আমি নতুন বিয়ে করেছি। বাসায় কেও জানে না। সত্যি বলছি, বিয়ে করার মতন কোনও পূর্ব পরিকল্পিত প্ল্যান ছিল না। আমার থেকে নববধূর বয়স বারো বছর কম। না বালিকা না তরুণী! আমার বেতন কম। বাসায় অসুস্থ মা আর ছোটবোন। নিজের পরিবার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি, এমন অবস্থায় কোনও পাগলও বিয়ের কথা ভাববে না। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, যৌবন থাকতেই বিয়ে করার কথা লেখা আছে, ক্যারিয়ার পরে তৈরি করা যাবে। অনেক মানুষের কথা শুনলে মনে হয়, স্ত্রীর মতন খাদক প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই। আমি এশার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
এশা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। মাত্র আঠারো বছর বয়সী কোনও মেয়ে এধরণের প্রশ্নে বিব্রতবোধ করে, তখন তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে, মায়া জন্মে। এশা মাথানিচু করে বলল, জি।
আমিও তোমাকে ভালোবাসি। চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। কাজী অফিসে গিয়ে সোজাসাপ্টা বিয়ে। বড় কোনও অনুষ্ঠান হবে না, বড়সড় ভালোবাসা থাকলেই হলো।
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। অবাক হয়ে বলল, আপনি কি পাগল? এতদিন ধরে ভেবে এসেছিলাম, আপনার মাথায় অনেক বুদ্ধি। এখন দ্যাখি আপনি আস্ত একটা পাগল। আপনি কি আপনার লেখা গল্পের সাথে বাস্তব জীবন গুলিয়ে ফেলেছেন?
আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইলে ডান হাত উঠাও, না করতে চাইলে বাম হাত উঠাও। সময় মাত্র আঠারো সেকেন্ড, তোমার বয়সের সাথে মিল রেখে বললাম।
এশা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এক, দুই, তিন… করে সময় কাউন্ট করছি। এশা বিড়বিড় করে বলছে, আপনি একটা পাগল। আমি তাতে কোনও জবাব করছি না, আমি বলেই চলছি, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো। এশা অন্যদিকে তাকিয়ে লজ্জায় ডান হাত উঠালো। সাথে সাথে তার হাত চেপে ধরে কাজী অফিসে নিয়ে গেলাম। মেয়েটা বোকার মতন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমিও বোকার মতন কাজ করে ফেলেছি। নতুন বউকে কি খাওয়াবো, কি পরাবো; জানি না। তবে তাকে ছাড়তে পারব না তা এতদিনে বুঝে গেছি।
বিয়ের পর সে তার বাসায় চলে গেল। এভাবে কেটে গেল সাতদিন। আমাদের বিয়ে হলো, অথচ ফুলশয্যা হলো না, দুজন দূরে দূরে, অথচ কি অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমরা এক মলাটের বই। মায়ের কাছে বিষয়টা গোপন না রেখে বলেই ফেললাম। মায়ের চক্ষু চড়কগাছ! ‘কি বলিস তুই? তোকে থাপড়ানো উচিত।’
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কখন মা আমাকে থাপ্পড় দিবেন। আমার চোখে পানি চলে আসছে, কেন তা জানি না। আমি কি অপরাধী? মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হারামজাদা! বিয়ে করে আকাম করেছিস, অথচ আমাদের জানালি না? ঘরে নাই টাকাপয়সা! ধারদেনা প্রতিমাসেই করা লাগে। এগুলো এখন বাদ। আমি রাগ করেছি। বউকে তুই কোথায় ফেলে আসলি? একটাবার মায়ের সামনে আনবি না? আমি কি ফেলে দিতাম? তুই বড় ছেলে। আমি জানি, আমার ছেলেটা সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কোনও অপরাধ করে না। এক্ষুনি বউমাকে বাসায় আনার ব্যবস্থা কর।
মা সাথে সাথে আমার ছোটবোন ইতিকে ডাকলেন। ঘরে নতুন বউ আসবে, আয়োজন তো করাই লাগে। আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। এত ভালোবাসা আমাকে ভাগ্যবান করে তুলেছে।
বাসা থেকে বেরুনোর সময় ইতির দিকে তাকিয়ে বললাম, কি রে, তোর চিঠিওয়ালা কেমন আছে?
