেপারে আপনার ছবি দেখেছি। তারপর জানতে পেরেছি নাম। দশটা পরিবারকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন।তাদেরকে ব্যবসা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করে দিয়েছেন। এতো টাকা কোথায় পেলেন স্যার? যদিও সে সব হিসেব আমার দরকার নেই। কিন্তু আপনার আসল মতলব আমি জেনেছি।সামনে নির্বাচন। পাশ করার অনেক ইচ্ছা তাই না স্যার? বিশ্বাস করেন স্যার আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান হয়ে গিয়েছি। তাই তো আপনার সাথে দেখা করতে সেই রাঙ্গামাটি থেকে আসছি। এই পুরান বাড়িটা অনেক নিরব স্যার। রাঙ্গামাটি থেকে আসার সময় সব কিছু জেনে শুনে আসছি। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে।” বশির একটু অবাক হলো। মনে হয় রাঙ্গামাটি নাম শুনে। উনি চোখ বড় বড় করে বললেন “শুয়রের বাচ্চা আমার সাথে মজা করোস? চিনস আমারে?” আমি একটা হাসি দেই। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ওর কাছে গিয়ে চুলের মুঠোয় ধরে একটু জোড়েই বললাম “শুয়রের বাচ্চা তোরে যে আমি কত খুঁজছি বিশ্বাস কর।আমার থেকে তোরে আর ভালো কে চিনবে? তোর চেহারাটা যে আমি এখনো ভুলি নাইরে।তোর হাতের কামড়ের দাগটা দেখ এখনো আছে। মনে আছে সেদিনের কথা? ছেলেটার কান্নার শব্দের কথা? আমার মায়ের চিৎকারের কথা? রাঙ্গামাটির ভয়ানাক রাতের কথা? আমি জানতাম তুরে ধরা সহজ হবে না।মেয়ে মানুষের প্রতি তোর অনেক লোভ আছে সেটা আমি জেনেছি। আমি ভাবি নাই কাজটা এতো সহজ হয়ে যাবে। যেই তোরে একটা অচেনা নাম্বার দিয়ে ফোন দিলাম তুই চইলা আসলি।তুই না নির্বাচনে দাঁড়াবি? এতো বোকা হলে কি হয় হারামির বাচ্চা? এই একটা জিনিসই তোরে মরনের দিকে টাইনা আনছে।বল আগে তোর কোন জিনিসটা আমি কাটবো? এখানে আসার পর দেখলাম এই খানের কুকুর গুলা অনেক ক্ষুধার্ত।একদম শুকায় গেছে। ভাবছি তোরে মাইরা কুত্তারে খাওয়াবো। ভালো হবে না?” বশির একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “একবার ছাইড়া দেখ তোরে আমি কি করি।ভুল হয়ে গেছে তোরে সেদিন বাচাইয়া রাইখা।” আমি কিছু্ক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ছোট ছুরিটা নিয়ে “কুত্তার বাচ্চা এখনো মনে ভয় ঢুকে নাই?” এটা বলেই ওর হাতের বাহুতে ঘাই দিতে লাগলাম।আর ও চিৎকার দিতে লাগলো।চারটা ঘাই দেওয়ার পর বললাম “বান্দির বাচ্চা দেখ কেমন লাগে। আমার মা ও এমন কইরা চিৎকার করছিল।তোরা কেউ শুনিস নাই।” আমি ওর চোখে মুখে এখন ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। আমার কেন যেন এই ভয়ের ব্যাপারটা ভালো লাগছে। আমি বললাম “তোরে আমি মাফ করে দিতে পারি এক শর্তে যদি সাকের আলীর ঠিকানা দেস।” বশিরের চোখে পানি।কান্না করতে করতে আর ভীতু গলায় বললো “তুমি আমার বাপ লাগো আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ওর ঠিকানা দিব। ও এখানেই থাকে।” আমি মনে মনে ভাবি মানুষ মরনের ভয়ে কি না করতে পারে। আমি একটা হাসি দেই।তারপর বললাম “এখানেই থাকে? বেশ ভালো। এখানে আসতে বললে আসবে?” সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বলে “হ আসবো, ব্যবসার ধান্দার কথা বললে আসবো।” এটা বলেই ওর পকেট থেকে ফোনটা নিয়ে সাকের নাম দিয়ে সার্চ করতেই নাম্বার চলে আসে। আমি বললাম “এখানে আসতে বল। সত্য বলছি ও আসলে তোরে ছেড়ে দিব।তবে সাবধান।একা আসতে বলবি।”