ইতি ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল। ক্লাসের একটা ছেলের থেকে প্রথম চিঠি পেয়েছে, খুশীতে তা বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে। আমি বললাম, মাকে বলে দিই?
ইতি সরুচোখে বলল, ভালো হবে ভাইয়া! মেরে ফেলব কিন্তু।
এশাকে বাসায় আনা হলো। নববধূকে সবার পছন্দ হয়েছে। সবার বলতে মা আর ইতির। বাসায় সাজ-সাজ রব। গরীবের বিয়ের মতন অবস্থা। বনেদি পরিবারের মেয়ে হয়েও এশা সবকিছু দ্যাখে মুগ্ধ, অথচ তার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কথা ছিল। আমি তাকে নিয়ে রুমে গেলাম। সব পরিপাটি করে সাজানো। চারপাশে রঙিন সব কাগজ দেয়ালে। এশা মুগ্ধ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি গোসল সেরে এসে বললাম, কেমন লাগছে?
এশা ঠাণ্ডা গলায় বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না।
কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
আমরা কি বিয়ে করেই ফেলেছি?
হ্যাঁ, এখন থেকে আমি তোমার হাজব্যান্ড। এশা, আজ আমাদের প্রথম রাত। কি করা যায়?
আমি জানি না।
আমিও জানি না। কত সুন্দর, তাই না? আমরা কেওই কিছু জানি না! একজন বেশী জানলে আরেকজন কষ্ট পায়। দুজন সমান হলে হিশেব জমে ভালো।
আপনি আমার থেকে বেশী জানেন।
কেন? বয়সে বড় বলে? হা হা হা!
সারারাত ঘুমাতে পারি নি। ঘুমানোর চেষ্টা করামাত্রই এশা ফিসফিস করে বলছে, আমার ভয় লাগছে, আমি পানি খাবো। কেন ভয় পাচ্ছে, তা জানা হলো না। নতুন বাসা বলেই হয়তো। এশা বারবার পানি খাচ্ছে, আর জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম, এশা, এদিকে আসো।
এশা আসলো। কোনও ছেলের সাথে রাতে বিছানায় শোয়ার অভ্যাস নেই, তাই হাত-পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতন বসে আছে। আমি হেডফোন বের করলাম। শাদা রঙের হেডফোন, এশাই উপহার দিয়েছিল। কখনও পাশাপাশি বসে গান শোনা হয় নি। এশা হেডফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন গান শুনবেন?
হ্যাঁ, আমি একা শুনব না তুমি শুনবে।
আচ্ছা, হেডফোনের এক কানে লাল দাগ কেন?
এমনি দিয়েছি। আমি এমনি এমনি অনেক কাজ করি।
বিয়েটাও কি এমনি এমনি করেছেন?
করেছিলাম, কিন্তু তোমাকে এমনি এমনি ভালোবাসি নি। এখন চুপ থাকো, গান শুনো।
আমি হেডফোনের যে অংশে লাল দাগ রয়েছে, সেটা নিজের কানে লাগিয়ে বাকিটা এশাকে দিলাম। মুখ ফিরিয়ে বললাম, কি গান শুনবে?
আপনার যা ভালো লাগে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্যাখি এশা বসে আছে। আমাদের প্রথম সকাল। এশার চুল বাতাসে উড়ছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম, এশা, চা খাবে?
আপনি খাবেন? তাহলে আমিও খাবো। বানিয়ে আনব?
না। মাকে বলছি। তুমি বসে থাকো।
তাহলে খাবো না।
মা এশাকে কোনও কাজ করতে দিলেন না। যদিও বাসায় কোনও কাজও ছিল না। ইতি হোটেল থেকে খাবার এনেছে। বাসার চুলাটা নষ্ট। ঠিক করাতে হবে। এশা রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আগেই মা তার হাত ধরে ফেললেন। নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখবে, চুলো নষ্ট, এ তো বড় লজ্জার কথা!
এশাকে নিয়ে এই বাসায় বেশীদিন থাকা যাবে না। আরও বড় বাসা নিতে হবে। এশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে বললেই তো আমি আরেকটা হেডফোন কিনে দিতাম।
কেন? একটা তো আছেই।
ছাঁই আছে। একটা কান নষ্ট, সেখানে লাল দাগ দিয়ে রেখেছেন। সারারাত কেবল আমিই গান শুনলাম।
আমিও যে তোমাকেই শুনলাম।
এসব কথা বলবেন না। আমি এখন আর নতুন বউ নেই, আমি এখন পুরান বউ। একদিন হয়ে গেছে না?
এভাবে কথা বলছো কেন?
আমি এরকমই, এভাবেই আমি কথা শিখেছি, এবং এভাবেই কথা বলি।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভুল ভাঙিয়ে সে বলল, কনফিউজড হয়ে গেছেন? ইচ্ছে করে এমন করছি। কষ্ট পেলে মাফ করে দিবেন।
আমি কষ্ট পাই নি। ভালো লাগছে, তুমি তো কথাই বলো না ঠিকঠাক। বাইরে বের হবে?
হবো।
আমি এশাকে নিয়ে বাইরে বের হলাম। এশা আমার মাসিক সেলারি কত জানতে চাইলো। ঢোক গিলে বললাম, দশ হাজার। সে অবাক হলো না। কাঁচা বয়স, পরে হয়তো বুঝবে। ‘এশা!’
জি।
বেতন কম, মানুষ বেশী। অংক করে বের করব, প্রতিদিন কত খরচ করতে হবে। ঠিক আছে?
না, ঠিক নেই। অংক টংক করা লাগবে না, যখন যেটা খেতে ইচ্ছে হবে, সেটাই খাবো। মাসের শেষে উপোস থাকব। আপনার তো সমস্যা নেই, আপনি হচ্ছেন, অবাস্তববাদী মানুষ। আমাদের জীবনে কোনও বাস্তবতা নেই, সবই অবাস্তবতা।
খাঁটি কথা বলেছো।
এশা! একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?
না দিবো না। শুধু প্রশ্ন করুন।
উত্তর দিবে না কেন?
এখন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। আপনি প্রশ্ন করুন। প্রশ্ন শুনতে ইচ্ছে করছে।
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি প্রশ্ন বলব না।
আজ বিয়ের সাত বছর হতে চলল। আর্থিক অবস্থান আগের থেকে ফিরেছে, সুদিন এসেছে। আমার কাছে কখনও মনে হয় নি দুর্দিনে আছি। এশা সবসময়ই পাশে ছিল। অভাবের আরেক নাম এশা, সুদিনের আরেক নামও এশা৷ সেই শাদা হেডফোনটা এখনও আছে, এখনও আছে সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া চুলোটা। কত কি স্মৃতির মায়ায় সেগুলো জড়িয়ে আছে। সেই প্রথম ফুলশয্যার রাতের বিছানা চাদরটাও আছে আজোও, তবে তা ফুঁটো। মা এখন প্যারালাইজড, এশার ভালোবাসার থেরাপিতে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করেছেন সম্পূর্ণটা। ইতির বিয়ে হয়েছে সেই ছেলেটার সাথে, চিঠিওয়ালার সাথে। জীবন বদলে যাচ্ছে, না আমরাই বদলে দিচ্ছি, জানি না।