ঠিক দেড় ঘন্টা পর সাকের আলীর দেখা পাই আমি। ও বশিরকে খুঁজছে। আমার ভিতরটা কেমন করে ওঠে ওরে দেখে। আমার ভাবতেও কেমন যেন লাগছে কিছুক্ষন আগে একটা পশু জবাই দিয়েছি আমি। আমার হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে। এসব জানোয়ারকে গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। আমি কাপা কাপা শরীর নিয়ে ওর পিছন থেকে বললাম “স্যার কি খুঁজেন?” সে চমকিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকায়। ফিরে তাকাতেই ওর পেট বরাবর ছুরিটা ঢুকিয়ে বলি “শুয়রের বাচ্চা এই সুযোগটার জন্যই তো আমি অপেক্ষা করছিলামরে।” সাথে সাথেই সে পরে যায়। আমি কান্নার সুরে বলি “স্যার ব্যাথা পাইছেন? কষ্ট লাগতেছে? ও স্যার।” এটা বলেই বশিরকে যে রশিটা দিয়ে বাধছিলাম সেটা দিয়ে বাধি।তারপর বললাম “স্যার আর একটু সময় আমার জন্য বেঁচে থাকেন। বশিরকে দিয়ে আমিই ফোন করে আপনাকে এখানে এনেছি। একটু বাম দিকে তাকান দেখেন জানোয়ারটা মইরা কেমনে ভ্যাটকাইয়া আছে।” সে যন্ত্রনায় কুকড়াতে কুকড়াতে আস্তে আস্তে বললো “কে তুই?” আমি হাসি দিয়ে বললাম “স্যার ১৯৯৮ সালে রাঙ্গামাটিতে একজন মহিলার ইজ্জত নষ্ট করে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন মনে আছে? আমি তার সন্তান স্যার।ও স্যার আপনার জিবটা বাহির করেন না। বিশ্বাস করেন স্যার এই এতোটা বছর আমি ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি। যতবার ঘুমিয়েছি ঠিক ততবার আমার ঘুমের মাঝে আপনার মুখ দিয়ে উচ্চারন করা মাগী শব্দটা আমাকে কি পরিমান যন্ত্রনা দিয়েছে বুঝাতে পারবো না।আমার মা কি মাগি ছিলরে শুয়রের বাচ্চা।” এটা বলেই ওর জিবটা টান দিয়ে কেটে দুভাগ করে ফেললাম।তারপর গলায় জোরে একটা টান দিয়ে মাটিতে বসে পরে আমি কাঁদতে লাগলাম।মানুষ মানুষকে খুন করলে অনুতপ্ত হয়।ভিতরে ভিতরে জ্বলে। কাউকে বুঝতে দেয় না। কিন্তু আমি তো মানুষ মারিনি। আমি মানুষ নামের দুইটা পশু মেরেছি। এই জন্য আমার খারাপ লাগছে না।একটুও না।
আকাশে যখন মেঘ করে তখন আমাদের মানুষের মনের ভিতরও এই মেঘের মত একটা ছাপ তৈরি হয়। সেই মেঘ জানান দেয় মানুষের মনের মাঝে জমে থাকা বিষণ্নতাকে।আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে সেই বৃষ্টির মাঝে কেউ কেউ তাদের মনের বিষণ্নতা ভাসিয়ে দেয়। আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখি। দেখি পাহাড়ের বুকে টুপটুপ করে পরা বৃষ্টিকে।সবুজ গাছগুলোকে এই বৃষ্টি কেমন করে ছুয়ে দেয়। চাচী আমাকে বলে “আদনান খেতে আয় বাবা।বিনিটাকেও ডাক দে।” আমি কিছু বলি না। বিনি আমার চাচাতো বোন।ছোট বেলায় মাঝে মাঝে বাবা মায়ের কথা মনে পড়লে যখন কাঁদতাম এই বিনি আমার চোখের পানি মুছে দিত। বলতো “ভাইয়া তুমি না বড়। বড়রা কি কাঁদে? ও ভাইয়া কাঁদবানা।” সামনে ও অনার্সে ভর্তি হবে।আমি বিনিকে ডাক দিতে গেলাম।
ঠিক ছয় মাস পর এক সকাল বেলা আমি বাড়ির উঠোনে বসে শরীরে রোদ মাখাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার সামনে এসে একজন দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি মিলি।আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম “আপনি?” সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বললো “হ্যাঁ আমি।এইভাবে আপনার সামনে হাজির হবো আশা করেননি তাইতো?” আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। আমার চুপ থাকা দেখে মিলি আবার বললো “আমি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে জয়েন করবো এই সপ্তাহ পর।পাশাপাশি পরের পর্যায়ের পড়াটা চালিয়ে যাবো। জয়েন করার আগে ভাবলাম আপনাদের এই শহরের সবুজ প্রকৃতি, প্রকৃতির বিশাল পাহাড়, পাহাড়ের সাথে লেগে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ, দ্বীপের নীল জলরাশিকে নিজের চোখের মাঝে বন্ধি করে যাই।আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি তো চিনি না।একা এসেছি কিন্তু।অবশ্য আপনাকে ভরশা করা যায়। কি যায় না?” আমার কি বলা উচিৎ জানি না।মিলি হঠাৎ করে এখানে এসে এমন কথা কেন বলছে? ও কি ওর নতুন ঠিকানাটা জানাতে আসছে?
তারপর দিন থেকেই রাঙ্গামাটির শুভলং, ঝুলন্ত ব্রিজ, বীর শ্রেষ্ট মুন্সী আব্দর রউফ এর সমাধি ঘুরে ঘুরে দেখাই।তিনটা দিন মিলিকে আমি ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখাতে থাকি। ঘুরে দেখাই এই রাঙ্গামাটির দুমলং পর্বত, যা অনেক বড় পাহাড়। এই পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে আকাশ ছোয়ার একটা নিছক আশা করা যায়। আশা করা যায় এই আকাশে উড়ে যাওয়া সাদা মেঘ ধরার। কিন্তু কিছুই ছোয়া যায় না। তবে একটা শান্তি শান্তি ভাব অনুভব করা যায়।এই অনুভবের মাঝে সে আমার জীবনের কথা জানতে চায়। আমি তাকে আমার জীবনের গল্প শোনাই।এই শোনার মাঝে তার চোখে জল দেখি।সে জল আড়াল করার চেষ্টা করে। আমি বললাম “আমাদের মানুষের মত প্রকৃতি অনেক গভীর। এই প্রকৃতির গন্ধটা যে নিজের ভিতরে মিশাতে পারবে সেই একজন খাটি মানুষ, মা বলতো। একটা কথা বলবো?” মিলি মাথা নাড়ে। আমি অনেক ইতস্তত হয়ে বললাম “আপনি এই রাঙ্গামাটিতে প্রকৃতির রুপ নিজের চোখে বন্ধি করার সাথে আর একটা কারণে আসছেন তা কি জানতে পারি?” সে আমার কথার ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো “আগামীকাল চলে যাবো। এই কয়েকটা দিন আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।আপনার কথা আমার সব সময় মনে থাকবে। আপনাকে আমি মাঝে মাঝে পাগল ভাবতাম আপনার উদ্ভট আচরনে।কিন্তু আপনি কেন এমন করতেন তা জানার জন্য কৌতূহল হলো।মানুষের জীবনটা হাওয়া বদলের মত। কি হয় কিছু বুঝা যায় না।” আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম “হয়তোবা ঠিক বলেছেন। আমার এক বন্ধু আছে। নাম রাসেল। সে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিল। বিয়ে করেছে। জানেন তার বউটা অনেক ভালো। একটু আগে বললেন না জীবনটা হাওয়া বদলের মত? আমার বন্ধুটাও আবার পড়ালেখা শুরু করেছে। উন্মুক্ত থেকে। এই যে ইচ্ছেটা হলো তার বউ এর জন্যই। আমি মনে করি জীবনে কেউ একজন থাকতে হয়। যার ছোয়ায় জীবনের হাওয়া বদলে যেতে পারে।আগামীমাসে আমি চাকরিতে জয়েন করবো। মূলত আমার বন্ধুই চাকরির সব কিছু ব্যবস্থা করেছে। এই জীবন যুদ্ধের মাঝে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বো তখন যদি মাঝে মাঝে আপনার কাজলে আঁকা চোখ দুটোকে একটুর জন্য দেখে আসি তখন কি আপনি রাগ করবেন? জানি আমার এমনটা বলা ঠিক হয়নি।” মিলি আমার কথা শুনে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে থাকলো তারপর একটা হাসি দিয়ে বললো “আপনি একটা আসলেই পাগল।” আমি তার হাসির অর্থ বুঝি না। শুধু বুঝেছি এই হাসির সাথে তার কাজলে আঁকা চোখ দুটোও হাসছে আর বলছে অনুমতি দিলাম…